আমাদের ছোট পৃথিবী পর্ব-০২

0
2

#আমাদের_ছোট_পৃথিবী (২)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

মেয়েকে নিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে বসে রয়েছি। জীবনের এই পর্যায়ে এসে দ্বিতীয়বার বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। যদিও আমি চাচ্ছিলাম না কোন সম্পর্ক জড়াতে। আমি এবং আমার মেয়ের ছোট এই পৃথিবীতে আমি কারো আগমন ঘটাতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু! কলিগ, বন্ধুরা আমাকে নানাভাবে বোঝালো। এভাবে সারাজীবন একা কাটানো যায় না। তাছাড়া আমার মেয়েরও একজন বাবার প্রয়োজন। গত সাত বছর তো দুনিয়াটাকে চিনলাম। এবার সেই দুনিয়া থেকে ভালো কাউকে খুঁজে বের করে জীবনসঙ্গী করা প্রয়োজন। অতঃপর আমারও মনে হলো আমার জীবনে কারো প্রয়োজন। সেজন্য আমার বান্ধবীর মাধ্যমে পাওয়া এক পাত্রের সঙ্গে আজ দেখা করতে আসলাম। পাত্রের পরিবার আমাকে দেখার পূর্বে আমার মনে হয় তার সঙ্গে আমার কিছু কথা বলে নেওয়া উচিত। সেই কথামতো আমার বান্ধবী স্নেহা আজ আমার সঙ্গে ঐ ভদ্রলোকের এখানে দেখা করার ব্যবস্থা করলো। যদিও ভদ্রলোক এখনো এসে পৌঁছালো না। যার জন্য আমি কিছুটা বিরক্ত হচ্ছিলাম। তবে বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে ভদ্রলোক আসলেন। তিনি এসে আমাকে বললেন,“আপনি মৌমিতা?”

“জ্বী।”
ভদ্রলোক আমার কথা শুনে খুশি হয়ে বসলেন। তিনি মিমিকে দেখে বললেন,“আপনার মেয়ে?”

“হ্যাঁ।”
ভদ্রলোক মিমির সঙ্গে কথা বললো। খুব অল্প সময়ে তার সঙ্গে ভাব জমালেন। আমার কাছে বিষয়টি খুবই ভালো লাগলো। তবে তেমন কিছু বললাম না। অতঃপর লোকটি মিমিকে তার ফোনে গেম খেলতে দিয়ে আমাকে বললেন,“আমার নাম প্রীতম।” সংক্ষেপে তার কাজ সম্পর্ক বললেন। আমি শান্ত হয়ে শুনলাম। তারপর বললাম,“আপনি অবিবাহিত হয়ে আমার মতো একজন বিবাহিত এক বাচ্চার মায়ের সঙ্গে বিয়ের কথা আগাতে চাচ্ছেন কেন?”
আমার এই প্রশ্নে ভদ্রলোক ঘাবড়ালেন না। বরং খুবই স্বাভাবিক কন্ঠে বলেন,“এই দুনিয়ায় কেউ খুঁত পছন্দ করে না। সবাই স্বচ্ছ মানুষ জীবনসঙ্গী হিসাবে চায়। সেই অনুযায়ী আমিও স্বচ্ছ নই। তাহলে তো আপনাকে বিয়ে করার কথা ভাবতাম না।”

“আমি বুঝিনি। একটু বুঝিয়ে বলুন।”
আমার কথাই প্রীতম খুবই স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,“আমি সন্তান জন্মদানে অক্ষম। শুধুমাত্র এই কারণেই আমি আপনাকে দেখতে আসছি। কারণ আমার মিমির মতো একজন বাচ্চা চাই। যাকে আমি নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসবো এবং সেও আমাকে বাবার স্থানে বসাবে।”

“আর জীবনসঙ্গীর থেকে কোন চাওয়া পাওয়া নেই?”
আমার এই কথায় প্রীতম মুচকি হাসি দেয়। অতঃপর বলে,“আছে। সেগুলো যাচাই করতেই তো এখানে এসেছি।”

