আনমনে সন্ধ্যায় পর্ব-০৩

0
231

#আনমনে_সন্ধ্যায়
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৩

রিমির আজও ফিরলো রাতে। অবশ্য বারোটার উপরে যায়নি। এই এগোরোটার একটু উপরে হতে পারে। মোবাইল নেই তাই শিওর ভাবে বলা যাচ্ছে না।
মোবাইল পড়েছে ময়লার স্তুপে, পানির মধ্যে । এখন চালু হওয়ার নাম নেই । রুমেল ভাই বললো ঠিক করে দেবে। রুমেল ভাই তার মতোই কনস্টেবল। সে তো আর এখনো এতো কিছু চিনে না। তাই বললো সে ঠিক করে দেবে। রিমি আর অমত করেনি। কি হবে করে? সেধে উপকার করছে, করুক।

সে দরজার সামনে এসে কলিং বেল চাপলো। এই বাড়ির কলিং বেল চাপতে গেলেই তার এক রাজ্যের বিরক্তি। কেন রে ভাই মানছি বাড়ি পুরোনো, দরজা পুরোনো লকটা নতুন লাগালে কি হয়। ভাব তো আর কেউ কম নিচ্ছে না। বাড়ির বেলায় এতো অনাদর কেন?

সে বিরক্ত নিয়েই আরেকবার চাপলো। চেপে চোখ বন্ধ করলো। ছেলেটার চেহেরা এখনো চোখে ভাসছে।

সে বলতে গেলে ঘন্টা খানেকের মতো ওই বাথরুমে ছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই দোকান পাট খুলেছে। গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। পনেরো বিশ জনের টিম ছিলো। কেউ ওভাবে খেয়াল করেনি। সবাই ভেবেছে আশে পাশেই আছি। পরে গিয়ে খেয়াল করেছে সে নেই। মোবাইলও বন্ধ। যেই কনস্টেবল কে বলে এসেছিলো তার কথা মতো খুঁজতে খুঁজতে ওখানে গেছে। তাদের শব্দ পেয়েই সে দরজায় শব্দ করতেই তারা দৌড়ে এসেছে।

কি যে একটা অবস্থা। তারা তো দরজা খুলেই হতম্বভ। সে সব বলতেই সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো। কিন্তু ততোক্ষণে আর কি করবে। চলমান রাস্তা, এক ঘন্টায় সব স্বাভাবিক। কোন ফাকে চলে গেছে কে জানে।

ওসি স্যার নিজে আমাকে ডাকলেন। সব বিস্তারিত শুনলেন। আমি চেহেরা দেখেনি। তবে ছেলেটার গায়ে সাদা শার্ট ছিলো। যখন বাথরুমে ধাক্কা মারে এক ফাকে সে রকমই কিছু দেখেছিলো। আর সবচেয়ে বড় কথা লোকটা স্টুডেন্টের মধ্যে কেউ ছিলো না। গন্ডগলের ঘটনার সাথে এটা মিলেছে কাকতালীয় ভাবে। সেই লোকটা আর মারা যাওয়া লোক দুজনের একজনকেও ভার্সিটির পড়ুয়া টাইপ ছেলে মনে হয় নি। বয়স আরো বেশি হবে।

যাই হোক ! সে যা দেখেছে, বুঝেছে সব বলেছে। এখন বড় বড় স্যারদের কাজ। তাই আজ সারা দিন গেলো এসব নিয়েই। ভার্সিটিতেও খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। কালকে কি হবে কে জানে। আশে পাশের দোকানে সি সি ক্যামেরা আছে কিনা খোঁজ খবর চলছে। ওই ব্যাটার জন্য সারা দিন আবার বসে বসে সি সি ফুটেজও দেখতে হয় কিনা কে জানে।

— এখানেই ঘুমানোর ইচ্ছা তো কলিং বেল দিয়েছো কেন?

রিমি চমকে চোখ খুললো। দরজা কখন খুলেছে সে খেয়াল করেনি। সে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। প্রতিদিন এই বান্দার মুখ দেখে কি ঘুমোতে যেতে হবে নাকি?

