আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-৩০+৩১

0
727

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_৩০

নীল রঙের একটা শাড়ি পড়ে অপেক্ষিত মন নিয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে তুলি। রৌদ্রজ্বল দিন। বাতাসের ছিটেফোঁটাও নেই। গাছের পাতাগুলো কেমন ঝিম ধরে আছে,যেনো এক ফোঁটা জল পেলেই সজীব হয়ে উঠবে খুশিতে।বাগানের ফুলগুলো জ্বলসে যাচ্ছে রোদের তেজে। বড্ড মায়া হচ্ছে তুলির ফুল গুলোর জন্য। হা-হুতাশ করে নজর ফেলল তুলি মোবাইলের স্ক্রিনে। আদ্র কে গুনে গুনে পঁচিশ বার কল দিয়েছে অথচ একটা কলও ব্যাক করে নি আদ্র। ভিতর টা অশান্তিতে ছটপট করছে। মনের সুপ্ত কোণে অজানা একটা ভয় ঝেকে ধরেছে। যতক্ষণ না আদ্র কে এক পলক দেখার সাধ্যি হবে ততক্ষণ অব্দি কলিজা টা শান্ত হবে না তার। বুকে বার কয়েক হাত দিয়ে নিজের হৃদস্পন্দন মেপে নিয়েছে তুলি। কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না। বরং পাল্লা দিয়ে ডাক্তার সাহেবের প্রতিক্ষায় বেড়েই চলেছে। চাতক পাখির ন্যায় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গেইটের দিকে, এই বুঝি সাময়িক অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে পদার্পণ করবে আদ্র।

দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করল আমরিন। চারদিকে চোখ বুলাতেই দৃষ্টি গিয়ে স্থির হলো বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা তুলির দিক। দ্রুত গতিতে হেঁটে এসে বললো,

” কি রেডি হয়ে রৌদ্রে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?ঘেমে যাচ্ছিস তো।”

” তোর ভাইয়া ফোন ধরছে না কেন আমরিন?কখন আসবেন ওনি?”

গেইটের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে আওড়ালো তুলি। ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে দিল আমরিন। রসাত্মক স্বরে বলে উঠল,

” বাহ!আমার ভাইয়ার সাথে একদিন থেকেই ভালোবাসা দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেয়ে গেল বুঝি?”

” দেখবো তো নিবিড় ভাইয়া কে ছাড়া থাকতে পারিস কিনা!এখনই তো লাফালাফি করছিস ওনার কাছে যাওয়ার জন্য। আমি তোর মনের কথা বুঝি তো। ভাবী হয়ে যদি ননদের মনের কথা না বুঝি তাহলে ভাবী ডাকের কলঙ্ক হোক।”

তুলির কথা শুনে গা দুলিয়ে হেসে উঠল আমরিন। সেই সাথে তুলিও হেসে উঠল। দুই বান্ধবীর কথার মাঝে কর্ণে এলো গাড়ির হর্ণের শব্দ। তাকিয়ে দেখল আদ্র এসেছে। ক্লান্ত মনে হচ্ছে তাকে। ফর্সা মুখশ্রী টা রোদের প্রখর উত্তাপে রক্তিম লাল। আদ্র মাথা তুলে বেলকনির দিক তাকাতেই তুলি ঘাড় ঘুরিয়ে নিল। আমরিন তাড়া দিয়ে বললো,

” আমি যাচ্ছি তুলি। ব্যাগ গুছিয়ে নে। বিকালের দিকে তো বের হবো সবাই। ভাইয়াও এসে গেছে। আমি যাই।”

আমরিন চলে যেতেই তুলি রুমে এলো। হন্তদন্ত হয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমে আসল আদ্র। শার্টের বোতাম খুলে গা থেকে ছুঁড়ে মারল বিছানায়। ঘর্মাক্ত, উম্মুক্ত দেহ এলিয়ে দিল বিছানার মাঝ বরাবর। আকস্মিক এহেন দৃশ্য দেখে ভরকে গেল তুলি। আদ্রর কাছে বসে কম্পিত গলায় বললো,

” আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?”

