আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-৪২+৪৩

0
645

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব__৪২

নিঝুম আঁধারে ডুবে আছে প্রকৃতি। সাঁই সাঁই করে বাতাস অবলীলায় প্রবেশ করছে ট্রেনের উন্মুক্ত জানালা দিয়ে। বাতাসের ঝাপটায় তুলির খোলা কেশে যেন পাখনা গজিয়েছে। চুলগুলো উড়ছে বাধাহীন। বারংবার উপচে পড়ছে কপালে, মুখে। দু দু’বার এদের কানের পিঠে গুঁজে তুলি হাল ছেড়ে দিল, বাঁধতে গিয়েও আলতো হেসে হাতের বেন্ড টা ঢুকিয়ে রাখল ব্যাগে। পাশ ফিরে দেখল আদ্র এলো কিনা!কিন্তু শূণ্য সিট টা পূর্ণ হয় নি। সেই কখন গেল আদ্র অথচ এখনও আসছে না। পাশ থেকে চোখ সরিয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি তাক করল তুলি। মুহুর্তেই চক্ষে ভেসে উঠল সুন্দর,মনোরম একটা দৃশ্য। অন্তুর বুকে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে পায়েল। কে বলবে এই কপোত-কপোতী দু’জন সারা বেলা কাটায় ঝগড়া করে! প্রেম নিবেদন যদি হয় ঝগড়াতে তবে ঝগড়া মন্দ নয়। ঘন্টা দুয়েক আগেও ট্রেনে উঠে পায়েল খুব রাগ দেখাচ্ছিল অন্তুর সাথে সামান্য একটু দেরি হওয়ার জন্যে। অন্তু মুখে তালা দিয়ে হজম করে যাচ্ছিল তিতা তিতা বাক্যগুলো।

তুলির চোখ দুটো সরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে না হৃদয় জুড়ানো এই দৃশ্য থেকে। কেন জানেনা, তবে সবাইকে মন ভরে দেখতে ইচ্ছে করছে ট্রেনের ভিতরের হলদেটে আবছা আলোয়। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করল তুলি। ঘুমন্ত অন্তু,পায়েলের প্রেমময় মুহুর্ত টা বন্দি করে নিল ক্যামেরায়। যখন ওদের ঘুম ভাঙবে,মুহুর্ত টা তখন অতীত হবে। কিন্তু তুলির মোবাইলের গ্যালারিতে সর্বদা স্মৃতিরূপে থাকবে এই অত্যল্পকাল।

তুলি পুনরায় বিমূর্ত দৃষ্টিতে আকাশ পানে চাইল। থালার মতো বিশাল বড় একটা চাঁদ অনেকখানি জায়গাজুড়ে স্থির হয়ে আছে অন্তরিক্ষে। তুলির মনটা আজ ফুড়ফুড়া। এডমিশন টেস্টের জন্য পড়তে পড়তে ইদানীং খুব ক্লান্ত লাগতো। মনটা বিষিয়ে যেত,তবুও ছিল নিরুপায়। ‘কিছু পেতে হলে কষ্ট তো করতে হবে’ দিন-রাত মনে মনে এটা আওড়ায় তুলি। তার মতে,এটা তার অনীহা কাটাতে সাহায্য করে, পড়ার প্রতি স্পৃহা বাড়ায়। আজ সকালের কথা,আদ্র হুট করে এসে জানাল রাতের ট্রেনে রাজশাহী যাবে পরিবারের সবাই। আদ্রর কাছে পরিবার বলতে শুধু রক্তের সম্পর্কে আবদ্ধ মানুষগুলো নয় বরং অন্তু,পায়েল,রিমি,নিবিড় সকলেই আদ্রর জীবনের অংশ। প্রথমত শুনে প্রচন্ড অবাক হলেও তুলি পরমুহূর্তে জানতে পারল বাড়ির সবাই এটা আগে থেকেই জানে। অকস্মাৎ রাজশাহীর নিমিত্তে যাত্রা টার কারণ তুলির জানা নেই তবে এই যাত্রা না হলে ট্রেন যাত্রার সুন্দর মুহুর্ত গুলো তুলির মিস হয়ে যেত। তুলি হাত বাড়িয়ে দিল জানালার বাহিরে। বিড়বিড় করে বললো,

