#আনমনে_সন্ধ্যায়
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১৪
রিমি বোতল থেকে চোখে মুখে পানি দিলো। বরফ শীতল পানি চোখে মুখে লাগতেই, তার শরীর শিরশিরিয়ে উঠলো। সে বোতল ফেলে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে টিস্যু বের করলো। ইশ এই শীত, এই মরার শীত যে কবে যাবে কে জানে। শীত তার সহ্যই হয় না, একদম না।
সে ঝটপট টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে মিথিলা ম্যামের দিকে তাঁকালো। সে এক ঠোঙ্গা বাদাম কিনেছে। সেই বাদাম দেয়ালে হেলান দিয়ে মনোযোগ সহকারে খাচ্ছে। বেশ কয়েকবার অবশ্য রিমিকে সেধেছে। রিমি নেয়নি। তার কাছে বাদাম খাওয়া আর ঝামেলা খাওয়া এক কথা।
খোসাটা ছাড়াতে কেন জানি তার লাগে দুনিয়ার আলসেমি । কলেজ টলেজে আবার ধরা বাঁধা নিয়ম। আড্ডায় বসেছো, তো ভালো লাগুক আর না লাগুক গরুর জাবর কাটার মতো বসে বসে চিবুতেই হবে। সে অবশ্য ছোলা টোলার ধারের কাছে যেতো না। ডাইরেক্ট মুখে দিয়ে চিবিয়ে ফেলতো। পেসা খতম, বাদাম হজম তার সাথে খোসার জীবাণুও হজম।
সে হাই তুললো। কাল রাতে তার ঘুম হয়নি। বই পড়তে পড়তেই আধা রাত শেষ । তার মধ্যে বের হয়েছে আবার সকালে। যার ফলে এখন দু- চোখ বুজে আসছে। তাই পানি ছিটিয়ে ছাটিয়ে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করছে।
তখনি চারিদিকে উচ্চ শব্দে মাইক বেজে উঠলো। রিমি একটু ধাক্কার মতো খোলো । ধুর! আজকে যে শরীর, মাথা, কান সব শেষ হবে ঠিক বুঝলো।
সে বিরক্তমুখে একবার আশে পাশে তাকালো। তারা দাঁড়িয়ে আছে সাব্বির দ্যা হ্যান্ডসাম বয়ের ভার্সিটিতে। এই মাঠেই আজ বিশাল সমাবেশ। এমপি টেমপি আসবে। ব্যাপার স্যাপার ই আলাদা। ভার্সিটির আশে পাশে পুলিশের মেলা লেগে গেছে। সেই মেলায়ই সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছে।
— রিমি চা খাবে ?
রিমি ফিরে তাকালো! রুমেল ভাই দু- হাতে দুটো ওয়ান টাইম কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই বেচারা তাকে ইমপ্রেস করার জন্য অনেক খাটা-খাটনি করছে। এই পর্যন্ত এই সাইডে চক্কর ই দিয়েছে বেশ কয়েকবার। খোঁজ খবরও নিচ্ছে আগ্রহ করে।
রিমি মনে মনে হাসলো! তবে মুখে কিছু বললো না। স্বাভাবিক ভাবেই হাত বাড়িয়ে কাপ নিলো। সে আর যাই করুক চা ফেরানো তার পক্ষে সম্ভব না।
সে তৃপ্তি নিয়ে চায়ে চুমুক দিলো। দিয়ে চোখ বন্ধ করে বললো, আহ্ শান্তি। ঘুমে সকাল থেকে মাথা এমনিই জ্যাম হয়ে আছে। তার মধ্যে সূর্যের চেহেরাও দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় চা ই একমাত্র শেষ ভরসা। থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ রুমেল ভাই।
রুমেল রিমির বাচ্চামো দেখে হাসলো। এই ছোট ছোট বাচ্চামোর জন্যই রিমিকে তার ভালোলাগে। সে আরেক কাপ মিথিলা কে দিলো। দিয়ে আর দাঁড়ালো না। চলে এলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই এমপি সাহেব এসে পড়বে। রাস্তা সব ক্লিয়ার রাখতে হচ্ছে। রিমিরা দেখছে ভেতরের সাইড টা।
রিমি চা খেতে খেতেই একটু সাইডে আসলো। ওলীদ ফোন দিচ্ছে। এ অবশ্য আজকাল তাকে যখন তখন ফোন দেয়। সে ফোন রিসিভ করলো না। এতো শব্দে কথা বলা অসম্ভব, সে ম্যাসেজ করলো।
— আমি ব্যস্ত।
সাথে সাথেই উত্তর এলো — জানি।
— তাহলে?
