আনমনে সন্ধ্যায় পর্ব-০৪

0
179

#আনমনে_সন্ধ্যায়
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৪

গালে ঠাস করে থাপ্পড় পড়তেই আয়াশ ঠোঁট ফোলালো। থাপ্পড় তার জন্য নতুন না । তবে বিনা দোষে খাওয়া নতুন। সে তো ভেবেই পাচ্ছে না। তাকে ফাঁসালো কে। তাও আবার ভাইয়াকে টোপ বানিয়ে। আর মানুষ পায়নি। সে যতোই আকাম, কুকাম করুক। ভাইয়ার থেকে দশ হাত দূরে।

এই বান্দা আবার সব কিছুতে সিরিয়াস, খুঁতখুঁতে। ঊনিশ বিশ হলেই থাপ্পড় । থাপ্পড়ে যদি কোন পি এইচডি থাকতো তা হলে এতোদিনে এই বান্দার কমপ্লিট হয়ে এফোড় ওফোড় হয়ে যেতো। আর এসব জেনে সে নাকি যাবে তার সাথে দুষ্টুমি করতে। মানুষ তার জন্য অভাব পড়েছে। তাও আবার এসব ময়লা টয়লা নিয়ে। যা ভাইয়া সহ্য ই করতে পারে না।

সে ঠোঁট ফুলিয়েই বললো,— আমি আবারো বলছি ভাইয়া, আমি করিনি। আমিতো বাথরুমে ছিলাম। তোমার হুঙ্কার শুনে মাত্রই বের হলাম।

সাব্বির কথা বললো না। সে চোখে মুখে আগুন নিয়ে ফুসফুস করছে। তার সাদা শার্ট পুরো শ্যাওলায় মাখামাখি। ভার্সিটিতে যাবে। তার ক্লাস ছিলো। সেটাও মিস। তার ইচ্ছা করলো আরেকটা বসাতে।

আয়েশাও ঘড়ি দেখলো। তারও দেরি হচ্ছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, —- তোমাকে আমি পরে দেখছি। দিন দিন দুষ্টুমির মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছো।

আয়াশ আবারো বললো — আমি করিনি আম্মু।

— এই বাসায় এই রকম অকাজ একমাত্র তুমিই করো।

সাথে সাথেই হাসি মুখ খুললো —- একদম হাছা কথা ছোট ভাবি । আমাগো কথাতো বাদই দিলাম। হেই দিন দেখলেন না। রিমি আম্মার কি অবস্থা? বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই কোমরডা একেবারে শ্যাষ। আহারে দু- দিন পর্যন্ত সোজা হইবার ই পারে নাই। প্রথম দিন ই তো থানায় গেলো কুঁকাইতে কুঁকাইতে ।

আয়াশ চোখ গরম করে তাকালো। যার অর্থ হাসি তোকে আমি দেখে নেবো। সেই দিন তো সে এর জন্যই তেলটা ফেলেছিলো। কে জানতো তখনই রিমি আপু আসবে। অবশ্য সে মজা কম পায়নি। মানুষ বদলেছে প্ল্যানতো ঠিকিই কাজ করেছে তাইনা।

হাসি অবশ্য এই গরমে কিছু এলো গেলো না। সে মুখ বাঁকালো। সে বড় ভাই, ছোট ভাইয়ের গরমেরই ধার ধারে না। আবার আইছে এই পুইচক্যা পুলাপাইন।

মহুয়া আয়াশকে টেনে নিজের কাছে আনলো। বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে বলালো। বুলিয়ে বিরক্ত নিয়ে সাব্বিরের দিকে তাকিয়ে বললো, —- ছোটমানুষ এখন একটু দুষ্টুমি করবে নাতো কবে করবে? তার জন্য সাত সকালে ছেলেটাকে তুই এভাবে মারবি?

নিপা নাস্তা খাচ্ছিলো। সে খাওয়ার ফাকেই বললো, — এই বাঁদরকে লাই দিয়ে তুমিই মাথায় তুলছো মা। সেদিন কি করেছে ? আমার ফাউন্ডেশনে ময়দা মিক্স করে রেখেছে। মুখে দিয়েছি, কি একটা অবস্থা। সেটা তুমি জানো?

