আঙুলে আঙুল পর্ব-৪১+৪২

0
219

#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (৪১)

” আপনি কি আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন? ”

বেশভূষায় পুরুষ লোক বোধ হলেও মুখটা দেখা হয়নি অরুণিমার। দরজার দিক থেকে হেঁটে আসায় পেছনটা দেখা যাচ্ছে শুধু। সে প্রশ্নটা করতে করতে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল। একপাশে দাঁড়িয়ে মুখটায় তাকাতে অজ্ঞাত লোকটি ঝট করে ফিরল তার দিকে। অরুণিমার একহাত টেনে নিয়ে কাতর স্বরে বলল,
” আমাকে ক্ষমা করে দাও! ”

মুখ ফেরাতে অরুণিমা চিনে ফেলেছে। তন্মধ্যে হাত টেনে নিয়ে এভাবে মাফ চাওয়ায় সে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে পড়ল। প্রায় আধা মিনিট নীরব থেকে সচকিত গলায় উচ্চারণ করল,
” মাইমূন! ”

মাইমূন অরুণিমার কণ্ঠে নিজের নাম শুনে আরও ভেঙে পড়ল যেন! চোখের কোল ভিজে ওঠল। সকাতরে পুনরায় বলল,
” ভালোবাসা, আমাকে মাফ করে দাও। ”

এবার অরুণিমার চিত্ত চঞ্চল হলো। সচেতনে বলল,
” কোথায় ছিলে এতদিন? কল দেওনি কেন? আমি দিয়েও পাইনি তোমাকে, বন্ধ দেখাচ্ছিল। ”

মাইমূন চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল ঝট করে। বিনা নোটিশে গিয়ে বসল নিচে, নোংরা মেঝেতে। মাথা নিচু করে কৈফিয়তের মতো বলল,
” ইচ্ছে করে বন্ধ রেখেছি। চাচ্ছিলাম না, তোমার সাথে যোগাযোগ হোক। ”
” কেন? ”
” আমি যে দো’ষ করেছি! ”

বিস্ময়ের রেশ কাটার বদলে বেড়েই যাচ্ছে। অরুণিমাও স্থান ও অবস্থান ভুলে বসে পড়ল মাইমূনের সামনে। মুখটা তুলে জিজ্ঞেস করল,
” কী দো’ষ করেছ? ”

মাইমূন এক মুহূর্ত চুপ থাকে। ভালোবাসার মানুষটির উদগ্রীবের আভাস ছড়ানো মুখটায় চেয়ে থেকে জবাব দিল,
” তোমার বাবার শর্ত ভেঙেছি। অরুনিমা, আমি সিগারেট খেয়েছি। ম’দও। ”

অসাড় ব্যক্তির মতো হাতের জোর হারাল সে। মাইমূনের মুখ থেকে হাতটা সরে পড়ল আপনাআপনি। ঠিক তখনই নাকে এসে লাগল তী’ব্র বি’দঘু’টে গন্ধটা। না চাইতেও চোখ-মুখ বিকৃত করে মাথাটা পিছিয়ে নিতে হলো। দূর হতে সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল,
” মদ খেয়ে আমার সামনে এসেছ? ”

মাইমূন চট করে দুইহাতে মুখ ঢেকে ফেলল। সেই অবস্থায় অস্পষ্টভাবে বলল,
” কী করব? আর দূরে থাকতে পারছিলাম যে! তাই এভাবে ছুটে এসেছি। ক্ষমা প্রার্থনা করছি। ”

অরুণিমার মে’জা’জ গ’র’ম হলো। দেহভঙ্গিতে কঠিনত্ব ফুটে ওঠল। একটু আগের নরম, কোমল, স্নেহার্দ্র ব্যবহারটা বদলে ক’ঠো’র গলায় বলল,
” আগে শুনি, এই অ’ন্যা’য় করার কারণটা কী। ”