কোনো রূপ জবাব দিল না আদ্র। তুলি কে টেনে বিছানায় ফেলে দিয়ে গলায় মুখ ডুবিয়ে দিল। আকস্মিকতায় অজস্র শিহরণ বয়ে গেল তুলির সর্বাঙ্গে। আদ্রর দেহের উত্তাপে তুলির দেহ হতে ঘাম ঝরতে লাগল ক্রমাগত। মন বলছে কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু পুনরায় জিজ্ঞেস করার সাহস জোগাতে পারল না। গলা থেকে মুখ উঠিয়ে গভীর দৃষ্টিতে তুলির সারা মুখে নয়ন বুলালো আদ্র। গালে শুকনো ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। হতভম্ব তুলি। উঠতে নিলে আদ্র হাত টেনে বুকের উপর নিয়ে আসল। হতাশার সুরে বললো,

” আজকের ওটি টা সফল হয় নি তুলি। পেশেন্ট টা মারা গেছে। তার পরিবার খুব দেরি করে ফেলেছিল তাকে হসপিটালে আনতে। অকালে মারা গেছে এটা বলবো না। ছেলেটার আয়ুকাল ফুরিয়ে গিয়েছিল তাই তো ত্যাগ করেছে এই পৃথিবীর মায়া। জানো ছেলেটা কে অজ্ঞান করার আগে কি বলেছিল?”

তুলি অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আদ্র হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,

” আমার ওয়াইফ কে বলবেন আমি ওকে খুব ভালোবাসি। ”

অন্তরস্থলে ভূমিকম্পন ন্যায় কম্পন হলো তুলির। তুলির হাতে গভীর ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে আদ্র ফের বলে উঠল,

” ছেলেটার ওয়াইফ কে পায়নি বলার জন্য। ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে জানলাম কোনো একটা বিষয় নিয়ে অভিমান করে চলে গেছে মেয়েটা। ফোন দেওয়া হয়েছিল ছেলেটার খবর জানানোর জন্য ধরে নি। অভিমান কি এতোটাই দীর্ঘ হওয়া উচিত যা প্রিয় মানুষ কে হারিয়ে যেতেও বাঁধা দিবে না?”

তুলি নিরুত্তর তাকিয়ে রইল আদ্রর মুখের দিকে। কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। হয়তো ছেলেটার জন্য খারাপ লাগছে, আফসোস হচ্ছে।

” তুলা!”

গাঢ় স্বরে ডাকল আদ্র। তুলি সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া দিল।

” জ্বি।”

” তোমার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার আগে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিয়ে যেও। জানি মৃত্যু অনিবার্য। তবুও আমি তোমাকে ছাড়া আমাকে মানতে পারব না তুলি।”

তুলি বিমূঢ়, বাক্যহারা হয়ে রইল।অচেনা, অজানা মানুষের জন্য হৃদয় টা ব্যথিত হয়ে উঠল। মেয়েটা যখন জানবে অভিমানের পাল্লা ভারী করে দিয়ে চিরতরে বিদায় জানিয়েছে প্রিয় মানুষ টা,তখন কেমন অনুভূত হবে তার?তুলি আর ভাবতে পারলো না। আদ্রর কথাগুলো মনের ভয় টা বাড়িয়ে দিয়েছে। অকারণে কেন এতো ভয় লাগে?চাওয়ার চেয়ে অতিরিক্ত পেয়ে যাচ্ছে বলেই কি!আদ্রর বুকে মাথা রেখে সাহস করে বললো,

” ডাক্তার সাহেব আমি আপনাকে ভালো টালো বাসি না।”

নিমিষেই আদ্রর চোখের মণি লাল হয়ে গেল। তুলির কোমর আঁকড়ে ধরে উঁচিয়ে তুলতেই ঘাবড়ে গেল তুলি। পরক্ষণেই রক্তিম দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলে উঠল,

” ভালো টালো কে বাসে?শব্দটা আজকাল কেমন সস্তা সস্তা লাগে?অহরহ উচ্চারণ করে বসে মানুষ। তাই আমি ভালো টালো বলা ছেড়ে দিয়েছি। বুঝলেন ডাক্তার সাহেব? আমি তো আপনাকে অস্তিত্বে ধারণ করে নিশ্চিন্তে শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছি। ”

