আকাশে তারার মেলা ২ পর্ব-৫২+৫৩

0
691

#আকাশে_তারার_মেলা_২
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব_[৫২+৫৩]

প্রগাঢ় বিভাবরী। প্রকৃতি নির্জীব, স্তব্ধ। ফোঁপানোর শব্দ কর্ণধার হতে শুরু করল। গাঢ়ঘুম হালকা হয়ে এল আদ্রর। ঘুমের দাপটে চক্ষু জোড়া মেলতে পারছে না। শব্দ টা বেড়ে চলেছে ক্রমশ। তীক্ষ্ণ ভাবে প্রবেশ করছে শ্রবণ গ্রন্থিতে। বক্ষে ভেজা ভাব অনুভব হলো। সম্পূর্ণ রূপে তন্দ্রা কেটে গিয়ে ছ্যাৎ করে উঠল অন্তর টা। ধপ করে চক্ষুদ্বয় মেলে তাকাল। তুলি বেশ জোরেই কাঁদছে এখন। মেয়েটার কান্নারত ধ্বনি আদ্র কে অস্থির করে তুলছে। বিষাক্ত ফোঁড়ার ন্যায় বিষাক্ত যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে পড়ল পুরো দেহ।

‘ কি হয়েছে তুলা?কাঁদছ কেন?’

তুলি তখনও কেঁদে চলেছে। মুখে কিছুই বলছে না মেয়েটা। অথচ আদ্র পাগলের মতো জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে, প্রলাপ করছে। একটা সময় রেগে বুক থেকে সরিয়ে উঠে বসল। রাশভারি কন্ঠে বললো,

‘ না বললে আমি কিভাবে বুঝব?তোমার শরীর খারাপ লাগছে?পেট ব্যাথা করছে বউ?বলো প্লিজ। কষ্ট হচ্ছে আমার। এভাবে কেঁদো না।’

‘ পা,,পা দু’টো অসম্ভব ব্যাথা করছে। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার আদ্র।’

দ্রুত গতিতে পায়ের কাছ থেকে কাপড় সরিয়ে ফেলল আদ্র। দৃশ্যমান হলো তুলির ফুলে যাওয়া পা দুটো। হয়ত পায়ে পানি এসেছে। প্রেগন্যান্সি তে এমন হয় তা সম্পর্কে অবগত আদ্র। কিন্তু তুলির বেলায় কেন হতে হবে?নাহলে পারত না!নয় মাস চলছে মেয়েটার প্রেগন্যান্সির। গত কয়েকদিন ধরে একটুও শান্তিতে ঘুমোতে পারছে না মেয়েটা। আদ্রর ইচ্ছে করে তুলির সকল কষ্ট নিজের ভাগে নিয়ে নিতে কিন্তু পারে না। এ ক্ষেত্রে যে সে বড্ড নিরুপায়! দ্রুত গতিতে মোবাইলটা হাতে নিয়ে পায়েলকে কল দিল। খুলে বলল সবটুকু। এই সময় এটা নরমাল হলেও পায়েলের নিজেরও খুব খারাপ লাগছে। তুলি খুব নাজুক। শুধু যে মনের দিক থেকে তা নয়। শরীরও খুব একটা ভালো না। দিন দিন যেন দুর্বলতা বেড়েই চলছে। পায়েল অন্তুকে জাগিয়ে তুলে এই গভীর রাতেই বেরিয়ে পড়ল আদ্রদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। তুলি কষ্ট পাচ্ছে অথচ সে শান্তিতে ঘুমাবে তা হয় না। ছোট বোন নেই। মেয়েটা ছোট বোনের জায়গা দখল করেছে তার জীবনে। কষ্ট কমিয়ে দিতে না পারলেও চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই।

আদ্র মাথার চুল টানছে পাগলের মতো। তুলির পায়ের কাছে বসে মুভ লাগিয়ে টিপে দিতে লাগল। থমকে গেল তুলি। ধুক করে উঠল বুকটা। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বললো,

‘ কি করছেন আপনি আদ্র?’

