আনমনে সন্ধ্যায় পর্ব-২৫+২৬

0
177

#আনমনে_সন্ধ্যায়
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২৫

মুহুয়া আন্টির প্রেশার বেড়েছে। রিমি আর কি করবে? দৌড়ে আয়েশার কাছে গিয়েছে। বলার মতো বাসায় আর আছেই বা কে? আয়েশা অবশ্য এক ডাকেই দরজা খুলেছে। তার মুখে তবলা বাজিয়ে দিন – দুপুরে দরজা লক করে বসে বসে কি করছিলো কে জানে। রিমি অতো ভাবেনি, টেনে নিয়ে এসেছে।

এখন অবস্থা একটু ভালো। ঔষুধ দেওয়া হয়েছে। টক শরবত খাওয়ানো হয়েছে। সে ভেবেই পায় না , হঠাৎ করে হলোটা কি?

নিসা আর তার হাসবেন্ড এসেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই। এসেই এই মেয়ে হাউ-কাউ শুরু করেছে। হাউ-কাউ ছাড়া এই মেয়ে মনে হয় না কিছু পারে । এর জামাই একে হজম করে কিভাবে কে জানে। মনে মনে বলতেই রিমি নিসার হাসবেন্ডের দিকে তাঁকালো।

সেও তাঁকিয়ে ছিলো। রিমি তাঁকাতেই দু- জনের চোখাচোখি হয়ে গেলো। চোখাচোখি হতেই দু- জনে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। । ফট করে দু- জনেই মাথা ঘুরিয়ে ফেললো।

দেখতো কি কান্ড? রিমি আর ওদিকে তাকালোই না। এমন ভাব কিছু হয়ইনি। আর নাঈম হাঁসফাঁস করতে করতে কিছুক্ষণ দাড়ালো। তারপর কোনরকম রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

আরে ধুর মেয়েটা কি ভাবলো। সে তো তাকিয়ে ছিলো মেয়েটার মুখ দেখে। নিসা আর এই মেয়ের একই অবস্থা। সে অবশ্য নিসাকে জিজ্ঞেস করেনি । নিসাকে সে চেনে। এখন না সেই ছোট বেলা থেকে। সাব্বির আর সে কলেজের বন্ধু। প্রেম না তবে পছন্দ সে নিজেই করেছিলো। পরে ফ্যামিলির মাধ্যমে বিয়ে।
সে ভালো করেই জানে নিসা ভেজাল লাগাতে উস্তাদ। সেই সুবাদে দু- একটা চড় থাপ্পড় সাব্বির যে দেয়, সে জানে। সে অবশ্য কখনো এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাইনি। কেননা সে নিজেই মোটামুটি ত্যক্তবিরক্ত।

তার বোন ছাড়া নিসা আর তাদের বাড়ির কাউকেই তেমন একটা দেখতে পারে না। না পারে নিসাকে তাদের বাড়ির মানুষ। আর এই দুইয়ের মাঝে পড়ে তার অবস্থা চিড়েচ্যাপ্টা।

কিন্তু এই মেয়ে আবার কি করলো? অন্য মেয়েদের গায়ে হাত তুলবে এমন ছেলে তো সাব্বির না। উঁহু, একদম না! সে সাব্বির কে ভালোভাবে চিনে।

নাকি এরা দু- জনে মিলে কোন গন্ডগল করেছে ? দেখতো , কি এমন করলো যে এমন গাল, মুখ ফাটাতে হবে। নিজের বোন ঠিক আছে। তাই বলে অন্য মেয়েকেও। এর মাথা টা গেছে নাকি। এই টেনশনেই নিশ্চয়ই আম্মার প্রেশার উঠেছে। না! এই ছেলেকে নিয়ে আর পারা গেলো না। এজন্যই বলে তার ছেড়ার আগেই তার টেনে ধরার মানুষ ঠিক করতে হয়। কি যে করে এরা। বাড়ির বড় ছেলে, তার জন্য এখনও একটা মেয়ে ঠিক করতে পারে না। যত্তোসব পাগলের দল।

সে মোবাইল বের করলো। রুমে যেতে যেতে সাব্বির কে কল দিলো। গাল টাল ফাটিয়ে কোথায় যে বসে আছে কে জানে। ভাগ্যিস এই মেয়ে কোন অ্যাকশান নেয়নি। তা না হলে পুরো গুষ্টি আজ জেলে। পুলিশের গায়ে হাত, কম কথা? ধুর! কোন দুঃখে যে সে এই বাড়িতে থাকতে গেছে। বাড়িতো না যমের ঘর।

মুহুয়া ঘুমিয়ে গেছে। আয়েশা তার গায়ে কম্বলমুড়ে উঠে যেতে যেতে রিমি উদ্দেশ্যে বললো, — আমার রুমে এসো।

রিমি স্বাভাবিক ভাবেই আয়েশার পেছন পেছন গেলো। রুমে যেতেই আয়েশা জিজ্ঞেস করলো,
— এসব কি?
— কোন সব?

