#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-২০
“ভাইয়া, কি হয়েছে তোমার? অবেলায় শুয়ে আছো?”
ছোট ভাই গালিবকে দেখে বিরক্ত হলেও কিছু বলে না। আলসেমি ছেড়ে রিফাত শোয়া থেকে বসলো। যদিও মনটা খুব খারাপ তবে ভাইকে বুঝতে দিলো না।
“তেমন কিছু না। তোর খবর কি? অনার্স তো শেষ এখন কি করবি?”
“জানি না কি করবো। কিন্তু তোমার কি অবস্থা? শুনলাম তোমার বিয়ে ভেঙে গেছে?”
“জানি না কি হচ্ছে। সবার যেমন ইচ্ছে তেমন করছে। আমি আর কি বলবো?”
গালিব হাসছে-“এর চাইতে প্রেম করা ভালো। নিজে পছন্দ কোরে বিয়ে করে নিয়ে আসবো। মানলে মানবে না মানলে নেই। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাব। নিজের মতো থাকবো।”
রিফাত গালিবের দিকে চেয়ে ভাবে, কথাটা খুব একটা ভুল না। তবে চাইলেই প্রেম করা যায় না এটা গালিবকে কে বুঝাবে। মেয়েরা সবাইকে সমান পাত্তা দেয় না। রিফাত কথা ঘুরায়-“তুই কি তাহলে প্রেম করে বিয়ে করবি?”
“আবার জিগায়।”
“বাহ ভালো তো? তা প্রেম কি করে ফেলেছিস অলরেডি? একা একা বিয়ের কথা ভাবছিস মনেহয়।”
গালিব খানিকটা লজ্জা পায়-“আরে না ভাইয়া। কি সব বলো। এখন ওসব করলে তো জীবনই শেষ। আগে নিজে কিছু একটা করি।”
রিফাত গালিবকে দেখলো। লম্বায় ওর চাইতে তিন চার ইঞ্চি বেশি। চেহারায় পুরুষালী ভাব বেশ। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। গালিব কিছুটা এগিয়ে এসে গলা নিচু করলো-“মাকে কথা বলতে শুনলাম। আদৃতাকে ছেলের বউ করতে চায়। চাচীর সাথে কথা বলছিল মনে হলো।”
এ কথা শোনা মাত্রই রিফাতের অলসতা কেটে গেল। মাথার শিরায় দপদপ শুরু হলো। প্রায় চিৎকার করলো-“তুই ঠিক শুনেছিস? কি বাজে চিন্তা ভেবে দেখ? যে মেয়েকে বোনের বাইরে কিছু ভাবিনি তাকে বউ বানাব? মায়ের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”
গালিব ভাইকে শান্ত করলো-“তুমি আদৃতাকে বিয়ে করতে চাও না, তাই তো? তাহলে আর চিন্তা কিসের? তুমি ভেব না একটুও। মাকে ম্যানেজ করবো আমি।”
“আর ইউ শিওর? তুই পারবি তো? মা যা শুরু করেছে কি আর বলবো। তুই না পারলে আমি কথা বলবো মায়ের সাথে। আর যদি মা বেশি বাড়াবাড়ি করে তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব তবুও আদৃতাকে বিয়ে করবোনা। ওর মতো মেয়েকে বিয়ের প্রশ্নই আসে না।”
গালিব ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখে-“আহা, উত্তেজিত হচ্ছ কেন? আমি বলেছি তো মাকে ম্যানেজ করবো। তুমি ভেব না। কিন্তু কি যেন বললে? আদৃতার মতো মেয়েকে বিয়ে করা যাবে না। মানে কি? আদৃতা কেমন মেয়ে?”
“তুই জানিস না কিছু?”
গালিব মাথা নাড়ে। রিফাত গড়গড়িয়ে সব বলে যায়। আদৃতা শোভার সাথে কি করেছে। রিফাতের বিয়ে ভাঙতে কি বলেছে সব বলে। শুনতে শুনতে গালিবের চোখ বড় হয়। আশ্চর্য চাহুনি দিয়ে বলে-“ও এতো খারাপ? অথচ আমরা কেউ টের পেলাম না? কি করে?”
