আঙুলে আঙুল পর্ব-১৯+২০

0
237

আঙুলে আঙুল
পর্ব (১৯)

অরুণিমা কফি মুখে দিয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল। অহীদুলের আগ্রহান্বিত দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ আছে। সে খেয়াল করে বলল,
” কফিটা বিশ মিনিট আগে দিয়ে গেছে, তাই ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ”

ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ায় কফির স্বাদ হয়েছে তেতো, বিদঘুটে। অরুণিমা দ্বিতীয় চুমুক দেওয়ার আগ্রহ পেল না। তাই টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল,
” আমি তো জানতাম, এসব জায়গায় অর্ডার করার পরও খাবার পেতে বিশ-ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। ”
” ঠিকই জানেন। এখানেও তাই। ”
” তার মানে আপনি মিনিটের বেশি সময় অপেক্ষা করেছেন? ”

অহীদুল এতক্ষণ কফিতে চুমুক দেয়নি। এবার দিল। অরুণিমার মতো তার মুখমন্ডলের কোনো অংশই কুঁচকাল না। দিব্যি স্বাভাবিক। একের পর এক চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। সেই অবস্থায় প্রত্যুত্তর করল,
” না। বিশ মিনিটই করেছি। এখানে আসার পূর্বে কল করে কফির কথা বলে রেখেছিলাম। ”

অরুণিমা জবাবে মৃদু হাসল। বুঝে গেল, অহীদুলকে বিশ মিনিট অপেক্ষা করানোর শাস্তি এই বিস্বাদের কফি। যা উপেক্ষা করা মানে তাকে অপমান করা। এই মুহূর্তটাকে অপমানে ভাসিয়ে দেওয়ার মনোবাসনা নেই। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঠাণ্ডা কফি পান করতে শুরু করে অহীদুলকে সঙ্গ দিতে চাইল। সেটাও বেশিক্ষণ সম্ভব হলো না। চোখের চাহনি অহীদুলের শরীরটা ছাড়িয়ে পেছনের টেবিলটায় পৌঁছাতে দেহ, মন পাথরের মতো শক্ত ও নিশ্চল হয়ে এলো নিমিষেই। মিয়া ভাইয়ের সেই ছেলেটা বসে আছে তার দিকে মুখ করে। চোখের পাতা দুটো এক সেকেন্ডের জন্যও পলক পড়ছে না। কী আকুতি, ব্যাকুলতা সেই চাহনিতে! কিছু একটা বলার তীব্র প্রার্থনা।

” পরিচিত? ”

অহীদুলের আকস্মিক প্রশ্নবাণে অরুণিমা চমকে ওঠল। চট করে দৃষ্টি সরিয়ে আনল। দোলাচল চিত্তে দুই হাতে কফির গ্লাস চেপে ধরে খেতে শুরু করার পরও ছাড় পেল না। আগের প্রশ্নটায় আরেকটু স্পষ্টভাবে শুনতে পেল,
” ছেলেটি আপনার পরিচিত? ”

অরুণিমা বিচলিত স্বরে উত্তর করল,
” না, চিনি না। ”
” আপনার কি গরম লাগছে? হঠাৎ করে ঘামছেন যে! ”

অহীদুলের দৃষ্টিভঙ্গি তীক্ষ্ণ ও সন্দেহগ্রস্থ। অরুণিমা ওড়না দিয়ে ঘাম মুছার জন্য ব্যস্ত হলে সে টিস্যু বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল,
” কাঁপছেনও। তার মানে গরম নয় ভয়। অরুণিমা, আপনি ভয় পাচ্ছেন! ভয়ের কারণ কি ঐ ছেলেটি? ”

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই অরুণিমা। সুযোগও পেল না। অহীদুল ঘাড় বাঁকিয়ে চড়া স্বরে ডাকল,
” এই ছেলে? এদিকে এসো তো। ”

ছেলেটিও খানিক ঘাবড়ে গেল। ধীর পদক্ষেপে তাদের পাশে এসে দাঁড়ালে অহীদুল প্রশ্ন করল,
” এনাকে চেন? ”

অরুণিমা না তাকিয়েও বুঝল, তাকে উদ্দেশ্য করেই প্রশ্নটা করেছে। সে তাৎক্ষণিক উত্তর করল,
” না চিনে না। আমিও চিনি না। ও কে চলে যেতে বলুন, প্লিজ। ”

