#আনমনে_সন্ধ্যায়
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ৩৩ ( শেষ পর্ব)
রিমিকে যখন হসপিটালে আনা হলো তখন সন্ধ্যা। আগেই ইনফ্রম করা ছিলো। সাথে সাথেই তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়েছে। তার অবস্থা ভালো না খারাপ শামীম বুঝতে পারছে না। রক্ত অনেকটা’ই বেরিয়েছে। এই অবস্থায় এই মেয়ে বসে ছিলো কিভাবে এটাই তাকে অবাক করছে। তাছাড়া হয়েছেও কি সেটাও সে বুঝতে পারছে না।
ওলীদের শরীরে কোন হাতা পায়ের চিহ্ন নেই। দেখে ফিটফাটই মনে হয়েছে। আর রিমির যে অবস্থা? এই অবস্থায় এরকম সুস্থ, সবল মানুষের গলা কাটা অস্বাভাবিক।
সে ভাবতে ভাবতেই সাব্বিরের দিকে তাকালো! এক কর্নারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে শার্ট রক্তে মাখামাখি। পুরো রাস্তা এক বারের জন্যও রিমিকে ছাড়েনি। এম্বুলেন্সেও জাপটে বসে ছিলো। রিমির কপালে হাজার কষ্ট থাকলেও এই দিকে সে ভাগ্যবতী। আজকাল যুগে এরকম ভালোবাসা বরই দুর্লভ বস্তু।
সে হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে এলো ! থানায় যেতে হবে। কাজ তো আর একটা না। এখানে অবশ্য অর্ধেক থানা চলে এলেছে। মিথিলা, রুমেল তো ভালোই আরো কনস্টেবল রাও এসে হাজির । আবার নাকি এই মেয়ের কেউ নেই। আত্মীয় – স্বজনও তো হসপিটাল ভরে গেছে।
আয়েশা নিঃশব্দে সবাইকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো! খবর পেয়ে সবাই চলে এসেছে। এমন কি রিমির দাদি বাড়ির মানুষও। অনেক দিন পরে সে আনিসকে দেখলো। মনে হয় অসুস্থ! শুকিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর পর শার্টের কোনা দিয়ে চোখের পানি মুছছে। তাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে রিমির মতোই দেখতে একটা ছেলে।
রিমির জন্মের সময় কেউ ছিলোনা। আয়মানের মৃত্যু রাস্তায় হয়েছিলো। খবর পেয়ে যখন সবাই হসপিটালে গেলো। এক আয়া কোলে নিয়ে বসে। আয়েশাই প্রথম এগিয়ে গেলো। সবাই আয়মানের জন্য আহাজারি করছে। এদিকে রিমির প্রতি কারোই না ছিলো খেয়াল, না ছিলো আগ্রহ।
তবে আজ এতো কেন? আয়মান ভুল ছিলো! তবে সে কি শাস্তি পাইনি? অনুতপ্ত মানুষের বড় শাস্তি। সেটা সে করেছিলো। আর নিজের সন্তান! যার জন্য এতো লড়াই। তাকে একটি বারের জন্যও বুকে নেওয়া তো ভালোই চোখের দেখাটাও না দেখা। এর চেয়েও বুঝি আর বড় শাস্তি আছে?
আয়মান দোষী ছিলো, রিমি না। অনাকাঙ্খিত ছিলো, ভুল ছিলো তবে সুধরে নেওয়া যেতো। আয়মানতো চলেই গিয়েছিলো। রাস্তার পড়ে থাকা একটা নিষ্পাপ শিশুকেও তো আগলে নেওয়া যায়। আর এখানেতো নিজের সন্তান। তাকে গ্রহন করতে আরেক জন কে বিয়ের শর্ত দিতে হবে কেন? এখানে তো তার নিজের ভালোবাসারও অপমান! এই অপমানটারই কি কোন প্রয়োজন ছিলো। তার প্রতি আর সম্মান থাকবেই বা কি?
আনিস যদি তখন রিমিকে আগলে ধরতো, হয়তো ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যেতো। এখনের মতো এই পরিস্থিতি আসতোই না। সবাই আয়মানের দোষ দেখে অথচো যার যার জায়গায় থেকে প্রত্যেকে সমান দোষী।
আয়মান ভালোবেসে হয়েছে অন্ধ! আনিস হারিয়েছে বিবেক। আর আয়েশা? সে হয়েছে নিঃস্ব। নিজের পরিবার, বিশ্বাস, বোন, ভালোবাসা সব।
সেই সব হারিয়ে সে এই একজন কে পেয়েছে। যে তাকে সব জেনে, বুঝে আগলে ধরেছে।
আয়েশা চোখ বন্ধ করে রেজাউলের কাঁধে মাথা রাখলো। তার সব কষ্টে সমাপ্তি এখানে। রেজাউল ও তাকে যত্ন করে আগলে ধরলো। ধরতেই চোখের কার্নিশ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
সে জানে না এই ত্রিমুখী গল্পে কে খারাপ, কে ভালো, কে দোষী। তবে হয়তো সবচেয়ে ভাগ্যবতী সে’ই। আল্লাহ সব নিয়েও তাকে রেজাউলের মতো মানুষ দিয়েছে, যে তার দিকে কখনো আঙ্গুল তুলেনি, বরং ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে সব দুঃখ কষ্ট দূর করেছে।
সাব্বির ও তেমন! এই বাড়ির ছেলেরা ভালোবাসতে জানে। মন প্রাণ উজার করে । সে জানে তার মতো রিমিও ভালো থাকবে। সাব্বির তাকে ভালো রাখবে। রিমির যতো দুঃখ কষ্ট, তার মতোই ভালোবাসা দিয়ে মুড়িয়ে নিবে।
আয়েশা কাঁধে মাথা রেখেই তার মায়ের দিকে তাকালো! ভালো ভাবে কথা বলা হয় না অনেক দিন। বয়স হয়েছে! সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তার পাশেই বসে আছে। গুনগুন করে কাঁদছে। আয়েশা মৃদু হাসলো! তাচ্ছিল্যের হাসি। নিজের পেটের মেয়েদেরই হতে পারেনি আবার নাতনীর। একটু যদি মানুষ হতো রিমির দূর্ভাগ্য কিছুটা হলেও ভালো হতো।