” ইশ! যদি বৃষ্টি হতো এখন।”

এক্ষেত্রে মনঃক্ষুণ্ণ হল তুলির। কারণ বৃষ্টি হবার কোনো লক্ষণ বা আশঙ্কা নেই আজ। তুলি হাত টা ভিতরে নিয়ে আসল,সাথে সাথেই ধরাস করে কেঁপে উঠল অন্তস্থল। নিস্তব্ধতা ভেঙে মোবাইলে মেসেজ আসার ছোট্ট একটা শব্দ হলো। কিন্তু তুলির কাছে রাতের এই সম্পূর্ণ নিস্পন্দতায় আওয়াজ টা বিকট শোনালো। আকস্মিকতায় ভয়ে কেঁপে উঠল। মোবাইলের স্ক্রিনে ভয়ার্ত নজর নিক্ষেপ করতেই দেখল আদ্র মেসেজ পাঠিয়েছে। ভ্রুঁ যুগল কুঞ্চিত হল তুলির। এখান থেকে এখানে কেন মেসেজ পাঠাল আদ্র তা বোধগম্য হল না।

” দরজা পর্যন্ত আসবে কি বউ?আমি জানি তুমি আমার অপেক্ষায়। তোমার অপেক্ষার প্রহরের ইতি ঘটিয়ে জলদি এসো। নাকি আমি আসব?”

ঠোঁটের কার্ণিশে হাসি ঝুলিয়ে তুলি উঠে দাঁড়াল। দাঁড়ানো মাত্র হেলেদুলে পড়ে যেতে নিয়েও সিটে হাত রেখে সামলে নিল নিজেকে। পিছনে ফিরে দেখল সাগরের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমে মগ্ন রিমি। রিমি কে সাথে নিতে নারাজ ছিল সাগর। প্রেগন্যান্সির সাত মাস চলছে। এই অবস্থায় লং জার্নি টা ঠিক না। কিন্তু সাগরকে আচ্ছামতো ঝেড়েছে রিমি। ঝগড়াও করেছে এক চোট। তার একটাই কথা সে গাইনোকোলজিস্ট,বাচ্চার কিসে ক্ষতি হবে না হবে সে দিব্যি জানে। রিমির তর্কে হার মেনে শেষমেশ সাথে নিতে বাধ্য হল সাগর। আগে কখনও এমন ঝগড়াটে ছিল না রিমি,তর্কও করতো না। তবে প্রেগন্যান্সিতে মুড সুইং হয়তো এসবের জন্য দায়ী। তাছাড়া তুলির কাছে মনে হয় রাজশাহী যাওয়া তে রিমি অবিশ্রান্ত অনুভব করবে না বরং অনেকটাই সতেজতা পাবে।

গুটি গুটি পায়ে খানিকটা হেঁটে এল তুলি মন্থরগতিতে। চলন্ত ট্রেনে হাঁটা কষ্টকর ঠেকল তুলির কাছে। শরীর বার বার হেলেদুলে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। একটা সিটে হাত ঠেকিয়ে তুলি থামলো কিছুক্ষণ। গভীর রাতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সকল যাত্রী। তুলি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে পুর্নবার এগোতে আরম্ভ করলো। তৎক্ষনাৎ ট্রেনের ঝাঁকুনিতে মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম তুলির। রক্ত হিম হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। কোমরে মৃদু চাপ পেয়ে সামনের মানুষ টাকে আঁকড়ে ধরল শক্ত করে। বুকে মাথা ঠেকিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগল অনবরত। স্মিত হাসল আদ্র। কোমরে হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত করল। তুলির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিচেল স্বরে বললো,

” জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি আসব কিনা!নিরুত্তর থেকে নিজেই চলে এলে। আমার সাহসী তুলা, যদি আপনি পড়ে যেতেন?”