আয়েশা নিজেকে দমালো। মনে মনে বললো, — আল্লাহ! ধৈর্য্য দাও। বলেই সে আর ডানে বামে গেলো না। সোজা জিজ্ঞেস করলো,
— কোথায় যাচ্ছো?

— কোথায়ও না। ঢাকাতেই আছি। তবে এই বাসায় না।
— কেন জানতে পারি?

রিমি ভ্রু উঁচু করে তাকালো। তার মানে চলে যাওয়ার মতো এখনও কিছু হয়নি? ও তার গালতো আবার সরকারি । যখন যার ইচ্ছা তবলা বাজাতেই পারে। মাই মিসটেক প্রাইভেট ভেবেছিলো। সে ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
— এই বাসায় বোর হচ্ছি তাই এন্টারটেইনমেন্টের জন্য যাচ্ছি।

— ফাজলামি করছো?

— সেটাতো আপনিও করছেন। জেনেও না জানার ভান করছেন।

— না আমি জানি না। তুমি বলো? তোমার মুখ থেকে শুনি।

রিমির রাগ হলো! সে বলবেনা, কিচ্ছু বলবেনা। কাউকে না। কেন বলবে? এটাতো থাপ্পড় দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো। এখন তো শাস্তি পেয়ে ই গেছে। তাই এখন কোন বলাবলি নেই। নো, নেভার।

আয়েশা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। সে বুঝলো এই মেয়ে মুখ খুলবে না। এতো ঘ্যাড়তেরা! মায়ের চেয়েও দু- ডিগ্রী উপরে চলে গেছে।

সে খাটে গিয়ে বসলো। তার নিজেরও শরীর ভালো না । সকাল থেকে না খাওয়া। বুক ব্যথা করছে। সে শান্ত ভাবে বললো, — আমরা একটা সমাজে বাস করি রিমি। সেখানে ইচ্ছে হলেই যখন যা ইচ্ছা করা যায় না । তোমার কাজ ছিলো। ঠিক আছে, মানলাম। বাসায় তোমার খালু ছিলো, আশিক ছিলো। এভাবে হুট করে কোথাও যাওয়া ঠিক না। ওই ঠিক নার মধ্যেই সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো সাব্বিরের সাথে যাওয়া।

রিমি কঠিন ভাবে বললো, — আমি তাকে যেতে বলিনি।

— আমি বুঝলাম তুমি তাকে যেতে বলোনি। কিন্তু তার পরিবারের মানুষ তোমাকে বিশ্বাস করবে কেন? তারা তোমার দিকেই আঙ্গুল তুলবে। যেভাবে নিসা তুলেছে। আমরা পরিবার! সাব্বিরের কথা শুনলাম, মানলাম। কিন্তু অন্য সবাই কিন্তু এটা মানবে না। তাই এমন কোন কাজই করা উচিত না। যেটা ঘুরে ফিরে নিজের উপরে আসে। তোমার কি উচিত ছিলো না, কাউকে একটু ইনফ্রম করা?

রিমি উত্তর দিলো না। আয়েশা দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে আবার বললো, — তোমার মনে হচ্ছে তোমাকে বিনা দোষে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একবার আমার জায়গায় নিজেকে দাঁড় করাও রিমি। নিজের সম্পর্কের কারো গায়ে কাদা ছুঁড়লে কেমন লাগে। তখন তুমি দেখবে তোমার দোষ কোথায়? তখন আমার থাপ্পড় তোমার আর শাস্তি মনে হবে না। আর বিশ্বাস করো এর জন্য আমার কোন আফসোসও নেই। আমার কাছে অন্যায় মনে হলে আমি আয়াশকে যেমন শাস্তি দিতে পারি, সেটা তোমাকেও পারি।