“তাহলেই বোঝ এমন চালাক মেয়ে বিয়ের যোগ্য কিনা?”
“ঠিকই বলেছ ভাই। এমন মেয়েকে বউ বানানো দূর ওকে তো ঘরেই জায়গা দেওয়া উচিত না। যাক, তুমি ভেব না একটুও। মাকে আমি বোঝাব।”
“মা বুঝলেই ভালো।”
রিফাতের কথায় সায় জানায় গালিব। ওকে খানিকটা চিন্তিত দেখায়। রিফাত তখন এলোমেলো ভাবে ভাবছে কি করবে। এমনিতেই শোভার ব্যবহারে মনটা ব্যাথতুর হয়ে আছে। তারমধ্যে মায়ের কথা শুনে হৃদয় জুড়ে হাজারো কাঁটা ফুটলো যেন। কেন এমন করছে মা? আদৃতা কেমন মোহে আচ্ছন্ন করলো মাকে? এই মোহ কাটবে কি করে? আচ্ছা তোড়ার সাথে কথা বলে দেখবে? আদৃতা যেহেতু তোড়ার সাথে রুম শেয়ার করতো ও আদৃতার ব্যাপারে কিছু জানতো পারে। কারো সাথে আদৃতার সম্পর্ক আছে কিনা? রিফাত তখনই উঠে তোড়ার রুমে গেল।
খুব বেশি কিছু জানা গেল না তোড়ার কাছ থেকে। আদৃতা রাতে ফোনে কারো সাথে কথা বলে, চ্যাট করে কিন্তু তার পরিচয় তোড়া জানে না। পরিচয় জানার উপায়ই বা কি? একমাত্র আদৃতার ফোন হাতে পেলে জানা যাবে। কিন্তু ফোন পাবে কোথায়? সে কখন আসে কখন যায় কিছু বোঝার উপায় নেই। রিফাত যখন থাকে না তখন বাড়িতে আসে। আবার রিফাত আসার আগে চলে যায়। বাবাকেও পাওয়া যাচ্ছে না। সে তার বিজনেস নিয়ে ব্যস্ত বলে এই সুযোগে মা তার নিজের ইচ্ছে চরিতার্থ করছে। রিফাতের হাসফাস লাগে। কার কাছে গেলে মন খুলে কথা বলতে পারবে একটু? শোভা তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বন্ধুদের কাছে যাবে কি? অনেকদিন যায় না। গেলে ওরা অনেক কথা শুনাবে। শুনাক তবুও আজ ওদের খুব দরকার রিফাতের, খুব দরকার।
★★★
দশ দিন পর হিমেল ফোন করেছিল আজ। শোভার কাঙ্ক্ষিত খবর নাকি পাওয়া গেছে। শুনে শোভা ছুটে চলে এসেছে হিমেলের সাথে দেখা করতে।
“ভাইয়া, কেমন আছেন?”
হিমেল হাসলো, আন্তরিক সে হাসি দেখে শোভার ভালো লাগে।
“ভালো আছি। সরি অনেক লেট করে ফেললাম খবর দিতে।”
“আরে কি বলেন? দেরি হলেও তাতে আপনার দোষ কোথায়?”
শোভা মাথা নাড়ে।
“ঠিকই বলেছ। তোমার বান্ধবীটি কেমন তাতো জানোই। তার অগোচরে কিছু করা ইম্পসিবল। আর এতো চালাক মানুষের বিরুদ্ধে প্রমান জোগাড় অনেকটা যুদ্ধের সামিল।”
“পেয়েছেন কিছু?”
