#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-১০
রাত নয়টার দিকে শোভাকে হলে নামিয়ে দিয়ে রিফাত ঢাকায় ফিরেছে। কিন্তু বারোটা বেজে যাওয়ার পরও রিফাতের ফোন না আসাতে শোভার একটু টেনশন হচ্ছিল। রিফাত ঠিকঠাক মতো পৌঁছেছে তো? আশা করেছিল রিফাত ওকে ফোন দিয়ে বলবে, সে ঠিকঠাক বাসায় পৌঁছেছে। নিজ থেকে ফোন দিতে কেমন যেন লাগছে। প্রথমদিনই ফোন দিলে শোভাকে হ্যাংলা ভাবতে পারে। ভাবতে পারে শোভা রিফাতকে মেনে নিয়েছে। নিজেকে এতোটাও ফেলনা বানাতে চায় না শোভা। তাই ফোন করা থেকে বিরত রইলো। কিন্তু রাত একটা বাজার পর আর পারলোনা। ভীষণ দুশ্চিন্তা গ্রাস করছে। পথে কোন ঝামেলা হয়নি তো? একা গাড়ি চালিয়ে গেছে। না পারতে শোভা ফোন দিলো। একবার রিং বেজেছে কি বাজেনি ওপাশ থেকে হ্যালো শোনা গেল-“তোমাকে টেস্ট করছিলাম শোভা। দেখতে চেয়েছি তোমার মনে আমার প্রতি বিন্দু মাত্র অনুভুতি জাগ্রত হয়েছে কিনা। এইজন্য পৌঁছে ফোন না দিয়ে বসে আছি, তোমার ফোন আসার অপেক্ষা করছি। ভাগ্য ভালো যে তুমি পাশ করে গেছ।”
শোভা রীতিমতো বোবা বনে গেল। তার বোঝা উচিত ছিল এই ছেলের মাথা ভর্তি দুষ্ট পোকার বাস। এদিকে ও দুশ্চিন্তায় মরছে আর এই লোক আছে তাকে পরীক্ষা করার তালে। বাহ! কি দারুণ।
“প্লিজ কাটবেনা শোভা। রাগ করার মতো কিছু করিনি আমি। আজ এতো সুন্দর কিছু মুহূর্ত উপহার দিলাম তোমাকে। আমি জানতে চেয়েছি মুহূর্তগুলো তোমার মনে কি ইফেক্ট ফেললো। এটা নিশ্চয়ই কোন অন্যায় চাওয়া নয়?”
শোভা কথা বদলায়-“কখন পৌছেছেন বাসায়?”
“এগারোটার দিকে। ইচ্ছে করেছিল তখনই ফোন করতে। কিন্তু বাবা ডাকলো, তার সাথে কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেলো। পরে ভাবলাম দেখি তুমি কি করো।”
শোভা চুপ করে রইলো। রিফাত মোলায়েম কন্ঠে বললো-“আমার জন্য কি দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তোমার?”
“রাখছি আমি। অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ুন।”
শোভা লজ্জিত হয়ে ফোন রেখে দিতে চায়। রিফাত অনুনয় করে-“প্লিজ বলো না। তুমি না বললে ঘুম আসবে না আমার।”
“এসব কি কথা? সবসময় ব্লাকমেল করা জরুরি?”
