#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-২৭
শোভার ভীষণ লজ্জা লাগছে। শরমে আধমরা হয়ে সে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে কোন কিছু দৃষ্টিগোচর না হলেও সে যেন খুব দারুণ কিছু দেখছে এমনই তার মুখের ভাব। ভুলে থাকার আপ্রাম চেষ্টা করলেও
বারবার কিছুক্ষণ আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। কিসের থেকে কি হয়ে গেলো এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। হজম হওয়া অনেক দূরের কথা। হয়তো কোন স্বপ্ন দৃশ্য ছিলো এমনটা ভেবে হাতে চিমটি কাটলো। ব্যাথায় ককিয়ে উঠে বুঝলো সমস্ত ঘটনাই বাস্তবেই ঘটেছে। মনটা চড়ুই এর মতন ছটফট করে উঠলো।
অপরদিকে রিফাতের অবস্থাও একই। শোভার মতোই ভাবছে কি করে ফেললো এটা। তার মতো ছেলে এমন কিছু করেছে এটা ভেবেই মাথা ঘুরে উঠছে। সত্যিই কি সে এমন কিছু করেছে? অজান্তেই হাতটা চলে গেলো অধরে। দৃশ্যটা আবারও চোখের সামনে ভেসে উঠতেই রিফাতের কান দু’টো উষ্ণ হয়ে গেলো। লজ্জাও কম পাচ্ছে না। তাইতো লজ্জা লুকাতে মন দিয়ে গাড়ি চালাতে লেগেছে। আর মাঝে মাঝে আড়চোখে কিংবা গাড়ির রিয়ারভিউ মিররে শোভাকে দেখে নিচ্ছে। লজ্জাবনত শোভাকে দেখতে কিযে মিষ্টি লাগছে সেটা বলে বোঝানো যাবে না। মেয়েটা যে ইচ্ছে করেই অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে সে। অথচ রিফাতের ইচ্ছে করছে গাড়ি থামিয়ে একনজরে শোভাকে দেখতে। কিন্তু জানে সেটা সম্ভব না। শোভা তাহলে সত্যি সত্যি গাড়ি থেকে নেমে যাবে। ভেবেই মিটিমিটিয়ে হাসলো রিফাত।
“আপনি হাসছেন কেন?”
আচমকা শোভার আক্রমনে দিশেহারা বোধ করে রিফাত। মুখের হাসি মিলিয়ে নিলো দ্রুত-“কেন বলোতো? হাসা কি অপরাধ?”
সাথে সাথে শোভার মুখ গম্ভীর হলো-“সেটা বলিনি। এই মুহূর্তে এভাবে হাসার মানে কি সেটা বোঝার চেষ্টা করছি।”
“সব হাসির মানে খুঁজতে হবে কেন?”
“হুমমম ঠিকই বলেছেন। একটা কথা বলি, আজ যা হলো মোটেও ঠিক হয়নি। এসবের জন্য আমি একদম প্রস্তুত ছিলাম না। আর চুপ ছিলাম বলে আবার অন্য কিছু ভেবে বসবেন না।”
রিফাত ফিক করে হেসে দিলো। শোভার দিকে তাকিয়ে বললো-“আমি বুঝি প্রস্তুত ছিলাম? কি যে আজব কথা বলো না? এসব অনুভূতি কি বলেকয়ে আসে? আমিও কি জানতাম এমন কিছু করবো? তাছাড়া আমি অন্য কিছু ভাবিনি। আসলে ভাবার মতো সুযোগই পাইনি। একা থাকলে হয়তো ভাবতাম এখন তো তুমি আছো ভাববার দরকার কি?”
