আনমনে সন্ধ্যায় পর্ব-০১

0
387

#আনমনে_সন্ধ্যায়
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০১

রিমির বাসায় ফিরতে রাত হয়ে গেলো। রাত বলতে বারোটার একটু উপরে। ঢাকার মতো ব্যস্ত শহরে এটা তেমন রাত না। তবে ভদ্র বাড়ি ভদ্র মেয়েদের জন্য অবশ্যই বেশ রাত। তবে যেই পেশায় সে ঢুকেছে। ভদ্র বাড়ির হোক আর অভদ্র বাড়ির হোক। এই পেশার অর্ধেক কাজ কারবারই রাতে। মানে যখন প্রয়োজন পরে আর কি। তার মধ্যে নতুন জয়েন! সবার মন রেখে চলতে হয়। তাই আর রাত, দিনের হিসেব করে আর লাভ কি?

অবশ্য নিজের বাড়ি হলে এতো চিন্তা করতে হতো না। সমস্যা হলো এটা তার খালার বাড়ি। তাও আবার যেন টেন টাইপ খালা না। রিনা খান টাইপ। আর কোন এক বিশেষ কারণে তিনি তাকে দু- চোখের এক চোখেও দেখতে পারেন না।

রিমির জন্মের সময় মা মারা যায়। বাবা খরচের টাকা দিয়ে হাত মুছলেন। তখন তার স্থান হলো নানুর কাছে। তখন অবশ্য খালামণির বিয়ে হয় নি। বিয়ে হয়েছে অনেক পরে। তবুও সে কখনও তাকে ডেকে কাছে টানেনি। বোনের শেষ স্মৃতি হিসেবে মাথায় স্নেহের হাত রাখেনি। এমনকি কখনও ভুলে তার সামনে পড়লে এমন ভাবে তাকিয়েছে। যেন তার বিরাট রাজকাজে সে কুফা লাগিয়ে দিয়েছে।

যাইহোক সেই রিনা খানের বাসায় তার আসার ইচ্ছা কখনও ছিলো না। তবে ঐ যে বলে না। চার আঙ্গুলের কপালে যা আছে, খন্ডাবে কে?

ভার্সিটিতে পড়ার সময় কনস্টেবলের সার্কুলার বেরুলো। তার দু- বান্ধুবি জানালো আবেদন করবে। কি মনে করে তাদের সাথে রিমি নিজেও জুটে গেলো। একেই বলে কপাল। তারা গেলো ভেসে সে গেলো ফেসে।

তখন এই রিনা খান গিট্টু লাগালেন। সারা বেলা চোখ উল্টিয়ে শেষ সময়ে এসে যতো ঢং। পড়ালেখার নাকি বারোটা বেজে যাবে। অবশ্য তার পড়ালেখার সত্যিই বারোটা বেজে গেছে। যাক! সবাই পড়ালেখা শেষ করে যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে এমন কোন কথা আছে? কাউকে না কাউকে পড়ালেখার বারোটা বাজিয়ে এসব তো করতেই হবে। তা না হলে সমাজের ভারসাম্য বাজায় রাখবে কে ?

শুশুর বাড়ি বসে নানুকে সে বোমার মতো হুমকি ধমকি ছুঁড়তে লাগলেন। কিছুতেই তিনি জয়েন করতে দেবেন না।

তার হুমকি ধুমকি গনায় ধরে কে? রিমি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ট্রেনিংয়ে চলে গেলো। গাল ভেঙে চামড়া শুকিয়ে শুটকি হয়ে জানতে পারলো। তার পোষ্টিং পড়েছে এখানে।

খালু বৃহত্তম ঢাকার এক কোনার সাইডের বাসিন্দা। আর তারা রংপুরের। খালা, খালুর বিয়ে পিওর অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। খালুর দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় ছিলো রংপুরে। ঘুরতে গিয়েছিলেন। এক দেখাই কুপোকাত। সে গাঁট ধরে বসলো। এই মেয়েকে ছাড়া সে কাউকে বিয়ে করবে না।

ঢাকার মানুষদের আবার এক সমস্যা। বউ হিসেবে নিজ জেলার মেয়ে ই চাই। তারাও চাইলেন। অবশ্য তাদের চাওয়া খুব একটা কাজে আসলো না। কারণ, দশ জন টেন অন টেন রুপবতীকে এত সাথে দাঁড় করালে, তার খালা দিকে নজর পড়বে সবার আগে।

