আঙুলে আঙুল পর্ব-২৭+২৮

0
203

আঙুলে আঙুল
পর্ব (২৭)

দুই ঘণ্টা যাবৎ শূভ্রা ও সঞ্জয়ান এক রুমে একসাথে আছে। এরমধ্যে এক সেকেন্ডের জন্যও শূভ্রার কান্না বন্ধ হয়নি। অবিরাম সেই কান্নার শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসলেও কানে বাজছে খুব। সঞ্জয়ান দূরে দাঁড়িয়েও লক্ষ্য করল, মেয়েটা কাঁপছে। চোখ, মুখ ভিজে লাল হয়ে গেছে। হেঁচকি উঠামাত্র সে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। বিরক্ত ও বিস্ময় নিয়ে স্বগোতোক্তি করল, ‘ একটা মানুষ এতক্ষণ কাঁদে কিভাবে? ক্লান্তি লাগে না? ‘ সে দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়াল। সিটকানি খুলতে গিয়ে মনে পড়ল, ঐপাশটায় বাবা চেয়ার নিয়ে বসেছিল। এখনও আছে নাকি বুঝার জন্য দরজায় আড়ি পাতল। তখনই মায়ের গলা শুনতে পেল। তিনি বলছেন,
” এখানে বসে ঝিমুচ্ছেন যে! রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। ”

এবার বাবার গলা ভেসে এলো। তিনি উত্তরে বলছেন,
” আমি যাই আর তোমার ছেলে ফাঁকি দিক, তাই না? ”
” কাকে ফাঁকি দিবে? ”
” নিজেকে। ”
” কিভাবে? ”
” সে তুমি বুঝবে না। যাও এখান থেকে। ”

সঞ্জয়ান জানে, তার মা কখনও বাবার সাথে তর্ক করে না। উঁচু স্বরে কথাও বলে না। যদি মনে হয় তিনি ভুল বলছেন তাহলে মা চুপ থাকেন। পরবর্তীতে নিজের মতো করে ভুলটা সুধরে দেন। তাই ভাবল, মা চলে যাবে। কিন্তু যাননি। তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে জিজ্ঞেস করলেন,
” বুঝব না কেন? ”
” অল্প বয়সে বিবাহের সুধা পান করলে বাসর রাতের সুমিষ্ট স্বাদ অনুভব করতে পারে না। তুমি পারনি, তোমার ছেলেও পারবে না। ”
” আমার ছেলে কি অল্প বয়সে করেছে? আবারও ওর বয়স ভুলে যাচ্ছেন। ”
” ভুলে যাইনি। শরীরের নয় ওর মনের বয়সের কথা বলছি। তাছাড়া আমার সাথে তুলনা করলে তো শরীরের বয়সও কম হয়। ঠিক বললাম তো, আদুরী? ”

এখানে কথা-বার্তা থেমে গেল। সঞ্জয়ানেরও মনোযোগ সরে গেল। আপনচিন্তায় বিভোর হয়ে যাচ্ছে, প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে অজান্তেই, ‘ মনেরও বয়স হয়! সেই বয়স বাড়ানোর কৌশল কেমন? নিয়ম কী হয়? ‘ অচেতন হয়ে অসাবধানে হাঁটার ফলে বিছানার সাথে ধাক্কা খেল অকস্মাৎ! শব্দটা হালকা হলেও শূভ্রা ভয়ে চমকে ওঠল। অশ্রু ভর্তি চোখ জোড়া মেলে চেয়ে আছে সঞ্জয়ানের দিকে। জিজ্ঞাস্য দৃষ্টি। সে প্রথমে হকচকিয়ে গেল। পর মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” এখনও কোনো উপায় খুঁজে পাইনি। ”

সমুদ্রের জলে সূর্যের আলো পড়লে যেমন ঝিলিক দিয়ে উঠে শূভ্রার চোখের অশ্রুরাও তেমন ঝিলিক দিয়ে উঠে কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। ক্লান্ত অথচ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
” আমি বাড়ি যাব। ”

