আজ শুভ্রর বিয়ে পর্ব-০৪

0
46

#আজ_শুভ্রর_বিয়ে
পর্ব ৪

——————
“চুকিয়ে দেব বেচা কেনা, মিটিয়ে দেব গো
মিটিয়ে দেব লেনা দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই ঘাটে
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে……..”

কট করে ওয়াড্রোবের উপর রাখা পুরোনো ক্যাসেট প্ল্যায়ারের লাল স্টপ বাটনটা চেপে গানটা বন্ধ করে দিলো তোয়া।আজ সকাল থেকেই বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুযে আছে তুলি।আর এই একটা গানই বার বার শুনছে। তোয়ার আচরনে রেগে গেলো তুলি

এই তুই অনুমতি না নিয়ে আমার গান বন্ধ করলি কেনো। এই নাও… একটা ছোটো ডায়েরী ধরিয়ে দিলো তোয়া তুলিকে।
কি এটা

– হিসাব

মানে

– লেনাদেনা চুকিয়ে দিতে হবে না
আজ সন্ধ্যার পর তুমি হবে কোটিপতির বউ
তখন কি তোমার এসব মনে থাকবে
দেখো হিসাব লেখা আছে আমি তোমার কাছে পুরো সাতশ পঁয়ত্রিশ টাকা পচাত্তর পয়সা পাই। কবে কেনো নিয়েছো কতো দিয়েছো কত বাকি সব লেখা আছে পড়ে দেখো।

তুলির মাঝে মাঝে বিশ্বাসই হয়না তোয়া তুলির আপন বোন। তোয়ার সব কাজ গোছানো আর তুলির সব এলোমেলো। ডায়েরীর দিকে তাকিয়ে নিজের স্বাক্ষর ও দেখতে পেলো তুলি। তিন বছর আগের একটা তারিখ,টাকা দেয়ার সময় তোয়া তুলির স্বাক্ষর ও নিয়েছিলো।
আশ্চর্য।
কি রে এতোদিনের পুরোনো হিসাব সুদে আসলেতো আরো বেশি হবার কথা

– আমি সুদ কেনো নিবো সুদতো হারাম

ড্রেসিং টেবিলের উপর আমার ব্যাগে কিছু টাকা আছে পুরোটাই নিয়ে নেয়।

– না আমি যা পাই তাই নিবো।

কি রে তোয়া আমি চলে যাবো তোর কষ্ট হচ্ছেনা?

– হচ্ছে আবার হচ্ছেও না

মানে কি?

– তোমার বিয়ে না হলেতো আমি বিয়ে করতে পারছিনা

তোর বিয়ে করাটা কি খুব জরুরি

– হুম

কেনো

-বলা যাবেনা, এটা গোপন কথা, সব গোপন কথা সবাইকে বলা যায়না আর তোমার মতো বোকা মেয়েদেরতো একদমই বলা যায়না।

হঠাৎ তোয়াকে খুব বড় বড় লাগছে মনে হচ্ছে একটা কিশোরী মেয়ে নয় বরং একটি পূর্ন বয়স্ক যুবতী মেয়ের সাথে কথা বলছে তুলি।

তোয়ার সাথে কথা বলার পর থেকে তুলির খুব ভয় হচ্ছে ও আর বিছানায় থাকতে পারলো না। তোয়া বানিয়ে কথা বলার মেয়ে নয়। ঘটনা কি কে জানে? খুব বড় কোনো বিপদে না পরে যায় মেয়েটা। তুলি ওর জীবনে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে। ওর বান্ধবীদের মধ্যে যারা বোকা সোকা তাদের জীবনটা সহজ কি করে যেনো তাদের ভালো বিয়ে ও হয়ে যায় আর যারা বুদ্ধিমতি তাদেরই দুনিয়ার ঝামেলা। তোয়ার বেশি বুদ্ধিই না ওকে আবার কোনো বড় ঝামেলায় ফেলে দেয়।