‘ ব্যাথা কমানোর চেষ্টা। ‘

তুলি চুপ হয়ে রইল। আদ্রর কথার ভাঁজে কিছু বলতে পারল না। সে জানে তার এই ব্যাথার চেয়েও অত্যাধিক ব্যাথা বিস্তার লাভ করছে আদ্রর বক্ষস্থলে। এখন আর শব্দ করে কাঁদছে না৷ চোখের কার্নিশ গড়িয়ে জল বালিশ ভিজিয়ে দিচ্ছে অতি সন্তর্পণে। নিষ্পলক তাকিয়ে রইল আদ্রর দিকে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। চেহারায় বেদনা,অস্থিরতা স্পষ্ট। আচ্ছা সব স্বামী কি তার অর্ধাঙ্গিনী কে বুঝে?ঠিক আদ্রর মতো করে!এই মানুষ টা প্রেগন্যান্সির এতগুলো মাস আগের থেকেও বেশি আগলে রেখেছে। বেশি বললে ভুল হবে। কারণ আদ্রর আগলে রাখার তুলনা হয় না। কিন্তু তুলি জানে এই কয়েকটা মাস কেমন ঝড় যাচ্ছে আদ্রর উপর দিয়ে। হসপিটালে ডিউটি, বাসায় এসে তুলির দেখাশোনা, সারা রাত নির্ঘুম কাটানো। এসব কি যথেষ্ট নয় একটা সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করে তোলার জন্য? তুলির যন্ত্রণা হয়। নিজের জন্য নয় বরং তার ডাক্তার সাহেবের জন্য।

তুলির এখনও মনে আছে,কয়েক মাসে আগে যখন ডায়েরি টা অসমাপ্ত পেয়েছিল তখন অভিমান করেছিল। অতঃপর আদ্র নিজ থেকেই বললো সবকিছু। তুলি আদ্রকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করে নি। না জিজ্ঞেস করতেই ওই অসমাপ্ত অংশ হতে আদ্রর বলতে শুরু করা বুঝিয়ে দিয়েছিল নিজ থেকেই বাকিটুকু মুখে বলতে চেয়েছিল। তুলি স্রেফ প্রশ্ন করল, মেম্বারের ছেলেকে যেদিন মারল আদ্র কিভাবে জানল তেঁতুল তলা দিয়ে বাড়ি যাবে সে। পাকা রাস্তা দিয়ে তো যায় নি। আদ্র নির্পিল্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিল,

‘ সেদিন তোমাকে দেখতেই গিয়েছিলাম। স্কুলে নৃত্য দিবে সেটা আমার জানা ছিল না। সবার সামনে নৃত্য দিয়েছ তাতে মাথা বিগড়ে গিয়েছিল আমার। তোমাকে শায়েস্তা করব বলে পিছু পিছু এসেছিলাম। অপেক্ষা করছিলাম শুধু একটা নির্জন জায়গার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার ফোনে কল আসে। রিসিভ করে কথা বলতে বলতে দেখতে পেলাম কাঁচা রাস্তায় নেমে পড়েছ তোমরা। কথা শেষ করে দ্রুত গতিতে তেঁতুল তলায় আসতেই আগে থেকে বিগড়ানো মেজাজ, মস্তিষ্কে রক্ত উঠে গেল। গরম লাভার ন্যায় টগবগিয়ে উঠল রক্ত। মনে শুধু একটা কথায় বলছিল ওই জানোয়ার যদি তোমাকে স্পর্শ করে তবে জ্যান্ত পুঁতে ফেলব এখানে। তোমার বাবার দেওয়া শর্তও মানব না। নিজের কাছে চিরতরে নিয়ে আসব তোমাকে। মা যেদিন তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তোমার বাবা নাকচ করে দেন। ইচ্ছে করছিল তোমাকে মেরে ফেলি,নিজে মরে যাই। বয়সের ব্যবধান এতোটাই কি বেশি হয়ে গেল উনি আমার কাছে তোমাকে দিবেন না!খালামণি,মা মিলে তোমার বাবা কে রাজি করাল। তবুও তিনি শর্ত রাখলেন তোমার আঠারো নাহলে বিয়ে দিবেন না। শুধু এতটুকুই না,অবশ্যই তোমার মর্জি থাকতে হবে বিয়েতে,নিজ মুখে বলতে হবে তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও। সেদিন থেকে এক দন্ডও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারি নি। প্রচন্ড ভয় ঝেঁকে থাকত তুমি আমাকে চাইবে তো!ভালোবাসবে তো। ভিতরে ভিতরে প্রতিনিয়ত ভেঙে পড়ছিলাম আমি,যখন তোমাকে দেখতাম মন বলত ঠিক একদিন তুমি আমাকে চাইবে। মেম্বারের ওই চরিত্রহীন ছেলেকে বেশি না শুধু সারাজীবন কোনো মেয়ের দিকে হাত বাড়াতে পারবে না, চোখ তুলে তাকাতে পারবে না এমন ব্যবস্থা করেছি।’

