আনমনে সন্ধ্যায় পর্ব-০২

0
312

#আনমনে_সন্ধ্যায়
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০২

রিমি ঘুম থেকে উঠে নিচে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করলো। বিশেষ কোন কারণ নেই, এমনিই। সে গত কিছুদিন এই বাসায় থাকলেও, বলতে গেলে না থাকার মতোই। এসে ব্যস্ত ছিলো। নতুন জায়গা, নতুন চাকরি। তাছাড়া এই বাড়ি নিয়ে রাতটুকুতে মাথা গোঁজা ছাড়া তার তেমন কোন আগ্রহও ছিলো না। তাই তেমন মাথাও ঘামাইনি।

এখন অবশ্য একটু ঘামাতে ইচ্ছে করছে। সে এগিয়ে সোফায় বসলো। তার সামনেই নাদু মামা বসা। সে সোফায় পা তুলে আয়েশ করে পরোটা চা’য়ে ডুবিয়ে খাচ্ছে ।

আজব এক চিজ ইয়ার। বিয়ে করে নি। কাজ টাজের ধারের কাছেও নেই। মাথায় গোঁফে কলপ দিয়ে করে রেখেছে কালোজিরার চেয়েও কালো। মুখ ধবধবে ফর্সা। অন্ধকারে দেখলে যে কোন মানুষ বিনা রিয়েকশনে পটল তুলবে। আর এই আজব চিজের একটাই কাজ। অতি আগ্রহে বোনের মাথায় কুবুদ্ধি ঢালা ।

তার বোন হচ্ছে মুহুয়া আন্টি। খালামণির বড় জা। ফর্সা গোলগাল চেহেরার নাদুস নুদুস টাইপ সুখী মহিলা। দু- দিনেই সে রিমিকে যে ভাবে আপন করে নিয়েছে। তার খালামণি এতো বছরেও তা পারেনি।

পুরো সংসারটা এক হাতে সে ই টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্যাচ নামক শব্দ টা যে দুনিয়াতে আছে, সে হয়তো জানেও না। জানে না বলেই দেবরের বউ চাকরি করছে, ফ্যাশন কুইন হয়ে ঘুরছে আর সবার উপরে বসে বসে কলকাঠিও নাড়ছে, এটা সে মেনে নিতে পারতো না। তাই সে নিজের সাথে তাদের সংসারেও ঘানি আরামছে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি খালামণির ছেলে আয়াশকেও বলতে গেলে সে ই কোলে পিঠে করে বড় করছে।

আর এ সবই মিষ্টার নাদু সহ্য করতে পারে না। নাদু মামার ভালো নাম নাহিদ হোসেন। বাবা, মার শেষ বয়সের সন্তান। এখন বাবা, মা নেই। তার সময় কাটে এক ভাই বোনের বাসা থেকে , আরেক ভাই বোনের বাসায় টপকাতে টপকাতে । অবশ্য বলতে গেলে বেশি ভাগ সময় এই বাসায়ই থাকে । আর মহাভারতের শকুনি মামার মতো বোনের মাথায় কুবুদ্ধি ঢালতে থাকে। এতে অবশ্য খুব একটা লাভ হয় না। মুহুয়া আন্টি মাদার তেরেসা টাইপ মহিলা। এই মাদার তেরেসার জীবনে একটাই প্রবলেম, সেটা হলো গুণধর, রুপধর, তেজিধর, বিদ্যাধর দুনিয়াতে আরো যদি কোন ধর থাকে, সেই সব নিয়ে তার একমাএ ছেলে।

মুহুয়া আন্টির এক ছেলে, দুই মেয়ে। মেয়েরা নিসা, নিপা। নিসাকে সে দেখেনি। সে থাকে শুশুর বাড়ি। তবে সে আর নাদু মামা নাকি এক পেট। নাদু মামার কুবুদ্ধির কদর একমাএ নাকি নিসাই করে। আর নিপা। সে তার নিজের সমবয়সী। ভার্সিটিতে পড়ছে। তবে এখনও তেমন ভাবে কথা হয় নি।

আর রইলো কালকের নায়ক সাহেব। সে ই হলো মুহুয়া আন্টির একমাএ বহুবৈশিষ্ট্য ধরওয়ালা আর সৈয়দ বাড়ির বড় পুএ সাব্বির আল মাহমুদ।