শোভার গালে লালিমার আভাস-“অসভ্য।”
রিফাত আঁতকে উঠলো-“কাকে বললে? আমাকে? এখনো তো কোন অসভ্যতা দেখাইনি। বিয়ে হলে টের পেতে।”
শেষের কথাটা খুব মিহি স্বরে উচ্চারণ করলো রিফাত। শোভা খানিকটা কেঁপে উঠলো। আর কিছু বলার সাহস হলো না তার। রিফাত বড্ড সাহসী হয়ে উঠছে আজকাল। কথার লাগাম নেই। কি বলতে কি বলবে সেই ভয়ে চুপ করে রইলো। বাকী পথটা দু’জনই চুপচাপ। বাসা থেকে কিছু দূরে রিফাত গাড়ি থামায়-“নামো। এসে গেছি। এর পরে আর যাওয়া উচিত হবে না আমার।”
শোভা চুপচাপ নেমে গেলো। রিফাত পিছু ডাকে-“শোন, জীবনে যা ঘটে তা নিয়ে কখনো আফসোস করতে নেই। স্মৃতি হিসেবে জমা হচ্ছে সবই। কোন একদিন হয়তো এই স্মৃতি মনে করে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটবে।”
কথাটা শেষ করে রিফাত দাঁড়ায় না। গাড়ি নিয়ে চলে গেলো। শোভা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো।
★★★
দরজা খুলে দিলো বিভা। বোনকে আপাদমস্তক দেখে তার ঠোঁটের কোনে চোরা হাসি। চোখ নাচিয়ে জানতে চাইলো- “বৃষ্টিতে ভিজে এতো রাতে কোত্থেকে এলি আপা?”
শোভা কিছু না বলে চুপচাপ নিজের কামড়ায় ঢুকে গেলো। শুকনো কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকবে সেই সময় বিভা বললো-“অবস্থা তো সুবিধার লাগছে না আপা। তুই দেখি প্রকৃতির বৃষ্টির সাথে সাথে প্রেমের বৃষ্টিতে ভিজে একাকার।”
শোভা অগ্নিঝরা বৃষ্টিতে বিভাকে দেখলো-“এতো পাকা কথা বাদ দিয়ে আমার জন্য এককাপ চা বানা। ভীষণ ঠান্ডা লাগছে আমার।”
বিভা মুখ বাঁকায়-“হুহ, আমার ঠেকা পড়সে। বাবা মা আমাদের দেখেশুনে রাখতে তোমাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছে তোমাকে দেখতে আমাদের না। বুঝলে? বাবা আগে বাড়ি থেকে আসুক তারপর তাকে বলছি সব। তার মেয়ে কি কান্ড করছে।”
শোভা কথা না শোনার ভাণ করে গোসলে ঢুকে গেলো। গোসল করে বেরুতেই দেখলো বিভা দাঁড়িয়ে আছে টেবিলের সামনে। শোভা ভ্রু কুঁচকে তাকালো-“কি চাই? এরকম সং সেজে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
“কি চাইবো? তোমার জন্য চা বানিয়েছি সেটা দিতে এলাম।”
বিভা টেবিলে রাখা চায়ের কাপ দেখালো।
“ওহহহ, থ্যাংকস রে। চা টা সত্যিই দরকার ছিলো।”
“মা ফোন করেছিলো। তোমাকে চাইলো আমি বললাম…”
“কি বললি? আমি কেবল ঘরে ফিরলাম এটা বলে দিয়েছিস?”
শোভা উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো। বিভা মুচকি হাসলো-“না বলিনি। তুমি বাথরুমে গেছ এইটুকু বলেছি।”
শোভার বুক থেকে যেন ভারী পাথর সরে গেলো এমনভাবে শ্বাস ফেললো।
“এতো ভয় পাচ্ছ কেন আপু? তুমি কার সাথে ছিলে আর ছিলে কোথায়?”
“কককোথায় আবার থাকবো? বন্ধুদের সাথে ছিলাম। আসার সময় বৃষ্টি শুরু হলো আর আঁটকে গেলাম।”
শোভা তোতলায়। ছোট বোনের চোখে চোখ রাখতে পারে না। মনেহয় চোখ তুলে তাকালেই ও সব বুঝে ফেলবে। নিজেকে বাঁচাতে শোভা রেগে যায়-“মায়ের মতন এতো জেরা করছিস কেন বলতো? যা পড়তে বয়। পরীক্ষা চলছে না তোর?”