মাইমূন তখনই বলতে শুরু করল। অরুণিমা খেয়াল করল, ক্যান্টিনে কর্মরত সকল কর্মচারীরা তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সে হাত দিয়ে ধরে মাইমূনকে নিচ থেকে তুলে চেয়ারে বসিয়ে দিতে দিতে তাদের উদ্দেশ্যে বলল,
” সবাই কাজে যাও। এখনই। ”

কথাটা ধ’ম’কের মতো শুনালে তারা সকলে ছুটে চলে নিজ নিজ কর্মস্থানে। এই ফাঁকে মাইমূনের কথাগুলো মন দিয়ে শুনার সুযোগ হয় অরুণিমার। জানতে পারে, মাইমূন কাজের প্রথম দিন সজীব নামক এক পুরোনো কর্মচারীর কাছ থেকে ব’কা শুনে। বয়সে ও মাপে তার থেকে ছোট। যা সে সহজে হজম করতে পারেনি। প্রথম দিন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখলেও দ্বিতীয় দিন উত্তর দিয়ে বসে। ঝা’মে’লার শুরু হয় এখান থেকে। সজীব সেখানে কাজ করছে দুই বছর যাপত। মালিকের চেনা ও বিশ্বস্ত। সুযোগ পেয়ে মাইমূনের নামে সত্য-মিথ্যা নানান না’লি’শ করে। এর বিচারে মাইমূন হেরে যায়। চাকরিও চলে যায়। ব্যাপারটা এখানে সমাপ্ত হতে পারত, হয়নি। মাইমূনের ভেতরের সত্যপরায়ণতা জেগে ওঠে। তার মতে, মিথ্যা দো’ষে চাকরি গিয়েছে। যা সে মানতে পারেনি। প্র’তি’বাদ করতে গিয়ে গলা ধা’ক্কা খেয়েছে দারোয়ানের কাছ থেকে। ব্যস! আরও অঘটনের সৃষ্টি হলো। সে ভুলেই গেল, এটা তার জন্মস্থান নয়। এখানকার মানুষজন তার চেনা নয়, ভিতু নয়, সহজ নয়। উল্টো হাত চালিয়ে দিল। শুধু দারোয়ান নয়, সজীব এমনকি মালিককেও ছাড়েনি। সবাইকে মে’রে হাসপাতালে পাঠানোর পর হুঁশ এসেছে। বাড়িতে সে পৌঁছানোর পূর্বে পুলিশ পৌঁছে গেছে। ভাগ্য ভালো, যার সাথে রুম ভাগ করে থাকছিল, সে ফোন করে জানিয়েছে। তাই তখনই জেলে ঢোকেনি। এতটুকু শোনার পর অরুণিমা নিজের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করল,
” পুলিশ কেসেও জড়িয়ে পড়েছ? ”

মাইমূন অসহায় মুখ বানিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে বলল,
” তারপরেই তো চিন্তায় পড়ে গেলাম। তোমার বাবা যদি এসব জানে, তাহলে স্বপ্নেও তোমাকে বিয়ে করা হবে না। এই চিন্তা ও ভ’য়ে কখন যে সিগারেট খেয়ে ফেললাম! টেরও পাইনি। ”
” আর মদ? ওটা কেন খেলে? তুমি তো মদ খাওয়ার কারণ অন্য কিছু বলেছিলে। ”

মাইমূন লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিয়েও তুলল আবার। অ’ভি’যো’গের মতো করে বলল,
” ওরা বাবা তুলে গালাগাল দিচ্ছিল। ”
” দিক। তোমার সমস্যা হবে কেন? তুমি তো জন্মদাতা কিংবা পালিত বাবা কাউকে ভালোবাসো না। সম্মান করেও চলো না। ”

অরুণিমার কথাটা শুনে চোখ নামিয়ে নিল সে। ভার স্বরে বলল,
” আমাকে বিজন্মা বলেছে বার বার। ”