শোভা বিরক্তি বুঝে রিফাতের মন খারাপ হলো। ম্লান কন্ঠে বললো-“ঠিক আছে বলতে হবে না। ঘুমাও তুমি। গুড নাইট।”
কেটে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ ফোনটা কানে ধরে রাখলো শোভা। রিফাতের জন্য খারাপ লাগলো। ভাবলো সত্যিটা বলে দিলেই হতো। কেন যে এতো রুঢ় হলো। সারারাত এপাশ ওপাশ করে ভোর রাতের দিকে ঘুমালো শোভা।
★★★
পরদিন বিকেলে যথারীতি রিফাতের ফোন-“কি ভেবেছিলে শোভা, অভিমান করে আসবো না তোমার কাছে? আমি কালকের জায়গাতে আছি, তাড়াতাড়ি নেমে এসো।”
সত্যি বলতে সারাদিন কয়েকবার করে মোবাইল দেখেছে শোভা। রিফাতের ফোন না পেয়ে যথেষ্ট অবাক হয়েছে। ভেবেছে আর আসবে না সে। শোভা বেশি কিছু বলে না। কেবল ‘আসছি’ বলে ফোন কাটে। কিছুক্ষণ পরই ওকে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে আসতে দেখলো রিফাত। আজ পরে আছে লাল রঙের সালোয়ার কামিজ। কালকের মতোই আধমাথা ঘোমটা টানা। পুরো বউ বউ লাগছে মেয়েটাকে। শোভা এসে ওর পাশের সিটে বসা অবধি রিফাত ওকে দেখলো একনজরে।
ও বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো। পথে কোন কথা বলেনি রিফাত। ঘন্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে থামলো একটা নদীর ধারে। বাঁধানো ঘাটে কয়েকটা নৌকা বাঁধা। আর আছে পানির উপর ভাসমান কয়েকটি খাবারের দোকান। রিফাত ওকে নিয়ে একটি খাবারের দোকানে বসলো-“জায়গাটা সুন্দর না? এটাকে বলে মিরপুর বেড়িবাঁধ। আর এই নদীর নাম তুরাগ।”
শোভা মুগ্ধ হলো আশেপাশের দৃশ্য দেখে। ঢাকাতেও এমন জায়গা আছে সেটা কাল আর আজ না আসলে জানা হতো না তার। বলতে গেলে ঢাকার কিছুই চেনে না ও। কোথাও বেড়াতে যায়নি এতোদিন। গন্ডির বাইরে এই প্রথম পা রাখা। সেই হিসেবে নতুন এক পৃথিবীর খোঁজ পাচ্ছে সে। শোভা মুগ্ধতা নিয়ে শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশটা দেখে।
“তুমি কাল বলেছিলে না নদীর পাড়ে বসে থাকতে ভালো লাগতো তোমার সেই জন্য এখানে নিয়ে এলাম। ভালো লেগেছে না?”
শোভা মাথা দুলায়-“খুব সুন্দর জায়গা। ঢাকায় এমন জায়গা আছে জানতাম না।”
“এসব জায়গা আমরা বন্ধুরা মিলে খুঁজে বের করেছি। এরকম আরও অনেকগুলো জায়গা চেনা আছে আমার। তোমাকে নিয়ে যাবো সেসব জায়গায়। একেকদিন একেক জায়গায় বেড়াবো। শুধু ঢাকা কেন আমরা সারাদেশ ঘুরে বেড়াবো। শুধু তুমি বলবে মুখ ফুটে কোথায় যেতে চাও।”
রিফাতের কথাগুলো বুকের গহীনে যেয়ে আচর কাটে। এই ছেলে কি তাকে নিয়ে বেশি ভাবছে? এতো তাড়াতাড়ি এতটা এচাটমেন্ট কি ভালো? ভয় লাগে যে?
“কাল বাবা আমাকে ডেকে কি বললো জানো?”
“কি?”
“বাবা চায় আমি যেন তার অফিসে বসি। কিন্তু ওরকম ধরাবাঁধা কাজ আমার ভালো লাগে না। কন্টেন্ট বানাই ভিডিও বানাই ওসবই ভালো লাগে।”
“যা ভালো তাই করুন। তাছাড়া আপনার কন্টেন্ট বেশ ভালো। অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য উপকারী।”
রিফাত বিস্মিত হয়ে শোভাকে দেখলো-“তুমি আমার ভিডিও দেখো?”
“হুমম দেখি। দেখবোনা কেন? অনেক আগে থেকে ফলো করি আপনাকে।” “রিয়েলি! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।” রিফাত সত্যিকার অর্থেই হতবাক।
“তারমানে প্রথমদিন শুরুতেই তুমি আমাকে চিনে ফেলেছিলে? অথচ প্রিটেন্ড করেছ চেননি?”
শোভা হেসে দিলো। রিফাত চেচিয়ে উঠলো-“ও মাই গড! তুমি তো দেখছি সেই চতুর। আমি উল্টো তোমাকে বোকা সোকা মেয়ে ভাবছি। আচ্ছা, সেদিনের ঘটনা বলো তো? ওরকমভাবে কেন এসেছিলে অনুষ্ঠানে?”
