আঙুলে আঙুল পর্ব-৩৯+৪০

0
188

#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (৩৯)

” চিন্তিত মনে হচ্ছে। কোনো সমস্যা? ”

অসময়ে অপ্রত্যাশিত পুরুষ কণ্ঠে অরুণিমা ভয়ে চমকে ওঠল। এক কদম পাশে সরে গিয়ে তাকাল পুরুষ কণ্ঠের মালিকের দিকে। চিনতে পেরে বিস্ময় ঝরে পড়ল কণ্ঠ থেকে,
” আপনি! কখন এসেছেন? ”

সঞ্জয়ান আন্তরিক হাসে। জবাবে বলল,
” অনেক্ষণ হয়েছে। আসার পর তোমাকে দেখিনি। আন্টির কাছে জিজ্ঞেস করতে বলল, ছাদে আছ। ”

তার সহজ স্বীকারোক্তি! অরুণিমার কাঁধে শুকনা কাপড়। সেগুলোতে হাত রেখে বলল,
” এগুলো নিতে আসছিলাম। ”

একটু থেমে আবার বলল,
” আমাকে খুঁজছিলেন? কোনো দরকার? ”
” হ্যাঁ, একটু। ”
” বলুন। ”

সঞ্জয়ান রেলিংয়ের কাছে ঘেষে দাঁড়াল। দূরে অন্ধকার ছায়ার দিকে চেয়ে বলল,
” একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছি। ”
” আমার সাথে? ”

সে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল অরুণিমার দিকে। মুখটা আগের চেয়েও শুকিয়ে গেছে। লাবণ্য ক্ষয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। নরম ও মসৃণ ত্বকে ময়লা ভাব। যেন কতকাল এখানটায় যত্ন পড়ে না! বলল,
” আগে তোমার সমস্যাটা শুনি। ”
” আমার কোনো সমস্যা নেই। ”
” আছে। বলতে চাচ্ছ না। কেন বলো তো? আমি তোমার বন্ধু নই? ”
” বন্ধু! ”

অরুণিমার চোখে, মুখে ও কণ্ঠে বিস্ময়ের আভা। সঞ্জয়ান বলল,
” হ্যাঁ। আমি তোমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছি অনেক দিন ধরে। ”
” সেজন্যে আমার সাথে আলোচনা করতে এসেছেন? ”
” ধরে ফেলেছ। আমি তাহলে সঠিক মানুষটিকেই বন্ধু বানিয়েছি। ”

কথাটা বলতে বলতে সে একটু হাসল। অরুণিমাও সঙ্গ দেয়। হাসি ধরে রেখে একটুক্ষণ চুপ থাকে দুজন। তারপর সঞ্জয়ান বলল,
” এবার বলো। দেখি, সমস্যার সমাধান করা যায় নাকি। ”

অরুণিমা সঙ্গে সঙ্গে বলতে পারল না। আরও কিছু সময় চুপ থাকল। সংকোচ নিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
” মাইমূনের ফোন বন্ধ। ”
” কখন থেকে? ”
” কাল সকাল থেকে। ”
” বাসায় যাওনি? হতে পারে মোবাইলটা নষ্ট হয়ে গেছে কিংবা চুরি হয়েছে। ”
” বাসায় যেয়ে লাভ নেই। ও এখানে থাকে না। ”

সঞ্জয়ান গুরুত্ব বাড়াল। জিজ্ঞেস করল,
” তাহলে কোথায় থাকে? ”

অরুণিমার সংকোচ কেটে গেছে। মাইমূনের চাকরি পাওয়া ও চলে যাওয়ার পুরো ঘটনাটা খুলে বলল তাকে। সে সব শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত। অতঃপর অভিভূত হয়ে বলল,
” তোমরা তো প্রেমের ইতিহাস লিখছ! ”
” মজা করছেন? ”
” একদম না। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, এই ইতিহাসের প্রথম পাঠক ও দর্শক আমাকে বানানোর জন্য। ”

সঞ্জয়ান পকেট থেকে ফোন বের করল চটজলদিতে। অরুণিমার দিকে চেয়ে গম্ভীরমুখে বলল,
” ঠিকানাটা ঠিক করে বলো। ঐদিকে আমার লোক আছে। তোমাদের একটু উপকার করি। ”
” ও যদি রা’গ করে? ”
” রা’গ করার মতো উপকার করব না। শুধু তোমার দুশ্চিন্তার কারণটা তার কাছে দূত হিসেবে পাঠাব। ব্যস। ”