রিমি এবারো কথা বললো না। ছোট বেলা থেকে সবাই তো শুধু আঙ্গুল তুলে তুলে দোষ দেখিয়েছে। কই কেউ তো একদন্ড বসিয়ে, মাথায় হাত রেখে একটু বুঝায়নি। এখন কেন এতো বোঝাবুঝি। সে কোন কিছু বুঝতে চায় না। কিচ্ছু না, কিচ্ছু না, কিচ্ছু না…. সে তেজের সাথে বললো, — ঠিক আছে! আমি মেনে নিচ্ছি। সব দোষ আমার। আমার কারণেই সব অশান্তি। তাই চলে যাচ্ছি। অন্তত আমাকে নিয়ে আপনার বাড়িতে আর কোন সমস্যা সৃষ্টি হবে না।

— তুমি শিওর চলে গেলেই সব শেষ। আর কোন সমস্যা সৃষ্টি হবে না?

রিমি উত্তর দিলো না।

— যেটা নিয়ে তোমার উপরে আঙ্গুল তোলা হয়েছে সেটা কি পুরোপুরি মিথ্যা?

রিমি এবারো উত্তর দিলো না।

— চারটা মানুষ একসাথে থাকে একটু না একটু সমস্যা হবেই। জীবন তো নাটক সিনেমা না। যেখানে হেসে হেসে জীবন পার করবে। কেউ দোষ করবে। কেউ শাসন করবে। তার মানে এই না তাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। তাছাড়া থাপ্পড় তো নিসাও খেয়েছে। সে কি গাল ফুলিয়ে, ব্যাগ গুছিয়ে চলে যাচ্ছে?

— এটা তার পরিবার, তার বাড়ি, সে যাবে কেন? এখানে আমি কেউ না।

— মানলাম এটা তোমার বাড়ি না। কিন্তু আমার তো? আর আমি তোমাকে আমার বাড়িতে এনেছি। তাই আমি তোমাকে এভাবে যেতেও দেবো না।

— কেন?

— কারণ তুমি আমার একমাত্র বোনের একমাত্র মেয়ে। আর তোমাকে দেখে রাখা আমার দায়িত্ব।

রিমি হেসে ফেললো! হেসে বললো, — এতোদিন পরে এটা আপনার মনে পড়লো?

— হ্যাঁ পড়লো! সমস্যা কি জানো? তুমি শুধু তোমার সমস্যা দেখেছো । আমারটা দেখোনি। আমিতো তাও এতোদিন পরে দেখলাম। তুমি তো নিজের চোখে নিজেই কাপড় বেঁধে বসে আছো। তা না হলে ঠিকিই সব বুঝতে। শুধু কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেই আগলে নেওয়া হয় না।

— আমার নতুন করে কোন কিছু বোঝার দরকার নেই।

— ভালো! সেটা যে তুমি বুঝবে না আমি আগেই জানি। আয়মানের মেয়ে তুমি। ঘাড়ের যতো গুলো রগ আছে সব ই ত্যাড়া।

— আমার মাকে নিয়ে কিছু বলবেন না।

এবার আয়েশার গলা চড়লো! চেঁচিয়ে বললো, — একশবার বলবো! হাজার বার বলবো! দুনিয়াতে এসেছো কবে? তার অনেক অনেক আগে থেকেই সে আমার বোন। পেট থেকে বের হয়েছো বলে তাকে কিনে নাওনি। যা অন্যায় সব সময় অন্যায়ই থাকে। বড় গলায় বললেই তা সঠিক হয়ে যায় না। তুমি যেমন কর্ম করবে লোকতো তাই ই বলবে। তাই তোমার মায়ের টাও বলবে। বলবেন না, বলবেন না বললেই সবাই চুপ হয়ে যাবে না। না কিছু বদলাবে। কয়েকটা থাপ্পড় মেরেছি বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছো। একবার ভেবেছো, তোমার মা আমার সাথে কি করেছে?

