আজও_তোমারই_অপেক্ষায় পর্ব-১৪+১৫

0
152

#আজও_তোমারই_অপেক্ষায়
#আফসানা_মিমি
১৪.

আনন্দ উৎসব জমে উঠে আত্বীয়স্বজনদের জন্যই। প্রতিজনের হাসি, গল্প রঙ্গ নিয়েই উৎসব মুখরিত হয়ে উঠে। প্রতিটা উৎসবের একটি প্রধান মাথা থাকে যে কি না উৎসবকে প্রানবন্ত করে রাখে। মীর আজকের উৎসবের প্রধান মাথা। মারিয়া ও রিপ্তীকে দুই পাশে বসিয়ে গল্প করছে। বড়োরাও সেই গল্পে শামেল হয়েছে। মীরের গল্প হিমাকেই ঘিরে। আজও সে হিমাকে জ্বালাতন করার সুযোগ হাত ছাড়া করছে না। সে হিমার ছোটবেলার গল্প সবাইকে শুনাচ্ছে। গল্পটা ছিল ঠিক এরকম,
“ একবার হিমা আমার কাছে লিচু গাছে চড়ার বায়না করে। আমিও তখন ছোট ছিলাম কিন্তু শরীর স্বাস্থ্যে বেশ গুলুমুলু ছিলাম। হ্যাংলা পাতলা মেয়েকে ধরে লিচু গাছে উঠানো আমার বাম হাতের কাজ ছিল। তো প্রথমে হিমাকে গাছের একটি ঝুলন্ত ডালে চড়িয়ে আমি নিচে দাঁড়িয়ে দোল দিতে থাকি। প্রায় বিশ মিনিট পর হিমা আবদার করে বসে আমাকেও গাছে চড়তে। আমি সেই সময়ে ভাবছিলাম,যদি ওর মতো চড়তে যাই তবে ডাল ভেঙে নিচে পড়ে যাবো। তাই গাছ বয়ে গাছে চড়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমি গাছে চড়তে চড়তে জানো কি হয়েছে?”

মীর এতটুকু বলে থামে। রিপ্তী ও মারিয়াকে প্রশ্ন করে।তারাও উৎসাহী হয়ে একত্রে জবাব দেয়,“ কি হয়েছে?”

মীর আবারো বলতে শুরু করে,“ কি আর হবে আমার গাছে উঠার ঝাকিতে শুকনা কাঠি ধপাস করে নিচে পড়ে গিয়েছে, আর মা মা বলে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে।”

এতটুকু বলার পর উপস্থিত সকলে হাসতে শুরু করে। হিমা এতক্ষণ রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে সবটা শুনে মনে করতে চেষ্টা করছে, এমনটা সে কবে করেছে কিন্তু সে মনে করতে ব্যার্থ হয়। আশাও সাথে ছিল সেও হাসছে। হিমা বুঝতে পারে মীর বানোয়াট গল্প সকলকে বলছে। এতে হিমা ভীষণ রেগে যায়। ভেতর থেকে এখনো হাসাহাসির আওয়াজ আসছে। আশা হিমার কাছে এসে মাথায় ঘোমটা টেনে হাতে চায়ের ট্রে ধরিয়ে দেয়। হিমা এতক্ষণে বুঝে গিয়েছে আজ তাকে কে বা কারা দেখতে এসেছে। হিমা ভদ্র মেয়ের মতো সকলের সামনে আসে। মাথা উঁচু করে তাকাবে তখনই মীরের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়,“ বাড়ির মেয়েকে দেখতে হলে এতে ঘটাকরে আয়োজনের দরকার কি ছিল, ফুফু! রাস্তায় ধরে বেঁধে নিয়ে আসলেও কথা পাকাপাকি হয়ে যেত, কি বলো সবাই?”

