আবার এলো যে সন্ধ্যা পর্ব-৩১

0
236

#আবার এলো যে সন্ধ্যা
#পর্ব-৩১

অনুভূতিগুলো এমন হয় কেন? যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন সব বুঝেও জাগতে চায় না। আর যখন জেগে ওঠে তখন তাকে ঘুম পারিয়ে রাখতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। রিফাত যখন কাছে ছিলো তখন শোভার অনুভূতিগুলো ছিল ঘুমন্ত। অনেক চেষ্টার পরেও রিফাত তাকে বোঝাতে পারেনি। এখন যখন দূরে চলে গেছে তখন রিফাতের অনুপস্থিতিতে শোভার অনুভূতিতে আঘাত লেগে আপনাতেই জেগে উঠলো। যে জন্য রিফাতের এতোদিনের অপেক্ষা সেই আনন্দ সংবাদ সেলিব্রেট করার উপায় নেই। কাছে থাকলে কি পরিমান পাগলামো করতো সেসব ভেবে আফসোস হচ্ছে রিফাতের। ইচ্ছে ছিল বিশেষ মুহূর্তে শোভার মুখভঙ্গি দেখবে মন ভরে। কিন্তু তা আর হলো কোথায়? তবুও ভালো খবর এই যে অপেক্ষার প্রহর খানিকটা কমে এলো। আপাতত পড়ালেখার জন্য যে কয়েকদিন বাইরে থাকতে হবে সেই সময়ের দূরত্বটুকু কষ্টে সৃষ্টে মেনে নেবে সে। এই দূরত্বটুকু হয়তো প্রয়োজন ছিলো দু’জনার জন্যই। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া আর টান বোঝার জন্য দূরত্ব মাঝে মাঝে টনিকের কাজ করে। ওদের জন্য অন্তত তাই হয়েছে।

লজ্জায় দু’দিন কথা বলেনি শোভা। কেবল ম্যাসেজ আদান প্রদান চলেছে। পরে রিফাত আন্দোলন শুরু করলো। কথা না বললে আর নিজে থেকে নক দেবে না সে। বাধ্য হয়ে ফোন দিয়েছিলো শোভা। আড়ষ্টতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে রিফাতের সাথে কথা শুরু করে। কতো কথা সেদিন বলেছিল ওরা ভাবলে দু’জনই অবাক হয়।

লন্ডন স্কুল অফ বিজনেস থেকে এক বছরের মাস্টার্স প্রোগ্রাম করবে রিফাত। এক বছর পর দেশে ফিরে বাবার অফিসে বসবে। সেই সাথে শোভার সাথে শুভকর্মটা সেরে ফেলবে। এবার কোন ধরনের ছুতোবাজি শুনবে না বলেছে রিফাত। ওর একটাই কথা, একবছর যত খুশি ব্যাচেলর লাইফ কাটাও মন ভরে। কিন্তু আমি ফিরলে পড়ালেখার বাইরে বাকী সময় আমার। তখন কোন অজুহাত মেনে নেবো না। শোভা কিছু বলেনি, কেবল মুচকি হেসে সায় দিয়েছে।

আনুষ্ঠানিক ভাবে ওদের প্রেম পর্ব শুরু হলো যেন। কোন কোন সময় দূরত্ব সম্পর্ককে গভীর করে তোলে। ওদের ক্ষেত্রে কথাটা একশত ভাগ ফলে গেছে। প্রতিদিন রাত বারোটা,বা নাগাত শোভাকে ফোন দেয় রিফাত। তখন লন্ডনে সন্ধ্যা নেমেছে। ক্লাস শেষে ক্লান্ত শরীরে শোভার গলা শুনলেই রিফাতের ক্লান্তি কেটে যায়। ওদের গল্প ফুরাতে চায় না কিন্তু পড়ালেখার জন্য দায়বদ্ধতার কারণে ফোন রাখতে হয়। মাঝে মাঝে পড়ালেখার চাপ না থাকলে দু’জনই সারারাত গল্প করে পার করে দেয়। ছুটিছাটায় ঢাকায় গেলে ভীষণ সমস্যায় পড়তে হয় শোভার। একরুমে দুই বোন থাকে। বিভাটা রাতে পড়ে, দেরি করে ঘুমানোর অভ্যাস। কাজেই রাতে কথা বলার উপায় নেই। আর এতে রিফাত গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। কিছুতেই বোঝানো যায় না যে বিভার সামনে কথা বলা যায় না। এভাবেই ছোটখাটো মান অভিমানের মধ্যে দিয়ে ওদের দিনগুলো কেটে যাচ্ছে।

