#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-১৮
পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও আদৃতাকে পাওয়া গেলো না। রিফাত মায়ের ঘরে এলো-“আদৃতা কোথায় মা? ওকে দেখছি না কেন?”
“ও আজকে ভার্সিটিতে থাকবে। কাল নাকি এক্সাম আছে তাই।”
“তুমি শোভাদের বাড়ি গেছিলে? কি বলেছ শোভার বাবাকে?”
রোকেয়া তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করলেন-“এরইমধ্যে তোর কানে খবর পৌঁছে গেছে? নিশ্চয়ই আজও শোভার সাথে ছিলিস তুই? আদৃতা ঠিকই বলে, শোভা মেয়েটাই তোর মাথা খাচ্ছে।”
রিফাত রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠলো-“আর তোমার মাথা কে খাচ্ছে মা? আদৃতা? তুমি বিনা দোষে শোভার নিরীহ বাপকে যেয়ে কথা শুনিয়ে আসো। একবারও ভেবেছ কতটা অমানুষ এর মতো কাজ করেছ? এখন ওর বাবা যদি অসুস্থ হয়ে যায় তাহলে এই দায় কে নেবে বলতো? এক আদৃতা শোভার জীবন নষ্ট করেছে আর এখন ওর তালে নাচছো তুমি। শোন মা, একটা কথা পরিস্কার বলে দেই, শোভা ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবোনা আমি। যদি ভাবো তুমি মা তাই তোমার কথা শুনে আমি শোভাকে ভুলে অন্য কাউকে বিয়ে করব তাহলে ভুল ভাবছো। এমন আশা করা ভুলে যাও। বুঝলে?”
রিফাত যেভাবে এসেছিল সেভাবেই ফিরে গেল। ওর মাথাটা দপদপ করছে। বেশ বুঝতে পারছে এই আদৃতা ইচ্ছে করে এমন লুকোচুরি খেলছে ওর সাথে। ঘরে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে যায়। কি করবে এখন? এভাবে কতদিন চলবে? কিছু বুঝতে পারছে না। কোন বন্ধুকে বলবে সে উপায়ও নেই। হঠাৎ করে জেনে ওরা হয়তো সহযোগিতার বদলে উল্টো রিয়্যক্ট করবে। এরমধ্যে আজ শোভাও সম্পর্ক ছিন্ন করলো। ওকেই বা দোষ কি দেবে? মেয়েটাও নিরুপায় হয়ে গেছে। একজন মানুষ কতগুলো জীবন নিয়ে খেলছে। হাসফাস লাগে রিফাতের। মাথাটা ফাঁকা লাগে হয়ে গেছে। পানি ছেড়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে রইলো।
শোভা বাসায় যায় না বহুদিন। ইচ্ছে করলেও যায় না। খবরটা শোনার পর থেকে ইচ্ছেটুকুও গায়েব হয়ে গেছে। বাবার মুখোমুখি হওয়ার না ইচ্ছে আছে না সাহস। এই মানুষটা বারবার তার কারণে ছোট হচ্ছে, লোকের সামনে মাথা নত করতে হচ্ছে। অথচ এসবে তার বিন্দুমাত্র দোষ নেই। না বাবার জন্য কিছু করার উপায় আছে। নিজেকে খুব হেল্পলেস লাগে তার। এতোটা নিরুপায় হয়ে থাকতে থাকতে দমবন্ধ লাগে শোভার। একা কামরায় হাওমাও করে কাঁদে শোভা। জীবনটা তাকে নিয়ে এতো খেলছে কেন? কি দোষ তার? আদৃতাকে বিশ্বাস করে ঠকেছে। তাই বলে বারবার আদৃতাই কেন জিতে যাবে? কেন শোভাকেই ছোট হতে হবে?