মীরের কথায় হিমা কটমট দৃষ্টিতে তাকায়। সকলেই বুঝতে পারে মীর হিমাকে জ্বালাতন করার জন্য এসব বলছে। সে দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দেয়,“ পাত্র আমার পছন্দ হয়নি, মামা। এমন বাচাল ছেলেকে বলো, মুচি ওয়ালার কাছ থেকে কথা শিখে আসতে।”

সকলে উচ্চস্বরে হাসছে। হোসনেআরা এগিয়ে এসে হিমাকে মীরের পাশে বসিয়ে বলতে শুরু করে,“ এই বাঁদর ছেলেকে তুই ই ঠিক করতে পারবি রে হিমা। তোকে বিয়ে করবে বলে আমাদের ফোন করতে করতে পাগল করে ফেলেছে। ফোনে তার একটাই কথা,আমার হিমালয় কে চাই। এই নে হিমাকে এনে দিলাম। এবার আংটি পরা।”

আফজাল হোসেন এতক্ষণ পরে মুখ খুলেন। তিনি কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলেন,“ তোমার সব কথা রেখেছি। এবার দুজনের জন্য হলেও প্রতিষ্ঠিত হও। আমার ভাগনেকে কিন্তু রাজরাণী করে রাখতে হবে।”

“ তোমার ভাগনিকে আমার মবের রাণী করে রাখব, ঐসব নিয়ে একটুও ভেবো না।”

আজ হিমার কাছে সবকিছু বিরক্ত লাগছে। এই বাড়ির প্রতিটি সদস্য তার থেকে সত্য লুকিয়েছে। অথচ সে এতোদিন ভয়ে, চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল। আসল আসামী তো মীর! কি সুন্দরই না নাটক করে এসেছে সে। আশার মীরের ওাশে এসে বসে। মীরের মাথায় হাত রেখে বলে,“ সেদিন তোকে কথা দিয়েছিলাম, মেয়েকে তোর হাতেই দিব। ফলস্বরূপ তুই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলি,মেয়েকে সুখে রাখবি। আমি মেনে নিয়েছি। হিমা যেমন আমার সন্তান সাথে তুইও। আমি খুব খুশি মীর!”

মীর আশার হাতে হাত রাখে।হিমার দিকে তাকিয়ে বলে,“ আমি তো শুধু তাকেই ভালোবাসি,যে আমার হৃদয়ের ঘরে বাসা বেধেছে। সেই আমার হৃদয় হরিণী, যে আমার হৃদয়ে শক্তভাবে জায়গা করে নিয়েছে। আমার পূর্ণা, আমার অনন্যা।”

সকলের উপস্থিতিতে আংটি বদলের কার্যক্রম শুরু হয়। মীর মহা খুশি সে হোসনেআরার হাত থেকে আংটি নিয়ে হিমাকে পরাতে যায়। হিমা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে। সে কোনক্রমেই হাত খুলবে না। মীর সকলের সামনে হিমাকে ধমক দিতে চাচ্ছে না তাই সকলের অগোচরে হিমার উদ্দেশ্যে বলে,“ ভালোয় ভালোয় হাত খুলে ফেল, হিমালয়! নয়তো তোর ছোটবেলার লিচু গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার ছবি সবাইকে দেখিয়ে দিব!”

“ কিন্তু তখন তো তুমি ছোট ছিলে মীর ভাই! আর সেকালে স্মার্টফোনও তো ছিল না। তবে কীভাবে তুমি আমার ছবি তুললে?”

হিমার সভাবের কথা মীর কীভাবে ভুলে গিয়েছিল কে জানে! এই মুহূর্তে সে হিমার থেকে এমন প্রশ্ন আশা করেনি। তাই আগের চেয়েও ফিসফিস করে উত্তর দেয়,“ “ বেশি বাড়াবাড়ি করিস না রে, হিমালয়! নয়তো সকলের সামনে কাঁধে উঠিয়ে কাজি অফিসে নিয়ে চলে যাব! আমাকে দোষ দিতে পারবি না।”

হিমা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। তা দেখে মীর এক চোখ টিপে বলে,“ আমি যা বলি তাই করি, সো জলদি।”