তুলি মাথা তুলে আদ্রর দিকে তাকালো। কন্ঠে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বললো,

” আমি জানি আপনি আসবেন তাই আর রিপ্লাই দেই নি। এছাড়া আপনি তো আছেনই আমাকে আগলে রাখার জন্য। আমিও থাকব সবসময় আপনার বুকে, চুপটি করে পরিমাপ করবো আপনার স্পন্দন। ”

কথাগুলো বলে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল তুলি। হলদেটে আলোতে তা চক্ষু এড়ায়নি আদ্রর। তুলি ফ্যালফ্যাল নয়নে আদ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অনড়। তুলি ভাবছে যদি তার চোখের মণি কালো না হয়ে আদ্রর মতো নীল হতো তবে কি তাকে এতটা সুন্দর লাগতো!উঁহু! লাগতো না৷ মনেই মনেই বললো তুলি। আদ্র কোমল স্বরে বলে উঠল,

” আমার গলা আঁকড়ে ধরে দাঁড়াও।”

তুলি তার ডাক্তার সাহেবের আদেশ মান্য করে দূরত্ব কমালো। হাত দু’টো নিয়ে আদ্রর গলা আঁকড়ে ধরল। তাৎক্ষণিক মনে হলো আগের থেকে সামান্য একটু লম্বা হয়েছে। নয়তো বিয়ের প্রথম প্রথম তো আদ্রর গলা আঁকড়ে ধরতে হাল বেহালে পরিণত হতো। ভ্রান্ত হোক অথবা ভ্রম তুলি খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল মনে মনে। আদ্র গায়ের জ্যাকেট টা খুলে তুলির গায়ে জড়িয়ে দিল। সাথে সাথেই শুনতে পেল তুলির উৎকন্ঠিত আওয়াজ।

” লাগবে না ডাক্তার সাহেব। ঠান্ডা লাগছে না তো।”

সারা দুপুর,বিকেল ভ্যাপসা গরমে অবস্থা নাজেহাল হলেও এখন মৃদু মৃদু ঠান্ডার সমারোহ। ট্রেনের গতিতে বাহিরের বাতাস এসে মাঝে মাঝে শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে।

” লাগবে।”

আদ্রর নির্লিপ্ত প্রতুত্তরে আর কিছুই বলার সাহস পেল না তুলি। আদ্রর সাথে এগিয়ে এল দরজা পর্যন্ত। দেখল একটা বয়স্ক লোক একপাশে বসে বসে ঝিমাচ্ছে। সামনে বাদাম রাখা। হয়ত বাদাম বিক্রি করেন। লোকটা হঠাৎ চোখ মেলতেই খানিকটা লজ্জা পেয়ে গেল তুলি। সংকোচ ঘিরে ধরল তাকে। নিমিষেই আদ্রর থেকে কিছুটা সরে গেল। আদ্র সবটাই খেয়াল করল। তুলি কে কাছে টেনে নিয়ে সবটুকু দূরত্ব ঘুচিয়ে দিল অনায়সে। লহু স্বরে বললো,

” তোমার আমার মাঝে দূরত্ব মানায় না তুলা।”

তুলির বক্ষস্থল কেঁপে উঠল আদ্রর বলা বাক্য টা কর্ণে প্রবেশ করা মাত্র। ভালোবাসা কখনও আকাশসম হয়?হতে পারে। যদি হয় তবে এক আকাশসম ভালোবাসা অনুভব করেছে তুলি আদ্রের মুগ্ধ কন্ঠে। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় কাজ করে আদ্রর বলা প্রতিটি কথা তুলির হৃদপিণ্ডে।

তুলি কে এক হাতে জড়িয়ে নিল আদ্র। বাদামওয়ালা বয়স্ক লোকটার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে উঠল,

” কেমন লাগছে আমাদের চাচা?যদি ভালো লাগে তবে ঝটপট বাদাম দিন তো। বিয়ের এক বছর পেরিয়ে গেল এখনও বউকে নিয়ে বাদাম খাওয়া হয় নি। ”