যাই হোক! বিয়ে শাদির কাথা বাদ।এখন তার কথায় আসা যাক। কথায় আছে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়।

তাই রিমি শুনেই নানুকে সোজা বললো,” সে কোন হোস্টেলে উঠবো। ঢাকায় ওয়ার্কিং উম্যানদের থাকার যায়গার অভাব নেই।

নানু বেগরা বাঁজালেন। সে কিছুতেই একা ছাড়বে না। তার এক কথা সিয়ানা মাইয়া, পুলিশের চাকরি হইছে বইলা কি, পাখা গজাইছে নি? সব বাদ।

রিমি আর দু- চোখে রাস্তা দেখলো না। পুলিশ হয়েছে, অন্যকে সিকিউরিটি দেবে কি? সে তার নিজেরই সিকিউরিটিই পাচ্ছে না। হুহ্! একেই বলে কপাল….

নানু খালামণিকে বললেন। খালামণি শুনে নির্বিকার রইলেন। তার এমন ভাব। গো টু হেল।

তার দোয়া কবুল হলো। তার বাড়ি আমার কাছে জাহান্নামের চেয়েতো কম না। নানু আড়ালে কি ডোজ দিলেন কে জানে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে তিনি রাজি হলেন।

আর রিমিও দাঁতে দাঁত চেপে রওনা দিলো। সে এর আগে কখনও খালামণির বাসায় আসেনি। সম্পর্ক তেমন ভালো না হওয়ায় বড় মামাও বাস থেকে নেমে সিএনজিতে তুলে দিলেন। এই গলি ওই গলি ঘুরে ঘুরে সে দিশেহারা। যাকে জিজ্ঞেস করে, এক গাল হেসে হাত উঁচিয়ে বলে, ” সৈয়দ বাড়ি এই তো সোজা সামনে।

সে সোজা আর শেষ হয় না । ভাগ্যিস সিএনজি চালকের অসীম ধৈর্য্য। তা না হলে কবেই ছুঁড়ে ফেলে উড়ে চলে যেতো।

তার পর অবশেষে যে বাড়ির সামনে এসে রিমি দাঁড়ালো। হা করে বাতাস সহ হজম করতে তার পাক্কা দশ মিনিট লাগলো।

এই বাড়িতে থেকে মাস্টারনির এতো ফুটানি? সেই পুরোনো মডেলের দু- তলা বাড়ি। সামনে লম্বা টানা বারান্দা। দেয়ালে আস্তরের চেয়ে শ্যাওলার পরিমাণ বেশি। সে হলফ করে বলতে পারে একটু ভালোমতো উঁকি ঝুঁকি মারলেই দু- একটা সাপের মাথা ঠিক দেখা যাবে।

সামনে লোহার গেট। বাড়ি পুরোনো হলেও গেট মাশাআল্লাহ চকচকে ফটফটে। সেই চকচকে, ফটফটে গেইটের পেট, মানে পকেট গেট হাঁট করে খোলা। সম্ভবতো এ বাড়ির ও সবাই জানে। চোর টোর আর যাই করুক, এ বাড়ির এিসীমানায় পা মাড়াবে না।

সে আর ডাকাডাকির ঝামেলায় গেলো না। ডাকলে দেখা যাবে সাদা শাড়ি পরে মোমবাতি হাতে কেউ এসে হাজির হয়েছে। কি দরকার? সে সোজা ঢুকে গেলো। বাড়ির মেইন ফটক পর্যন্ত অবশ্য সে পৌঁছাতে পারলো না। মাঝেই ধপাস করে পড়লো।

সে পড়তেই একটা মোটা মতো ছেলে বাড়ির সামনের এক গাছের সাইড থেকে, ডানে বামে না তাকিয়ে বাইরের দিকে দিলো ভৌঁ দৌড় । কার জন্য এই ফাঁদ পেতেছিলো কে জানে। হালাল হলো সে।

এই হালালকারীকে কে রিমি চেনে । ভালো করেই চিনে। চিনবে না কেন? এটা হচ্ছে রিনা খানের একমাএ সন্তান। দেখতে আলা ভোলা মাছুম টাইপ মনে হলেও দুনিয়ায় শয়তানি বুদ্ধি এর মাথায় ঘোরে।