বিভা জিভ বের করে ভেংচি কাটে-“সে কথা চা বানাতে বলার সময় মনে ছিল না?”
“না ছিলো না। এখন মনে পড়লো। যা পড়তে বয়।”
“যাচ্ছি যাচ্ছি।”
চলে যেতে যেতে আবার ফিরে এলো বিভা-“ভাইয়া কেমন আছে? আগে তো তোমার খবর নিতে আমাকে ফোন দিত মাঝে মাঝে। এখন তোমাকে পেয়ে আমাকে একদমই ভুলে গেছে। ভাইয়াকে বলে দিয়, দিস ইস নট ফেয়ার।”
শোভা চমকে উঠে জানতে চাইলো-“কোন ভাইয়া? কার কথা বলছিস?”
“যার সাথে তুমি বৃষ্টিতে ভিজে এলে।”
শোভা বিভার দিকে বোকার মতো হা করে তাকিয়ে থেকে বললো-“কার সাথে ভিজে এলাম? এসব কি কথা বিভা?”
“ইসসস, ন্যাকা। কিচ্ছু জানে না বোঝে না।”
“বিভা!”
শোভা চেচিয়ে উঠতেই বিভা পালিয়ে দরজার কাছে দাঁড়ায়-“ভয় দেখিয়ে সত্য গোপন করা যায় না বুঝলে? তাছাড়া আমাকে ভয় দেখিয়ে চুপ করাতে পারলেও বাকীদের চুপ করাবে কি করে? তোমার ঠোঁটের অবস্থা দেখেছ? না দেখলে দেখো। কি অবস্থা করেছ ঠোঁটের।”
বলেই ছুটে চোখের আড়াল হলো বিভা। শোভা হতবিহ্বল হয়ে গেলো। ভীত হয়ে ঠোঁটে হাত দিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করলো। না বুঝতে পেরে দ্রুত দৌড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে। শরীরের সমস্ত রক্ত যেন ওর মুখে জমা হয়েছে। ছোট বোনের সামনে এমন লজ্জা পেতে হবে জীবনেও ধারণা ছিলো না। কি করে বুঝলো বিভা? আয়নায় তাকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজের অধর পরীক্ষা করছে। সত্যি কি কিছু হয়েছে তার ওষ্ঠে? ছোট একটা কালচে দাগ আর খানিকটা ফুলে থাকা ঠোঁট আবিস্কার করে তার লাজুক ভাব আরও বেড়ে গেলো। আয়নার দিকে বহুক্ষণ তাকিয়ে রইলো শোভা। তাকে দেখে কি সত্যি কিছু বোঝা যাচ্ছে? ছিহ! কি লজ্জার ব্যাপার। রিফাতের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। রাগে দাঁতে ঠোঁট চাপতেই ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো শোভা। মনে মনে বিরবির করে, এমন অসভ্যের মতন কাজ কেউ করে? লোকে দেখলে কি বলবে? রিফাত যতই রাগ করুক একদম ঠিক উপমাটা দিয়েছে তখন। শোভা মনে মনে বারবার উচ্চারণ করলো-“অসভ্য! অসভ্য!” মজার ব্যাপার হলো অসভ্য শব্দটা উচ্চারণ করতে ভীষন ভালো লাগছে তার।
চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন
#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-২৮
মোবাইল হাতে নিয়ে বসতেই ম্যাসেজ এলো-“আজকের সন্ধ্যাটা কি আমাকে দেবে?”