সঞ্জয়ানের ভেতরটা বাতাসের মতো দুলে ওঠল। নিজের অপরাধটা প্রাণ ও শরীরসহ সমুখে দেখা দিচ্ছে যেন! ভুলের ভেলায় ভেসে বিশাল মাপের অন্যায় নামক সমুদ্রে পতিত হওয়া মুহূর্তটা মস্তিষ্কে আরও একবার বিজলির মতো জ্বলে ওঠল। সে অস্থির কিন্তু নরম স্বরে বলল,
” তুমি কোনো উপায় পেলে, বলো আমাকে। ”

তার বাক্যার্থে সন্ধি তৈরির ইচ্ছা। দুষ্কর্মটা ঢাকার প্রচেষ্টা। আরও কিছু মুহূর্ত কেটে গেল চুপচাপ, নীরবে। কান্নার শব্দটা একেবারে মিইয়ে এসেছে। সঞ্জয়ান আড়চোখে তাকাল পাশে। সে ধীর কদমে বিছানার এককোণে বসেছিল উপায় খোঁজার মাঝে। শূভ্রার উল্টোপাশে। দূরত্ব মেপে নিয়ে। দেখল, কান্না থামার সঙ্গে চোখের পানিও ফুরিয়ে এসেছে। চোখ বন্ধ করে ঝিমুচ্ছে। একপাশে হেলছে একটু একটু করে। যেকোনো মুহূর্তে পড়ে যাবে। সঞ্জয়ান সাবধান করতে চেয়ে বলে ফেলল,
” শাড়িটা বদলে ঘুমাও। ”

শূভ্রা আবারও ভয়ে চমকে ওঠল। উদ্ভ্রান্তের মতো চারপাশে দৃষ্টি বুলাচ্ছে। সঞ্জয়ান পাশ থেকে বলল,
” ভূত না আমি কথা বলেছি। ”

শূভ্রা অবোধের মতো চেয়ে আছে। মুহূর্তটাকে মাথায় সেঁট করার সময় পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে পাল না। তার চোখে ঘুমের ঝাঁপি নেমে এলো। চোখজোড়া আলগোছে বন্ধ হতে শুরু করলে সঞ্জয়ান পুনরায় বলল,
” শাড়িটা বদলে ঘুমাও। ”

বন্ধ চোখজোড়া খুলে গেলেও মস্তিষ্ক সজাগ হলো না ঠিকমতো। অশান্ত, অভদ্র মেয়েটা প্রথমবারের মতো সঞ্জয়ানের কথা শুনল। বিনাবাক্যে আদেশ পালনে তৎপর হলো। গোসল খানার দিকে হাঁটা ধরলে সঞ্জয়ান পিছু ডাকল,
” দাঁড়াও। ”

শূভ্রা থামল। সঞ্জয়ান বিছানা থেকে উঠে নিজের আলমিরাহ’র দিকে ছুটে চলল ব্যস্ত চালে। তার মন বলছে, মা-বাবা এত আয়োজন করেছে, মেয়ের কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থাও করে থাকবে। তেমন হয়ে থাকলে, কাপড় তার আলমিরাহতেই থাকবে। সে চট করে পাল্লা মেলল। নিচের তাক ছেড়ে উপরের তাকে চোখ যেতেই তার মনের ভাবনা সত্যি হয়ে গেল। ভাঁজ করে রাখা তিনটা সুতির শাড়ি। সে একটা ছোঁ মেরে নিয়ে শূভ্রার দিকে বাড়িয়ে বলল,
” এটা পরো। ”

কথাটা বলেই বুঝল, শূভ্রার কানে ঢোকেনি। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। সঞ্জয়ান মৃদু স্বরে ডাকল,
” শূভ্রা? ”

এক ডাকে কাজ হলো। সে চোখ মেলেছে। সঞ্জয়ান শাড়িটা এগিয়ে দিয়ে আরও একবার বলল,
” এটা পরে আসো। ”

শূভ্রা কাপড় নিয়ে সামনে এগুনোর পরিবর্তে বুকে জড়িয়ে ধরে আবারও চোখ বন্ধ করে ফেলল। এই পর্যায়ে বিরক্তের ছায়া নামল সঞ্জয়ানের মুখজুড়ে। ইচ্ছে হলো ধমক দিতে। পরক্ষণে দমিয়ে ফেলল। আশঙ্কা করল, ঘুম ভেঙে গেলে এই মেয়ে কান্না-কাটি জুড়ে দিবে। বাড়ি যাওয়ার জেদ ধরবে। তাই রাগ সংবরণ করে নরম স্বরে বলল,
” এটা পরে এসে ঘুমাও। বিছানা সাজানোই আছে। ”