খালামণি যেমন তাকে কখনও কাছে টানে নি। সেও কখনও এই মটকাকে ধারের কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। তার আবার এক নীতি, পেয়ার দো পেয়ার লো। দেবেও না পাবেও না। আর সেটা যে ই হোক।

অবশ্য খালামণি বিয়ের পরে খুব একটা বাপের বাড়ি যাইও নি। না বাবার বাড়ি থেকে কেউ খুব একটা এখানে এসেছে। শুধু নানা বেঁচে থাকতে কিছুদিন পর পর আসতেন। আর যখন ফিরে যেতেন তার মন থাকতো খুব ভার।

সে কুঁকাতে কুঁকাতে ভালো করে ফ্লোরের দিকে তাকালো। তেল ফেলা। সাদা মোজাইক! খেয়াল না করলে বোঝার উপায় নেই। এই বাঁদরামি যে এই মোটা বাঁদরই করেছে। তাতে কোন সন্দেহ নেই। মা রিনা খান, পুলা হইছে ডিপজল।

সে উঠতে চাইলো। তার কোমর শেষ। কুফা মার্কা বাড়ি। নিজের নানীর পেটের আপন মার বোন। তার কাছেই সে কিছু আশা করে না। আর এখানে এই ইট পাথরের স্থুপ। থু! এই দুনিয়ার সব কিছু উপরে রিমির থু।

সে উঠতে উঠতে এক মহিলা হায় হায় করতে করতে দৌড়ে এলো। তখন না জানলেও এখন জানে কে সে। হাসি খালা! তার নামে হাসি থাকলেও তার মুখে হাসির লেশও দেখা যায় না। কথা বললে মনে হয় সবার উপর বিরক্ত। এই বাসার মতো সেও পুরোনো। এই বাসায় ঢুকেছে যে ঢুকেছে। বের হওয়ার আর মনে হয় রাস্তা পাই নাই।

হাসি খালা তাকে টেনে হিঁচড়ে উঠালো ।বাঁকা কোমর নিয়ে রিমি কুঁকুাতে কুঁকাতে খালামণির রুম পর্যন্ত গেলো।

এতো এতো কষ্ট করে আসা রিমির মনে হলো সার্থক। পটের বিবি, পটের বিবিই সেজে বসে আছে। মানুষের বয়স বারে, রুপের ঘাটতি হয়। রিমির খালা, মানে আয়েশা আফরোজ, এর ক্ষেএে হয়েছে উল্টো। দিন যাচ্ছে এর রুপও বাড়ছে। এর সামনে দাঁড়ালে রিমিকেই খালা আর একেই অনায়াসেই ভাগ্নি বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে।

তাকে দেখে পটের বিবি চোখ মুখ কুঁচকে বললো, — লাইফটা নষ্ট করে ফেললে। কতো খাঁটতে হয় জানো। তাও আবার বেতন যদি আহমরি টাইপ হয়। লেখাপড়াটা শেষ করলে, আরো ভালো পোস্টের জন্য এপ্লাই করতে পারতে। কনস্টেবল সিরিয়াসলি?

রিমির অবস্থা খারাপ। কোমর টাটাচ্ছে তাও তেজের সাথে বললো, —– আপনি মনে হয় লেখা পড়া করে জাহাজ, টাহাজ উড়িয়ে ফেলেছেন। কোন গাছ কেটেছেন। সেই তো বাচ্চাদের এ ফর আপেল, বি ফর বেল মাথাই শেখাচ্ছেন। আর এমন ভাব বেতন যেন লাখ টাকা।

আয়েশার রাগে পিত্তি জ্বলে গেলো। ইচ্ছে করলো ঠাস করে গাল ফাটিয়ে দিতে। বাপের মতো ফাজিল এই মেয়ে। সে সেই জ্বলে যাওয়া পিত্তি নিয়ে দাঁত চেপে বললো, —- যা খুশি করো, শুধু আমার চোখের সামনে এসো না। আউট।

রিমির কোমরের ব্যথা না থাকলে সে নেচে নেচে এসে দেখিয়ে দিতো, যে আপনার সামনে যাওয়ার জন্য রিমি মরে যাচ্ছে না ।

সে মরে না গেলেও। তাদের ভাগ্য কেমন যেন জোরা লাগানো। যতো দূরে যায় ঘুরে ফিরে সামনেই এসে পরে।