সারারাত অনেক ভেবেছে সে। আদৃতার করা কাজ, তার পালিয়ে যাওয়া তারপর কোইন্সিডেন্টলি একই ইউনিভার্সিটিতে পড়া সবকিছু নিয়ে ভেবেছে। ভেবেছে আর কেঁদেছে যেমনটা গত তিনবছরে অসংখ্যবার হয়েছে। তিনবছর ধরে মনে মনে আদৃতাকে খুঁজেছে সে। ওকে পেলে কি করবে তা ভাবেনি কিন্তু খুঁজেছে। এখন যখন ওকে পেয়েছে তখনও বুঝতে পারছে না কি করবে। আদৃতাকে ওর কর্মের সাজা দিতে চায় কিন্তু কিভাবে দেবে? উপায় কিছু আছে কি? অন্য কারো হেল্প নেবে সেই উপায় নেই। কারো হেল্প চাইলে তাকে নিজের পুরনো কাহিনি বলতে হবে। সে জানে কেউ সহজে বিশ্বাস করবে না ওকে। উল্টো হিতে বিপরীত হতে পারে। সকলে ওকেই অবিশ্বাস করবে। কারন জগতটা যা দেখে তাই বিশ্বাস করে। আর দেখার হিসেবে শোভা দোষী। সকলের কাছে কৈফিয়ত দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেছে শোভা। নতুন করে কৈফিয়ত দেওয়ার সাহস নেই আর। কিন্তু একা একা কি করবে, কি করতে পারে?
ক্লান্ত বিদ্ধস্ত শোভা সকালে হেঁটে হেঁটে ক্লাসে যায়। আকাশ পাতাল ভাবনার মধ্যেই মাথায় প্রশ্নটা এলো। কেন আদৃতা যেখানে পড়ে সেখানেই ভর্তি হলো সে? বিধাতা কেন আদৃতার সাথে তার দেখা করিয়ে দিলো? কি চান তিনি? উদ্দেশ্য কি তার? উত্তরটা পেয়ে গেল তৎক্ষনাৎ। আদৃতাকে সাজা দেওয়ার সু্যোগ দিয়েছে ঈশ্বর। যেন অপরাধীকে সামনে দিয়ে উপরওয়ালা বলছে, এবার তুমি বুদ্ধি করে তার শাস্তি নির্ধারন কর যেমন তোমার মর্জি। শোভা হাসলো, আসলেই তো। এভাবে কেন ভাবেনি আগে? আদৃতা যেভাবে তাকে ফাঁদে ফেলেছিল সেই একই উপায়ে কি ওকে ফাঁদে ফেলা যায়? কিংবা ওরই ফাঁদে ওকে আঁটকে ফেললে কেমন হয়? ওরও নিশ্চয়ই কোন দূর্বলতা আছে? কি সেই দূর্বলতা সেটাই খুঁজে বের করতে হবে।
অনেক ভেবে শোভা ঠিক করলো আদৃতাকে ফলো করবে ও। ইউনিভার্সিটিতে কার সাথে মেশে কি করে সব জানবে। কিছু না কিছু তো অবশ্যই পাবে। কিন্তু ওকে খুঁজে বের করবে কি করে? কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ে সেটাই তো জানে না। ওর নিশ্চয়ই ফেসবুক একাউন্ট আছে? আদৃতার পুরো নাম লিখে সার্চ দিলো শোভা। অনেকগুলো একাউন্ট সামনে এলো। খুঁজে খুঁজে পেয়ে গেলো কাঙ্ক্ষিত আইডি। প্রোফাইল লক করে রেখেছেন ম্যাডাম। নিজের আইডি দিয়ে তো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেওয়া যাবে না। এমনকি নতুন কোন আইডি হলেও আদৃতা একসেপ্ট করবে না। তাহলে? কি করবে? অন্য কিছু ভেবে রাখে শোভা। দেখা যাক কাজে দেয় কিনা।
★★★
দুই দিন পর অবশেষে কনার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করেছে আদৃতা। শোভা কনার পারমিশন নিয়ে আদৃতার আইডি ঘুরে দেখলো। পাবলিক হেলথ নিয়ে পড়ছে আদৃতা। ওর মতো মেয়ে যদি জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবে তাহলে তো জীবন শেষ। এই মেয়ে যেখানে যাবে সবার স্বাস্থ্য খারাপ করে ছাড়বে। ও নাকি আবার পাবলিক হেলথে পড়ে। নিজের মনে হাসলো শোভা। অনেক অনেক বন্ধু আদৃতার। সেই লিষ্টে রিফাতও আছে। একদম ছবির মতো পরিস্কার আদৃতার আইডি। ঠিক ওর চরিত্রের বিপরীত অবস্থা।
অনেক সময় ধরে খুঁজে অবশেষে কাঙ্ক্ষিত জিনিস পেলো শোভা। কনার আইডি থেকে আবারও একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো। জানে না একসেপ্ট হবে কিনা। আশা করতে দোষ কি? শোভা বেশ উত্তেজনা বোধ করে নিজের মধ্যে। হঠাৎ কণার দিকে নজর পড়ে। ফেসবুকে কিছু একটা দেখে হাসছে। কণাকে বলবে নাকি? সারাদিন ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ায়।
মেয়েটার বন্ধু অনেক, হয়তো কিছু জানলেও জানতে পারে। শোভা কণাকে ডাকে-“এই কণা, একটা উপকার করবি?”