তীব্র গরমের মাঝেও হিম করা এক বাতাস বয়ে গেল আদ্রর হৃদপিণ্ডে। এসি অফ। তুলির রিনঝিন স্বরে উচ্চারিত বাক্য গুলোই বুঝি আদ্রর বক্ষস্থল শীতল করার জন্য দায়ী। ঘর্মাক্ত শরীরেই তুলি কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল বুকে। লহু স্বরে বললো,

” ঘামে লেপ্টে দেওয়ার জন্য স্যরি। আরেকবার গোসল করে নিও। এই মুহুর্তে বুকে না নিলে শান্তি পাচ্ছিলাম না।”
________

পুকুর পাড়ের বড় আম গাছ টার ডালে দু’টো হলুদ পাখি গা ঘেষে বসে আছে। নীল আকাশে লাল লালিমার অবতরণে প্রকৃতিতে আধার তার সূত্রপাতের জানান দিচ্ছে। বহু মাস পর নিজের মাতৃভূমি তে,চিরচেনা গ্রামে পা রেখে তুলির বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠছে। এই তো বিকেল বেলা আড্ডায় মত্ত থাকা সেই পুকুর ঘাট। লোকমুখে হাজার বার শুনেছে হলুদ পাখি নাকি মেহমান আগমনের জানান দেয়। তুলির কাছে আজ তা সত্য বলে মনে হলো। এইতো একটু আগেই ওরা আসল ঢাকা থেকে। আসতেই তুলি সবাইকে রেখে ছুটে এসেছে পুকুর পাড়ে। এতো শান্তি কেন বাতাসে? নিঃশ্বাস টা খুবই শান্তিপূর্ণ।

ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে তুলি কে রুমে না পেয়ে হতভম্ব আদ্র। পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে বাহিরে উঠোনে আসতেই অন্তু দাঁত কেলিয়ে বললো,

” বাহ্! বিয়ের পর পাঞ্জাবি পড়া শুরু করে দিয়েছিস। আজ বিয়ে হয় না বলে ঘনঘন পাঞ্জাবি পড়তে পারি না।”

মোড়া পেতে উঠোনে বসে আছে সবাই। একটু আগেই সবাই তুলিদের বাড়িতে এসেছে সবাই। বিয়ের আগেই প্ল্যান ছিল অনুষ্ঠানের পরদিন সবাই কুমিল্লা আসবে। আদ্রর নিকট মানুষ মানেই ওর বন্ধুমহল। ওদের ছাড়া শুধু আদ্র নয় তুলি নিজেও শূন্য শূন্য অনুভব করে। তাই সবাইকে রাজি করিয়ে নিয়ে এসেছে। আসতে না আসতেই ওরা তুলির বাড়ির প্রত্যেক টা মানুষের সাথে মিশে গেছে। মিশবেই না কেন?ওরা তো শুধু বন্ধু না,আদ্রর কলিজার টুকরোও। আদ্র অন্তুর কথা কে ব্যঙ্গ করে নিচু স্বরে বললো,

” বিয়ের পর ঘন ঘন পাঞ্জাবি পড়লে বউয়ের আদর পাওয়া যায় ঘন ঘন। বুঝলি অন্তু?সিংগেল থাকিস না। সময় থাকতে মিংগেল হয়ে যা।”

” ভয় লাগে।”

” ভয় নিয়ে বসে থাক। অন্য কেউ নিয়ে যাক তোর গজদন্তিনী। আমার কি আমি তো বিয়ে করে ফেলেছি। ছেলে নামের কলঙ্ক। ভীতু একটা।”

ভাবলেশহীন ভাবে আদ্র চলে গেল। অন্তু পায়েলের দিকে একবার তাকিয়ে দেখল পায়েল চোখ ছোট ছোট করে তার পানে চেয়ে। গায়ের শার্ট টা একটু ফাক করে বুকে থু থু দিল ঝটপট। বিড়বিড় করল, ” বাঘিনী একটা।”