— এমনিই।
— ভালো।
— অবশ্যই ভালো। তোমার সাথে কথা বলছি খারাপ থাকার তো প্রশ্নই আসে না।
রিমি হালকা হাসলো!
— কি করছেন?
— কি আর করবো? পরের টাকার হিসাব রাখছি।
— ভালোতো রাখেন।
— হুম সেটা ভালো হোক খারাপ রাখতে তো হবেই। এখন বলুন তো ম্যাডাম কবে একটু ফ্রি হবেন ?
— কেন?
— এই ব্যস্ততায় বোর হচ্ছি। একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে।
— আমার কারণে তা বন্ধ হয়ে আছে নাকি?
— যদি বলি হ্যাঁ।
— আপনার হাব ভাব তো ভালো না মিষ্টার ওলীদ।
— আমি ধন্য এতো সহজেই যে তুমি বুঝতে পারছো।
রিমি আবারো হাসলো! হেসে আবার কিছু লিখতে যাবে, তখনি তার মনে হলো, তার পেছনে কেউ আছে। সে ফট করে পেছনে ফিরলো।
সটান হয়ে সাব্বির দাঁড়িয়ে আছে। দু- হাত পকেটে। গায়ে সাদা শার্ট, তার উপরে ডার্ক চকলেট নেহারু জ্যাকেট। রিমির মনে হলো এই লোক রং প্রফেশনে এসে পড়েছে। এর উচিত ছিলো সিনেমার নায়ক হওয়া।
রিমির সাথে সাথেই ঘোর লেগে গেলো। এই চকলেট বয় কে তার কচ কচ করে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হলো । ইশ আমার চকি চকি বয়…
সাব্বির রিমির মুখের সামনে তুরি বাজালো। সাথে সাথে রিমির ঘোর কেটে গেলো। সে মুখ গোঁজ করে দাঁড়ালো। এই বান্দা তাকে শান্তি দেবে না। তখনি তার মোবাইলে আবার ম্যাসেজ আসলো।
সাব্বির দেখলো! দেখে বললো, — বাহ্! এক্সসেপ্ট করাও হয়ে গেছে।
রিমি মেসেজ আর অপেন করলো না। মোবাইল পকেটে রাখলো। তার চা পানি হয়ে গেছে। সে কাপ ফেলে দিলো। দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললো, — হ্যাঁ ।
— গুড! রকেটের গতিতে ছুটছো দেখি।
— হ্যাঁ, এক ভাবে বলতে গেলে সেই রকমই।
— ডেটেও যাওয়া হয়ে গেছে নিশ্চয়ই?
— ঠিক বুঝতে পারছি না, তবে সেই দিন একসাথে লাঞ্চ করলাম।
সাব্বির নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো। আজকাল তার আজব আজব ইচ্ছে হয়। এই যে এখন যেমন হচ্ছে, এই মেয়েকে তুলে আছাড় মারতে। সভ্য সমাজে বাস করার অনেক যন্ত্রনা। চাইলেও সব ইচ্ছে পূরণ করা যায় না। তাই সে তার ইচ্ছেকে সাইড করে গম্ভীর কন্ঠে বললো —- একটা কথা জিজ্ঞেস করবো সত্যিই উত্তর দেবে?
— সেটাও ঠিক বলতে পারছি না, তবুও করুন বলার চেষ্টা করি।
— অভিনয় করছো কেন?
রিমি উত্তর দিলো না। সে গোলগোল চোখে চুপচাপ সাব্বিরের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে সাব্বিরের চেয়ে হাইটে একটু কম। এই নাক বরাবর। আরেকটু কম হলে ভালো হতো। গলা ধরে ঝুলে পড়া যেতো, ইশ মিস হয়ে গেলো রে….