সেও খালামণির মতো টিচার। তবে স্কুলের না ভার্সিটির। রিমি এই নায়ক সাহেবকে আগেও দেখেছে। খালুর সাথে নানু বাসায় যেত। সব সময় চোখ মুখ কুঁকচে থাকতো। এখনকার চেহেরার সাথে অবশ্য আগের চেহেরার মিল নেই। আগে লম্বা, চাপা ভাঙা চেংড়া টাইপ ছেলে লাগলো। আর এখন ভরাট চেহেরার টগবগে সুদর্শন যুবক। এই কয়দিন বাসায় ছিলো না। আর মাঝেও অনেকটা সময় গেছে। তখন রিমিও ছোট ছিলো। বিশেষ ভাবে মনেও রাখেনি। তাই চিন্তেও পারেনি।

চিন্তে পারলো সকালো। হাসি খালার মাধ্যমে। হাসি খালা না হাসলেও তাকে খুব সমীহ করছে। সম্ভবতো পুলিশের চাকরি করছি বলে। আর এই সব খবরা খবর তার কাছ থেকেই পাওয়া। কাজের লোক বাসার কাজ করুক আর না করুক। খবরা খবর পাচারের কাজ করে খুব দক্ষতার সাথে। তাই হাসি খালা আর বাদ যাবে কেন। সেও খুব দক্ষতার সাথে তা পালন করছে।

নাদু মামা চা খাওয়ার ফাকে রিমির দিকে তাকালো। সে এখনো সম্ভবতো তাকে বুঝতে পারছে না। তবে খালামণির সাইডের আত্মীয় বলে খুব একটা ভালো নজরেও দেখছে না। দেখছে গোদের উপরে বিষ ফোঁড়ার মতো। তার বোন দেবর, দেবরের বউ, দেবরের ছেলের ঘানি টানছে। এখন আবার দেবরের বউর ভাগ্নির। তার টেনশনের শেষ নেই। মনে মনে নিশ্চয়ই বলছেন,” আহারে তার সাদাসিধে বোনটা। জীবন শেষ হয়ে গেলো পরের বোঝা টানতে টানতে। কতো করে বলছে আলাদা হয়ে যা। তা না, কে শোনে কার কথা।”

রিমি একটু হাসলো। মন ভোলানো টাইপ হাসি। যদি বিষ ফোঁড়ার একটু বিষ কমানো যায় আর কি।

নাদু মামা অবশ্য হাসির ধার ধরলো না। সে গম্ভীর মুখে বললো, — কালকে কখন বাড়ি আসছো?

রিমি স্বভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো — বারোটার দিকে।

— এতো রাত পর্যন্ত কি কাজ?

— এই চাকরিতে তো রাত দিন নেই মামা। যখন ডাক পরে।

— কি দরকার সিয়ানা মেয়েদের এই কাজ করার। ব্যাটারা মরে গেছে নি?

— তা মরেনি। তবে মহিলাদের জন্যও তো মহিলা দরকার।

— তো মহিলাই নেবে। সিয়ানা মেয়েদের নেওয়ার দরকার কি?

রিমি গোলগোল চোখে তাকালো! বলে কিরে , মহিলারা আর মেয়েরা আলাদা জাত নাকি? কি জানি বাবা! জীবনতো সবে মাএ শুরু। আরো কতো কিছু জানবে কে জানে।

তখনি হাসি খালা নাস্তা নিয়ে এলো। রিমি অবাক হলো। সেও কি এখানে নাস্তা খাবে নাকি? এই বাসায় অযথা চেয়ার টেবিল রাখছে কেন? যে যেখানে বসে আছে সেখানেই খাবার ডেলিভারি দিচ্ছে । আজব বাড়ি!

এই আজব বাড়ির খাবার অবশ্য রিমির আরাম করে খাওয়ার সময় হলো না। তার ফোন এসেছে। যেতে হবে। সে পর পর দু- গ্লাস পানি খেলো! খাওয়ার অবশ্য কারণ আছে। সে সকালে ডাইরেক্ট নাস্তা খেতে পারে না। এখন তো আর ডাইরেক্ট, ইনডাইরেক্ট কোন ভাবেই খাওয়ার সময় নেই। তাই পানি দিয়ে আগে কাজ চালালো। চালিয়ে পরোটায় ডিম পোচ মুড়িয়ে মুখে দিতে দিতে উপরে যেতে লাগলো।

সিঁড়ির মাথায় বহু বৈশিষ্টি ধরওয়ালা সাব্বির দ্য হ্যান্ডসাম বয়ের সাথে দেখা। গায়ে ধূসর রঙের টিশার্ট, টাউজার। ঘুম থেকে উঠে এসেছে। তবুও দেখতে একেবারে সকালের টাটকা সবজির মতো সজীব লাগছে। ইশ….. এই পুরো গুষ্টি মুলার বংশধর। আর এখানে রিমি পচে যাওয়া বেগুন। ধুর!