এই যে আজ সকালে, সে বেরুবে। রুম থেকে বের হতেই দেখলো পটের বিবিও বের হচ্ছে। সে বুঝতে পারে না, তাদের টাইমিং এক হয় কিভাবে? সে ইউ টান নিয়ে রুমে চলে গেলো। কোন দরকার নেই এই রুপবতীর রুপ দেখে দিন খারাপ করার।

অবশ্য ইউ টান নিয়েও বিশেষ লাভ হয়নি। দিন তার বিরিয়ানি খাওয়ার মাঝে মুখে এলাচি পড়ার মতোই গেছে। দৌড়ের উপর। তাই তো আসতে আসতে এতো রাত হয়ে গেলো।

অবশ্য এক দিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। রিনা খানের চেহেরা দেখতে হবে না। সে আবার চলে ঘড়ির তালে তালে। আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজ। বাচ্চাদের পড়াতে পড়াতে তার মাথায় সেট হয়ে গেছে। সেটা থেকে মনে হয় না আর বাকি জীবন আর বের হতে পারবে।

যাগগে, এই রিনা খানের কথা বলতে গেলে আর শেষ নেই। তার মাথা ঘোরাচ্ছে। সে তার ক্লান্ত শরীর টেনে কলিং বেল চাপলো। নতুন মডেলের লক হলে চাবি রাখা যেতো। বাইরে থেকে খুলে অনায়াসেই ভেতরে চলে যাও যেতো। কিন্তু এ বাড়ির দরজা সেই মান্ধাতার আমলের । তাই ডিস্টার্ব হলে, কি আর করার। ঘাড়ে যখন নিয়েছো এবার টানো।

সে আবার কলিং বেল চাপলো। কারো কান পর্যন্ত যাচ্ছে কি না কে জানে। নাকি এখানেই শুয়ে পড়বে। তার অবশ্য সমস্যা নেই। সে এখন যেখানেই কাত হবে সেখানটাই জমপেশ একটা ঘুম হবে।

তখনি মোঘল সাম্রাজ্যের দরজা খোলার শব্দ হলো। যাক কেউ তো শুনেছে। লাইট জ্বালানো হয়নি। ড্রিম লাইটের আলোতে ড্রয়িং রুম আধো আলো, আধো অন্ধকার। সে ওতো খেয়াল করলো না। ঘুম ঘুম চোখে এগিয়ে গেলো।

তার ঘুম ছুটলো কারো দু- আঙ্গুলের তুড়ি বাজানোতে।

সে ফিরে তাকালো। তাকিয়েই ছোট খাটো মিনি সাইজের একটা ঝটকা খেলো। আরে এই বান্দা কে? রিনা খানের বাড়িতে নায়ক সাকিব খান। এসেছে তো সপ্তাহ হয়ে এলো। এ আবার কোথা থেকে উদয় হলো। সে গোলগোল চোখে তাকিয়ে রইলো।

নায়ক সাহেব অবশ্য তার ঝটকা পটকার ধার ধারলো না। সে বিরক্ত মুখে চোখ দিয়ে পেছনে ইশারা করলো।

রিমি ফিরে তাকালো! ঘুম আর ক্লান্তিতে জুতো খুলতে ভুলে গেছে। কাদা ধুলোয় ফ্লোর মাখামাখি। ইশ…

নায়ক সাহেব বিরক্ত মুখে দরজা লক করলেন। যেন আমার মতো মানুষের জন্য দরজা খুলে তার জীবনই বৃথা।

সে তার বৃথা জীবন নিয়ে যেতে যেতে বললেন,— ফ্লোর ক্লিন করে তারপর রুমে যাবে। নিজের তাল নেই, গিয়েছে আবার দেশের তাল ঠিক করতে। যত্তোসব নোংরা কাজকারবার।

রিমি হতম্বভ হয়ে সেখানেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। সে অবশ্য কখনও কারো কাছে ভালো কিছু আশা করে না। তবুও অপ্রত্যাশিত ভাবে আসা এই অপমানে, তার ঘুম, ক্লান্তি সব উবে তো গেছেই। সাথে মাথায় জ্যাম লেগে গেলো।

সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো। এসব কি স্বপ্নে হলো না বাস্তবে। বাই চান্স সে সিঁড়িতেই ঘুমিয়ে পরেনিতো?

চলবে……