‘ বিজন্মা ‘ শব্দটা ধা’রা’ল ফলার মতো আ’ঘা’ত করল তাকে। একটা অদ্ভুত অসহণীয় ব্যথা তৈরি হলো বুকের মাঝে। যা চোখে পানি এনে ছাড়ল অরুণিমার চোখজোড়ায়। ইচ্ছে হলো মাইমূনকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরতে, আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিয়ে মনটাকে শান্ত করে দিতে। এই দুর্নিবার ইচ্ছাটাকেও সে সামলে নিল। কঠোর হয়ে বলল,
” বলার সুযোগ দিয়েছ, তাই বলেছে। তোমাকে কে বলেছিল, সজীবের সাথে তর্ক করতে? ও বয়সে ছোট হলেও কাজের ক্ষেত্রে বড়। তাছাড়া কাজটাও তোমার জন্য নতুন। হয়তো সত্যি ভুল হয়েছে। সেজন্যই ব’কে’ছে। ”

কথার ফাঁকে অরুণিমা মাইমূনের গালে হাত রাখল। প্রথম স্পর্শটা নরম হলেও ধীরে ধীরে সেটি শক্ত চাপে রুপান্তর হলো। জোরপূর্বক নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,
” একটা কথা মনে রাখ, চাকরি মানে পরাধীনতা। সেখানে তোমার যেমন স্বাধীনতা নেই তেমন ক্ষ’ম’তাও নেই। ”

এটুকু বলে অরুণিমা তার সামনে থেকে একটু সরে গেল। গোপনে প্রলম্বিত নিশ্বাস টেনে বলল,
” যদি এই পরাধীনতাকে মেনে নিতে না পার, তাহলে চাকরি করার চিন্তা ছেড়ে দাও। ”

মাইমূন উঠে এসে দাঁড়াল তার সমুখে। বলল,
” তাহলে ব্যবসা করব? কিভাবে? আমার তো টাকা নেই। ”

অরুণিমা সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল না। ব্যবসা সে করেনি। কিন্তু একেবারে অজ্ঞ নয়। এখানেও সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে না। সবসময় মাথা উঁচু করে চলা যায় না। ব্যবসার স্বার্থে কখনও কখনও মাথা নত করতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিপক্ষ তৈরি হয়। সর্বক্ষণ তাদের সাথেও গোপনে ও প্রকাশ্যে ল’ড়া’ই চালাতে হয়। এসব ভাবনা-চিন্তা করতে করতে তার বুকটা ভার হয়ে গেল। মনে হলো, এই ছেলের স্বাধীনতা হরণকারী সে! অন্য কেউ নয়, অন্য কিছু নয়। হয়তো তাদের দেখাটা ভুল, প্রেমে পড়া ভুল, বিয়ের কথা ভাবাও ভুল।

” আমার চাকরি ছাড়া উপায় নেই। এবারের মতো তুমি মাফ করে দাও। কথা দিচ্ছি, পরবর্তীতে এমন কিছু ঘটবে না। ”

অরুণিমা সচেতনে বলল,
” শুধু আমার কাছে না। তোমার ওদের কাছেও ক্ষমা চাইতে হবে। পুলিশের ঝা’মে’লা মেটাতে হবে। আমি চাই না, বাবা আরেকটা কারণ দেখিয়ে বলুক, আমার পছন্দ খারাপ। ”
” ওরা কি মাফ করবে? ”
” সেটা তো মাফ চাইলে তবেই জানা যাবে। ”

মাইমূনের কুঁচকে থাকা শার্টটা টেনে ঠিক করল সে। হাত দিয়ে মাথার চুল ঠিক করে বলল,
” বসো এখানে। আমি নাস্তার ব্যবস্থা করছি। খাওয়া শেষ করে গাজীপুরের বাস ধরবে। ”

অরুণিমা ব্যস্ততা দেখিয়ে ক্যান্টিনের রান্নার দিকটায় যেতে চাইল। মাইমূন বাঁধা দিল। পেছন থেকে বলল,
” এখনই চলে যাব? আরেকটু থাকি? কতদিন পর তোমাকে দেখলাম! ”

তার এই প্রেম বুলিকে পাত্তা দিতে দিল না অরুণিমা। নিষ্ঠুরের মতো বলল,
” হ্যাঁ, এখনই যাবে। ”