তার এই অনুনয়-বিনয়ের বিপরীতে অহীদুল অভিমত প্রকাশ করতে পারল না। তার পূর্বেই ছেলেটি জোর গলায় বলল,
” মিথ্যা বলছেন কেন, ভাবি? আমরা তো একে-অপরকে চিনি। আমি রতন। মিয়া ভাইয়ের সঙ্গে থাকি। দেখেছেন তো। ”

অহীদুলের চোখ-মুখ কঠিন হলো। ধারাল ও সন্দেহে ভরপুর চোখজোড়া রতনের থেকে সরিয়ে আনল। অরুণিমার মুখপানে স্থির রেখে প্রশ্ন করল,
” ও আপনাকে ভাবি ডাকছে কেন? এই মিয়াভাইটা কে? আপনার কী আগে বিয়ে হয়েছিল? ”

তার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিল রতন। নির্ভয়ে সঠিক তথ্যটা বলল,
” বিয়ে হয়নি এখনও। হবে। তার আগে প্রেম চলছে। ”

অহীদুলের মাথায় ভারী কোনো বস্তুর আঘাত পড়ল যেন! তেমনি আঘাতপ্রাপ্ত গলায় সুধাল,
” আপনি প্রেম করছেন! এ বিষয়ে সঞ্জয়ান কিছু বলেনি আমাকে। ”

অরুণিমা বিপদগ্রস্থ। অসহায় সুরে প্রতিবাদ করল,
” আমি প্রেম করছি না। ও ভুল বুঝছে। ”

রতনও চুপ থাকার ছেলে নয়। আগের চেয়েও অধিক জোরাল স্বরে বলল,
” আবার মিথ্যা বলছেন, ভাবি। আমি নিজে দেখেছি, আপনারা রেস্টুরেন্টে দেখা করেছেন। ভালোবাসার চিঠি আদান-প্রদান করেছেন। ”
” ঐ চিঠিতে ভালোবাসা নেই ”
” তাহলে মিয়া ভাই রিহ্যাবে গিয়েছে কেন? আপনি বলেননি, মদ-সিগারেট থেকে দূরে থাকতে? ”

অরুণিমা অত্যন্ত বিরক্ত স্বরে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” মদ-সিগারেট থেকে দূরে থাকতে বললে ভালোবাসা হয়ে যায়? ”

অহীদুল এতক্ষণ চুপচাপ দুজনের কথা-বার্তা শুনছিল। এবার মুখ খুলল। অরুণিমার উদ্দেশ্যে বলল,
” আমার এত কিছু জানার প্রয়োজন নেই। শুধু জানতে চাই, তুমি মিয়াভাইকে ভালোবাসো কিনা। ”

অরুণিমা তাৎক্ষণিক কিছু বলতে পারল না। নত দৃষ্টি নিয়ে নীরব দাঁড়িয়ে থাকলে অহীদুল পুনরায় বলল,
” অরুণিমা? তাকাও আমার দিকে। ”

সে ধীরে ধীরে দৃষ্টি উঁচু করল। অহীদুলের চোখে চোখ পড়তে সে প্রশ্ন করল,
” মিয়াভাইকে ভালোবাসো? ”

অরুণিমা কয়েক সেকেন্ড স্থির চেয়ে থাকল। তারপরে চাহনি নিচে নামিয়ে নিতে নিতে মাথা দু’পাশে নাড়ল। অহীদুল কী বুঝল কে জানে! বিনাবাক্যে তাকে আর রতনকে ফেলে কফি হাউস থেকে বেরিয়ে গেল।

__________
” এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছিস, বাবা? ”

সঞ্জয়ান চমকাল। গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকা ছবিটা হাত থেকে পড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। স্বর্নলতা উবুড় হয়ে ছবিখানা তুলে মুখের সামনে ধরে আছে। কয়েক সেকেন্ড পর ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বললেন,
” ভারি মিষ্টি দেখতে। কে ওরা? ”

সঞ্জয়ান শুরুতে হকচকিয়ে গিয়েছিল। সুযোগ পেলে হয়তো ছবিটাও লুকাত। এখন আর সেই চেষ্টা করল না। স্বাভাবিক স্বরেই বলল,
” দুই বোন। অরুণিমা ও শূভ্রা। ”
” কোনটা কার নাম? ”