বেশ কয়েক বার বলার পর শূভ্রা স্নাগারে ঢুকল। সঞ্জয়ান বিশাল বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছে এমনভাবে শান্তির নিশ্বাস ফেলল। উপলব্ধি করল, এমন নিশ্বাস তার ব্যবসা সামলাতে গিয়েও ফেলতে হয় না। সে ক্লান্তভাবে বিছানায় এসে বসল। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতে তার চোখদুটিও ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে এলো। পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার আগে মনে পড়ল শূভ্রার কথা। ঘুম ছুটে গেল তৎক্ষনাৎ। ঝটিতে তাকাল স্নাগারের দিকে। দরজাটা বন্ধ। মেয়েটা এখনও বেরুচ্ছে না কেন? শাড়ি বদলাতে এত সময় লাগে? সে ঠিক করল, শূভ্রাকে ডাকবে। দরজা পর্যন্ত গিয়েও থেমে গেল। শাড়ি পরায় তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কাপড়ের দৈর্ঘ্য বেশ! সময় লাগতেও পারে। সে নিজেই নিজেকে আশা দিয়ে শান্তকরণ করল। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকল না। প্রায় আধ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও শূভ্রা বেরুচ্ছে না। সে ভয় পেয়ে গেল। একই সাথে অনুমান করল, এই মেয়ে ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই দরজায় আঘাত করে ডাকল,
” শূভ্রা? দরজা খোল। জলদি। ”

লাগাতার দরজা ধাক্কানোর শব্দের মধ্যে আরেকটা শব্দও মিশে গেল। সেই শব্দটা সঞ্জয়ানের কানে গেল না। ডাকাডাকি থামল, শূভ্রা বেরিয়ে এলে। তার আধো চোখ মেলে কান্না প্রায় গলায় বলল,
” আপনি আমার রুমে কী করছেন? বাজারে যান। বি’র’ক্ত করবেন না। ”

বলতে বলতে সে বিছানার দিকে দৌড়ে গেল। বালিশের প্রয়োজনবোধও করল না। এলোমেলোভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল ধপাস শব্দে। সঞ্জয়ান নিজ জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে আছে। অবাক চোখে চেয়ে দেখছে শূভ্রাকে। শাড়ি, গয়না কিছু খুলেনি। আগের মতোই পরে আছে সব। তাহলে এতক্ষণ ভেতরে কী করছিল? ভাবনাগুলো মস্তিষ্কে উদ্ভুত হতে ঠোঁটদুটি অজান্তেই উত্তর করল, ‘ ঘুমাচ্ছিল। ‘ তারও বেজায় ঘুম পেয়েছে। চোখের পলক মেলে রাখা দায়। সে ভেবেই পাচ্ছে না, হুট করে এমন দুর্দমনীয় ঘুম এলো কোত্থেকে। তার তো রাত জাগা অভ্যাস আছে। সঞ্জয়ান নিজের ঘুমের জায়গা খুঁজতে ব্যস্ত হলো। শূভ্রা বিছানায় এমনভাবে শুয়েযে যে, সে ঘুমাতে চাইলে বেকায়দায় পড়ে যাবে। অন্য কোথাও শুতে হবে। বাইরে? বাবা আছে যে! নিশ্চিত, বাবার সাথে মাও আছে। তাহলে উপায়? একমাত্র মেঝে। সে অসন্তুষ্ট মনে নিচে বিছানা করল। শোয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। সেই মুহূর্তে তার নজর গিয়ে পড়ল শূভ্রার পায়ে। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে লাল রঙের তরল বেয়ে পড়ছে। আলতা? না, র’ক্ত। সঞ্জয়ান ভয় পেয়ে গেল। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল ঠিক শূভ্রার পায়ের কাছে। আলতো স্পর্শ করতে গিয়ে সর্বাঙ্গ শিরশির করে ওঠল! একটু নয় অনেকটায় জ’খ’ম হয়ে গেছে। নখটা উল্টে গেছে সম্পূর্ণ। থে’ত’লে যাওয়া মাংসটাও র’ক্তে ডুবে আছে। এখনই চিকিৎসা প্রয়োজন। নাহলে র’ক্ত ঝরেই যাবে। সঞ্জয়ান অনিচ্ছায় দৌড়ে গিয়ে ক্লিনজার, মলম, তুলো ও ব্যান্ডেজ নিয়ে এলো। ক্লিনজার দিয়ে তুলো ভিজিয়ে আ’ঘা’তে স্পর্শ করতে শূভ্রা নড়ে ওঠল। পা টেনে নিয়ে গড়িয়ে গেল বিছানার মাঝামাঝি। অগত্যা সঞ্জয়ানকে বিছানায় বসতে হলো। শূভ্রার পায়ের র’ক্ত পরিষ্কার করতে নিলে সে আবারও টেনে নিল। এবার সে শক্ত করে পা চেপে ধরল। টেনে এনে রাখল নিজের কোলে। র’ক্ত পরিষ্কার করে মলম লাগানোর সময় শূভ্রা পিটপিটে তাকাল। পা সরিয়ে নেওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করে চিৎকার করল,
” সাজনা শাক! ছাড়ুন, আমি ঘুমাব। ”