আদ্রর এমন কথায় লজ্জা পেল তুলি। কঠিন রকমের লজ্জা। এভাবে না বললে কি হতো না আদ্রর?তুলির মনে হচ্ছে আদ্রর উচিত ডাক্তারি ছেড়ে দিয়ে মাতাল প্রেমিকের ট্যাগ নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর। লোকটা কাঁপা কাঁপা হস্তে বাদাম এর ঠোঙ্গা টা এগিয়ে দিলেন আদ্রর দিকে। আদ্র হাতে নিয়ে তুলি কে ধরতে বললো। তারপর ওয়ালেট থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে লোকটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নম্রতার সহিত বললো,

” টাকা টা রাখুন চাচা। আমি যে ওষুধের নামটা কাগজে লিখে দিয়েছি রেখেছেন কাছে?”

লোকটা ছোট্ট করে বললো,

” রাখছি।”

” ওষুধ টা কিনে নিবেন। বুক ব্যাথা টা কমেছে এখন?”

” কমছে বাবা। ”

” এটা তেমন সিরিয়াস কিছু না৷ আপনার বয়স হয়েছে, এ বয়সে এভাবে ঘুরে ঘুরে কাজ করাটা কষ্টকর। ”

তুলি একদৃষ্টিতে আদ্রর দিকে তাকিয়ে রইল। উত্তেজিত সুরে প্রশ্ন করল,

” চাচার জন্যই কি এতক্ষণ ধরে এখানে ছিলেন?”

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো আদ্র। হুট করেই স্বামীর প্রতি সম্মান বেড়ে গেল তুলির। তুলির জন্য আচার, চিপস কিনতে এক স্টেশনে ট্রেন থামাতেই নেমে পড়েছিল আদ্র। পরক্ষণেই কল দিয়ে জানিয়েছিল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে,কিছু সময় পর আসবে। চাচা উঠে দাঁড়ালেন। তুলির মাথায় হাত রেখে বললেন,

” ভালা স্বামী পাইছো তুমি। কষ্ট দিও না কোনোদিন। ”

দৃঢ় পায়ে হেঁটে চলে গেলেন চাচা। তুলি সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দরজা দিয়ে বাহিরে তাকাল। আদ্রর বুকের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে রইল চুপটি করে। কানের পিঠে আদ্রর গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়তেই শিউরে উঠল পুরো দেহ। আদ্র তুলি কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। গালে হাত রেখে বললো,

” ভালোবাসি তুলা। ”

তুলির বুক ভরে উঠল আনন্দে। নিমেষে মাথা এলিয়ে দিল আদ্রর বক্ষে। আদ্রর চোখে বিঁধেছে ডাগরডাগর আখিঁদ্বয়ের উপর একটুখানি লাজুক হাসির আভা। সাথে সাথেই তৃপ্ততা নিয়ে তুলিকে চেপে ধরল নিজের বলিষ্ঠ বাহু বন্ধনে। তুলির মুখে ভালোবাসি শব্দটা আসে না। আদ্রও তো বলে না সচরাচর। হুট করে যখন বলে তখন তুলি স্তব্ধ হয়ে যায়,অল্পক্ষণ লাজুক হাসে। সেই হাসিটুকুই যেন আদ্রের কাছে ঢেউ ভাঙার শব্দ মনে হয়, কল কল করে ছুটে বেড়ায় অন্তরে।
_______

ভোর ৪ টা ৩০ মিনিটে রাজশাহী এসে পৌঁছাল আদ্র রা। স্টেশন হতে দু’টো অটো ভাড়া করে এসে পৌঁছাল একটা গেইটের সামনে। আমরিন,নিবিড়, তুলি সকলে অটো থেকে নেমে দাঁড়াল। সাগর রিমি কে ধরে নামাল অটোরিকশা থেকে। সায়েরা বেগম,রাদিফ সাহেব একপাশে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেন। খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে সবাইকে। ভাড়া মিটিয়ে আদ্র সবাইকে নিয়ে পা বাড়াল। একজন লোক দৌড়ে এলেন। লোকটা কে তুলি চিনে না। রাদিফ সাহেব কে সালাম দিল লোকটা। বয়স হয়ত পঁয়ত্রিশ কিংবা সাঁইত্রিশ হবে। আদ্র উদ্বেল স্বরে জিজ্ঞেস করল,