অপারেশনের পরে রিমিকে আই সি ইউ তে সিফ্ট করা হলো। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। মাথার আঘাতটা বেশ গভীর ছিলো। সময় মতো তো কিছুই করা হয়নি। শুধু তুলো গুজে ব্যান্ডেজ করা ছিলো। ঠোঁট সেলাই করা হয়েছে। দেখতে ভয়ংকর লাগলেও কাটা ওতো গভীর ছিলো না। শুধু টান দেওয়া হয়েছে। তবে রক্ত দিতে হয়েছে প্রচুর।
পুলিশ, রিমির আত্মীয় স্বজনে হসপিটাল ভরে গেছে। হসপিটাল কর্তৃপক্ষ সব ক্লিয়ার করতে বললো। এতো লোক তারা এলাউ করে না। শুধু পুলিশ বলে এতোক্ষণ কিছু বলেনি।
রিমির জ্ঞান ফিরলো শেষ রাতে। নার্স এসে জানালো। সাব্বির নড়লো না। আশিক এগিয়ে গেলো। সে সবাইকে জোর করেই বাসায় পাঠিয়েছে। কারোই নাওয়া, খাওয়া নেই। ফুপুর অবস্থাও ভালো না। তাই ফুপাকে জোর করেই পাঠালো সবাইকে নিয়ে। সাব্বিরকে অবশ্য কিছু বলার সাহস হয়নি। সে ভালো করেই জানে সে নড়বে না।
সে বাইরে থেকে কাচের হোল দিয়ে রিমিকে দেখলো। সকাল হওয়ার আগে মনে হয় না কাউকে ঢুকতে দেবে। অবশ্য ঢুকেও কোন লাভ নেই। মাথা, মুখ সব ব্যান্ডেজ। কথা বলাও তো সম্ভব না। দু- ঠোঁটের মাঝামাঝি কেটেছে জানোয়ারটা । সেখানে সেলাই করা হয়েছে।
সে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার সাব্বিরের পাশে এসে বসলো। পুরো রাতে সাব্বির একটা কথাও বলেনি। মূর্তির মতো চুপচাপ বসে ছিলো।
সে বসে নিজের মতো করেই বললো, — দাদার মৃত্যুর পরে.. আপনার হয়তো মনে আছে। ছোট চাচির ভাই হঠাৎ করেই হসপিটালে। তার অবস্থা খারাপ। কি হলো, কি হয়েছে কেউ’ই কিছু বুঝলো না। হয়তো আপনি কিছুটা জানতেন। রিমি বলেছিলো। ঐ বাড়িতে রিমি শুধু টুকটাক আমার সাথেই কথা বলতো।
রিমির মধ্যে অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার আছে। আমার ধারণা আপনি সেটা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন। ছোট বেলা একবার পালিয়ে গেলো, তখন থেকে তার এই সমস্যা। গ্রাম গঞ্জের মানুষ তো সবাই অন্য কিছু মনে করে। আসলে তেমন কিছু না। এটা মানসিক সমস্যা।
সাধারণ, স্বাভাবিক একটা শৈশব, কৈশোর টা তো সে পাইনি। আদর, ভালোবাসাও না। এক কথায় বলতে গেলে অবহেলিত, লাঞ্ছিত।
তাই যখন পালিয়ে গেলো ছোট মানুষ রাত ছিলো, থাকার জায়গা ছিলো না। ভয়, কষ্ট, মানসিক চাপ থেকে সে কল্পনা করে নিয়েছে একজন এসেছিলো যে তাকে আগলে নিয়েছে।
দেখে অবশ্য বোঝার উপায় নেই। সব সময় স্বাভাবিক। কিন্তু যখন অতিরিক্ত মানসিক চাপ পড়ে,তখন এরকম হয়। তার ধারণা কেউ এসে সব বিপদ থেকে রক্ষা করে। আসলে এটা সে নিজেই। গ্রামের মানুষ এসব বুঝে না। আশাকরি আপনি হয়তো বুঝতে পারবেন।
সাব্বির এবারো কিছু বললো না! উঠে দাঁড়ালো! তার কোন কিছু নিয়েই ভাবতে ভালো লাগছে না। সে শুধু জানে রিমিকে সে ভালোবাসে। যা হবে, যা হোক, সে রিমির পাশে থাকবে। থাকনা কিছু অস্বাভাবিক! এটায় যদি রিমি নিজেকে সেইভ ভাবে এটাই সই। তবে একটা জিনিস তার খটকা লাগছে।সেটা হলো ঘ্রাণ! রিমি ভেতরে অস্বাভাবিক ব্যাপার থাকতে পারে। তার ভেতরে তো না।
রিমির পুরোপুরি জ্ঞান ফিরলো সকালে! সে চোখ খুলেই সাব্বির কে দেখলো। উষ্কখুষ্ক চুল, ক্লান্ত চেহেরা, রক্ত শুকিয়ে চট হয়ে যাওয়া শার্ট নিয়ে দরজার সাইডে দাঁড়িয়ে আছে।
এই ছেলে নাকি একটুকুও বদলাবে না। অথচো দেখো, এখনো বিয়ে তো ভালোই, ভালোভাবে প্রেমটাই হলো না। এখনি পুরোপুরি বদলে এলোমেলো হয়ে গেছে।
তার হাসি পেলো! অবশ্য হাসতে পারলো না। বরং ঠোঁটে টান লেগে চোখ কুঁচকে ফেললো।
সাব্বির দাঁতে দাঁত চেপে বললো, — জ্ঞান না ফিরতেই বাঁদরামি শুরু। তবুও ভালো মুখ বন্ধ, তা না হলে হেঁয়ালির রেল গাড়ি ছুটতো।
রিমি তাকিয়ে রইলো! তার খুব খুব ইচ্ছে হলো, এই যে প্রশস্ত বুকটা। সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়তে। ইশ!
সাব্বির বিরক্তি নিয়ে বললো — ডাক্তারের উচিত ছিলো তোমার চোখেও ব্যান্ডেজ করা, কুনজরি। হসপিটালের বেডে শুয়ে শুয়েও এখানে ওখানে তাকঝাঁক । ফাজিলের ফাজিল!
রিমির এবারো হাসি পেলো! তার এক হাতে ক্যানোলা! আরেক হাতের আঙুল নাড়িয়ে সাব্বির কে কাছে ডাকলো। এই লোক মুখে তো রাগ ঝাঁড়ছে তবে চোখ চিকচিক করছে। আমার মতো মেয়েকে এই যে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসলেন। এর বিনিময়ে আমি কি দেবো বলেন তো? শূণ্য আমি!