রিমি মুখ ফুলিয়ে দাঁড়ালো! এই প্রথম সে কোন কথা খুঁজে পেলো না। আয়েশা বুঝলো! তার হাসি পেয়ে গেলো! যাক একবার হলেও এই কটকটিকে দমানো গেছে। কারো কথা না শুনে, না বুঝে এই মেয়ে। সব কিছুতে শুধু জেদ আর জেদ।

সে নিজেকে সামলালো। মনে মনে বললো, — “আয়মান, তোকে আমি ক্ষমা করলাম। এই মেয়েটার জন্য করলাম। তোর ভুলে ভরা জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া এই মেয়ে। যে তার পুরো সত্তা নিয়ে তোকে ভালোবাসে। তোর সকল কষ্ট সার্থক। ”

তারপর মুখে বললো, — এখন যাও! আমার কথা শেষ। কাপড়, জিনিসপএ সব জায়গা মতো রাখ। তা না হলে শরীর এখনো সহিসালামত আছে। কথা না শুনলে হাত, পা ভাঙতেও আমি একবার ভাববো না। মনে করো না বড় হয়েছো, পুলিশের চাকরি করছো বলে যা খুশি তাই করবে। তুমি যদি তোমার মায়ের মতো জেদি হও। তাহলে একটা কথা মাথায় রেখো। আমি তোমার মায়ের বোন। তোমার মায়ের সাথে আমিও একই সময়, একই সাথে গর্ভে ছিলাম। একই দিনে, একই সাথে পৃথিবীতে এসেছি। তাহলে আমি কতোটা জেদি হতে পারি।

রিমি আর দাড়ালো না। হনহনিয়ে চলে এলো। তার রুমে মুহুয়া আন্টি। সে চলে এলো ছাদে। ছাদে এসে সে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো । তার চোখে পানি। সেই পানি অনেকদিন পর টপটপ করে পড়তে লাগলো।

সাব্বির তার মুখের সামনে রুমাল এগিয়ে ধরলো। নাঈমের ফোন পেয়ে সে মাত্রই এসেছে। মাকে দেখে বের হতেই দেখলো রিমি হনহনিয়ে ছাদে যাচ্ছে।

রিমি কঠিন চোখে তাকালো। এই লোকের জন্যই যতো সমস্যা। কে বলেছে তাকে তার সাথে যাওয়ার জন্য। আবার পিছু পিছু ছাদেও চলে এসেছে। শান্তি নেই। কোন জায়গায় শান্তি নেই। মন খুলে একটু কাঁদবে এই ভুতের বাড়িতে সেই সুযোগও নেই।

সে ঝাড়া মেরে রুমাল নিলো। চোখ, মুখ মুছলো। কয়েকবার নাক ঝাড়লো। ঝেড়ে রুমাল সাব্বিরের পকেটে ঢুকিয়ে দিলো।

সাব্বির প্রায় লাফিয়ে উঠলো।– ইয়াক, ছিঃ কি করলে?
— যা করেছি বেশ করেছি। আবার যদি দেখেছি আমার আশে পাশে তো ডাইরেক্ট গায়ে। আমার কাছ থেকে দশ হাত দূরে। গুনে গুণে দশ হাত। বলেই রিমি চলে যেতে নিলো ।

সাব্বির রিমির হাত ধরলো! ধরে টেনে কাছে আনলো। তারপর হেসে বললো,— আচ্ছা থাকবো। এখন প্লিজ এটা পকেট থেকে বের করে দিয়ে যাও। আমি এটা ধরতে পারবো না।

রিমির আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা। সে অবস্থায় ই বললো, — এর জন্য আপনি আমাকে এভাবে টেনে এনেছেন?

সাব্বির ঠোঁট চেপে হাসি থামালো!
— হ্যাঁ ! তো আর কি করবো? তাড়াতাড়ি বের করো প্লিজ। সব জীবাণু শরীরে ঢুকে গেলো । ইশ! এতো শখের শরীর আমার।

রিমি ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো! বিরক্ত মুখে বললো — এর জন্যই তো ছ্যাঁকা খেয়ে ব্যাঁকা হয়ে আছেন। এখন বাকি জীবন সিঙ্গেল হয়ে বনে বাদাড়ে স্যানেটাইজার কোলে নিয়ে ঘুরেন। নিরামিষ কোথাকার। বলেই সাব্বির বাহুতে ধাক্কা দিলো। দিয়ে হনহনিয়ে চলে এলো । সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মনে হলো। পকেটে তার কিছু। সে সাথে সাথেই হাত দিলো।

সে সিঁড়িতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। একটা ছোট্ট সুন্দর কারুকাজের লাল বক্স। এটা কোথা থেকে আসলো? সে সাথে সাথেই খুললো। ভেতরে সুন্দর একটা আংটি তার পাশে ছোট্ট করে লেখা ” উইল ইউ ম্যারি মি অ্যাংরি বার্ড। ”

চলবে…….

