আঙুলে আঙুল
পর্ব (১৫)
অরুণিমা হাসপাতালে পৌঁছাতে তার বাবা ব্যস্ত পায়ে একটি রুমে নিয়ে এলো। সে ভেবেছিল, এখানে রোগী থাকবে। রোগী নেই, একজন নার্স আছে৷ অসীউল্লাহকে দেখতে পেয়ে নার্স জিজ্ঞেস করল,
” রক্ত যোগাড় হয়েছে? ”
” হ্যাঁ, আমার মেয়ে দিবে। ওর রক্তের রুপ ও পজেটিভ। ”
অরুণিমা অবাক হলো। হতভম্ব দৃষ্টিতে বাবার দিকে চেয়ে আছে। তিনি আঁচ করতে পেরে অসহায় ভঙ্গিতে বললেন,
” রাগ করিস না, মা। আর কোনো উপায় নেই৷ ”
নার্স রক্ত নেওয়ার জন্য অরুণিমার শরীরে সুই প্রবেশ করল। সে ব্যথায় চোখ বন্ধ করে নিল। সেকেন্ড পেরুতেই ব্যথার ছাপ উবে গেল মুখমন্ডল থেকে। ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতে মনে মনে বলল, ‘ কিছুক্ষণ আগেও যার জন্য বিরক্ত হচ্ছিলে, রাগ দেখাচ্ছিলে তাকে সুস্থ করার জন্যই মেয়ের শরীর থেকে রক্ত দিয়ে দিচ্ছ। একটুও ভয় পাচ্ছ না। অথচ কিছুদিন আগেও ব্লেডে কেটে এক ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ায় সে কি অস্থিরতা দেখিয়েছিলে! ভালো মানুষরা বুঝি এমনই হয়? ‘
রক্ত দেওয়ার সময়টুকুতে অসীউল্লাহকে দৃষ্টি সীমার মধ্যে পাওয়া গেল না। নার্স চলে যেতেই হাওয়ার মতো ছুটে এলেন। মেয়েকে পাশ থেকে এক হাতে জড়িয়ে বললেন,
” চল, বাসায় যাই। ”
” তোমার রোগী সুস্থ হয়ে গেছে? ”
” জানি না। কিন্তু সুস্থ হওয়ার জন্য যা যা দরকার সব ব্যবস্থা করেছি। ”
অরুণিমা বাবার স্নেহ ডোরে থেকেই রুম থেকে বেরিয়ে এলো। করিডোর পেরুতে পেরুতে ভাবছে, যাকে নিজের রক্ত দান করল তাকে এক নজর দেখবে না? ইচ্ছাটা গোপন রাখল না। উড়িয়েও দিল না। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বাবাকে বলল,
” রোগীর কি জ্ঞান ফিরেছে, বাবা? ”
তিনি মনখারাপের সুরে উত্তর করলেন,
” না। ”
” উনার পরিবারকে খরব দিয়েছ? ”
” কীভাবে দিব? কাউকে চিনি না তো। ”
অরুণিমা ঘড়ি দেখার বাহানায় মোবাইলটা বের করল। তারপরে বলল,
” খুব বেশি রাত হয়নি। জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করি? পরিবারের কেউ নেই। যদি ভালো-মন্দ কিছু হয়ে যায়, আমাদের উপরই তো দোষ আসবে। ”
মেয়ের প্রস্তাবে অসীউল্লাহ খুশি হলেন না। আবার ফেলতেও পারছেন না। অরুণিমা ভুল কিছু বলছে না। দুর্ঘটনা তার রিকশার সামনেই ঘটেছে। সে মানবতা দেখাতে গিয়ে আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনলেও রিকশাওয়ালাকে ধরে রাখতে পারেনি। তাকে না জানিয়ে সুযোগ পেয়ে পালিয়েছে। ইচ্ছা না থাকলেও বাধ্য হয়ে মেয়েকে নিয়ে রোগীর রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভেতরে ডাক্তার আছে, সম্ভবত চিকিৎসা চলছে। অসীউল্লাহ অপেক্ষা করতে করতে ঝিমাতে শুরু করলেন। অরুণিমা এই সুযোগে দরজার নিকটে গিয়ে দাঁড়াল। ভেতরে একটা ঢুঁ মারার ফন্দি। দূর থেকে নার্স ও একজন ছেলে ডাক্তারকে দেখা যাচ্ছে। দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকায় অজ্ঞান লোকটির অর্ধেক শরীর আড়ালে ঢাকা পড়েছে৷ কোমর থেকে পা অবধি দেখা যাচ্ছে শুধু। সে সরে যাওয়ার জন্য দৃষ্টি সরিয়ে নিবে তখনই ডাক্তার ঘুরে দাঁড়াল দরজার দিকে। অরুণিমার চঞ্চল দৃষ্টিজোড়া অজান্তেই আটকে গেল আড়াল মুক্ত হওয়া মুখটায়। নিষ্পলক চোখে ঠোঁট কাঁপিয়ে উচ্চারণ করল, ‘ মিয়া ভাই! ‘