সাব্বির নড়লো না! দাঁড়িয়েই রইলো! কাছে গেলে নিজেকে সামলাতে পারবে না।
রিমি এবার চোখ গরম করে তাকালো! সাব্বির দেখেও দেখলো না। রিমি চোখ গরম করেই তাকিয়ে রইলো। মনে মনে বললো, বাবা পরিষ্কারগির! একবার শুধু সুস্থ হই। তারপর দেখাছি।
সাব্বির বেরুতেই আয়েশা আসলো। আয়েশা অবশ্য কিছুই বলতে পারলো না। সে শুধু রিমির হাত শক্ত করে ধরে রাখলো। আর আকুল হয়ে কাঁদলো। চলে আসার আগে কপালে ব্যান্ডেজ উপরেই আলতো করে চুমু খেলো।
আর রিমি বিস্ময়ভরা চোখে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো। তার মনে হলো এটা আয়েশা না। তার মা! রাগি, জেদি, খারাপ যাইহোক রিমিকে অসম্ভব ভালোবাসার মায়া মমতাময়ী মা।
তারপর অনেকটা দিন পরের কথা। রিমি এখন মোটামুটি সুস্থ! তার কোমর সমান চুল কেটে ফেলা হয়েছিলো। এখন একটু বড় হয়ে ঘাড় পর্যন্ত নেমেছে। মুখের দাগ অবশ্য মুখের জায়গা মতোই আছে। আরেকটা সার্জারি করাতে হবে। তবে কেউ’ই এখন আর রাজি হয়নি। পরে দেখা যাবে।
রিমির দাদি, নানির বাড়ির লোক নিয়মিত খোঁজ খবর নিচ্ছে। এতে অবশ্য রিমির কোন হেলদোল নেই।
পরেরদিন যখন তাকে কেবিনে সিফ্ট করা হলো। সেখানে আনিস গিয়েছিলো দেখা করতে। কথা তো বলা সম্ভব না। তবে রিমি কোন রিয়েক্ট ও করেনি। তবে আনিস অনেক সাহস নিয়ে রিমির মাথায় হাত রেখেছিলো। রেখে বলেছিলো, — আমাকে ক্ষমা করতে হবে না। এই যে মাথায় হাত রাখতে দিলে। এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। আর তোমার মাকে আমি ক্ষমা করলাম। তার প্রতি আমার আর কোন ক্ষোভ নেই।
রিমি তাও কিছু বলে নি। এখনো কিছু বলছে না। সে তার মতোই আছে বিন্দাস। এতো বড় ঘটনা ঘটে গেছে তার মধ্যে সেই রেশ বিন্দুমাত্রও নেই। অন্য সব মেয়ে হলে এই ট্রমা থেকে বের হতেই সময় লাগলো বছর খানেক। তবে রিমির মধ্যে তেমন কোন হেলদোলও নেই।
আর নেই বলেই সাব্বিরের ভয় হয়। অন্য রকম একটা ভয়! সে অবশ্য সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে কথা বলেছে।
সে বলেছেন, “এটা নিঃসন্দেহ মানসিক রোগ। ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার। স্প্লিট পার্সোনালিটি ও বলতে পারেন। সাইকোলজিতে এরকম অসংখ্যা কেস আছে। শৈশব কাল বিশেষ করে পাঁচ বা ছয় বছরের মধ্যে কোন অ্যাকসিডেন্ট যেমন- ধর্ষণ, সহিংসতা, অবহেলা, প্রিয়জন হারানো এসব কষ্ট তারা নিতে পারে না। নিতে না পারার কারণে একাধিক রুপ তাদের অজান্তেই তাদের ভেতরে সৃষ্টি হয়। আর সেটা সময়ের সাপেক্ষে বেরিয়ে আসে। এখানে আলৌকিক কিছু নেই। আর ফুলের ঘ্রাণ। রিমির নানা বাড়ির পেছনে নানা রকম গাছ ছিলো। ফুলের গাছ থাকাও স্বাভাবিক। আপনি সেই ঘ্রাণই পেয়েছেন। যেহেতু সে সময় আপনি একটা অস্বাভাবিক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। সেটাই আপনার মনে দাগ কেটেছে। মস্তিষ্ক সেটাই সেট করে রেখেছে।
আবার মেয়েটা নিখোঁজ হওয়ার পরে আপনি টেনশনে সারারাত ছিলেন নির্ঘুম, ক্লান্ত, বিদ্ধস্ত। সেই একই দৃশ্য যখন আপনার মস্তিষ্ক পুনরায় দেখলো। সেই সেট করা অংশ থেকেই সেরকমই একটা সিগন্যাল এসেছে। আসলে সেখানে কোন ঘ্রাণ ছিলো’ই না। যেমন ধরুন একটা আপনার পছন্দের খাবার আপনি খেলেন। খুব আগ্রহ মজা নিয়েই খেলেন। অনেকদিন পরে সেই খাবার টাই অন্য একজনকে আপনার মতোই আগ্রহ করে খেতে দেখলে। তখন আপনার সেই খাবারের দৃশ্যটা একেবারে হুবুহ চোখের সামনে ভাসতে থাকবে এমনি সেই ঘ্রাণ, সেই স্বাদ কিছুটা হলেও আপনি অনুভব করবে পারতে পারবেন ।
মস্তিষ্ক খুব ক্রিটিক্যাল সাব্বির সাহেব। এটা কি কি করতে পারে আপনি ধারণাও করতে পারবেন না। রিমির টাও ঠিক তেমনি। তাকে আগলে নেওয়ার মতো কেউ ছিলো না। বড় হয়েছে একটা অসুস্থ পরিবেশে। মাকেও খুব মিস করতো। এই ডিপ্রেশন থেকেই তার মস্তিষ্ক একজনকে বের করেছে। যে তাকে আগলে রাখে। বিপদে এগিয়ে আসে। এরকম মনোবিজ্ঞানে নতুন কিছু না। তার যেটা দরকার সেটা হলো প্রপার কেয়ার। এসব রোগীর ক্ষেএে ঔষুধের চেয়ে যত্ন, ভালোবাসা বেশি কার্যকরী হয়।
সাব্বির সবই শুনেছে, বুঝেছে। তবুও কোথায় যেন একটু খটকা থেকেই যায়। না এতে তার সমস্যা নেই। তবে রিমির জন্য ভয় হয়। সে ঠিক করেছে মানসিক চাপ পড়বে এমন কোন কাজ সে করতেই দেবে না। তবে সমস্যা হলো এই মেয়ে কারো কথা শুনেই না। সে চাচ্ছে এই চাকরি আর করার দরকার নেই। লেখা পড়া আবার শুরু করুক। অন্য কিছু করুক। শুনলে তো!
