আমাদের ছোট পৃথিবী পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
3

#আমাদের_ছোট_পৃথিবী (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

রায়ান বলে,“পরী আমার মেয়ে।” এই কথাটি শুনে আমি একদম বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। রায়ানের কথা অনুযায়ী, তার সঙ্গে তার ভাবীর সম্পর্ক অনেক গভীর এবং ভালোবাসার। এই সম্পর্ক নিয়ে আমি কোন প্রশ্ন করতে পারবো না। কোন কথা বলতে পারবো না। এইসব জেনে আমাকে থাকতে হবে।

অনাথ হওয়ার জন্য আমার যাওয়ার কোন জায়গা ছিলো না। সেজন্য রায়ান ভেবেছিলো তার সবকিছু মেনে আমি থেকে যাবো। আমিও থাকতামও। আমি রায়ানকে বলেছিলাম সে পরীর খেয়াল রাখুক কিন্তু তার ভাবীর সঙ্গে সবকিছু শেষ করতে হবে। তাহলে আমি তার সাথে থাকবো। প্রথমে অবশ্য রায়ান রাজি হয়েছিলো। কিন্তু দিনশেষে এসব কিছুই হয়নি। উল্টো এসব তার ভাই জানার পর তাদের মাঝে বিশাল এক মারা মারি হয়। তাও এই নির্লজ্জ দুজন এই সম্পর্কে কোন পাপ নেই, এটা ভালোবাসার এই জ্ঞান বড় মুখ করে বলে। আমি এসব জানার পর রায়ানকে ছেড়ে স্নেহার কাছে আসি। সেদিন রায়ান আমাকে একবার আটকালোও না। আট মাসের পেট নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে আসি। রায়ানের এসবে কোনকিছু যায় আসে না।

একটা সময় পর মিমির জন্ম হয়। আমিও স্নেহার মাধ্যমে একটি কাজে যোগ দেই। তারপর রায়ানের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দেই। মিমির তিন বছর অব্দি রায়ান একবারের জন্য খোঁজও নেয়নি। তারপর আসছিলো যখন সে জীবনে ভালো নেই তখন ক্ষমা চাইতে। আমাদের জীবনে ফেরত নিতে। তবে আমি তাকে আর সুযোগ দেয়নি। এভাবেই মিমির বয়স আজ সাত এ পড়লো। আগের তুলনায় ভালো একটি জব করি। আমি এবং আমার মেয়ে ছোট এই পৃথিবীটা খুব সুন্দরভাবেই কাটছিলো। যদিও গত সাত বছরে অনেক কষ্ট করেছি। ছোটখাটো একটি জব দিয়ে এক বেলা খেয়ে দুবেলা না খেয়ে মেয়েকে মানুষ করেছি। অনেক কষ্টকর ছিলো জীবন। কিন্তু খারাপ কাটছিলো না। এখানে অন্তত রায়ান নামক মানসিক অত্যাচারের মানুষটি ছিলো না। মেয়ের সঙ্গে খুবই ভালো কাটছিলো জীবন। আমার মেয়ে আমার ভালো থাকার ঔষধ।
____
মিমিকে বুকে জড়িয়ে এসব কথাই ভাবছিলাম। বেশ কিছুদিন কেটে যায়। এই সময়ে প্রীতমের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। লোকটিকে খুব একটা খারাপ মনে হলো না। সেজন্য বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দিলাম। আমার সম্মতি পেয়ে তার পরিবার এসে আমাকে দেখে গেল। আমাদের দুজনার মাঝে সবকিছু ঠিক হলো। কয়েকদিন বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ এবং ফোনে কথা হলো। আজও দুজন দেখা করতে চলে আসলাম। সঙ্গে মিমিও ছিলো। বিয়ের আগে এত দেখাশোনা এজন্যই করছি যাতে বিবাহিত জীবনে গিয়ে সে মানুষটি অচেনা না হয়ে যায়। একবার যেহেতু খারাপ সময় কাটিয়ে এসেছি সেহেতু দ্বিতীয়বার না চিনে বিয়ে করতে চাচ্ছিলাম না। সেজন্যই আমি বিয়ের তারিখ ঠিক করতে বাঁধা দিয়েছি। দুজনে একটি পার্কে বসেছিলাম। প্রথমে কথা প্রীতমই শুরু করলো। সে বললো,“আপনার আমাকে এখনো চেনা হয়নি? বিয়ের তারিখ কী আর একটু আগে করা যায় না?”

“না। এই দুনিয়ায় মানুষ চেনা সবচেয়ে কঠিন। সেই কঠিন কাজটি আমি এত দ্রুত করতে চাই না। তাছাড়া আপনার পরিবার রাজি, আমি রাজি আপনি রাজি। সবই তো ঠিক আছে। তাই একটু দেরিতে বিয়ের তারিখ পড়লে সমস্যা তো নেই।”
আমার এই কথায় প্রীতম হতাশ হয়ে বললো,“সত্যি বলতে আমার আপনাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আমি এত অপেক্ষা সহ্য হচ্ছে না।”

সামনে খেলা করা মিমিকে লক্ষ্য করে আমি বললাম,“আপনার তো একার জীবন কিন্তু আমাদের দুজনার জীবন। তাই সময়টা একটু বেশিই দরকার।”

“আচ্ছা নিন সময়। আমার সমস্যা নাই। আপনি আমার হলেই হবে।”
প্রীতমের এই কথায় আমি ম্লান হাসলাম। তারপর দুজনে আরও কিছু কথা বললাম। কথা প্রসঙ্গে প্রীতম বলে,“আমার বিশ্বাসই হয় না। আপনার মতো এত একজনকে কেউ একজন চিনতে পারলো না। সেই হতভাগার জন্য আফসোস হচ্ছে।”
আমি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,“আপনি যেই নজরে আমাকে দেখছেন সেই নজরে সে দেখেনি। প্রত্যেক মানুষই আলাদা। যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে সবাই আলাদা।”
প্রীতম মাথা নাড়ালো। বেশ কিছুটা সময় কথা বলা শেষে আমরা উঠলাম।