” আপনার পরিচিত? ”
অপরিচিত পুরুষ গলা পেয়ে অরুণিমা ছিটকে ওঠল। অচৈতন্য ভাব মুছে গেল সঙ্গে সঙ্গে। অপ্রস্তুত হয়ে সুধাল,
” জি? ”
ডাক্তার খানিক বিরক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” রোগী আপনার কে হয়? আপনি কি উনার বাড়ির লোক? ”
প্রশ্নটা শুনে অরুণিমার দেহখানা পাথরের মতো হয়ে এলো। মস্তিষ্কে প্রচণ্ড চাপও পড়ছে। উত্তরটা ঠিক কী হলে ডাক্তার ও সে দুজনেই খুশি হবে সেটাই ভাবছে। তার এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিল অসীউল্লাহ। এদিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,
” জি। আমরা উনার বাড়ির লোক। ”
কাছে পৌঁছে উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন,
” ওর কি জ্ঞান ফিরেছে? সুস্থ হয়ে যাবে তো? ”
” না, এখনও জ্ঞান ফিরেনি। ফেরার সময় হয়েছে। ”
অসীউল্লাহর চিন্তা একটু কমল বুঝি। মুখে হাসি হাসি ভাবটা দৃশ্যায়িত হতে ডাক্তার বলল,
” আপনাদের সাথে জরুরি কথা আছে। চেম্বারে আসুন। ”
অরুণিমা খেয়াল করল, তার বাবার ঘর্মাক্ত মুখটা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তাই বলল,
” তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি শুনে আসি, ডাক্তার কী বলে। ”
ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে একটু স্বস্থি বোধ করল সে। এক্সিডেন্টের জন্য মাইমূনের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু স্বস্থি বোধটা বেশিক্ষণ টিকল না। কারণ, আপাতদৃষ্টিতে মাইমূনকে যতটা সুস্থ দেখা যায়, সে ততটা সুস্থ নয়। অতিরিক্ত ধূমপান ও মদ্যপানের ফলে তার ভেতরের অধিকাংশ যন্ত্রাংশ নষ্টের পথে। এই মুহূর্তে এসব থেকে দূরে সরতে না পারলে প্রাণহানিও ঘটতে পারে। এই অবস্থায় এই ছেলে কয়েক ঘণ্টা পূর্বে কাউকে রক্ত দান করে এসেছে। জ্ঞান হারানোর মূল কারণই ছিল রক্তস্বল্পতা ও দৈহিক দুর্বলতা। অরুণিমা হালকা দৃষ্টিতে মলিন মুখে ডাক্তারের বলা কথাগুলো শুনছিল। সহসা প্রশ্ন করলেন,
” পেশেন্টের শরীরের কন্ডিশন দেখে ভেবে নিয়েছিলাম, সে একা। পরিবার বলতে কিছু নেই। তাই এই অবস্থা। এখন তো দেখছি, পরিবার আছে। আপন মানুষ আছে৷ তারপরও এই অবস্থা হলো কী করে? খোঁজ-খবর রাখেন না নাকি🫣? ”
সে উত্তর দিতে পারল না। চাহনি টেবিলের উপর ফেলে মাথা নত করে ফেলল। এরমধ্যে নার্স এসে জানিয়ে গেল, রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার তড়িঘড়িতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
” যত দ্রুত সম্ভব আপনার স্বামীকে খারাপ অভ্যাস থেকে ফিরিয়ে আনুন। নাহলে মৃত্যু অনিবার্য। ”