” বাচ্চা টার কি অবস্থা? ”

লোকটা মাথা নত করে জবাব দিল,

” একটু আগে মইরা গেছে স্যার। আপনেরা তো আইতাছেন তাই আর ফোন কইরা কয় নাই কেউ। ”

#চলবে,,,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব__৪৩

হন্তদন্ত হয়ে আদ্র ছুটে গেল গেটের ভিতরে। তুলি বিস্ময়াহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনেকটা সময়। কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে হকচকালো,দৈবাৎ দৃষ্টি ফেলল পাশে। আমরিন কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা মলিন কন্ঠে বললো,

” ভিতরে চল।”

প্রভাতের স্নিগ্ধ বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে তুলির সমস্ত দেহ। কি হচ্ছে,কোথায় এসেছে কিছুই তুলি জানে না তবে আদ্রর পাগলের মতো ছুটে যাওয়া তুলির হৃদয়পটে তীরের ন্যায় কিছু একটা বিঁধেছে। যার ফলে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করছে তুলি। হয়ত রক্তাক্ত হয়েছে হৃদপিণ্ড। বুকের বা পাশে বিরাজমান ব্যাথা নিয়ে তুলি পা বাড়ালো। নিত্যি নিত্যি পায়ে হেঁটে গেইটের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করল। নত মস্তক সম্মুখে নিবদ্ধ করা মাত্র দেখতে পেল স্কুল ঘরের মতো লম্বা একটা তিন তালা বিল্ডিং। কৌতূহল দৃষ্টিতে চারদিকে নজর বুলাতে লাগল অনবরত। কন্ঠনালি হতে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এল,

” এটা কি কোনো এতিমখানা?”

পাশে অবস্থিত আমরিন সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,

” এটা এতিমখানা নয় তুলি। তবে এমন কিছু চাইল্ডরা এখানে বাস করে যাদের খাওয়া,পড়া,চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে এই জায়গায়। ”

আমরিনের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারল না তুলি। উৎসুক এবং প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আমরিনের দিক। তা বুঝতে পেরে আমরিন পুনরায় বলতে শুরু করল,

” ক্যান্সার আক্রান্ত বাচ্চাদের রাখা হয় এখানে। ক্যান্সারের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল সেটা তো জানিস। আবার অল্প বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বাচ্চারা কেমন নেতিয়ে পড়ে,ভয় পায়। সেই সকল বাচ্চাদের এখানে রেখে সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়। ”

এতক্ষণে তুলি বুঝতে সক্ষম হলো সবটুকু। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,

” বাচ্চা টা যে মারা গেছে ক্যান্সার আক্রান্ত ছিল?”

“হু।”

জবাব দিতে গিয়ে গলা ধরে এল আমরিনের। এই বাচ্চাগুলোর জন্য অনেক কষ্ট হয় তার। যতবারই দেখতে আসে বাচ্চাগুলোকে তখন মনে হয় কেন তাদের জীবনের আয়ুষ্কাল এত সামান্য!কিছুটা দীর্ঘ হলে কি খুব ক্ষতি হতো? পরক্ষণেই মনে হয় আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। তুলির চোখ থেকে টপটপ করে দুই ফোঁটা অশ্রু ঝরে গেল। চাপা যন্ত্রণায় বিষাক্ত হয়ে উঠল ভিতরটা।
সবার সাথে দু’তলায় এসে দেখল আদ্র স্থির দাঁড়িয়ে আছে রুমের সামনের লম্বা বারান্দা টায়। দৃষ্টি তার সূদুর কোথাও। মুখ দেখে বুজবার জো নেই ভিতরকার অনুভূতি।