হিমেলের চেহারায় তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো-“পেয়েছি বলেই তো তোমাকে ডেকেছি। তার অমুল্য রতনটিকে অনেক কষ্টে খুঁজে বের করেছি। এই যে দেখ ওদের ছবি।”
শোভা দেখলো। একটা হ্যান্ডসাম ছেলের সাথে আদৃতা দাঁড়িয়ে আছে। দু’জন দু’জনার হাত ধরে আছে শক্ত হাতে, মুখে মোহনীয় হাসি। ঘৃনার গা গুলিয়ে উঠলো শোভার। তবুও হিমেলকে দেখে শোভা মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে-“ওর ক্যাম্পাস প্রেমিক নিশ্চয়ই জানে না এর কথা?”
“পাগল! যেমন এই ছেলে জানে না ক্যাম্পাস প্রেমিকের কথা।”
“যদি দু’জনই দু’জনার কথা জেনে যায় তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে ভাইয়া?”
শোভার মুখে দুষ্ট হাসি দেখে হিমেলও হাসে-“খুব থ্রিলিং ব্যাপার হবে। একটা দারুণ থ্রিলার ফিল্ম দেখার আনন্দ মিস করতে চাই না।”
এমন সময় শোভার ফোনটা আওয়াজ দিলো। ফোন বের করে চেক করতেই ওর ঠোঁটের কোনে হাসি চওড়া হলো। যাক, আরেকটা সুসংবাদ এলো। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট হয়েছে।
“আমাদের ক্যাম্পাসে শিগগিরই ফিল্মটার চিত্রায়ন দেখবেন ভাইয়া।”
শোভা উঠে দাঁড়াতেই হিমেল বাঁধা দিল-“আরে দাঁড়াও একটু। আরেকটা কাজ করেছি। এই যে ওই ছেলেটার আইডি। তোমার কাজ একটু এগিয়ে দিলাম।”
হিমেল মোবাইল বাড়িয়ে দিলো। শোভা টুক করে দেখে নিল কাঙ্খিত নামটি। হিমেলের দিকে তাকিয়ে বললো-“অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। আমার জন্য অনেক কষ্টে করলেন।”
“ধন্যবাদ একদম নেব না। তুমি সফল হলে আমি আমার কাজের পারিশ্রমিক পেয়ে যাব। কাজেই ধন্যবাদ দেওয়ার দরকার নেই।”
“ইনশাআল্লাহ সফল হব। যাই ভাইয়া।”
হিমেল মাথা দুলায়। কাজটা সেও করতে পারতো কিন্তু এই মেয়েটাকে সুযোগ দিলো। আদৃতার কারনে মেয়েটা অনেকদিন ধরে কষ্ট পাচ্ছে। আদৃতাকে শাস্তি দিয়ে যদি ওর মনে কিছুটা শান্তি মেলে মিলুক। হিমেল এই পূন্য কর্মে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না।
শোভা পথে যেতে যেতে হিমেলের দেখানো আইডিতে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে আদৃতার দ্বিতীয় আইডিতে ম্যাসেজ করলো-“আপনার প্রেমিকটি একদম আপনারই মতন। আজ তাকে দেখলাম বসুন্ধরায়। কিন্তু সাথে আপনি নেই, আপনার জায়গায় অন্য কেউ।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই উত্তর এলো-“হু আর ইউ?”
শোভা লিখলো-“আপনার ফেসবুক ফ্রেন্ড।”
“ইশরাক কে কিভাবে চিনলেন? কে আপনি?”
“আরে ওনাকে চিনব না কেন? আপনার সাথেই দেখেছি কয়েকবার। হদয়ের বন্ধু উনি।”
সমানে বানোয়াট কথা লিখছে আর হাসছে শোভা।
“হৃদয় আবার কে?”
“ওনার বন্ধুকে চেনেন না? কেমন প্রেমিকা আপনি?”
ওপাশ চুপ। কিছুক্ষণ পর লিখতে দেখা গেল। শোভা অপেক্ষা করছে। টেক্সট আসলো-“ওর সাথে কাকে দেখেছেন? কে মেয়েটা?”