সে ঠিকানা দিল। সঞ্জয়ান দাঁড়িয়ে থেকে একজনকে কল দিল। কথা বলে ঠিকানাটাও জানিয়ে দিল। তারপর ফোন পকেটে রেখে বলল,
” চিন্তা করো না। যে তোমার জন্য জন্মস্থান ছেড়ে দিয়েছে সে আর যাইহোক অকারণে ফোন বন্ধ রাখবে না। ”
” জানি।

সঞ্জয়ান প্রত্যুত্তর করল না। গভীর চোখে চেয়ে থাকে অরুণিমার মুখটায়। অনুভব করে তার এই ‘ জানি ‘ শব্দটা উচ্চারণের পেছনে কী পরিমাণ আত্মবিশ্বাস লুকিয়ে আছে! ভালোবাসার মানুষের প্রতি এই বিশাল ওজনের বিশ্বাস ও ভরসাটায় তো সম্পর্ক ধরে রাখে। এগিয়ে নিতে উৎসাহ দেয়। বাঁধা এলে ভেঙে ফেলে। ঠিক যেমনটা অরুণিমা ও মাইমূন করছে।

” এবার আপনার আলোচনা শুরু করা যাক? ”

সঞ্জয়ান কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিল। সচেতন হয়ে বলল,
” হ্যাঁ, করা যায়। সেজন্যই আসা। ”
” তাহলে বলুন, আলোচনার বিষয়বস্তু কী? ”
” শূভ্রা। ”

অরুণিমার ভ্রজোড়ার মাঝে ভাঁজ পড়ল। কপট রা’গ নিয়ে বলল,
” আপনার সাথে ও আবার খারাপ ব্যবহার করেছে? ”
” ভালো ব্যবহার করেছে কখনও? ”

বিদ্রুপ নিয়ে বাক্যটা শেষ করে পুনরায় বলল,
” এবার তার ব্যবহার না। বিয়ে নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি। ”
” বিয়ে? ”
” হ্যাঁ। আমি ভেবেছিলাম দুই পরিবারকে একত্রে নিয়ে কথাটা বলব। কিন্তু এখানে আসার পর মনে হলো আগে তোমার সাথে আলাপ করি। যদি সদুপদেশ পাই? ”
” যদি আমার জ্ঞানে থাকে অবশ্যই পাবেন৷ তার আগে সব শুনি? ”

দুজনের এই আলাপের মধ্যে নিয়াজ দৌড়ে উপরে আসল। দূর থেকে বলল,
” আপু, মা দুলাভাইকে খেতে ডাকছে। ”

অরুণিমা উত্তর করল,
” যা, আসছি। ”

সে চলে যেতে সঞ্জয়ান প্রশ্ন করল,
” ও কি আমাকে দুলাভাই বলল? ”
” হ্যাঁ। আর কাকে বলবে? ”

অরুণিমা খেয়াল করল তার মুখের ভাব একটু অন্য রকম হয়ে গেছে। তার কারণ আর যাই হোক খুশি বা আনন্দ নয়। জিজ্ঞেস করল,
” ডাকটা আপনার পছন্দ হয়নি? বড় বোনের বরকে গ্রামাঞ্চলে দুলাভাই ডাকে। ”

সঞ্জয়ান কিছু বলল না। চুপ করে দেখল, অরুণিমা মিটিমিটি হাসছে। ডাকটা পছন্দ হয়নি এমন নয়। কিন্তু গ্রহণ করতে কোথাও একটা বাঁধা পাচ্ছে। সেই বাঁধাটা ভুলে গেল অরুণিমার হাসি দেখে। মেয়েটার দুশ্চিন্তা অবশেষে কমল! পুনরায় আলাপ শুরু করতে বলল,
” শূভ্রা মনে হয় এই বিয়েটাকে মন থেকে মানতে পারছে না। ”
” হ্যাঁ, হঠাৎ করে হয়েছে তো তাই। ”