হিমা হাত বাড়িয়ে দেয়। মীর আংটি পরিয়ে দেয়। এবার হিমার পালা, আশার থেকে আংটি নিয়ে মীরের হাতে পরিয়ে দেয়। এতো আনন্দ উল্লসের মাঝে রাদিফ নেই। সোফার কোণে বসে ফোনে কি যেন করছে।

বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে আরো এক বছর পর। দুইদিন পরই মীর চট্রগ্রামে চলে যাবে। হিমা লজ্জায় উপরে চলে গিয়েছে। এদিকে মীরকে সবাই ধরে বসে। রিপ্তী ও মারিয়ার আবদার যাওয়ার আগে তাদের বড়ো ট্রিট দিতে হবে। মীরও রাজি হয়ে যায়।

“ তুই মীরকে অনেক ভালোবাসিস, তাই না হিমা?”

হিমা চেয়ারে বসে হাতের আংটি নড়াচড়া করছিল আর মিটমিট করে হাসছিল। রাদিফের কথা শুনে ফিরে তাকায়। আজ রাদিফের মাথা নত নয় বরং হিমার চোখের দিকে। রাদিফকে কিছুটা এলোমেলো লাগছে হিমার কাছে। মুখে হাসির রেখা টেনে হিমা পালটা প্রশ্ন করে,“ তুমিও কি সব জানতে,রাদিফ ভাইয়া?”

“ আমি কিছুই জানতাম না, জানতে চাইও না। তুই আগে আমার কথার উত্তর দে।”

রাদিফের উচ্চ আওয়াজে কথা বলায় হিমা ভয় পেয়ে যায়।শান্ত মানুষ যখন রেগে যায় তখন সবকিছু তছনছ করে ফেলে। হিমার কাছে রাদিফকে আজ ভয়ংকর লাগছে। সে তুতলিয়ে বলে,“ হ্যাঁ, অনেক ভালবাসি।”

রাদিফ থমকে যায়। সে হিমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,“ নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা হিমা।”

রাদিফ দাঁড়ায় না। ঝড়ের বেগে বের হয়ে যায়। এদিকে হিমা কিছুই বুঝতে পারে না। ভাবুক নয়নে সেদিকেই চেয়ে থাকে। এমন সময় মীরের আগমন ঘটে। হিমাকে চিন্তিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,” দিন দুপুরে তোর সতিনকে দেখেছিস নাকি রে, হিমা? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

মীর কথা বলেই দরজার কাছটায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। হিমা মীরকে দেখেই জ্বলে উঠে। এক আঙুল উঁচিয়ে বলতে শুরু করে,“ আমার ঘরে কেন এসেছো, মীর ভাই? এখনই বের হও বলছি! তুমি একটা বাটপার, চিটার, বদের ছানা, কথা লুকাও। তুমি জানো! আমি আজ কতো চিন্তায় ছিলাম। ইচ্ছে তো করছিল ম’রে যাই।”
হিমার এক কথাতেই মীরের হাসি উবে যায়। সে একদম হিমার কাছে এসে তার গাল চেপে বলে,“ আজকেই শেষ ম’রা’র কথা আর কোনদিন উচ্চারণ করলে তোর জীবন থেকে তোর মীর ভাই চলে যাবে।”
হিমা কান্না শুরু করে। মীর রেগে বিছানায় বসে। সে হিমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। এটা দেখে হিমা আরো কান্না শুরু করে। মীরের কাছে বসে তাকে বার বার ছুঁয়ে দিতে চায় সে কিন্তু মীর প্রতিবারই হিমার হাত সরিয়ে দেয়। পরিশেষে হিমা জমিনে বসে মীরের কোলে মাথা রেখে বলে,“ আমি আজ জীবনের সবচেয়ে সুখের মুহূর্তে অবস্থান করছি। তুমি রাগ করে থেকো না,মীর ভাই! এই দিনটাকে কষ্টের দিন হিসেবে স্মৃতিতে এনো না। আগামী একবছর এই দিনটার কথাই স্মরণ করে তোমার অপেক্ষা করব।”

