আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-৪০+৪১

0
653

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব__৪০

থমথমে নিরবতা এক মুহুর্তে গ্রাস করে নিয়েছে পুরো রুমটাকে। পায়েলের বাবা চোখ থেকে চশমা টা খুলে টেবিলে রাখলেন। খানিকটা মৌন হয়ে রইলেন তিনি। বিছানায় বসে পাশের টি টেবিল থেকে পানির গ্লাস টা উঠিয়ে নিলেন হাতে। থেমে থেমে তিন ঢোকে সম্পন্ন করল গ্লাসের সবটুকু জল। উনার মুখ দেখে তুলির মনে হচ্ছে উনি যেন আগে থেকেই জানত সবটা। চমকিত হওয়ার বিন্দু মাত্র আভাস নেই পুরো চেহারায়। ভঙ্গিমা একদম সহজ, সরল। সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। ধীর কন্ঠে বললেন,

” আমি অভিক কে ডেকে পাঠিয়েছি। মেয়ের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে দিতে পারব না আমি। পায়েল মুখ ফুটে বলে নি কিন্তু আমি জানি ও অন্তু কে ভালোবাসে।”

অতিশয় বিস্ময় নিয়ে হতবাক দৃষ্টিতে তাকালো তুলি। পাশে থাকা আদ্রর হাত টা চেপে ধরল শক্ত করে। আদ্র যে অবাক হয় নি তা না, অবাক সে ও হয়েছে। পায়েলের বাবা ফের বলতে শুরু করলেন,

” একটু আগে ছাদে গিয়েছিলাম আমি। যেতেই চোখে পড়ল আমার মেয়ে বড় তৃপ্তি করে অন্তুর কাঁধে ঘুমোচ্ছে। তখন আর এক পা ও আগানোর সাহস হয় নি আমার। দরজায় দাঁড়িয়ে ঠিক সেই মুহুর্তে উপলব্ধি করতে পেরেছি এই বিয়ে হলে কখনও খুশি হবে না আমার মেয়ে। বাবা হিসেবে আমি মেয়ের প্রতি খুবই গর্বিত। আমি জানি ও আমার মান রাখতে রাজি হয়েছে এই বিয়েতে। যার জন্য এতো বছর করে গেলাম, বিনিময়ে কেবল এক টুকরো হাসি দেখলেই পরাণ টা জুড়িয়ে যায় আমার জেনে বুঝে কি করে কষ্টের দিকে ঠেলে দিব তাকে? আমি জানি ব্যাপার টা খুবই জঘন্য হবে,হয়তো অভিকের পরিবার আমাদের হেয় করবে তবুও মেয়ের খুশি কোনো ক্রমেই ছিনিয়ে নিব না আমি। অন্তুর পরিবার কে বুঝাতে পারবে আদ্র?আমি এখনই যেতাম তোমার কাছে। ”

ম্লান হাসল আদ্র। নম্র কন্ঠে বললো,

” হয়ে যাবে। কিন্তু অভিকের পরিবার মানবে তো এসব?”

” ভয় তো এটাই। ভুল করে ফেলেছি আমি আদ্র। বুঝতে ভুল করে ফেলেছি মেয়ের মনের কথা। অভিকের বাবার সাথে আমার পার্টনারশিপ দীর্ঘ দিনের। তাছাড়া তুমি জানো ব্যবসায় বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি আমি।এখনও সেটা থেকে উঠতে সক্ষম হয় নি। ”

পায়েলের বাবার হতাশাজনক বার্তায় তুলির ভীষণ খারাপ লাগল। ভয় হচ্ছে খুব। এতো বছর ধরে বিয়েটা ঠিক এমনি এমনি কেন বিয়ে ভাঙতে রাজি হবে কেউ? তাছাড়া অভিকের পরিবারের জন্য এটা খুবই অপমানজনক। যেকোনো মানুষ মেনে নিবে না এমনটা।

তুলির মনে ঝেঁকে ধরা ভয়টাই বাস্তবে পরিণত হলো। নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেছে পুরো বিয়ে বাড়িতে। গতরাতেও তুমুল আওয়াজে মুখরিত হয়ে ছিল এই বাড়ির চারপাশ। অথচ সকাল সকাল নির্জীব, নিস্তব্ধ। সামনের সোফায় একটা ছেলে বসে আছে। গায়ের রং টা শ্যামলা,দেখতে খারাপ নয়। তুলির এমনটাই মনে হলো, কারণ তার অক্ষিতে শুধু তার ডাক্তার সাহেবই সবচাইতে সুন্দর পুরুষ। নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে পায়েল তুলির পাশে। এতো বড় হয়েও নার্ভাসের তাড়নায় তুলির মতো ছোট্ট দুর্বল দেহের অধিকারী একটা মেয়ের হাত আঁকড়ে ধরে আছে। অভিক রাগী গলায় বলে উঠল,

” আপনাদের কোনো অধিকার নেই আমাদের কে এভাবে অপমান করার। এতো বছর ধরে বিয়ে ঠিক অথচ বিয়ের খানিক সময় আগে বলছেন বিয়ে হবে না?আর ইউ ম্যাড?এতো ফালতু আপনারা।”

