আজ শুভ্রর বিয়ে পর্ব-০৩

0
49

#আজ_শুভ্রর_বিয়ে
পর্ব ৩

————-
তুলির ঘরের পাখাটা খুবই স্লো মোশনে ঘুরছে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, ঋতু যাই হোক না কেনো পাখা ছাড়া ও একদমই ঘুমাতে পারেনা। প্রচন্ড শীতে দুটো লেপ এক সাথে নিয়ে হলেও ওর পাখা ছেড়ে ঘুমাতে হবে।কিছুক্ষন আগে বেশ তান্ডব করে ঝড় হয়ে এখন ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এটাই মৌসুমের প্রথম বৃষ্টি। ঋতুটা বসন্ত হলেও শীত এখোনো পুরোপুরি যায়নি।

সাধারনত কয়েকদিন টানা ভ্যাপসা গরমের পরে হঠাৎ একদিন অপরাহ্নে, প্রবল গর্জনে, গ্রীষ্ম তার আগমনীর জানান দেয়, ভয়ংকর সুন্দর কাল বৈশাখীর রুপে। কিন্তু এবারের ঘটনা ভিন্ন, বছরের প্রথম বৃষ্টি শুরু হলো ভোর বেলা থেকে। বৃষ্টির আগে কিছুক্ষন ঝড়ের তান্ডব ও চলেছে। সেই শব্দেই ঘুম ভেঙ্গেছে তুলির। এমনিতেই সকালে ঠান্ডাটা বেশি লাগে তার উপর বৃষ্টি শুরু হওয়াতে ভালো রকম শীত করছে। তুলি ওর লেপটাকে আরো ভালো করে পেচিয়ে নিলো। ঠান্ডা পরিবেশ সাথে বৃষ্টির শব্দ এমন আবহাওয়ায় শুয়ে থাকার অন্য রকম মজা। ধীরে ধীরে ঘুরতে থাকা পাখার দিকে তাকিয়ে তুলির মনে পরে গেলো ঠিক দু বছর আগের এক চৈত্র মাসের কথা।

“প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ”

এমনই এক ঝড় বাদলের দিনে ওদের বাসায় এসে হাজির হয়েছিলো জহির। মা গিয়েছিলো উপরতলার আন্টির সাথে ইন্ডিয়াতে মাসখানেকের জন্যে আর বাবা ছিলো অফিসে। বাবা মা বাড়িতে না থাকায় খুব শখ করে ছাদে বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়েছিলো তুলি। দরজায় জোড়ে ধাক্কানোর শব্দে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। যে এসেছে তার এতোটুকু জ্ঞান বুদ্ধি নেই যে কলিং বেল চাপবে। ছাদ থেকে উকি মেরে দেখলো এক লোক বাক্স পেটরা নিয়ে কাক ভিজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর একটু পর পর সজোড়ে দরজা ধাক্কাচ্ছে। নিচে যেয়ে দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়ানো মানুষটি কাঁচুমাচু হয়ে সালাম দিলো।

আপনি মনে হয় তুলি

জ্বী

আমি সূবর্ণ পুর থেকে এসেছি। আপনার নানি বাড়ি। দুই বছর আগে আপনারা গিয়েছিলেন তখন আপনাকে দেখেছিলাম। তাই চিনতে পেরেছি।

কিন্তু আমি আপনাকে চিনতে পারিনি।

আপনার বাবা বলেছিলেন ঢাকায় আসলে যেনো আপনাদের বাসায় আসি।

দেখেন এখন বাবা বাসায় নেই আর অপরিচিত কাউকে বাসায় ঢুকতে দিতে পারবোনা।

আমি অপরিচিত না সূবর্ণপুরের মানুষ

আপনার কাছে পাসপোর্ট বা ভোটার আইডি কার্ড আছে যেখানে লেখা আছে আপনি সূবর্নপুরের মানুষ

জ্বী না

তাহলে আমার কিছুই করার নেই, আপনি বরং আপাতত অন্য কোথাও যান সন্ধ্যার পর বা কালকে সকালে আসলে বাবাকে পাবেন বলেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলো তুলি।

ঢাকা শহরে উনার আর যাওয়ার জায়গা ছিলোনা সেই কাক ভিজা অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তুলির বাবা ফেরা পর্যন্ত। ততক্ষনে বেচারার কাপুনি দিয়ে জ্বর চলে এসেছে।

বাবা অফিস থেকে এসে ওনাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুলির উপর খুব রাগ করে বললেন,’তুলি তাড়াতাড়ি ওকে গেস্ট রুমটা দেখিয়ে দেয় আর কিছু খাবারের ব্যবস্থা কর।’ খাবারের ট্রেটা নিয়ে রুমে যেয়ে দেখে উনি বিছানার চাদর মুড়ি দিয়ে বসে কাঁপছেন। কি রেখে কি করবে তুলির মাথায় আসছিলো না বাবাকে ডাকতে যেয়ে দেখে বাবা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে বসে বসেই ঘুমিয়ে পরেছে।

তুলির খুব অনুশোচনা হচ্ছিলো, ওনাকে ধরে বসিয়ে জ্বরের ওষুধ দিলো। কিন্তু ওষুধ দেয়ার পরও জ্বর নামছিলো না। সারা রাত মাথার কাছে বসে জল পট্টি দিলো। সেদিন থেকে টানা সতেরদিন এমন ই চললো। এর মধ্যে বাবা ডাক্তার এনে দেখিয়েছেন। রক্ত পরীক্ষা করে দেখে টাইফয়েড। অনুশোচনা থেকেই হয়তো লোকটার দিন রাত সেবা করেছে তুলি। আঠারো দিনের দিন জ্বর ছেড়ে দিলো। এ কদিন জহির শুধু একটা কথাই বলেছে, ‘তুলি, আপনি আমাকে চির ঋনী করে ফেলছেন।’