রিমি এখন ছুটিতে আছে। কেসটা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। এমপির সাথে তো আর পারা সম্ভব না। তবে পুরোপুরি না! কন্ট্রাক্ট কিলার, কিডন্যাপ, এটেম্পট টু মার্ডার এসব বেসিকে রির্পোট করা হয়েছে। তবে যেহেতু বেঁচে নেই কাদের জন্য কাজ করতো সেগুলোর প্রমান নেই বলে সেইটুকু ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে।
ওলীদের লাশ তার মা, বোনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ওলীদের মা নাকি রিমির সাথে দেখা করতে চেয়েছিলো। কেন চেয়েছিলো কে জানে। তবে সাব্বির রাজি হয়নি। কোন দরকার নেই চেনা জানার। দূরে থাকাই ভালো।
কাল সাব্বিরের জন্মদিন! রিমি অবশ্য জানতো না। নিপা আর আয়াশ এসে চুপিচাপি বলে গেলো। রাত বারোটায় ছাদে তারা ফ্যামিলি সারপ্রাইজ পার্টি রেখেছে, সেটাই বলে গেলো। আর এই সুন্দরাকে ঠিক সময়ে ছাদে নেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে গেলো।
এখন বাজে এগারোটা চল্লিশ। সে সাব্বির কে ম্যাসেজ পাঠালো! পনেরো মিনিটের মধ্যে ছাদে আসবেন। না হলে, আমাদের না হওয়া প্রেমটা একেবারে ব্রেকআপ। আর হ্যাঁ! আপনার সাদা পাঞাবি আছে সাব্বির? কতোদিন কু- নজরে তাকায়ই না। চোখ, মন, ইত্যাদি ইত্যাদি ব্যথা করছে। ইশ! এতো শখের চোখ, মন আমার।
পাঠিয়ে রিমি হাসলো! কিছুদিন হলো রাগ করে আছে, কথা বলছে না। সাব্বির চাচ্ছে চাকরিটা আর না করতে। রিমি এখনো ওতো কিছু ভাবেনি। দেখা যাক!
ভেবেই রিমি আয়নার সামনে দাঁড়ালো! মাথায় এক সাইডে সিঁথি কাটলো। কেটে চুল মুড়িয়ে মুড়িয়ে কানের পাশে এনে একটা ক্লিপ লাগালো। খাড়া সিল্কি চুল। কপালে এসে বিরক্ত করে। তার কাছে বরই অসহ্য লাগে।
সে আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো। গরম পড়েছে! গায়ে তার ঢিলেঢালা সাদা গেঞ্জি আর প্লাজু। রাতে এগুলো পরেই ঘুমায়। তাকে দেখতে এখন লাগছে তোরো চৌদ্দ বছরের কিশোরীর মতো। আগের চেয়ে আরো শুকিয়েছে তাই বয়স আরো কম লাগছে।
সেই দিনতো মুহুয়া আন্টি এক প্লেট ভাত টিপে চেপে, চুপে খাওয়াতে খাওয়াতে বললো, — চার বেলা ভাত খাবি। ভাতের চেয়ে বড় ঔষুধ আর আছে। ইশ! তোকে তো দেখে আমার ভয়ই হয়। কখন না জানি আবার মাঝখান থেকে পুট্টুস করে ভেঙেই যাস।
রিমি হাসলো! একটা নিজের আপন মানুষ চেয়েছিলো। পুরো এক গুষ্টি দিয়ে দিয়েছে। এজন্যই বলে, তোমাদের জন্য যা উত্তম, সময় হলে আল্লাহ ই দেবেন। দশ গুন বেশি ই দেবেন।
সে হেসেই গায়ে ওড়না চাদরের মতো জড়ালো। জড়িয়ে বেরিয়ে আসলো।
সাব্বির অবশ্য ঠিক সময়েই ছাদে আসলো!গায়ে তার সাদা পাঞ্জাবি। রিমির মনে হলো শুভ্রতায় মোড়ানো একটা সাদা পদ্ম ফুল।
তখনি সবাই এক সাথে হ্যাপি বার্থডে বলে চেঁচিয়ে উঠলে। সাব্বির হাসলো! সে অবশ্য এরকমই কিছু একটা ভেবেছিলো। তা না হলে রিমি তাকে একা ছাদে ডাকবে? এও সম্ভব! এই মেয়ে হসপিটাল থেকে এসে তার সাথে লুকোচুরি খেলছে।
সে হেসেই রিমির দিকে তাকালো। রিমি চোখে মুখে মুগ্ধতা নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সেও তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ে কি জানে সেও এরকম মুগ্ধ ভরা চোখে তার দিকে কতোবার তাকায়?
রিমি ভেংচি কাটলো! সাব্বির আবারো হেসে ফেললো! হেসে ম্যাসেজ পাঠালো, — ফুসকা, বাদাম তো খাওয়ার ভাগ্য হলো না। গরম ও তো এসে পড়লো। এখন কি অন্য কিছু ভাবা যায়?
রিমি মেসেজ দেখলো! উত্তর দিলো না। সব শেষে সবাই যখন নিচে গেলো। সাব্বির চুপচাপ এক কর্নারেই দাঁড়িয়ে রইলো।
রিমি হাসলো! যেতে গিয়েও আবার ফিরে এলো! এসে সাব্বিরের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
— কি চাই?
— রিমি।
— ভেবে বলছেন?
— হ্যাঁ!
— আমার অনেক কিছু বলার আছে।
— সব শুনবো, তবে কবুল বলার পরে।
— শুনে যদি মনে হয় আপনি ভুল করেছেন তখন?
— তুমি আছো না। সাহসী, রাগি, জেদি সব সুধরে দেবে।
রিমি মুখ বাঁকালো, বাঁকিয়ে বললো — চেহেরা দেখেছেন আমার?
তখনি সাব্বির ঘুরলো! রিমির ঢিলেঢালা গেঞ্জির কার্নিশ ধরে টেনে কাছে আনলো। এনে পকেট থেকে আংটি বের করে রিমির হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বললো,
— আমি খুবই ভদ্র টাইপ ছেলে! তাই যা যা দেখার সব বিয়ের পরেই দেখবো। বলেই রিমির কাটা সেলাই করা ঠোঁটের উপরে টুপ করে চুমু খেয়ে ফেললো।
তারপর নির্বিকার ভাবে যেতে যেতে বললো,– আমি সত্যিই ভদ্র ছেলে! ওটা তো তুমি দেখতে বললে তাই একটু নড়চড় হলো। আর কান খুলে একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নাও। চাচি যদি বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। ডাইরেক্ট হ্যাঁ চাই। যদি ঊনিশ বিশ করেছো রিমি। শীত চলে গিয়েছে তো কি হয়েছে। সোজা ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখবো।
বলেই ভাবওয়ালা তার রেড কার্পেটের ভাব নিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেলো! রিমি হেসে ফেললো! হেসে হাতের দিকে তাকালো! সেম ডিজাইনের আংটি। জন্মদিন নিজের অথচো গিফ্ট দিয়ে গেলো তাকে।
সে হেসেই আকাশের দিকে তাকালো। এখন অবশ্য আকাশ বিষন্নতার চাদরে মুড়িয়ে নেই। ঝলমলে তারা ভরা আকাশ! চাঁদ ঝিলমিল করে হাসছে । একদম তার মতো।
সে চোখ বন্ধ করলো। বুক ভরে নিশ্বাস নিলো। কোন ঘ্রাণ অবশ্য নেই তবুও সে ফিসফিস করে বললো, — থ্যাঙ্কিউ।
বলেই রিমি নিচে নেমে এলো! তখনি শীতল মৃদু বাতাস আর মিষ্টি একটা ঘ্রাণ পুরো ছাদে ছড়িয়ে গেলো।
#সমাপ্ত
#আনমনে_সন্ধ্যায়
#নূপুর_ইসলাম
#বোনাস পর্ব
রিমি পুকুরের সাইডে এসে দাঁড়ালো! লাল টকটকে সূর্য ডুবুডুবু করছে! এখনো পুরোপুরি সন্ধ্যা নামেনি, তবুও গাছগাছালির জন্য বেশ অন্ধকার। সে চোখে মুখে বিস্ময় নিয়ে আশপাশ দেখলো! সে এখানে এলো কিভাবে? সে তো ঠিক করেছিলো রংপুর আর আসবে না। তো?