“চিনি না। বেশ সুন্দরী, দেখে মনে হলো প্রচুর টাকার মালকিন। আপনাকে ওই ভাইয়ার সাথে অনেকদিন দেখেছি বলে অন্য কারো সাথে দেখে খারাপ লাগলো। এর আগেও একদিন দেখেছিলাম। সেদিনই ভাবলাম আপনাকে জানাই। এইজন্যই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি তো রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করলেন আজ। ভাবলাম তাজা খবরটাই দেই। বাসীটা পরে দেওয়া যাবে।”
শোভা দেখলো ম্যাসেজ সিন হয়েছে সাথে সাথে। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও উত্তর এলো না। শোভার মুখে শয়তানি হাসি। তীর আসল জায়গায় লেগে গেছে তাহলে? একপাশে আগুন লেগে গেছে এবার আরেক পাশে লাগানোর পালা। একপক্ষের কাজ হয়ে গেছে এবার অপর পাশের কাজ শুরু করতে হবে। অপেক্ষা কেবল মানুষটার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করার।
চলবে—
© Farhana_য়েস্মিন
#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-২১
কয়েকদিন আদৃতার পেছনে লেগে থেকে ওর রুটিন মোটামুটি মুখস্থ হয়ে গেছে শোভার। এজন্য অবশ্য নিজের পড়ালেখাকে শিকেয় তুলতে হয়েছে দু’তিনদিনের জন্য। তাতে কোন আপত্তি নেই শোভার। যে নরক যন্ত্রণা সে ভোগ করেছে সেই একই সাজা আদৃতাকে দিতে পড়ালেখার একটু ক্ষতি করতে রাজি শোভা। ওর ডেডিকেশন দেখেই হয়তো খোদা মনিরা মেয়েটাকে জুটিয়ে দিয়েছে।
মনিরা আদৃতার ক্লাসেই পড়ে। লুকিয়ে চুরিয়ে আদৃতাকে দেখতে যেয়ে ওকে নজরে আসে। একটু চুপচাপ ধরনের মেয়ে। একা একা ক্লাসের পিছনের দিকে বসে থাকে। লুকিয়ে চুরিয়ে আদৃতা আর কায়সারকে দেখো। দু’দিন দেখে ওকে ধরলো শোভা।
“হাই মনিরা, আমি শোভা ফাস্ট ইয়ার আইবিএ ডিপ। একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
মনিরা তার লম্বা বেনী পেছনে ঠেলে দিয়ে বাচ্চাদের মতো নাকি গলায় বলে-
“তুমি জুনিয়র হয়ে আমায় নাম ধরে বললে কেন?”
শোভা হেসে দিলো-“ইউনিতে জুনিয়র হলেও আমরা ব্যাচমেট। এক বছর লস আছে আমার।”
“ওহহহ। তাহলে ঠিক আছে। বলো কি বলবে।”
“তুমি কি কাওসারকে লাইক করো?”
মনিরার গালে লালিমা, খানিকটা তুতলে জানতে চাইলো-“তোতোতোমাকে কে বললো?”
“দেখেছি আমি।”
মনিরা মন খারাপ করে শোভার পাশে বসলো-“আমি পছন্দ করলে কি হবে ও তো ফিরেও তাকায় না আমার দিকে।”
“একটা কাজ করবে আমার? আশাকরি কয়েকদিনের মধ্যে কায়সার তোমার সাথে কথা বলবে।”
মনিরার চোখ চকচক করে-“সত্যি! কি কাজ বলতো?”
“বেশি কিছু না আদৃতার দিকে নজর রাখবে। ও কখন কোথায় যায়, কার সাথে কথা বলে এসব আমাকে জানাবে। পারবেনা?”
“ব্যাস এইটুকু?”
শোভা মাথা নাড়তেই মনিরা খুশি হয়ে হাসলো-“খুব পারবো।”
“গুড গার্ল। আমি তাহলে আর আসবো না। তুমি কিন্তু আমাকে জানাতে ভুল না। ওর সব একটিভিটির খবর দেবে আমাকে। ওকে?”
মনিরা মাথা দুলায়-“দেব। ভেব না একদম। কিন্তু আমার কথা হলো আদৃতাকে নজর রাখলে কায়সার কেন কথা বলবে আমার সাথে?”