— আমার জানতে হবে না। নিজেরা কতো ভালো ছিলে আমার চেয়ে আর কে জানে। আর একেকজন তো বুইড়া হতে চললো, তাও হাড় হাড্ডি এখনও জ্বালিয়ে মারছে। বলেই চোক পাঁকিয়ে সাব্বিরের দিকে তাকালো।

সাব্বির আর কিছু বললো না। চলে এলো। এদের সাথে কথা বলাই বৃথা। তার ফ্রেশ হতে হবে। অবশ্য পরের ক্লাস এগারোটায়। এখন আর ওতো তাড়া নেই, তবে মিস কোন ভাবেই দেওয়া যাবে না।

সে দু- তলায় উঠতেই রিমির সাথে দেখা হলো। সে সিঁড়ির গোড়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নিচের তামাশা দেখছে। সকাল সকাল এতো বিনোদন মনে হয় সে খুব ই ইনজয় করছে।

সাব্বির ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রিমি অবশ্য তাকালো না। সে সাব্বির কে দেখেই নি এমন ভাবে নিচে নেমে গেলো। এক ঢিলে দু- পাখি মেরেছে সে। কম তো না। আহারে তার গুলুমুলু ভাই টা। গালটা একেবারে লাল হয়ে গেছে । যাক তার কোমর আর এর গাল একেবারে হিসাব বরাবর।

রিমি নাস্তার শেষে টুল নিয়ে কিচেনের দরজায় বসলো। এখন বলতে গেলে বাসা খালি । সবাই বেড়িয়ে গেছে। শুধু নাদু মামাকে দেখলো এই বাড়ির এক চিলতে উঠানে মাদুর পেতেছে। সেখানে সে নিজেকে শীতের রোদে উলটে পাল্টে ভাজচ্ছে।

সে নিজেও অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই বেড়িয়ে যাবে। তবে ভাবলো কাজে যাওয়ার আগে একটু আড্ডা দেওয়া যাক। আর এই বাসায় আড্ডা দেওয়ার বেষ্ট অপশন হলো মুহুয়া আন্টি আর হাসি খালা। তারা দুপুরের রান্না আয়োজনে লেগে গেছে।

সে বসতেই মুহুয়া হাসলো!মেয়েটা জন্য তার এতো মায়া হয়। সবাই থেকেও যেন কেমন নেই। একেই বলে কপাল! সে হেসেই বললো —- চা দেবো রিমি?

— থাকলে দিন। নাস্তার সাথে অবশ্য খেয়েছি একবার।

— চা খুব পছন্দ নাকি?

— ঠিক পছন্দ না । তবে খাই।

মুহুয়া চা গরম করে এগিয়ে দিলো। দিয়ে বললো, — কি জানি বাপু ? তোমার দুটো খালুই চা বলতে অজ্ঞান। কি এমন মজা কে জানে। আমার কাছে তো পানির মতো লাগে।

পানি দিয়া বানাইলেতো পানির মতোই লাগবো। ঘন কইরা দুধ জ্বাল দিয়া বানাই দেইক্ষেন। মুখ থাইকা স্বাদই সরবো না। হাসি আলু কাটতে কাটতে নির্বিকার ভাবে বললো।

— হুম তুইতো আবার চায়ের বিশারদ ।

হাসি মুখ বাঁকালো। রিমি হাসলো, হেসে চায়ে চুমুক দিলো। সে চা খাওয়া শিখেছে নানার কাছ থেকে। তার চা খুব পছন্দ ছিলো।

— তোমার হাইট কতো রিমি? আজকাল লম্বা মেয়ে তো দেখাই যায় না। চার সারে চারে এসেই শেষ। তুমি তো মাশাআল্লাহ।

রিমি কিছু বলবে কি তার আগে হাসিই ভ্রু নাচিয়ে বললো, — কেন, আপনের আবার হিংসে হচ্ছে নি? লম্বা লম্বা আফসোস করতে করতে তো আপনার জীবন শ্যাষ।

রিমি মুহুয়ার আন্টির দিকে তাকালো। তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসলো।

মুহুয়াও হাসলো! হেসে বললো — হ্যাঁ তা হচ্ছে! হবেই না কেন বলতো রিমি ? এই বাড়ির ছেলেদের দেখেছো? একটা বউও যদি তাদের কাঁধ সমান আসে। ভাগ্যিস ছেলে মেয়ে গুলো আমাদের মতো হয় নি। কতো কিছু যে করলাম এই একটু লম্বা হওয়ার জন্য। আর ভাগ্য দেখো দিন দিন ফুলে গোল হচ্ছি।
একবার টিভিতে এক এ্যাড দেখলাম। জুতার! বুঝেছো ? পরে দৌড়ালেই নাকি হাইট বাড়ে। তোমার খালুকে ধরে বেঁধে জুতা অর্ডার করলাম।

তারপর আর কি। জান প্রাণ ছেড়ে শুরু করলাম দৌড়দৌড়ি। শুধু কি দৌড়াদৌড়ি পায়ে থেকে খুলতামই না। দিন নেই, রাত নেই পরেই হাঁটাহাঁটি। কি সের কি? লম্বাতো এক ইঞ্জিও হলাম না। গায়ে থেকে মাংস কমে গেলো কয়েক কেজি। এমনিতেই খাঁটো তার মধ্যে হয়ে গেলাম শুকনা। চিন্তা করো তোমার ওমন লম্বা, চওড়া খালুর পাশে কেমন দেখায়?