মীরের মন নরম হয়ে আসে। সে হিমার বাহুতে ধরে কোলে এনে বসায়। হিমাকে জড়িয়ে ধরে তার মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে বলে,“ কষ্টের পরই সুখ আসে, পাগলী। দিন গুঁনতে গুঁনতেই আমি চলে আসবো।”

হিমা প্রত্ত্যুত্তরে কিছু বলে না। মীরের বুকের বাম পাশে মাথা রেখে হৃদপিণ্ডের আওয়াজ শুনছে। কতক্ষণ তারা এই অবস্থায় ছিল, জানে না। মীরের দুষ্ট সুরে হিমার ধ্যান ফিরে আসে,“ এভাবেই থাকবি, হিমালয়! তোর হাতির মত শরীরের ভাড়ে আমি এবার শুটকি ভর্তা হয়ে যাবো তো!”

হিমা ছিটকে দাঁড়িয়ে যায়। কোমড়ে হাত রেখে বলে,“ তুমি এখনও আমাকে জ্বালাচ্ছো, মীর ভাই?”

মীর হসে। হিমার হাতের পিঠে চুমু এঁকে বলে,“ ভালোবাসছি তো,হিমালয়!”

এভাবেই তাদের সুখের সময় পাড় হয়ে যায়। সুখের পর দুঃখ আসে। এটাই জাগতিক নিয়ম! এককালে সুখ করলে পরে দুঃখ আসে। হিমার ভাগ্যেও কী এমন কিছু আছে! মীরের অপেক্ষায় কতোকাল তাকে পোড়াবে? কে জানে!

চলবে ইনশাআল্লাহ……..

#আজও_তোমারই_অপেক্ষায়
#আফসানা_মিমি
১৫.

[১৮+ এলার্ট]
“ কুরিয়ারে তোর জন্য একটা কাগজ পাঠিয়েছি। কোন কিছু না পড়ে চোখ বন্ধ করে সাইন করে দিবি।”
“ কিন্তু চোখ বন্ধ করে কেন সাইন করব,মীর ভাই! যদি ঠিক জায়গায় কালি না পড়ে তাহলেও তো বকবে।”
“ এমনিতেও পাগল হয়ে যাচ্ছি, তুই আমাকে আর পাগল করিস না, হিমালয়। যা বলছি তাই করবি।”

হিমা মুখ ভেংচি কাটে। মীর চলে গিয়েছে আজ এক সপ্তাহ হয়েছে। নতুন অফিসে কাজের খুব চাপ। কাজ বুঝে নিতেই কয়েক সপ্তাহ লাগবে। সারাদিনের ব্যস্ততার শেষে রাতে হিমার সাথে কথা বলার সুযোগ পায়। যতক্ষণ তাদের কথাহয় ততক্ষণই হিমা উলটা পালটা কথা বলে মীরের মাথা নষ্ট করে ফেলে।

“বুঝলি হিমালয়! তোর কাছে থেকেও যন্ত্রণায় ছিলাম, এখন দূরে এসেও যন্ত্রণায় আছি। ইচ্ছে করছে সব কাজ ফেলে তোর কাছে চলে আসি।”

“ কি বলছো, মীর ভাই! তুমি চলে আসলে ঘর ভাড়া, গাড়ি ভাড়া কোথায় থেকে পাবে শুনি? তার থেকে ভালো সেখানে থেকে যাও। তুমি জানো না! বাড়িওয়ালারা তোমাদের মতো অসহায় মানুষদের ভাড়া দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করতে পারে! তাদের প্রতি একটু দয়া করো,মীর ভাই!”