“বলবে। তুমি শুধু আমার কাজটা করো। ক’দিন পরই রেজাল্ট পাবে।”
“ওকে।”
এরপর থেকে ফোনে নিয়মিত আদৃতার আপডেট পাচ্ছে শোভা। ভার্সিটিতে সারাক্ষণ সহপাঠি কাম প্রেমিক কায়সারের সাথে থাকে আদৃতা। ইদানীং রেগুলার হলে থাকছে। তিনদিন ক্লাস শেষে ঢাকায় যায়। কোন রাতে হলে ফেরে কোনরাতে ফেরে না। সেদিন মনিরা জানালো, কায়সারের সাথে নাকি তুমুল ঝগড়া হয়েছে আদৃতার। দু’জন একে অপরের সাথে কথা বলছে না। শুনে মুঁচকি হেসেছে শোভা। আসল মুভিটা কখন মুক্তি পাবে সেই অপেক্ষায় তর সইছে না ওর। দিনক্ষণ জানে না বলে মনের মধ্যে সর্বদাই আকুলিবিকুলি হয়। উফফ, অপেক্ষা কবে ফুরাবে?
★★★
রবিবার সকালের ক্লাসটা ক্যানসেল হয়েছিল বলে ঘুমিয়ে ছিল শোভা। তার সেই ঘুম ভাংলো হিমেলের ফোন পেয়ে।
“এই শোভা, তোমার ফিল্মের শুটিং হচ্ছে আর তুমিই নেই। এটা কোন কথা হলো? চিত্রগ্রহন না করলে সবাইকে ফিল্ম দেখাবে কি করে?”
ঘুমন্ত শোভার ব্রেনও বুঝি ঘুমিয়ে ছিল। তাই সে না বুঝে বোকার মতো জানতে চাইলো-“কোন ফিল্ম ভাইয়া? বুঝিনি কি বলছেন?”
“এতো বুঝতে হবে না। শিগগিরই ফুচকা চত্বরে চলে এসো। যে অবস্থায় আছো চলে এসো। দেরি করলেই মিস করবে। কুইক।”
শোভা লাভ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো। নিজের কাপড়ের দিকে তাকালো। গেঞ্জি আর ঢোলা পাজামা পরে আছে। দ্রুত গতিতে একটা জামা গায়ে চাপিয়ে মোবাইল আর পার্স নিয়ে ছুটলো। মাথায় তখন হাজার রকম চিন্তা। হিমেল ফোন করেছিল মানে আদৃতা কেস। কি হতে পারে ঘটনা? কই মনিরা কিছু জানাল নাতো? ও হাটতে হাটতে সাথে সাথে মনিরাকে ফোন লাগায়-“কোথায় তুমি? আদৃতার খবর জানো কিছু?”
“ক্লাসে ছিলাম। সকালে আদৃতাকে দেখলাম ক্লাস না করে তাড়াহুড়ো করে কোথায় যেন গেল। কায়সারকে কানে কানে কি যেন বলে গেল।”
“শোন, তাড়াতাড়ি কায়সারকে নিয়ে ফুচকা চত্বরে চলে এসো। আদৃতা আছে এখানে।”
“হয়েছে কি? কায়সারকে কেন বলবো? ও আসবে কেন আমার সাথে?”
“আদৃতার কথা বললেই আসবে। তাড়াতাড়ি এসো।”
আদৃতা তাড়াহুড়ো করে এসেছে তার মানে কোন ঝামেলা হয়েছে। উত্তেজনায় গা কাঁপে শোভার। ভাবনাগুলো ওকে যেন কারেন্ট শক দিচ্ছে। উত্তেজিত হয়ে এবার ছুটতে শুরু করলো। ফুচকা চত্বরের কাছাকাছি আসতেই দেখলো কিছু মানুষের জটলা। কি হচ্ছে এখানে?