সঞ্জয়ান ছবির উপর আঙুল রেখে চিনিয়ে দিলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
” ওদের ছবি তোর কাছে কেন? ”
” চাচা দিয়েছেন। ”
” চাচা কে? ”
” অরুণিমার বাবা। আমি চাচা বলে ডাকি। ”

স্বর্নলতা বুঝতে পেরেছেন এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। পরক্ষণে আবারও প্রশ্ন ছুড়লেন,
” তোকে ছবি দিয়েছে কেন? ”
” বিয়ের জন্য। অরুণিমাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। ”

বিয়ের কথা শুনে স্বর্ণলতা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হলো। পর মুহূর্তে বিস্ময় ঝরে পড়ল কণ্ঠ থেকে। বললেন,
” তুই বিয়ে করবি আমাকে জানাসনি তো। নিজের বিয়ের ঘটকালি নিজেই করছিস! ”

সঞ্জয়ান বলতে চাইল, ঘটকালি নিজের জন্য নয় অন্য কারও জন্য করছে। কিন্তু বলা হলো না। মনসুর সাখাওয়াতের গলার স্বর পাওয়া গেল। দরজা থেকে বলছেন,
” কার বিয়ের কথা হচ্ছে? ”

স্বর্ণলতা এগিয়ে গিয়ে স্বামীর হাত ও কাঁধ ধরলেন। ভেতরে হাঁটিয়ে নিতে নিতে বললেন,
” তোমার ছেলের। ”

তিনি ছেলের দিকে তাকালেন সরাসরি। বললেন,
” এখনই কিসের বিয়ে? বয়স কত তোর? ”

বাবার প্রশ্ন শুনে সঞ্জয়ান থতমত খেল। বয়সটাও ভুলে গেল বোধ হয়। তাকে রক্ষা করল জন্মদাত্রী। স্বামীর পাশ থেকে বললেন,
” পুরো ছাব্বিশ। ভুলে গেছেন? ”
” ভুলব কেন? এই বয়সে আমি বাবার খেতে হাল চষে বেড়িয়েছি। ”
” আপনি বাবার ছেলে ছিলেন তাই হাল চষেছেন। সঞ্জয়ান আমার ছেলে তাই বিয়ে করবে। ”

কথাটা বলতে বলতে মনসুর সাখাওয়াতকে ছেলের বিছানায় বসিয়ে দিলেন। তারপরে ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
” উনার কথা বাদ দে তো, বাবা। তুই আমাকে বল, অরুণিমাকে পছন্দ হয়েছে নাকি। ”

মনসুর সাখাওয়াত ছেলের পছন্দ জানানোর পূর্বে বললেন,
” ওর পছন্দ হলে হবে না। আমার পছন্দ হতে হবে। নাহলে বউ নিয়ে ঘরে ঢুকতে দিব না। ”

স্বর্ণলতা রাগ চোখে তাকালেন। পর মুহূর্তে দারুন উৎসাহে দুই বোনের ছবিটা দেখালেন স্বামীকে। তিনি বয়সের চাপে ছোট হয়ে আসা চোখদুটো আরও ছোট করে ছবিতে তাকিয়ে সুধালেন,
” এখানে অরুণিমা কোনটা? ”

স্বর্ণলতা দুষ্টুমি করে বললেন,
” আপনি খুঁজে বের করেন। দেখি, ছেলের পছন্দ খুঁজে পান নাকি। ”

সঞ্জয়ান বাবা-মায়ের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে ঠিক জানত, অরুণিমাকে তারা এক দেখায় পছন্দ করে ফেলবেন। তেমনটায় হয়েছে। তবুও খুশি হতে পারছে না। কারণ, অরুণিমার বাবা তাকে পছন্দ করেনি। যেদিন অরুণিমার বিয়ের কথা তুলল সেদিন ‘ মেয়ের যোগ্য ছেলে পাবে কোথায় ‘ প্রশ্নটা এমনভাবে করেছিলেন যে সে বিস্মিত না হয়ে পারল না। এই সমাজে সকলে ছেলের সাথে মেয়ের যোগ্যতার তুলনা করে। অসীউল্লাহ করছেন মেয়ের সাথে ছেলের যোগ্যতার তুলনা। সেই মুহূর্তে তার মনের আয়নায় অরুণিমাকে মনে হয়েছিল, নিঁখুত সুন্দরী, সর্বগুণে গুণান্বিতা। যার কখনও নিন্দা করা যায় না। শুধু প্রশংসা করতে হয়। তার পাশে নিজেকে বড্ড ছোট, বেমানান লাগছিল। যেন স্বর্গীয় কিছু পাওয়ার অবিশ্রাম বৃথা চেষ্টা!