কথাটা বলে সে হাঁটা ধরে। তন্মধ্যে শুনল,
” অনেকদিনই হবে। সেজন্য এত যত্ন করছ, ভালোবাসছ। ভালোবাসা, তোমাকে এভাবে সারাজীবনের জন্য পাওয়ার জন্য আমি সব করব। শুধু দোয়া করো, তোমার মতো আল্লাহও যেন আমার পাশে থাকে। ”

_________
অরুণিমা রাতে বাসায় ফিরে সঞ্জয়ানের খোঁজ করল। যে রুমটায় শূভ্রা ও সঞ্জয়ানকে থাকতে দিয়েছিল সেখানে ঢুকে দেখল, সে নেই। শূভ্রা আর নিয়াজ ইশারায় ঝগড়া করছে। তাদের মাঝে বসে জিজ্ঞেস করল,
” স্যার চলে গেছেন? ”

শূভ্রা বিরক্ত মুখে উত্তর দিল,
” হ্যাঁ, চলে গেছে। ”

অরুণিমা আরেকটা কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও থমকে গেল। তার নজর গিয়ে পড়েছে শূভ্রার গলায়। আঁচড় কাটা অংশটায় হাত লাগিয়ে উদ্বিগ্নচিত্তে বলল,
” অনেকটা কেটে গেছে তো! কিভাবে হলো? ”

শূভ্রা চোখ পা’কি’য়ে তাকাল নিয়াজের দিকে। না’লি’শের মতো করে বলল,
” তোমার এই আদুরে ছোট ভাই করেছে। আসতে না আসতে খামচে র’ক্ত বের করে দিয়েছে। ”

অরুণিমা নিয়াজের দিকে তাকাল শা’স’নের ভঙ্গিতে। কিছু বলার পূর্বে হাসির শব্দ শুনতে পেল। ঘাড় ফিরে দেখল, শূভ্রা হাসছে। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি রাখতে শূভ্রা বলল,
” তোমার স্যারকে বোকা বানিয়েছি, আপু। ”

কথাটা বলে হাসি থামাল। মুখের ভাব বদলে বলল,
” প্র’তি’শো’ধ নিব। সবসময় আমাকে ছোট করে কথা বলে, ধমকায়, শাস্তি দেয়! এবার আমার পালা। শাস্তি কাকে বলে, কত ধরনের হয়, সব আমি দেখাব। ”

চলবে

#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (৪২)

শূভ্রা আনন্দ ও সগর্বের সাথে ধীরে-সুস্থে জানাল, কীভাবে সঞ্জয়ানকে বোকা বানিয়েছে। বুদ্ধি খাটিয়ে বোকা বানানোর পর তার মুখের অবস্থাটাও জানাল অরুণিমাকে। সবটা শুনে সে জিজ্ঞেস করল,
” শার্টটা তুই খুলেছিস? উনি টের পাননি? ”
” না। একটুও নড়েনি। কী গভীর ঘুমে ছিল! আমার তো মনে হয়, কেউ যদি এসে খুন করে যেত তাও টের পেত না। ঘুমের মধ্যেই মরে লাশ হয়ে থাকত। ”

শূভ্রার মনে হওয়া বিষয়টি তার একদম পছন্দ হলো না। বুকের মধ্যে হালকা বাড়ি লাগল বুঝি! সামান্য রাগ নিয়ে ধমকে ওঠল,
” শূভ্রা! এমন করে মৃত্যুর কথা বলে কেউ? জিহ্বে বাঁধল না? উনি তোর স্বামী হয়। ”

সে নাক সিঁটকে চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
” না, বাঁধল না। স্বামী হিসেবে মানলে তো বাঁধবে। আর কেউ না জানুক, তুমি জানো এই বিয়েতে আমার মত ছিল না। ”