“বাবা কোন কারণে রাগ হয়ে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলেন। কোথায় যাবো ওইসময়? কানিজ আপু দেখে সাথে করে নিয়ে গেছিলেন। ওখানে যেয়ে বুঝলাম ভুল করে ফেলেছি। ওমন পোশাকে ওখানে যেয়ে উল্টো আরও ঝামেলা হয়েছে। সবাই ঘুরে ঘুরে আমাকেই দেখেছে। কি বাজে অবস্থা।”
“হুমমম, আর হোস্টেলের সামনে নেমে যাওয়াটা? ওটা কি ছিলো?”
শোভার মুখে দুষ্টু হাসি-“আপনি যেমন নাছোড়বান্দার মতো পিছনে পড়ে ছিলেন না নেমে উপায় ছিলো? কোন ভাবে বাবা আপনাকে দেখলে আমার কি হতো তাই বলুন। চিরতরে ঘর থেকে বের করে দিতো না?”
রিফাত হো হো করে হাসলো-“তুমি পিচ্চি হলেও মাথায় বুদ্ধি রাখো বেশ। আমি তো পরের দিন হোস্টেলে গিয়ে বোকা বনে গেছি৷ হোস্টেলের দারোয়ানকে তোমার কথা বললাম সে আর চেনে না। বলে এই নামে কেউ থাকে না। আমি তো কিছুতেই বিশ্বাস করি না। পরে এন্ট্রির খাতা দেখে শিওর হলাম তুমি আমাকে বোকা বানিয়েছ। এর আগে এমন ঘটনা আর ঘটেনি আমার সাথে। প্রচুর বিস্মিত হয়েছিলাম।”
শোভা মিটমিটিয়ে হাসছে। রিফাত জানতে চাইলো-“একটা জিনিস বলো তো, নামটা মিথ্যে বললে কি করে? ওটা কি তখনই মাথায় এসেছিল?”
“একদম যে মিথ্যে তা নয়। দাদী আমাকে মেঘা বলে ডাকতো। গায়ের রং একটু ময়লা তো তাই।”
রিফাত কিছুক্ষণ শোভার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর ক্ষীনকন্ঠে বললো-“আমার কিন্তু নামটা ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। কেমন রোমান্টিক একটা ভাব আছে নামের মধ্যে। তাছাড়া তোমার সাথে এই নামটাই যায়। আভিজাত্য আছে নামটায়। তুমি যদি কিছু মনে না করো তাহলে তোমাকে আমি এই নামে ডাকতে চাই।”
শোভা মনে মনে চমকে উঠলো। একটা মানুষের সাথে ভাবনায় এতোটা মিল কিভাবে সম্ভব? মেঘা নামটা তার নিজেরও বেশ পছন্দ। সে নিজেও নামটা নিয়ে ঠিক এমনটাই ভাবতো। আজ রিফাতের মুখে এরকম ব্যাখা শুনে অবাক লাগছে।
“ডাকতে পারেন।”
“থ্যাংক ইউ।”
গল্পে গল্পে ওরা টের পেলো না সূর্য কখন অস্ত গেলো। মশার কামড় খেয়ে হুঁশ এলো। দু’জনই হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠলো। ফিরতে হবে এখন। গত দিনের তুলনায় শোভা আজ অনেক সহজ। মুখের কোনে হাসি এসেছে। রিফাতের ভালো লাগে। মনের কোণে কিছুটা আশা জাগছে। ভবিষ্যতে তার হয়তো পারফেক্ট জোড়া হতে পারবে। তবুও একটা কিন্তু থেকে যায়। বন্ধুদের কেউ কেউ শোভাকে চিনবে। ওকে নিয়ে গসিপ করবে। কিভাবে রুখবে ওদের? অনেক ভাবে রিফাত। ভেবে ভেবে মনে হলো, শোভাকে এমন কিছু করতে হবে যাতে ওর পুরনো ভিডিওটা ফিকে হয়ে যায়। শোভাকে নতুন করে ভাইরাল হতে হবে। নতুন করে ভাইরাল হয়েই একমাত্র পুরনো স্মৃতিকে মুছে ফেলা যাবে।