★★★

ক্লাস শেষ করে কেবলই বেরিয়েছে শোভা। আজ একটা প্রজেক্টের কাজ ছিলো। তার উপর ক্লাস হয়েছে পাঁচটা। ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে পড়ছে। হোস্টেলের উদ্দেশ্যে হাঁটছে। মনটা খানিকটা খারাপ হয়ে আছে। কয়েকদিন হলো কথা হয় না রিফাতের সাথে। সামান্য বিষয় নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়ে কথা বন্ধ। রিফাত তাও একদিন কল দিয়েছিল কিন্তু শোভা রিসিভ করেনি। তারপর থেকে জনাবের আর খবর নেই। নিজ থেকে ফোন দিতে লজ্জা লাগে শোভার। কারণ দোষটা তার বেশি ছিল। তবুও রাগ সে বেশি দেখিয়েছে। আজ মনেহচ্ছে ঝগড়া না করলেই হতো। কেন যে মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না? দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ঘড়ি দেখে দ্রুত পা চালায়। হোস্টেলে ফিরে গোসল করে খেয়ে টিউশনে ছুটবে। কিন্তু আজ একদম ইচ্ছে করছে না যেতে।

হোস্টেল পৌঁছে গেছে এমন সময় ফোনটা বাজলো। বিরক্ত শোভা ফোনটা বের করে কানে ধরে-“হ্যালো?”
“কোথায় তুমি?”
হার্টবিট মিস হলো শোভার। অবশেষে জনাবের মান ভাঙলো। ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে বললো-“হোস্টেলে ঢুকছি। ফ্রেশ হয়ে টিউশনে যাব। আপনি আজ এতো তাড়াতাড়ি ফোন দিলেন যে?”
“ফ্রেশ হয়ে গেটে এসো তাড়াতাড়ি।”
রিফাতের গম্ভীর কন্ঠ শুনে শোভার ভ্রু কুঁচকে গেল-“গেটে মানে? কোন গেটে? আপনি কোথায় আছেন?”
“বেশি প্রশ্ন করো না। তাড়াতাড়ি মেইন গেটে এসো। আম ওয়েটিং।”
শোভার বুকের ভেতর হার্টঅ্যাটাক হওয়ার জোগাড়। মানে কি? মানুষটা দেশে ফিরেছে? একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করলোনা? রাগ হচ্ছে কিন্তু সেই সময়ও নেই। অভিযোগ না হয় পরে জানানো যাবে আগে যাওয়া যাক। শোভা দ্রুত নিজের কামরায় ফিরে। ত্রস্ত হাতে সবচেয়ে সুন্দর জামাটা বের করলো। শাওয়ার নিয়ে ঝটপট চোখে কাজল টেনে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলো। গেট অবধি জেতে হার্ট অ্যাটাক হবে মনেহয় এমনই দ্রুত গতিতে হার্টবিট করছে। অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করছে। আরও কিছুদিন পরে আসার কথা ছিল রিফাতের। এভাবে চলে আসলো কেন? কিছু কি হয়েছে? এবার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। একদিকে মনের মানুষকে দীর্ঘদিন পরে দেখার আনন্দ অপরদিকে টেনশন। মনের মধ্যে চলা দ্বিপাক্ষিক ভাবনায় ঘেমে নেয়ে উঠলো শোভা।

গেট পেরুতেই চোখ দুটো অনবরত বনবন করে ঘুরছে চারপাশে। কাঙ্ক্ষিত জনকে খুঁজে পেয়ে চোখ দুটো স্থির হয়ে গেলো সেই সাথে পা দু’টো থেমে গেলো। গত এক বছরে মানুষটা একদম পাল্টে গেছে দেখি। গায়ের রং উজ্জ্বল হয়েছে, শরীর আরও সুগঠিত। শোভা চুম্বকের আর্কষনের মতো রিফাতের দিকে এগিয়ে গেলো। তার নয়ন জুড়ে মুগ্ধতা। রিফাত অস্থির পায়চারি করছিল। হঠাৎ শোভার উপস্থিতি টের পেয়ে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। পাঁচ মিনিট ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো দু’জন। কারো নজর ফিরছে না একে অপরের উপর থেকে। হঠাৎ গাড়ির হর্নের বিকট আওয়াজে ওদের সম্বিৎ ফিরে আসে।
“এসো, গাড়িতে ওঠো।”
রিফাত নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে আদেশ করলো। শোভা কিছু ভাববার সুযোগ পেলো না। রোবটের মতো রিফাতের আদেশ মান্য করলো। সেই পুরনো দিনের মতো রিফাত ড্রাইভিং সিটে পাশে শোভা। পুরো রাস্তা মন দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করলো রিফাত। একেবারের জন্যও তাকালো না শোভার পানে। অথচ শোভা বারবার আড়চোখে দেখে যাচ্ছে রিফাতকে। রিফাতের ওমন গাম্ভীর্য রুপ ওকে ভাবিয়ে তুলছে। কি এমন হলো যে না বলে চলে আসতে হলো রিফাতকে? জানার জন্য মনের ভেতর আকুপাকু করছে।