অরুণিমার রাগ ঝরে পড়ল। একটু চিন্তায় পড়ল। আপনমনে কিছু একটা ভাবল কতক্ষণ। অতঃপর শান্ত স্বরে সুধাল,
” স্বামী হিসেবে মানিস না কেন? ”
” খারাপ মানুষ তাই। তুমি জানো, উনার জন্যই বাবা আমাকে বকেছে, পড়াবে না বলেছে। তারপর তো বিয়েই দিয়ে দিল! ”

তার বাক্যার্থে দুঃখ, ক্ষোভ। মুখের ভাবে হতাশা, অসুখী। অরুণিমা এই দুঃখ ও ক্ষোভ সৃষ্টির ঘটনাগুলোও এক এক করে শুনল। তারপর প্রশ্ন করল,
” শুধু এটাই কারণ, নাকি অন্য কিছু? ”

শূভ্রা একটু নড়ে-চড়ে বসল। আপুর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
” অন্য কিছু কী? ”

অরুণিমা পাশে তাকাল। নিয়াজ পড়া রেখে তাদের দিকে চেয়ে আছে। খুব মনেযোগী হয়ে আগ্রহ নিয়ে তাদের কথোপকথনও শুনছে। চোখের চাহনি বড় করে শাসনের সুরে বলল,
” কী শুনছিস? যা, বাইরে থেকে ঘুরে আয়। ”

সে মনখারাপ করল। অনিচ্ছায় বই বন্ধ করে মাথা নিচু করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অরুণিমা বোনের দিকে ফিরে গম্ভীর সুরে প্রশ্নটা করল,
” কাউকে ভালোবাসিস? প্রেম-টেম আছে? ”

শূভ্রা প্রথমে আকাশ থেকে পড়েছে এমনভাবে তাকাল। পরমুহূর্তে মনে পড়ল সেই বন্ধুটির কথা। যে তাকে ফোন উপহার দিয়েছিল। আগের বারের মতো এবারও এটাই মনে হলো, তাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে। সেজন্যই মোবাইল উপহার দিয়েছিল। খুব শীঘ্রই প্রেমের প্রস্তাবও দিত। কথাটা মনের মধ্যে চাঁদের মতো উঁকি দিতে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। বলল,
” না। নেই। ”
” তারপরও এমন? মানছি, উনি তোর সাথে একটু কঠিন ব্যবহার করেছে তাই…”

আপুকে কথাটা শেষ করতে দিল না শূভ্রা। ধেয়ে এসে বলল,
” ওটা কঠিন ব্যবহার নয়, আপু। খুবই বাজে ব্যবহার। খারাপ মানুষরা এমন ব্যবহার করে। ”

প্রথমে অরুণিমা এটা নিয়ে কথা না বললেও এবার বলল,
” না, ওটা খারাপ মানুষের মতো ব্যবহার নয়। তুই ছোট, কলেজের ছাত্রী। ভুল কাজ করেছিলি তাই শাসন করেছেন। ”

শূভ্রা গভীরভাবে ভাবল না। বাচ্চাদের মতো জেদের মুখ বানাল। প্রতিবাদের মতো করে বলল,
” আমি ভুল করিনি। ”
” করেছিস। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া বিশাল বড় অপরাধ। সিগারেট খাওয়া নিষেধ। এটা জানা সত্ত্বেও তুই একজন মেয়ে হয়ে কিনেছিস। ”
” কিনেছি, খাইনি। আমি অতটাও খারাপ নই, আপু। ”
” স্যারও অতটা খারাপ নয়। তুই মনের মধ্যে রাগ আর জেদ পুষে রেখেছিস। তাই ভালো-মন্দকে আলাদা করতে পারছিস না। ”

শূভ্রা কিছু একটা বলার জন্য প্রস্তুতি নেয়। অরুণিমা বুঝতে পেরে বাঁধা দিল। বলল,
” আমি ভেবেছিলাম, স্যার তোর থেকে বেশি লম্বা ও বয়সে বড় তাই মেনে নিতে সমস্যা হচ্ছে। তেমনটা যেহেতু নয়, সেহেতু তোর উচিত সবকিছু ভুলে বিয়েটাকে মেনে নেওয়া। সংসারে মন দেওয়া। ইচ্ছে হলে, তার পাশাপাশি পড়ালেখাও করতে পারিস। আমি যতদূর জানি, তুই চাইলে স্যার পড়াবেন। বাঁধা দিবেন না। ”