★আমার লেখা যাদের ভালো লাগছে তারা চাইলে বইটইতে থাকা আমার চারটা ই-বুক পড়তে পারেন। সর্বশেষ ই-বুক এর নাম পারিজাত কিংবা ঘাসফুলের গল্প। লিংক কমেন্টে দিলাম। ★
চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন
#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-১১
শোভার ক্লাস শুরু হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেলে রিফাতের সাথে বেড়াতে যাওয়া আর ক্লাস শুরু হওয়ার পর প্রতি বৃহস্পতিবার করে বেড়াতে যাওয়া রুটিন হয়ে গেলো ওদের। বৃহস্পতিবার ক্লাস শেষ করেই হলের দিকে ছোটে শোভা। হলে ফিরে কোনরকমে নিজেকে ফ্রেশ করে আবার দৌড়। রিফাত ভার্সিটির গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে ওর জন্য। একটু দেরি হলেই ফোনের পর ফোন আসতে থাকে। বাধ্য হয়েই ছুটতে হয় শোভাকে।
এরমধ্যে রিফাত নিজের চ্যানেলে নতুন ভিডিও আপলোড করলো যার বিষয়বস্তু ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ইস্যু নিয়ে। বলা যায়, এই ভাইরাল শব্দটা রিফাতের ভিডিওকে ভাইরাল করে দিলো। রিফাত যেন নতুন করে অনলাইন আলোচনায় ফিরলো। কয়েকটা কেস স্টাডি নিয়ে তৈরি করা ভিডিওতে ভাইরাল হওয়া কয়েকজন ছেলে ও মেয়ের অতীত আর ভাইরাল হওয়ার পর জীবনের কি অবস্থা নিয়ে বানানো। তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে একটা তথ্যবহুল প্রামান্যচিত্রে রুপ দেওয়া ভিডিও এখন সবার কাছে আলোচনার বিষয়।
ভিডিও দেখে ভীষণ রাগ হলো শোভার। বোঝাই যাচ্ছে তাকে উদ্দেশ্য করে ভিডিওটা বানানো। তাকে এভাবে নিচু করার কোন কারণ খুঁজে পেলো না সে।
শোভা বুঝে পাচ্ছে না রিফাত আসলে কি চাচ্ছে? সে তাকে মোটিভেট করতে চাচ্ছে নাকি তাকে পুনরায় আলোচনায় আনতে চায়? দুইদিন গুম হয়ে রইলো শোভা। ফোন বন্ধ করে বসে থাকলো।
এদিকে রিফাত শোভাকে ফোন দিয়ে দিয়ে পাগল হয়ে গেছে। ছেলেটা শোভার প্রতিক্রিয়া পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ছিলো। কারণ ভিডিওটা ওর জন্যই বানানো। ওর রিভিউটা গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে। কিন্তু শোভার এমন আচরণে হতবাক হলো। মেয়েটার আবার কি হলো? এই ভিডিও যে ওর জন্য বানানো সেটা কি বুঝতে পারছে না? তবুও একটিবার ফোন করলোনা রিফাতকে? রিফাত ফোন করবে সে উপায়ও রাখেনি। কিন্তু কেন এই অভিমান? কারণটা তো জানাবে?
