#আগুন_ঝরার_দিনে
#পর্ব_১২
আশফাকের ঘুম ভাঙলো অনেক বেলাতে। চোখ মেলে দিনের কড়কড়ে হলুদ আলো শরীরে লাগতেই তার দিনক্ষন সব গুলিয়ে গেল। চোখটা আবার বন্ধ করে নিজেকে কিছুটা সময় ধাতস্থ করার পর আশফাকের গতকাল রাতের কথা সব মনে পড়ল। গতকাল হঠাৎ করে দীপা তার উপর চড়াও হয়েছিল। কিছুক্ষণের জন্য আশফাক বুঝতে পারেনি কী হচ্ছে! কেন হচ্ছে! বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে দীপা তার উপর চড়াও হয়ে গেল কেন? তবে কয়েক মুহুর্ত পর দীপা যখন বলছিল, অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর সময় তার কেন একবারও দীপার কথা মনে পড়লো না তখন আশফাক বুঝতে পেরেছিল, দীপা কোনোভাবে রুহীর ব্যাপারটা টের পেয়ে গেছে এবং এরপররেই সে সবচেয়ে বড় ভুলটা করে বসেছিল।
অনেকটা প্রতিরক্ষার ভঙ্গিতে সে দীপাকে বলেছিল, তুমি রুহীকে চিনলে কী করে? আর তুমি ভুল ভাবছ দীপা। রুহী শুধু আমার ছাত্রী। তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
কথাগুলো বলার পর আশফাক করুণ চোখে দীপার দিকে তাকিয়েছিল। এমন একটা পরিস্থিতিতে যে কোনো পুরুষই নিজ স্ত্রীর করুণা ভিক্ষা চাইবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু দীপার পরের কথাটায় আশফাক বুঝতে পেরেছিল, বড় একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। সে বোকার মত দীপার ফাঁদে পা দিয়েছে। দীপা অনেকটা অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতই আশফাককে কথাগুলো বলেছিল। কিন্তু সে নিজেই রুহীর প্রসঙ্গ তুলে দীপার কাছে সব কিছু পরিষ্কার করে দিয়েছে।
দীপা রাগে অন্ধ হয়ে বলেছিল, এর মানে আমি এতক্ষন যা বলেছি তা-ই ঠিক? তোমার জীবনে আসলেই কোনো মেয়ে রয়েছে? আর সেই মেয়েটির নাম রুহী? সে তোমার ছাত্রী?
স্বাভাবিক ভাবেই আশফাক চুপ করেছিল। একবার কোনো কথা বলে ফেললে সেটা আর ফিরিয়ে নেয়ার কোনো উপায় নেই। তবুও সে তার ভুলটা শুধরে নেয়ার একটা শেষ চেষ্টা করেছিল। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলেছিল, আরে না না। আমি তো বললাম তুমি ভুল ভাবছো। রুহী কেন কোনো মেয়ের সাথেই আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
দীপা বলেছিল, তাহলে তুমি রুহীর কথা কেন বললে?
আশফাক সেই মুহুর্তে দীপার প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, মাথাটা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। দীপা কয়েকটা মুহুর্ত আশফকের জবাবের অপেক্ষা করেছিল। তারপর আশফাকের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একটু বাঁকা হেসে বলেছিল, তোমার জবাবের আমার প্রয়োজন নেই আশফাক। খুব ভালো মতই বুঝতে পারছি, আমি নিছক কোনো সন্দেহ করিনি। তুমি এখন যায়-ই বলো না কেন আমি আর তোমাকে বিশ্বাস করছি না। একটা কথা খুব ভালো মত জেনে রেখো আশফাক, ভালোবাসা হয়ত ফিরে পাওয়া যায় তবে বিশ্বাস একবার ভেঙে গেলে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না।
আশফাক কাতর গলায় বলেছিল, দীপা প্লিজ। একটু শান্ত হও। এভাবে মাথা গরম করো না।
দীপা কঠিন গলায় বলেছিল, আমার মাথা ঠিক আছে আশফাক। তবে আমার ভয় হচ্ছে তোমার আর তোমার ছাত্রীর মাথা ঠিক আছে তো? বিশেষ করে তোমাদের শরীর ঠিক আছে তো? নাকি ইতিমধ্যেই গরম শরীরগুলো তোমরা ঠান্ডা করে ফেলেছ?