সঞ্জয়ান এবার সরাসরি বিয়ে ভাঙার বিষয়টি তুলে ধরতে চাইল, পারল না। অরুণিমা বাঁধা দিয়ে বলল,
” এখানে দুই-একদিন থাকবেন তো? ”
” হ্যাঁ। কেন? ”
” তাহলে এই ব্যাপারে পরে এক সময় কথা বলি? মা খাওয়ার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন। আমার জন্য দেরি হচ্ছে জানলে খুব রা’গ করবেন। ”

সঞ্জয়ান চায় না তার জন্য এই মেয়েটি ব’কা শুনোক। তাই সম্মতি দিয়ে বলল,
” আচ্ছা। চলো, নিচে যাই। ”

____________
শূভ্রা বাসায় এসে বাবার রুমে ঢুকে বসেছিল। সঞ্জয়ান রুম থেকে বেরুতে সে এই রুমে আসে। নিজের জিনিসপত্র ঠিকঠাক জায়গায় আছে নাকি নিয়াজ নষ্ট করে ফেলেছে তাই পরখ করে দেখছিল। তন্মধ্যে মা খাবারের জন্য ডাক পাঠায়। সেই উদ্দেশ্যে বেরুতে দেখে সঞ্জয়ান ও অরুণিমা আগে-পিছে বাসার ভেতর ঢুকছে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে তৎক্ষনাৎ। সঞ্জয়ান কাছে আসতে নিচু স্বরে বলল,
” আপুর কোনো জিনিস আমি ব্যবহার করলে ফেরত চায় না কখনও। কিন্তু আমি খুব করে চাই আপনাকে ফেরত নিয়ে যাক। ”

সঞ্জয়ান তেজ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আমি জিনিস? আমাকে তুমি ব্যবহার করছ? ”
” পুরোপুরি ব্যবহার করা হয়নি এখনও। আশা করছি, আপু ফেরত চাওয়ার পূর্বে পুরোপুরি ব্যবহার হয়ে যাবেন। ”

কথাটা বলে শূভ্রা চোখ মে’রে চলে গেল। অরুণিমা কাপড় রাখতে রুমে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখল, সঞ্জয়ান আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। বলল,
” দাঁড়িয়ে আছেন যে? শূভ্রা নিয়ে যায়নি আপনাকে? মেয়েটা এখনও শিখল না কিছু! বয়স কম তো। রা’গ করবেন না। আস্তে-ধীরে শিখে ফেলবে। আপনি আমার সাথে আসুন। ”

__________

অরুণিমাদের বাসায় দুটো রুম। এক রুমে দুই বিছানা। একটাতে নিয়াজ ঘুমায়। অন্যটায় শূভ্রা ও অরুণিমা ঘুমাত। আজ এখানে শুধু শূভ্রা ও সঞ্জয়ানের শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ নিয়াজ ও অরুণিমা অপর রুমে মা-বাবার সাথে ঘুমাবে। সঞ্জয়ান খাওয়া শেষ করে রুমে চলে আসে। শূভ্রা আসে একটু পর। দরজা আটকে বলল,
” একটু নিচে দাঁড়ান তো। ”

সঞ্জয়ান প্রশ্ন করল না। নীঃশব্দে বিছানা থেকে নিচে নেমে দাঁড়াল। শূভ্রা এই সুযোগে হাতে করে নিয়ে আসা জগের পানিটুকু ঢেলে দিল বিছানার একপাশে৷ অন্যপাশে নিজে শুয়ে বলল,
” আমার সাথে ঘুমাতে হলে ভেজা বিছানায় শুতে হবে। ”

এই একই কাজ শুরু থেকে করে আসছে শূভ্রা। অন্য সময় প্র’তি’বাদ করেনি সে। রুমে থাকা আরাম কেদারায় শুয়ে পড়েছে চুপচাপ। এখানে সেই সুব্যবস্থা নেই। তন্মধ্যে সে এখানকার অতিথি। অপমানটা সহ্য করতে কষ্ট হলো। তাই শূভ্রাকে একটানে ভেজা স্থানে এনে বলল,
” ছাড় ও মাফ সবসময় পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে লোকসান ও শাস্তি পেতে হয়। ”