ডাক্তারের পিছু পিছু অরুণিমাও বেরিয়ে এলো। অসীউল্লাহ একটু দূরেই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। অরুণিমা তার কাছে হেঁটে গিয়ে বলল,
” বাড়ি চলো, বাবা। অনেক রাত হয়েছে। ”
” ডাক্তার কী বলেছে? ”
বাবার প্রশ্নের উত্তর দিল না। বড় বড় কদম ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। অসীউল্লাহও মেয়েকে অনুসরণ করে নিচে নামছেন। তার শরীরটাও খুব একটা ভালো লাগছে না। ভীষণ ক্লান্ত অনুভব করছে। বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচে। বাবা-মেয়ে একদম নিচে নেমে এসেছে। সামনেই হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার মূল দরজা। সেদিকে পা এগিয়ে নিতে আচমকা অরুণিমার কানে পৌঁছাল একটা পরিচিত কণ্ঠ,
” মিয়া ভাইকে এখানে ভর্তি করা হয়েছে? কোন ফ্লোরে? রুম নাম্বার কত? ”
সে ডানপাশে ঘাড় বাঁকাতে পরিচিত মুখটা দেখতে পেল। মাইমূনের খোঁজ পেয়েছিল, এই ছেলেটির কাছ থেকেই। নামটা এখন মনে পড়ছে না। কিন্তু চেহারা ঠিক চিনেছে। মিয়া ভাইয়ের জন্য তার অস্থিরতা ও উগ্র ভাবটা চোখে পড়ছে। সে রিসিপশন থেকে মিয়া ভাইয়ের খোঁজ করলেও তারা দিতে পারছে না। এতে যেন সে আরও বেশি উগ্র হয়ে যাচ্ছে। আক্রমণাত্মক হয়ে যাচ্ছে। অরুণিমা বুঝতে পেরে দূর থেকে বলল,
” মিয়া ভাই তৃতীয় তলায়। রুম নাম্বার তিনশ দুই। ”
ছেলেটি ঝটিতে পেছনে তাকাল। চাহনি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। খোঁজ পেয়ে দৌড়ে চলে গেল সিঁড়ি মুখে। অরুণিমা সাহায্যের কাজ শেষ করে পুনরায় বেরিয়ে যাওয়ার উদযোগ শুরু করে। তখনই প্রশ্নবাণে জর্জরিত হলো,
” মিয়া ভাই কে? ”
অরুণিমা ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। অসীউল্লাহ পুনরায় বললেন,
” তিনশ দুইয়ে তো ঐ মাতালটা শুয়ে আছে। ওর নাম মিয়া ভাই? ”
অরুণিমা মুখে উত্তর করার সাহস পেল না। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝাতে পরের প্রশ্নটি তীরের মতো ছুটে এলো,
” তুই জানলি কিভাবে? মিয়া ভাইকে চিনিস? ”
অরুণিমা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দ্রুত কদমে সামনে এগুতে এগুতে হালকা স্বরে জবাব দিল,
” তেমন পরিচয় নেই। আমাদের এলাকায় থাকে। শুনে শুনে চিনেছি। ”
” তাই নাকি! আমি তো দেখিনি কখনও। আজই প্রথম দেখলাম। ”
___________
বাসায় ঢুকে মাইমূনকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে অরুণিমা। পারেনি। অন্য সময় যেমন-তেমন, ক্লাবের সামনে আসলেই তার বুকের ভেতর অস্থিরতা শুরু হয়। মায়া কাজ করে। ইচ্ছে হয়, একবার খোঁজ নিয়ে জানে, মানুষটা এখন কেমন আছে। ডাক্তারের কথাগুলোও মনে পড়ে। মনের ভেতর জ্বালা ধরে, মস্তিষ্ক ঝিম ধরে যায়। তাকে পরিবারের লোক ভেবে যে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়েছিল, সেটা মাইমূনের পরিবারের কারও কাছে পৌঁছে দেওয়ার তীব্র বাসনা তৈরি হয়। কিন্তু সে তো মাইমূনকে ছাড়া কাউকে চিনে না!