বাধ্য হয়ে রিফাতকে মঙ্গলবার ভার্সিটিতে আসতে হলো। মঙ্গলবার শোভার ক্লাস সিডিউল বেশ টাইট। চারটে থিউরি আর একটা ল্যাব ক্লাস পড়েছে এই দিন। সারাদিন টানা ক্লাস করে শোভা ক্লান্ত হয়ে যায়। বের হওয়ায় কোন সুযোগ নেই। এতকিছু রিফাত কি করে জানে? রুটিনটা ওকে ম্যাসেন্জারে পাঠিয়েছিল বলেই জানে। তবুও আজ রিস্ক নিতেই হলো। শোভার সাথে কথা বলা জরুরি। ও কি ভাবছে সেটা জানা আরও জরুরি। রিফাত মাথায় ক্যাপ আর গালে আলগা দাড়ি লাগিয়ে নিজেকে যথেষ্ট আড়াল করে শোভার ক্লাস থেকে ফেরার পথে দাঁড়িয়ে আছে। যেহেতু ফোন বন্ধ এছাড়া আর উপায় নেই কোন।
রিফাত কয়েকবার করে ঘড়ি দেখলো। এতোক্ষণে চলে আসার কথা শোভার। কিন্তু আসছে না কেন? অস্থির পায়চারি করে রিফাত। অবশেষে ম্যাডামকে আসতে দেখে হাফ ছাড়ে। চেহারা মলিন হয়ে আছে শোভার। মনটা খারাপ নাকি মেয়েটার? পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রিফাত ওকে ডাকলো-“মেঘা, আমি। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে। সোজা হাঁটতে থাকো।”
“আপনার সাথে কোন কথা নেই।”
শোভা হাঁটতে হাঁটতেই জবাব দিলো। রিফাতকে সে আগেই চিনেছে তবুও থামেনি।
“কিন্তু কেন? আমার অপরাধ কি? ফোন বন্ধ রেখেছ দুইদিন ধরে বাধ্য হয়ে আজ আসতে হলো।”
“আপনার সাথে কথা বলবো না বলেই ফোন বন্ধ রেখেছি। আর অপরাধ কি সেটা আপনি ভালো জানেন।”
রিফাত অসহায় চোখে মাথা নাড়লো-“সত্যি জানিনা কেন তুমি এমন করছো। প্লিজ চলো কোথাও বসে কথা বলি। আমাকে বলো কি করেছি আমি।”
“বললাম না আপনার সাথে কথা নেই? চলে যান আপনি।”
শোভা রাগী কন্ঠে কথাগুলো বলে আর দাঁড়ায় না। রিফাত দৌড়ে ওকে ধরলো-“আচ্ছা বুঝেছি ভালোমতো বললে তুমি আসবে না। এখন আমি চেঁচাব, সিনক্রিয়েট করবো। সবাই জানতে চাইলে বলবো তুমি আমাকে কষ্ট দিচ্ছ। ভালো হবে?”
শোভা দাঁড়িয়ে গেলো-“মিথ্যে কথা কেন বলবেন?”
“তাহলে সত্যিটা বলি? বলি যে তুমি আমার বউ। চলবে?”
শোভার গাল রক্তিম হলো। চোখ দুটোও লাল। দাঁতে ঠোঁট চেপে রাগ সামলালো-”
কথায় কথায় ব্লাকমেল করা মোটেও ভালো ব্যাপার না।”
“আমি তো করতে চাই না। তুমি বাধ্য করছো।”
“আপনি সামনে এগুন আমি আসছি।”
“উহু, তুমি সামনে আমি পেছনে। পালিয়ে যে যাবেনা তার গ্যারান্টি কি?”
রিফাতের বলার ধরনে হাসি পেলেও হাসলো না শোভা। উল্টো গম্ভীর দৃষ্টি হেনে সামনে এগিয়ে গেল। রিফাত মুচকি হেঁসে শোভার পিছু নিলো।
রিফাত এবার ওকে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে নিয়ে এলো। একগাদা খাবার অর্ডার করে বসলো। শোভা বাঁধা দিলো-“এতো খাবার কার জন্য?”
“তুমি দুপুরে খাওনি, খিদে পেয়েছে না?”
“আমি এখন খাব না। আপনার কথা শেষ করুন আমি হলে ফিরবো।”
রিফাত করুন নয়নে তাকাল-“আমিও খাইনি দুপুরে। ভাবলাম তোমার কাছেই আসবো যেহেতু একসাথেই খাব।”
শোভা কড়া কথা বলতে গিয়ে থামে। খাবার নিয়ে কাউকে কিছু বলা শোভন না। রিফাত ডাকলো ওকে-“এবার বলো,
মেঘার মনে মেঘ জমার কারণ কি? মেঘের গর্জন শোনাও দেখি। যেরকম শান্ত পরিবেশ তৈরি করেছ মনেহচ্ছে দশ নম্বর বিপদ সংকেত। যে কোন সময় ঝড় শুরু হবে।”
শোভা অন্য দিকে তাকালো। মনে মনে বললো, ন্যাকা কিছু বোঝে না। আবার ঢং করে সাহিত্য কপচানো হচ্ছে। অন্যায় করে সাধু সাজা হচ্ছে। শোভার চুপ থাকা দেখে অস্থির হলো রিফাত-“কি হলো? কোন গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ নেই কেন? আর কতোক্ষণ মেঘ জমিয়ে রাখবে? এবার না হয় বর্ষন হোক।”
রিফাতের কথার তালে অভিমান ফিকে হয়ে যাচ্ছে শোভার। সে তাড়াতাড়ি প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-“নতুন ভিডিও তে কি বলেছেন এসব?”