সে আর কথা বাড়ালো না। নিচু হয়ে জুতা খুললো। তা না হলে কালকের মতো আজকেও এতো রাতে ফ্লোর ঘষামাজা করতে হবে। তার মনে ইচ্ছা আর শরীরে শক্তি এখন কোনটাই নেই।

সাব্বির ততোক্ষণে সোফায় গিয়ে বসেছে। আজকে অবশ্য বাতি জ্বালানো। একগাদা কাগজ টাগজ নিয়ে সে সোফায় বসেছে।

রিমি দরজা লক করলো। যেতে নিবে সাব্বির তখন শান্ত ভাবে বললো, —- টেবিলে খাবার রাখা। চাচি খেয়ে ঘুমাতে বলেছে। আর না খেলে ফ্রিজে তুলে রাখো। কালকে খাবার নষ্ট হয়েছে।

রিমির মেজাজ খারাপ হলো। মানছে সে তার বয়সে ছোট। কিন্তু অচেনা তো। তুমি, তুমি বলতে হবে কেন? সবাই কে স্টুডেন্ট মনে হয় নাকি? সব সময় শুধু অর্ডার। নাকি তাদের বাসায় আছি বলে গনায় ধরছে না।

রিমি মনের গরম মনে মনেই দমালো। মুখে একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না। তার ভালো লাগছে না। তবে ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। সকাল থেকে না খাওয়া। কিছু যে খাবে সে সময়ই পাইনি। সে রুমে গেলো, ফ্রেশ হয়ে আবার আসলো। নিপার রুম বাদে সব রুমের আলো নেভানো। এতো তাড়াতাড়ি মানুষ ঘুমায় কিভাবে?

সে খাবার নিলো। তবে খেতে পারলো না। রক্ত চোখে ভাসছে। বাথরুমের কথা মনে হতেই তার পেট গুলিয়ে উঠলো। নাড়িভুঁড়ি উলটে আসলো। প্রায় এক ঘন্টা একটা লাশের সাথে থাকা সহজ কথা না।

সে হাত দিয়ে মুখ চেপে দৌড়ে বেসিনের সামনে গেলো। গরগর করে বমি করে ভাসিয়ে দিলো।

চোখে মুখে অন্ধকার নিয়ে তার শরীর ছেড়ে দিলো। সাব্বির কুনোই ধরে টেনে সোজা করালো। চোখ মুখ কুঁকচে ধমকে বললো, —- নোংরা মেয়ে, এখনি তো পড়ে মাথা ফাটাতে। আর এখানে বমি করেছো কেন? দৌড় যখন দিয়েছোই বাথরুমের দিকেই তো যেতে পারতে। খাবার টেবিল এখানে। এই বেসিন কি বমি করার জন্য?

রিমি বিরক্ত হলো। তার দম বেরিয়ে যাচ্ছে। এ আছে বেসিন নিয়ে। তবে এবারো কিছু বললো না। বলার মতো অবস্থা অবশ্য তার নেই ও। সারাদিনের ক্লান্তি, না খাওয়া শরীর। বমি করে সে নিস্তেজ। তার শরীর কাঁপছে।

সে দু- হাত দিয়ে সাব্বিরের বুকের গেঞ্জি খামচে ধরলো। মনে মনে বললো, — নে ব্যাটা পরিষ্কারগির। এখন কি করবি কর। এসেছি পর থেকে তোর ঢং দেখছি। নে এখন যতো খুশি ঢং কর।

সাব্বির এক মূহুর্তের জন্য থমকালো। বমি মাখা হাতের জন্য, না বুকে হাত রাখার জন্য বুঝা গেলো না। তবে সাথে সাথেই নিজেকে সামলে দাঁতে দাঁত চেপে বললো —- এই টির্শাট তুমি পরিষ্কার করবে। পরিষ্কার করে আয়রন করে আমার রুমে সেফলি পৌঁছে দেবে। বলেই রিমিকে চেয়ার টেনে ঠাস করে বসালো। বসিয়ে ফট করে টিশার্ট খুলে রিমির হাতে ধরিয়ে দিলো।