#আনমনে_সন্ধ্যায়
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২৬

সকালে রিমি নিচে নামলো একেবারে রেডি হয়ে। তার বর্তমানে একটাই কাজ, সোজা থানায় যাওয়া। নাস্তার তার দরকার নেই। এমনিই ভালো। এই বাড়ির মানুষের কাছ থেকে যতো দূরে থাকা যায় ততোই ভালো। সে আর চায় না ঝামেলা হোক। অন্তত তার জন্য।

সে বের হবে তখনি পেছন থেকে ওবাইদুল ডাকলো।
— রিমি?

রিমি ফিরে তাকালো! সে তাড়াতাড়ি বের হওয়ার তাগিদে ডানে বামে খেয়াল ই করেনি। সে এগিয়ে এসে হালকা হেসে বললো,
— জ্বি আঙ্কেল?

— থানায় যাচ্ছো?

রিমি মাথা নাড়লো, সাথে বললো — হুম।

— যদি পনেরো বিশ মিনিট পরে যাও সমস্যা হবে?

রিমি না বোধক মাথা নাড়লো! সে ঠিক বুঝতে পারছে না। আঙ্কেলদের সাথে টুকটাক কথা হয়। তবে সেভাবে না। আবার কিছু হলো নাকি? ধুর! সেতো কিছু করেই নি। ভদ্র মেয়ে হয়ে আছে। বাড়ি টু থানা, থানা টু সোজা রুম। গত দু- দিন খাবারও খাচ্ছে রুমে।

ওবাইদুল স্নেহ মাখা কন্ঠে বললেন, — এসো।

রিমি কিছু বললো না। চুপচাপ তার পিছু পিছু এগিয়ে গেলো। নাস্তার টেবিলে আজ দুনিয়ার আয়োজন। ঘরোয়া তো ভালোই নান, তান্দুরি চিকেন, হালিম কোন কিছুই আর বাকি নেই।

— বসো।

রিমি কিছুই বুঝলো না। তবে তার সাথে সাথে সেও চেয়ার টেনে বসলো। এখনও কেউ টেবিলে আসেনি। সে আর আঙ্কেলই প্রথম।

সে বসতেই মুহুয়া আন্টি টেবিলে গরম গরম পরোটা রাখতে রাখতে বললো, — এই হাসি যা সবাইকে ডেকে নিয়ে আয়। না ডাকলে একটাও আসবে না। সব নবাবের বংশধর। আর আয়েশা চা টা তুই কর। আমার টা ভালো হয় না। সবই তো দেই তাও লাগে পানি পানি । কি জ্বালা দেখো তো। এতো কিছু রান্না শিখলাম এই চা কে শেখা হলো না।

রিমি হাসলো!
— আপনার শরীর কেমন এখন আন্টি?

মুহুয়াও হাসলো! রিমির মাথায় হাত বুলালো। মায়ামাখা কন্ঠে বললো,
— ভালো! মনে কিছু রাখিস না মা। সব জায়গায় পাঁচ আঙ্গুল তো সমান হয় না।

রিমি কিছু বললো না ! এই প্রথম মনে হলো। নিসা আর তার মধ্যে খুব একটা তফাৎ নেই। দু- জনেই সার্থপর। আমরা শুধু নিজের কথা ভাবি। তফাৎ তো এই মানুষগুলো। যারা ভালোবাসার অফুরন্ত ভান্ডার নিয়ে বসে আছে।

— আজকে কি কোন বিশেষ দিন আন্টি?

— না! বলার মতো বিশেষ নেই। আশিক ছেলেটা নাকি চলে যাবে। জামাই বাসায়। সে ভাবে তো কিছু করতেই পারলাম না। আর…

— আর?