রিমি সাগরের পিছু পিছু রুমে এলো। দু’জন কে একসাথে একই রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে। প্ল্যান টা তুলির। পায়েলের কাছ থেকে জেনেছিল দু’জন স্বামী,স্ত্রী। কোনো একটা বিষয় নিয়ে বিশাল দেয়াল তুলে দিয়েছে দু’জন নিজেদের মধ্যে। রিমি কে নিজের সাথে এক রুমে দেখে মেজাজ খিঁচে আসতে লাগল সাগরের। ইচ্ছে করছে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে। কিন্তু এটা খুবই বেমানান। বেড়াতে এসে বন্ধুর শশুড় বাড়িতে কোনো ধরনের সিন ক্রিয়েট করতে চায় না সে। কিন্তু যতবারই রিমি কে নিজের অতি কাছে অনুভব করে সেই বিবর্ণ মুহুর্ত টা মনে পড়ে যায়। তুলি কে মনে মনে শুকরিয়া জানালো রিমি। বাহিরে ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না সাগরের সাথে,সুযোগ টুকুও দেয় না ছেলেটা। কতগুলো মাস ধরে চেষ্টা করেও ছেলেটার মন গলাতে অক্ষম। আজ বদ্ধ রুমে নিজেদের মধ্যকার দেয়াল ভাঙতে চায় রিমি ভালোবাসা দিয়ে। দরজা আটকে সাগরের হাত টা স্পর্শ করে কিছু বলবে তার পূর্বে রিমির গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। থরথর করে কাপতে লাগল চোয়াল। হাত মুঠো করে রিমির দিকে তাকিয়ে বললো,

” তুই কোন সাহসে স্পর্শ করেছিস আমায়?”

রক্তজবার মতো টকটকে লাল হয়ে আছে রিমির গাল টা। চক্ষুদ্বয় জলে টুইটুম্বুর। হৃদস্পন্দন যেন থমকে গেছে ক্ষণিকের জন্য। সাগর গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখে তীব্র রাগের ছাপ। রিমি অশ্রু সিক্ত কন্ঠে তেজ ঢেলে বলে উঠল,

” বউয়ের অধিকারে ছুঁয়েছি আমি তোকে। তার জন্য আমার সাহসের প্রয়োজন নেই। ”

নিমিষেই তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটলো সাগরের ঠোঁটে। রিমির দিকে অনেকখানি এগিয়ে গিয়ে হালকা ঝুঁকে বললো,

” মনে আছে সেই রাতের কথা,যেই রাতে আমিও ছুঁয়েছিলাম তোকে স্বামীর অধিকারে?”

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_৩১

” বিয়ের রাতে তোকে স্পর্শ করেছিলাম বলে তুই আমাকে চরিত্রহীন উপাধি দিয়েছিলি। অবাক করা ব্যাপার নিজের বউয়ের গালে ভালোবেসে হাত রাখার কারণে চরিত্রহীনের খাতায় নাম লিখিয়েছিলাম আমি। বিয়ের মাধ্যমে নাকি পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ দুটো ছেলেমেয়ে। স্বামীর পুরো হক থাকে বউ কে ছোঁয়ার। কিন্তু আমাকেই দেখ গভীরভাবে না ছুঁয়েও বউয়ের কাছে আমি চরিত্রহীন। এতগুলো বছর ধরে তোকে ভালোবাসার অপরাধে আমি চরিত্রহীন রিমি। ”

কথাগুলো বলে ঠোঁট কামড়ে হাসল সাগর। কন্ঠে বিষাদের রেশ ছিল স্পষ্ট। রক্তিম আঁখি যুগল ছলছল করছে। পলক ফেললেই কার্নিশ ঘেঁষে জল গড়িয়ে পড়বে। নিজের দুর্বলতা দেখাতে রাজি নয় সাগর। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার প্রতি দুর্বলতার কারণেই তো এতগুলো বছর ধরে প্রতিনিয়ত দহন হচ্ছে হৃদপিন্ডে। মুখ ফিরিয়ে নিল তৎক্ষনাৎ। বিনা সময় ব্যতীত ওয়াশরুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিল। সেদিকে তাকিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে কান্নায় ভেঙে পড়ল রিমি। বদ্ধ রুমে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। কান্নার শব্দ দেয়াল ভেদ করে সাগরের কর্ণে এসে বিঁধছে। চৌচির হয়ে যাচ্ছে অন্তর।