আশফাক চুপ করেছিল। সত্যি বলতে কী আশফাক সেই মুহুর্তে দীপাকে রীতিমত ভয় পাচ্ছিল।
আশফাকের দিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে দীপা বলেছিল, থাক তোমার কিছু বলার দরকার নেই। আমি সত্যটা জানতে চাচ্ছি না। কিছু সত্য না জানাটায় হয়ত আমাদের দুজনের পক্ষে ভালো হবে।
তারপর আর কথা থাকে না। কথা শেষ হয়ে গিয়েছিল। অবাক হলেও সত্য, এরপর থেকে দীপা তার সাথে ভীষণ শীতল আচরণ করছিল। অন্য সময় সামান্য একটু মান অভিমান হলেই দীপা তাদের বিছানা আলাদা করে দেয় অথচ কাল রাতে দীপা দিব্যি তার পাশে শুয়েছিল। দীপার থেকে মাত্র কিছু দুরত্বে শুয়ে আশফাক দীপার ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কান্না করার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। আশফাক কয়েকবার দীপাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিল তবে লাভ হয়নি। তাতে দীপার কান্নার গতি এতটুকু কমেনি। অনেক রাত অবধি আশফাক নিজেও ঘুমাতে পারেনি। বিছানার এপাশ ওপাশ করেই রাত পার হয়ে গিয়েছিল। আশফাকের স্পষ্ট মনে আছে ফজরের আজান পর্যন্ত সে জেগে ছিল। তারপর তার আর কিছু মনে নেই। সারা রাত জাগরনের ক্লান্তিতে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল।
আশফাক ঘড়িতে দেখল দুপুর বারোটা বাজে। ভাগ্য ভালো আজ সকালে তার কোনো ক্লাস ছিল না। তবুও ক্লাস রুটিনটা আরেকবার চেক করার জন্য সে মোবাইলটা এদিক ওদিক খুঁজল। তার স্পষ্ট মনে আছে গতকাল রাতে শোবার সময় মোবাইলটা সে বালিশের পাশে রেখেছিল। তবে মোবাইল গেল কোথায়? মোবাইলটা কী দীপা সরিয়েছে? আশফাক ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবলো। মোবাইলটা যদি দীপা সরিয়েও থাকে তাহলেও কোনো লাভ হবে না। মোবাইল পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করা রয়েছে। এই পাসওয়ার্ড বের করার সাধ্য দীপার নেই।
আশফাক পুরো বাড়িতে দীপাকে খুঁজলো। দীপা কোথাও নেই। ল্যান্ডফোন দিয়ে সে দীপাকে ফোন করল। কয়েকবার রিং বেজে যাবার পরেও দীপা ফোন ধরল না। আশফাক দীপার বাবার বাড়িতে একটা ফোন করল। দীপা সেখানেও যায়নি। আশফাক বেশ অবাক হলো। রাগ করে সে বাবার বাড়িতে যেতে পারত। এটা দীপার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। এর আগে অসংখ্যবার এমন ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া এখন সেখানে বাবু রয়েছে। তবুও দীপা আজ বাবার বাড়িতে না যেয়ে অন্য কোথাও গিয়েছে। আশফাক দীপার যাওয়ার সম্ভাব্য জায়গাগুলো নিয়ে চিন্তা করলো। দীপার ছোটবেলার এক বান্ধবীর বাসা আছে মিরপুরে। আশফাক সেখানে ফোন করল। দীপা সেখানেও নেই। আরো কয়েকজন কাছের বন্ধুবান্ধবকে ফোন করার পর আশফাক বেশ চিন্তায় পড়লো। দীপা আর কোথায় যেতে পারে এই সম্পর্কে তার ধারনা নেই। হঠাৎ করে আশফাকের মাথায় একটা ভাবনার উদয় হলো। দীপা তার ক্যাম্পাসে যায়নি তো? কাল যেহেতু আশফাকের কাছে সে রুহী সম্পর্কে ধারনা পেয়েছে তাই দীপা হয়ত রুহীর সাথে দেখা করার জন্য ক্যাম্পাস পর্যন্ত গিয়েছে। চিন্তাটা মাথায় আসতেই আশফাক ভেতরে ভেতরে তীব্র আতঙ্কে জমে গেল। একমাত্র আল্লাহ জানেন দীপা এতক্ষণে ক্যাম্পাসে যেয়ে কী ঝামেলাটা বাধিয়েছে!