শূভ্রা এবারও কিছু বলতে চাইল। অরুণিমা সুযোগ দিল না। আগ বাড়িয়ে বলল,
” কী চাস? বিয়েটা ভেঙে যাক? ভাঙার পর জীবনটা কেমন হবে ভেবে দেখেছিস? ”

শূভ্রা মাথা নাড়ল দুই পাশে। অরুণিমা বলল,
” তাহলে ভাব। সেটাও যদি না পারিস, চোখ দিয়ে দেখ। ”
” কী দেখব? ”
” ডিভোর্সি মেয়েদের জীবন কেমন হয়। তিনতলায় রুনা আপাকে চিনিস তো? তোর মতোই পরিবারের ইচ্ছেতে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছিলেন। তারপর বয়ফ্রেন্ডের কথায় ডিভোর্স দিয়ে চলে আসে। আসার পর কী হয়েছিল সেটাও জানিস। এই পাড়ার সবাই জানে, শুধুমাত্র একরাতের জন্য গ্রহণ করে তার টাকা-পয়সা, গয়না-গাটি সব নিয়ে পালিয়েছে৷ এরপর জীবন হয়ে গেছে জাহান্নামের মতো। না স্বামী ফিরিয়ে নিয়েছে, না পরিবার ভালোবেসে গ্রহণ করছে। সন্তানকে ফেলে দিতে পারবে না বলে, বাসায় থাকতে দিলেও শান্তি দেয়নি এক মুহূর্ত! ”

শূভ্রা এসবই জানে। আপুর মুখে শোনার সময় সবটা আবারও চোখের সামনে দেখতে পারছিল যেন তেমনই তন্ময় হয়েছিল। ছাদে উঠতে গেলে রুনা আপাদের রুমের চিল্লাচিল্লি শোনা যায়। মাঝেমধ্যে তাকে ছাদের কিনারায় কাঁদতেও দেখেছে কয়েক বার। সে খানিকটা ভীতমনেই বলল,
” আমি কারও কথায় চলে আসছি না, আপু। আমার বয়ফ্রেন্ডও নেই। ”
” এজন্য বেঁচে যাবি ভাবছিস? এটাও ভুল। মেয়েরা বিয়ের আগ পর্যন্ত পরিবারের আদরের মনি থাকে। বিয়ের পর ভারী বোঝা হয়ে যায়। এই বোঝার ওজনটা শুরুতে তুলার মতো ভারী হলেও ধীরে ধীরে পাথরের মতো ভারী হয়। ”

শূভ্রা কথাগুলোর অর্থ সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল না। চেষ্টা করার মধ্যে অরুণিমা পুনরায় বলল,
” তাছাড়া বিয়ে হলো আল্লাহর দেওয়া বিশেষ নেয়ামত। সবার ভাগ্যে এত সহজে জুটে না। তুই সোভাগ্যশালী তাই না চাইতেও এই নেয়ামত পেয়েছিস। অন্যরা পায় না। কত কান্না-কাটি করে! বিশেষ করে মেয়েরা। সুন্দরী, পরিবার ভালো এরপরও বিয়ে হচ্ছে না। এরকম হাজারটা মেয়ে আছে। ”
” বিয়ের জন্য কান্না-কাটি করে? ”

তার কণ্ঠে স’ন্দে’হ, অনাস্থা। অরুণিমা মাথা নেড়ে জোর দিয়ে বলল,
” হ্যাঁ করে। অন্যদেরটা বাদ দে, আমাকে দেখ। আমি, মাইমূন রাজি থাকা সত্ত্বেও বিয়ে হচ্ছে না। ও কি খা’রাপ? ওর পরিবারও কত ভালো! আমাদের চেয়ে অনেক উঁচু বংশ, এরপরও হচ্ছে না। ”