সাব্বির এবার সত্যিই বিরক্ত হলো । এই মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো কি, আর এই মেয়ে করছে কি? সে আর দাঁড়ালো না। সত্য তো ভালোই এই মেয়ে তাকে মিথ্যাও কিছু বলবে বলে মনে হয় না।
সে চলে যেতে নিলো, তখনি মিথিলা আসলো। সে মাথা এপাশ ওপাশ করে দু- জনের দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বললো, —- কোন সমস্যা রিমি?
— না ম্যাডাম।
— এটা কে? একে কোথায় জেনো দেখেছি?
— আপনি কোথায় দেখেছেন, আমি কিভাবে বলবো ম্যাডাম?
সাব্বির ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রিমির দিকে তাকালো। রিমি দেখেও দেখলো না।
মিথিলা এবার সাব্বিরের দিকে তাকালো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো। কোথায় দেখেছে সে,মনে করতে পারলো না। প্রতিদিন এতো এতো মানুষ দেখে কতোজনকে আর মনে রাখবে।
সাব্বির হাত উঠিয়ে ঘড়ি দেখলো। তার স্টেজের ওখানে যাওয়া দরকার। এসব সমাবেশ টমাবেশে তার আগ্রহ কম। তবে নিজেদের ভার্সিটি, ইচ্ছে না থাকলেও থাকতে হয়। সে মিথিলার দিকে তাকিয়ে বললো, — আমাকে যেতে হবে। বলেই সাইড কাটলে চাইলো।
মিথিলা দিলে তো। সে ফট করে আবার সামনে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে বললো, — উঁহু্! এভাবে তো যাওয়া যাবে না, আপনাকে আমার সন্দেহ হচ্ছে। এর আগেও কোথায়ও দেখেছি, তবে মনে পড়ছে না। তবে হান্ড্রেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। নিশ্চয়ই কোন কেস টেস খেয়েছিলেন। মেয়ে ঘটিত ব্যাপার? হ্যাঁ এমনি হবে। আজকাল দেখতে নায়কের মতো সুদর্শন ছেলেরা এসবই করে বেড়ায়। প্রথমে লুক, মিষ্টি মিষ্টি কথা পরে ব্লাকমেইল করে টাকা। এতো ফ্যাশন আসে কোথা থেকে হ্যা? জানি জানি! আমি সব জানি।
সাব্বির দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে রিমির দিকে আবার তাকালো ।
রিমি মুখ বাঁকালো। মনে মনে বললো, “সেইদিন চিনেছিলেন? আজ রিমিও চিনবে না। উঁহু একদম না।
সাব্বির দাঁতে দাঁত চাপলো। চেপে বললো, —- আমি এই ভার্সিটিই টিচার। আর এই যে দেখতে মাসুম টাইপ চেহেরার মেয়েটাকে দেখছেন। এ আমার হবু শাশুড়ির বাবা- মায়ের ছোট মেয়ের ভাগ্নি।
মিথিলা ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে গেলো।
বোকার মতো চেহেরা করে হা করে বললো — হ্যাঁ…..
— জ্বি! বিশ্বাস না হলে ওকেই জিজ্ঞেস করুণ।
বলেই সাব্বির আর দাঁড়ালো না। সে তার দু- হাত পকেটে পুরে ভাব নিয়ে হেঁটে গেলো। যেন ভার্সিটির মাঠ না রেড কার্পেট। চারিদিকে লাইট ক্যামেরা, পটাপট ক্লিক হচ্ছে। রিমি মুগ্ধ চোখে সেই যাওয়া দেখলো । ইশ….
মিথিলা রিমির দিকে তাকিয়ে বললো, — কি বললো, কিছুই তো বুঝলাম না । তোমার পরিচিত নাকি?