দীপা তার ক্যাম্পাসে যেতে পারে এই বিষয়টা তার আরো আগে ভাবা উচিৎ ছিল। আশফাক আবারো ঘড়ির দিকে তাকালো। সারে বারোটা বাজে। দীপাকে খুঁজতে তার অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছে। আশফাক আরেকবার ল্যান্ডফোন থেকে দীপাকে ফোন করল। মোবাইলে একটানা রিং বেজে গেলে। দীপা ফোন ধরল না। এদিকে রুহীর মোবাইল নাম্বার তার মুখস্থ নেই। এই যুগে কেউ কারো মোবাইল নাম্বার মুখস্থ করে রাখে না। মোবাইলে নাম্বার সেভ করে রাখে। তাই রুহীকে ফোন করে কিছু জানানোর সুযোগটুকুও আশফাক পেলো না।
আশফাক বেশ কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইল। এই মুহুর্তে তার মাথা কাজ করছে না। আজ দুপুর দুইটার পর তার তিনটা ক্লাস আছে। ক্লাসগুলো জরুরী। না নিলেই নয়। হালকা কিছু খেয়ে আশফাক ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
…………
দীপা চলে গেছে প্রায় ঘন্টাখানেক হলো। রুহী একই ভাবে ক্যান্টিনে বসে রয়েছে। তৃষ্ণায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে। অথচ পানি খাবার মত ইচ্ছে বা শক্তি কোনোটায় তার নেই। সুমি অনবরত ফোন করছে। একটু পর ক্লাস আছে। ক্লাসটা সম্ভবত আশফাক স্যারের। এই মুহুর্তে আশফাক স্যারের মুখোমুখি হবার সাহস তার নেই। দীপার বলা কথাগুলো বারবার তার কানে বাজছে। দীপার গলায় যতই কাঠিন্য থাকুক না কেন তার চোখে একটা হাহাকার মেশানো যন্ত্রনা ছিল। এই হাহাকারটুকু রুহীর ভেতরটাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। নিজের সামান্য কিছু ভালোলাগার অনুভুতির জন্য সে আজ একটা মেয়ের জীবন নিজের অজান্তেই নষ্ট করে দিয়েছে। যদি সত্যি সত্যি আশফাক আর দীপার সম্পর্কটা ভেঙে যায় তাহলে দীপা আর তাদের বাচ্চাটার কী হবে? আর এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়ে সে কি পারবে আশফাকের সাথে সুখি হতে? কিংবা আশফাক কি সত্যি তাকে মন থেকে মেনে নিবে? নাকি দীপা ছেড়ে গেছে বলে মেনে নিতে বাধ্য হবে? তাছাড়া বাবা মা! তারা যখন এতকিছু জানবেন তখন কী হবে? তারা কি এত কিছু জানার পরও তাকে নিজের মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করবেন? রুহী আর কিছুই ভাবতে পারলো না। দিপা তাকে একটা প্রশ্ন করেছিল। সেই