সে ছাড়ল না। ব্যান্ডেজটা এত শক্ত করে বাঁধল যে শূভ্রা ঘুমের ঘোরেও ব্যা’থা’য় কাতরে ওঠল। ক্ষীণ স্বরে আ’র্ত’চিৎকার করল।

____________

অরুণিমা ভেবেছিল, বিয়ে ভেঙে দেওয়ায় হয়তো সঞ্জয়ান তাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিবে। স্বর্ণলতায় ঢোকা নিষেধ করে দিবে। তেমনটা হয়নি। স্বর্ণলতার সামনে দাঁড়াতে, অন্যান্য কর্মচারীরা সাদরে গ্রহণ করে। তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে নিজেদের কাজে মশগুল হয়। অনেক দিন পর কাজে প্রবেশ করায় একটু সমস্যা হচ্ছিল, ভুল হচ্ছিল। অন্যরা সেটাকেও খুশিমনে সামলে নেয়। নতুন করে শিখিয়ে দেয়। অদৃশ্যভাবে এদের মধ্যে সঞ্জয়ানের ছায়াটাকেই দেখতে পেয়েছে। কাজ শেষে যখন বাইরে বেরুল তখনই মনটা খারাপ হয়ে গেল। আগের মতো বাবা তার অপেক্ষায় নেই। সে মাথা নিচু করে শ্বাসরুদ্ধ করে কলেজের ফটকের দিকে এগুচ্ছে। সহসা মাইমূনের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। অরুণিমা থমকে গেল। পেছন ফিরতে দেখল, সে কলেজের প্রশাসনিক ভবন থেকে বেরিয়ে আসছে। দ্রুত কদমে তার সামনে এসে দাঁড়াতে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি? ”

মাইমূন হালকা হেসে বলল,
” তোমার অপেক্ষা করছিলাম। ”
” এখানে? কেন? ”

মাইমূন সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর করল না। অরুণিমার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টি রেখে বলল,
” তুমি খুশি হওনি? আমি ভেবেছিলাম, খুব খুশি হবে। ”

অরুণিমা অপ্রস্তুত হেসে বলল,
” তোমাকে এখানে দেখিনি কখনও। ”
” তোমার মানা ছিল, তাই আসিনি। দেখনি। ”

চলবে

আঙুলে আঙুল
পর্ব (২৬)

অরুণিমা বাসা থেকে বেরিয়ে ছাদে এসেছে। একপাশে আড়ালে দাঁড়িয়ে ছোট বোনের বিদায় কান্না দেখছে। তার চোখেও কান্নার তৃষ্ণা এসেছে। সে পাত্তা দিল না। নিষ্ঠুরের মতো সংবরণ করে নিল। শূকনো চোখজোড়া শুধু র’ক্ত’বর্ণ হচ্ছে ধীরে ধীরে।