শূভ্রা মানতে চাইল না। যু’দ্ধের জন্য উঠেপড়ে লাগল। সঞ্জয়ান টের পেয়ে সাবধান বাণী শুনাল,
” বেশি বাড়াবাড়ি করলে, মাথায় তুলে আছাড় মা’র’ব। এইটুকু তো শরীর! আছাড় খেয়ে বেগুন ভর্তা হয়ে যাবে। ”

হুমকি শুনে ভ’য় পেয়ে যায় শূভ্রা। এতদিনে বুঝতে পেরেছে, এই ছেলে যা বলে তা করে ছাড়ে। তার জন্য কোনো দয়া-মায়া নেই। তাই রা’গ হলেও কিছু বলল না। জে’দ ধরে ভেজা বিছানায় শুয়ে পড়ল।

তখন মাঝরাত। সঞ্জয়ান ঘুমিয়ে পড়েছে প্রায়। সেই সময় শুনল,
” শীত লাগছে, আপু। কম্বল দাও। ”

সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল পাশে। দুজনের রা’গা’রা’গির মধ্যে রুমের আলো নেভানো হয়নি। সেই আলোতে দেখল, শূভ্রা হাত-পা গুটিয়ে এমনভাবে শুয়েছে যে তার পাঁচ ফুটের শরীরটা দুই ফুটে রূপ নিয়েছে। চোখে পড়ার মতো থরথর করে কাঁপছে! তার মনে সন্দেহ জাগল। মাত্রই জ্বর থেকে উঠা মেয়েটা আবারও জ্বরে পড়ল না তো! সঞ্জয়ান সংশয় ও ভীতচিত্তে উঠে বসল। ইচ্ছে হলো, শূভ্রার গা ছুঁয়ে তাপমাত্রা পরখ করতে। হাত বাড়িয়েও ফিরিয়ে নিল বার বার। বেশ কিছু সময় এভাবে পার করে সিদ্ধান্ত নিল, অরুণিমাকে ডেকে আনবে। বোনকে দেখাবে। যদি সত্যি তেমন হয়, তাহলে শূভ্রার একটা ব্যবস্থা করা যাবে। সে সিদ্ধান্ত মতো দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো৷ পুরো অন্ধকার! কোনো আলো জ্বালানো নেই। সঞ্জয়ান রুমে ফেরত গিয়ে মোবাইলটা নিয়ে এলো। আলো জ্বেলে বাইরে পা রাখল। কয়েক কদম এগুতে অন্য রুমটি পায়। ভেতর থেকে আটকানো৷ সে ডাক দিতে গিয়েও থেমে গেল। ঘড়িতে দেখল, তিনটা পার হয়েছে। একজনকে ডাকতে চাইলেও সবাই জেগে যাবে। মাঝরাতে এরকম কাণ্ড ঘটানোর ইচ্ছেটা হলো না তার। তাই ফেরত এলো। শূভ্রা তখনও কাঁপছে! হাত-পায়ের লোম কাঁটার মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ সঞ্জয়ান পাত্তা দিবে না ভেবেও ডান হাতটা বাড়িয়ে রাখল শূভ্রার কপালে। মুহূর্তে বুকটা কেঁপে ওঠল। যা ভেবেছিল তাই। জ্বর উঠেছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে মনে পড়ল, শূভ্রা ভেজা বিছানায় শুয়ে আছে। জ্বরটা হয়তো একারণেই নতুন করে এসেছে। এই মুহূর্তে তার কী করা উচিত বুঝতে পারছে না। কিছুটা বিব্রত, বুদ্ধিশূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কতক্ষণ। তারপর কল দিল মাকে। ওপাশ থেকে রিসিভ হতে জ্বরের কথাটা বলতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
” তোর ব্যাগে যে ওর ওষুধগুলো দিয়েছিলাম খাওয়াসনি? ”

সঞ্জয়ানের মাথায় বাড়ি পড়ল যেন! স্মরণে এলো, ওষুধ তো দূর এখানে আসার পর ব্যাগের চেইনটাও খোলা হয়নি। এই সত্য স্বীকার করবে নাকি লুকাবে এই দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেল। স্বর্ণলতা অপেক্ষা করে ধ’ম’কে উঠলেন,
” বোবা হয়ে গেলি নাকি? উত্তর দিচ্ছিস না কেন? ”