সে ভাবতে ভাবতেই একটু ভেতরের দিকে আসলো! ইশ! কতো স্মৃতি যে এখানে। তখনি ঝাঁঝালো, তীক্ষ্ণ একটা দুর্গন্ধ তার নাকে লাগলো। সে সাথে সাথে ওড়না দিয়ে নাক, মুখ চেপে ধরলো। গন্ধ আসছে কোথা থেকে?
সে নাক, মুখ চেপেই আরেকটু এগুলো! কেন এগুলো সে নিজেও জানে না। না জানে এখানে আসার কারণ। সে কিছুদূর এগুতেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। তার পেছনে কেউ আছে। পেছন বলতে খুব কাছে। সে তার অস্তত্বি বুঝতে পারছে আর গন্ধ তার থেকেই আসছে।
সেই তীব্র গন্ধে রিমির গা গুলিয়ে উঠলো! সে নাক, মুখ আরো শক্ত করে চেপে ধরলো! তবুও কি তীক্ষ্ণ! যেন শরীর, ব্রেইন সব কিছুর শিরায় শিরায় পৌঁচ্ছে যাচ্ছে। সে ঘামতে লাগলো! শ্বাস- প্রশ্বাসের গতি আরো দ্রুত হলো। তখনি কানের কাছে ফিসফিস করে কেউ বললো,
— কেমন আছো রিমি?
রিমি কেঁপে উঠলো! এই কন্ঠ যে তার চেনা। ভীষণ ভীষণ চেনা।
সে হাসলো!
— ইশ! এভাবে কেঁপে উঠো না রিমি! তোমার ভয় আমাকে রোমাঞ্চিত করে। বলেই একটা আঙ্গুল আলতো করে রিমির ঘাড় থেকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ধীরে ধীরে নিচে নামলো।
রিমি শক্ত হয়ে গেলো।
— আমার সাথে যাবে রিমি?
রিমি উত্তর দিলো না! সে চোখ মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইলো।
— আমি তোমাকে নিয়ে যাবো ! কতো শাস্তি যে জমা হয়েছে তোমার। ধীরে ধীরে যত্ন করে দেবো। পারলে এবার তোমার সেই জনকে ঠেকাতে বলো।
তখনি রিমি ঝট করে ঘুরে দাঁড়ালো! কেউ নেই! চারপাশ শূণ্য! তবে একটা দুর্গন্ধ তাকে ঘিরে আছে। সে দৌড়াতে চাইলো। তখনি কেউ তার হাত টেনে ধরলো! টেনে এক ঝটকায় কাছে নিয়ে আসলো।
রিমি এবার দেখলো! দেখে শিউরে উঠলো! একটা রক্ত মাংসের শরীর। আর কিছু নেই, কোন চামড়া নেই। চোখ, মুখ, নাক কিছু নেই। আর সেই পুরো শরীর জুড়ে পোকা আর পোকা। পোকা গুলো জীবন্ত! সারা শরীর জুড়ে কিলবিল করছে। তাকে জড়িয়ে ধরার কারণে কিছু পোকা তা শরীরে ও বেয়ে উঠছে। সে এক চিৎকার দিলো। দিতেই ধরফরিয়ে উঠে বসলো।
আয়েশা অবাক হয়ে বললো, — কি হয়েছে?
রিমি কিছু বলতে পারলো না। সে থরথর করে কাঁপছে! আয়েশা এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো! নিশ্চয়ই খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। এই মেয়েও না, দিন দুপুরে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে থরথরিয়ে কাঁপছে। আবার সাহসী ফুল বানু হয়ে ঘুরে বেড়ায়। দেখতো কি অবস্থা! সে পরম আদরে রিমির পিঠ, মাথা বুলিয়ে দিলো।
সে তো এসেছিলো রিমিকে চা দিতে। কিছুক্ষণ আগে চেয়েছিলো। নানা ঝামেলায় আর দিতে পারেনি। তাই এখন দিতে এসেছিলো। এসে দেখে এই মেয়ে জানালা টানালা লাগিয়ে ঘুমাচ্ছে। সময় অসময় এতো ঘুমাতে পারে মেয়েটা। তাই সে আর ডাকেনি। তবে তার নাকে উদ্ভট একটা গন্ধ লাগলো। ইঁদুর টিদুর মরেছে নাকি? সে দেখার জন্য লাইট জ্বালিয়ে সবে মাএ জানালা খুলেছে। ওমনি এই মেয়ে দিয়েছে এক চিৎকার। সে তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলো।
রিমি বুঝলো সে দুঃস্বপ্ন দেখেছে। সব সময়ের মতো সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিলো। নিজের প্রতি তার নিজেই রাগ হলো! দিন দুপুরে ঘুমিয়ে এমন স্বপ্ন দেখার মানে কি? যত্তোসব!