নিমিষেই ক্রুদ্ধ রূপ ধারণ করল আদ্রর চক্ষু জোড়া। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এল তার। পায়েল রাগের চেয়ে আহত হলো বেশি। তার জন্য তার বাবাকে এমনটা বলার সাহস পেল কেউ। শুধু মাত্র একটা ভুলের জন্য। আজ বুঝল পায়েল কখনও বাবা মায়ের কাছে কিছু গোপন রাখতে নেই। কারণ তারা সবসময় সন্তানের খুশিটাই চায়। আরও আগে যদি মনের কথা বাবার নিকট প্রকাশ করত তবে হয়তো পরিস্থিতি আজকের চেয়েও কিছুটা ভালো হতো,এতোটা কষ্ট পেতে হতো না। তুলি গভীরভাবে তাকালো সবার দিকে। দেখতে পেল পায়েলের বাবার চোখের কোণায় জল চিকচিক করছে। গড়িয়ে পড়ার আপ্রাণ চেষ্টাও চালাচ্ছে হয়ত। অন্তু,নিবিড়, সাগর হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেদের সামলানোর প্রয়াসে অব্যাহত। কিন্তু আদ্র পারে নি নিজের ভিতরে দাউদাউ করে জ্বলে উঠা অগ্নি শিখা নিভাতে। কিছুটা গম্ভীর কন্ঠে অভিক কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,

” আমার জানামতে আপনি একজন ইউনিভার্সিটির লেকচারার। কিন্তু আপনার কথা বার্তা দ্বারা আমার মনে হচ্ছে আপনি একজন অশিক্ষিত লোকের চেয়েও অধম।”

আদ্রর সোজাসাপ্টা অভিব্যক্তিতে রোষপূর্ণ চাহনি নিক্ষেপ করল অভিক কিন্তু তা খুবই নগন্য আদ্রর ওই নীলাভ চোখের তেজী রূপের কাছে। আদ্রর ঠোঁটের কার্ণিশে লেগে আছে তুচ্ছ হাসি অথচ নেত্রে কেবলই ক্রুদ্ধতা। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারল না অভিক। কিছুটা তেঁতে উঠে বললো,

” আপনার সাহস কি করে হলো ডা.আদ্র আহনাফ? আপনি আমার ক্যারেক্টার নিয়ে বিবেচনা কেন করবেন?আমি আপনাকে সেই রাইট দেই নি।”

” তাই নাকি?কিন্তু আমি তো আপনার ক্যারেক্টার নিয়ে কিছুই বলি নি। যদি বলতে শুরু করি কিছুই বাদ পড়বে না। আপনার বাল্যকাল হতে এতটুকু পর্যন্ত গড়গড় করে বলে দিতে পারবো অনায়াসে। একটুও ভুল হবে না। দেখবেন এতে না আপনার সব তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। শুরু করবো কি?”

আদ্রর কথার প্রেক্ষিতে সূক্ষ্ম একটা ঢোক গিলল অভিক। সেকেন্ডের ব্যবধানেই পাংশুটে রূপ ধারণ করল সারা মুখশ্রী। অভিকের মুখভঙ্গি চোখে পড়তেই বাঁকা হাসি ফুটে উঠল আদ্রর অধর যুগলে। কন্ঠস্বর যথেষ্ট সংযত রেখে বললো অভিক,

” তাহলে বিয়ের ব্যাপারে নাকচ করছেন আপনারা?আমি কিন্তু চাইলে জোর করে বিয়ে করতে পারি পায়েলকে। তাছাড়া এই বিয়ের সাথে আপনার ছোট খাটো প্রজেক্ট টাও জরুরি আংকেল। বিয়ে নাহলে আপনার সাথে আমার বাবা কোনো সম্পর্ক রাখবেন না। তখন শর্ত মোতাবেক আপনার প্রজেক্টে ইনভেস্ট করা চার লাখ টাকা আপনি আমাদের ফেরত দিতে হবে।”

আকস্মিক এমন কথায় থমকে গেল পায়েলের বাবাসহ সকলে। একটা মানুষ এত নিকৃষ্ট কি করে হতে পারে,কিভাবে পারল বিয়ের সাথে বিজনেস টানতে। তিনি আজ বুঝতে পারলেন মুখে পাশে আছি বলে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় অনেকে কিন্তু অন্তরে ধারণ করে রাখে অন্য কিছু। আল্লাহর প্রতি লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করছেন তিনি যে সময় থাকতে এভাবে এই মানুষ গুলোর খোলস উন্মুক্ত হয়েছে। নয়তো নিজের মেয়েকে এমন মানুষদের হাতে তুলে দিতে ভাবছিলেন ভাবতেই বুকটা হাহাকার করে উঠল। গম্ভীর স্বরে বললেন,

” আমাকে কয়েক টা দিন সময় দাও অভিক। দিয়ে দিব আমি। ”

” কোনো সময় দেওয়া হবে না। আজ রাতের মধ্যে দিয়ে দিবেন।”

ঝাঁঝালো দৃষ্টিতে তাকাল আদ্র। কপাল কুঁচকে কন্ঠে রাগ নিয়ে বলে উঠল,

” নামে টিচার, বিবেকে মূর্খ। টাকা আজ দু’ঘন্টার মধ্যেই পাবেন। ইচ্ছে হলে টাকা নিয়ে যাওয়ার জন্য দু’ঘন্টা অপেক্ষা করতে পারেন। ”