প্রশ্নের উত্তর সে তখন দিতে পারেনি। এখন সেই প্রশ্নটা নিজেকে নিজেই একবার করলো। সে কি আসলেই আশফাককে ভুলে থাকতে পারবে? আশফাকের সাথে চিরদিনের মত যোগাযোগ বন্ধ করে সজলের সাথে সংসার করা তার পক্ষে কি আদৌ সম্ভব হবে? রুহীকে বেশিক্ষণ ভাবতে হলো না। তার সামনে উত্তরটা আপনাআপনি চলে এলো। রুহী অবাক হয়ে দেখল, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আশফাক।
“চলবে”
#আগুন_ঝরার_দিনে
#পর্ব_১৩
রুহী অবাক হয়ে আশফাকের দিকে তাকিয়ে রইল। অন্তত এই মুহুর্তে ক্যান্টিনে সবার মাঝে আশফাক স্যারকে সে আশা করেনি। তাছাড়া স্যারের এখন ক্লাস থাকার কথা। রুহী ভ্রু কুঁচকে ভাবলো, তবে স্যার কি ক্লাস না নিয়ে তার খোঁজে ক্যান্টিন পর্যন্ত এসেছেন?
আশফাক স্যারের কথায় রুহীর ভুল ভাঙলো। আশফাক স্যার চিন্তিত গলায় বলল, দীপা কোথায়? সকাল থেকে তার কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। ফোন করলেও ফোন ধরছে না। আমার দীপার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে।
রুহী ফ্যালফ্যাল করে আশফাকের দিকে তাকিয়ে রইল। দীপা আশফাকের স্ত্রী। দীপার জন্যে তার চিন্তা হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এই মুহুর্তে আশফাকের চিন্তার কিছু অংশ বোধহয় রুহীরও পাওনা ছিল। রুহী আশফাকের কথার কোনো জবাব দিল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
আশফাক আবারো বলল, দীপা কি এসেছিল? তোমার সাথে তার দেখা হয়েছে?
আশফাকের কথার সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে রুহী বলল, আপনি কীভাবে জানলেন আমি এখানে?
– তোমার বান্ধবী সুমী বলল। তাছাড়া আমার মনে হয়েছিল, দীপা ক্যাম্পাসে এলে সবার প্রথমে ক্যান্টিনে আসবে।
স্বাভাবিকভাবেই এত কোলাহলের মাঝে তারা দুজন নিজেদের মধ্যে ঠিক মত কথা বলতে পারছিল না। ক্যান্টিনে ছাত্র, শিক্ষক সহ অনেকেই আছে। এদের মাঝে কেউ কেউ আবার তাদের দিকে বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে। আশফাক চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, তুমি আর এখানে থেকো না। বাসায় চলে যাও। আমি তোমার সাথে পরে যোগাযোগ করব।
রুহী আশফাকের চোখে চোখ রেখে বলল, পালিয়ে যেতে বলছেন?