সঞ্জয়ানের মোবাইলটা বেজে ওঠল। সে পকেট থেকে মোবাইল বের করল। অহীদুল কল করেছে। বাবা-মায়ের থেকে একটু দূরে সরে কলটা ধরল। ওপাশের কথা শুনতে শুনতে তার মুখের রঙ বদলে গেল। কিছুটা চড়া স্বরে বলল,
” অহীদ, তুই ভুল বুঝছিস। অরুণিমা কাউকে ভালোবাসে না। ”

অহীদুল দৃঢ় স্বরে উত্তর করল,
” বাসে। ”
” ও তোকে বলেছে? ”
” মুখে বলেনি। ”
” তাহলে? ”
” আমি যখন জিজ্ঞেস করেছি, সে মিয়াভাইকে ভালোবাসে নাকি। তখনই চোখ নামিয়ে নিয়েছে। ”
” এতেই প্রমাণ হয়ে গেল, ও মিয়াভাইকে ভালোবাসে? তোর সাথে আজই পরিচয়। ভয় পেয়ে হয়তো…”

সঞ্জয়ান বাক্যটা সম্পূর্ণ করতে পারল না। অহীদুল বলল,
” হ্যাঁ, ভয় পেয়েছে। কারণ, আমি সত্যটা ধরে ফেলেছি। সঞ্জু তুই হয়তো ভুলে যাচ্ছিস, আমি পেশায় একজন পুলিশ। শুধু মুখের কথায় না, চোখ ও চালচলনেও সত্য উদ্ঘাটন করতে পারি। ”

বন্ধুর কল কেটে দিল। অরুণিমার নাম্বারে কল ঢুকাতে বন্ধ পেল। মুহূর্তে দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে পড়ল মুখে ও বুকে। উৎকণ্ঠায় বেরিয়ে এলো ছায়ানীড় থেকে। মা-বাবা কেউই ছেলের চলে যাওয়া খেয়াল করল না। মনসুর সাখাওয়াত অনেকটা সময় মেয়ে দুটোকে খুঁটিয়ে দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন। ডানপাশের মেয়ের মুখের উপর হাতের আঙুল রেখে বললেন,
” এই আমার ছেলের পছন্দ। ”

স্বর্ণলতা মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
” জি না। এই মেয়েটি অরুণিমা নয়, শূভ্রা। আপনার ছেলের পছন্দ অরুণিমা। ”
” আমার পছন্দের উপর আঙুল তুলছ? ”
” উহু, বুকে টানছি। আপনার কী মনে হয়, আপনার মনের ষড়যন্ত্র আমি বুঝতে পারিনি? ”
” কী বুঝেছ? ”
” ছেলের মতো আপনারও অরুণিমাকেই পছন্দ হয়েছে। কিন্তু দেখতে আমার চেয়েও সুন্দরী মেয়ে আপনার চোখের সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করবে এটা সহ্য হবে না। তাই অরুণিমাকে রেখে শূভ্রার উপর আঙুক রেখেছেন। ”
” কচু বুঝেছ! ”

__________

কলিংবেলের শব্দ পেয়ে শূভ্রা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। দরজা তাকে খুলতে হলো না। নাজিয়া বেগমই খুলেছেন। সে আগ্রহ নিয়ে দরজার ওপাশের মানুষটার মুখ দেখতে চাইল। মুখটা দৃষ্টি সীমা আসতে তার বুকের মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠল। স্বগোতক্তি করল, ‘ সাজনা শাক এখানেও চলে এসেছে! ‘ সে মুখ ফিরিয়ে নিজের রুমে ঢুকতে চাইল, তখনই মায়ের গলা পেল। ফিসফিসে বলছে, ‘ তুই উনার বসার ব্যবস্থা কর। আমি দোকান থেকে এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে আসি৷ ‘ শূভ্রা বুঝতে পারল, মা তার পড়ার টেবিলের সামনে থাকা চেয়ারটা এনে বসতে দিতে বলেছে। সে আনল না। সঞ্জয়ানের সামনে পড়ে থাকা টুলটাও সরিয়ে নিতে চাইল। সঞ্জয়ান ধরে ফেলল। জোর করে টেনে নিয়ে তার উপর বসে বলল,
” একমাত্র সাজনা শাকই পারবে তোমার এই বেয়াদবি ছাড়াতে। অপেক্ষা করো, সঠিক সাজনা শাককে তোমার সামনে হাজির করব। ”