বাড়ির সামনের উঠোনে লাল সাদা কাপডের প্যান্ডেল টানানো হচ্ছে। দুপুরের পর থেকেই বাড়িতে আত্মিয় স্বজন আসা শুরু করলো।ঢাকায় যারা ছিলো তারাতো আসলোই। ময়মনসিংহ থেকে তুলির বড় মামাও চলে আসলেন। বড় মামা আসাতে একটা সুবিধা হলো উনি পরিবারে কোনো বিয়ে শাদী হলে বা কেউ মারা গেলে সব দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নেন।
‘যাক বাঁচা গেলো এখন আর কোনো চিন্তা নেই তোর বড় মামা এসে গেছেন দেখবি সব ঠিকঠাক মতো হয়ে যাবে।’
শোন তুলি তোর উপরতলার আন্টি বলে রেখেছেন ঠিক তিনটায় পার্লারে যেতে হবে না হলে দেরী হয়ে যাবে। তুলি মাকে হ্যা না কিছুই বললো না কিন্তু ও ঠিক করেছে ও পার্লারে যাবেনা ঘরেই সাজবে।

দুপুরের দিকে মন্ত্রী সাহেবের বাড়ি থেকে বিয়ের তত্ত্ব এলো।সেই জিনিষ দেখে মিরপুরের ছোটো ফুপু খুব রাগ করে বসে আছেন বাকি আত্মিয় স্বজন রাও খুব অবাক। সবাই কানা ঘুষা করছে এতো বড় লোকের ছেলের বিয়ের তত্ত্ব এমন ফকিরনীর মতো কেনো। তাদের ড্রাইভারকে দিয়ে দায়সারা গোছের একটা শপিং ব্যাগ পাঠিয়ে দিয়েছেন যাতে শুধু বিয়ের শাড়ি আর ওড়না। কোনো কসমেটিকস গয়না ব্যাগ জুতো কিছুই নেই। বিয়ের জিনিষ যে স্যুটকেসে বা ডালাতে দিতে হয় সেটাও মনে হয় ওনারা জানেন না। উপরতলার আন্টি দেখে বললেন মনে হয় বাকি জিনিষ উনারা সাথে করে নিয়ে আসবেন।
ছোটো ফুফু গজর গজর করেই চলেছেন। কাউকে না পেয়ে শেষে বাবাকে যেয়ে বলছেন ভাইজান আপনে সারাটা জীবন শুধু ভাবীর কথাই শুনলেন আমরাযে আপনার কিছু লাগি সেটাতো বিয়ের পর থেকে আপনে ভুলেই গেছেন। ভাবী লোভ করে আমার এতো সুন্দর ভাতিজিটার জীবন নষ্ট করে দিচ্ছে আপনার সে খেয়াল আছে। আপনাদের জামাই বললো সেই মন্ত্রীর চরিত্র নাকি খুবই খারাপ। যার বাপের চরিত্র এতো খারাপ সেই ছেলে আর কি করে ভালো হবে। আপনাদের কতো বললাম আমার ননাসের ছেলে অস্ট্রেলিয়া থাকে কি ভদ্র মার্জিত তার উপর নিজেদের বাড়ির ছেলে। আপনারা রাজী হলেন না আমার ননাস ভাবীকে কতো রিকোয়েস্ট করলো। সেই ঘটনার পর থেকে আমার শশুর বাড়ির মানুষের সাথে আমার সম্পর্ক ও খারাপ হয়ে গেলো।
বাবা চুপ হয়ে শুনছেন আর মাথা ঝাকাচ্ছেন। তার বড় আদরের ছোট বোন নাইমা। নামের মতো জন্মের একদিনের মাথায় ছোট তুলতুলে বিড়াল ছানার মতো মেয়েটাকে রেখে পরপারে চলে গেলেন মা।তখন জামান সাহেবের বয়স পনের বছর ছয় ভাই বোনের মধ্যে উনিই সবার বড়। মার মৃত্যুর পর ওনাদের বাবার অবস্থা পাগল প্রায়। স্ত্রীকে প্রচন্ড ভালবাসতেন উনি। এক হিসাবে জামান সাহেবই নাইমার মা বাবা দুজনের দায়িত্ব পালন করেছেন। নিজে পছন্দ করে বিয়ে ও দিয়েছেন। কিন্তু তুলির মা দেবর ননদদের একদমই পছন্দ করেন না তাই সংসারে অশান্তি করার থেকে উনি নিজেই যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছেন ভাই বোনদের সাথে।