শূভ্রার মনটা ভার হলো। আপুর কথাটা সত্যি। তার দুঃখটা উপলব্ধি করছে যেন! চোখের দিকে চেয়ে থেকে সুধাল,
” তুমিও বিয়ের জন্য কাঁদ? ”

অরুণিমা ক্লান্তপূর্ণ হাসল। বলল,
” একসময় আমাকে তোর হিংসে হতো না? আজ আমার তোকে দেখে হচ্ছে৷ আল্লাহ আমাকে সব দিয়েছে কিন্তু তোর মতো সৌভাগ্য দেয়নি! ”

শূভ্রার মায়া হলো। সহানুভূতি উপচে পড়ছে চোখজোড়ায়। আপুকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরল সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। অরুণিমা চোখ বন্ধ করে বলল,
” স্যারকে কল করে ক্ষমা চেয়ে নিস। উনি খুব একটা রা’গি নন। বোকাও নন। যদি তোর কুবুদ্ধিটা ধরে ফেলে তাহলে অবশ্যই রে’গে যাবেন। এতে কিন্তু দোষ থাকবে না। আর রে’গে গিয়ে যদি সত্যি বিয়েটা ভেঙে দেয়, তাহলে নিশ্চিত হ, তোর কপাল পুড়েছে। বাবার অবস্থা জানিস, আমিও আগের মতো নেই। দ্বিতীয় বিয়ে কপালে আছে নাকি আমরা জানিও না। যদি না থাকে চিরকালে এখানে দুঃখে কাটাবি। আর যদি বিয়ে হয়ও, সেই স্বামী স্যারের মতো ভালো নাও হতে পারে। এরচেয়ে জঘন্য রকমের খা’রাপ পুরুষ এই পৃথিবীতে আছে। দোয়া করি, তোর কপালে এসব কখনও না আসুক। ”

এই সময়ে নিয়াজ দৌড়ে এলো। চিৎকার করে বলল,
” দুলাভাই এসেছে৷ ছোটআপু, তোকে ডাকছে। ”

শূভ্রার বুকটা ধড়াস করে ওঠল! গলা শুকিয়ে এলো। ভী’তসন্ত্রস্ত হয়ে ধীরকদমে বেরিয়ে এলো বাইরে। সঞ্জয়ান বসার রুমটায় মোড়ায় বসে আছে৷ আশেপাশে কেউ নেই। তার দিকে চেয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
” একটা জরুরি কথা ছিল। রুমটা ফাঁকা করো। ”

তার পেছনে অরুণিমাও বের হয়েছিল। দূর থেকে শুনতে পেয়ে বলল,
” ফাঁকায় আছে। ভিতরে বসুন। আমি চা-নাস্তার ব্যবস্থা করছি। ”

সঞ্জয়ান রুমের ভেতরে ঢুকল। শূভ্রা দরজার কাছে পৌঁছাতে তাকে হাত ধরে টেনে কাছে আনল। দরজাটা পা দিয়ে ভিড়িয়ে বলল,
” কোনো ভণিতা করবে না। একটা প্রশ্ন করব, উত্তর দিবে। ”

শূভ্রা এই প্রথম চোখে চোখ রাখতে পারল না। বুঝতে পারল তার হাত-পা কাঁপছে৷ হঠাৎ করে তার ভেতরটা অন্যরকম ভয়ে শিউরে ওঠছে। এমনটা আগে হয়নি। এবারই প্রথম!