সে ভ’য়ে শিউরে ওঠল। বাহানা সৃষ্টির ব্যস্ততার ভাব নিয়ে বলল,
” তোমাকে পরে কল দিচ্ছি, মা। ”

কলটা কেটে দৌড়ে ওষুধ বের করল। গ্লাসে পানি ভরে ডাকল,
” শূভ্রা? উঠো। ওষুধটা খেয়ে নাও। ”

সে ঘুমের ঘোরে অচেতনের মতো জবাব দিল,
” শীত করে তো! ”
” করবে না। ওষুধটা খাও, শীত চলে যাবে। ”

শূভ্রা নড়ল। উঠে বসতে গিয়ে একহাত গিয়ে লাগল সঞ্জয়ানের হাতে থাকা গ্লাসটিতে। অকস্মাৎ ধাক্কায় সেটি পড়ে গেল নিচে!

চলবে

#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (৪০)

” শূভ্রা? উঠো। ওষুধটা খেয়ে নাও। ”

সে ঘুমের ঘোরে অচেতনের মতো জবাব দিল,
” শীত করে তো! ”
” করবে না। ওষুধটা খাও, শীত চলে যাবে। ”

শূভ্রা নড়ল। উঠে বসতে গিয়ে একহাত গিয়ে লাগল সঞ্জয়ানের হাতে থাকা গ্লাসটিতে। অকস্মাৎ ধাক্কায় সেটি পড়ে গেল নিচে! গ্লাস ভাঙার শব্দে সঞ্জয়ান চমকে কেঁপে ওঠে। শূভ্রার চোখের পাতা আলগা হয়। আধো ঘুমে দুর্বল চাহনি রাখে তার উপর। সঞ্জয়ান কিছুটা বিরক্ত হয়ে ধমক দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। তখনই শুনতে পেল,
” আপনি! আমার কাছে? আমার ঘরে? আসুন, এখানে বসুন। ”

শূভ্রা প্রথমে বিস্ময় প্রকাশ করে। পর মুহূর্তে আনন্দে আপ্লুত হয়। ব্যস্ত হয়ে পড়ে সঞ্জয়ানকে তার পাশে বসানোর জন্য। সে অবাক চোখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। শূভ্রার নিকট থেকে এমন নরম, ভদ্র আচরণ পায়নি কখনও। এটাই প্রথম। বিস্মিত না হয়ে পারছে না।

” কী হলো, আসুন না। বসুন এখানে। ”

বসার আমন্ত্রণ জানানোর সময় শূভ্রা হাত দিয়ে স্থানও দেখাচ্ছে। সঞ্জয়ান বসছে না দেখে সে নিজের হাত বাড়িয়ে তাকে টেনে বসাল জোর করে। বসার সঙ্গে সঙ্গে কোলের উপর নিজের মাথা রেখে বলল,
” আমি আপনার কবুতর। ”

শূভ্রার এই সেধে এসে কোলে মাথা রাখা, আহ্লাদী কণ্ঠস্বরে সঞ্জয়ান বিমূঢ় হয়ে পড়ল যেন! মূক হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর সুধাল,
” তুমি কবুতর? ”
” হ্যাঁ। সেদিনের মতো আমাকেও ভালোবেসে আদর করে দিন। ”
” কোন দিনের মতো? ”

সঞ্জয়ানের কণ্ঠে সংশয়, সন্দেহ। চোখে-মুখে অস্বস্থি, দ্বিধা। শূভ্রার সাথে আজ পর্যন্ত ভালোভাবে কথা হয়নি। তাহলে আদরের বিষয়টি আসছে কী করে?