————-
আজ বৃষ্টির যেনো কোনো থামাথামি নেই। তুলিদের ছোট বাসা সবগুলো ঘর মানুষে গিজ গিজ করছে। বাইরে বৃষ্টিতে প্যান্ডেল ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। তুলিদের উঠোনেও এক হাটু কাদা পানি। এর মধ্যেই তুলির বাবা সমানে বারান্দায় পায়চারী করছে আর ঘড়ি দেখছে, বরযাত্রী আসার কথা সন্ধ্যা সাতটায় প্রায় পোনে নয়টা বাজতে চললো।এখোনো কোনো খবর নেই। এই নিয়ে প্রায় দশবার তুলির মা কে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘কি গো ওরা কই।ফোন দিয়েছিলে..?কি বললো..?’

‘জ্বী কথা হয়েছে রাস্তায় জ্যাম যেকোনো সময় চলে আসবে’
মুখে একথা বললেও ভেতরে ভেতরে উনিও চিন্তায় অস্থির, শুভ্রর মা ফোন ধরছে না। উপরতলার মহিলার কাছে উনি আগেই জানতে পারেন শুভ্রর বাবা নাকি একদমই রাজী না এজন্যেই বিয়ের তত্ত্বে তেমন কিছু দেয়নি আর বরযাত্রীও অল্প কয়জন আসবে। সেটা সমস্যা না তুলির মার বিশ্বাস তুলির মতো এমন সুন্দর বুদ্ধমতী মেয়ে ছেলের বউ হিসেবে পেলে ঠিকই উনি মেনে নিবেন।কিন্তু শেষ মুহূর্তে শুভ্রর বাবা যদি বিয়ে ভেঙ্গে দেন তাহলে…
এমনিতেই তুলির চাচা ফুফুরা ওনাকে একদমই পছন্দ করেন না আজ সবাইকে বড় মুখ করে দাওয়াত দিয়ে এনেছেন। মেয়ের এতো বড় ঘরে বিয়ে হচ্ছে বলে এখন যদি বিয়ে ভেঙ্গে যায় সবাইতো একেবারে ছিঃ ছিঃ করবে…

আপা তোমাকেতো মনে হচ্ছে এই মাত্র স্বর্গের দেবতাদের নাচ দেখিয়ে টায়ার্ড হয়ে মর্ত্যে এসেছো জল পান করতে।

কি বলছিস এসব হাবিজাবি কথা

আরে তোমাকে দেখতে একদম অপ্সরাদের মতো লাগছে। অপ্সরারা কি করে..? স্বর্গে দেবতাদের নাচ দেখায় না… সেটাই বললাম।

তোয়ার এই মজার মজার কথা গুলো আজকের পর আর শুনতে পাবেনা ভাবতেই তুলির চোখ ছলছল করে উঠলো।

কাদছো কেনো…

আমি চলে গেলে তোর বুঝি কষ্ট হবে নারে তোয়া

হবেতো তবে আনন্দ ও হবে। খাটটা এখন পুরোটা আমার। আমি চাইলেই মশারি ছাড়া মশার কামড় খেতে খেতে ঘুমাতে পারবো। প্রচন্ড শীতেও আমাকে ফ্যানের বাতাস খেতে হবেনা। তোমার ভাঙ্গা পুরোনো ক্যাসেট প্লেয়ারে ঘ্যানঘ্যানে রবীন্দ্র সংগীতও শুনতে হবেনা।
আমি হিসাব করে দেখেছি আনন্দ থেকে কষ্ট মাইনাস করলে আনন্দই বেশি থাকে।

তুলি তোয়াকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো।

নাইমা ফুপু এসে বললো থাক থাক আর আদিখ্যেতা করে কাঁদা লাগবেনা, তোর বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। বর যাত্রী আসারতো কোনো খবর নেই আর তোদের মার ও ফোন ধরছে না ওরা। বড় ভাবী মুখে কিছু না বললেও আমি ওনার চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছি।

তুলি কাঁদতে কাঁদতেই আবার হেসে ফেললো, যাক বাঁচা গেলো… অবশেষে ওর ট্রিক কাজ করেছে।
শুভ্রই বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে হয়তো…

চলবে…