“কি বলেছি? তোমার ভালো লাগেনি?”
শোভা মাথা নাড়লো-“ইনিয়ে বিনিয়ে আমার কথাই তো বলতে চেয়েছেন তাই না? কেন এমন কাজ করলেন?”
রিফাত একইসাথে বিরক্ত ও হতাশ হলো। হতবাক চাহুনি দিয়ে শোভার দিকে তাকালো-“তোমার খারাপ লাগার মতো কনটেন্ট তো বানাইনি মেঘা। আমি উল্টো ভেবেছি তোমার ভালো লাগবে। তোমার ফোনের আশায় বলেছিলাম অথচ ভিডিও আপলোড করার পর তুমি ফোন বন্ধ করে বসে রইলে।”
“আশ্চর্য কথা বলছেন। আপনি আমাকে ছোট করে কথা বললে আমি খুশি হব? আপনাকে ফোন করে কনগ্রাচুলেশন জানাবো? এতোটাই ফেলনা আমি?”
“আমি তোমাকে ছোট করে কথা বলেছি? কেন এমন মনে হলো বলোতো?”
রিফাত এবার অবাক।
“ছোট করেননি? বলেননি, যারা ভাইরাল হয় পরবর্তীতে সস্তা ফেমের মোহে বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে এই পথেই এগিয়ে যায় যেটা উচিত না। আমি কি সেই পথে আছি? পড়ালেখা করিনি?”
রিফাত কপালে হাত দিয়ে বসে থাকে। ও কি বলেছে আর এই মেয়ে কি বুঝেছে? বোকা মেয়েটা ভুল বুঝেছে তাকে। এখন এই বোকাপাখিটাকে কিভাবে বুঝাবে যা বলেছে সেটা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে।
“কি হলো কথা বলছেন না কেন?”
“ভাবছি কি বলবো? কিভাবে বললে তুমি বুঝবে। আচ্ছা কথাগুলো যখন বলপছি তার আগে বা পরে কি তোমার নাম নিয়েছি? বা তোমায় নিয়ে কিছু বলেছি?”
শোভা আবারও মাথা নাড়ে।
“তাহলে কেন মনে হলো কথাগুলো তোমাকে উদ্দেশ্য করে বলা? মোট দশজনের উপর জরিপ করেছিলাম আমি। তারমধ্যে সাতজন কোনরকমে পড়ালেখা করে। তারা টিকটক করে, ইউটিউবে ভিডিও বানায়, শর্টস বানায়, অনেক সময় সেগুলোর মধ্যে এমন কিছু দেখায় যেগুলো দেখানো উচিত না। আমি যা বলেছি তাদের উদ্দেশ্যে বলেছি। তোমার অতীতে কি হয়েছে সেটা তো আমি এখনো ক্লিয়ার জানি না। তোমাকে নিয়ে কেন কিছু বলবো? কেন জাজ করবো তোমাকে?”
শোভা মুখ নিচু করে রইলো। ক্রমাগত ঠোঁট কামড়ে যাচ্ছে সে। রিফাত যা বলছে তা কি সত্যি? সে সত্যি ভুল বুঝেছে রিফাতকে?
“শুরু থেকে এখন পর্যন্ত একবারও কি তোমাকে এসব নিয়ে কিছু বলেছি?”
“নাহ।”
“তবে? এই ক’দিনে আমাকে দেখে কি মনে হয়েছে? তোমাকে হার্ট করতে পারি আমি?”
“উহু।” ছোট্ট করে জবাব দিলো শোভা। রিফাত হাসলো-“এতটুকু বিশ্বাস করবে তো আমাকে?”