শোভাকে দেখে হাত নাড়ে হিমেল। হিমেলের পাশে দাঁড়াতেই দৃশ্যটা নজরে এলো। আরেহ, এতো আদৃতা! কথা কাটাকাটি হচ্ছে একটা ছেলের সাথে। ছেলেটাকে দেখেই চিনলো শোভা। এই ছেলেটাকেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল, ম্যাসেজ করেছিল। তবে ছেলেটা ম্যাসেজ সিন করলেও কোন আন্সার দেয়নি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ও একসেপ্ট করেনি। আজ হঠাৎ চোখের সামনে ছেলেটাকে দেখে অবাক না হয়ে পারে না। কি যেন নাম ছেলেটার? ইশরাক, হ্যা ইশরাক। শোভা দ্রুত হাতে মোবাইলের ভিডিও অন করলো।
“ওই যে আরেক হিরো চলে এসেছে। এখন আসল এ্যাকশন শুরু হবে।”
হিমেল ওর কানে ফিসফিস করলো। শোভা হেঁসে দিলো। কায়সারকে এসে দাঁড়াতে দেখলো, ওর পেছনে মনিরা আছে। কায়সার প্রশ্ন করে-“আদৃতা, কি হয়েছে? উনি কে? একজন আমাকে খবর দিলো তোমার সাথে নাকি উনি অশোভন আচরণ করছে?”
আদৃতা কিছু বলার আগেই ইশরাক ওর সামনে এলো-“আগে বলো তুমি কে? আমাদের মধ্যে নাক ঢুকাচ্ছ কেন?”
“আপনি কে? এভাবে ক্যাম্পাসে এসে গুন্ডামী করছেন, ক্যাম্পাসের ছাত্রীর সাথে অশোভন আচরণ করছেন আবার আমাকেই প্রশ্ন করছেন?”
কায়সারের কথা শুনে ইশরাক হোহো করে অট্টহাসিতে দিলো-“আমি কে সেটা ওর কাছ থেকেই শোন। আদৃতা বলো তো আমি কে?”
আদৃতা দৌড়ে এলো কায়সারের সামনে-“কায়সার তুমি চলে যাও। আমি ওর সাথে কথা বলে আসছি।”
“তুমি ওকে চেন?” কায়সার অবাক হয়ে জানতে চায়।
“আচ্ছা, তাহলে এটাই তোমার ইউনিভার্সিটির না*র। কি যেন নাম তোমার বাছা? কায়সার তাই না?” ইশরাক প্রশ্ন করে।
কায়সার মাথা দুলায়। ওকে দ্বিধান্বিত দেখায়।
“ইশরাক খুব বেশি হচ্ছে কিন্তু।” আদৃতা হুমকি দিলো। আদৃতাকে সম্পূর্নরুপে ইগনোর করে ইশরাক কায়সারের দিকে তাকিয়ে হাসলো-“তোমার সাথে ওর সম্পর্কটা কি?”
“সহপাঠী আমরা। তাছাড়া আমরা দু’জন একে অপরকে ভালোবাসি।”
“ভালোবাসো!”
কায়সার মাথা দুলায়। ইশরাক একবার আদৃতাকে দেখলো একবার কায়সারকে। তারপর আদৃতার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো-“একসাথে ক’জনকে ভালোবাসা যায় দিতি?”
আদৃতা উত্তর দিলো না। কায়সার বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করে-“আপনি কে বলুন তো? উল্টো পাল্টা কথা বলছেন কেন ওর নামে?”
“তার আগে বলো তোমার সাথে ওর কতদিন ধরে সম্পর্ক?”
“তা জেনে আপনার কি? আদৃতা কে উনি? কি সম্পর্ক ওনার সাথে?”
কায়সার আদৃতার দিকে তাকালে আদৃতা মুখ লুকিয়ে অন্য দিকে তাকায়। ইশরাক হাসলো-“ও বলবে না কিছু। আচ্ছা আমি বলছি। আমার সাথে ওর অনেকদিনের সম্পর্ক কিনা। ইউনিতে চান্স পাওয়ারও আগে। আদৃতা ভালোবাসে আমাকে, তাই না আদৃতা?”