রিমি হেসে ফেললো! খিলখিলানো হাসি। হেসে বললো, — একদম অমিতাভ আর জয়া বচ্চন।

হাসি খালা আবারো মুখ বাঁকালো। কথায় কথায় তার মুখ বাঁকানো মুদ্রাদোষ। তবে মুহুয়ার মুখ হাসি হাসি। সেই হাসি হাসি মুখ নিয়েই বললো, — ছায়ের মতো। হাই হিল পরতে পরতে জীবন শেষ।

— নিজের শখ ছেলের বউ দিয়ে পূরণ করবেন। দেখে শুনে লম্বা, চওড়া একটা বউ আনবেন।

মুহুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, — আর বউ! আমিতো ভাই সোজা ভাবে বলে দিয়েছি। তোমার বিয়েতে বাপু আমি টামি নেই। বিয়ে করার ইচ্ছা হলে নিজে গিয়ে করো ।

রিমি অবাক হলো। তবে তার মুখ হাসি হাসি। হাসি নিয়েই বললো, — ওমা কেন?

— আরে মা -সকল কি যে আপদ পেটে ধরেছি। তা তো তুমি জানো না। জীবন আমার তেজপাতা। সব কিছুতে খুটাখুটি। এটা এমন কেন? ওটা ওভাবে কেন? ওর জ্বালায় আমি ঘরে চুলই খুলি না। মাথা আঁচড়াই ছাদে গিয়ে। বাড়ির আর কারো খাবারে কিছু পাবে না। সে হাত দিলেই চুল, এটা, সেটা। আল্লাহ চোখ তো দেয় নাই। দিছে অনুবীক্ষণ যন্ত্র। সে যন্ত্রের যন্ত্রনার শুধু আমি না। বাড়ির সবাই অতিষ্ঠ। এতো যন্ত্রনা কি পরের মেয়ে সহ্য করবে?

বিয়ের পরের দিনই মেয়ে ডির্ভোসের জন্য লাফাবে। আর আজকালকের যে মেয়ে ঊনিশ, বিশ হলেই কেস খাইয়ে দেয়। তাই আমি ভাই আগেই হাত ধুয়ে ফেলেছি। অনন্ত এটা বলে রেহাই পাবো। যে নিজের ইচ্ছায় এসেছো। যা খুশি করো।

রিমি অনেক কষ্টে হাসি থামালো। সে ভেবেছে তাকে দেখেই হয়তো এমন করছে। এখন তো দেখি অন্য কাহিনী।

রিমি আর বসলো না। উঠে দাঁড়ালো। তাকে যেতে হবে। সে উঠতে উঠতে বললো, —- নিশ্চিন্তে বিয়ে করিয়ে দিন আন্টি। বউর প্যারায় দেখবেন সব ঢং জানলা দিয়ে পালিয়েছে। তখন খাবারে চুল কেন অন্য কিছুও পেলে সোনা মুখ করে খেয়ে চুপচাপ উঠে যাবে। বউর সামনে বনের রাজা সিংহও পালের ভেড়া।

মহুয়া হাসলো! না হাসা হাসির মুখেও এবার হাসির রেখা দেখা গেলো। সে রেখা নিয়েই সে বললো, — সহমত! কতো দেখলাম এলে বেলে ঘোড়ার ডিম। বিয়ের পরেই ফুট্টস।

রিমি আর দাঁড়ারো না। তাকে এবার সত্যিই যেতে হবে। সে বাইরে আসলো, এসেই চমকালো। চারশ চল্লিশ ভোল্টের ঝটকা খেলেও এতোটা চমকাতো না। যতোটা এখন হলো। সাব্বির দাঁড়িয়ে আছে। তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকেই তাকিয়ে । আল্লাহগো! সব শুনেছে নাকি। সে তো ভেবেছিলো এ চলে গেছে।

সে ঢোক গিললো! গিলে নাদান বাচ্চার মতো সাইড কেটে চলে এলো। আসতে গিয়ে আড়চোখে তাকালো।
ড্রেস চেইঞ্জ। সাদার জায়গায় এখন ডার্ক ব্লু শার্ট। পেটানো শরীরে আট সাট ভাবে লেগে আছে। উপরের দু- বোতাম খোলা। ফর্সা বুক উঁকিঝুঁকি মারছে।

ইশ! আগুন… সাথে সাথেই রিমি নিজেকে নিজে মনে মনে শাসালো। ছিঃ ছিঃ! সে তো জানতোই না। তার নজর এতো খারাপ। কিভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বদ নজরে দেখছে। আল্লাহগো রক্ষা করো। এই পাপী বান্দাকে এই পাপ থেকে রক্ষা করো।

আর এই দিকে এই বান্দা, নিজেকে কি সে সুন্দর লাগবে ঠিক জানে। জানবেই না কেন? ভার্সিটির টিচার বলে কথা। এরা কিছু পারুক আর না পারুক, মেয়েদের মাথা নষ্ট করতে ঠিক পারে। সে নিজেও এক স্যারের জন্য পাগল ছিলো। হায় কোথায় গেলো সেই দিন ।

চলবে……..