তুলি আমতাআমতা স্বরে প্রশ্ন করে,

‘ মানে?’

‘ ওর দু-হাতের রগ কেটে দিয়েছি,চোখও অন্ধ হয়ে গেছে। সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে থাকবে। তোমাদের গ্রামের মেম্বার ছেলের চেয়েও টাকা কে বেশি ভালোবাসে তাই খুব একটা কষ্ট করতে হয় নি। চিকিৎসাও করিয়েছি,জানে মারি নি।’

আদ্রর এই ভয়ংকর রূপ সম্পর্কে তুলি কোনোদিনও আভাস পায় নি। সাথে সাথেই আদ্রর বুকে থেকে ছিটকে সরে গিয়েছিল। হাত টা ধরে খুব কাছে টেনে নিয়েছে আদ্র, অনবরত কাঁপতে থাকা তুলির দিকে তাকিয়ে নরম কন্ঠে বলে উঠল,

‘ সব সহ্য হয় তবে আমার তুলার দিকে হাত বাড়ালে মনে হয় আমার প্রাণ কেঁড়ে নিতে আসছে কেউ। নিজের প্রাণ কে-ই বা ত্যাগ করতে চায় বলো?’
.
.
পেটে গভীর স্পর্শে তুলির সারা শরীর শিউরে উঠল। বেরিয়ে এল স্মৃতিচারণ হতে। পায়ের ব্যাথাও কমে গেছে অনেকটা। আদ্র পেটে ছোট ছোট চুমু এঁকে দিচ্ছে। যখনই তুলির কষ্ট হয় এমন করে আদ্র। অতঃপর তুলি বুঝতে পারে কষ্টের মাঝেও রয়েছে হাজারো সুখের সমারোহ। আদ্রর এই অতিরিক্ত ভালোবাসা, পাগলামি তুলি কে ভীষণ ভাবায়। শুনেছে অতিরিক্ত সুখ অতিরিক্ত দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তুলির যে অতিরিক্ত সুখটাই চায়।
__________