– না তা কেন! দেখছো তো সবাই আমাদের দিকে কীভাবে তাকিয়ে আছে। এভাবে কি কথা বলা যায়? তাছাড়া দীপাকে আগে খুঁজে বের করা দরকার। রাগের মাথায় সে কী করে বসে কে জানে! এদিকে আমার ফোনটাও খুঁজে পাচ্ছি না। আমার ধারনা ফোনটা দীপার কাছে। তুমি আপাতত আমার সাথে যোগাযোগ করো না। আমি সময় সুযোগ পেলে তোমার সাথে যোগাযোগ করব।
কথাগুলো বলার পর আশফাক আর ক্যান্টিনে দাঁড়ালো না। যেভাবে ঝড়ের মত এসেছিল সেভাবে বেরিয়ে গেল। রুহী আবারো বসে পড়লো। আজ আর সে কোনো ক্লাস করবে না। মাথাটা একেবারে জট পেকে গেছে। অদ্ভুৎ ভাবে আজ সে আশফাকের চোখে নিজের ছায়া দেখতে পেলো না। অথচ এই ক’দিনে আশফাকের চোখে নিজের বসবাস দেখতে পাওয়াটা রুহীর কাছে অন্যতম সুখের কারন ছিল।
রুহীকে বেশিক্ষণ একা একা বসে থাকতে হলো না। আশফাক চলে যাওয়ার একটু পরেই সুমি ক্যান্টিনে এলো। নরম গলায় বলল, বাসায় যাবি না? চল বাসায় চলে যাই। আজ আমিও তোর সাথে তোদের ওখানে যাব। একটু আগে বাসায় ফোন করে জানিয়েছি। আজ আমি তোর সাথে রাতে থাকব।
রুহী বলল, দরকার নেই তোর এত ঝামেলা করার। আমি ঠিক আছি।
– বললেই হবে তুই ঠিক আছিস। আমি তোকে চিনি না! বুঝতেই পারছি তোর মন ভেঙে একাকার হয়ে গেছে।
– মন ভাঙার মত কিছু ঘটে নাই সুমী। সব কিছু ঠিক আছে।
– মানে! তুই কি ভাবছিস আশফাক স্যার তোর সাথে এখনো যোগযোগ রাখবে? আর যদি যোগাযোগ রাখেও তোর নিজেরই উচিৎ উনার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া।
রুহী অসহায় গলায় বলল, আমাকে আজকের দিনটা একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে দে সুমী। আমার মাথা কাজ করছে না।
– ঠান্ডা মাথায় ভাবার আগে তোর জেনে রাখা দরকার, তাদের স্বামী স্ত্রীর কিন্তু একটু আগেই দেখা হয়েছে। দেখলাম তারা দুজনেই বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গাড়িতে উঠল যেন তাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা নেই।
সুমীর কথাগুলো শুনে রুহী অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো।
সুমী আবারো বলল, এত অবাক হবার কিছু নেই রুহী। পৃথিবীর কোনো মানুষই নিজের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দের পতন ঘটুক তা চাইবে না। ঠিক তেমনভাবে নিজের অধিকারটুকুও কেউ সহজে হাতছাড়া করতে চাইবে না। প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু অদ্ভুৎ ইচ্ছে থাকে, যা হয়ত অন্যের সামনে প্রকাশ করা অসম্ভব। সেই ইচ্ছেগুলোকে পূরণ করার জন্য কিছুটা রিস্ক হয়ত নেয়া যায় তাই বলে সেই ইচ্ছে পূরনের জন্য নিজের জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাক সেটা কোনো মানুষই চাইবে না।
রুহী অবাক হয়ে বলল, তুই মানুষের মনের খবর এত জানিস কীভাবে?
সুমী করুন হেসে বলল, ভুলে যাচ্ছিস কেন আমার যখন দশ বছর বয়স তখন আমার বাবা মার ডিভোর্স হয়েছে। আমি দেখেছি একটা অবৈধ সম্পর্কের কারনে কীভাবে অনেকগুলো জীবন নষ্ট হয়, কীভাবে সুন্দর একটা সংসারের, নিত্য দিনের অভ্যাসগুলোর ছন্দপতন ঘটে। রুহী বিশ্বাস কর, এমন কোনো দিন নেই যেদিন আমি আমার স্টেপ মাকে অভিসম্পাত করি না, এমন কোনো দিন নেই যেদিন আমার নিজের মা সেই মহিলার কারনে চোখের পানি ফেলেন না। আর যদি বাবার কথা জিজ্ঞেস করিস তাহলে বলব আমার বাবাও নাকি সেই মহিলার সাথে ভালো নেই। বিয়ের এত বছর পরেও তাদের এখনো সন্তান হয়নি। শুনেছি বাবা নাকি দ্বিতীয় পক্ষের ঘরে সন্তান নিতে আগ্রহী নয়। কারন আমাদের দুই ভাই বোনের পড়ালেখার যাবতীয় খরচ বাবাকেই বহন করতে হয়। তাই বাবা হয়ত চাননি ওই পক্ষের কোনো সন্তান আসুক। সুতরাং বুঝতেই পারছিস, ওই মহিলা মনে কত কষ্ট নিয়ে আমার বাবার সাথে সংসার করছে। এসব দেখে আমার কখনো কখনো মনে হয়, আমার মা-ই হয়ত ওই মহিলার কাছে হেরে যাওয়ার পরেও জিতে গেছে।
…………….