“কি উপকার?” কণা অবাক হয়ে জানতে চায়। শোভা চাপা স্বভাবের মেয়ে, কখনো কোন কিছু নিয়ে কথা নেই ওর। হঠাৎ এমন প্রস্তাবে অবাকই হলো।
“তোর পরিচিত কেউ কি পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্টে আছে? সেকেন্ড ইয়ার একজনার খবর জানতে চাইছি। পরিচিত কেউ আছে?”
কণার মুখে দুষ্ট হাসি ছড়িয়ে পড়লো-“তাহলে এই ব্যাপার? সেকেন্ড ইয়ারকে হ্যা? কে বলতো? শেষ পর্যন্ত ক্যাম্পাস সিনিয়রকেই ভালো লাগলো?”
শোভা হেসে দিলো-“উফফ, তোদের মাথা! সবসময় এসবই ভাবিস। আমি একটা মেয়ের খোঁজ নেব।”
কণার হাসি গায়েব হলো-“ওহহহ। কোন মেয়ে দেখা তো?”
শোভা আদৃতার খুব সাজগোছ করা একটা ছবি দেখাল-“এই যে এই মেয়েটা।”
“আরে! এ তো সেই বিখ্যাত আপুটা।”
শোভা চমকে উঠলো-“বিখ্যাত! কি করেছে?”
“ফাস্ট ইয়ারেই নাকি এক সিনিয়র ভাইকে ছ্যাকা দিয়েছে। সেই ভাই আবার অনেক মেয়ের ক্রাশ।”
“বাহ দারুন তো! কিন্তু তোরা জানিস কিভাবে?”
“সবাই জানে। তুই তো ক্যান্টিনে থাকিস না। খেয়ে চলে আসিস তাই জানিস না। ওই ভাই এই আপুর জন্য হাতটাত কেটে অস্থির অবস্থা।”
“তাই?”
“হ্যা। এখন এক ব্যাচমেটের সাথে সম্পর্ক। খুব মাখামাখি করে ঘোরাফেরা করে ক্যাম্পাসে।”
“বাহ, বেশ ইন্টারেস্টিং তো।”
শোভার মন ফুরফুরে হয়।
“আরও ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো এই মেয়ে ভালো নাচে। ওদের ডিপার্টমেন্টের এক অনুষ্ঠানে নেচে হইচই ফেলে দিয়েছে। তবে নাচের ড্রেস দেখে লজ্জা পেতে পারিস।”
শোভার মনে পড়ে একসাথে নাঁচে ভর্তি হয়ছিল ওরা। পরে শোভা ছেড়ে দিলেও আদৃতা শিখেছিল নাচ। শোভার দিকে তাকিয়ে কণা হেসে দিলো-“এইসব খবরে হবে নাকি আরও খবর লাগবে?”
হাসলো শোভাও-“আপাতত চলবে। মেয়েটা এত বিখ্যাত সেটাই তো জানতাম না। আচ্ছা, ওই ভাইয়া টাকে কোথায় পাব বলতে পারিস?”