সুন্দর একটি সকাল,সুন্দর কিছু মুহুর্ত। পায়েল, অন্তু গত রাতে এসেছিল এখন বেরিয়ে গেল নাস্তা করে। নিবিড়,আহান,ঝুমু,আমরিন ড্রইং রুমে বসে আছে। আজ আর কলেজে যাবে না একটু পরেই তো বেরিয়ে যেতে হবে। মেডিক্যালে ভর্তি হবার পর এই প্রথম ক্লাস মিস দিচ্ছে। আমরিনের ডিএমসিতে চান্স হয়েছে। তুলির হয় নি। তবে তাকে আফসোস করার সুযোগ দেয় নি আদ্র। উল্টো বলেছে সে চায় নি কখনও তার বউ ডাক্তার হোক। তার ইচ্ছে তার বউ একজন টিচার হবে। তুলিও আদ্র কে নিরাশ করে নি। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে বায়োলজি সাবজেক্টে ভর্তি হয়েছে সে। আপাতত প্রেগন্যান্সির জন্য নিয়মিত ক্লাস করতে পারছে না। তুলির বেবী হয়ে গেলেই আমরিন ও নিবিড়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। আহান ও ঝুমুর বিয়ে হয়েছে গত মাসে। তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানও পেন্ডিং আছে তুলির জন্য। তুলির খারাপ লাগে আবার ভালোও লাগে এই ভেবে সবাই কতটা ভালোবাসে তাকে। আদ্র নাস্তার প্লেট নিয়ে তুলির পাশে বসতেই ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করে কানে দিতেই অপরপাশ থেকে ভেসে এল জারিফার কান্নার শব্দ।

‘ কান্না করছো কেন গালফ্রেন্ড?তোমার বার্থডে আর আমরা আসব না?একটু অপেক্ষা করো দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে যাব আমরা। তোমার তুলা কেও নিয়ে যাব সাথে। আদর দিও কিন্তু!’

আজ জারিফার জন্মদিন। আদ্রকে ছাড়া কেক কাটবে না বলে জেদ দেখিয়ে বসে আছে। দাদা-দাদি গ্রামে থাকায় সেখানেই সেলিব্রেট করা হবে। আদ্র তুলির মুখে নাস্তা তুলে দিতে দিতে বললো,

‘ সবাই রেডি হয়ে নে। এক ঘন্টা পর বেরিয়ে যাব।’
.
.
আমরিন কালো রঙের একটা শাড়ি পড়ে, হালকা মেকআপ করে ফেলল। নিবিড় অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে পেছন থেকে ঝাপটে ধরল। ঘাড়ে অধর ছুঁয়ে বললো,

‘ সাগর এক মেয়ের বাপ হয়ে গেল,আদ্রও হয়ে যাচ্ছে। দেখা যাবে অন্তুও দু দিন পর চিল্লিয়ে বলবে আমি বাপ হচ্ছি,আমি বাপ হচ্ছি। কিন্তু আমি!আমি এখনও ফুলশয্যা টা-ই করতে পারলাম না। হায়রে কপাল।’

নিবিড়ের আফসোসের স্বর শুনে আমরিনের পেট ফেটে হাসি আসার উপক্রম। লজ্জাও লাগছে ভীষণ। গাল দুটো হঠাৎ করেই কেমন লাল লাল আভায় ছেয়ে গেল!
_________

জানালার ধারে মাথা ঠেকিয়ে প্রকৃতি দেখতে নিমগ্ন তুলি। জারিফাদের গ্রামের বাড়ি গন্তব্য। দূর হতে ধেয়ে আসা বাতাস মৃদু মৃদু ভাবে তুলির মুখশ্রী ছুঁয়ে যাচ্ছে। অবাধে উড়িয়ে দিচ্ছে কেশ। মাথা কিছুটা বের করে পিছন তাকাল। কই!নিবিড়দের গাড়ি দেখা যাচ্ছে না। হয়ত অনেকটা দূরে রয়ে গেছে এখনও। পেটে লঘু চাপ পড়তেই ব্যাথায় মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এল চিৎকার। সাথে সাথে আদ্র চোখ রাঙিয়ে বললো,

‘ নিষেধ করেছি মাথা বের করতে। এমন করলে পেটে চাপ তো পড়বেই। তোমার কি আমার কথা অমান্য করার রোগে পেয়েছে?’