কথাটা শেষ করেই রাদিফ সাহেব কে কল দিল আদ্র। কল রিসিভ হতেই নম্র স্বরে বললো,

” আমার চার লাখ টাকা প্রয়োজন বাবা। জানি হুট করে বললেই এতো বড় এমাউন্ট রেডি করা পসিবল নয়। তাই দু’ ঘন্টা সময় দিলাম। ছেলে হিসেবে নয়, ব্যাংক থেকে যেভাবে লোন নেওয়া হয় তেমনভাবেই নিচ্ছি। একটা সময় দিয়ে দিব। কিন্তু এই মুহুর্তে আমার সামনে একজন নিকৃষ্ট মানুষ উপস্থিত আছেন,যিনি টাকার জন্য ছটফট করছেন। রাখি আল্লাহ হাফেজ। ”

আদ্রর তাচ্ছিল্য কথা শুনে অভিকের পরিবার বাদে উপস্থিত সকলের মুখে হাসি ফুটে উঠল। যাকে এক কথায় তৃপ্তির হাসি বলা যায়। বেশ জব্দ হয়েছে অভিক ও তার পরিবার। পায়েলের বাবা আদ্র কে বুকে জড়িয়ে নিলেন। অন্তুর ফ্যামিলিকেও রাজি করিয়ে নিল আদ্র। অন্তু খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,

” তোর মতো বন্ধু কারো কপালে না জুটুক। কারণ আমরাই ইউনিক থাকতে চাই।”

কোমরে কারো স্পর্শে তুলির দেহের সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল তীব্রভাবে। মুহুর্তেই ছিন্ন ভিন্ন হলো কল্পনার জগৎ। স্পর্শ আরো গভীর হতেই তুলি রাতের আকাশে ঝলমল করা তারার দিকে দৃষ্টি তাক করল। তুলি একটা জিনিস বেশ খেয়াল করেছে যখনই আদ্র ও সে কাছাকাছি আসে তখন সুদূর ওই গগণে আকাশে তারার মেলা বসে। ছোট থেকেই শত শত বার তুলি চেষ্টা করেছে তারা গুণার কিন্তু কখনও সম্ভব হয় নি। তবে তুলির কাছে মনে হয় আদ্র ও তার ভালোবাসার স্বাক্ষী হতে তারা রা দলে দলে আকাশের বুকে ভিড় জমায়। তুলি উল্টো ঘুরে আদ্রর বুকে মিশে গেল। কোমল স্বরে আওড়ালো,

” একটা প্রশ্ন করি ডাক্তার সাহেব?”

” হাজার টা করো।”

তুলি আলতো হাসল। প্রতুত্তরে বললো,

” হাজার টা নেই আপাতত মনে একটা প্রশ্নই আছে। ”

তুলির চুলের ভাঁজে ছোট্ট একটা চুমু খেল আদ্র। চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বললো,

” তাহলে মনের কথা মুখে এনে তাদের ধন্য করুন মিসেস তুলা। ”

” আপনি অভিক ভাইয়ার ব্যাপারে সব জানেন?মানে উনার সিক্রেটসহ?আমি তখন খেয়াল করেছি আপনার কথা শুনে খানিকটা চুপসে গিয়েছিলেন উনি। উনার চরিত্র নিয়ে কি বলতেন?উনার কি চরিত্র দোষ আছে?”

“হুম।”

” কেমন দোষ?”

” এটা তো মুখে বলা যাবে না। প্র্যাক্টিক্যালি দেখাতে হবে বউ।”

“মানে?”

আমতা আমতা করে প্রশ্ন করল তুলি। দেখল আদ্র ঝুঁকে পড়ছে তার দিকেই। চোখে মুখে দুষ্টমির ছাপ। তুলি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কিছু বলবে তার পূর্বেই গলায় আদ্রর ভালোবাসাময় স্পর্শ অনুভব করল। অভ্যাসবশত একটা হাত মুঠোয় পুরে নিল আদ্রর বুকের কাছের কালো টি-শার্ট টার কিছু অংশ। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে তুলির। ফ্লোরে ঠেকিয়ে রাখা পা দুটো থরথর করে কাঁপছে। আদ্রর বুকে নেতিয়ে পড়বে পড়বে ভাব। কোমরে হাত পেঁচিয়ে আরো প্রগাঢ়ভাবে মিশিয়ে নিল আদ্র। তুলি শুকনো কন্ঠে কোনো রকমে বললো,

” পা,,পানি খাব আদ্র।”

গলা থেকে মুখ উঠিয়ে তুলির শ্যাম বরণ মুখটায় নজর ঠেকাল আদ্র। নির্মল বাতাস ছুৃঁয়ে চলেছে দু’জনের দেহের সর্বাঙ্গে। তুলির বুঁজে রাখা ঘন ঘন আঁখিপল্লবে দৃঢ়ভাবে ঠোঁট ছুঁয়ালো আদ্র। তৎপরে তুলিকে কোলে তুলে নিয়ে রুমে এনে বিছানায় বসালো। পানির গ্লাস টা হাতে নিয়ে নিজে অর্ধেক পান করে বাকি টা তুলির দিকে বাড়িয়ে দিল। কাঁপা কাঁপা হস্তে গ্লাস টা নিয়ে পানিটুকু খেল তুলি। গ্লাস টা রেখে আদ্র তুলির খুব নিকটে বসলো। ভ্রুঁ উঁচিয়ে বললো,