” মন খারাপ? ”

হঠাৎ অন্য কারও গলা পেয়ে সে চমকে কেঁপে ওঠে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় সচকিত বদনে। অন্ধকারে ডুবে থাকা পুরুষ অবয়বটি অনুরণিত কণ্ঠটির মতোই পরিচিত।

” এগুলো তোমার জন্য। ”

মাইমূনকে চিনতে পেরে তার আ’ত’ঙ্ক কমেছে, ভ’য় দূর হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়টা এখনও কাটেনি। এই সময়ে এই জায়গায় তার উপস্থিতিটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয়।

” ফুলগুলো পছন্দ হয়নি? ”

অরুণিমা বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টিতে তার হাতের দিকে তাকাল। দুই হাতের কোষ ভর্তি ঝরা বকুল ফুল। বেশ সতেজ, স্নিগ্ধ। সুগন্ধ ছড়াচ্ছে একটু একটু করে। মাতাল করে তুলছে চারপাশ। মাইমূন মনখারাপের সুরে বলল,
” তোমার পছন্দের ফুলের নাম জানা হয়নি এখনও। তাই এবারও আমার পছন্দের ফুল নিয়ে এসেছি। এজন্য খুবই দুঃখিত। ”

অরুণিমা হাত পাতল। মাইমূন ফুলগুলো তার হাতে দিতে দিতে বলল,
” জানো তো, ফুল ও মনখারাপ দুটোর একসাথে থাকতে নেই? ”

সে উত্তর দিল না। উদাস চোখে তাকিয়ে আছে দূরের রাস্তাটায়। যেদিক দিয়ে মাত্রই শূভ্রা ও সঞ্জয়ান একই গাড়িতে চড়ে চলে গেছে। মাইমূনও তাকাল সেদিকটায়। পরক্ষণে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল নিজের ভালোবাসার মানুষটির দিকে। বলল,
” এমনি এমনি ফুল নিতে হয় না। এতে তাদের সৌন্দর্যের অপমান করা হয়। ভালোবাসা, এই ফুলগুলোর বিনিময়ে আমি কী পাব? ”

অরুণিমার দৃষ্টিও ফিরে এলো। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি রাখলে সে পুনরায় বলল,
” আমার চাওয়ার সুযোগ থাকলে তোমার মনখারাপটা চাইব। এতে কিন্তু তোমারও লাভ। ফুল ও মনখারাপ একসাথে থাকতে পারবে না। ”

মাইমূন খালি হাত জোড়া নিয়ে আঁজল আকারে অরুণিমার মুখের সামনে এমনভাবে ধরে আছে যেন, তার মুখ থেকে মনখারাপ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে! অরুণিমা এই অদ্ভুত প্রেমবাচন, দরদ আচরণে মুগ্ধ হতে পারছে না। খুব একটা গুরুত্ব দিল না। তার মন ও মস্তিষ্কে দুটো কথায় ঘুরপ্যাচ খাচ্ছে। প্রথমটা শূভ্রার বিয়ে হয়ে গেছে, এ বাড়ি ছেড়ে চলেও গেছে অথচ কেউ তার খোঁজ করেনি। আপন পরিবার থেকে কি সে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে? দ্বিতীয়টা এত রাতে এখানে মাইমূন কী করে এলো? সে কী করে জানল, অরুণিমা ছাদে আছে। তার মনখারাপ। প্রথমটার উত্তর এখন না পাওয়া গেলেও দ্বিতীয়টা পাওয়া সম্ভব। মাইমূনকে প্রশ্ন করলেই পেয়ে যাবে। কিন্তু তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। একেবারেই না। এমন নীরব, চুপচাপ থাকতে ভালো লাগছে।

” মনে হচ্ছে, কারণ না জানলে মনখারাপ দূর হবে না। অরুণিমা, কী হয়েছে আমাকে বলবে? ”

অরুণিমার হালকা দৃষ্টি এবার গাঢ় হতে বাধ্য হলো। মাইমূন তাকে সচরাচর ভালোবাসা বলেই ডাকে। অরুণিমা নামে আগে ডেকেছিল নাকি মনে নেই কিংবা আজকের মতো খেয়াল করে শুনেনি। সে ভালো করে সামনের মানুষটার মুখের দিকে তাকাল। চোখদুটিতে পাহাড়ের মতো নিটোল গাম্ভীর্য, প্রবৃত্ত। কিছু একটা অর্জন করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।