হঠাৎ করেই পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়ে যায় রিমি সাগরের। সকাল অব্দিও বিয়ে সম্পর্কে অবগত ছিল না রিমি। ইন্টার থেকেই সাগরের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। মেডিক্যাল লাইফ শেষ হতে না হতেই প্রিয় বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্বামী -স্ত্রী তে পরিণত হবে তা কল্পনাতীত ছিল। প্রথমে বিয়ের জন্য নাকচ করলেও আদ্র,পায়েল,নিবিড় সবার কথায় ভেবে দেখল। আজ পর্যন্ত কাউকে ভালোবাসে নি,তাহলে সাগরের মতো ভালো ছেলে কে জীবনসঙ্গী হিসেবে রিজেক্ট করার প্রশ্নই উঠে না। তবুও মনের মধ্যে কোথাও একটা বাঁধা দিচ্ছিল। হুট করে বিয়েটা মানতে কষ্ট হচ্ছিল। বিয়ের রাতে সাগর জানায় কলেজ লাইফ থেকেই ভালোবাসতো রিমি কে। অপ্রকাশিত রেখে সর্বদা চেষ্টা করেছে রিমি কে বউ হিসেবে পাওয়ার। বাসর রাতে সাগরের ব্যক্ত করা অনুভূতি মেনে নিতে পারে নি রিমি। এতো কাল পছন্দ করে, না বলে বন্ধুত্বের ভ্রমে রেখে বিয়ে টা ধোঁকা ঠেকল রিমির কাছে। বিষাক্ত অনুভূতিতে ছেয়ে গেল মন,অন্তর। গালে রাখা সাগরের হাত টা ছিটকে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বললো,

” চরিত্রহীন। আমার অনুমতি ব্যতীত কিভাবে স্পর্শ করলি তুই আমাকে?আমার কাছে আসবি না একদম। খুন করে ফেলবো তোকে। ”

চরিত্রহীন!হ্যাঁ এই শব্দটাই কেবল সাগরের হৃদয় রক্তাক্ত করে দিয়েছিল সেই মুহুর্তে। লন্ড ভন্ড করে দিয়েছিল বছরের পর বছর জমিয়ে রাখা ভালোবাসা। রিমির বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সেই মুহুর্তে। অভিমান সত্যিই কখনও কখনও ভালোবাসা কে হারিয়ে দেয়। নয়তো কেন সাগর অভিমান টা কেই বড় করে দেখল!রিমি বিয়ের কয়েকদিন পরেই বুঝতে পেরেছিল তার রাগ টা ছিল অযৌক্তিক। কিন্তু মানুষ রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বসে। সাগরের মা অনেকবার নিতে চাইলেও যায় নি রিমি। তার তীব্র আশা সাগর সব ভুলে আবারও ভালোবাসা দিয়ে আগলে নিবে তাকে। বধূবেশে শশুড় বাড়িতে পা রাখবে স্বামীর ভরসার হাত টা আঁকড়ে ধরে।

দরজা খোলার শব্দে রিমি মুখ তুলে তাকালো। মেয়েটার মুখ একদম লাল হয়ে আছে। চোখ গুলো ফুলে আছে কান্নার প্রকটে। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল সাগরের। এমনিতেই মেয়েটার বেহায়াপনায় মনটা আজকাল গলে যাচ্ছে, দাবিয়ে রাখা প্রণয় শিখা বার বার জ্বলে উঠছে। পরক্ষণেই বিয়ের প্রথম রাতের দৃশ্য মনে পড়লেই দেয়াল তুলে দেয় কষ্ট,অভিমানগুলো। এক পলক চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। নয়তো আজ আবারও চরিত্রহীন তকমা লাগিয়ে বসবে সে এই মেয়েটার কারণে। শার্ট ঠিক করে রিমির পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে বলিষ্ঠ হাত টা রিমির নরম হাতের দুর্বল বাঁধনে বাঁধা পড়ল। অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই রিমি হামলে পড়ল বুকে।