” এবার মানে টা বুঝলে অভিকের চরিত্র দোষের?আবার আমার চরিত্রে দোষ আছে ভেবো না তুলা। আমি তো আমার বউ কে একটুখানি ছুঁয়েছি।”

তুলির চক্ষুদ্বয় বড় বড় হয়ে গেল তৎক্ষনাৎ। এবার বেশ বুঝতে পারল সে। তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,

” এমন একটা জঘন্য লোকের সাথে পায়েল আপুর বিয়ে হতে যাচ্ছিল। পায়েল আপু জানত?”

ভিতরে চেপে থাকা দীর্ঘনিঃশ্বাস টা বাহিরে মুক্ত করে দিল আদ্র। মাথা নাড়িয়ে বললো,

” না জানত না। এটা প্রায় দু’বছর আগের কথা। আমার একজন হার্টের পেশেন্ট ছিলেন মিস তামান্না। উনি গত হয়েছেন প্রায় এক বছর হবে। মেয়েটা খুব স্টেস নিত,ডিপ্রেশনে ভুগত। আমি বার কয়েক উনাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর পরামর্শও দিয়েছি। তাছাড়া মেয়েটা প্রেগন্যান্ট ছিল। কথায় কথায় উনি আমাকে উনার জীবনের কিছু কথা শেয়ার করেন। শোনার স্পৃহা না থাকলেও উনার ভালো মন্দ ভেবে শুনলাম। বাবা মা নেই মেয়েটার। যতদিন বেঁচে ছিল স্ট্রাগল করেছে অনেক। তবে ভুল করে ফেলেছিল। রিলেশনশিপে জড়িয়ে বয়ফ্রেন্ডের কুপ্রস্তাবে রাজি হয়ে ইন্টিমেট হয়েছে। কথাটা শুনা মাত্রই মস্তিষ্কে রাগ চেপে বসেছিল আমার। জীবন কি এতোটাই তুচ্ছ কেউ বললেই দিয়ে দিবে?একটা মেয়ে নিজের সম্মান অন্যের হাতে তুলে দিলে আমার মতে সেটা জীবন দিয়ে দেওয়ার চেয়ে কম না। ফলস্বরূপ ছেলেটা নিজের স্বার্থ হাসিল করতে পেরে মেয়েটা কে ছেড়ে দিয়েছে। ছেলেটা আর কেউ নয়,সে ছিল অভিক। মিস তামান্না সেই ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন যেখানে অভিক লেকচারার হিসেবে নিয়োজিত। আমি মেয়েটার কথায় একদম বিশ্বাস করি নি। কিন্তু কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মতো ছিল না। আমার কথায় একদিন জোর করে মেয়েটা অভিক কে ডেকে রেষ্টুরেন্টে দেখা করে। দু’জনের কথাগুলো স্পষ্ট আমার কর্ণে প্রবেশ করেছিল। আমি আড়ালে থেকে সবটা দেখেছি। কতোটা অমানবিক, নিষ্ঠুর হলে নিজের সন্তানকে মেরে ফেলার হুমকি দিতে পারে তুলা?জানোয়ার একটা। আমি এসব কিছুই পায়েল কে, আংকেল কে বলি নি। কারণ আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম পায়েলের বিয়ে আমি এই জানোয়ারের সাথে হতে দিব না। একে শাস্তিও আমি দিব। আর এখনও বলি নি কাউকে, এতে আংকেলের কষ্ট বেড়ে যেত,দ্বিগুণ হয়ে যেত অনুশোচনার পরিমাণ। ”

তুলির চোখ জলে ভর্তি হলো। ভেবেই কুল পাচ্ছে না মানুষ এতো জঘন্য হতে পারে! থেমে থেমে প্রশ্ন করল,

” বা,বাচ্চা টা?”

“প্রেগন্যান্সি যখন পাঁচ মাস রানিং মিসক্যারেজ হয়েছে মিস তামান্নার।”

কষ্টে ভারী হয়ে গেল তুলির বুকটা। আদ্রর বুকে মাথা রেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। পিঠে হাত রেখে কানের পিঠে শুষ্ক অধর জোড়া ছুৃয়ে দিল আদ্র। স্মিত হেসে বলে উঠল,

” তুমি এতো নাজুক কেন তুলা?অন্যের কষ্টে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছো। এতো নরম কেউ হয়?জীবনে অনেক স্ট্রং হতে হবে তোমাকে। কিছু কিছু মুহুর্ত এমনও আসতে পারে তোমার একাই মোকাবিলা করতে হবে তখন এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। তুমি কাঁদলে আমার ভয় হয়। হৃদপিণ্ডের ব্যাথাটা বেড়ে যায় ক্রমশ।”

