#আজও_তোমারই_অপেক্ষায়
#আফসানা_মিমি
২২.
গেস্ট রুমের দরজার সামনে এই নিয়ে সাতবার হিমারম পা পড়েছে। অস্থির হয়ে পায়চারী করতে দেখা যাচ্ছে তাকে। কারণ বিগত ছয় ঘণ্টা যাবত গেস্টরুমে মীর আরামে ঘুমাচ্ছে বাহিরে সবাইকে চিন্তিত রেখে। হিমা ছয় ঘণ্টায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। বিগত কয়েকমাসের অসুস্থতা এক নিমিষেই শেষ হয়ে গিয়েছে। হিমেল প্রথমে মীরের হঠাৎ আগমনটা মেনে নিতে পারেনি। মীরকে দেখামাত্রই আঘাত করতে এসেছিল কিন্তু মীর তাকে কথার ছলেই থামিয়ে দেয়। হিমার হাত ধরে বলতে শুরু করে,“ কোন সমস্যা?”
মীরের শান্ত প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে হিমেল চুপসে যায়। সে নিজেও চায়, তার মেয়ে সুখে থাকুক। অবিশ্বাসের জন্য যেই ছেলে ছয় মাস দূরে সরে থেকেছে সেই ছেলেকে এখন কিছু বললে সারাজীবনের জন্য পালাবে। শেষে মেয়েও হারাবে, সাথে আদরের বউকেও হারাবে। হিমেল সাহেব এই রিক্স নিতে চায় না। তার নরম দিক অন্তরে পুষে রেখে বাহ্যিক শক্ত রূপ পেশ করে,“ আমার মেয়ের হাত ছেড়ে দাও,মীর?”
“ তুমি কী এখন আমাদের মাঝে ভীলেন সাজতে এসেছো? চেষ্টাও করো না। তাহলে আগামী ছয় যুগ মেয়ের চেহারা দেখতে পারবে না। মনে রেখো, এই মীর যা বলে তাই করে।”
মীরের স্পষ্ট বাংলা কথায় হিমেল থতমত খেয়ে যায়। মনে মনে সাব্বাশ ব্যাটা বললেও বাহ্যিকদিক দিয়ে মুখখানা ভোঁতা করে রাখে। কপালে সরু ভাজ ফেলে কিছু বকার আগেই মীর সকলের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করে,“ আমি ঘুমাতে যাচ্ছি। উঠে নেই,তখন না হয় সকলে জামাই আদর করবেন?”
সেই যে মীর ঘুমিয়েছে এখনও উঠেনি। হিমা কোমরে হাত রেখে ভাবছিল কি করবে সে। গেস্টরুমের এক্সট্রা চাবিও পাচ্ছে না। মীরের সাথে তার দরকারী কথা আছে! সে দরজার নিচে উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করছে ভেতরে মীর ঘুমাচ্ছে নাকি লুকিয়ে রয়েছে। হিমা খুব সমর্পণে কাজ করছে যেন কোন শব্দ না হয়! মীর ঘুমানের আগে শক্ত করে তাকে বলে গিয়েছিল,“ অনেক ঢং করেছিস। এবার দেবদাসিনী ছেড়ে ভালো মানুষ সাজবি। আমি ঘুম থেকে উঠে মাথার চুল থেকে ধরে পায়ের পাতা পর্যন্ত যেন চকচকে পাই, হিমালয়! নয়তো তোর কপালে দুঃখ আছে।”
হিমা প্রথমে তর্ক করতে চেয়েছিল কিন্তু মীর তাকে সেই সুযোগ দেয়নি। গেস্টরুমের দরজা ধরাম করে আটকে ফেলেছিল। হিমা মীরকে বকতে বকতে আগের রুপে সাজতে বসে। হিমার উঁকিঝুঁকির মাঝেই মিলির আগমন ঘটে। সে হিমার মতোই নিচু হয়ে ফিসফিস করে বলে,“ ভেতরে কী মিষ্টি বিতরণের প্রস্তুতি চলছে?”
হিমা বাঁকা চোখে মিলির দিকে তাকায়। তার থেকেও নীচু স্বরে উত্তর দেয়,“ তোমাকে কীভাবে শায়েস্তা করবে, তার ব্যবস্থা চলছে। যাও এখান থেকে!”
মিলি মুখখানা ভোঁতা করে উঠে দাঁড়ায়। হিমার অগোচরে তাকে ভেঙচিও কাটে। সে তো ভালো কথাই জিজ্ঞেস করছিল। হিমা কেন তাকেই কথার ছলে প্যাঁচালো? হিমা তখনো দরজার নিচে উঁকি দিচ্ছে।এরই মধ্যে ফট করে দরজা খুলে যায়। হিমা মাথা তুলে দেখে মীরের উন্মুক্ত বক্ষস্থল দৃশ্যমান। ভ্রু যুগল কুঁচকে তারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হিমা সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়।আমতাআমতা করে শুধায়,“ ভেতরে একটা তেলাপোকা ঢুকেছে, ঔষধ দিতে এসেছিলাম। আমি যাই!”