” ঐদিনের মতো৷ কৃষ্ণচূড়ার গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একটা সাদা কবুতরকে যে আদর করছিলেন? তেমন করে আমাকেও আদর করে দিন। ”

কবুতরের কথা আসায় তার মনে পড়ল, বাড়িতে অনেকগুলো কবুতর থাকলেও সাদা রঙের একটি কবুতর তার পোষ মেনেছে অনেক দিন ধরে। এই কারণেই হয়তো এটির প্রতি আদর-ভালোবাসা-যত্ন একটু বেশি। এবার ঢাকা থেকে ফিরে দেখে সেই কবুতরটি নেই। তার খুব মনখারাপ হয়। জুমু’আর নামাজ শেষ করে আশপাশে খোঁজ করে পায় না। সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরতে দেখে যাকে বাইরে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে কৃষ্ণচূড়ার ফুলের রূপে মুগ্ধ হয়ে গাছের ডালে বসে আছে। সে ডাকতে উড়ে আসে। না পেয়ে ভেবেছিল, হারিয়ে গেছে৷ তাই খুঁজে পেয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে ভালোবেসে আদর দিচ্ছিল সারা শরীরে। শূভ্রা কি সেই আদরের কথা বলছে? কিন্তু সে দেখল কীভাবে! সঞ্জয়ানের ভাবনা কাটল শূভ্রার হাতের স্পর্শে। উষ্ণ ও কোমল হাতটা দিয়ে তার ডান হাতটা মাথায় রেখে বলল,
” আদর দিন। ”

সে আপত্তি দেখাতে চাইল। শূভ্রার মাথাটা কোল থেকে সরিয়ে উঠে যেতে চাইল, পারল না। ওর শরীর ও নিশ্বাস এতটাই গরম যে সঞ্জয়ানের শরীরে ঘাম জড়ো হতে থাকে। কিঞ্চিৎ ঘাবড়েও যায়। মায়ের কথামতো ওষুধ খাওয়ালে হয়তো এমন হতো না! এই অপরাধ থেকে মাফের আশায় শূভ্রার আবদার রাখল সে। মাথায় হাত বুলানোর সময় চোখটা গিয়ে পড়ল তার মুখটায়। খেয়াল করল, মা ঠিকই বলেছে। মেয়েটা এই কয়দিনে অনেকটা শুকিয়েছে। চোখদুটি দেবে গিয়ে চারপাশে কালচে ছাপ পড়েছে। ঠোঁট শুকনো, ফাটা। সম্পূর্ণ মুখটায় উজ্জ্বল আভা হারিয়েছে। ওজনও কমেছে হয়তো। বয়সের তুলনায় অনেক শুকনা লাগছে। চোখ বন্ধ রেখে সে ক্ষীণ স্বরে বলল,
” আপনি সবসময় সাদা রঙের কাপড় পরেন? ”

সঞ্জয়ান নিজের দিকে তাকাল। সে সাদা রঙের পাতলা পোলো শার্ট পরে আছে। স্মরণে এলো, সেদিনও সে সাদা পাঞ্জাবি পরেছিল। কিন্তু এর মাঝে সে অন্য রঙের শার্ট পরেছে। শূভ্রা কি দেখেনি? শুধু এই সাদা রঙটাকেই মনে রেখেছে।

শূভ্রার শরীরের কাঁপন ধীরে ধীরে বাড়ছে। সঞ্জয়ান টের পেয়ে, বিছানায় থাকা কাঁথাটা গায়ের উপর দিয়ে বলল,
” শূভ্রা, ঘুমাবে না। ওষুধ খাওয়া হয়নি তোমার। ”

সে কোনো সাড়াশব্দ দিল না। সঞ্জয়ানের হাতে ওষুধ থাকলেও পানি নেই। পানির ব্যবস্থা করার জন্য শূভ্রার মাথাটা সরিয়ে উঠতে চাইল, পারল না। সে দুই হাতে খামচে ধরল প্যান্টের শক্ত কাপড়। মৃদু কাঁপুনি তুলে ফুপিয়ে উঠে বলল,
” আমি এখানে ঘুমাব, এখানেই। ”

________

সকালে সঞ্জয়ানের ঘুম ভাঙে কারও মিহি সুরে কান্নার শব্দে। সে চোখ ডলে উঠে বসে দেখল, শূভ্রা কাঁদছে। তার শরীরে কাঁথা নেই। জামার গলার দিকটা ছেঁড়া। ছেঁড়া দিয়ে শরীরের যে অংশটা উন্মুক্ত হয়েছে সেখানে নখের আঁচড়। সে আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কী হয়েছে? কাঁদছ কেন? ”

শূভ্রা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদছিল। এবার হাতটা সরাল। অশ্রুতে ভেজা চোখদুটি বড় বড় করে জবাব দিল,
” আমার সব কেড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, কাঁদছি কেন? ”
” আমি তোমার সব কেড়ে নিয়েছি? ”
” হ্যাঁ, নিয়েছেন। ”
” কখন? কীভাবে? ”