রিমি উঠে পড়লো! রিমি উঠতেই আয়েশাও বেরিয়ে গেলো! বিয়ে বাড়ি, দুনিয়ার কাজ পড়ে আছে। সে যেতেই রিমি হাত, মুখ ধুতে গেলো। গিয়ে পুরোই গোসল করে ফেললো! পোকার কথা মনে হতেই শরীর ঘিনঘিন করছে। গোসল করে নিজেকে পুরোপুরি সামলে নিলো! এটা শুধুই একটা স্বপ্ন! বাজে স্বপ্ন! আর তার জীবনে বাজে স্বপ্নদের আর কোন জায়গা নেই।
বলেই ফুরফুরে মেজাজে চায়ের কাপ হাতে নিলো। চা শরবত হয়ে গেছে তাও ঠোঁট ছোঁয়াবে এমন সময় হাসি খালা আর নিপা হাজির। তাদের হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ। এই বিশ্বসুন্দরা মনে হয় কিছু আর বাকি রাখেনি। এদের হাসি হাসি মুখটা দেখতে দেখতেই স্বপ্নের রেশটা একেবারেই কেটে গেলো।
আজ তার বিয়ে! ছোট খাটো মিনি সাইজের বিয়ে। রিমি সুস্থ তবে ধকল এখনো কাটেনি! এখনো টিংটিঙে শরীর। হাঁটতে চলতে গেলে হাড্ডিতে হাড্ডিতে টুংটাং শব্দ হয়। তবে তার খাওয়া খাদ্যের সকল পুষ্টি গুন নিয়ে চুল তার তরতর করে বেড়ে ঘাড়ের একটু নিচে নেমেছে। শুধু নিচে নেমেছে তা না, তারা রিমির চেয়েও স্বাস্থ্যবান, উজ্জল, সুন্দর। সে যদি হঠাৎ করে পেছনে ফিরে তবে শ্যাম্পুর বিজ্ঞপন করছি বলে যে কেউ ধোকা খেয়ে যাবে।
এরকমটা হওয়ার কারণ কি? আগের চুল সুন্দর ছিলো তবে এমন না। নাকি কেটে ফেলার কারণে এরা আরো নতুন উদ্যেমে বেড়ে উঠছে। হতেও পারে! বাড়ির সবাই তার চুলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তবে শুধু সাব্বির চোখে মুখে বিরক্ত এনে বলবে, — এই চুল আর বড় করার দরকার নেই। সব পুষ্টি খেয়ে শেষ। কেটে শুধু যতোটুকু দরকার ততোটুকু রাখ।
রিমি হাসে! আজকাল তার বেশি ভাগ সময় হাসতে হাসতেই যায়। তার এই চুলের জন্যই হোক আর টিংটিঙে শরীরের জন্যই হোক, সাব্বির এখন তাই বড় কোন অনুষ্ঠানে যেতে চায়নি। সব ঠিক হোক তারপরে সে বড় একটা অনুষ্ঠান রাখবে। তার কথার উপরে আর কেউ দ্বিমত করেনি। রিমির অবশ্য করার ইচ্ছে ছিলো। সারা জীবনে বিয়ে করবে মাত্র একবার তাও আবার এমন ছেঁড়াবেড়া। কবুল বলবে একদিন ঢোল ঢক্কোর বাজবে আরেকদিন। এটা কোন কথা? আরে বাবা দু- দিন পরেই না হয় করি। এতো তাড়াহুরার দরকার কি? কে শুনে তার কথা।
তবে কেউ না শুনলেও সাব্বির তার মনোভাব ঠিক বুঝতে পারে। কি করে যেন মুখের দিকে তাকালেই সব বুঝে যায় । এই যে সারাদিনে একবার তাকে না দেখলেই রিমির অস্থির লাগে! রিমি কিছু বলেনি, কিন্তু কোন না কোন বাহানায় ঠিকিই ফিট বাবু ফিট হয়ে একবার না একবার তার সামনে দিয়ে ঘুরে যাবে। তখন রিমির এতো ভালো লাগে। ইশ! তার হিরো।
তবে দরকার ছাড়া কথা হয় খুব কম। যেহেতু এক বাসায় তাই দৃষ্টিকটু এমন কিছু সে কখনও করে না। তাই যখন তার বিয়ে নিয়ে মনের হাবভাব বুঝলো, সাথে সাথেই ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। এগুলোকে অবশ্য ম্যাসেজ বলা যায় না। ছোট খাটো হ্যান্ড গ্রেনেড বলা যেতে পারে। যা কোন ভেজাল লাগালেই ফুট্টস। তাই রিমি আর টু শব্দও করেনি। ছেঁড়াবেড়া বিয়ের দুঃখ মনের মধ্যে ছাই চাপা দিয়ে বসে আছে।
সে আফসোস মাখা মুখ করে শরবত মার্কা চায়ে চমুক দিলো। দিয়ে হাসি খালা আর নিপার দিকে তাকালো! হাসি খালা সব সময়ের মতোই ত্যাক্ত বিরক্ত। যেন তাকে ঢেলে ঢুলে এই রুমে পাঠানো হয়েছে। অথচো এই বিয়ে নিয়ে তার আগ্রহ’ই বেশি। দু- হাত ভরে মেহেদী পরেছে। শাড়ি কিনেছে দুটো , একটা টকটকে হলুদ আরেকটা টকটকে লাল।
লালটা ঠিক আছে ! কিন্ত হলুদ টলুদ তো আর আপাততো হচ্ছে না। তো এটা দিয়ে করবে টা কি? যাক শখ বলে কথা। তবে মহুয়া আন্টি রাতে চুপিসারে এসে তাকে হলুদ ছুঁইয়ে গেছে। মুখ ভার করে বলেছে, — হলুদের ছোঁয়া ছাড়া বউ হয় নাকি? কি বদমাইশ দেখেছো! কিছুই করতে দেবে না। আরে বাবা মুখে না ছোঁয়ালেই তো হয়। হাতে পায়ে দিতাম, তা না! রিমি তোর জীবন তেজপাতা। পরে আবার আমাকে দোষ দিবি না।
রিমি হেসেছে! মনে মনে বলেছে, — আমার জীবন সব সময় তেজপাতাই ছিলো আন্টি। আপনার এই আপদ মার্কা ছেলে এসেই স্পেশাল বানিয়েছে। এই যে এতো এতো ভালোবাসা, এতো এতো কেয়ার, আমি তো কখনও কারো কাছ থেকে পাইনি। তাই ভয় হয়! নিজেরই না আবার নজর লেগে যায়।
রিমি আবারো হাসলো! তার সত্যিই ভয় হয়। ভয়ের কথা মনে পড়তেই স্বপ্নের কথা মনে পড়লো। সে ঝেড়ে ফেললো! দিন দুপুরের স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় নাকি? নিজেকে নিজে বুঝ দিতে দিতে সে খেয়ালই করলো না, স্বপ্ন তো হয় রংহীন, গন্ধহীন।
সে নিপার দিকে তাকালো, সে ব্যাগ থেকে সব বের করছে সাথে পূর্নিমার চাঁদের মতো ঝিলকও মারছে। এই মেয়ে তো এখন উড়ে বেড়াচ্ছে পৃথিবীরও বাইরে। এর অবশ্য যোথাযোগ্য কারণও আছে। কারণ! ওয়ান এন্ড অনলি আশিক ভাই। সে আজ সকালে এসে হাজির হয়েছে। মামাস বয় জীবনে প্রথম মায়ের অনুমতির বাইরে পা রেখেছে। তার কারণ!