উনি যখন সুস্থ হয়ে গেলেন তখন ও তুলির মন চাইতো ওনার ঘরে যেতে ওনার কপালে হাত দিয়ে দেখতে আবার জ্বর চলে আসেনিতো। কেমন যেনো অস্থিরতা শুরু হয়ে গেলো। কিন্তু ঐ মানুষটা বুঝতেই পারলেন না কোনোদিন। ঋন শোধ করার কোনো চেষ্টাই করলেন না আর। মাঝখান থেকে হঠাৎ একদিন বলে বসলেন, ‘তুলি, আমি আপনাকে এখন থেকে আম্মাজান বলে ডাকবো। সম্পর্কে তো আমি আপনার মামা হই।’ তুলির মনে হয় উনি ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন তুলির অবস্থা আর তাই ওকে ঠেকানোর জন্যে এই ট্রিকটা করেছেন।

—————
আপা আপা দরজা খোলো

খুবই বিরক্ত হয়ে উঠে দরজা খুললো তুলি কি হয়েছে সকাল সকাল চেচাচ্ছিস কেনো?

তুলির ছোটবোন তোয়া। স্বভাবে ওরা দুই বোন উত্তর মেরু আর দক্ষিন মেরু। তুলির ধারনা তোয়াও জহির মামাকে পাগলের মতো ভালবাসে। কিন্তু তোয়া খুব চালাকতো ও এমন ভাব দেখায় যে ও জহির মামাকে একদমই পছন্দ করেনা।

শোন আপা তুমি বয়সে আমার থেকে বড় হতে পারো কিন্তু মাঝে মাঝে তুমি এমন কিছু করে বসো মনে হয় তুমি একেবারে বাচ্চা মেয়ে

আমি আবার কি করলাম

তুমি তোমার হবু বরকে বলেছো কেনো যে তুমি জহির মামার প্রেমে তলিয়ে গিয়েছো আর উনি আমার প্রেমে তলিয়ে গেছেন।

তুলির মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। এই শুভ্র ছেলেটাতো সুবিধার না, এই কথা আবার বলতে গেলো কেনো?
এটাকি সবাইকে বলার মতো কথা..? মনে হয় বিয়ে ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে বলেছে।

– কি কথা বলছো না কেনো নিজেরটা বলেছো ভালো কথা আমার ব্যাপারে না জেনে কথা বললে কেনো?

তারমানে তুই ওনার প্রেমে তলিয়ে যাসনি।

– না মোটেই না, তোমার জন্যে মা উনাকে এই সকাল বেলা ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বাসা থেকে বের করে দিলো।

কথাটা শুনেই তুলির বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। আহারে বৃষ্টিতে ভিজে না বেচারা আবার আগের মতো অসুস্থ হয়ে যায়।

দৌড়ে যেয়ে মাকে ধরলো মা শুভ্র ওর মাকে মিথ্যা কথা বলে বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে আমি এমন কিছুই ওনাকে বলিনি বিশ্বাস করো।

শুভ্র ওর মাকে বলেনি আমাকে বলেছে আর এটাও বলেছে তুই যাকেই ভালবাসিস না কেনো তাতে ওর কোনো সমস্যা নেই।

মিথ্যা কথা বলেছে ওর মিথ্যা কথা শুনে তুমি একটা নিরীহ মানুষকে এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বের করে দিলে আমাকেতো জিজ্ঞেস করতে পারতে একবার।এখানে জিজ্ঞেস করার কি আছে সে ছেলে কেনো মিথ্যা বলবে। তুই না বললে ওর তো জহির কে তাই জানার কথা নয়।

আসলে মা আমি বিয়েটা করতে চাচ্ছিলাম নাতো তাই বানিয়ে মিথ্যে কথা বলেছি বিশ্বাস করো প্লিজ তুমি জহির মামা কে আসতে বলো। ওনার প্রতি আমার বা তোয়ার অন্য কোনো ফিলিংস নেই উনিতো আমাকে আম্মাজান বলেন। আর এরকম একটা বোকা মানুষকে আমরা দুই বোনই কেনো ভালবাসবো বলো।

– হুম, আমার সেরকমই মনে হয়েছিলো, তুই বিয়ে না করার জন্যে বানিয়ে বানিয়ে এসব বলেছিস। ওকে আমি জহিরকে ফোন দিয়ে আসতে বলে দিচ্ছি।

ফোন দেয়ার কিছুক্ষন পরই জহির মামা চলে এসেছেন মনে হয় উনি কাছাকাছি কোথাও তুলির মার ফোনের অপেক্ষা করছিলেন।

প্রায় অনেকক্ষন মন্ত্রী সাহেবের স্ত্রীর সাথে কথা বলে এসে উচ্ছসিত হয়ে তুলির মা ঘোষনা দিলেন, ‘শুভ্র তুলিকে এতোই পছন্দ করেছে যে ও বিয়েতে আর দেরি করতে চাচ্ছেনা, ওরা এই শুক্রবারই আসবে কাবিন করতে।’

চলবে…