রিমি দ্রুত বেগে মাথা নাড়লো! নাড়তে নাড়তে বললো — উঁহু, একদম না ম্যাডাম।
— সেকি! বলে তো গেলো তার শাশুড়ির নাকি কি হও।
রিমি ঠোঁট টিপে হাসলো! তবে কিছু বললো না। কিন্তু হাই স্পিডে মাথা না বোধক ঠিকিই নাড়ালো।
— আল্লাহ! বোকা বানিয়ে গেলো নাকি ? আর তুমিও মেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছো। মানছি নতুন, তাই বলে এতো গাধা হলে চলে। এখন আসো, দেখি এই বান্দর মার্কা ছেলে কোনদিকে গেলো। মিথিলাকে চুনা লাগানো, তোর কলিজা টেনে বের করে কুচিকুচি করে ভাজি না করি, তো আমি মিথিলা না।
তারা দুজনেই এগিয়ে গেলো। বেশি অবশ্য খুঁজতে হলো না। স্টেজের সামনে এসেই তাকে দেখা গেলো । একদল লোকের মাঝে দাঁড়ানো। হেসে হেসে কথা বলছে। এতো ভির ঠেলে ওখানে পৌঁছালো সম্ভব না।
তাই তারা সেখানেই দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ পরে সেখান থেকে সুন্দর মতো একটা মেয়ে, না মেয়ে বলা ঠিক হবে না, বয়স আরো বেশি। গায়ে পরিপাটি করে শাড়ি পরা, পায়ে উঁচু হিল। সেই হিল ঠকঠকিয়ে স্ট্রেট করা লম্বা চুল উড়িয়ে হেঁটে তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। মিথিলা ম্যাম তাকে থামালো। থামিয়ে বললো, — কিছু মনে করবেন না,একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিলো।
মেয়েটা হাসলো! মিষ্টি হাসি। হেসে বললো, — বলুন।
— জ্বি আপনি?
— আমি এই ভার্সিটিরই টিচার। বলুন! কোন সমস্যা?
— না, না কোন সমস্যা না । আসলে ঐ লোকটা কে বলতে পারবেন?
মেয়েটা ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
— কোন লোকটা?
— ঐ যে চকলেট বয়।
মেয়েটা আবারো হাসলো! ভার্সিটির সব টিচারা এমন সুন্দর হয় কেন? রহস্য কি? রিমি ভাবতে লাগলো।
— কেন বলুন তো।
মিথিলা থামলো! না সন্দেহের কথা কাউকে জানানো যাবে না। সে একটু হেসে রিমিকে টেনে পাশে এনে বললো,— আর বলবেন না। এ হলো তার শাশুড়ির “কি যেন ছিলো?” ও হ্যাঁ বাবা – মায়ের মেয়ের ভাগ্নি। এখানে হঠাৎ করে দেখলো তাই।
— জ্বি কি বললেন?
— আরে বুঝেন না। শাশুড়ির বাবা মায়ের ভাগ্নি, আরে থুক্কু মেয়ের ভাগ্নি ।
মেয়েটা অবাক হয়ে রিমির দিকে তাকালো। রিমি অপস্তুত হয়ে গেলো। মনে মনে বললো, ধুর এ আবার কোন ঝামেলা।
সে আমার দিকে তাকিয়েই কোন রকম বললো —- সাব্বির ভাই এই ভার্সিটিরই টিচার।
মিথিলা ঠোঁট ভেটকিয়ে আবার বললো —- এ্যা সত্যিই? নাম সাব্বির নাকি?
— জ্বি।
বলেই মেয়েটা আর দাঁড়ালো না। যেখান থেকে এসেছিলো হনহনিয়ে সোজা সেখানেই গেলো। গিয়ে সোজা সাব্বির ভাইয়ের কাছে গেলো। মনে হয় তাদের ব্যাপারেই কিছু বলছে। মাইকের শব্দ তাই তারা কথা বলছে একটু কাছাকাছি এসে। বলতে গেলে কানে মুখে টাইপ।
রিমির ভেতর কেন জানি জ্বলে গেলো। এই স্টেজ, এই মাঠ, এই ভার্সিটি সব তার গুলি করে ঝাঁঝড়া করে দিতে ইচ্ছে করলো।
তখনি সাব্বির তাকালো। সোজা রিমির দিকে। তার ঠোঁটের কোণে হাসি।
চলবে…….