আদ্রর রাগান্বিত কন্ঠে চুপসে গেল তুলি। বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ সোজা হয়ে বসল। গাড়ি ছুটে চলেছে। এতো মাস পর সূদুর কোথাও যেতে পারছে এতেই তুলির মন ভালো হয়ে গেল। প্রকৃতির সজীবতায় বিভোর নেত্রদ্বয়। গাড়ি যতদূর এগিয়ে যাচ্ছে চোখে পড়ছে ছোট খাটো পাহাড়। তুলির ভীষণ ভালো লাগে পাহাড়ি পরিবেশ। আদ্রর দিকে তাকিয়ে আলতো হাসল। সাদা শার্টের উপর কালো ব্লেজার পড়েছে আজ আদ্র। সুন্দর মানুষকে শুভ্র রঙে যেন আরো দ্বিগুণ সুন্দর লাগে। তুলি নিজের দিকে তাকাল। আজ তাকেও খারাপ লাগছে না। সাদা জামদানী এবং উঁচু পেটে মিষ্টি মিষ্টি লাগছে। তবে আদ্রর থেকে কম। এ মুহুর্তে তুলির প্রচন্ড ভালোবাসা পাচ্ছে। খুব করে ইচ্ছে করছে আদ্র কে বলতে-‘ আমি একটুখানি ছুঁয়ে দেই আপনাকে?’

স্মিত হেসে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকাতেই তুলি ভড়কে গেল। তড়িৎ গতিতে ফিরে চাইল আদ্রর দিকে। আদ্রর চোখে মুখে ভয়। আচমকা বদলে গেছে মুখের আদল। নিমিষেই তুলির দৃষ্টি ভয়ার্ত হয়ে উঠল। রক্ত হিম হয়ে আসছে তার। কথা আঁটকে যাচ্ছে গলায়। বহু কষ্টে বললো,

‘ গাড়ি ওইদিকে নিয়ে যাচ্ছেন কেন?এদিকে তো খাদ আর খাদ। আপনিই তো আসার সময় বললেন। ‘

আদ্রর চোখ লাল হয়ে গেছে। করুণ স্বরে উত্তর দিল,

‘ ব্রেক কাজ করছে না। ‘

কথাটা কর্ণধার হওয়া মাত্র অন্তর আত্মা শুকিয়ে গেল তুলির। ব্রেক কাজ করছে না মানে?এখনই তো সব ঠিক ছিল। এক মুহুর্তে কিভাবে এমন হতে পারে!আদ্র এলোমেলো দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাল। সামনে ও ডানে খাদ। কেবল তুলির দিক হতে একটুখানি সমতল জায়গা। তুলি ঠকঠক করে কাঁপছে। ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে। ওরা যেন নিমিষেই মরণ ফাঁদে ফেঁসে গেল। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল আদ্র তুলির চিন্তা করে। গাড়ি যখন ব্রেক কাটাতে যাবে তখনই আদ্র ঠাওর করতে পারল ব্রেক কাজ করছে না। দ্রুত গতিতে সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি টা। যত এগিয়ে যাচ্ছে তুলিকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে ভিতরে ভিতরে শতাধিক বার মৃত্যুবরণ করছে সে। আগে একবার এখানে এসেছিল ঘুরতে। সামনে অনেক গভীর খাদ আছে, পড়লে বেঁচে ফেরার রাস্তা নেই। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে।

আদ্র তুলি কে টেনে নিজের বুকে নিয়ে এল। ফোন হাতে নিয়ে কল লাগাল নিবিড় কে। রিসিভ হতেই মলিন কন্ঠে বললো,

‘ আমার লোকেশন ট্র্যাক করে জলদি আয়। গাড়ি ব্রেক ফেল হয়ে গেছে। ‘

মুহুর্তেই কর্ণে ভেসে এল আমরিনের কান্নার শব্দ। হয়ত ফোন টা মেয়েটা ধরেছিল। আদ্র কিছু না বলেই কেটে দিল। তার বুক টা ক্রমশ ভারি হয়ে আসছে। তুলি নড়ছে না। নেতিয়ে পড়েছে ভয়ের চোটে। সামনে মৃত্যু দেখে নেতিয়ে পড়াটা কি স্বাভাবিক নয়?দু বাহু আঁকড়ে ধরে আদ্র টেনে সোজা করে বসাল। কঠিন স্বরে বলে উঠল,