দুপুরবেলা। মল থেকে বাড়ির দিকে আসছে। সহসা নজরে পড়ল সেই ছেলেটিকে, যাকে হাসপাতালে দেখেছিল। ফোনে কারও সাথে কথা বলছে। অরুণিমার মনে হলো, এই ছেলে মাইমূনের পরিবারকে চিনবে। তাই ডাক দিল,
” এই ছেলে? ”
ছেলেটিও বোধ হয় অরুণিমাকে চিনে ফেলেছে। তাৎক্ষনাৎ মোবাইল পকেটে ভরে তার কাছে ছুটে গেল। মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে বলল,
” আমাকে ডাকতে এত দেরি করলেন কেন, ভাবি? আপনার ডাকের অপেক্ষায় ছিলাম এতদিন। ”
অরুণিমার ভ্রূ কুঁচকে এলো। জিজ্ঞেস করল,
” তুমি জানতে আমি ডাকব? ”
” আমি না, মিয়া ভাই জানত। ”
মিয়া ভাইকে নিয়ে কোনো কথা উঠাতে চায়নি সে। শুধু তার বাসার ঠিকানা জানতে চেয়েছিল। উঠেই যখন গেল তখন এড়িয়ে যেতে পারল না। পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” কিভাবে? ”
” এটা তো আমি জানি না। মিয়া ভাই বলতে পারবে। ”
উত্তর দিতে দিতে ছেলেটি পকেট থেকে ভাঁজ করা একটি কাগজ বের করল। অরুণিমার হাতে দিয়ে বলল,
” এটা আপনার জন্য। ”
অরুণিমা প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে সে পুনরায় বলল,
” মিয়া ভাই দিয়েছে। বলেছিল, আপনি যেদিন আমাকে ডাকবেন, সেদিনই যেন দিই। ”
চলবে
আঙুলে আঙুল
পর্ব (১৬)
‘ আগে শুধু মনে রাজত্ব করেছ, এখন থেকে শরীরেও রাজত্ব করছ। এভাবে হুট করে আমার সবকিছু দখল করে নেওয়া কি ঠিক হলো? আমি যে দেউলিয়া হয়ে গেলাম! ভালোবাসা, আমাকে দেউলিয়া করে যে ঋণী বানিয়ে দিলে, এর যথাযথ সম্মান দিতে চাই। সেজন্য তোমার পাশে থাকা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইচ্ছে করছে, তোমাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভেঙে ফেলি। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা এত কষ্ট! আগে জানলে কখনই করতাম না। ভালেবাসা, এই কষ্ট থেকে আমাকে মুক্তি দেও। তোমার পাশে থাকার অনুমতি দেও। কথা দিচ্ছি, শুধু পায়ে পা মিলিয়ে চলব। আঙুলে আঙুল রাখার বায়না করব না। বায়না তো মেয়েদের মানায়, তাই না? ‘ শোনো, আমার জ্ঞান ফেরার পর ডাক্তার বলেছিল, বাইরে আমার বউ দাঁড়িয়ে আছে। আমি গিয়ে পেলাম না কেন? তার জন্য আমি বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে রাজি আর সে কিনা কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে পারল না? এ তো ভারি অন্যায়! তাকে বলো আমার মনখারাপ হয়েছে। ‘