” সাগর আমার সহ্য হচ্ছে না আর তোর অভিমান। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। একটু একটু করে না মেরে একেবারে মেরে ফেল প্লিজ। নয়তো একটু ভালোবাসা দে। প্রমিজ করছি কোনোদিনও ফিরিয়ে দিব না তোকে। কয়েকটা মাসে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। জানি তোর বছর খানেকের ভালোবাসার কাছে আমার ভালোবাসা টা খুবই নগন্য তবুও আমায় ফিরিয়ে দিস না। আমায় আপন করে নে। একটু সুযোগ দে। তোর কষ্ট ভরা দৃষ্টি আমার ভিতর টা ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে। এতো কষ্ট কেন হচ্ছে সাগর?”

কাঁদতে কাঁদতে সাগরের পড়নের শার্ট টা খামচে ধরেছে রিমি। হাত উঠিয়ে রিমি কে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও গুটিয়ে নিল সাগর। নিজের স্ত্রীর ভালোবাসার জন্য এতো আকুলতা তার হৃদয় দ্বিখণ্ডিত করতে লাগল অনবরত। রিমি কাতর নয়নে সাগরের মুখ পানে চাইল। থমকাল সাগর। দৃষ্টি টা তার মনে জমানো এতো মাসের রাগ ক্ষোভ, অভিমান, কষ্ট সব বুলিয়ে দিল। এতোকাল কোথায় ছিল এই দৃষ্টি!রিমি কে উপেক্ষা করে চলছিল বলেই কি চোখে বিঁধে নি?আফসোস হলো সাগরের। কর্ণধার হলো রিমির আবেদনময়ী স্বর।

” প্রত্যেক টা মানুষ মনের মাঝে অফুরন্ত ভালোবাসা লুকিয়ে রাখে। তোমার অফুরন্ত ভালোবাসা থেকে আমায় একটু দিলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে সাগর?”

সাগর নির্বাক,নিস্তেজ। ভিতরে তোলপাড় হচ্ছে। তীব্র তোলপাড়! রিমি কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মিশিয়ে নিল। এই মেয়ে কে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্যি আর তার নেই। ক্ষীণ স্বরে বললো,

” আজ তোকে আপন করে নিলে আমি সত্যিই চরিত্রহীন হয়ে যাবো রে রিমি৷ মেনে নিতে পারবি,,”

সাগরের বাক্য টা শেষ করার তর সইলো না রিমির। গলা জড়িয়ে চুমু একে দিল সাগরের বুকে। দ্রুত গতিতে আওড়ালো,

” পারবো,পারবো,পারবো।”

সাগর গভীর নয়নে চেয়ে রিমি কে কোলে তুলে বিছানায় শুয়ে দিল। সম্পূর্ণ ভর রিমির উপর দিয়ে গলায় মুখ গুঁজে আলতো চুমু খেল। আবেশে চোখ নির্মলিত হয়ে এলো রিমির। সাগরের হাত টা আঁকড়ে ধরতেই কানের পাতায় চুমু খেয়ে মৃদু হাসল সাগর। কন্ঠে দুষ্টমির রেশ ধরে ফিসফিস করে বলে উঠল,

” তুই তো ভারী নির্লজ্জ মেয়ে রিমি।”
________

ক্ষেতের লাইল ধরে হেঁটে চলছে সবাই। কিন্তু হাঁটতে গিয়ে বার বার বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে পায়েল, রিমি। কখনো ক্ষেতের লাইল দিয়ে হাঁটা হয় নি তাদের তাও শাড়ি পড়ে। গ্রামে আগেও গিয়েছে তবে সেটা মেডিক্যাল ক্যাম্পেইনের জন্য। জমিতে পানি দেওয়ার ফলে লাইল ভিজে কাঁদা কাঁদা হয়ে আছে। সকাল সকাল হাঁটতে বের হওয়ার স্পৃহা জেগেছিল তুলির মনে। নিজের মন বাসনা পূর্ণ করতে সাথে নিয়ে এসেছে সবাইকে। নিজেদের গ্রাম টা ঘুরে দেখাতে চায় তুলি। পায়েল,রিমি,আমরিন,ইনশিতার কাছে আহ্লাদী স্বরে অনুরোধ করেছে শাড়ি পড়ার। এই মায়াবিনীর অনুরোধ ফেলে দেওয়ার মতো মন যে কারো নেই।