শূভ্রা কান্না থামিয়ে দিল। ভীষণ অবাক হচ্ছে এমন ভঙ্গিতে চেয়ে থাকে কতক্ষণ। তারপর বলল,
” আমার সর্বনাশ করে এখন মজা নিচ্ছেন? নিবেনই তো। আপনাদের স্বভাবই এমন। আমি আরও আগে থেকে জানতাম বুড়োরা লুচ্চা হয়। এজন্যই বিয়ে করতে চাইনি। ”

সঞ্জয়ানের মাথায় কেউ ভারী পাথর ফেলল যেন! চাপা পড়ে যাচ্ছে এরকম ব্যথা নিয়ে সুধাল,
” তোমার সাথে লুচ্চামি করেছি? ”
” করেছেনই তো। সেজন্যই জোর করে আমার সাথে একখাটে শুয়েছেন। আমি ছোট মানুষ। বুদ্ধি কম। তাই আপনার কুবুদ্ধি ধরতে পারিনি। ”
” শূভ্রা, সাবধানে কথা বলো। তুমি কি বুঝতে পারছ, আমার উপর কী অপবাদ দিচ্ছ? ”

শূভ্রা চোখের পানি মুছল। নাক টেনে ধেয়ে এলো তার কাছে৷ মুখের কাছাকাছি মুখ নিয়ে বলল,
” চোরের মায়ের বড় গলা! আপনি বয়সে আর শরীরে বড় হলেও জোর করে সত্যকে মিথ্যা বানাতে পারবেন না৷ আমার কাছে প্রমাণ আছে। ”
” কিসের প্রমাণ? তুমি এতক্ষণ ধরে কী বলছ, আমি সেটাই ঠিকমতো বুঝতে পারছি না। প্রথমে বললে, সব কেড়ে নিয়েছি, তারপর বললে, সর্বনাশ করেছি। এখন বলছ, লুচ্চামি করেছি। পরিষ্কার করে বলবে আমি আসলে কী করেছি? ”
” ধ’র্ষ’ণ। আপনি আমাকে একা পেয়ে ঘুমের মধ্যে ধ’র্ষ’ণ করেছেন। এই হলো তার প্রমাণ। ”

মুক্ত গলায় তার অন্যায়টা শুনিয়ে শূভ্রা জামার ছেঁড়া অংশটা সরিয়ে ফেলল। নখের একাধিক আঁচড় দেখিয়ে পুনরায় বলল,
” এটা কোনো মিথ্যা অপবাদ নয়। সত্যিকারের অন্যায়। আপনি আমার সাথে অন্যায় করেছেন। ”

সঞ্জয়ানের দৃষ্টি একভাবে পড়ে আছে শূভ্রার ক্ষত অংশটায়। রাতে জোর করে একখাটে ঘুমিয়েছে সত্য। অসুস্থ মেয়েটার আবদার রাখতে শরীরে ছুঁয়েছেও। এর বিনিময়ে এটাই প্রাপ্য ছিল তার? ধ’র্ষ’ক! এক মুহূর্তে তাকে ধ’র্ষ’ণের অপবাদ দিয়ে দিল?

” চুপ করে আছেন কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না এখনও? নিজের দিকে তাকান পুরোপুরি বিশ্বাস হবে। ”

শূভ্রার কথামতো সে নিজের দিকে তাকাল। রাতের সেই সাদা রঙের পোলো শার্টটি নেই। অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে, এটা পরে ঘুমিয়েছে।

শূভ্রা নিজের জায়গায় ফেরত গেল। কান্নার ভাব ধরে আবারও বলল,
” দেখতে কালো, খাটো মেয়েটাকেও ছাড়লেন না? ছি! একরাত, মাত্র একরাত তার পাশে শুয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলেন না? এই মানুষটাকে আমার পরিবার এত ভালোবাসে, সম্মান করে? বলেছিলাম না? আপনার ভেতরের খারাপ রূপটাকে সামনে আনব? এনেছি। কিন্তু নিজের ক্ষ’তি করে। ”