— মাঝে মাঝে ফ্যামিলিতে এমনিই সাধারণ দিনকে বিশেষ দিন বানাতে হয়। যাতে সবাই একসাথে হতে পারে।

রিমি হাসলো! সাবাই বলে আন্টি বোকা। ভালো, মন্দ খুব একটা ধরতে পারে না। কিন্তু কিভাবে সবাইকে টেনে এক জোট করে বেঁধে রাখবে তা ঠিক জানে। এমন বোকা হতেও তো ভাগ্য লাগে । কি হবে এতো বুদ্ধি দিয়ে, যেখানে নিঃস্বার্থ ভাবে আপন মানুষগুলোকে যদি ধরেই না রাখা যায় ।

তখনি আস্তে আস্তে সবাই আসতে লাগলো। এমন কি নাদুও। রিমি অবাক হলো না। সেখানে তার মতো পর কে বেঁধে ফেলেছে। সেখানে নাদু মামা তো তাদের কাছের। তাকে কি আর এতো সহজেই যেতে দেবে।

সাব্বির ও আসলো। তাকে দেখে রিমি ফট করে দাঁড়িয়ে গেলো। সে এতোক্ষণ খেয়াল করেনি। সে আজও সাব্বিরের চেয়ারটায় ই বসেছে। ধুর… এই ভেজাল তার পিছু ছাড়বে না। ডানে বামে এতো চেয়ার সব রেখে এটাই বসতে হবে কেন?

নিসা আর নাদু বাদে সবাই মুখ টিপে হাসলো। রিমি অবশ্য ওতো শতো খেয়াল করলো না। সে সরতে চাইলো। সে সুযোগ অবশ্য পেলো না। ততোক্ষণে সাব্বির অন্য চেয়ারে বসে গেছে।

রিমি ভোঁতা মুখে আবার চেয়ার টেনে বসলো। বসে আড়চোখে তাকালো। সাব্বির ও একেবারে রেডি হয়ে বের হয়েছে। তার শান বান বজায় রেখেই এগিয়ে নিচ্ছে। । এমন ভাব, ভাব নেওয়া ছাড়া দুনিয়ার আর কিছু বুঝেই না। আর দেখো তলে তলে পুরো তাল গাছ কেটে ফেলেছে । ডাইরেক্ট বিয়ে! আরে বাবা পরিষ্কারগির প্রথমে প্রেমের ট্রেমের অফার দে। এক দুই বছর প্রেম ট্রেম করি। ফুসকা, বাদাম খাই। তা না! বেটার বউ লাগবে। কেন রে ধৈর্য্য আর কুলোচ্ছে না?

তখনি তার মোবাইলে টুং করে শব্দ হলো। মেসেজ এসেছে। সে বা হাতে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো। পাঠিয়েছে বাবা পরিষ্কারগির।

সে সাথে সাথেই সাব্বিরের দিকে তাকালো। জানা কথা কোন হেলদোল নেই। সে নিজের মনে খাচ্ছে। এ তো সবচেয়ে বড় ক্রিমিনাল! আকাম কুকাম করে, কিছুই করে না টাইপ চেহেরা করে বসে থাকে। কি দিয়ে যে আল্লাহ এরে বানাইছে সেই জানে।

সে চোখ ফিরিয়ে মেসেজ অপেন করলো, সেখানে হুমকি স্বরুপ লেখা “- মোড়ে দাঁড়াবে। আর মনে মনে যদি আমার গুষ্টি উদ্ধার করেছো না, তোমার খবর আছে। ”

রিমি মুখ বাঁকালো! বাঁকিয়ে সাইডে তাকালো। নিপা মুখ ফুলিয়ে খাচ্ছে। কেন খাচ্ছে অবশ্য সে জানে।
সে আশিকের দিকেও একবার তাকালো। এই পুরো টেবিলে চোখে মুখে খুশির ঝিলিক একমাত্র তার মুখেই দেখা যাচ্ছে। সে প্রায় নেচে নেচে খাচ্ছে। মায়ের ছেলে মায়ের বুকে যাবে। এর খুশি আর দেখে কে?

সে হাসলো! হাসতেই তার খালামণির দিকে চোখ পড়লো। আজকে অবশ্য চোখ, মুখ কুঁচকে নেই। সে খালুকে এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে। খালুও খুশি মনে খাচ্ছে। ইশ! সকালটা এতো সুন্দর কেন? নাকি ভালোবাসা সুন্দর? এই যে চারিদিকে ভালোবাসা ভালোবাসা একটা আবেশ। এই আবেশেই বুঝি সব কিছু এতো সুন্দর আর রঙিন মনে হয়। নাকি শুধু তার কাছেই লাগছে।

সেই রঙিন রঙিন আবেশে রিমি মোড়ে এসে সত্যিই দাঁড়ালো। দোকান থেকে চিপস কিনলো। খাওয়া শুরু করতেই সাব্বির এলো। ভাবওয়ালা এক মণ ভাব নিয়ে বললো,