” আমি জানি, আজ শূভ্রার বিয়ে হয়েছে। মনখারাপটা এই কারণে নাকি অন্য কিছু? ”

মাইমূন কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ব্যাকুল স্বরে সুধাল,
” আংকেলকে আমার ব্যাপারে বলেছ? তিনি কি আরও রেগে গেছেন? ”

অরুণিমার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। শুরু থেকেই মাইমূনকে তার বাবা পছন্দ করেনি। সম্পর্কটাকে মেনে নেওয়ার কোনো লক্ষণও দেখতে পারছে না। এরমধ্যে যদি মাইমূনের জন্ম ইতিহাত তুলে ধরে তাহলে পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাবে। যে মুঠো পরিমাণ আশা নিয়ে চলাফেরা করছে সেটাও হয়তো আর থাকবে না। মাইমূন উত্তরের অপেক্ষা করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠল। খানিক অভিমানি সুরে প্রশ্নটা করল,
” তুমি কি এমন চুপই থাকবে? কিছু বলবে না? ”

অরুণিমা চোখের পলক ফেলল। মুখটা সরিয়ে নিল অন্যপাশে। একটু বামে সরে গিয়ে আগের মতোই নিস্তব্ধ হয়ে আছে। মাইমূন নিজ জায়গা থেকে নড়ল না। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
” আসছি। কথা বলতে ইচ্ছে হলে কল করো। ”

তার কণ্ঠ ভার, শীতল। বাক্যভাবে হতাশা, অবসন্ন। ধীর পদক্ষেপে ছাদ থেকে নেমে যাওয়ার দরজাটার নিকটে গিয়ে পৌঁছাল। নিচে না নেমে আচমকা পেছন ফিরে ডাকল,
” ভালোবাসা? ”

অরুণিমা চমকে তাকাল। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি রাখলে সে জিজ্ঞেস করল,
” তোমাকে ‘ ভালোবাসা ‘ নামে ডাকি কেন, জান? ”

সে আবছা আলো-আঁধারির মধ্যে মাথা দুপাশে নাড়ল। মাইমূন দূর হতে মৃদু হেসে বলল,
” কারণ, তুমি হলে আমার ছোট্ট হৃদয়ের সবটা ভালোবাসার একমাত্র মালিক। যার ভাগ আমি কাউকে দিতে পারিনি, কেউ নিতেও পারেনি। এ আমার দুর্ভাগ্য নাকি সৌভাগ্য আজও বুঝতে পারিনি। বুঝার দায়িত্ব তোমাকে দিতে চাই। ভালোবাসা, দায়িত্বটা নিয়ে আমার ভাগ্যটাকে নির্ণয় করে দেও। ”

তার এই আকুল আবেদন, হৃদয় বিদারক প্রার্থনায় অরুণিমার বোবা ভাব কাটিয়ে দিল। নিশিরাতের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মতো জড়িয়ে ফেলল গভীর মায়ায়। নিজস্ব চিন্তা-চেতনা থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
” আরেকটু আমার কাছে থাকুন। ”

মাইমূন দৌড়ভঙ্গিতে তার পাশে এসে দাঁড়াল। চাঁদের জোসনার মতো চোখ ও ঠোঁটে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাচ্ছে। মিষ্টি হেসে মুক্ত স্বরে বলল,
” আর একটু না সারাক্ষণ তোমার কাছে থাকতে চাই। এই নিয়ে আমার মধ্যে বিরক্ত কিংবা অনিহা খুঁজে পাবে না কখনও। ”

বাক্যদুটোতে ভীষণ আবেগ, অনুভূতির প্রাবল্য। অরুণিমা টের পেল, তার মানব-চর্মের ফাঁকে ফাঁকে শিলাবৃষ্টির মতো তুমুল বেগে কিছু একটা পতিত হচ্ছে। শিউরে ওঠা শরীরটাকে দুই হাতে বেঁধে নিল। মাইমূন ব্যস্ত স্বরে সুধাল,
” শীত করছে? চাদর এনে দেব? ”