সেও তেজ দেখিয়ে পাল্টা জবাব দিল,
” একমাত্র শূভ্রার বেয়াদবিই পারবে, আপনার ভালো মানুষি মুখোশটা খুলতে। অপেক্ষা করুন, বেঠিক সাজনা শাককে সকলের সামনে হাজির করব। ”

চলবে

আঙুলে আঙুল
পর্ব (২০)

অরুণিমার মোবাইল বন্ধ পেয়ে সঞ্জয়ানের মনে যে দুশ্চিন্তার ঝড় ওঠেছিল, তা থামাতে কল দিয়ে বসে অসীউল্লাহকে। তিনি চিন্তিত স্বরে জানান, অরুণিমা অসুস্থ। জ্বর-ঠাণ্ডায় একদম কাহিল! বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। যদি কিছু দিন ছুটি পাওয়া যায়, তাহলে মেয়েটা সুস্থ হয়ে ফিরবে। সঞ্জয়ান সঙ্গে সঙ্গে ছুটি মঞ্জুর করে ও পরবর্তী দিনই তাকে দেখতে আসে বাসায়। অরুণিমার সাথে দেখা হওয়ার পূর্বে শূভ্রার সাথে দেখা হয়ে যায়। মেজাজটাও বিগড়ে যায়। নাহলে যে বাড়িতে অরুণিমার মতো মিষ্টি মেয়ে থাকে সেই বাড়িতে রুক্ষ ভাষায় কথা বলে কেউ? অন্যরা বললেও সে কখনই বলত না।

নাজিয়া বেগম বিস্কুটের প্যাকেটটা আঁচলের তলায় লুকিয়ে ঘরে ঢুকলেন। সঞ্জয়ানের সামনে দিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে হেঁটে যেতে ধরলে সে বলল,
” চাচি, আমি অরুণিমাকে দেখতে এসেছিলাম। যদি ওর কাছে নিয়ে যেতেন। ”

এমন বিনয়ীসহিত অনুরোধ শুনে তিনি থামলেন। ম্লান স্বরে বললেন,
” ও তো বাসায় নেই, বাবা। ”

সঞ্জয়ান বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বিস্ময়াপন্ন হয়ে সুধাল,
” কোথায় গেছে? ”
” ডাক্তার দেখাতে। ”
” একা? ”
” না। ওর বাবার সঙ্গে। ”

সঞ্জয়ানের চিন্তা ভাব দূর হলো। টুলে বসল ধীরে ধীরে। মনে মনে ঠিক করল, অরুণিমার সাথে অসীউল্লাহকেও কয়েক দিন ছুটি পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবে। প্রায় আধ ঘণ্টা পর অসীউল্লাহ মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে ফিরলেন। তাকে ভেতর রুমে রেখে এসে সঞ্জয়ানের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সে কুশল বিনিময় সম্পন্ন করে জিজ্ঞেস করল,
” ডাক্তার কী বলেছে, চাচা? ”
” ওষুধপত্র দিয়েছে। নিয়ম করে খাওয়ালেই এক-দুই দিনের মধ্যে সেরে যাবে। ”

বেশ কিছুক্ষণ কথা-বার্তা চালিয়ে যাওয়ার পর কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি এলো। অরুণিমার সান্নিধ্যে দাঁড়ানোর সুযোগ পেল। সঞ্জয়ান কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে বলল,
” জ্বরটা কি ভয় থেকে এলো? ”

অরুণিমা চাহনি উপরে তুলল। ক্লান্ত চোখ জোড়ায় অসীম বিস্ময়! বিচলিত স্বরে সুধাাল,
” ভয় পাব কেন? ”

অসুস্থ হওয়ায় মাইমূনের বিষয়টা সরাসরি তুলল না। বলল
” অহীদুলের জন্য। নিশ্চয় খারাপ ব্যবহার করেছে? ”