#আনমনে_সন্ধ্যায়
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১৫
আয়েশা স্কুল থেকে ফিরে অবাক হলো। ড্রয়িং রুমে আশিক বসে আছে। আশিক তার বড় ভাইয়ের বড় ছেলে। কোন ভাইয়ের সাথেই তার খুব একটা ভালো সম্পর্ক নেই। এমন না ঝগড়া বিবাদ। ব্যস নেই। সেই সুবাদে কোন ভাইঝি, ভাতিজাদের সাথেও নেই। তবে সে বাড়ির প্রথম সন্তান। তখন তার বিয়ে হয়নি। এই ছেলেটা বলতে গেলে কম বেশি সবারই স্নেহ পেয়েছে । এমন কি আয়েশারও, তবে সেটা সময়ের সাথে সাথে ফিকে হয়ে গেছে।
আয়েশা তার স্বাভাব সুলভ নির্বিকার ভাবেই ভেতরে আসলো। এতোদিন পরে ভাতিজা এসেছে, সে রকম কোন উত্তেজনা তার মধ্যে দেখা গেলো না। তবে নিপা একগাল হেসে গদগদ হয়ে বললো, — এইতো চাচি এসে গেছে। বললাম না এক্ষুণি এসে পড়বে।
সে আশিক এসেছে পর থেকে আছে দৌড়ের উপর।কখনো এটা, কখনো ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। কেন দিচ্ছে, কেন ব্যস্ত হচ্ছে সে নিজেও জানে না। তবে তার আগ্রহ দেখে যে কেউ ভাববে আশিক তার পূর্বপরিচিত, ভাবও আছে গলায় গলায়। আসলে সে রকম কিছু নেই। আশিককে সে দেখছেই আজ প্রথম ।
আয়েশা কে দেখে আশিক হালকা হাসলো। হেসে উঠে দাঁড়ালো! দাঁড়াতে দাঁড়াতে একবার নিপার দিকে তাকালো। সে এই পাগল মেয়ের হাবভাব কিছুই বুঝতে পারছে না। এসেছে পর থেকে চম্বুকের মতো লেগে আছে। একটু পর পর এটা সেটা খাবার আনছে। না খাওয়া অবদি হা করে তার সামনেই বসে থাকছে। শুধু যে এই মেয়ের তা না বলতে গেলে কারোই হাবভাব সে বুঝতে পারছে না।
সে যখন এলো দরজা খুললো এই বাড়ির কাজের খালা। চোখ মুখ একেবারে অন্ধকার। এই অন্ধকার সে কলিং বেল দেওয়ায় নাকি অন্য কোন কারণে সে বুঝতে পারলো না। তারপর এলো আয়াশ! সে স্কুল থেকে আসলো কিছুক্ষণ আগে। সে হেসেই কাছে ডাকলো। হাজার হলেও ভাই। না থাক তেমন গলায় গলায় ভাব। তবুও তো ভাই।
আয়াশও আগ্রহ নিয়েই এগিয়ে এলো। কিন্তু আসতেই কোথা থেকে এক পিচ্ছি হঠাৎ করে তার গলা ধরে ঝুলে পড়লো । এমন পড়া পড়লো, দম আটকে মরে যাওয়ার জোগাড়। সে তড়িঘড়ি করে এক প্রকার ছুঁড়ে ফেলেছে।
ছুঁড়ে ফেলতেই এক লোক বলতে গেলে উড়ে আসলো। ছু মন্তর করে কোলে নিয়ে এমন ভাবে তাকালো।
আল্লাহ ! সে আরেকটু হলে হার্ট এ্যাটাক ই করতো। হাত মুখ ধবধবে ফর্সা। তার মধ্যে চুল, দাঁড়ি, ভ্রু সব কুচকুচে কালো । কোন আজাবের বাড়ি এটা! সে তো কিছু বুঝতেই পারছে না। তার ফুপিকে দেখে এখন জানে একটু পানি আসলো।
সেই পানি গিলে মনে মনে সে হাঁফ ছেড়ে বললো —- ভালো আছেন ফুপু?
— ভালো! বসো! বলে আয়েশাও বসলো। মনে মনে ভাবলো আশিক কি রিমির জন্য এসেছে? আসুক! রিমি না চাইলে এই বিয়ে সে কখনও হতে দেবে না। রিমি এটা বুঝেনি। বুঝেনি বলেই গাধার মতো স্টেপ নিয়েছে।
— বাসার সবাই ভালো?