তুলি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দোটানায় পড়ে গেল আদ্রর কাছে যাবে নাকি কক্ষের অভ্যন্তরে। মাথা উঁচিয়ে সামান্য উঁকি দিল রুমের মধ্যে। মুহুর্তেই মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল তার। সারা শরীর কাঁপতে লাগল ক্রমাগত। ফ্লোরে পাটি বিছিয়ে শুয়ে রাখা হয়েছে বাচ্চা টাকে। চেহারাটা উম্মুক্ত। কি স্নিগ্ধ, সৌন্দর্য স্থির হয়ে আছে মুখটাতে!পাঁচ – ছয় বছর হবে বাচ্চা টার। খুব সুন্দর করে প্রাণহীন দেহটা এলিয়ে রেখেছে। মুখটা হাসোজ্জল। কেন এত কম আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে আগমন হলো মেয়েটার? মুখে হাত চেপে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল তুলি। তার কোমল মন মেনে নিতে পারছে না কঠিন এই দৃশ্যটুকু। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে লাগল ফুপিয়ে ফুপিয়ে। কেন এতো মায়া-মমতায় জড়িয়ে গেছে জীবনটা?এই বাচ্চা টা নাহয় অবুঝ ছিল কিন্তু তুলি?মৃত,নির্জীব দেহ টা তুলির মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। প্রচন্ড অভিশঙ্কায় ভুগছে মন। বাচ্চাটার সাথে কোনো রকম সম্পর্ক নেই তবুও বুক ফেটে বেরিয়ে আসছে জল। কিন্তু প্রিয় মানুষ গুলো?যাদের সাথে রয়েছে আত্মার সম্পর্ক?তাদের এমন পরিণতি দেখার আগে নিজের মৃত্যু কামনা করে ফেলল তুলি মনে মনে। বেড়ে গেল ফুঁপানোর শব্দ। লম্বা বারান্দায় তড়তড় করে ছড়িয়ে পড়ল শব্দটা মৃদু মৃদু।

কর্ণ খাড়া হয়ে গেল আদ্রর। ভঙ্গ হলো বিমূর্ত দৃষ্টি। পিছন ঘুরে তাকাতেই ধুক করে উঠল বুক টা। হুট করেই অজানা এক ব্যাথায় পুরো শরীর অসাড় হয়ে পড়ল। সামনে হাঁটু মুড়ে বসে তুলি কাঁদছে। চোখে মুখে বিধস্ত ভাব। শরীর টা নেতিয়ে পড়ার উপক্রম। আকস্মিক তুলির এমতাবস্থায় আদ্রর দম বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। বহু কষ্টে পা ফেলে তুলির সামনে বসল। কিন্তু তুলির অবস্থার নড়চড় হলো না। হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিল আদ্র। দ্রুত পায়ে ছুটে এল অন্য একটা খালি কক্ষে। তুলি কে খাটে বসিয়ে গালে হাত রেখে অস্থির কন্ঠে ডাকল,

” তুলা।”

স্তব্ধ হয়ে আছে তুলি। নিরুত্তর হয়ে করুন চাহনি নিক্ষেপ করল আদ্রর রক্তিম চক্ষু যুগলে। ইতিমধ্যেই আদ্রর ফর্সা চেহারায় অস্থির ভাব স্পষ্ট। তুলি নিজের হাত টা আদ্রর চুলের ভাঁজে ডুবালো। এতো ভালো কেন বাসে এই ডাক্তার সাহেব তাকে?সামান্য একটু শকই তো পেয়েছে আচমকা ছোট একটা বাচ্চার নিথর দেহ দেখে, তাই বলে এত অস্থির হতে হবে আদ্র কে?আচ্ছা এই বাচ্চা টার মতো তো তুলি নিজেও একদিন চলে যাবে তখন কি তার ডাক্তার সাহেব কাঁদবে নাকি অতীত পিছনে ফেলে জীবনে অগ্রবর্তী হবে?প্রশ্ন টা তুলির মস্তিষ্কে উদয় হলেও মন বললো,” প্রাণ এবং তোকে যদি বাছাই করার শর্ত উঠে তাহলে আদ্র নিঃসন্দেহে তোকেই বেছে নিবে তুলি। তোকে ছাড়া তোর ডাক্তার সাহেব কখনও থাকতে পারবে না। ”

নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলো তুলি। আদ্রর বুকে মুখ গুঁজে সাদা শার্ট টা খামচে ধরল। চোখ ছাপিয়ে নেমে এল জল। অশ্রুতে মেখে দিতে লাগল শার্ট টা। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,

” আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি আদ্র। কখনও ছেড়ে যেতে চাই না আপনাকে। আপনি আমায় শক্ত করে জড়িয়ে রাখুন প্লিজ। ”

আদ্র বুঝতে পারল বাচ্চা টাকে দেখে কষ্টদায়ক প্রভাব পড়েছে তুলির মনে। এমনিতেই মেয়েটা খুবই নরম প্রকৃতির,চোখের সামনে এমন একটা সিচুয়েশন মেনে নিতে হিমশিম খাচ্ছে রীতিমতো। হাতের বাঁধন প্রগাঢ় করল আদ্র। তুলির দু’গালে হাত রেখে ললাটে অধর জোড়া ছুঁয়াল। বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না স্পর্শ টুকু। তুলির গাল থেকে হাত সরিয়ে এনে সোজা হয়ে বসল আদ্র। ঠোঁটের কার্ণিশে স্মিত হাসি নিয়ে বললো,

” তোমার বয়স কতো?”

আদ্রের এমন প্রশ্নে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল তুলি। ভেজা কন্ঠে বললো,

” উনিশ।”

” আমার কাছে মনে হচ্ছে আমার বউয়ের বয়স ২-৩ বছর। ২-৩ বছরের বাচ্চা রা যেমন করে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কাঁদে ঠিক তেমনভাবেই আমার বউ আমার বুকে আসার জন্য কাঁদছিল। সত্যি বলছি না বউ?”

আদ্রের কথায় কান্নার মাঝেই ফিক করে হেসে দিল তুলি। লজ্জাও পেল খানিকটা। সাথে এটাও বুঝল আদ্র তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই জায়গাটার সাথে,বাচ্চাগুলোর সাথে আদ্রর কি সম্পর্ক কিছুই তো জানতে পারল না। হাত টানে সম্বিৎ ফিরে পেল। আদ্র নিচু কন্ঠে বললো,

” চলো।”

গুটি গুটি পায়ে পাশাপাশি হেঁটে এসে একটা জায়গাতে স্থির হলো দু’জন। সামনে তাকিয়ে দেখল অনেকটা দূরে সাইনবোর্ডে লিখা আছে, কবরস্থান। তুলি তব্দা খেয়ে গেল খানিকক্ষণের জন্য। আদ্র তাকে কেন এখানে নিয়ে এল একদম ঠাহর করতে পারল না। পিছনে তাকাল তুলি। তিন তলা বিল্ডিং হতে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। তার মানে এই কবরস্থান টা এই জায়গারই অংশ। কিন্তু এখানে কবরস্থান কেন?তুলি কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই শুনতে পেল আদ্রর বিষাদমাখা কন্ঠ।

” আজ এখানে আসার কারণ কি তোমাকে তো বলা হয় নি তুলা। কেউ বলেছে?”

তুলি মাথা নাড়িয়ে না করল। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আদ্রের দিকে। আদ্র সেদিকে এক পলক চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলতে লাগল,

” আজ আমার দাদার মৃত্যুবার্ষিকী। দূরে যেই কবরস্থান টা দেখতে পাচ্ছো এখানেই আমার দাদা কে সমাহিত করা হয়েছে।”

তুলি চমকালো। আদ্রর ফ্যামিলি সম্পর্কে এতোটা জানা নেই তার। সে ভেবেছিল হয়ত আদ্রের দাদা বান্দরবানে নিজ বাড়িতে মারা গেছেন কিন্তু আজ, এই মুহুর্তে জানল অন্যকিছু। চমকিত নয়নে চাইতেই চোখে আটকা পড়ল আদ্রর দু’চোখ। আদ্র আলতো স্বরে প্রশ্ন করল,

” বান্দরবানে যে ডায়েরি টা দিয়েছিলাম,পড়েছিলে বউ?”

#চলবে,,,