অরুণিমার বিচলিত ভাবটা ঢাকা পড়ল। শুকনো ঠোঁটজোড়া টেনে হাসার চেষ্টা করে বলল,
” না, খারাপ ব্যবহার করেননি। পুলিশ মানুষরা তো একটু অমন হয়। ”
” পছন্দ হয়েছে? ”

অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনে অরুণিমা বিব্রত বোধ করছে। দৃষ্টি নামিয়ে নিল। পুরো শরীরটা হালকা নাড়িয়ে ভালো করে বসার চেষ্টা করছে এমন ভাব। সঞ্জয়ান উত্তরের আশায় থাকলেও ধৈর্য হারিয়ে ফেলল। নিজ থেকেই বলল,
” আমি শুনেছি, মিয়া ভাইকে নিয়ে অহীদুলের মনে একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে। এর জন্য দায়ী আমি। আমার আগে থেকে এই বিষয়টা বলে রাখা উচিত ছিল। তুমি চিন্তা করো না, আমি সব ঠিক করে দিব। ”
” প্রয়োজন নেই। ”

সঞ্জয়ান প্রথম থেকেই অরুণিমার দিকে চেয়ে ছিল। এবার দৃষ্টিটা আরও প্রখর ও অভিনিষ্ট হলো। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
” বুঝতে পারিনি। কিসের প্রয়োজন নেই? ”

অরুণিমা দুর্বল স্বরে পরিষ্কার ভাবে বলল,
” আপনার দায়ের ভার কমানোর প্রয়োজন নেই। আপনার এই পুলিশ বন্ধুটি একটু বেশিই সময় সচেতন মানুষ। আমি হয়তো মানিয়ে নিতে পারব না। ”

সঞ্জয়ান মনে মনে বলল, ‘ ঠিক সময়ে তোমাকে নয়, অহীদুলকেই মানিয়ে নেওয়ার অস্থিরতায় ভোগাবে। ‘ সামনাসামনি বলল,
” ভেবে বলছ? ”

উত্তরটা মুখে এলো না। মাথা কিঞ্চিৎ দুলাতে সঞ্জয়ান রুম থেকে বেরিয়ে আসে। অসীউল্লাহ বাইরে থেকে কথা-বার্তা শুনেছিলেন। তিনি বললেন,
” আমার মেয়ের পছন্দ না হলে বাদ দিন, স্যার। আরও পাত্র আছে। ”
” আগে সুস্থ হোক, তারপর নাহয় অন্য পাত্রের ছবি দেখাবেন। ”

পরের দিন এক ভ্যান সাজনা গাছের কচি পাতা পাঠিয়ে দিল অরুণিমাদের বাসায়। তাই দিয়ে নাজিয়া বেগম তিনবেলা ভাজা বড়া, ভাজি, ঝোল করে রেঁধে দিচ্ছেন শূভ্রার পাতে। প্রতিবেলায় একই জিনিস দেখে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠল। বিরক্ত ঝাড়তে অসীউল্লাহ আশ্চর্যের মুখ বানিয়ে বললেন,
” এটা না তোর প্রিয়? তাহলে রাগ দেখাচ্ছিস কেন? ”

শূভ্রা তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করল,
” এ কথাটা তোমাকে কে বলেছে, বাবা? ”
” সঞ্জয়ান স্যার। তার কাছে নাকি খেতে চেয়েছিস তাই বেশি করে পাঠিয়েছে। ”

মেয়ের দিক থেকে মুখ সরিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,
” শেষ হওয়ার আগে আমাকে জানিও। স্যার বলেছেন, আবার পাঠাবেন। ”

___________

অরুণিমা পুরোপুরি সুস্থ। ক্যান্টিনের কাজে যোগ দিয়েছে গতকাল থেকে। অসীউল্লাহ রাতের খাওয়া শেষ করে মেয়েকে ডেকে আনলেন নিজ রুমে। অহীদুলের ছবি ও জীবন বৃত্তান্ত ফেলে দিলেন তার সম্মুখে। বাকি তিনজনের ছবি একত্রে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
” দেখ তো মা কাকে পছন্দ হয়। ”

অরুণিমার মুখমণ্ডলে ক্লান্তভাব লক্ষ্যে আসে। অনাগ্রহের চাহনি রেখে বলল,
” তুমি দেখ, বাবা। তোমার পছন্দই আমার পছন্দ। ”