— জ্বি।
আয়েশা আর কথা খুঁজে পেলো না। কেন এসেছে জিজ্ঞেস করাটা তো বেমানান, সে চুপচাপই বসলো।
আশিক বুঝতে পারলো। না বুঝার অবশ্য কিছু নেই। সে ছোট বাচ্চা না। তাছাড়া তার নিজেরও আসার তেমন ইচ্ছা ছিলো না। দাদি আর মা বলতে গেলে তাকে ঢেলে ঢুলে পাঠিয়েছে। রিমি খবরা খবর নিতে। সে কি খবর নিবে নিজেও বুঝতে পারছে না। রিমি ছোট বেলা থেকে নিজের মন মাফিক চলার মতো মেয়ে। সেখানে থাকতেই কাউকে গনায় ধরে নি, আর এখানে।
রিমি আসলো সন্ধ্যার অনেক পরে। ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে। সারাদিন ভার্সিটিতে দাঁড়ানো, তার পরে আবার গিয়েছে আরেক জায়গায়। মহিলা মার্ডার কেস। মন, মেজাজ, শরীর তার সব তেনাবেনা। আশিককে দেখে তার খালামণির মতো তারও কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। সে সোজা এসে বিছানায় পটাং হয়ে শুয়ে পড়লো। দুনিয়ায় এখন জাহান্নামে যাক, সে এখন ঘুমাবে।
তার ঘুম ভাঙলো একেবারে বারোটারও পরে। মোবাইলের ভাইব্রেটে! সে হাতড়ে মোবাইল রিসিভ করে কানে রাখলো।
ওলীদ চিন্তিত হয়ে বললো, —- থ্যাংক গড তুমি ফোন রিসিভ করেছো। কোথায় ছিলে তুমি? কতোবার ফোন দিয়েছি।
রিমি চোখ, মুখ কুঁচকে মাথা তুললো! কোথায় আছে সে? কিছুক্ষণ বুঝতে পারলো না। তার মনে হলো এখনও সে ভার্সিটিতে ই আছে। একের পর এক প্যা প্যা করে বক্তিতা দিয়েই যাচ্ছে। তবে এতো অন্ধকার কেন? পা ও চুলকাচ্ছে। মশা তার দায়িত্ব মনে হয় ভালো ভাবেই পালন করছে ।
— হ্যালো রিমি?
রিমির ধ্যান ভাঙলো। সে কম্বল নিয়েই উঠে বসলো। কানে মোবাইল রেখে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো, — হুম।
— ঘুমাচ্ছিলে নাকি?
— হুম।
— স্যরি মনে হয় ডিস্টার্ব করলাম।
রিমি কিছু বললো না । তার ঘুম এখনও কাটেনি।
— তাহলে ঘুমাও। নটা থেকে ফোন করছি। ধরছিলেনা বলে টেনশন হচ্ছিলো।
রিমি অবাক হলো! অবাক হয়েই বললো — নয়টায় থেকে মানে! এখন বাজে কয়টা?
ওলীদ হাসলো! এই মেয়ে ঘুমাচ্ছে কখন থেকে? আচ্ছা ঘুম কাতুরে তো।
— এখন রাত প্রায় একটা।
— আল্লাহ! বলেন কি? এই মাত্রই না আসলাম।
— এমন হয়। খুব ক্লান্ত ছিলে বোধ হয়। রাতে খেয়েছো?
রিমি মনটা একটু খারাপ হলো। বাসায় এতগুলো মানুষ। কেউ কি পারতো না তাকে এসে খাবারের জন্য ডেকে তুলতে?
— কি হলো?
— না এখনো খাওয়া হয়নি।
— তাহলে তো মনে হয় ঘুম ভাঙিয়ে ভালোই করেছি। উঠো ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে আবার ঘুমাও।
— হুম।
— আচ্ছা তাহলে আমি রাখছি, তুমি খেয়ে নাও।
— হুম বায়।
— উঁহু বায় না, বলো শুভ রাএি।
— দিনরাত তো ইংলিশেই পটর পটর করেন। হঠাৎ আবার শুভ রাএি কেন?
ওলীদ হালকা হাসলো। হেসে বললো, —- কিছু কিছু শব্দের হাজার ইংরেজি শব্দ থাক, বাংলার মতো হ্নদয় ছুঁতে পারে না।
— আচ্ছা?