#চলবে,,,,

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব__৪১

চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছে তুলি। মাথা বার বার গিয়ে ঠেকছে বইয়ের উপর। পরমুহূর্তেই আবার শিরদাঁড়া সোজা করে ঘুম তাড়ানোর তীব্র চেষ্টা চালাচ্ছে। রাত পোহালেই তো ফাইনাল পরীক্ষা। এখন ঘুমে আচ্ছন্ন হলে আদ্রর রাগের সম্মুখীন হতে হবে তা শতভাগ নিশ্চিত তুলি। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে চেয়ারে এক পা তুলে মিনমিন করে পড়ছে। নিদ্রা চক্ষুকোটরে এসে বারংবার হানা দিয়ে যাচ্ছে। চোখ জ্বলছে খুব। বড়সড় করে মেলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা তুলির। তবে যদি রেহাই হয় তন্দ্রা নামক বেজাল হতে। কিন্তু ঘুম বুঝি তুলির ডাগরডাগর আখিঁদ্বয়ের প্রেমে মগ্ন হয়েছে নয়তো তুলিকে ছেড়ে পাড়ি জমাতো সুদূর কোথাও। হুট করে টেবিলে ঢলে পড়ল তুলি। সাথে সাথেই উচ্চ শব্দ কর্ণে আসতেই সারা শরীরে ঘাম ছুটে গেল তার। তড়িৎ গতিতে হুড়মুড়িয়ে উঠল। ভয়ে সারা শরীরে কম্পন ধরে গেল তৎক্ষনাৎ। ঘুম ঘুম ঝাপসা চোখে ভেসে উঠল এক জোড়া রক্তচক্ষু। নিমেষ তন্দ্রা তড়তড় করে জানালা দিয়ে পালিয়ে গেল যেন। শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠল,

” আমি,,,আমি ঘুমোয় নি তো ডাক্তার সাহেব। চোখ লেগে এসেছিল। কতবার ঘুম কে বলেছি প্লিজ পালিয়ে যাও কাল আমার পরীক্ষা কিন্তু ওরা আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। ”

ভয়ের চোটে আবোল তাবোল বকলো কতক্ষণ তুলি। আদ্র নির্বিকার দৃষ্টি মেলে নির্নিমেষ চেয়ে রইল খানিকটা সময় । তৎপরে কফির মগ টা ধরিয়ে দিল তুলির হাতে। সন্ধ্যা থেকে কথা বলছে না আদ্র তুলির সঙ্গে। রুমে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে সে। গম্ভীর ভাবের সাথে রাগ মিশ্রিত হয়ে সারা মুখে ছেয়ে আছে বিশদ। এহেন মুখভঙ্গি নেত্রে বিঁধতেই তুলির বুক টা ধুক করে কেঁপে উঠল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাতের গরম কফি টা পান করতে লাগল একটু একটু করে। ঠাহর হলো তার আদ্র ভীষণ রেগে আছে। রাগা টা কি যুক্তিযুক্ত নয়?তুলির কাছেও যুক্তিযুক্ত এটা। আগামীকাল ইংরেজি পরীক্ষা কিন্তু তুলির এখনও সব পড়া বাকি। সারা সন্ধ্যা না পড়ে সায়েরা বেগমের সাথে আড্ডা দিয়ে পার করেছে মূল্যবান সময়। হসপিটাল থেকে এসে আদ্র প্রিপারেশন কেমন জিজ্ঞেস করা মাত্র বেলুনের মতো তুলির কলিজা টা নিমিষেই চুপসে গিয়েছে। মুখের হাসিটা বিলীন হয়ে গেছে হুট করেই। সেই থেকে আদ্র একটা কথাও বলে নি তুলির সাথে। সারাদিন একটু পর পর আদ্র ফোন করে বার বার পড়ার জন্য তাগিদ দিয়েছে। কিন্তু তুলি অবলীলায় ফাঁকি দিয়ে গেছে তার ডাক্তার সাহেব কে। অতঃপর আদ্রর রাগের সম্মুখীন হয়ে কোনো কথা ছাড়া সেই সাত টায় পড়তে বসেছে এক টানা পাঁচ ঘন্টা ধরে চেয়ারে ঘাপটি মেরে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। পা,কোমর,পিঠ ব্যাথা করছে অনেক। পেট জানান দিচ্ছে প্রচন্ড ক্ষুধার্ত সে। তবে যতক্ষণ না আদ্র তার সাথে কথা বলবে ততক্ষণ অব্দি চেয়ারে বসে পড়ায় মনোনিবেশ করে রাখার দৃঢ় পণ করেছে তুলি। আদ্রর দিকে এক পলক চাইতেই দেখল তার দিকেই অপলক দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে আদ্র। দ্রুত গতিতে চোখ মুখ সরিয়ে নিল তুলি। দৃষ্টি মাধ্যমে হৃদয়পটে প্রহার করার ক্ষমতা রাখে আদ্র,তুলির কাছে এটাই মনে হয়। নিরীহ, নির্বাক তুলি নিজ মনে আওড়ালো,

” একটা বার কথা বলুন ডাক্তার সাহেব। আপনার কন্ঠস্বর শুনতে না পেয়ে আমার বুক টা ব্যাথা করছে। আমি কখনও আর আপনার অবাধ্য হব না। ”