সাব্বির দ্য হ্যান্ডসাম বয়ও তার দিকে একবার তাকালো। তার হেঁটে হেঁটে নাস্তা খাওয়া মনে হয় না খুব একটা পছন্দ হলো। তবে কিছু বললো না। চোখে মুখে বিরক্ত নিয়ে সাইড কেটে চলে গেলো।

যাক তাও ভালো। রিমিতো ভেবেছে এক্ষুণি বলবে, ” খাবার টাবারের লেহাজ নেই, গেছে দেশের সেবা করতে। যত্তোসব হাভাতের দল। ”

বলেই রিমি মনে মনে হাসলো! আহারে বেচারার সকালটাই মনে হয় নষ্ট হয়ে গেলো। হেসে সেও চলে এলো। আসতে আসতে গুন গুন করে গাইলো, — পেহেলে নাজারমে এছা জাদু কারদিয়া, তেরা মন বেঠা হে মেরা জিয়া….

রিমি আশে পাশে দেখতে দেখতে একটু এগুলো। সে একটা বিপদে পড়েছে। যেন টেন টাইপ বিপদ না। বিরাট টাইপ বিপদ। এই বিপদের উপরে আর কোন মা, বাপই নেই।

সে টুক টুক করে এগুলো। দোকান পাট সব বন্ধ। রাস্তা ঘাট একেবারেই নীরব। কিছুক্ষণ আগে এখানে গন্ডগল হয়েছে। ভার্সিটির এলাকা। দু- পক্ষের সংঘর্ষ। এগুলো অবশ্য কিছু না। এসব তো আজ কাল ডালভাত। পড়ালেখার করুক আর না করুক। ভার্সিটিতে উঠবে আর একটু গন্ডগল করবে না, তা হয় নাকি।

যে যতো গন্ডগল করবে তার ভবিষ্যৎ ততো উন্নত। আজকে যারা পিস্তল, দা নিয়ে দৌড়েছে। কালকেই আবার ভদ্র ছেলের মতো গিয়ে ক্লাস করবে। আবার এক সময় এরাই এসব গন্ডগল নিয়ে বিশাল বিশাল লেকচার দিবে। আগামী ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মন প্রাণ জান উজার করে উৎসাহ প্রদান করবে।

আর এই সব উৎসাহ প্রদান কারিদের জন্যই আজ এখানে তাদের ডিউটি পড়েছে। কতোক্ষণ থাকতে হবে কে জানে। এটা অবশ্য কোন সমস্যা না। সমস্যা হলো তার ইয়ে পেয়েছে। ভরে ভরে দু- গ্লাস পানি খাওয়ার ফল। দু- জন বড় অফিসার তাদের সাথে। এখন কি আর এসব বলা যায়। বললেই খাবে ধমক। গুলাগুলি হয়েছে। হতাহত অবশ্য কেউ হয়নি। তবে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

তাই সে আরেকজন মহিলা কনস্টেবলকে বলে একটু সাইডে এসেছে। যদি আশে পাশে পাবলিক টয়লেট টুইলেট পাওয়া যায় আরকি। ধুর! মেয়ে হয়ে দুনিয়ার জ্বালা। ছেলেদেরই ভালো, একটু চিপা চপা পেলেই কাম খালাস।

সে একটু এগুতে এগুতে অন্য সাইডে আসলো। এটা মার্কেটের পেছন সাইড। এক সাইডে ময়লার স্তুপ অন্য সাইডে দুনিয়ার হাবিজাবি রাখা। সে ফিরে যেতে নিলো। তখনি তার চোখ পড়লো কাঙ্খিত এক দরজার উপরে। আহ্! এতো খুশি যে জীবনে কবে হয়েছে তার মনে পড়ছে না। সে এগিয়ে গেলো। দরজায় হাত রাখতেই সে জমে গেলো।

— দরজা খোলার চেষ্টা করবে না। করলে মাথা আর মাথার জায়গায় থাকবে না।

রিমির নতুন জয়েন। এখনো ওতো পাকা হয়নি। সে ভয়ই পেলো। তবে বুঝতে দিলো না। ঢোক গিলে বললো, — এই মার্কেটের সামনেই আমাদের পুলিশ ফোর্স। মেরে পার পাবে?