মামাস বয়ের মাম্মি আর দাদি এই বিয়েতে গিট্টু দিয়ে বসে আছে। তারা কিছুতেই রাজি না। তারা বিয়ে ঠিক করে রেখেছে আশিক ভাইয়ের সাথে। তাই তাদের এক কথা, বিয়ে হলে আশিকের সাথেই হবে।
তাদের কথা কেউ গনায় ধরেনি। এই দুঃখে নানু হায়- হুতাশ থেকে শুরু করে আহাজারি, অভিশাপ কিছুই আর বাকি রাখেনি।
রিমি শুধু শুনেছে। আগের মতো এখনো এনার্জি গুছিয়ে উঠতে পারছে না। তা না হলে বুড়ির খবর ছিলো।
শুনেছে আয়েশাও! শুনে শুধু নির্বিকার ভাবে বলেছে, — শুকুনের দোয়ায় গরু মরে না মা। আর এক পা তো কবরে। এখন অনন্ত আল্লাহকে একটু ভয় করো।
ব্যস সেই থেকে সব যোগাযোগ বন্ধ। অবশ্য এই বন্ধে কারোই কিছু আসে যাই নি। খালামণি নিজের মতো করে’ই সব করছে। আর রিমির মাথায় হাত রেখে বলেছে, — মনে কিছু বসাবি না রিমি। আমি বলছি না বাকি জীবনে আর দুঃখ তোকে ছুঁতে পারবে না। তবে এটা বলতে পারি এই দুঃখ গুলো আছে বলেই সুখকে আমরা এতো গভীর ভাবে অনুভব করতে পারি। এই সুখ দুঃখ নিয়েই আমাদের জীবন। আর এদের নিয়েই আমাদের চলতে হবে, ভালো থাকতে হবে।
রিমি কিছু বলেনি! খালামণির সামনে এখন কেন জানি কিছু বলতেই পারেনা। যখন তার সামনে আসে, মমতায় আগলে ধরে। তখন তার কেমন জানি ঘোর লেগে যায়। সে শুধু তাকিয়ে থাকে! তার মা থাকলেও বুঝি এভাবে মমতা মাখা কন্ঠে সব কিছু বুঝাতো।
তবে আশিক ভাইয়ের আসার কথা শুনে রিমি নিষেধ করেছিলো! দরকার কি এতো ঝামেলার? সে সাধারণ মানুষ, সাধারণ ভাবে বিয়ে করছে। ঝড় ঝাটকা পেড়িয়ে উপস্থিত থাকতে হবে এমন কোন কথা আছে? তবে আশিক ভাই এসেছে! একা আসেনি সাথে নিয়ে এসেছে হাজার খানেক বই।
রিমি তো খুশিতে টইটুম্বুর! তার খুশি দেখে আশিক হেসে বলেছে, — জানতাম তো শাড়ি গহনায় তোর হবে না।
রিমি ভেঙচি কেটেছে! আশিক আফসোসের সুরে বলেছে, — বড় ভাই বলে আর জীবনে দাম পেলাম না।
রিমিও সমান তালে বলেছে — নন্দাই হয়ে যাও! দাম কতো প্রকার আর কি কি, সব দিয়ে দেবো।
আশিক ভাই রিমির কথা বুঝেনি! বুঝার কথাও না। সে সরল রেখার মানুষ। এক মেয়ে যে তার প্রেমে শুধু হাবুডুবু না, তলিয়ে গেছে। সে বুঝার ধারের কাছেও নেই।
রিমি ঢকঢক করে চা গিলে ফেললো ! নিপা তাড়া দিচ্ছে। তার এখন প্যাকেজিং শুরু হবে । অবশ্য সাব্বির ক্লিয়ার ভাবে বলে দিয়েছে নো মেকআপ। মুখে কোন ঘষামাজা যাবে না। লিপস্টিকতো একদম না। কাটা দাগে হাত লাগানোও নিষেধ। এমনকি মাথায় সেলাইতে টান লাগে এমন কোন হেয়ার স্টাইলো না। শুধু গুছিয়ে কাপড় পরাতে বলেছে।
নিপা মুখ ফুলিয়ে বললো, — সেলাই টেলাই সব শুকিয়ে খরখরে। একটু মেকআপ করলে কি হবে? একটু দেই রিমি। না সাজলে বউ মনে হয়, বলো?
রিমি মাথা নাড়ালো! তাই তো! এমনিতেই ছেঁড়াবেড়া বিয়ে। তার মধ্যে বউ হবে তেনাবেনা। আর ঐ দিকে বেটা টম ক্রুস হয়ে বসে থাকবে। ভাব আর স্টাইল ছাড়াতো তার এক সেকেন্ডও চলতে পারে না। শুধু তার ব্যাপারে যতো ঢং। এমনিতেই ফকিন্নি মার্কা চেহেরা তার মধ্যে না সাজলে হয়ে যাবে পেয়ারা।
রিমি চায়ের কাপ টাপ সরিয়ে সোজা হয়ে বসে বললো, — সাজাও, ইচ্ছে মতো সাজাও। তোমার নায়ক মার্কা ভাইও যেন ফেল খেয়ে যায়।
নিপা খুশিতে বাকবাকুম হয়ে বললো, — সত্যি!
— হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্যি! তার আগে দরজা লক করে চাবি গায়েব কর। কেয়ামত থেকে কেয়ামত হয়ে যাক! হাসি খালা যেনো রুম থেকে বের না হতে পারে। তার আবার পেয়ারের আব্বা! গিয়েই সব ছেড়ে দেবে।
নিপা তড়িঘড়ি করে দরজায় লক করলো। হাসি খালার মধ্যে অবশ্য কোন তোড়জোড় দেখা গেলো না। সে নির্বিকার ভাবে রিমির সাইড দিয়ে শুতে শুতে বললো, — গাল বাঁচায় রাইখো! ঊনিশ থেকে বিশ হলেই যেহানে থাপ্পড়, হেহানে তার বউ নিয়া ছলছোকোরী। কয়ডা পড়ে কে জানে। যাইগা সুযোগ যহন হইছে চোখটা বুইজা লই। বিয়ার আগে ডাইক্কা দিও। বড় আব্বার বিয়া, নয়া শাড়ির আঁচল ফালাইয়া দোয়া রাখবো।
নিপা ঢোক গিলে রিমির দিকে তাকালো! গাল মনে হয় আজকে থাকবে না।
রিমি হাসলো! — ভয় নেই! আমি আছি না। তোমার গালে পড়ার আগে আমি গাল পেতে দেবো ননদিনী। থাপ্পড়ওয়ালাকে গলায় ঝুলাচ্ছি দায়তো নিতেই হবে।
নিপা সাজালো! তার মনের মাধুরী মিশিয়ে তার ভাইয়ের বউকে সাজালো। কিন্তু বাইরে যখন সব ঠিক, রিমিকে নিয়ে যেতে বললো। তখন নিপা নিসাকে টেনে নিয়ে আসলো।
নিসা আছে গাল ফুলিয়ে, তার এতো সুন্দর ননদ তা না! শুধু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারছে না। তাই সকাল থেকে সে বিনা কারণে মেজাজ দেখাচ্ছে। একে ওকে ধমকাচ্ছে! নাদু মামার সাথে ফুসফাস করছে। তার মধ্যে হয়েছে আরেক জ্বালা। নাঈম পান চিবুতে গিয়ে দাঁত নাড়িয়ে ফেলেছে। সবাই তো অবাক! পরে ঘেটে দেখা গেলো পানের ভেতরে সুপারির জায়গায় পাথরের কণা।
কার এই কাজ বুঝতে আর কারোই বাকি রইলো না। বিয়ের আসর থেকে উঠে সাব্বির আয়াশকে দিয়েছে দু- টো লাগিয়ে। সবাই নির্বিকার! কেউ দেখেও দেখেনি। এখন নাঈম আর আয়াশ দুজনেই গালে হাত চেপে বসে আছে। আর নিসা আইস ব্যাগ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে।
এই দৌড়াদৌড়ির মধ্যে আবার এই দিকে টানাটানি! সে বিরক্ত হয়ে বললো,– কি হয়েছে?