মীর ক্লান্তিতে বিছানায় শুয়ে কথা বলছিল। হিমার কথা শুনে ক্লান্ত শরীরে রাগ চলে আসে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,“ সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য তোর চিন্তা হয়, কিন্তু আমার জন্য চিন্তা তো দূরের কথা ভালেবাসাও জন্মে না। একটা সুন্দর মুডে ছিলাম দিলি তো সব শেষ করে! আমাকে আর কল করবি না,হিমালয়!”

রোমান্টিক মীরের রোমান্সের তেরোটা বাজিয়ে হাসছে। মীরকে আচ্ছা জব্দ করে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে সে। আমরা তার সাথেই জীবনের সকল সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করতে পারি যারা আমাদের হৃদয়ের কাছটায় থাকে। হিমার বেলায়ও তাই। মীরকে হাসাতে রাগাতে, সুখ দুঃখে পাশে থাকতে ইচ্ছে করে হিমার।সে জানে,মীরকে প্রশ্রয় দিলে নিশ্চিত এক্ষুনি ট্রেন ধরবে! হিমা তা চায় না। কিছু সম্পর্ক অপেক্ষা করায় যদি পূর্ণতা পায় তাহলে যুগ যুগ অপেক্ষা করতে সে রাজি আছে। মীরের দুর্বল দিক হিমার জানা আছে। সে নিজেকে সেভাবেই তৈরী করছে। হিমা জানে, তাকে মীরের পছন্দে সাজতে দেখে সে মোমের মতো গলে যাবে।

এদিকে মীর আহত মনে ব্যাধিত হয়ে ছাঁদে বসে আছে। হাতে তার সিগারেট। হিমার সেই চিঠিখানা হাতে নিয়ে চাঁদের আলোয় পড়ছে। এই চিঠিটা তার বড্ড প্রিয়। এর মাধ্যমেই হিমার জন্য মীরের অনুভূতি আর গাঢ় হয়েছিল। দুই নাম্বার সিগারেটে শেষবারের মতো ঠোঁট ছুঁয়ে তৃতীয় সিগারেট ধরাতে নিতেই তার মুঠোফোন বেজে উঠে। হিমালয় নামক আনরোমান্টিক গাধী ফোন করেছে তাও আবার ভিডিও কল। যেই মেয়ে, ভিডিও কলে আসতে লজ্জা পায় সে আজ ভিডিও কল দিচ্ছে! এতো মেঘ না চাইতেও জলের মতো। মোবাইল একটি ইটের উপর সেট করে মীর কল রিসিভ করে। ফোনের দিকে মা তাকিয়েই সে সিগারেট ধরাতে নেয় তখনই হিমার কন্ঠস্বর ভেসে আসে, “ মীর ভাই, দেখো তো আমায় কেমন লাগছে?”

মীর বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থমকে যায়। হাতে জ্বলন্ত দিয়াশলাই কাঠি জ্বলছে। ঠোঁট থেকে সিগারেট জমিনে পড়ে যায়। মীর হা করে হিমাকে দেখছে। হাতে দিয়াশলাই কাঠির আগুনে স্তম্ভিত ফিরে আসে। আহ করে কাঠি ফেলে দিয়ে ফোন হাতে নেয়। ফোনের স্ক্রিনে শব্দ করে চুমু খায়। আদুরে স্বরে বলে,“ আগুন ধরিয়ে দিলি তো, হিমালয়!”

হিমা লাজুক হাসে। কপোলের উপর থাকা চুলগুলো সযত্নে কানের পিছনে নিয়ে মিনমিন করে বলে,“ তোমার পছন্দ হয়েছে, মীর ভাই? ”

মীর হা করে নিশ্বাস ত্যাগ করে মাথা দুলায়। তার প্রতিটা নিশ্বাসে দূরত্বের যন্ত্রণা বিদ্যমান। সে চোখ বন্ধ করে বলে,“ আমি থাকলে আজই তোকে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলতাম রে হিমালয়! তখন আবার আমাকে নষ্টা ছেলে বলে সম্বোধন করতি। ”

মীর থামে। একদম ফোনের কাছটায় ঠোঁট এনে বলে, “ তোর জন্য নষ্ট ছেলেও হতে রাজি আছি, হিমালয়!”