লোকটা হাসলো। রিমি শুধু বুঝলো! সে অবশ্য চেহেরা দেখতে পারছে না। লোকটা পেছন থেকে তার গলায় ছুরি ধরেছে । লোকটা একটু ঝুকে বললো, —- পার পাই আর না পাই। আপনি তো শেষ।

— আমাকে শেষ করে লাভ কি?

— তা ঠিক। কোন লাভ নেই।

— তো?

— তো মিস……

— রিমি

— সো মিস রিমি। আপনি কি একটু কম্প্রোমাইজ করতে পারবেন?

— কিসের কম্প্রোমাইজ?

— চুপচাপ এখান থেকে সোজা চলে যাবেন। সব স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আমি যে এখানে আছি আপনার বাহিনীকে কিছুই বললেন না।

— আচ্ছা! তো এটা আমি কেন করবো ?

ছেলেটা আবারো হাসলো! হেসে ব্যাঙ্গ করে বললো, — তাইতো, কেন করবেন? তাহলে তো প্রবলেম হয়ে গেলো। কি করা যায় বলুনতো রিমি ?

রিমি কিছু বললো না। ছোট বেলা থেকে কাট কাট কথা বলার অভ্যাসে ভুল হয়ে গেছে। লোকটার কথায় হ্যাঁ বলার দরকার ছিলো। সে কোন গুড মার্কা মেয়ে, যে যা বলে দিবে তাই গিয়ে অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে । আরামছে গিয়ে সবাইকে বলতে পারতো। এজন্যই পুলিশের উপর থেকে দিন দিন মানুষের ভরসা উঠে যাচ্ছে। তারা নিজের দরকারেই ঠিকঠাক মতো কাজ করতে পারে না। পরের বেলায় করবেটা কি?

লোকটা কি বুঝলো কে জানে, হেসে ফেললো! রিমি দাঁতে দাঁত চাপলো। সে তো এটাই বুঝতে পারছে না। পাবলিক টয়লেট! সে যাবে এর সমস্যা কি? নাকি গন্ডগলের কেউ। এখানে লুকিয়ে ছিলো। পুলিশের ড্রেস দেখে ভেবেছে ধরতে এসেছি। আরে বাবা ধরতে আসলে ডাইরেক্ট টয়লেটে যাবো কেন? আর গেলে যাই। তুই লুকিয়ে থাক। জায়গার তো অভাব নেই। নিজে থেকে এসে গলায় ছুরি ধরতে হবে কেন?

লোকটা হেসে হাত বাড়িয়ে বললো, —- আপনার মোবাইলটা দিনতো তো রিমি।

— কেন?

লোকটা এবার আর উত্তর দিলো না। তবে গলায় ধরে রাখা ছুরিটা আরেকটু চেপে ধরলো।

রিমি কেঁপে উঠলো। চামড়ায় লাগছে। সে আর এক সেকেন্ড ব্যয় করলো না। বিনা বাক্যে পকেট থেকে মোবাইল বের করে দিলো। সে তো আর আইফোন চালায় না। যে গলার চেয়ে মোবাইলের দাম বেশি হয়ে যাবে ।

লোকটা মোবাইল হাতে নিয়ে সুইচ অফ করলো। করে ময়লার স্তুপে ছুঁড়ে মারলো। তারপর ফট করে বাথরুমের দরজা খুলে রিমিকে ধাক্কা দিলো। দিয়েই দরজা বন্ধ করতে করতে বললো, — হ্যাভ এ নাইস ডে মিস রিমি।

রিমি বাথরুমের ভিতরে এসে আঁতকে উঠলো। একটা ছেলে বাথরুমের উপর উপুর হয়ে পড়ে আছে। পুরো ফ্লোর রক্তে ভাসা। সে নড়তে চড়তে ভুলে গেলো । স্তব্ধ হয়ে শুধু তাকিয়ে রইলো।

চলবে…….