চিরকুটে লেখা মাইমূনের মনের কথাগুলো পড়া শেষ করে অরুণিমা দুমড়েমুচড়ে হাতের মুঠোয় চেপে রাখল। প্রতিশ্রুতি ভাঙার কথা বলে আবারও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। মানুষটা কি বোকা হয়ে গেল? অরুণিমা বিরক্ত নিয়ে ছেলেটির দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
” এটা নিয়ে কতদিন ধরে ঘুরছ? ”
” ছয় দিন। ”
অরুণিমা ছোট্ট নিশ্বাস ছাড়ল। যা ভেবেছিল তাই। মিয়া ভাই জেনে গেছে, সেই রক্ত দিয়েছে। সেজন্যই মাথায় চড়ে বসেছে। সে যেমন বিরক্ত হলো তেমন খুশিও হলো। মাথায় চড়ে বসলেও নিজ প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যায়নি। যোগাযোগ তার সাথে ঠিকই করেছে। কিন্তু নিজের ইচ্ছায় নয়, অরুণিমার ইচ্ছায়। যদি না সে এই ছেলেটিকে ডাকত, কাগজখানা তার কাছে পৌঁছাত না। এই কৃতজ্ঞতায় দুমড়ানো কাগজটাকে টেনে টেনে ঠিক করার চেষ্টা করল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
” তোমার কাছে কলম আছে? ”
ছেলেটি উত্তর দিল না। পকেট থেকে সরাসরি একটি কলম বের করে তার হাতে দিল। সে কাগজটি উল্টাল। অন্য পাশে লিখল, ‘ আগে নিজের যত্ন নিন। মদ, সিগারেট থেকে দূরে থাকুন। ‘ লেখা শেষে কাগজ ও কলম ছেলেটির হাতে দিয়ে বলল,
” তোমার মিয়া ভাইকে দিও। ”
সে মাথা নাড়িয়ে হাসিমুখে রাস্তা পার হলো। ক্লাবের ভেতর ঢুকতে অরুণিমার মনে প্রশ্ন জাগল, ‘ মিয়া ভাই সুস্থ হয়েছেন তো? জিজ্ঞেস করা হলো না! ‘
_____________
সঞ্জয়ানের সাথে দেখা হয়েছিল অনেক দিন আগে। এর মধ্যে তার দেওয়া প্রস্তাবটি অরুণিমা একদমই ভুলে গিয়েছিল। আজ মনে করিয়ে দিয়েছে তার বাবা। ক্যান্টিনের সকল কাজ সম্পূর্ণ। সাজানো-গোছানোও হয়েছে। এখন শুধু পরিচালকের দরকার। অসীউল্লাহ রাতের খাবার সামনে নিয়ে মেয়ের সাথে এই নিয়ে কথা বলছিলেন। সহসা প্রশ্ন করলেন,
” সঞ্জয়ান স্যার চাচ্ছেন আগামী সপ্তাহেই স্বর্ণলতার উদ্বোধন করতে। তুই কী বলিস? ”
অরুণিমা অবাক হয়ে বলল,
” আমি আবার কী বলব? ”
” তোর কিছু বলার নেই? ”
অরুণিমা এই বিষয়ে কথা বলতে অনিচ্ছুক, অনাগ্রহী। তাই বাবার মুখ থেকে চাহনি সরিয়ে নিল। দায়সারা গোছের মাথা নেড়ে ‘ না ‘ বুঝাতেই তিনি বললেন,
” কিন্তু সঞ্জয়ান স্যার যে, তোর মতামত চাইল? ”