‘ তোমাকে লাফ দিতে হবে তুলা।’

তুলি চমকিত নয়নে চাইল আদ্রর পানে। দু হাত দিয়ে আদ্রর কলার আঁকড়ে ধরে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠল,

‘ আমাকে লাফ দিতে হবে মানে?আপনি কি করবেন?আপনার ওইদিকে তো খাদ। ‘

‘ আমি দিব। সময় নেই তুমি লাফ দাও প্লিজ। এতটুকু দরজা দিয়ে একসাথে লাফ দেওয়া সম্ভব নয়।’–তাড়াহুড়ো কন্ঠে বললো আদ্র।

‘লাফ দিলে কি বেঁচে যাব আদ্র?’

পেটের দিকে ইশারা করল তুলি। সামান্য একটু আঘাত পেলেই তো জান বেরিয়ে যাবে তার। লাফ দিলে বাঁচবে কিনা সন্দেহ আছে। আদ্রর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। লাফ না দিলে খাদে পড়ে নিশ্চিত মৃত্যু দু’জনের। লাফ দিলে একটু হলেও তো বেঁচে যাওয়ার আশা টা থাকবে। তুলির ললাটে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিল গভীরভাবে। বুকে শক্ত করে জড়িয়ে বলল,’তুলনা আহনাফ অদ্রি’ রেখো আমাদের মেয়ের নাম। তুলি খামচে ধরল শক্ত করে বুকে। নখ বিঁধে রক্ত বেরিয়ে আসছে আদ্রর বুক হতে। তবুও ছাড়বে না সে। আদ্র কে ছেড়ে লাফ দিবে না। সামনের দিকে তাকিয়ে আদ্রর চোখ বুঁজে এল। এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় ব্যক্তি মনে হচ্ছে। নিজের মৃত্যুর ভয় নেই তার। কিন্তু তুলি কে নিয়ে একসাথে মৃত্যুবরণ করার সাহস নেই।

গাড়ি খাদের একদম নিকটে চলে এসেছে। হয়ত মিনিটের ব্যবধানে গড়িয়ে পড়বে। আদ্র বুঝতে পারছে তুলি তাকে ছেড়ে লাফ দিবে না। তারও যে মেয়েটাকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না একদম। সময়টা এতো স্বার্থপর কেন হলো?কেন এক নিমিষে তছনছ করে দিল সবকিছু? যারা এক্সিডেন্টে মারা যায় তাদের কি ঠিক এমন অনুভূত হয় যেমনটা হচ্ছে আদ্র, তুলি দু’জনের?আদ্র হাতের বাঁধন শিথিল করে ফেলল। টেনে বুক থেকে সরিয়ে দিল তুলি কে। রূঢ় কন্ঠে বললো,

‘ যদি এক সেকেন্ডও দেরি করিস আমি ধরে নিব তুই নিষ্ঠুর একজন মা। যে কিনা নিজের ভালোবাসার চিন্তা করে সন্তানকে নিয়ে মরতে চাইছে।’

তুলি ডুকরে কেঁদে উঠল। আদ্র দরজা মেলে দিল গাড়ির। তুলির চোখ গোলা হয়ে আসছে বারংবার জলে। চোখের পলকেই গাড়িটা গড়িয়ে যাবে খাদে। লাফ দেওয়ার আগে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে আওড়ালো,

‘ আমার পর আপনিও কিন্তু লাফ দিবে,,,’

তুলির কথা অসমাপ্ত রেখে নিজেই বাধ্য হয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল আদ্র। ব্যাথায় গগনবিদারী চিৎকার করল তুলি। শুভ্র, সাদা শাড়িটা রক্তে লাল হতে শুরু করল। নিভু নিভু চোখ দুটো দেখল কেবল গাড়িটির গড়িয়ে যাওয়া।

#চলবে,,

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। শব্দসংখ্যা ২০০৭।)