হিমা এবার দু হাতে মুখ ঢেকে নেয়। লজ্জায় তার কান, নাক, মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সেই অবস্থায় থেকে সে বলে,“ এবার থামো তো! তোমার জন্য মন খুলে কথাও বলতে পারি না। সবসময় লজ্জামার্কা কথা বলে লজ্জা দাও।”

মীর এবার উচ্চস্বরে হাসে। তার হিমালয় আজ ব্ল্যাক এঞ্জেল সেজেছে। কালো শাড়ি গায়ে জড়িয়ে তাকে মাতাল করতে চলে এসেছে। মীর গভীর নয়নে হিমার দিকে তাকায়। হিমার ঠোঁট জোড়া শুষ্ক। কৃত্রিম সাজসজ্জা সেথায় ছুঁয়ে দেয়নি। মীরের ইচ্ছে করছে ঐ স্থানে লাল টকটকে রং দিয়ে সাজিয়ে দিতে। তাপর মীরের মাতাল স্পর্শে তাকেও মাতাল করতে। দুষ্ট চিন্তা মাথা থেকে ঝরে মীর হাঁটা ধরে। এই মুহূর্তে তার ঘরে যাওয়া প্রয়োজন। হিমার সাথে অনেক কথা বাকী! মনচিন্তায় চিন্তা করলে সময় ফুরিয়ে যাবে কিন্তু কথা আর হবে না।
_______________________________

সকালের আলসে সময় পাড় করছিল হিমা। আশা আজ বিনা কারণে জিদ ধরেছে। সে আজ কোনো রান্নাই করবে না। কারণও আছে! আশার কথা হচ্ছে, হিমেল পালটে গিয়েছে। সে পূর্বে মাসে তিনবার রেস্টুরেন্টে নিয়ে ঘুরিয়ে আনতো। অথচ এখন হিমেল বলে কি না, বুড়ো বয়সে ভীমরতি!
বাব-মায়ের ঝগড়াঝাটির মাঝে বেচারি হিমা বিপাকে পড়েছে। সোফায় পা উঠিয়ে আশা টিভি দেখছে। এদিকে হিমার ক্ষুধায় পেট চু চু করছে। সেখানে হিমার এই সময়ে টিভি দেখার কথা আজ আশা দেখছে। হিমা হতাশ হয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করে। কি বানাবে কি বানাবে ভাবতে ভাবতে আটার ডিব্বায় হাত দেয়। জীবনের প্রথম আজ সে পরোটা করবে। সে ভাবছে, এখন থেকে টুকটাক মায়ের হাতে হাত লাগিয়ে রান্না শিখবে। এই সুযোগে মীরের পছন্দ অপছন্দ খাবারও জেনে নিবে! একটি বোলে কিছু আটা নিয়ে তাতে পানি ঢেলে দেয় হিমা। পরিমাণের চেয়ে বেশী পানি দেওয়াতে খামি নরম হয়ে যায়। বেচারি হিমা ভয়ে আরো আটা ঢেলে দেয়। এভাবে সে বোল ভর্তি খামি বানিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ে। কলিং বেলের আওয়াজে হিমা উকি দিয়ে দেখে রাদিফ এসেছে। এই সময়ে রাদিফকে হিমা আশা কেউই আশা করেনি। আশা সোফা ছেড়ে রাদিফের কাছে এসে বলে, কিরে বাবা, সব ঠিক আছে তো? এতো সকালে না বলে এলি যে!”

রাদিফ আশার থেকে চোখ সরিয়ে হিমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়,“ আমি এক সপ্তাহের জন্য সিলেট যাচ্ছি। সন্ধ্যায় গাড়ি, ভাবলাম তোমাদের থেকে বিদায় নিয়ে যাই!”