— রিমিকে একটু নিয়ে যাও আপু।
— কোন ঠেকা আমার! দিনরাত তো তুই নিয়ে নাচানাচি করছিস। এখন আবার আমাকে কেন?
নিপা অপ্রস্তুত হাসলো! মনে মনে বললো, — তোমার থাপ্পড় খেয়ে অভ্যাস আছে। আমার তো নেই। মুখে বললো, — আমি হাসি খালা কেউই রেডি হইনি। ও যে দেখো, হাসি খালা দিন দুনিয়া ভুলে হা করে ঘুমাচ্ছে। একটু নিয়ে যাওনা প্লিজ। আমরা আসছি।
নিসা বিরক্ত মুখেই রিমির দিকে তাকালো! তাকিয়ে আরো বিরক্ত হলো! এরকম দশ হাত ঘোমটা টানার মানে কি? যেই না সিরি তার আবার ঢং। সে বিরক্ত নিয়েই এগিয়ে গেলে। রিমিকে ধরে বললো, — আসো!
রিমিকে সাব্বিরের পাশে বসাতেই সাব্বির ভ্রু কুঁচকে তাকালো! এই মেয়ে ভালো হবে না। সে ফিসফিস করে বললো, — এসব কি?
রিমি হাসলো! সেও ফিসফিস করে বললো, — কোন সব?
— এভাবে ঘোমটা টানার মানে কি?
— কু- নজরে যেনে না তাকাতে পারি। তাই পর্দা টেনে বসে আছি।
— রিমি?
— জ্বি নায়করাজা।
সাব্বির দাঁতে দাঁত চাপলো!
— ঘোমটা সরাবে।
— না বাবা না! আমি রিক্স নিতে পারবো না। সুন্দর বর হলে জ্বালা আছে। আপনার তো আর সুন্দর বউ নেই। তাই এই জ্বালা আপনি বুঝবেন না।
— ইয়ার্কি বন্ধ করবে?
— ওমা ইয়ার্কি করলাম কোথায়?
— রি..মি….
— আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে! কাউকে বলুন, আমি কিভাবে সরাবো? মানছি এই বাসায়’ই থাকছি। তাই বলে লাজ লজ্জা নেই নাকি?
সাব্বির আশে পাশে তাকালো! নিপা, হাসি খালা কাউকেই দেখলো না। সব গেছে কোথায়? অবশ্য তাকে আর কিছু বলতে হলো না। মুহুয়া নিজেই এগিয়ে এলো। ঘুমটা সরাতে সরাতে বললো, — ওমা নিজেদেরই তো বাড়ি। এতো বড় ঘোমটা কেন?
বলেই সে থমকে গেলো! শুধু সে না! নিসার হাত থেকে আইস ব্যাগ পড়ে গেলো। সে সাথে সাথেই দু – গাল চেপে ধরলো। বিরবির করে বললো, — নিপার বাচ্চা তোর চুল আমি ছিঁড়ে ফেলবো।
আয়েশা হেসে ফেললো! এগিয়ে এসে ঘোমটা ঠিক করতে করতে বললো, — মাশাআল্লাহ। আমার মেয়ের নজর না লাগুক।
আর সাব্বির সে কথা বলতে ভুলে গেলো! তার মুখ আপনা আপনি হা হয়ে গেলো। সে বিয়ের শাড়ি কিনেছে রেড চেরি রঙের, সিম্পল কারুকাজের। তার সাথে হালকা পাতলা গয়না। রিমির সমস্যা হবে এমন কিছু কিনেই নি। এই সিম্পল সিম্পল জিনিসেই রিমিকে অপরুপা লাগছে। বিয়ের রঙে সব বউদের’ই কি এমন সুন্দর লাগে! নাকি তার বউকেই লাগছে।
সে রাগ দেখাবে তো দূরের কথা! অপলক তাকিয়ে রইলো। সে এও ভুলে গেলো, সে তার বাবা, চাচা আরো এলাকার মুরুব্বিদের সামনে আছে। রিমি মুখ ঘুরিয়ে হেসে ফেললো।
নাঈম গালে হাত রেখেই এগিয়ে এলো। ! বিয়ের ঝামেলা শেষ হলেই সে যাবে ডেন্টিস্টের কাছে । জীবনে মনে হয় না গরু, খাসি আর খেতে পারবে। বিয়ে আহারে বিয়ে! কর না কর ! না করলে বুঝবি কিভাবে?
সে মনে মনে বলেই সাব্বিরের পাশে বসলো, আস্তে করে বললো, — শালা চোখ ফেরা! মুখ বন্ধ কর। বউ পরে দেখতে পারবি না। সারা জীবনের ভদ্র খেতাব তো একদিনেই ধূলিসাৎ করে ফেলবি। বলেই কাজি সাহেবকে তাড়া দিয়ে বললো, — বিয়ে শুরু করেন। মিয়া বিবি রাজি শুভ কাজে আর দেরি করে লাভ কি?
খুব দেরি অবশ্য হলো না। রিমির চোখে চোখ রেখেই সাব্বির কবুল বললো আর সুন্দর ভাবে তাদের শুভ কাজ সম্পূর্ণ হলো। হতেই সাব্বির আরেকটু চেপে বসলো। ফিসফিস করে বললো, — সৈয়দ বাড়ির বড় পুত্র বধু, ভূতের বাড়িতে পার্মানেন্ট স্বাগতম। আর তোমার অনেক শাস্তি পাওনা আছে। আমার কথা না শোনার শাস্তি।
শাস্তি শব্দটা শুনতেই রিমির আবার স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেলো । হাসির মাখা মুখের জায়গায় তার অজান্তেই অন্ধকার ছেয়ে গেলো।
সাব্বির সেই অন্ধকার দেখলো! দেখেই সবার সামনেই আঙুলের ভাজে আঙুল রাখলো। শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো।
রিমি চোখ তুলে তাকালো! তাকাতেই সব অন্ধকার দূর হয়ে গেলো। সাব্বির কোন শব্দ উচ্চারণ করলো না। তবুও রিমি জানে সাব্বির বলছে, — আমি আছি। সব সময় সব পরিস্থিতিতে।
#সমাপ্ত