“কি যা তা বলছেন? এমন হতেই পারে না। আপনি আমাদের ক্যাম্পাসে এসে আমাদের মেয়ে নিয়ে বাজে কথা বলছেন আর সেটা মেনে নেব আমি? এতো সাহস?”
“খুব হতে পারে। না হলে বলছি কেন?”
ইশরাক হাসলো। ওর হাসিটা কায়সারের সহ্য হলো না। যেমন আদৃতার নিরবতা সহ্য হচ্ছে না।
“প্রমান দেখান।”
কায়সার শক্ত কন্ঠে বললো। ইশরাক আদৃতার দিকে তাকিয়ে বললো-“প্রমান তো সামনে। পারলে ওর কাছেই জানতে চাও। আমি যদি ওর পরিচিত না হতাম তবে কি এতো সময় এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম?”
সেকেন্ডের মধ্যেই পরিস্থিতি পাল্টে গেল।কিছু বুঝে ওঠার আগেই কায়সার ঝাপিয়ে পড়লো ইশরাকের উপর। ইশরাক বুঝে উঠতেই একটা যুদ্ধ শুরু হলো। ক্যাম্পাসের কয়েকটা ছেলেও কায়সারের সাথে যোগ দিয়ে ইশরাককে মারতে লাগলো। হিমেল ফিসফিস করলো-“দেখেছ কিভাবে আদৃতা ইশারা দিলো কায়সারকে?”
ইশরাককে ওভাবে মার খেতে দেখে শোভা আঁতকে উঠলো-“হিমেল ভাই, ছেলেটাকে মেরে ফেলবে ভাই। যান কিছু করেন। আদৃতা তো আবার বেঁচে যাবে। স্পটলাইট ওর দিক থেকে সরে যাচ্ছে। ও পালানোর আগেই ওকে ধরতে হবে। ভাই যান প্লিজ।”
“সত্যি যাবো?”
“না গেলে আদৃতা পালিয়ে যাবে দেখবেন। আজই সবার সামনে সব ক্লিয়ার হতে হবে। ওর মুখোশ খোলার জন্য এরচেয়ে ভালো সুযোগ পাবেন না।”
“তুমি বলছো যখন যাচ্ছি।”
হিমেল এগিয়ে গেল-“এই কি হচ্ছে? কি করছিস তোরা? থাম বলছি।”
সিনিয়র বলে হিমেলের হুকুমে কাজ হলো। ছেলেগুলো থামলো। ইশরাকের অবস্থা খারাপ, মুখ চোখ ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। হিমেল ইশরাককে ছাড়িয়ে নিল-“সমস্যা কি? ওকে মারছিস কেন?”
“ভাই, এই ছেলেটা বাইরে থেকে এসে আমাদের ক্যাম্পাসের মেয়ের সাথে ঝামেলা করছিল।”
একজন উত্তর দিলে হিমেল চেচিয়ে উঠলো-“তাই বলে মারতে হবে? কি বলছে ও সেটা শুনবি না? বাইরে থেকে আসলেই সে দোষী এটা কে বললো তোদের?”
ইশরাক নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একদলা থুথু ফেললো রক্ত সমেত। মুখ চোখ বাঁকিয়ে বললো-“আদৃতা আমার প্রেমিকা প্রায় তিন বছর ধরে। খবর পেয়েছি ও নাকি ক্যাম্পাসে এক ছেলের সাথে প্রেম করছে। ও আমাকে ক্যাম্পাসে আসতে দেয় না। সেই ছেলেসহ হাতে নাতে ধরতেই আমি আজ ওকে না জানিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছি।”
হিমেল সত্যি সত্যি অবাক হলো। গোল চোখে তাকিয়ে বললো-“ভাই, আমি তাহলে দুই নাম্বার।”
“মানে?”
ইশরাক বিরক্ত সূচক আওয়াজ দিলো।
হিমেল হাসলো-“গত বছর আদৃতার প্রেমিকের লিষ্টে আমিও ছিলাম। তারপর আমি বাদ পড়লাম। ভেবেছিলাম আমি মনেহয় ওর প্রথম প্রেম। এখন আপনার কথা ভেবে নিজের জন্য অতোটা খারাপ লাগছে না।”
“তাহলে ও?”