শোভা মাথা দুলায়।
“তাহলে খামোখা ভুল বুঝো না আমাকে। আমি কখনো কোনভাবেই চাইবো না তুমি অন্যের কাছে ছোট হও। এই কারণে নয় যে তুমি আমার উডবি। বরং এই কারণে যে তুমি একজন মেয়ে, একজন ভবিষ্যৎ স্বপ্নস্রষ্টা। আমি বিশ্বাস করি অতীতে যেটা হয়েছিল সেটা একটা ভুল। তুমি এই ভুল থেকে সরে এসে ভালো রেজাল্ট করে ভালো জায়গায় ভর্তি হয়ে নিজেকে প্রমান করেছ। আর এইজন্য তুমি আমার চোখে বিশেষভাবে সন্মানিত। বুঝেছ বোকা মেয়ে?”
শোভা কিছু না বলে রিফাতের দিকে তাকালো। ওর কথাগুলো ভালো লাগছিল। এভাবে কেউ কখনো বলেনি তাকে। এইরকম ভরসা কেউ করেনি। দু’দিন উল্টো পাল্টা ভেবে যেমন অশান্তি লাগছিল আজ রিফাতের কথা শুনে মনের মধ্যে ভীষণ শান্তি শান্তি লাগছে শোভার।
“এখন কি খাবার খাবেন ম্যাডাম? এই অভাগার পেটে কিছু দানা পানি ফেলার সুযোগ দিন প্লিজ।”
শোভা কথা না বলে চুপচাপ প্লেটে রাইস তুলে রিফাতের দিকে এগিয়ে দিলো। নিজেও নিয়ে খাওয়া শুরু করলো।
“এই বৃহস্পতিবার না আসলে কি তোমার মন খারাপ হবে?”
শোভার খাওয়া থেমে যায়। বৃহস্পতিবারের রুটিন একটা অভ্যাস হয়ে গেছে শোভার। রিফাত না এলে কেমন লাগবে বুঝতে পারছে না এখন। সে জানতে চাইলো-“কোন কাজ আছে? কাজ থাকলে আসার দরকার নেই।”
“হ্যা কাজ আছে। আসলে আমরা বন্ধুরা বৃহস্পতিবার করে একত্রে আড্ডা দেই। গত তিন সপ্তাহে যাইনি বলে ওরা খুব করে ধরেছে। অন্য কিছু সন্দেহ করছে।”
“কি সন্দেহ করছে?”
“ওরা বলছে আমি কারো প্রেমে পড়েছি। তাই ওদের আড্ডায় যাচ্ছি না।”
প্রেমে পড়ার কথা শুনে শোভার গালের উত্তাপ বাড়ে। সে মাথা নিচু করে খাবারে মন দিলো-“তো নিয়ম করে এখানে না আসলেই হয়। বন্ধুদের সাথে থাকলেই তো হয়।”
“কিন্তু আমার যে এখানে আসতেই ভালো লাগে।”
শোভা চামচ নাড়াচাড়া করছিল। রিফাতের কথায় ওর হাত থেমে যায়। রিফাতের গলার স্বরে কিছু ছিল। সেটা কাটিয়ে পরক্ষনেই স্বাভাবিক গলায় বললো-“কিন্তু এবার যেতেই হবে। তা না হলে ওরা আমাকে আস্ত রাখবে না।”
“তো জান না কে মানা করেছে। আমিও আপনাকে বলতে চাইছিলাম বেরুবো না। আমার এক্সাম আছে শনিবারে পড়তে হবে।”
“তাহলে তো ভালোই হলো। তুমিও পড়তে পারলে আমিও ওদের সাথে সময় দিলাম। তাহলে ওই কথাই রইলো। এই বৃহস্পতিবার আসছি না।”
“বলেছেন তো একবার বারবার বলার কি আছে? বরং এই বৃহস্পতিবার কেন কোন বৃহস্পতিবারই আসতে হবে না। আমি তাহলে মন দিয়ে পড়তে পারবো। ঘুরতে যাওয়ার চিন্তায় পড়া হয় না।”
শোভার হঠাৎ মেজাজ ছুটে গেল। গরগরিয়ে কথা বলে রাগ উগলে দিলো। ওদিকে রিফাত মিটমিটিয়ে হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। রাগের মাথায় কি বলে দিলো মেয়েটা!
চলবে—
©Farhana_Yesmin