“ দরজা খোলা থাকলে তেলাপোকার ঔষধ কাজ করে না। কথাটা জানিস কে বলেছে? টিংকু বিজ্ঞানী। আয় তোকে প্রেক্টিক্যাললি দেখাই, হিমালয়!”
দেখা গেল, মীর হিমাকে যেতে দেয়না। হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে যায়। তা দেখে মিলি হেসে বলতে শুরু করে,“ এবার বুঝবে, চান্দু! বাঘ জেগে শিকারীকে ধরে ফেলেছে। না জানি তোমার কপালে কি আছে।”
————————-
বিছানার উপর আয়েশ করে মীর বসে আছে। তার চোখ হিমার দিকে। হিমা আপাতত কান ধরে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। মীরের উন্মুক্ত বক্ষস্থল না ঢাকা পর্যন্ত চোখ খুলবেই না! মীর তা দেখে ধমকে বলে,“ ঢং করবি না, হিমালয়? আমার রাগ এখনো কমেনি।”
“ কি করলে তোমার রাগ কমবে,মীর ভাই? তুমি যা করতে বলবে তাই করব।”
মীর এবার বাঁকা হেসে শুধায়, “ আগামী এক ঘণ্টা আমার উন্মুক্ত বুকে তাকিয়ে থাকতে হবে। তবে গ্যারান্টি দিতে পারছি না, এতে রাগ ভাঙবে কি না!”
হিমা চোখ মুখ কুঁচকে নেয়। মীরকে মনে মনে কয়েকশত গালি দিয়ে শক্ত সুরে বলতে শুরু করে,“ তোমার শরম লজ্জা কি বুটওয়ালার কাছে ধার দিয়ে এসেছো, মীর ভাই? আমি কীভাবে তোমার দিকে তাকাবো। আমার লজ্জা করবে না বুঝি!”
“ আগে বল, তোর কালাচান সুন্দর? না আমি !”
“ এখনই বলতে হবে?”
হিমার করুণ স্বরে মীর চাপা হেসে বলে,“ না! বাসর রাতে বলিস।”
একজন মেয়ে বাসরের কথা শুনে যেভাবে রিয়েক্ট করবে হিমাও সেভাবেই রিয়েক্ট করে। সে চিৎকার করে বলে,“ তুমি একদম নষ্ট হয়ে গেছো, মীর ভাই! বাচ্চা একটা মেয়েকে এসব বলে লজ্জা দিচ্ছো! তেমার পাপ হবে, পাপ!”
অনেকদিন পর মীর মন খুলে হাসছে। তার উচ্চ হাসিতে বাড়ির অন্যান্য সদস্যও এসে দরজার কাছটায় হাজির হয়েছে। আশা দরজায় কষাঘাত করে বলতে শুরু করে,“ এতমাস কী পাগলাগারদে থেকে এসেছিস? দরজা খোল বদমায়েশ ছেলে?”
মীর হাসতে হাসতে দরজা খুলে দেয়। আশা উঁকি দিয়ে মেয়েকে কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করে,“ তুই আবার কি করেছিস?”
প্রত্ত্যুত্তরে মীর বলে,“ আমাকে কঠিন থেকে কঠিনতম কথা বলেছে, তাই শাস্তি দিচ্ছি।”
“ আমি কখন কি বললাম, মীর ভাই! তুমি সেই কখন থেকে আমাকে যা তা বলে যাচ্ছো। তোমা বুকের দিকটায়,,,,,,
বেচারি হিমাকে পুরো কথাও শেষ করতে দেয়নি মীর। হিমার মুখ চেপে ধরে বলে,“ ফুফু, তোমার মেয়ের মাথার তার সব ছিঁড়ে গেছে, বুঝলে! তুমি যাও, আমরা আসছি।”
আশা কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে মুচকি হাসে। দুজনের উদ্দেশ্যে বলে,“ ভুল মানুষের দ্বারাই হয়ে থাকে।ভুল ত্রুটি সমাধান করে এক হয়ে যাওয়াই শ্রেয়।”
আশা চলে যেতেই মীর ভয়ংকর একটি কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। হিমার গালে শক্ত একটা চুমু খেয়ে বলে,“ চমচম মিষ্টি।”
এরপরে শিস বাজিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। হিমা স্তব্ধ হয়ে গালে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকে বিড়বিড় করে বলে,“ এটা কী হলো!”