— হুম। যেমন “আমি তোমাকে ভালোবাসি “বলতে যেই আবেগ কাজ করে “আই লাভ ইউতে “সেটা কাজ করে না। “আই লাভ ইউ” টা যান্ত্রিক মনে হয়। কিন্তু ভালোবাসি সেটা স্বর্গীয়। সেই অনুভূতির কোন ভাষা নেই।
— আমি তো ভেবেছি শুধু কফি নিয়েই পিএজডি করেছেন, এখনতো মনে হচ্ছে ভাষা নিয়েও।
ওলীদ হো হে করে হেসে ফেললো। এই মেয়েটা এতো হাসাতে পারে। সে এই কয়দিনে যতো হেসেছে তার পুরো জীবনেও মনে হয় এতো হাসেনি।
রিমি শুভ রাএি বলেই ফোন রাখলো! রেখে অবাক হলো। তার মোবাইলে অসংখ্য মিসডকল। শুধু ওলীদের না, বাড়ির সবার। তার মন নিমিষেই ভালো হয়ে গেলো।
সে দরজা লক করে ঘুমিয়েছিলো। তাই হয়তো সবাই ফোন উপর ফোন দিয়েছে। আর সে উপুর হয়ে পরে পরে নাক ডেকে ঘুমিয়েছে। ধুর….
বলেই সে ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। শীতে কাঁপতে কাঁপতে রুমের বাতি জ্বালালো। জ্বালিয়ে তার মন আরেক দফা ভালো হয়ে গেলো।
আশিক ভাই তার জন্য এক গাদা বই নিয়ে এসেছে। ইশ! আজকে কি তার মন ভালো হওয়ার দিন ছিলো।
সে উঠে কাঁপতে কাঁপতে জামা চেইঞ্জ করলো। ঠান্ডা পানি দিয়ে উহু আহু করতে করতে হাত, মুখ ধোয়া শেষ করলো। বের হয়ে মাথায় টুপি, পায়ে মোজা, গায়ে চাদর জড়ালো সাথে বিরবির করে বললো, শীত, শীতরে…
শীতের গুষ্টি উদ্ধার করে, পুরো প্যাকিং হয়ে রিমি বাইরে আসলো। তার খিদে পেয়েছে। ড্রইং রুমে এসে সে আরেক দফা অবাক হলো। সাব্বির ভাই বসে আছে, সোফায়। পা দুটো লম্বা করে টিটেবিলে ফেলা। লো ভলিউমে টিভি চলছে। তার মাথা সোফায় হেলান দিয়ে রাখা। সে রিমির দিকে না তাকিয়ে বললো, —- আজকাল নেশা টেশা করছো নাকি বলোতো? এভাবে কেউ ঘুমায়? আরেকটু হলে তো দরজাই ভেঙে ফেলা হতো।
রিমি হাসলো। কিছু বললো না। সে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। খাবার ঢেকে রাখা। নিশ্চয়ই মুহুয়া আন্টির কাজ। সে প্লেট এগিয়ে নিলো। আশিক ভাই এসেছে, তাই হয়তো আয়োজনও বেশি। সে অবশ্য বেশি কিছু নিলো না। সাদা ভাত, ডাল, আর মুরগির মাংস। এতো রাতে পোলাও টোলাও খেতে ইচ্ছা করলো না। আর অন্য মাংস। না বাবা না! সেই দিন তার শিক্ষা হয়ে গেছে। এই বাসায় যতোদিন আছে গরু হোক আর খাসি। সে হাতই দেবে না।
সে প্লেট, এক গ্লাস পানি নিয়ে সোফার দিকে এগিয়ে গেলো। এই বান্দাকে তো আর কচ কচ করে খাওয়া সম্ভব না। তাকে দেখে কচ কচ করে মুরগির মাংস খেয়েই আপাততো মন শান্ত করা যাক।
সে বসতেই মাথা কাত করে সাব্বির তার দিকে তাকালো। বিরক্ত মুখে বললো, — সোফায় ভাত কে খায়?
রিমি নির্বিকার ভাবে বললো,– আপনার মামা খায়।
— তো? তোমারও খেতে হবে?