অসীউল্লাহ খুশি হলেন। চোখে ও ঠোঁটে গর্বের দ্যুতি প্রকাশ হলো। বুকের ভেতরটা পরিপূর্ণ হলো অপরিমেয় কৃতজ্ঞতা ও তৃপ্তির ওজনে।

অরুণিমার সামনে বাবা ছবিগুলো এক এক করে দেখছিলেন। এই দৃশ্যটি তার দু’খানা নয়ন সয়তে পারল না। কোথাও বেলের কাঁটার আঘাতের মতো ব্যথা অনুভব করছে। যাকে প্রশ্রয় দেওয়ার মতো সাহস হলো না। অনুমতি না নিয়ে চট করে সরে এলো।

__________

সঞ্জয়ান ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে আধ ঘণ্টার মতো বাবার রুমে বসে থাকে। এই সময়টায় স্বর্ণলতা স্বামী সেবায় ভীষণ ব্যস্ত থাকেন। মুনসুর সাখাওয়াত দুইবার গোসল করায় অভ্যস্ত। বয়স বাড়ার সাথে সাথে নানান রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। এগুলোর মধ্যে সর্দি ও টনসিল ফুলে যাওয়ার সমস্যাটাও আছে। এজন্য রাতে গোসল করতে দেন না স্বর্ণলতা। মুনসুর সাখাওয়াতের মনের শান্তির জন্য নরম কাপড় ভিজিয়ে গলা থেকে কোমড় অবধি মুছে দেন। আজও তাই করছিলেন। হঠাৎ বললেন,
” ঐদিকের খবর কী? আমরা কবে যাচ্ছি? ”

শুরুতে সঞ্জয়ান বুঝতে পারেনি। সংশয় নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কোন দিকে? কোথায় যাবে? ”
” তোর শ্বশুরবাড়িতে। বিয়ের তারিখ ঠিক করতে হবে না? নাকি আমাদের ছাড়া বিয়েটাও করে ফেলবি? ”

স্বর্ণলতার রসিকতায় মৃদু হাসল সে। সলজ্জায় বলল,
” এমনটা কখনও হবে না, মা। ”
” তাহলে নতুন কিছু বলছিস না যে? ”

সঞ্জয়ান নিরুত্তর। নিজেকে অরুণিমার অযোগ্য হিসেবে সনাক্ত করার পরও যাচাই করার সুযোগটা হাত ছাড়া করেনি। অসীউল্লাহকে দেওয়া চারটি ছবির মধ্যে একটা তার। বড্ড যত্ন ও সাজসজ্জা করে তুলেছে। ছাব্বিশ বছরে অর্জন করা সকল গুণ ও দক্ষতাও কাগজে ছাপা অক্ষরে লিপিবদ্ধ করেছে। তবুও ডাক পড়েনি। তার ধারণাই হয়তো ঠিক ছিল, অসীউল্লাহর মেয়ের সামনে সে অযোগ্য, অপছন্দনীয়। তালিকার বহির্ভূত! এই প্রথম নিজের কাজ নিয়ে আফসোস হচ্ছে। মায়ের উপর রাগ হচ্ছে। কেন সে, ব্যবসাতে উৎসাহিত না করে পুলিশ কিংবা সামরিক বাহিনির প্রতি প্রলুব্ধ করল না!

” তোর ফোন বাজছে। ”

মায়ের কণ্ঠ পেয়ে কেঁপে ওঠল। আপন ভাবনায় মশগুল হয়ে চেতনা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সে। দ্রুত হস্তে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে অরুণিমার বাবার কল। ধরতে ওপাশ থেকে শুনতে পেল,
” স্যার, ভুল করে আপনার বন্ধুর পরিবর্তে আপনার ছবি দিয়ে ফেলেছেন। ”

সঞ্জয়ানের বুকের রক্ত ছলকে ওঠল বুঝি! সূচ ঢোকার মতো অনুভূতি হলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলল। লজ্জা ও বেহাপনার সর্বোচ্চ ডালটায় উঠে চড়ে বলল,
” ভুল করে না, ইচ্ছে করেই দিয়েছি। ”

এবার ঐপাশটাও কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিশ্চুপ, শব্দহীন হয়ে গেল। আচমকা নীরবতা ভেঙে এলো,
” আপনিও কি…”