আশা খুব খুশি হয়। রাগের কথা ভুলে গিয়ে ভাতিজার জন্য খাবার বানাতে চলে যায়। এদিকে হিমা আস্তে করে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসে। রাদিফের পিছনে এসে ভয়ার্ত স্বরে বলে, “ আমাকে বাঁচাও রাদিফভাই! মা আজ আমার কল্লা কাটবে।”
রাদিফ হিমার কথার আগা মাথা বুঝতে পরে না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আশার চিৎকার শুনতে পেরে মূল ঘটনা বুঝতে পারে।
“ আমার রান্নাঘর কী তোর গোসলখানা পেয়েছিস? পানি আর আটা দিয়ে এ কী বানিয়েছিস? ”
“ তোমাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম,মা! ঐ পানি একটু বেশি পড়ে গেছে।”
আশা কপাল চাপড়ে কাজে মনোযোগ দেয়। এদিকে হিমা রাদিফকে নিয়ে সোফায় বসে জিজ্ঞেস করে,“ তুমি কি একই ঘুরতে যাবে, রাদিফ ভাই! ভয় করবে না! ”
“ না, তুই কেমন আছিস বল?”
“ ভালো আছি তো!”
রাদিফ নীরব হয়ে বসে আছে। হিমা টেলিভিশন দেখায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে সে। অকস্মাৎ রাদিফ হিমার হাত ধরে বসে। হিমা রাদিফের এহেনকাণ্ডে অপ্রস্তত হয়ে যায়। সে হাত ছাড়িয়ে নিতে নিলে রাদিফ বাধাঁ প্রদান করে হেসে বলে, “ অথচ মীর হাত ধরলে তুই হাত সরিয়ে নিস না। আমি মীরের জায়গায় থাকলে কী খুব ক্ষতি হতো!”

হিমা অবাক তারসাথে ভয়ও পাচ্ছে। রাদিফের ব্যবহারে হিমা এতটুকু বুঝতে পেরেছে যে, রাদিফ তাকে বোনের নজরে নয় বরং অন্য নজরে দেখে। হিমা রাদিফের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলে, “ রাদিফ ভাই, হাত ছাড়ো। আমি ব্যথা পাচ্ছি।”
রাদিফ হাত ছেড়ে দেয়। হিমার থেকে দূরে দাঁড়িয়ে বলে,“ আমাকে ভিলেন ভাবিস না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল জানি। তোকে শুধু জানাতে এসেছিলাম যে, আমার মনে তোর জন্য আলাদা অনুভূতি তৈরী হয়েছিল। কিন্তু এখন সেটা নাই। মীরের সাথে তোকে এখসাথে দেখার পর থেকে সব অনুভূতি মাটিচাপা দিয়েছি। ”

এমন পরিস্থিতিতে হিমা কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সে মুখ চেপে কান্না আটকে দৌঁড়ে উপরে চলে যায়। রাদিফ থাকা কালীন হিমা আর ঘর থেকে বের হয়নি। আশা অনেকবার ডেঁকে গিয়েছে। হিমা মাথা ব্যথার অজুহাতে ঘরে বন্দী অবস্থায়ছিলো।

– [ ] কেঁটে গিয়েছে আরো কিছুদিন। শীতের কোনো এক বিকালে হিমা গায়ে শাল জড়িয়ে ছাঁদে দাঁড়িয়ে ছিলো। অকস্মাৎ বাড়ীর সামনে এসে গাড়ি থামে। হিমার সেই গাড়ি চিনতে একটুও অসুবিধা হয়নি। এই গাড়ি তার মামার গাড়ি। খুশিতে হিমা লাফিয়ে উঠেই। এক দৌঁড়ে নিচে এএসে মামাকে জড়িয়ে ধরে। আফজাল সাহেবের চোখে পানি। পাশে মাত্রই আশা এসে দাঁড়িয়েছে। আফজাল হোসেন এবার নিজেকে আটকে রাখতে পারেননি। বোনের উদ্দেশ্যে বলে,“ আমার ছেলেটা কোথায় হারিয়ে গেলোরে, আশা?”

চলবে ইনশাআল্লাহ………….