সঞ্জয়ান খাট থেকে নামল। মেঝেতে পড়ে থাকা পোলো শার্টটা খুঁজে বের করে গায়ে পড়তে পড়তে বলল,
” আমাকে অপমান করার জন্য তুমি কতটা নিচে নামতে পার সেটারই প্রমাণ পেলাম। শূভ্রা, আমি মুখে যাই বলি না কেন, মনে মনে তোমার ভালোটাই চেয়ে এসেছি। এর সাক্ষী স্বয়ং আল্লাহ। ”

সে দরজা খুলে বাইরে বেরুতে অরুণিমার সঙ্গে দেখা হলো। সে হেসে বলল,
” আপনাকে ডাকতে এসেছিলাম। নাস্তা দিয়েছি। হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আসুন। ”

অরুণিমা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেল। জিজ্ঞেস করল,
” ওর কোনো খোঁজ পেয়েছেন? ”

‘ ও ‘ দিয়ে যে মাইমূনকে নির্দেশ করেছে সঞ্জয়ান বুঝতে পারে। তারপরও কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
” হ্যাঁ। আমার পাঠানো লোক বলল, মাইমূন ভাই গত সপ্তাহে বাসা ছেড়ে দিয়েছে। বর্তমানে কোথায় থাকছে কেউ জানে না। ”

তথ্যটা শুনে অরুণিমার মুখের রঙ বদলে গেল। বাদল দিনের বজ্রপাতের মতো চমকাতে লাগল বুকের আকাশটায়। যার আভাস কিছুটা টের পাচ্ছে সঞ্জয়ান। সান্ত্বনা দিতে বলল,
” চিন্তা করো না। খোঁজ চলছে এখনও। শীঘ্রই তাকে পাওয়া যাবে। ”

অরুণিমা বিপরীতে কিছু বলল না। চুপচাপ তার সামনে থেকে সরে যেতে চাচ্ছে। সহসা আবারও থামল। পেছনে চেয়ে বলল,
” আপনি কী যেন বলতে চেয়েছিলেন? খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু? ”

সঞ্জয়ানকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ দিল না। রুমের দিকে অগ্রসর হতে হতে বলল,
” শূভ্রা উঠেনি এখনও? ওর সামনে বলা যাবে? তাহলে ভেতরে বসে কথা বলি? ”
” না। ”

অরুণিমা থেমে গেল। বলল,
” তাহলে তো রাতের আগে সময় দিতে পারছি না। নাস্তা করে আমি বেরুব। রাতে থাকবেন তো এখানে? ”

সঞ্জয়ান সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর করল না। শূভ্রা তাকে যে অ’ন্যা’য়ে দো’ষী করেছে সেটি ভাবাচ্ছে। যদিও সে মানতে পারছে না, এমন কাজ করেছে। তবুও শূভ্রার দেখানো প্রমাণ মিথ্যা নয়। এমনকি হতে পারে, সত্যি সে দোষী? তার অসুস্থতার জন্য অনেকটা সময় কাছাকাছি ছিল। তন্মধ্যে মেয়েটা আদর পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। এসব সামলাতে গিয়ে সে তার কঠিন ব্যক্তিত্ব থেকে পিছলে যায়নি তো! যদি সত্যি পিছলে পড়ে তাহলে বিয়ে ভাঙাটা বিরাট বড় অন্যায় হবে। প্রকৃত সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে এই ব্যাপারে আলোচনা করা ঠিক হবে না এমন মনস্থির করল। অরুণিমাকে বলল,
” এখন না। মনে হয়, আমার নিজেকে আরও একটু ভাবনা-চিন্তা করতে হবে। ”
” আপনার যেমন ইচ্ছে। ”

__________
অরুণিমা স্বর্ণলতা ক্যন্টিনের কাছে আসতে একজন দৌড়ে এলো। হাঁপিয়ে উঠে বলল,
” আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। ”
” কে? ”
” জানি না। সেই ভোরবেলা থেকে বসে আছে। ”

অরুণিমা দ্রুতপদে ক্যান্টিনের মধ্যে ঢুকল। অজ্ঞাত লোকটি একপাশের একটি টেবিল দখল করে বসে আছে। তার উদ্দেশ্যে বলল,
” আপনি কি আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন? ”

চলবে