তুলির মনে কষ্টগুলো বিস্তার লাভ করতে লাগল ক্রমাগত। বুক ঠেলে কান্না উঠছে। গলা অবধি আটকে যাচ্ছে। না চাইতেও এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে গেল কপোল বেয়ে। জল বিন্দু কপোল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রইল,কোনো ক্রমেই স্পর্শ করতে পারল না তুলির গলা। তার পূর্বেই একটা বলিষ্ঠ হাত অতি যত্নের সহিত অশ্রুকণা মুছে দিল। নতমস্তকে তুলি আদ্রর হাত টা গালে চেপে রেখে ডুকরে কেঁদে উঠল। চোখ ছাপিয়ে নেমে আসছে জল। অশ্রুসিক্ত, অস্পষ্ট কন্ঠে বলতে লাগল,

” একটু কথা বলুন না ডাক্তার সাহেব। আপনি আমার সাথে কথা না বললে নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয় আমার। একটুও থাকতে পারব না আমি আপনাকে ছাড়া। একটা বার তুলা বলে ডাকেন দয়া করে। ”

কি আকুলতা শ্যামবর্ণার কন্ঠে! তুলির আকুল আবেদনে আদ্র নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে নি। তুলির হাত টা টেনে নিজের বুকের বা পাশে চেপে ধরল শক্ত করে। মলিন কন্ঠে বললো,

” এখানে প্রকান্ড ব্যাথা বাসা বেঁধেছে তুলা। তোমার সাথে কথা না বলে থাকার মতো ক্ষমতা নিয়ে আমি জন্মায় নি। তবুও খুব করে চেষ্টা করেছি আজ তোমার সাথে কথা না বলার। কিন্তু পারি নি। ”

এতটুকু বলে সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল আদ্র। তুলির হাতের তালুতে ঠোঁট দুটো ছুঁয়ে দিল। পাশের চেয়ার টেনে বসল মুখোমুখি। নিজের দু’হাতের ভাঁজে নিয়ে নিল তুলির হাত দু’টো। মায়াময় কন্ঠে পুনরায় বলে উঠল,

” তুমি কি সারাটা জীবন ডা.আদ্র আহনাফের ওয়াইফ হিসেবে পরিচিত হয়ে থাকতে চাও নাকি নিজেরও আলাদা একটা আইডেন্টিটি চাও?তুমি যা চাও তা-ই হবে। আমি তোমাকে একদম পড়ার প্রেশার দিব না।”

কিরূপ প্রতুত্তর করবে তুলি ঠিক বুঝতে পারছে না। প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আদ্রর মুখের দিকে। কিছু সেকেন্ড অতিক্রম করে রিনঝিনে কন্ঠে জবাব দিল,

” আপনাকে চাই। আপনার ইচ্ছে গুলো পূরণ করতে চাই। ”

সাথে সাথেই তুলির হাত টা টেনে তুলি কে নিজের উপর নিয়ে আসল আদ্র। আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল তুলি। পরক্ষণেই আদ্রর বুকে মাথা রেখে চুপ করে রইল ক্ষীণ সময়। শুনতে পেল আদ্রর লহু স্বর।

” দিন দিন তোমার ভিন্ন ভিন্ন পরিবর্তন দেখছি তুলি। তোমার জবাব টা আমার ভাবনার বাহিরে ছিল। একসাথে আমার দু’টো প্রশ্নকে সমর্থন জানালে। তুমি ভালো করে জানো আজ যদি আমি রাগ না দেখাতাম তবে তুমি মন দিয়ে পড়তে না। আমার মনে তোমার জন্য জন্ম নেওয়া ইচ্ছে গুলো খুব বেশি কঠিন নয় তুলা। আবার খুব একটা সহজও নয়।”

তুলি কে বিছানায় বসিয়ে খাবার নিয়ে এল আদ্র। যত্ন করে খাইয়ে দিয়ে হাত টা ধুয়ে এসে নিজ দায়িত্বে পড়াতে শুরু করল তুলি কে। এবার আর তালবাহানা করল না তুলি। টানা একঘন্টা পড়ে অবশেষে আদ্রর প্রশস্ত বক্ষে মুখ গুঁজে পাড়ি জমাল ঘুমের রাজ্যে।
_______

বৃষ্টিমুখর দিন। প্রভাতের ঠিক প্রথম প্রহরে বৃষ্টি পৃথিবীর বুকে নিজের আগমন ঘটিয়েছে। প্রবল বেগে ধরণীতে আছড়ে পড়লেও তা স্থায়ী হয় নি দীর্ঘক্ষণ। দুপুরের দিকে বর্ষণ ধরণী হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল,উঁকি দিয়েছিল সোনালী রোদ্দুর। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়তেই রোদ্দুর নিজেকে ঘন কালো মেঘে আড়াল করে নিল। নীল অম্বরে আধিপত্য বিস্তার করল কালো মেঘের দল। কিছু সময়ের ব্যবধানে বৃষ্টি রূপে নেমে এল আবারও পৃথিবীর বুকে। আহা!দিনটা যেন আজ শুধুই বর্ষণের নামে লিখা। তুলির শাড়ির অনেকটা ভিজে গেল বৃষ্টির পানিতে। তেছড়াভাবে বৃষ্টি ছুঁয়ে যাচ্ছে দেহের একপাশে। গ্রাম্য ভাষায় কেউ কেউ বলেন হিঁচা বৃষ্টি। এই হিঁচা বৃষ্টির কবলে পড়ে অবস্থা নাজেহাল তুলির। কোনো রকমে তুলি কে নিজের সাথে মিশিয়ে ছাতা টা ঠিক করে ধরল আদ্র। পায়ে পা মিলিয়ে দু’জন হেঁটে এল ইনশিতার শশুড় বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত। আদ্রর হাতের শপিং ব্যাগ গুলো তুলি নিজের হাতে নিয়ে নিল। ছাতা টা বন্ধ করে একপাশে রেখে দিল আদ্র। তুলির হাতটা মুষ্টিমেয় করে ভিতরে প্রবেশ করল।