রিফাতের ম্যাসেজ টের পেয়েই শোভা ঠোঁট ফুলালো। তিনদিন বাদে জনাবের হুঁশ এসেছে। এখন আবার কাব্য করে বাইরে নেওয়ার অনুমতি চাওয়া হচ্ছে। যত্তসব ঢং। এই ক’দিন কোথায় ছিলো? এই যে শোভার জ্বর হলো কোথায় একবারও তো খবর নিলো না। আজ এসেছে ঢং দেখাতে। শোভা আর কোথাও যাবে না এই বদ ছেলেটার সাথে।
“রাগ করলে মিস করবে। তোমাকে নিয়ে খুব সুন্দর একটা জায়গায় যেতে চাইছিলাম। অবশ্য যেতে না চাইলে তো আর জোর করতে পারি না।”
ম্যাসেজ দেখে মেজাজ আরও খারাপ হলো। কোথায় দোষ করেছে তাকে তেলাবে উল্টো ভাব দেখাচ্ছে এমন যে শোভাকে অপরাধী ঠাওরাচ্ছে।
“আপনি একাই যান। আপনার সাথে কোথাও যাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করছে না কেউ।”
“হুমমম। ঠিক আছে একাই যাবো। আমি কারো কেউ হই নাকি যে কেউ আমার কেয়ার করবে। তাইতো জ্বরে পড়লে কেউ একবারের জন্যও খবর নেয় না। উল্টো রাগ করে থাকে আর আমি অসুস্থ রুগী তার রাগ ভাঙাই। আচ্ছা ভালো থেক।”
শোভা পুরোপুরি ক্লিন বোল্ড হয়ে গেলো। রিফাতের ও জ্বর হয়েছিলো? আশ্চর্য মানুষ তো? জ্বর হয়েছে তাকে বলবে না? শোভা কি অন্তর্যামী নাকি যে সব বুঝে ফেলবে?
“আপনার জ্বর হয়েছিল আমাকে বলেন নিতো?”
“তুমিও তো বলনি তাই বলে কি আমি জানিনি? সেধে সেধে সব বলা যায়? আমাকে আপন ভাবলে ঠিকই জেনে নিতে। যেমন তোমার জ্বরের খবর আমি জেনে গেছি। তোমার পছন্দের পাস্তা বাসায় পার্সেল পাঠিয়েছি।”
শোভার হাত থেমে গেলো। সেদিন তবে রিফাত খাবার পাঠিয়েছিলো? অথচ এই বিভাটা সব প্রশংসা নিজের ঝুলিতে পুরেছে।
“বেশ, মানছি আমার ভুল হয়েছে। এবার বলুন কি করতে হবে আমাকে।”
“যা বলবো তাই করবে?”
“অফেন্সিভ কিছু না হলে চেষ্টা করবো।”
“একটা পার্সেল পাঠিয়েছি তোমার নামে। ওতে যা পোশাক আছে সেই মতো তৈরি হয়ে চারটার মধ্যে চলে এসো। আমি গাড়ি নিয়ে রাস্তার মাথায় ওয়েট করবো তোমার জন্য।”
“ব্যাস এতটুকু?”
“আপাতত এটুকুই করো।”