— যাক আছো! আমিতো ভেবেছিলাম দাঁড়াবে না।

রিমি অবাক হওয়ার ভান করে বললো, — ওমা দাঁড়াবো না কেন? আমাকে এতো খারাপ মনে হয় বুঝি? এক টাকা খরচ করে ম্যাসেজ পাঠিয়েছেন। দাঁড়াবো না মানে, দরকার পড়লে কাঁথা, বালিশ, কম্বল নিয়ে এখানে শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করবো। এক টাকার একটা দাম আছে না।

তার ভান টানে সাব্বিরের তেমন কোন ভাবান্তর হলো না। যেন এই মেয়ের সব নাটকে সে অভ্যস্ত। সে স্বাভাবিক ভাবে রিকশা থামালো। থামতেই উঠে বসলো। মুখে কিছু বললো না, তবে সাইডে চেপে বসলো।

রিমি এগিয়ে গেলো! রিকশার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, — ভাড়া কে দেবে? আগেই ঠিক করে নেন। পরে আপনি ফায়ে ফায়ে কেটে পড়েন।

সাব্বির এবার কটমট করে তাকালো। রিমি সেই তাঁকানোর ধার ধরলে তো। সেও স্বাভাবিক ভাবেই উঠতে উঠতে বললো, — থাক না দিলেন। রিমি কলিজা বড়। এই বিশ ত্রিশ টাকায় তার কিছু আসবে যাবে না। শুধু রিমি বলে পার পেয়ে গেলেন।

বলেই সে বসলো! নড়ে চড়ে সাব্বির কে চাপিয়ে ফেললো। ফেলে হেসে বললো, — ঢাকার রিকশা! আমার কোন দোষ নেই।

সাব্বির কিছু বললো না। সে নির্বিকার চিত্তে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো। সে ভালো করেই জানে বিশ্বের যতো আজব আজব জিনিস আছে, তার আর দেখার প্রয়োজন পরবে না। কেননা বিশ্বের বাহিরের আজব চিজ সে নিজের ঘাড়েই বসাচ্ছে।

সে রিকশা চালাতে বললো। তার শরীরের অর্ধেক রিকশার বাইরে। সে মনে মনে ঠিক করলো। যদি সে পড়ে, এই ফাজিলটাকে সাথে নিয়েই পড়বে।

রিমি আরামছেই বসলো! বসে চিপস খেতে খেতে বললো, — একটা কান্ড ঘটেছে জানেন?

সাব্বির ভ্রু কুঁচকে তাকালো! তাকিয়েই বললো,
— কি ?

— কে জানি আমাকে প্রপোজ করলো। আজব ব্যক্তি। নাম, ঠিকানার খবর নেই। পকেটে রিং রেখে হাওয়া। আরে বাবা আমার কি দৈবশক্তি আছে, যে রিং দেখেই বুঝে যাবো! শোয়ার সময় ছাড়া দিন, রাত কাটে আমার এই ইউনিফর্মে। কোথায় কোথায় যাই ঠিক নেই। কি করে বুঝবো কে? আর কি করেই আমি উত্তরটা দেব বলেন তো? এখন কি আমি জনে জনে গিয়ে জিজ্ঞেস করবো? আপনি কি আমাকে প্রপোজ করেছেন?

সাব্বির এবার হাসলো! হেসে বললো, — উত্তর লিখে পকেটেই রেখে দাও। পকেটে যখন রিং রাখতে পেরেছে, উত্তরও নিয়ে নিতে পারবে।

রিমি মুখ বাঁকালো! সাব্বির আবারো হাসলো! তবে কিছু বললো না। কিছুক্ষণ এভাবেই নীরবতায় কেটে গেলো। রিমির চিপস খাওয়ার কচর মচর শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা গেলো না ।

সেই কচর মচর করতে করতে রিমিই আবার বললো,
— দাঁড়াতে বলেছিলেন কেন?

— এমনিই তেমন কোন কারণ নেই।

— ও। বলেই রিমি চিপসের প্যাকেট মুড়িয়ে গোল বানালো। চিপস শেষ। দশ টাকায় আর কতো থাকবে। সে গোল করে, ঠেলে সাব্বিরের প্যান্টের পকেটে ডুকিয়ে দিলো। দিয়ে হাত ঝেড়ে বললো,
— আমি ভাই দেশের সেবক। প্যাকেট, টেকেট ফেলে দেশ নোংরা করতে পারবো না।

সাব্বির আগের মতোই নির্বিকার ভাবে বললো, — গুড! আরো কিছু থাকলে সেটাও দিয়ে দাও। এর পর থেকে প্যান্টের চেয়ে পকেট বানাবো বড়। দেশ সেবায় বাঁধা দেই কি করে।

রিমি ঠোঁট টিপে হাসলো। রিকশা ভার্সিটি পেড়িয়ে গেলো! সাব্বিরের নামার কোন হেলদোল দেখা গেলো না। রিমি তাকিয়ে বললো, — ভার্সিটিতে যাবেন না?