——————————-
আশ্বিনের বিকাল বেলায় হিমাদের বাড়িতে হৈ হুল্লোড় পরিবেশ।আনন্দ নগর থেকে আফজাল হোসেন ও তার পরিবার এসেছে। মীরের ফিরে আসায় জেরা করার পরিবর্তে আনন্দ করছে সবাই।বিকালের আড্ডায় সকলে একত্রে মীরকে ঘিরে বসেছে। কারণ, মীর। এতদিন সে কোথায় ছিল তাই সবার মনে প্রশ্ন।
” আমার অসুস্থতার খবর কার থেকে জানতে পেরেছো,মীর ভাই! সত্যি বলবে।”
মীর বিসমিল্লাহ বলে শুরুই করছিল। হিমার প্রশ্নে থেমে যায়। আরচোখে হিমেল ও মিলির দিকে তাকায়। সকলের বুঝার আর বাকী রইলো না কার সাথে মীরের যোগাযোগ ছিল। আশা হিমেলের দিকে তাকাতেই সে মিনমিন করে বলে,” আমি শেষেরদিন জেনেছি। আমি সত্যিই নির্দোষ। মিলি সবসময় ফিসফিস করে জানাতো।”
এবার সকলের দৃষ্টি মিলির দিকে যায়। মিলি আমতা আমতা করে বলে,” আমার ধর্মের ভাইয়ের উপকারই তো করেছি মাত্র, এভাবে তাকাবেন না। সব দোষ মিচকে শয়তানের।”
সকলে ভেবেছিল রাদিফের সাথে মীরের যোগাযোগ ছিল কিন্তু মিলির সাথে যে যোগাযোগ থাকবে ভাবতেও পারেনি। রাদিফ রক্তিম চোখে মিলির দিকে তাকায়। চোখের ইশারায় বুঝায়,” আজ একা পেয়ে নেই! ডিটেকটিভ গিরি বের করে দিব।”
মিলি শুকনো ঢোক গিলে মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে বলে,” ইয়া রব, আজকের মতো বাচিয়ে দিও!”
মীর সবকিছু দেখে বলতে শুরু করে,” জৈন্তাপুরে পৌছে রাদিফকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করি। তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নেই রাদিফকে ফেরত পাঠানোর। মিলিকে দেখেই বুঝেছিলাম, মেয়েটা রাদিফকে পছন্দ করে। আমার জন্য ছন্দহীন রাদিফের জীবনের সব ছন্দ হারিয়ে গিয়েছিল। সেদিন মিলিকে দেখে মনে হয়েছিল সেই রাদিফের জীবনে রং এনে নিতে পারবে। এই বিষয়ে রাদিফের সাথে কথা বলি। এটাও বলি, সে যেন মিলিকে ঢাকায় নিয়ে পড়াশোনা করায়। মিলি মেয়েটা এক বেলা আমার সাথে মিশে ছোট বোনের স্থান দখল করে নেয়।তাকে হিমার কথা বললে, আমাকে বুঝায়। আমি যে অবুঝ তা কিন্তু নয়! হিমা যা করেছিল তা বুঝার জন্য এতদিন দূরে থাকি।”
” কিন্তু তুই এতোদিন কোথায় ছিলিস, মীর?”
আশার কথার প্রত্ত্যুত্তরে মীর মাথা চুলকে উত্তর দেয়,” মিলির বাবার সাথে। সিলেটে উনার সাথে ব্যবসা শুরু করেছি। আলহামদুলিল্লাহ দ্বিগুণ পরিমানে লাভবান হয়েছি। দুইদিন আগে মিলির থেকে খবরাখবর নিতে কল করায় ফুফা দেখে ফেলে। মিলিকে বকা দিয়ে যখন ফোন কানে নেয়, তখন আমার সাথে কথাহয়।”
এতটুকু বলে মীর থামে। হিমেলের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,” শ্বশুরকে ম্যানেজ করা যা কষ্ট ভাই! এদের জন্যই পৃথিবীর আশি পার্সেন্ট লাভাররা কষ্টে ম’রে।”
মীরের শেষের খোঁচাটা কাকে দিয়েছে যেটা সবাই বুঝতে পারে। সকলে একত্রে হেসে উঠে। আশা স্বামীর দ্বিতীয়া রূপ দেখে মুখে ভেঙচি কাটে। সেদিনের ব্যবহারের জন্য নিশ্চিত আজ হিমেলকে শাস্তি দিবে!
এখানে নীরব দর্শক হোসনেআরা আর মারিয়া। দুজনে আপাতত গুগলে কী যেন খুঁজছে।
সকলের আড়ালে একজোড়া প্রেমিক যুগলের চোখে চোখে কথা হচ্ছে। মীরের মুখে দুষ্ট হাসি। হিমাকে দুষ্ট ইশারা করে জ্বালাচ্ছে। হিমা বিপাকে পড়ে বিড়বিড় করে বলে,” তুমি খুব খারাপ ,মীর ভাই! তোমার মুখে তেলাপোকা বাসা বাঁধুক যেন আমাকে আর জ্বালাতে না পারো।”
মীর বুঝতে পেরে হেসে ফেলে। মবে মনে প্রতিজ্ঞা করে,” তোর দুঃখ মুছে দিব, আদরে ভরিয়ে দিব। তোর আয়না হবো, আধার রাতের সঙ্গী হবো। তোর বন্ধু হবো, নীরবে সাথী হবো। তোর নিশ্বাসে আমি রবো, আমি শুধু তোর হবো।”
চলবে ইনশাআল্লাহ………