কথাটা সম্পন্ন হলো না। সঞ্জয়ান টের পেল অর্ধ সম্পন্ন বাক্য উচ্চারিত মানুষটার গলা কাঁপছে। সে দ্রুত জানাল,
” হ্যাঁ। যদি আপনারা রাজি থাকেন। ”
” রাজি হব না কেন? এ যে আমাদের পরম সৌভাগ্য! ”

অসীউল্লাহর মতো সঞ্জয়ানেরও নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। আবেগপ্রবণ হলেও বিবেচনার নিয়ন্ত্রণ হারায়নি। বিচক্ষণের গুণটাকে প্রয়োগ করে বলল,
” শুধু আপনি রাজি হলে হবে না, চাচা। অরুণিমার মত জানাটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। ”
” আপনাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস আছে ওর? আমার তো মনে হয়, মনে মনে আপনাকেই পছন্দ। সেজন্যই অন্য ছেলেকে পছন্দ হচ্ছে না। বিয়ে করতে রাজিও হয়েছিল আপনার কথায়। ”

অরুণিনা তাকে চাই। মনে মনে তাকে পছন্দ করে রেখেছে। কথাগুলো এত ভালো লাগল! এতদিন মনের মধ্যে যে অনিশ্চয়তা ও অশান্তি নিয়ে ঘুরছিল তা এক নিমিষেই ধূলোর মতো মিলিয়ে গেল। মনের গোপন ও বিলাসপূর্ণ বাগানটায় বসন্তের হাওয়া বয়তে শুরু করেছে, কোকিলও তো ডাকছে! সঞ্জয়ান চোখ বন্ধ করে সেই হাওয়া থেকে প্রেমের ঘ্রাণ টেনে নিল, কোকিলের কণ্ঠে ভালোবাসার গান শুনতে শুনতে বলল,
” আমি কালই অরুণিমার সাথে দেখা করতে চাই। ”
” অবশ্যই করবেন। কখন আসবেন বলুন, আমিও বাসায় থাকার চেষ্টা করব। ”
” বাসায় না, বাইরে। আপনি দয়া করে অরুণিমাকে আমার কথা বলবেন না। চমকে দিতে চাই। ”
” আপনি যেটা ভালো মনে করেন। আমার মেয়েটাকে তো আগেই আপনার হাতে তুলে দিয়ে ছিলাম। এবার সাক্ষী নিয়ে সারাজীবনের দায়িত্ব দেওয়ার অপেক্ষায়। ”

______________
অরুণিমা ক্যান্টিন বন্ধ করে কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেছে। রাস্তা ফাঁকা। তেমন লোকজন নেই, খালি রিকশাও না। সে একপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আজও তাকে সেই কফি হাউজটায় যেতে হবে। অহীদুলের মতো অন্য একটি অপরিচিত ছেলের সাথে দেখা করতে হবে। ভাবতেই পেটের ভেতরটায় মোচড় দিয়ে ওঠল, জোর করে অপছন্দ খাবার খেলে যেমন হয় ঠিক তেমন! রিকশার অপেক্ষা করতে করতে একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য বিজলির মতো মস্তিষ্কে জ্বলে উঠে হারিয়ে গেল। দৃশ্যটা কাল রাতের ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্নের অংশ। যার কেন্দ্রিয় চরিত্রে ছিল মিয়া ভাই। মিয়া ভাইকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে, কথাটা যতবার মনে পড়েছে ততবারই শিউরে ওঠেছে। মাত্রই আরও একবার শিউরে ওঠল। অরুণিমা হাতের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেখল, ছুরির ফলার মতো সবকটা লোম দাঁড়িয়ে গেছে। ঠিক যেন, মিয়া ভাইয়ের গলায় ধরে রাখা ছুরিটা! সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা সিনেমার মতো চলতে লাগল। একটা বিশাল ও উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে মাইমূন। তার চোখদুটো সূর্যের মতো তীক্ষ্ণ ও উত্তপ্ত। চাহনিতে ব্রহ্মাণ্ড পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ক্ষমতা। সেই মানুষের গলায় ছুরি ধরে আছে একটি নারী হাত। মুখটা অরুণিমার দৃষ্টি সীমার বাইরে হলেও মাইমূন ঠিক চিনে। তাই তো চেঁচিয়ে বলছে, ‘ আমাকে শেষ করে দাও, নাহয় আমার সাথে সাথে পুরো পৃথিবী ধ্বংস করে দিব। ‘

চলবে
]