কায়সারের দিকে ইশারা করলো ইশরাক। হিমেল হাসলো-“ও তিন নাম্বার। আমাকে ছেড়ে দিয়ে কায়সারকে ধরেছে। কায়সারের ও নিশ্চয়ই প্রথমবার তাই অতি আবেগি হয়ে আপনাকে মেরেছে। কিছু মনে করবেন না আদৃতার সাথে সম্পর্কের প্রমান দেখিয়ে দিন ওদের। আদৃতাকে বিশ্বাস নেই। পরে দেখা যাবে হাবিজাবি কথা বলে ঠিকই আপনাকে মিথ্যুক বানিয়ে দেবে দেখবেন।”
ইশরাক হতবাক হয়ে আদৃতাকে দেখলো। আদৃতা মুখ লুকিয়ে পালাচ্ছিলো তখন হিমেল ডাকলো-“এই আদৃতা, কোথায় যাচ্ছ? এদিকে এসো।”
বাধ্য হয়ে আদৃতাকে আসতে হয়। ইশরাক মোবাইল বের করে কিছু ছবি দেখালো হিমেলকে। হিমেল সেটা কায়সারের দিকে এগিয়ে দিলো-“আমার আর দেখার দরকার নেই। ওকে আমার চেনা হয়ে গেছে। তুই দেখ।”
পরের কয়েক মুহূর্ত সুনসান নীরবতা। এরপর ঠাস করে চড়ের আওয়াজ-“তুমি এতটা খারাপ সেটা জানা ছিলো না আদৃতা। আমার অনুভূতি নিয়ে এভাবে না খেললেও পারতে। আজ থেকে তোমার সাথে সব সম্পর্ক শেষ। কোন কথা বলার চেষ্টা করবে না আমার সাথে।”
কায়সার চলে গেলো ওর পিছু পিছু মনিরা। আদৃতা তখন গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইশরাক ওর সামনে এলো-“তোকে চড় দিয়ে হাত নোংরা করব না আমি। এখন থেকে যত খুশি ততগুলো প্রেম করতে পারবি দিতি। কোন বাঁধা নেই। তবে আমার কাছে আর আসিস না। চেষ্টাও করিস না তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। বুঝলি?”
ইশরাক চলে গেলো। হিমেল ফুরফুরে মেজাজে আদৃতাকে দেখলো-“এতোদিন তোমার বিরহে কষ্টে ছিলাম আদৃতা। আজ মনেহচ্ছে যা হয়েছে ভালো হয়েছে। আল্লাহ বাঁচিয়েছে আমাকে। আর হ্যা, নতুন কাউকে বাকরা বানাতে যেয় না আবার। অবশ্য আজকের পর পারবে কিনা সেটাও কথা।”
হিমেল ইশারা করতেই শোভা হাসি হাসি মুখ করে হাত উচিয়ে ফোনটা নাড়লো। আদৃতার মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে গেছে। সে ভাবতেও পারেনি এমন কিছু হতে পারে। সে দাঁত চেপে ধরে রাগ থামিয়ে রাখে। এই শোভাটা এদিকে এলো কি করে? কিভাবে খবর পেলো? এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিডিও করছিল। আদৃতার ইচ্ছে হলো শোভার চুলের মুঠি টেনে মোবাইল কেড়ে নিতে। কিন্তু ওটা করা এখন সম্ভব হবে না বলেই দাঁত কিড়মিড় করলো। হিমেল পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করলো-“আজ ফেসবুকে ধামাকা হবে ধামাকা। তুমি মোটামুটি বিখ্যাত হয়ে গেলে বলা যায়। কি দারুণ ব্যাপার তাই না আদৃতা?”
হিমেল মিটমিটিয়ে হাসছে। শোভা ফিক করে হেসে দেয়-“যেমন কর্ম তেমন ফল। কি বলিস আদৃতা?”
চলবে—
©Farhana_Yesmin