ড্রইং রুমে রনক,পূর্ব,ইনশিতা বসে আছে। তুলি আনন্দিত হয়ে গটগট পায়ে হেঁটে এল ইনশিতার কাছে। দিক বিদিক ভুলে ইনশিতার কোলের বেবী টাকে হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়েও থেমে গেল। কিছুটা মন খারাপ করে বললো,

” আমার হাত ভেজা। রোয়ানের ঠান্ডা লেগে যাবে।”

তুলি ও আদ্র কে দেখে ইনশিতা খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল। চোখ দুটি চকচক করে উঠল যেন। কোমল স্বরে বললো,

” কিছু হবে না। বরং রোয়ান তো পথ চেয়ে ছিল কখন তার ছোট্ট মামী টা আসবে,কখন তার কোলে নিয়ে আদর দিবে তাকে।”

ইনশিতার কথায় খুশিতে তুলি ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। সোফায় বসে ইনশিতার বেবী কে কোলে নিয়ে ঠোঁটের পরশ বুলিয়ে দিতে লাগল গালে,কপালে,ঠোঁটে। তুলির কান্ড দেখে মুচকি হাসল সবাই। পূর্ব তুলির দিকে এক পলক চেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে আনল ঝটপট। কেননা তুলি এখন তার জন্য নিষিদ্ধ। সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। আদ্রর দিকে চেয়ে বললো,

” কেমন আছেন?”

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আদ্র। আলতো হেসে ফিসফিস করে জবাব দিল,

” আমার বউয়ের দিকে না তাকালে ভীষণ ভালো থাকব আমি এবং তুমি দু’জনেই।”

” তাকালে বুঝি রিশাদের মতো অবস্থা করবেন? নাকি একদম প্রাণে মেরে ফেলবেন?একবার তো বেধরম পেটালেন আমাকে আপনার বউকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য। ”

পূর্বর কথার প্রেক্ষিতে আদ্র বিস্তর হাসল। আগ্রহহীন কন্ঠে বললো,

” বাহ্!তুমি তো খুব জিনিয়াস হয়ে গেলে পূর্ব। তা তিশার কি অবস্থা? ”

” ভালো। তিশাকে বিয়ের আইডিয়াটা আপনি দাদি কে দিয়েছিলেন তা আমি জানি। এদিক থেকে আমি খুব কৃতজ্ঞ আপনার প্রতি। ভুল করে আপনার ভালোবাসা কে ভালোবেসে ফেললেও ঠিক করে তিশা কে ভালোবাসতে শিখেছি আমি। ভালোবাসা অন্যায় নয়। তুলি আমার মনের সুপ্ত কোণে চিরকাল থাকবে না পাওয়া ভালোবাসার স্মৃতি হয়ে। আর তিশার থেকে পাওয়া ভালোবাসা আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আগলে রাখব নিজের কাছে। ”

একটা মেয়েকে এগিয়ে আসতে দেখে পূর্ব কথা থামিয়ে দিল। দৌড়ে গিয়ে মেয়েটা কে আগলে ধরে বিচলিত কন্ঠে বলে উঠল,

” একা একা আসতে গেলে কেন তিশা?বলেছিলাম না নিচে আসলে আমাকে ফোন দিবে,আমি নিয়ে আসব।”

তিশা ঠোঁট উল্টে বললো,

” তুলি ও আদ্র ভাইয়া এসেছেন আপনি বলবেন না আমাকে?”

” মাত্রই এসেছে।”

মুখ ফিরিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল তিশা। উঁচু পেট টা আঁকড়ে ধরে এগিয়ে এল আদ্রর কাছাকাছি। খুব বেশি উঁচু হয় নি তবুও চোখে হারায় পূর্ব। ভয় হয় হারানোর। ছয়মাস চলছে তিশার প্রেগন্যান্সির। প্রায় দু’মাস আগে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল তুলির সাথে আদ্রদের বাসায়। সায়েরা বেগম দাওয়াত করেছিলেন এই বাড়ির সবাইকে সেই উপলক্ষে যাওয়া হয়েছিল। তাছাড়া তুলি কে দেখার খুব শখ ছিল তিশার। আদ্র,পূর্ব দু’জনের মুখেই শুনেছে শ্যামবতী তুলার নাম। আদ্রর সাথে পরিচয় টা বহু বছর আগের। তিশার বাবা ছিলেন আদ্রদের মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসর। উনার মুখে আদ্রর নাম টা খুব শুনত তিশা। প্রিয় ছাত্র ছিল আদ্র। বাবার মুখে নাম শুনতে শুনতে কৌতূহলবশত দেখাও করেছিল তিশা আদ্রের সাথে। বাবার রিটায়ার্ডের পর কানাডা স্যাটেল হলেও ভালো যোগাযোগ ছিল আদ্রর সাথে। তিশা খুব সহজ সরল একটা মেয়ে। পূর্বর কথা আদ্রই তিশা কে জানিয়েছিল। পূর্বর সম্পর্কে সব জেনে তিশা শুধু এতটুকুই বলেছিল-