অরুণিমার চোখদ্বয় আবারও বাবার দিকেই উদ্বেলিত হলো। কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে যেতে হলো। মনে পড়ল, সঞ্জয়ান তাকে স্বর্ণলতার দায়িত্ব দিতে চেয়েছিল। সে গুরুত্ব না দেখালেও, সঞ্জয়ান ঠিকই দেখিয়েছে। সেজন্যই আজ এই আলাপটা বাড়িতে বসেও করতে হচ্ছে। যদিও সে এই ব্যাপারটি বাবাকে বলেনি, কিন্তু অজানাও নেই। তিনি ঠিকই জানেন। হয়তো সঞ্জয়ানই বলেছে। অরুণিমাও আর ঘোরপ্যাঁচে গেল না। নি:সংকোচে মুক্ত স্বরে বলল,
” আমি উনার প্রস্তাবে রাজি না। বলে এসেছিলাম, তারপরও এটা নিয়ে কথা হচ্ছে। ”
” রাজি না কেন? ”
অসীউল্লাহর কণ্ঠে খানিক উত্তাপ। অরুণিমা টের পেল কিন্তু ঘাবড়াল না। শান্ত থেকেই জবাব দিল,
” আমার মনে হচ্ছে, উনি দয়া দেখাচ্ছেন। ”
” এটা দয়া নয়, সুযোগ। যেটা আমাদের প্রয়োজন। যদি এমনি এমনি টাকার বান্ডেল ছুঁড়ে মারত তাহলে দয়া হতো, করুণা হতো। তেমনটা তো করছেন না। তোকে কাজ দিচ্ছেন। গায়েগতরে খাটলে মাস শেষে বেতন পাবি। ”
অরুণিমা দৃষ্টি নিচু করল। একটু জোরাল স্বরে প্রত্যুত্তর করল,
” এই সুযোগটাও এখন দরকার নেই, বাবা। আমি আগে থেকেই একটা চাকরিতে আছি। বেতনও বাড়িয়েছে। ”
” বেতন বাড়িয়েছে? আমাকে বলিসনি তো! ”
বেতন সত্যি বেড়েছে নাকি অরুণিমা নিজেও নিশ্চিত নয়। তবে এই মাসের বেতনের টাকার সাথে পাঁচ হাজার অতিরিক্ত দিয়েছে। অন্য সময় বেতনটা হাতে হাতে দিলেও এবার খামে ভরে দিয়েছে। দোকানদার চাচার সামনে খাম খুলে টাকা গুণতে লজ্জা পাচ্ছিল, তাই খুলেনি। বাসায় এসে দেখে অতিরিক্ত পাঁচ হাজার টাকা। সে ভেবেছিল, কাল চাচার সাথে কথা নিশ্চিত হওয়ার পর বাবাকে বলবে। এখন বেফাঁসে বলে ফেলায় চিন্তায় পড়ে গেল। যদি বেতন না বাড়ে? চাচা ভুল করে এই টাকা দিয়ে থাকে তাহলে বাবাকে কী বলবে?
মেয়ের নীরব ভাবনার সাথে তাল মিলিয়ে বাবাও ভাবছিলেন। মলের মতো ক্যান্টিনে বারো ঘণ্টা কাজ করতে হবে না। শুধু কলেজের সময়টুকুই থাকবে। তাছাড়া অসীউল্লাহ নজরে রাখতে পারবে। প্রয়োজনে তার অবসর সময়টুকুতে মেয়ের কাজে সাহায্যও করতে পারবে। সঞ্জয়ান মানুষটা খুব ভালো। নম্র, ভদ্র, বিনয়ী। নির্লোভ ও নিরহংকারী ছেলে। এত বছর ধরে দেখছেন, কলেজে নিয়মিত যাতায়াত করতে, কখনও চরিত্রে দোষও পাননি। এমন মানুষের ছায়াতলে থাকতেও কপাল লাগে। সেই কপাল তার মেয়ের হয়েছে। সে না বুঝলেও তিনি তো বুঝছেন! নীরব ভাবনা সমাপ্তি করে তিনিই বললেন,
” বেতন কম না বেশি সেটা দেখে লাভ নেই। সঞ্জয়ান স্যারের দেওয়া চাকরিটাই তুই করবি। আমার চাওয়া এটাই। ”
অরুণিমা দ্বিমত প্রকাশ করতে চাইল। বাবার গম্ভীর মুখটায় তাকাতেই সে চাওয়া হারিয়ে গেল। চুপচাপ আনত বদনে খাওয়া শুরু করতে শুনল,