অরুণিমা এক ঝলক তাকিয়ে দৃষ্টি নিচু করে ফেলল। মাথা দুলিয়ে না বলতে সে পুনরায় বলল,
” এভাবে চুপ করে থাকলে থাকি কী করে? আমার খারাপ লাগে। মনে হয়, তুমি বিরক্ত হচ্ছ। ”

অরুণিমা দৃষ্টি উঁচু করল। সুধীর গলায় বলল,
” মাঝে মাঝে চুপ করে থাকার মধ্যেও স্বস্থি থাকে, আরাম পাওয়া যায়। তুমি কি চাও, আমি সেই স্বস্থি ভেঙে কথা বলি? ”
” সেরকম হলে কথা বলার প্রয়োজন নেই। আমি নাহয় তোমার নীরবতার সঙ্গী হয়ে থাকি। ”
” বাইরে হাঁটতে যাব? ”
” অবশ্যই। এসো। ”

মাইমূনের পেছন পেছন সেও ছাদ থেকে থেমে রাস্তায় এলো। এক কিনার ধরে চুপচাপ হাঁটল অনেক্ষণ। অরুণিমা যত সামনে এগুচ্ছে ততই যেন মাইমূনের উপস্থিতিটাকে ভুলে যাচ্ছে। মন ও মস্তিষ্ক দখল করে নিয়েছে সঞ্জয়ান ও শূভ্রার বিবাহের মুহূর্তটা। যে মানুষটা তাকে বিয়ে করতে এসেছিল সেই মানুষটা আজ তার ছোট বোনের স্বামী। হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদলের কারণ কী হতে পারে? প্র’তি’শো’ধ?

” আর সামনে যাওয়া কি ঠিক হবে? বারোটা পার হয়ে গেছে। আংকেল-আন্টি নিশ্চয় খুব চিন্তা করছেন। ”

অরুণিমা থেমে গেল। মাইমূনের দিকে চেয়ে আছে। নিষ্পলক চাহনি। মুখমন্ডলে মেঘের আবির্ভাব। ইচ্ছে হলো বলতে, বাসায় তার জন্য কেউ চিন্তা করছে না। চিন্তা করার মতো যে একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল সেটি ছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু বলা হলো না। নিরুত্তরে পা ঘুরিয়ে নিল ফেরার পথে। মাইমূন তাকে অনুসরণ করতে করতে একদম বাসার নিকটে এসে গেছে। মূল ফটকে ঢোকার পূর্বে বলল,
” অনেক ভেবে দেখলাম, সেদিন তোমাদের বাসায় আমার আসা উচিত হয়নি। ভাং’চু’র করাও খুব অন্যায় হয়েছে। আমি ভীষণ লজ্জিত ও অনুতপ্ত। তোমার বাবার কাছে কি ক্ষমা চাইব? ”

অরুণিমা ভেতরে ঢুকল। একটুক্ষণ নীরবে ভেবে বলল,
” আগে আমি ক্ষমা পাই, তারপরে তুমি চেষ্টা করো। ”
” আচ্ছা। ”

মাইমূনও ভেতরে ঢুকল। অরুণিমার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল,
” সেই খারাপ মুহূর্তের মাঝেও একটি আনন্দিত মুহূর্ত ছিল। কী জানো? ”
” কী? ”
” তোমার ‘ আপনি ‘ থেকে ‘ তুমি ‘ তে নেমে এসে আমাকে গ্রহণ করা। ”

কথা বলতে বলতে দুজনে সামনে এগুচ্ছে। অরুণিমাদের ফ্ল্যাটের সামনে আসতে দুজনে থমকে গেল। অসীউল্লাহ দরজা মেলে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে দেখে সে ভয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। মাইমূন পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। এই সময় অরুণিমার স্মরণ হলো, মাইমূন এই বাড়ির ছেলে।

___________
শূভ্রাকে নিয়ে বাসায় আসার পর বিস্ময়ের অন্ত খুঁজে পাচ্ছে না সঞ্জয়ান। তার রুমে ফুল ও বেলুন দিয়ে সাজানো। বিছানায় সাদা চাদর, মধ্যখানে গোলাপ ফুলের পাপড়ি ছড়ানো-ছিটানো। সে ভেবেই পাচ্ছে না এত অল্প সময়ে বাবা-মা এত কিছু করল কখন!