সামনে কাঁদা চোখে পড়তেই পা থেকে জুতা খুলে হাতে তুলে নিল তুলি। এই পিচ্ছিল মাটিতে শাড়ি পড়ে জুতা পড়ে হাঁটা সম্ভব নয়। পরে দেখা যাবে চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে ধান ক্ষেতের মাঝে। অগ্রিম বিপদের কথা ভেবে এক হাতে শাড়ি ধরে অন্য হাতে জুতা জোড়া নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,

” আপু, আমরিন সবাই জুতা খুলে নাও। শাড়ি আকড়ে ধরো। সামনে কাঁদা অনেক।”

তুলির কথা কর্ণপাত হতেই সামনে এগিয়ে যাওয়া আদ্র,অন্তু সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছু ফিরতেই আদ্রর চোখ নিবদ্ধ হলো এক হাতে শাড়ি,অন্যহাতে বেসামাল হয়ে হেঁটে আসা তুলি কে। দেখে উপলব্ধি করা সহজ মেয়েটার দু হাত ব্যস্ত রাখায় হাঁটতে সুবিধা হচ্ছে না। কেমন হেলে দুলে হেঁটে আসছে। প্যান্ট ফোল্ড করে এগিয়ে এলো আদ্র। সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে তুলির হাত থেকে জুতা নিজের হাতে নিয়ে নিল। বিরক্তিকর স্বরে বলে উঠল,

” বলেছিলাম জুতা বাড়িতে রেখে আসতে। বাট অলওয়েজ মেয়েরা ওভার পাকনা। ”

আদ্রের তিক্ত বাক্যে ধ্যান নেই তুলির। তার সকল ধ্যান মগ্ন আদ্রের পায়ের দিকে। প্যান্ট ফোল্ড করার জন্য পায়ের অনেকাংশ দেখা যাচ্ছে। কি ফর্সা পা!ফর্সা পায়ে লোমশ গুলো দেখে তুলির মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল। ইচ্ছে করল ছুঁয়ে দিতে। কাঁদা লেগে আছে পায়ে। তুলির বুক টা ছ্যাঁত করে উঠল। কেন লাগল এতো সুন্দর পায়ে কাঁদা। বিড়বিড় করল, ” আমার শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দিতে পারতাম যদি অসভ্য,লুচু কাঁদা কে!”

আমরিনের হাত থেকেও জুতা নিয়ে নিল আদ্র। ইনশিতার হাত থেকে নিতে নিলে রনক এগিয়ে এসে বললো,

” আমি নিতে পারব ভাইয়া। ”

কোনো রূপ প্রতিক্রিয়া করল না আদ্র। তুলি ও আমরিনের জুতা নিয়ে সামনে চলে গেল। প্রচন্ড অবাক হল তুলি। একটা মানুষ কত পারফেক্ট হতে পারে তুলির জানা নেই। তবে তুলির দেখা সবচেয়ে পারফেক্ট মানুষ টা তার ডাক্তার সাহেব। বোনদের প্রতিও ভালোবাসার কোনো ত্রুটি রাখে না। সাগর রিমির কাছ থেকে জুতা নিতে দেখে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকালো সবাই। এ যেনো স্বপ্ন সবার নিকট। অতঃপর রিমির লজ্জা রাঙা মুখ প্রমাণ করে দিল ইহা স্বপ্ন নয়। সত্যি! সাগর হাত বাড়িয়ে পায়েলের কাছ থেকে জুতা নিবে তার আগেই সবাইকে পাশ কাটিয়ে হাজির হলো অন্তু। আমতা আমতা করে বললো,

” আমার তো হাত খালি। আমি নিবো। ”

অন্তুর কথা শুনে রিমি কে নিয়ে অভিমুখে এগিয়ে গেল সাগর। পিছন থেকে উচ্চ শব্দ কর্ণে আসতেই দ্রুত বেগে ফিরে তাকাল। যা দেখল তাতে সবার মাথায় হাত।

#চলবে,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)