রিমি খেতে খেতে বললো — আমার কোন দোষ নেই। সব দোষ আপনার।
— আমার?
— হুম! আপনি যদি না থাকতেন আমি খাবার নিয়ে সোজা রুমে চলে যেতাম। কম্বলমুড়ে তারপরে খেতাম।
সাব্বির তাকিয়ে রইলো! কিছু বললো না। অবশ্য তার বলার ভাষা নেই। সে কম্বলমুড়ে তো ভালোই বিছানায় খাওয়া কথা কল্পনাও করতে পারে না। তবে তার ভবিষ্যৎ মনে হয় কল্পনার বাহিরে। শুধু খাওয়া কেন আরো কতো কিছু বিছানায় বসেই করতে হয় কে জানে।
— পরে টেনশন কমলো কিভাবে?
— আমাদের স্পাইডার ম্যান আছে না। সে পাইপ বেয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিলো। দেখলো এক নোংরা মেয়ে সারাদিন যে ইউনিফর্ম পরে ছিলো সেই ইউনিফর্ম গায়েই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে পা চুলকাচ্ছে। ভাগ্যিস চুলকেছো। তা না হলে ভাবতাম মরে পড়ে আছো।
রিমি হাসলো! হেসে বললো,
— আয়াশ।
— হুম।
রিমি পানির গ্লাস নিয়ে চোখ তুলে তাকালো। সাব্বির তার দিকে এক পলকে তাকিয়ে আছে। সে চোখ প্লেটে রেখেছিলো, তাই এতোক্ষণ খেয়াল করেনি।
সে পানি খেয়ে বললো, — আমার পেট খারাপ হলে আপনার খবর আছে।
— আমি এখানে আসতে বলেছি?
— আমি আপনাকে ড্রয়িং রুমে বসতে বলেছি?
— তোমার বলতে হবে কেন?
— তাহলে বসে আছেন কেন?
সাব্বির হেসে ফেললো ! কথার পিঠে কথা সাজাতে এর সাথে আর কেউ পারবে না। সে হেসেই বললো, — ভালো ভাবে হাত মুখ ধুয়েছো?
রিমি মাত্রই এক লোকমা মুখে দিতে নিয়েছিলো। সে থেমে গেলো, মনে মনে বললো, ” বেটা পরিষ্কারগির আমি হাত ধুই আর না ধুই। আপনার কি? আমার হাতে তো আর আপনি খাবেন না। সেই তো খাবো আমিই। তো এতো ফেদলার দরকার কি? কিন্তু মুখে বিরক্ত এনে বললো — কেন?
সাব্বির ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। রিমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। ওমা এখন আবার তার হাত মুখ ধোয়াতে নেবে নাকি?
সাব্বির রিমির সামনে এসে দাঁড়ালো। তাকে অবাক করে দিয়ে ঝুকে তার হাতের লোকমা মুখে নিলো। নিলোও খুব কায়দা করে। রিমির শরীর ঝনঝনিয়ে উঠলো। এই শীতের মাঝেও গরমে তার কান দিয়ে ধোঁয়া ছুটে গেলো।
সাব্বির অবশ্য নির্বিকার! সে তার সেই নির্বিকার মুখ নিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো, —- তোমার চোখে চশমা দরকার। তা না হলে গাধী দ্যা নাম্বার ওয়ান দেখতে টেবিলে দু- জনের খাবার রাখা, দুটো প্লেট,যার মধ্যে একটা সাব্বিরের।
বলেই সাব্বির রিমির গ্লাস থেকে পানি খেলো। খেয়ে স্বাভাবিক ভাবে টিভি অফ করলো। করে হাই তুলে যেতে যেতে বললো, — সব কিছু গুছিয়ে খাবার ফ্রিজে তুলে তারপর যাবে। তা না হলে এই যে আমি না খেয়ে রইলাম। সেটা ঠান্ডা পানিতে চুবিয়ে শোধ করবো।
সাব্বির চলে গেছে। রিমিকে অবশ্য ঠান্ডা পানিতে চুবানোর দরকার নেই, সে যে ভাবে বসে ছিলো ঠিক সে ভাবে এমনিতেই জমে বসে আছে।
চলবে……