” আমি বাড়ি যাব। এখনই যাব। ”

কাঁদতে কাঁদতে কথা দুটি বলেছে শূভ্রা। সঞ্জয়ান বিছানা থেকে নজর নামিয়ে আনল মেঝেতে। শূভ্রা এখানে বসে কাঁদছে। পরনের শাড়ি, গয়না ঠিক স্থানে নেই। পুরো মুখ, গলা ও বুকের একঅংশ ভিজে গেছে চোখের পানিতে। ক্ষণে ক্ষণে কাঁপছে আর নাক টানছে। তার এত মায়া লাগল! চাহনি বদলে গেল সহানুভূতিতে। বেদনা ও দরদ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। বয়সের মাপে মেয়েটি তার থেকে অনেকটাই ছোট, কথাটা পূর্বেই অবগত ছিল। এখন যেন, বয়সটা আরও কমে এসেছে। কিছুতেই স্বীকার করতে পারছে না এই মেয়েটি তার বিবাহিত স্ত্রী। সারা জীবনের সাথী। জেদের বশে পড়ে একি করল! এমন একটা ভুলে জড়িয়ো পড়ল যা শোধরানোর সুযোগ ও সময় কোনোটায় পাবে না। অনুতাপে সঞ্জয়ানের বুকের ভেতরটা পুড়ছে। মাথার ভেতরটা ঝিমিয়ে আসছে। চিন্তা-ভাবনার শক্তি লোপ পেয়ে যাচ্ছে। হাত-পা হয়ে আসছে অসাড়। সে দরজার নিকটেই দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে এগুতে পারল না আর। তার এই অনুভূতিশূন্য অবস্থায় শূভ্রা দৌড়ে এলো। সঞ্জয়ানের কলার চেপে ধরে বলল,
” আপনি এটা কেন করলেন? কেন? আমি আপনাকে ছাড়ব না। ”

তার কণ্ঠে একই সাথে তীব্র ধ’ম’ক, শা’সা’নি। সঞ্জয়ান রা’গ করতে চেয়েও করল না। ঠাণ্ডা স্বরেই বলল,
” শূভ্রা ছাড়ো। এ ধরনের ব্যবহার আমার পছন্দ নয়। ”

সে ছাড়ল না। আরও শক্ত করে চেপে ধরল। চিৎকার করে বলল,
” না ছাড়ব না। আপনাকে মে’রে ফেলব। ছোটলোক, বদমাশ, লুচ্চা, বুইড়া ব্যাডা। মেয়ে মানুষ দেখলে শরীরে আগুন জ্বলে ওঠে। প্রথমে আপুকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। তা না করে আমাকে কেন করলেন? কচি মেয়ে দেখেই মাথাটা বিগড়ে গেছে, তাই না? ”

বলতে বলতে সঞ্জয়ানের হাতের কনুইয়ের উপর কা’ম’ড়ে দিল। একবার, দুই বার। তিন বারের সময় বাঁধা পেল। সঞ্জয়ান তার মাথা হাত দিয়ে ধরে পেছনে ধা’ক্কা মেরে বলল,
” পাগল হয়ে গেছ নাকি? কা’ম’ড়াচ্ছ কেন? ”
” হ্যাঁ, পাগল হয়ে গেছি। আপনি আমাকে পাগল বানিয়ে দিয়েছেন। ”

উত্তর দিয়ে সে দরজার দিকে ছুটল। বাইরে বেরুতে বেরুতে বলল,
” আপনার সাথে থাকব না। কখনও না। আমি এখনই বাড়ি চলে যাব। এখনই। ”

সে ছুটতে চাইলেও পারল না। সঞ্জয়ানের হাতে বাঁধা পড়ে গেল। ভেতরে টেনে আনল জোর করে। দরজায় খিল টেনে বলল,
” তোমার সাথে একঘরে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। চুপচাপ বসো, মাথা ঠাণ্ডা করো। আমি একটা উপায় বের করছি। ”

চলবে