রিফাত হাসির ইমোজি দিলো। ঠিক তখনই কলিংবেলের আওয়াজ এলো। শোভা ছুটে গিয়ে দরজা খুললো। কুরিয়ারের লোক দাঁড়িয়ে ছিল। শোভার নাম জিজ্ঞেস করে পার্সেল দিয়ে চলে গেলো। শোভা রুমে এসে পার্সেল খুলতেই চক্ষু কপালে উঠলো। খুব সুন্দর টকটকে লাল রঙের একটা সুতি শাড়ি সাথে ম্যাচিং জুয়েলারি। আছে একগাছি লাল রঙের কাঁচের চুড়ি। জীবনে দুইবারই শাড়ি পরেছিল সে। একবারও নিজে পরেনি। আজ কি করবে? বিভা বাড়ি নেই, ওর পরীক্ষা শেষে ফিরতে বেলা গড়াবে। এতো সুন্দর শাড়ী দেখে মানা করতে একদমই ইচ্ছে করছে না। অনেক ভেবে শোভা ইউটিউব ওপেন করলো। কয়েকবার করে ভিডিও দেখে মনেহলো খুব কঠিন কিছু না। ও একা একা পারবে শাড়ী পরতে।
দু’ঘন্টা চেষ্টা করে অবশেষে শাড়ী পরতে পেরেছে শোভা। পুরো সাজ কমপ্লিট করে আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হলো। ঠোঁটের গাঢ় লাল লিপস্টিক আর চোখের মোটা কাজলেই অনিন্দ্য সুন্দর লাগছে তাকে। হাতের কাঁচের চুড়ির রিনিঝিনি কানে মৃদু তরঙ্গের সৃষ্টি করছে। নিজেকে মুগ্ধতা নিয়ে দেখা শোভা নজর ফিরিয়ে নিলো। ঘড়ি দেখে চটপট ব্যাগ তুলে নিয়ে বাইরে এলো। রিফাত বলেছিল চারটার যেতে এখন অলরেডি চারটা বেজে গেছে। শোভা দ্রুত পা চালায়।
দূর থেকে এক লাল পরীকে হেঁটে আসতে দেখে রিফাতের হার্টবিট ড্রপ হলো। ও হা করে তাকিয়ে ছিলো শোভার দিকে। নেহাৎ শাড়ীটা নিজে পছন্দ করে কিনেছিল বলে শোভাকে চিনতে পারলো রিফাত। লাল শাড়ীতে কি সুন্দর লাগছে শ্যামা মেয়েটাকে। ঠিক একদম তার মনের মতন। ঘোরলাগা মানুষের মতো রিফাতের আশপাশের পৃথিবী খানিক সময়ের জন্য থমকে গেল যেন। শোভা কাছে এসে কয়েকবার করে ডাকার পরও রিফাতের ঘোর কাটে না। বাধ্য হয়ে শোভাকে চিমটি কাটতে হয়।
“আউউউ। কি হয়েছে? এতো জোরে কেউ চিমটি কাটে?”
“কতক্ষণ ধরে ডাকছি হিসেব আছে? কোন ধ্যানে ছিলেন শুনি? কাকে ভাবছিলেন?”
“এক লাল পরীকে দেখতে যেয়েই তো সর্বনাশটা হলো। তাহাতে নজর আঁটকে গেল।”
শোভা গালে লালিমার ছোঁয়া। তা না দেখার ভান করে রিফাত তাড়া দেয়-“ওঠ ওঠ, এখনই না রওনা দিলে দেরি হয়ে যাবে।”
শোভা গাড়িতে উঠে বসে জানতে চাইলো-“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“গেলেই দেখতে পাবে।”
ঘন্টা খানেক ড্রাইভের পর বেশ মনোরম পরিবেশে গাড়ি থামাল রিফাত। রেস্টুরেন্টের পেছনে নদী। সেখানে বসার সুব্যবস্থা। ফুল আর লাইটিং এর অপূর্ব কম্বিনেশনে সাজানো হয়েছে পুরো রেস্টুরেন্ট।
“এসো বসে সূর্যাস্তটা দেখি।”
“আপনি মনেহয় ঢাকার একটা প্লেসও ঘোরা বাদ দেননি তাই না?”