— যাবো?

— তাহলে নামলেন না কেন?

— রিকশায় ঝুলে ঝুলে যেতে ভালো লাগছে। বাঁদর বাঁদর ফিলিং পাচ্ছি।

রিমি এবার হেসেই ফেললো! হেসে বললো, — কেন এসব করছেন বলুন তো?

— তুমি জানো।

রিমি বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে পকেট থেকে রিং এর বক্সটা বের করে সাব্বিরের হাতে দিয়ে বললো, — এটা সম্বভ না ।

সাব্বির বক্স নিয়ে হাতে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো। তারপর বললো, — কেন?

— আপনি ভালো একটা মেয়ে ডিজার্ভ করেন।

— তুমি বলতে চাইছো তুমি ভালো না?

— আমি কি বলতে চাই সেটা ম্যাটার করে না।

— কেন?

— আমি আপনার জন্য ঠিক না।

— সেটা ডিসাইড করবে কে তুমি?

রিমি উত্তর দিলো না। চুপচাপ বসলো।

— এতো কথা প্রেমে পড়ার আগে মনে ছিলো না?

— এতো মনে টনে করে কি কেউ প্রেমে পড়ে? বিশ্বসুন্দরা আপনি। এতে আমার দোষ কি? আমি তো আর যোগী সন্ন্যাসী না। যে ধ্যান তপস্যা করে নিজেকে দমাবো। আর তাছাড়া পড়লে পড়েছি। এতে আপনার সমস্যা কি? আমিতো বলছি না। আমার প্রেমের জন্য আপনি আমাকে বিয়ে করেন।

সাব্বির ফুস করে শ্বাস ফেললো ! কি পাগলের পাল্লায় যে পড়েছে । সে বক্স খুললো। রিমির হাত টেনে আংটি পরিয়ে দিলো। দিয়ে বললো, — প্রেমে পড়ার শাস্তি।

— সেটা তো আপনাকে দেখে অনেকেই পড়ছে। সবাইকেই ধরে ধরে এই শাস্তি দিচ্ছেন নাকি?

— না! সবাই তো আর তোমার মতো কু- নজরে তাকায় না। তাই শুধু তোমাকেই দিলাম।

— আবারো ভেবে দেখেন। আমি কিন্তু এতোটুকুও বদলাবো না । পরে গিয়ে পস্তাবেন।

— সেটা তো আমিও বদলাবো না। তাই দেখি কে পস্তায়।

রিমি আঁতকে উঠলো। উঠে বললো,
— আল্লাহ! দু- মেরুর দু- মানুষ আমরা। ভবিষ্যৎ তো বিপজ্জনক।

— হ্যাঁ অবশ্যই! তোমারটা বলতে পারছি না, তবে আমারটা অবশ্যই বিপজ্জনক।

— তবুও আপনার আমাকেই বিয়ে করতে হবে?

— হ্যাঁ!

রিমি ঢোক গিললো! মনে মনে কিছু চিন্তা করে আল্লাহ বলে শিউরে উঠলো। তারপর করুণ মুখে বললো, — আচ্ছা! ঠিক আছে! প্রেম ট্রেম হয়েছে ভালো। সমস্যা নেই। ঘুরি ফিরি বাদাম খাই। বিয়ের চিন্তাভাবনা এখন থাক। গরম টরম আসুক তারপর ধীরেসুস্থে দেখা যাবে।

সাব্বির হো হো করে হেসে উঠলো! সে ভুলেই গেলো সে এখন রিকশায়। তার শরীর অর্ধেক ঝুলে আছে। সে পড়ে যেতে নিলো।

রিমি টেনে ধরলো। রিকশাওলাকে ধমকে বললো, — আরে বেটা থাম, আর কতো যাবি? ভার্সিটি, থানা সব পেছনে। যা রিকশা ঘোরা ।

চলবে…….