“কোন ভাইয়া? ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে যাওয়া ভাইয়া? ওকে আর কোথায় পাবি। পড়া শেষ মনেহয় এতোদিনে।”
“নামটা বলবি? একটু খোঁজ নে না।”
“ওয়েট। দেখি আমার এক আপু আছে তার কাছে বলছি। খোঁজ পেলে তোকে জানাব।”
“আচ্ছা।”
শোভার হাসি পেল। ফিতরত বলে একটা কথা আছে। মানুষ তার ফিতরত থেকে বেরুতে পারে না এটা আদৃতা প্রমান করে দিলো। ভালোই হলো একদিকে। তার জন্য সহজ হলো সব। আদৃতা নিজেই সব সহজ করে দিলো। এখন শুধু সব তথ্য জোগাড় করতে হবে।
মোবাইলের ভাইব্রেশনে চিন্তাভঙ্গ হলো শোভার। রিফাত ফোন দিচ্ছে। কেটে দিলো শোভা। কিন্তু জানে লাভ নেই। আবার ফোন দেবে রিফাত, দিতেই থাকবে। গত তিন দিন ধরেই দিচ্ছে শোভা ধরেনি। এমন না যে ধরতে ইচ্ছে করেনি। খুব ইচ্ছে করেছে, কথা বলতে মন চেয়েছে কিন্তু তবুও রিসিভ করেনি ফোন। মায়ের কাছে শুনেছে, বাবা একদম নীরব হয়ে গেছে। শোভার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পর, বিয়ে ঠিক হওয়ার পর বাবা খানিকটা স্বাভাবিক হয়েছিল। মায়ের সাথে টুকটাক কথা বলতো এখন সেটাও বলছে না আর। সারাদিন অফিস করে বাসায় ফিরে চুপচাপ ঘরের মধ্যে বসে থাকে। এসব শুনে শোভার বুকে আদৃতার জন্য ঘৃনার আগ্নেয়গিরি টগবগিয়ে ওঠে। রিফাতের প্রতি ভালোলাগাটুকু উবে যায়। আসলে সন্মান যেখানে থাকে না সেখানে ভালোবাসা ফিকে লাগে।
চলবে—
© Farhana_য়েস্মিন
#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-১৯
ছেলেটার নাম হিমেল, মাস্টার্স দেবে। শোভা ফোন করে একবার দেখা করার অনুরোধ করতেই ছেলেটা রাজি হয়েছে। শোভা এখন বসে আছে স্টাফ কোয়ার্টারের সামনের চায়ের দোকানে হিমেলের অপেক্ষায়। সামনে একটা খেলার মাঠ। বাচ্চারা ফুটবল খেলছে সেখানে। শোভা সেদিকে তাকিয়ে ছিল। কিছুক্ষণ পরে একজন সুদর্শন যুবক এসে দাঁড়ায় সামনে-“শোভা?”
“জ্বি!” শোভা উঠে দাঁড়ায়।
“আমি হিমেল। তুমি মনেহয় আমাকে ফোন করেছিলে।”
“জ্বি ভাইয়া। ভালো আছেন আপনি?”
হিমেল মাথা দুলায়-“হ্যা। বসো প্লিজ।”
একটু দূরত্ব রেখে বসে শোভা। হিমেলকে দেখলো ভালো মতো। লম্বা একহারা ছেলেটা বেশ স্মার্ট। ফর্সা চেহারায় আদূরে ভাব আছে। এমন ছেলেকে আদৃতা কেন ফিরিয়ে দিলো? ছেলেটা দু’কাপ চায়ের কথা বলে শোভার সামনে বসলো-“কি বলবে বলো তো? ফাস্ট ইয়ার কারো ফোন পেয়ে অবাকই হয়েছি। তোমাকে তো চিনি বলে মনে হচ্ছে না।”
শোভা হাসলো-“আমাকে আপনার চেনার কথা না ভাইয়া। বলা যায় আপনার খোঁজ পেয়েছি ভাগ্যগুনে।”
শোভার কথায় হিমেলের ভ্রু কুঁচকে গেল-“ভাগ্যগুনে! এতো দামী মানুষ কবে হলাম ভাই? কি ঘটনা খুলে বলোতো?”
“আদৃতাকে মনে আছে ভাইয়া? ওকে নিয়ে ঘটনা।”
হিমেলের মুখে অন্ধকার নামে। গম্ভীর কন্ঠে জবাব দিলো-“ওকে নিয়ে কোন কথা বলতে চাই না আমি এমনকি শুনতেও চাই না।”
শোভা অনুনয় করে-“প্লিজ ভাইয়া, রেগে যাবেন না। আমি জানি আদৃতা কি করেছে আপনার সাথে। আর এই কারনেই আপনাকে খুঁজে বের করেছি। একমাত্র আপনি আমার কষ্ট বুঝবেন। আমাকে সাহায্য করতে পারবেন।”
হিমেল বিস্মিত হয়ে তাকায় শোভার দিকে-“সাহায্য! তোমাকে? খুলে বলোতো আদৃতা কি করেছে তোমার সাথে?”