রিমি হতম্বভ! সে ভেবেছিলো এ বাসায় থাকছে বলে তাকে গনায় ধরছে না। এখন তো মনে হচ্ছে এ তাকে মেয়ে হিসেবেই গনায় ধরছে না। ছোট বেলা দেখেছে তাই বলে এখনো ছোট’ই মনে করছে নাকি? দেখতো কি একটা অবস্থা। এদিকে সে ঝটকা পটকা খেয়ে বসে আছে।

সেই ঝটকায় পটকায় রেশ ধরেই সে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো। তার নিস্তেজ, কাঁপাকাঁপি সব সাথে সাথেই থেমে গেলো। সে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলো।

সুদর্শন এক যুবক। পেটানো মেদহীন ফর্সা শরীর। সেই চোখ ধাঁধানো শরীর নিয়ে সে সব কিছু গুছালো। খাবার ফ্রিজে রাখলো। তাকে পুরো অদৃশ্য করো লেবু চিপে সরবত বানালো। এক গ্লাস ঠাস করে তার সামনে রেখে, কাগজ পএ গুছিয়ে আরেক গ্লাস হাতে নিয়ে নির্বিকার ভাবে উপরে চলে গেলো।

আর রিমি সেখানে সেই ভাবেই বসে রইলো। তার চোখে আর এখন রক্ত ভাসছে না। ভাসছে গোল গোল দুটো গোলাপজামন। ইশ….

— এখন কি অবস্থা? রাতে নাকি বমি টমি করে ঘর ভাসিয়ে ফেলেছো?

রিমি চোখ তুলে তাকালো। দরজায় ধরে তার খালামণি দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে সবুজ রঙের সুতির শাড়ি। এই রঙেও কাউকে এতো সুন্দর লাগতে পারে সে জানতো না।
সে আবার চোখ বইয়ের মধ্যে নিলো। আজকে সে একটু দেরিতে যাবে। তাই আর রুম থেকে বের হয়নি।

সে স্বাভাবিক ভাবেই বললো, — ভালো।

— আগেই বলেছিলাম। প্রচুর খাঁটতে হয়। কথা তো শুনলে না।

রিমি উত্তর দিলো না। তার মুখ আর উনার মেজাজ এই দুইটার ভরসা নেই। যে কোন সময় ব্লাস্ট হয়। তাই যতো কম কথা বলা যায় ততোই ভালো।

— সাব্বিরদের ভার্সিটিতে নাকি গন্ডগল হয়েছে? লাশও নাকি পাওয়া গেছে। এক কনস্টেবলকে নাকি লাশের সাথেই আটকে রেখেছিলো। রেজাউল বললো। আমাদের শোরুমটাও কিন্তু পাশেই।

রিমি চোখ তুলে তাকালো। খালু নামের ব্যক্তির সাথে তার এখনও তেমন ভাবে কথা হয়নি। টাইম টেবিল মিলছে না। মার্কেটে তাদের টাইলসের শোরুম আছে । তারা দুই ভাই, ওবাদুল আর রেজাউল। দু- ভাই ই এই ব্যবসায় জড়িত। তারাও থাকে ব্যস্ত। আর রিমি তো মহা ব্যস্ত।

তাই এসেছে পরে একবার শুধু দেখেছে। হালকা পাতলা হাই, হ্যালো টাইপ কথাবার্তা হয়েছে। তবে ছোট বেলা এই লোকটা তাদের বাসায় গেলে কেন জানি তাকে খুব স্নেহ করতো। ডেকে পাশে বসাতো। দোকানে নিয়ে এটা সেটা কিনে দিতো।

— সাব্বির ভাই এই ভার্সিটির টিচার নাকি?

— হ্যাঁ! সে তো নাকি তোমাকে সেখানে দেখেছে। মুরগীর মতো নাকি ছটফট করছিলে। হয়েছিলো কি?

রিমি দাঁতে দাঁত চেপে রাগ দমানোর চেষ্টা করলো। একঘন্টা লাশের সাথে থাক তখন বুঝবি কেমন লাগে। দিন ভরে আশে পাশে কচি কচি খুকিদের নিয়ে বসে থাকিস। আমার কষ্ট তো মুরগির ছটপটানি ই মনে হবে। ব্যাটা পরিষ্কারগির। তোকে আমি দেখছি। বাসায় এসে কথা লাগাস কুইটন্যা কোথাকার।

— এখনো সময় আছে। এসব ছাড়ো। ছেড়ে লেখাপড়াটা কমপ্লিট করো।

রিমি অতি ভদ্র ভাবে বললো — আপনার আর কিছু বলার আছে?