শোভার প্রশ্ন শুনে রিফাত হাসলো-“আমার পানির কাছাকাছি থাকতে ভালো লাগে। ফ্রেশ বাতাস ফুসফুসকে পরিস্কার করে। তাছাড়া এরকম পরিবেশে কিছুক্ষণ থাকলে ব্রেন স্ট্রমিং ভালো হয়। নতুন নতুন আইডিয়া জেনারেট হয়।”
“এতোক্ষণে বুঝলাম আপনার দারুণ দারুণ ভিডিওর রহস্য।”
রিফাত জবাব দিলো না। তার নজর নদীতে চলা নৌকার দিকে। শোভা তাকিয়ে দেখলো আকাশ লাল হয়ে গেছে। টুপ করেই যেন সন্ধ্যা নেমে এলো। দু’জনই চুপচাপ বসে রইলো মৌনতায় ঘিরে থাকা পরিবেশে। দু’জনই নিশ্চুপ হয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে পরিবেশ উপভোগ করছে।
হঠাৎ একসাথে রেস্টুরেন্টের সবগুলো বাতি জ্বলে উঠতেই আলোর ঝলকানিতে চমকে উঠলো শোভা। পুরো রেস্টুরেন্টে সুসজ্জিত লাইটিং। ওর ঠিক পেছনেই লাইটিং এ লেখা আছে-‘শুভ জন্মদিন শোভা।’ হালকা মিউজিকে জন্মদিনের গান বাজছে। সারাদিন পরে শোভার মনে পড়লো, আজ তার জন্মদিন ছিল। প্রতিবার মা কিংবা বাবা মনে করে তাকে উইশ করে। এবার তারা কাছে নেই, হতে পারে তাদেরও মনে নেই। অবাক ব্যাপার হলো ভাই বোন দু’জনার কেউই তাকে উইশ করেনি। মজার ব্যাপার হলো শোভার নিজেরও তো মনে নেই। নিজের জন্মদিন কি করে ভুলে গেলো সে? সামনে তাকিয়ে দেখলো রিফাত দাঁত বের করে হাসছে-“শুভ জন্মদিন মেঘা। সারপ্রাইজ পছন্দ হয়েছে?”
এতোক্ষণে বিষয়টা পরিস্কার হলো। এখানে আসার পর থেকে ভাবছিল, রেস্টুরেন্টটা এমন জনমানবহীন কেন? ওরা দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই কেন? এতোক্ষণে বুঝলো রিফাত তারই জন্য হয়তো পুরো রেস্টুরেন্টটাই বুক করেছে। শোভার কেমন যেন হতবিহ্বল লাগছে। এসব তারই জন্য করেছে রিফাত? সেকি এতকিছু পাওয়ার যোগ্য? এতো সন্মান এতো আহলাদ!
“এসো কেক কাটি।”
রিফাত তাকে ডাকলো। শোভা তাকিয়ে দেখলো শুভ জন্মদিন লেখা দেয়ালের সামনে একটা টেবিলের উপর রেড ভেলভেট কেকের ওপর ‘শুভ জন্মদিন লাল পরী’ লেখা। শোভা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে সব। রেড ভেলভেট তার পছন্দের কেক। নিশ্চয়ই বিভা সব জানিয়েছে রিফাতকে। ওরা এগুতেই রিফাতের ইশারায় রেস্টুরেন্টের বাতিগুলো বন্ধ করে দিলে
মোমবাতির আলোতে মোহনীয় এক পরিবেশ সৃষ্টি হলো। শোভার কাছে পুরো ব্যাপারটা একটা স্বপ্ন দৃশ্য মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখবে সব ভ্রুম। শোভা ঘোর লাগা কন্ঠে জানতে চাইলো-“এতসব কি আপনি আমার জন্য করেছেন?”
রিফাত উচ্চকন্ঠে হাসলো-“আর কেউ আছে এখানে? অবশ্যই তোমার জন্যই সবকিছু করেছি। তুমি মনেহয় এখনো বোঝনি তুমি আমার জন্য কি। কারণ বুঝলে আমাকে এই প্রশ্নই করতে না।”
“কিন্তু আমি তো আপনাকে…”
“বিয়ে করতে চাও না তাই তো? না করতে চাইলে আমার তো কিছু করার নেই। আমার দিক থেকে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি এটাই স্বান্তনা থাকবে। ভবিষ্যতে যাতে কোন আফসোস না থাকে আর নিজের কাছে ক্লিয়ার থাকার জন্য আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাব।”
শোভা চুপ করে গেলে। এমন কথার পর আসলে কিছু বলার থাকে না। এই মানুষটা বারবার তাকে চুপ করিয়ে দেয়, বারবার হারিয়ে দেয়। তবুও কেন যেন মানুষটার কাছে হেরে যেতে ভালো লাগছে তার।
চলবে—
©Farhana_Yesmin