“আচ্ছা। আপনি জানেন আমার আগের স্বামীর সঙ্গে আমার কেন….।”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে প্রীতম শান্ত গলায় বলে,“আমি আপনার অতীত নিয়ে জানতে আগ্রহী নই। আমি চাই না আমার জন্য আপনি আপনার অতীতের খারাপ স্মৃতি মনে করে কষ্ট পান।”

“আচ্ছা।”
আমি এটা বলে চুপ করে গেলাম। অতঃপর আমাদের মাঝে টুকটাক কথা হলো। বেশিরভাগ কথা ভদ্রলোক বললেন। কথা শুনে মানুষটিকে খারাপ মনে হলো না। কিন্তু কথায় বলে দুষ্টু লোকের মিষ্টি কথা। সেজন্য বিদায়ের সময় প্রীতম আমাকে বিয়ে করতে সম্মতি জানালেও আমি বললাম,“আমি আমার মত পরে জানাবো।”
প্রীতম এটা শুনে স্বাভাবিক গলায় বললো,“আচ্ছা। আপনার মতামত জানার অপেক্ষা করবো। আশা করি সেটা পজেটিভ হবে।”

আমি এই কথার জবাব না দিয়ে মিমিকে নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। বাসায় এসে মিমিকে বললাম,“তোমার ঐ আংকেলকে কেমন লাগলো?”

“খুব ভালো। সে আমার সঙ্গে কত গল্প করলো, খেললো। আমার খুবই ভালো লেগেছে।”
আমার মেয়ের ভালো লাগার কথা শুনে আমি কিছুটা খুশি হলাম।
__
রাতের বেলা মিমিকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছি। মিমি ঘুমে মগ্ন। তবে আমার চোখে ঘুম নেই। আমার চোখে শুধু অতীতের সেই স্মৃতিগুলো ভেসে উঠছে। রায়ানের সঙ্গে সেদিনের তর্কের পর আমি পরবর্তী দিন আমার শাশুড়ীকে ডেকে পাঠাই। শাশুড়ী মা এসে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলে,“পুরুষ মানুষের যখন রেগে থাকে তখন বউদের একটু শান্ত থাকতে হয়। তুমি সবসময় ওর সাথে ঝগড়া করো কেন? একটু শান্তভাবে সবটা ম্যানেজ করার চেষ্টা করো।”

“কিভাবে করবো মা? আপনি আমার দিকে তাকান। আমি কোন জামা পড়ে আছি দেখুন? গত দেড় বছরে আপনি আমাকে কিছু জামা উপহার না দিলে আজ আমাকে জামা ছাড়া থাকতে হতো। এমন তো নয় যে আপনার ছেলে গরিব কিন্তু তাও সে আমার প্রতি উদাসীন। নিজের স্ত্রী, সন্তানের থেকে তার কাছে ভাবী, ভাবীর সন্তান মূল্যবান। কিন্তু কেন?”
আমার এই কথা শুনে শাশুড়ী মা চুপ করে যায়। সে কথা বলে না। আমি খুবই কঠিন গলায় এবার বলি,“আপনি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছেন তাই না মা? এই পরিবারে সবার আড়ালে অন্যকিছু চলে?”

আমার মুখে এই কথা শুনে শাশুড়ী মা বলে,“ছিহ। বৌমা তুমি এসব কী বলছো? তুমি ওদের ভাই বোনের সম্পর্ককে অন্যকিছু ভাবছো?”
আমার শাশুড়ী মা কথাটি বললেও তার কথায় তেমন জোর ছিলো না। সে কথাটি খুবই থতমত খেয়ে বলেন। আমি শান্ত গলায় বললাম,“চোখের সামনে সব দেখা যাচ্ছে মা। আর হ্যাঁ এবার হয়তো আপনি আপনার ছেলের মতো আমাকেই হিংসুটে, আমার মানসিকতা খারাপ এটাই বলতে চাচ্ছেন। আসলেই তাই? কোন স্ত্রী এসব সহ্য করবে এবং স্বাভাবিকভাবে নিবে বলেন?”