” আমি সঞ্জয়ান স্যারকে বলে দিচ্ছি, তুই রাজি। ”
____________
স্বর্ণলতার উদ্বোধনের তারিখ পড়েছিল সোমবার। টিফিন পিরিয়ডের সময়। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকগণ ও সঞ্জয়ানের দাওয়াত গ্রহণ করা কিছু গুণী ব্যক্তিদেরও আগমন ঘটেছে। শুরুতে অরুণিমা ভয় ও সংকোচ নিয়ে উপস্থিত হলেও ক্যান্টিনের ভেতর ঢুকতে সেটা কমে এসেছিল। এখানে সে একা নয়, আরও দুজন মহিলা ও পুরুষ আছে। তারাই রান্না-বান্না ও বেচাকেনায় থাকবে। অরুণিমা হলো তত্ত্বাবধায়ক। সঞ্জয়ান প্রথম থেকেই অরুণিমাকে সঙ্গ দিচ্ছে। তার আচরণে মনে হচ্ছে না সে মালিকপক্ষ। যেন অরুণিমার মতোই কেউ। বড্ড চেনা, পূর্বপরিচিত। দুজনের মধ্যে বেশ ভাব। সঞ্জয়ান গুণী ব্যক্তিদের বিদায় করে এসে অরুণিমার পাশে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
” অরুণিমা, তোমার কি মনখারাপ? ”
ছাত্র-ছাত্রীদের ভেতরে ঢোকার অনুমতি পাওয়ামাত্র শূভ্রা ভিড় ঠেলে একদম সামনে দাঁড়ায়। আপুর দেখা পেতেই তার পিছু পিছু ঘুরছিল। সেসময় সঞ্জয়ান এখানে ছিল না। তাই চোখেও পড়েনি। এবার কণ্ঠ পেয়ে সে চমকে ওঠল। মুখটা দেখে নিয়ে আপুর পূর্বে সে উত্তর করল,
” জি। আপুর খুব মনখারাপ। ”
শূভ্রাকে সে অপছন্দ করলেও এবার এড়িয়ে গেল না। জিজ্ঞেস করল,
” কেন? ”
” মা, আজ সাজনা শাক রান্না করেনি যে তাই। ”
মুহূর্তে সঞ্জয়ানের চোখদুটো রক্তরাঙা হলো। দাঁতের পাটি সংলগ্ন স্থানটা শক্ত করে বলল,
” আবার বেয়াদবি করছ? এখনও শিক্ষা হয়নি তোমার? ”
অরুণিমা দুজনের মাঝে আছে। শূভ্রাকে ধমক দেওয়ার জন্য উদ্যত হলেও, দেওয়া হলো না। সঞ্জয়ানকে জিজ্ঞেস করে বসল,
” ও আগেও আপনার সাথে বেয়াদবি করেছে? ”
” হ্যাঁ, শুরু থেকেই করে আসছে। আমার তো বিশ্বাসই হয় না এই মেয়েটা তোমার বোন। না চেহারায় মিল, না ব্যবহারে। ”
শূভ্রা রাগে ফুঁসে উঠেও নিভে গেল। ছোটবেলা থেকে যে কথাটা মনে মনে ভেবে এসেছে, সেটা আজ বাইরের একজন সকলের সামনে এমন করে প্রকাশ করল? তাহলে কি সত্যি সে অন্য কারও মেয়ে? সঞ্জয়ান এখানে থেমে থাকল না। শূভ্রাকে যতবারই অন্যায় কাজে পেয়েছে ততবারই ভেবেছিল, চাচাকে বলে দিবে। কিন্তু একবারও বলেনি। অন্যভাবে সামাল দিয়েছে। সে চায়নি, চাচাকে কষ্ট দিতে, দুশ্চিন্তায় রাখতে। কিন্তু এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না। অরুণিমাকে বিচার কাজে বসিয়ে দিয়ে একে একে শূভ্রার সবগুলো অন্যায় কাজগুলো বলতে লাগল।
চলবে