দেখতে দেখতে পনের দিন পার হয়ে গেলো। এরমাঝে আশফাক স্যারের সাথে রুহীর কোনোরকম যোগাযোগ হলো না। রুহী খুব স্বাভাবিক ভাবে ক্যাম্পাসে যাচ্ছে। রুটিন অনুযায়ী আশফাক স্যারের সাথে তাদের যে ক্লাসগুলো ছিল সেই ক্লাসগুলো অন্য একজন স্যার নিচ্ছেন। রুহী শুনেছে, আশফাক স্যার নাকি মাস খানেকের ছুটি নিয়েছেন। এদিকে সুমীও সেদিনের পর আর রুহীর সাথে আশফাক স্যারের বিষয়ে কোনো কথা বলেনি। এসবের মাঝে রুহীর বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। আর মাত্র আটাশ দিন পর রুহীর বিয়ে। গত সপ্তাহে সে সজলের সাথে খুব স্বাভাবিক ভাবে বিয়ের শপিং করেছে। শপিং এর পর ডিনার শেষে বাড়ি ফেরার পথে সজল যখন ওর গালে একটা চুমু খেয়েছে তখনও সে বেশ স্বাভাবিক আচরন করেছে। রুহীকে স্বাভাবিক থাকতে দেখে সজলের সাহস আরো এক ধাপ বেড়েছে। আজ সকালে সে রুহীর শরীরের প্রাইভেট পার্টসে হাত দিয়েছে। রুহী এরপরেও কোনো রিয়াক্ট করেনি। আজ ক্লাস শেষ হবার পর সজলের তার ক্যাম্পাসে আসার কথা। রুহী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ক’মাস আগেও তার জীবনটা অনেক সহজ আর সুন্দর ছিল। এ ক’দিনেই কীভাবে যেন সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। সেদিন সুমী যে কথাগুলো তাকে বলেছিল তা যদি সত্য হয় তাহলে রুহী হয়ত আশফাক স্যারের জীবনের অদ্ভুৎ সেই ইচ্ছে ছিল যার জন্য সে নিজের জীবনের এতটুকু ছন্দপতন ঘটাতে রাজি নয়। তবে রুহী খুব ভালোমত জানে আশফাক স্যার তার জীবনের অদ্ভুৎ কোনো ইচ্ছে ছিল না। বরং তার জীবনে আশফাক স্যারের জায়গা ছিল এক টুকরো খোলা আকাশের মত, সতেজ মিষ্টি বিকেলের নরম হাওয়ায়র মত, ভেজা ঘাসের উপর দুলতে থাকা নরম শিশির কনার মত , এক চিলতে রৌদের মত…..
রুহী ঝরঝর করে নিজের অজান্তেই কেঁদে ফেলল। নিজেকে বারবার প্রশ্ন করল, আচ্ছা এসব ছাড়া কি বেঁচে থাকা যায়? একজন মানুষের পক্ষে কি আদৌ এগুলো ছাড়া বাঁচা সম্ভব? স্বাভাবিকভাবেই রুহী কোনো জবাব পেল না। নিজের প্রশ্নগুলো তাই উত্তরের পরিবর্তে শুধুই প্রতিধ্বনি হয়ে নিজের কাছে ফিরে এলো।
“চলবে”