আমার শাশুড়ী মা কোন কথা না বলে ঘরে চলে যান। সেদিন রাতেই আমি রায়ানের সবচেয়ে বড় সত্যি সম্পর্কে জানতে পারি। রাতে শাশুড়ী মা রায়ানের গালে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলে,“নিজের স্ত্রী, সন্তানের কথা না ভেবে পরের স্ত্রী নিয়ে এত ভাবলে বউয়ের তো রাগ হবেই। আবার তুই নিজেকে ভোলাভালা প্রমাণ করতে তার চরিত্র নিয়ে কথা বলছিস। তোর এই কথা বলতে একটু লজ্জাও করছে না?”

“লজ্জা করবে কেন? এটাই তো সত্যি। তোমার বউ তো সারাদিন বলে আমি তাকে ভালোবাসি না। আমি যদি তাকে ভালো না বাসি, তার কাছে না থাকি তাহলে তার পেটে সন্তান আসলে কিভাবে? কার অবৈধ বাচ্চা পেটে ধরেছে?”
নিজের স্বামীর মুখে নিজের সম্পর্কে এমন কথা শুনে আমি পুরো হতভম্ব হয়ে গেলাম। তবে আমাকে সেই কথার প্রতিবাদ করতে হয়নি। আমার হয়ে শাশুড়ী মা প্রতিবাদ করেন। যার ফলে মা ছেলের মধ্যে তর্ক বেঁধে যায়। তর্কের এক পর্যায়ে আমার শাশুড়ী বলে,“ঐ ন ষ্টা মেয়ের কথা ভেবে তুই নিজের স্ত্রী সন্তানকে কষ্ট দিচ্ছিস। নিজের সন্তানকে অবৈধ বলছিস। ছিহ।”

এই কথা শুনে রায়ান তার মায়ের গায়েই হাত তুলতে যায়। সে বলে,“একদম ময়না(ভাবী) সম্পর্কে বাজে কথা বলবে না।”
তাদের এই কথা কাটাকাটির মাধ্যমেই আমি জানতে পারি আমার ধারণাই সত্যি। আমার স্বামী আমার বিয়ের আগে থেকেই তার ভাবীর সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক জড়িত। আমার ভাসুর আগে বিদেশ ছিলো। সেই সময়ে তাদের মাঝে সম্পর্ক হয়। এই বিষয়ে শাশুড়ী মা জানতে পেরে অনেকবার ভাবীকে বের করে দিতে চায়। কিন্তু রায়ানের জন্য পারেনি। বাধ্য হয়ে ভাসুরের কাছেও এসব গোপন করতে হয়। আমার শাশুড়ী মা ভাবছিলো রায়ানকে বিয়ে করালে সে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এমনটা হয় না। এমন মানুষকে ঠিক করতে আমার শাশুড়ী মা আমার মতো অনাথ একটা মেয়ের জীবনটা এভাবে নষ্ট করলো। এটা ভাবতেই আমার বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিলো। এক পর্যায়ে আমি মাথা ঘুরে সেখানে পড়ে যাই। যখন জ্ঞান ফিরে তখন আমি নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করি। আর তখন রায়ান আমাকে বলে,“দুই টাকার রাস্তার মেয়ে। একটা অনাথ। তোর যাওয়ার মতো কোন জায়গা নেই। তাই তুই যা শুনেছিস সেটা ভুলে যা এবং এখানে চুপচাপ কাটিয়ে দে।”
তার কথা অনুযায়ী তিনবেলা ভাত তো পাচ্ছি। এটাই যথেষ্ট। আমি আর কথা বললাম না। আমার শাশুড়ীর দিকে তাকাতে সে লজ্জা বা অপরাধবোধে মাথানত করে চলে যায়। আমি রায়ানের দিকে তাকিয়ে বলি,“তোমাদের এতদিনের সম্পর্ক তাহলে তুমি আমাকে কেন বিয়ে করলে?”
এই সময়ে রায়ান যা বলে তা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিলো কেউ আমাকে এসব শোনার আগে মে রে ফেলতো। তাহলে অন্তত বেঁচে যেতাম।


চলবে,
(ভুলক্রটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)