“আপনি একটু শান্ত হয়ে বসুন প্লিজ। মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনুন।”
“হ্যা বলো শুনি। ওই বদমাশ মেয়েটা কি করেছে তোমার সাথে।”
শোভা বলতে শুরু করে। ওর আর আদৃতার বন্ধুত্ব, আদৃতার স্বভাব চরিত্র, ও কিভাবে শোভাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে ঢাকায় পালিয়ে এলো, তারপর এখানে কিভাবে আদৃতার সাথে দেখা হলো সবকিছু বিস্তারিত বললো হিমেলকে। হিমেল সব শুনতে শুনতে কখনো চোখ বড় হয় কখনো দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। শোভার কথা শেষ হতেই হিমেল প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো-“তুমি রিফাত সাহেবকে ভালোবেসে ফেলেছ, তাই না?”
এমন প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল না শোভা। তাই প্রশ্নটা আসতেই হতভম্ব হয়ে গেল। হিমেল মুচকি হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। শোভা আরক্ত গালে মাথা নাড়ায়-“না ভাইয়া, ভালোবাসি না। ওসব ভাবনা মাথাতেই আসে না। আমার মাথায় কেবল আদৃতার ভাবনা। কোন অপরাধ না করেও যে সাজা আমি গত তিনবছর ধরে পাচ্ছি সেটা বন্ধ করতে আর আসল অপরাধীকে শাস্তি দিতে চাই। এর বাইরে অন্য কিছু ভাবছি না।”
“আদৃতাকে সাজা দেওয়ার এই যে ডেসপারেশন এইটা তোমার মধ্যে কেন এসেছে জানো? রিফাত সাহেবের জন্য। ধর, উনি তোমার লাইফে নেই। এমনিতেই একদিন আদৃতা তোমার সামনে এলো। তাহলে কি করতে? বড়জোর ওর সাথে ঝগড়া করতে, চুলোচুলি হতো হয়তোবা কিন্তু তুমি যে ওকে সাজা দিতে চাচ্ছ এই অটল ভাবটা তোমার মধ্যে আসতো না। আমাকে খুঁজে বের করে দল ভারী করতে চাইতে না। তুমি হয়তো বুঝতে পারনি কিংবা তোমার মন এটা মানতে চাইছে না যে তুমি ওনাকে ভালোবেসে ফেলেছ তবে এটাই সত্যি। যা কিছু করছো করতে চাইছ
সবকিছুর মুলে রিফাত সাহেব। ওনার সাথে তোমার বিয়ের আলাপ, এখন আদৃতার তোমাকে তার জীবন থেকে দূর করার চেষ্টা ওর প্রতি তোমার ঘৃণা বাড়িয়ে দিয়েছে। মানে না কি দাঁড়াচ্ছে তাহলে?”
শোভা বোকার মতো প্রশ্ন করে-“কি?”
“আরে তুমি তাকে ভালোবাসো বলেই তো এতকিছু করতে চাইছো। তিন বছর আগে আদৃতা যা করেছে সেসবে তোমার রাগ থাকতে পারে তবে এই যে এভাবে ওকে নিয়ে পড়ে থাকা এটার ক্রেডিট রিফাত সাহেবের। বুঝলে বোকা মেয়ে?”
শোভা হিমেলের দিকে তাকিয়ে রইলো। হিমেল আফসোসের সুরে বলে-“রিফাত সাহেব খুব লাকি উনি তোমাকে পেয়েছেন। আর আমি পেয়েছি আদৃতার মতো মেয়েকে যাকে জীবনে প্রথমবারের মতো ভালোবেসে মনটা কালিমায় লেপন করেছি।”
শোভা ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। লাজের ভাজ ভেঙে নিজেকে ফিরে পেতেই জানতে চাইলো-“আপনাদের ব্রেকাপ হলো কেন? মানে আদৃতার অজুহাত কি ছিলো?”
হিমেল মুখটায় অপমনের ছায়া-“আমি নাকি ওর থেকে অনেক বড়। আমার বয়স মনমানসিকতার সাথে ওর এডজাস্ট হচ্ছে না। তাছাড়া ও অনেক খোলামেলা চলাফেরা করতে শুরু করেছিল সেসব নিয়েও ঝামেলা হত। আমার দেওয়া গিফটে ওর মন ভরতো না। ব্রেকাপের পর বুঝলাম আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। তাই ওর পোষাবে না। এখন যার সাথে মিশছে তার বাবার বেশ টাকাপয়সা আছে। তবে শুনেছি এই ছেলেই ওর একমাত্র প্রেমিক নয়। আরও আছে একজন।”
শোভার চোখ চকচক করে উঠলো-“আরও আছে? কে সে?”