-” কাউকে ভালোবাসা দিয়ে সঠিক পথে আনার খুব ইচ্ছে আমার ভাইয়া। কখনও কাউকে ভালোবাসি নি আমি। খুব ইচ্ছা আমার ভালোবাসার টানে কেউ জীবনের ভুল গুলো পিছনে ফেলে সঠিক পথে ছুটবে।”

আদ্র প্রথমে নাকচ করলেও তিশার আকুতিভরা আবেদন ফেলতে পারল না। দাদির মাধ্যমে পূর্বর বিয়েটা তিশার সাথে ঠিক করল। এক প্রকার বাধ্য করল পূর্বকে এই বিয়ে টা করতে কৌশলে।

” কেমন আছো তুলি?”

হাসি মাখা চেহারা নিয়ে প্রশ্ন করল তিশা। সামনের সোফায় বসল কিছুটা আয়েশ করে। পূর্ব মৃদু হাসল। ধপ করে বসে পড়ল তিশার পাশে। কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করল তিশা। ফের চক্ষু যুগল তুলির দিকে নিক্ষেপ করল। রোয়ানের উপর থেকে নজর সরিয়ে তুলি ঠোঁটের কার্ণিশে হাসি নিয়ে বললো,

” আলহামদুলিল্লাহ আপু। আপনি এবং বাবু দু’জনে কেমন আছেন?”

” তোমাকে দেখে আমার বাবু একদম ভালো হয়ে গেছে। নইলে কেউ কেউ তো আমাদের রুমে বন্দি করে রেখে পাগল বানানোর ধান্দা খুঁজে। ”

পূর্বর দিকে চেয়ে তীর্যক স্বরে বললো তিশা। তুলি ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করল খুব। এবং সফলও হল এই যাত্রায়। তার ভীষণ ভালো লাগে তিশা কে। মেয়েটার সারা মুখে মায়াদের বসবাস। এখন আর পূর্ব সামনে থাকলে তুলির খারাপ লাগে না,অস্বস্তি অনুভব হয় না। কারণ প্রণয়ে তো পূর্বও আবদ্ধ তফাৎ একটাই তা এখন তিশা তেই সীমাবদ্ধ। তুলির ধারণা- হয়তো ধামাচাপা পড়ে গেছে তুলির প্রতি এক কালের ভালোবাসা, অনুরাগ।

রোয়ানের গালে চট করে একটা চুমু এঁকে দিল তুলি। বাচ্চা টার বয়স দেড় মাস। এক সপ্তাহ হতে না হতে তুলি রোয়ান কে দেখার বায়না নিয়ে হাজির হয়ে যায় আদ্রর নিকট। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে প্রায় বিশ দিন হবে।কোচিং এর ক্লাস, পড়া সব ফেলে শুধু এখানেই ছুটে আসে। রোয়ান কে তার ভীষণ ভালো লাগে। ভীষণ, মাত্রারিক্ত। মাঝে মাঝে নিজের মেদহীন পেটে হাত বুলায় তুলি। খুব করে চায় এই পেটে কারো অস্তিত্ব আসুক। সবার অগোচরে পাশে বসে থাকা আদ্রর কানের কাছে মুখ টা এগিয়ে নিল। নিম্নস্বরে বললো,

” ডাক্তার সাহেব রোয়ানের দিকে তাকান তো একটু।”

তুলির মুখের দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল আদ্র৷ গোলাপি চিকন ওষ্ঠের হাসি টা হৃদয়ে প্রশান্তি ছড়িয়ে দিল মুহুর্তে। রোয়ানের দিকে অত্যন্ত মনোযোগের সহিত তাকাল। অনন্তর ঝুঁকে ছোট্ট একটা চুমু খেল। মাথা তুলতেই তুলি মিহি সুরে বলে উঠল,

” শুনবেন না ডাক্তার সাহেব? ”

“শুনব তুলা।”

আদ্র ভালো করেই জানে তুলি কি বলবে তাকে। এই এক বাক্য যে রোয়ান জন্ম নেওয়ার পর থেকে তুলি কয়বার বলেছে তার হিসেব কেবল আদ্রই জানে। তুলি লজ্জা মাখা স্বরে চিরাচরিত বাক্য টা বলেই বসলো।

” জানেন,রোয়ানকে আমার পেটে এখনও না আসা মেয়ের জামাই জামাই লাগে।”

আদ্র মনে মনে একশ এর পাশে এক বসিয়ে নিল। অর্থাৎ ১০১।

#চলবে,,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)