— কেন?

— না থাকলে এবার আসুন, প্লিজ । আমি যেমন আপনার সামনে যেয়ে বিরক্ত করছি না। আপনিও যদি তেমনটা করেন আমার খুব উপকার হয়।

আয়েশা রাগে ফুসলো। বললো, — এটা আমার বাড়ি। আমি কোথায় যাবো না যাবো সেটা তুমি বলবে না। আর খবরদার আমার সাথে যদি এভাবে কথা বলেছো।

রিমি ঠাস করে বই বন্ধ করলো। করে উঠে দাঁড়ালো! আয়েশা কে সাইড কেটে বাইরে যেতে যেতে বললো, —- আচ্ছা মহারাণী আপনার বাড়িতে আপনিই থাকেন। আর কথা, সেটার গ্যারান্টি দিতে পারছি না। সেটা মানুষ বুঝে বের হয়, বলেই সে বেড়িয়ে এলো।

আয়েশা তার যাওয়া দেখলো। তবে সে গেলো না। রুমের ভেতরে আসলো। এই মেয়ে গোছগাছে আশে পাশেও নেই। পুরো রুম এলোমেলো। এসেছে এক সপ্তাহের উপরে অথচো ব্যাগ থেকে এখনো কাপড় টাপড়ও সব বের করেনি। মানুষ হবে কবে এই মেয়ে।

রিমি ছাদে চলে এলো। এই সকালে এই বাড়ি থাকে গমগম। সবাই নাস্তা টাস্তা করে যে যার কাজে বেড়িয়ে যায়। তাই সে আর নিচে গেলো না। একমাত্র ছাদই এখন শান্তির জায়গা।

বিশাল ছাদ। চারিদিকে উঁচু দেয়াল টানা। শ্যাওলায় ছাদ কালো হয়ে আছে। এই বাড়িটা নাকি করেছিলেন খালামণির দাদা শুশুর। তার নাকি ছিলো সুদের ব্যবসা। টাকা কমিয়েছেন দু- হাত ভরে। তাই বাড়িটাও করেছিলেন মনের মতো। তখন মনের মতো হলেও এখন এটা ভূতের বাড়ি বলে অনায়াসেই চালিয়ে দেওয়া যায়। তবে ইচ্ছে করলেই এরা ভেঙে নতুন করে করতে পারে। দেখে তো তাই মনে হয়। সবাই ভাব টাপ নিয়ে উড়ছে।

তবে কিছু কিছু জিনিস ভাবের উপরে হয়। সেটা হলো মায়া। মানুষ সব ছাড়তে পারে তবে মায়া জিনিসটা না। ছোট একটা শব্দ তবে এর যে কি ক্ষমতা। যেই মায়ায় পড়ে সে ই বুঝে। এই বাড়িটাও এই বাড়ির মানুষের হয়তো মায়ায় জড়ানো। তাই ভাঙার মতো ডিসিশানটা এখনও নিতে পারছে না।

তখনি বাড়ির দরজা খোলার শব্দ হলো। রিমি এগিয়ে উঁকি দিলো। সাব্বির বের হচ্ছে। গায়ে তার ফর্মাল সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট।

রিমি হাসলো ! শয়তানি হাসি। হেসে দেয়াল খামচে শ্যাওলা বের করলো। এখনো ভালো ভাবে শীত পড়েনি । তবে সকালের দিকে হালকা কুয়াশা পড়ে। সেই কুয়াশায় শ্যাওলা ভিজে চিপচিপে। সেই চিপচিপে শ্যাওলা মুঠো করে ছুঁড়ে মারলো। মেরেই টুপ করে বসে পড়লো।
মনে মনে বললো “নে ব্যাটা পরিষ্কারগির, আমি একা একা মুরগীর মতো ছটফটাবো কেন? এবার আপনিও একটু ছটফটান।

চলবে……