“দেখিনি কখনো। শুনেছি মাত্র। প্রথম প্রেম তো মায়া ছাড়তে পারি না। সেই মায়া থেকেই খোঁজ রাখা।”
“ভাইয়া, তাহলে একটা কাজ করেন। ওর সেই গুপ্ত জনের খোঁজ নেন। সামহাউ তাকে পেলে কাজ হয়ে যাবে।”
“কি করতে চাইছো বলো তো?”
হিমেল উৎসুক হয়ে জানতে চাইলে শোভা। শোভা দৃঢ় প্রত্যয়ে বলে-“বেশি কিছু না ভাইয়া। জাস্ট ওর মুখোশ খুলতে চাচ্ছি। ঠিক যেভাবে ও আমাকে ভাইরাল করেছিল আমিও ওকে ওভাবেই বিখ্যাত বানাবো।”
“আর ইউ শিওর? পারবে তো?”
শোভা বিশ্বাসি হাসি দিলো-“পারবো ভাইয়া। আপনি শুধু খোঁজ এনে দেন। বাকী কাজ আমার।”
“ঠিক আছে। আমাকে কটা দিন সময় দাও দেখি খোঁজ পাই কিনা। এখানে তো সেই ছেলে আসবে না। আদৃতাই হয়তো কখনো সেই সুযোগ দেবে না। কারন তাতে ওর গোমর ফাঁস হয়ে যাবে। পার্সোনালি ওর পেছনে কাউকে লাগাতে হবে। দেখি কতটুকু করা যায়। আমি তোমাকে খবর দেব।”
হিমেল চলে যেতে উদ্যত হতেই শোভা ডাকলো-“ভাইয়া, শেষ মুহূর্তে আবার পিছিয়ে আসবেন না তো? বললেন যে ওর প্রতি এখনো মায়া আছে।”
হিমেল গভীর দৃষ্টি মেলে শোভাকে দেখলো-“নাহ পিছিয়ে আসবো না। আমার নিজের জন্য যতটা না করতে চাই তার চাইতে অনেক বেশি তোমার জন্য করতে চাই। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। খুব ভালো মেয়ে তুমি।”
হিমেল বড় বড় পা ফেলে চলে যায়। শোভা তাকিয়ে রইলো ওর দিকে।
★★★
তার কয়েকদিন পরে হলে যাওয়ার পথে রিফাতের গাড়িটা দেখলো শোভা। গাড়িটা দেখেই শোভা উল্টো ঘুরে হাঁটতে শুরু করলো। আয়নায় দেখে রিফাত গাড়ির দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো-“মেঘা, চলে যাচ্ছ কেন? প্লিজ কথা শোন।”
শোভা দাঁড়ায় না আরো দ্রুত পা চালায়। রিফাত দৌড়াতে শুরু করে। শোভার পথআগলে দাঁড়ায়। হাঁফাতে হাঁফাতে জানতে চাইলো-“আমাকে দেখে পালাচ্ছ? এতোটাই খারাপ আমি?”
“কেন এসেছেন আপনি? মানা করেছিলাম না?”
“ফোন ধরছো না। দু’সপ্তাহ হয় কথা বলছো না, দেখা হচ্ছে না। কিভাবে থাকি বলোতো?”
“যেভাবে এতদিন ছিলেন।”
রিফাত আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো-“এতো নিস্ঠুর করে কথা বলছো কি করে? এই যে দুইমাস রেগুলার ঘুরে বেড়ালাম, এত এত কথা বললাম। তোমার মনে পড়ে না একবারও? আমাদের একসাথে কাটানো সন্ধ্যা বৃষ্টিমুখর দিন সব ভুলে গেছ? একটু জায়গাও কি পাইনি তোমার মনে?”
“পথ ছাড়ুন আপনার এসব বাজে কথা শোনার সময় নেই আমার।”
“ছাড়ব না। দু’টো মিনিট দাঁড়িয়ে না হয় একটু কথা বল আমার সাথে।”
রিফাতের অনুনয় কানে তোলে না শোভা।
“ভালো মতো বললে বোঝেন না আপনি? কেন কথা বলবো আপনার সাথে? কিসের অধিকারে, কোন সম্পর্কের জোরে?”