টানা একঘন্টা গাড়ি চালিয়ে রিফাত শোভাকে যেখানে নিয়ে এলো সেই জায়গা দেখে ভেতর ভেতর চমকে গেল শোভা। আরে! এতো সেই পুরনো জায়গা যেখানে রিফাত তাকে প্রথমদিন নিয়ে এসেছিল। চমকিত শোভাকে বসিয়ে রেখে রিফাত কোথাও গেলো। দশমিনিট পরেই ফেরত এলো হাতে দুইকাপ চা নিয়ে। ওর পাশে বসে এককাপ চা বাড়িয়ে দিলো। শান্ত হয়ে কয়েকবার চায়ের কাপে চুমুক দিলো। শোভা উসখুস করছে। মনটা উচাটন হয়ে আছে। কথা বলার জন্য ব্যাকুলতা বোধ করছে। কিন্তু রিফাতকে শান্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে সাহস পাচ্ছে না। বারবার নজর ঘুরিয়ে দেখছে।
“জায়গাটার কথা মনে আছে তোমার? চিনতে পেরেছ?”
শোভা মাথা দুলায়।
“আমি এয়ারপোর্ট থেকে সোজা তোমার কাছে এসেছি। তারপর এখানে। তোমার কোন আইডিয়া আছে কেন নিয়ে এলাম তোমাকে এখানে?”
শোভা মাথা নেড়ে না করলো। রিফাত আরও একটু গম্ভীর হলো-“হঠাৎ না বলে চলে এলাম কেন জানতে চাইবে না?”
শোভার গলা শুকিয়ে এলো। এমন করছে কেন ছেলেটা? তীব্র পানির পিপাসা পেয়ে গেল তার। অসহায় চোখে রিফাতের দিকে তাকালো-“এভাবে কথা বলছেন কেন? আমার খুব ভয় লাগছে। কি হয়েছে বলুন তো? সব ঠিক আছে? বাবা মা ভালো আছে?”
শোভার হাত পা কাঁপছে মৃদু। প্রচন্ড ভয় লাগছে তার। রিফাত ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। সেই দৃষ্টির মানে বুঝতে না পেরে আরও অসহায় বোধ করলো সে।
“তুমি আমাকে ভালোবাসতো মেঘা? আমায় নিয়ে তোমার মনে কোন দ্বিধা নেই তো?”
থমকে গেলো মেয়েটা। ছেলেটা কি বলছে এসব? এতোদিন তাহলে কোন সম্পর্কের ভিত্তিতে কথা বলেছে ওর সাথে? এই চিনেছে তাকে? বিশ্বাসের ভিত্তি কি এখনো নড়বড়ে? হতবিহ্বল শোভা রিফাতকে দেখলো-“আপনার কি মনেহয়?”
“প্রশ্নের বদলে প্রশ্ন নয় মেঘা। উত্তরটা সরাসরি চাইছি।”
“কেন এমন প্রশ্ন করছেন আমি জানি না। শেষবার খুব তুচ্ছ কারনে আপনার সাথে ঝগড়া করেছি সেই কারণে কিনা জানিনা। সেটাই কারণ হয়ে থাকলে আমি ভীষণ লজ্জিত। কারণ ঝগড়াটা করা আমার উচিত হয়নি।”
“এসব কথা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়।”
শোভা থামলো, ভাবলো কিছু একটা। তারপর খুব ধীরস্থির হয়ে উত্তর দিলো-“আপনাকে নিয়ে আমার মনে কোনরকম দ্বিধা নেই। ভালোবাসি আপনাকে।”
“তাহলে আমি কোন ডিসিশন নিলে বিনা প্রশ্নে মেনে নেবে তো? বিশ্বাস করবে তো আমায়?”
রিফাত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়। শোভা মাথা দুলায়-“আপনার উপর পূর্ন বিশ্বাস আছে আমার।”
এইবার রিফাতের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো। চেহারায় অদ্ভুত আনন্দের ছটা। সেই চোরা হাসি দেখে শোভার বুক কেঁপে উঠলো। হৃদয় জুড়ে তান্ডব শুরু হলো। কি করতে চাইছে রিফাত?

চলবে—
©Farhana_Yesmin