সঞ্জয়ান প্রশ্নটা করার পূর্বে আবারও বলল,
” একটাই প্রশ্ন। একবারই করব। কোনো মিথ্যা নয়। সত্যিটা বলবে। ঠিক আছে? ”

শূভ্রা মাথা হালকা কাত করতে সে বলল,
” রাতে কি সত্যি আমাদের মধ্যে কিছু হয়েছে? ”

এই পর্যায়ে শূভ্রা চোখ তুলে তাকাল। পলক জোড়া কাঁপছে। হৃৎস্পন্দনের গতিও বেড়েছে। সঞ্জয়ান তার চোখে চেয়ে বলল,
” ভ’য় পেয়ো না। আমি তোমাকে ধ’ম’কাতে আসিনি। শাস্তি দিতেও না। বিশ্বাস করতে এসেছি। তোমার এই উত্তরের সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও জড়িয়ে আছে৷ শূভ্রা, আমাদের বিয়েটা নিয়ে এবার সত্যি ভাবা উচিত। এর একটা পরিণতি পাওনা হয়েছে৷ ”

শূভ্রার বুকের ভেতর উথাল-পাতাল ঢেউ শুরু হলো। আপুর কথা মনে পড়ল। মাথায় ভাবনা এলো, সত্যিটা বললে তার বিয়ে ভাঙবে, কপাল পুড়বে। তাই আরও একবার ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলল,
” হ্যাঁ, হয়েছে। ”
” সরি। ”

সঞ্জয়ান মুহূর্ত ক্ষণ সময় না নিয়ে ‘ সরি ‘ শব্দটা উচ্চারণ করায় সে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল। অবুঝের মতো প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি রেখে চেয়ে আছে৷ সঞ্জয়ান নির্দ্বিধায় পরিষ্কারভাবে বলল,

” তোমার অনিচ্ছায় স্পর্শ করার জন্য সরি, জোর করে বিয়ে করার জন্য সরি, এর আগের দুর্ব্যবহারগুলোর জন্যও সরি। তুমি যদি চাও, আমাকে শা’স্তি দিতে পার। আমি জো’র করে মাফ নিব না। বলো, কী শাস্তি দিতে চাও। ”

শূভ্রা কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে আনত নয়নে বলল,
” আমি এখান থেকে যেতে চাই। ”
” কোথায়? ”
” আপনার বাড়িতে। আপনার মায়ের কাছে। তাকে একটা কথা বলা দরকার। ”
” এরজন্যে বাড়ি যেতে হবে কেন? ফোন করছি। কথা বলো। ”

সঞ্জয়ান মোবাইল বের করলে শূভ্রা দ্রুত বলল,
” কথাটা সামনে বলব। আপনি এখনই আমাকে নিয়ে চলুন। ”
” খুব জরুরি কথা? ”

সে মাথা নাড়লে সঞ্জয়ান বলল,
” ঠিক আছে। আগে তোমার পরিবারের সবাইকে ডাকো। তাদের সাথেও আমার একটা জরুরি কথা আছে। ”

শূভ্রা সবাইকে ডেকে নিয়ে আসল। সঞ্জয়ান বিছানায় বসা অবস্থায় তাকায় শ্বশুরের দিকে। বলল,
” শুনলাম, মাইমূন ভাইকে বিয়ের জন্য একটা শর্ত দিয়েছেন? ”

অসীউল্লাহ উত্তর করলেন,
” হ্যাঁ। ”

সঞ্জয়ান সঙ্গে সঙ্গে বলল,
” সেই শর্ত আমি মানি না। ”
” শর্ত আপনাকে না, মাইমূনকে দিয়েছি। আপনি না মানার কেউ না। ”

সে দাঁড়িয়ে বলল,
” আমি এই বাড়ির আত্মীয়, অরুণিমার বন্ধু ও মাইমূন ভাইয়ার ছোট ভাই। সেই হিসেবে এই শর্তে আমার আপত্তি আছে। ”
” কিসের আপত্তি? ”

অরুণিমা প্রথমে চুপচাপ শুনছিল। এবার সাবধানে গিয়ে দাঁড়াল সঞ্জয়ানের পাশে। ফিসফিসের মতো করে বলল,
” এটাই আপনার সেই জরুরি আলাপ? ”

এই প্রথম তার কথাকে মনোযোগ দিল না৷ তাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
” আপনি শর্ত ভাঙুন ও অরুণিমার বিয়ের ব্যবস্থা করুন। নাহলে শূভ্রাকে আমি ঘরে তুলব না। এখানে ফেলে চলে যাব। আজ, এখনই। ”

চলবে