শোভার রাগত স্বরে বলা কথায় রিফাত দু’পা এগিয়ে এলো। শোভার দিকে তাকিয়ে কোমল গলায় বললো-“আগে যে অধিকারে বলতে সেই অধিকারে। কেন মায়ের রাগ আদৃতার রাগ আমার সাথে দেখাচ্ছ মেঘা? আমি তো কিছু করিনি। উল্টো তোমাকে হেল্প করতে চাইছি।”
“গরু মেরে জুতো দান চাই না আমার। আপনার মা আমার বাবাকে অপমান করে আর আপনি আসেন আমাকে সান্ত্বনা দিতে। হলো কিছু?”
রিফাত অসহায় হয়ে কাঁধ ঝাঁকাল-“আমি বলেছি তো সব ঠিক করে দেব। কিছুদিন সময় দাও আমাকে। আমার উপর বিশ্বাস নেই তোমার?”
“না নেই। হয়েছে? এবার আসুন।”
রিফাত তাকিয়ে রইলো শোভার দিকে। এই শোভাকে যেন সে চেনে না। নাকি গত দুই মাসের শোভা অন্য কেউ ছিলো? রিফাত ঠান্ডা গলায় বললো-“অন্য কাউকে ভালো লেগেছে? তোমারও বুঝি আদৃতার মতো অসুখ করেছে? আমি তো দেখতে ভালো না তাই আমাকে এড়িয়ে চলছো। সুন্দর কাউকে পেয়েছ তাই না? টল হ্যান্ডসাম। সেদিন দেখলাম এমন একটা ছেলের সাথে কথা বলতে।”
শোভা এবার সত্যিই রেগে গেল-“আপনি আমার পিছু নিয়েছেন?”
“তুমি এভোয়েড করছো বাধ্য হয়ে আসতে হয়। বুঝলাম আদৃতার কথায় মা ভুল করেছে। কিন্তু তার বদলা নিতে তুমি কি করছো?”
“আশ্চর্য মানুষ আপনি। আমি কথা বলতে চাইছি না আপনি আমাকে জোর করছেন।”
“কথা বলবে না কেন? কেন কথা বলবে না? আমার কি দোষ?”
রিফাত রেগে চেচিয়ে উঠলো। শোভা রাগলেও শান্ত রইলো। ঠান্ডা গলায় বললো-“আপনার দোষ আপনি আদৃতার ভাই। দয়া করে আর আসবেন না। নিজেকে দুঃখী দেখতে চাই না আর।”
“আমি আসলে তুমি দুঃখ পাও?”
রিফাত অবাক হয়ে বলে। শোভা মাথা দুলায়-“হ্যা পাই।”
“ঠিক আছে আর দুঃখ দেব না তোমাকে। ভালো থেক নতুন কারো সাথে।”
রিফাত হেলেদুলে হেঁটে গাড়িতে উঠলো। শোভার বুক কাঁপছিল রিফাতকে দেখে। ছেলেটার হাঁটা দেখে মনে হলো এখনই মাটিতে লুটিয়ে পড়বে। গাড়িতে বসতে হাফ ছেড়ে বাঁচে।
রিফাতের গাড়ি চলতে শুরু করতেই শোভার চোখ ঝেঁপে কান্না নেমে এলো। কষ্ট কি তার কম হচ্ছে? বৃহস্পতিবারের জন্য তার মনটা কি ছটফটিয়ে উঠে না? তাহলে? রিফাত কেন বুঝতে চায় না তাকে? সে কি ইচ্ছে করে এমন করছে?
এতোটা কঠোর তো হতে চায়নি সে। কিন্তু এটাও সত্যি এভাবে রিফাতের সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় না। এইসব টানাপোড়েন ভালো লাগছে না। গত দু’টো মাসের স্মৃতি তার কাছে অনেকটা স্বপ্নের মতো। যে স্বপ্ন দেখলে মন ভালো হয় সেই স্বপ্নের মতো বেঁচেছে সে। ওই দিনগুলোর স্মৃতি তার আজকের দিনের বেঁচে থাকার রসদ। ওইটুকু নিয়েও বেঁচে থাকা যায়। শোভা বেঁচে থাকবে।
চলবে—
© Farhana_Yesmin