আমি প্রায় প্রীতমের সঙ্গে বিয়ের তারিখ নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছিলাম। সেই মূহুর্তে আমি জানতে পারি সে বিবাহিত। অর্থাৎ আগে বিবাহিত ছিলো। তার স্ত্রী তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। সে ডিভোর্সি তাতে আমার কোন সমস্যা ছিলো না। আমিও তো তাই। কিন্তু আমার সমস্যা হলো সে আমাকে মিথ্যা বলেছে। যে সম্পর্কের শুরুটা মিথ্যা দিয়ে হলো সেই সম্পর্ক কখনোই সুন্দর হয় না। সত্যি বলতে এমন মানুষকে আমি ভরসা করতে পারবো না। তাই মিমিকে স্নেহার কাছে রেখে আমি প্রীতমের সঙ্গে দেখা করলাম। প্রীতম আসতেই আমি বললাম,“মায়া কে?”
আমার কথা শুনে প্রীতম হতভম্ব হয়ে গেল। কিছুটা আমতা আমতা করে বলে,“মায়ার কথা আপনি জানলে কিভাবে?”

“যেভাবেই জানি। আপনার এটা আমাকে জানানো উচিত ছিলো না? এভাবে মিথ্যা বলে বিয়ে করতে চাচ্ছিলেন কেন? আপনি অবিবাহিত নন এটা আমার সমস্যা নয়। কিন্তু আপনি মিথ্যা কেন বললেন?”
আমার কথা শুনে প্রীতম কয়েক মূহুর্ত ভাবনায় পড়ে যায় সে কী বলবে। পরক্ষণে শান্ত গলায় বলে,“আমি আসলে চাইনি এই বিয়েটা ভেঙে যাক।”

“তাই নিজেকে অবিবাহিত দাবী করলেন? স্যরি মিস্টার প্রীতম আমার পক্ষে এই বিয়ে করা সম্ভব নয়।”

“না। প্লীজ মৌমিতা এমন করবেন না। আমি আপনাকে অনেকটা পছন্দ করে ফেলেছি। এই মূহুর্তে এই সামান্য কারণে বিয়ে ভেঙে দিলে আমি সহ্য করতে পারবো না।”

“এটা আপনার কাছে সামান্য কারণ মনে হচ্ছে? এখন তো মনে হচ্ছে আপনাকে আমি এক ফোঁটাও চিনিনি। আমার সিদ্ধান্ত মস্তবড় ভুল ছিলো।”

“আপনি এমনটা করতে পারেন না মৌমিতা। আমরা পরিবার সব আত্মীয়দের জানিয়ে দিয়েছে। এখন বিয়ে ভাঙলে আমার সম্মান নষ্ট হবে।”
আমি প্রীতমের কথা শুনে হতবাক হলাম। এই মানুষটি নিজের মিথ্যা নিয়ে এক বিন্দু অনুশোচনা হচ্ছে না। বরং তার কষ্ট হচ্ছে সবাইকে জানিয়েছে, তাদের এখন কিভাবে জানাবে এখানে বিয়ে হবে না। এটা জানার পর আমি তৎক্ষনাৎ বললাম,“আজকের পর আমার সাথে আর যোগাযোগ করবেন না।”

“আপনি এমন করছেন কেন? এমন একটা ভাব নিচ্ছেন মনে হচ্ছে আপনি অবিবাহিত?”
এই কথার জবাবে আমি মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,“আপনি আমার বিষয়টি বুঝবেন না। এটা বোঝার জন্য যেটা দরকার সেটা আপনার নেই। আর এই জিনিসটা যার থাকবে আমি তাকেই বিয়ে করবো।” এই কথা বলে আমি চলে আসলাম। প্রীতম পিছনে বসে হয়তো রাগান্বিত চোখে আমাকে দেখতে। তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।

বাড়িতে এসে মিমিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে তার কপালে চুমু খেলাম। অতঃপর বললাম,“তোমার ভালো আংকেলের সঙ্গে আর দেখা হবে না। তুমি যদি দেখা করার বায়না ধরো তাহলে মাম্মা খুব কষ্ট পাবে। তুমি নিশ্চয় মাম্মাকে কষ্ট দিতে চাইবে না?”
আমার কথা প্রথমে মিমি বুঝতে পারেনি। তাই অবুঝের মতো তাকিয়ে ছিলো। আমি তাকে শান্তভাবে বোঝালাম। অতঃপর মিমি বললো,“না মাম্মা। তুমি কষ্ট পেলে আমি তার সাথে কোন কথা বলবো না।”

“এই তো আমার ভালো মেয়ে।”
এটা বলে মিমিকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। আর কী চাই জীবনে! এই তো আমি, আমার মেয়ের একটি সুন্দর পৃথিবী রয়েছে। হতে পারে আমাদের এই পৃথিবীটা ছোট। কিন্তু অনেক শান্তির তো। এই শান্তির জীবনে কোন মিথ্যার জায়গা কেন দিবো? এই জগৎ এ আমরা এমন কাউকে জায়গা দিবো যে স্বচ্ছ হবে। যাকে বিশ্বাস করে আমরা আমাদের পৃথিবীর একাংশ তাকে দিতে পারবো। হ্যাঁ এমন পার্ফেক্ট কেউ না আসলে আমি বিয়ে করবো না। কখনো না। মিমিকে বুকে নিয়ে আমি যে শান্তি অনুভব করি আমি চাই না আমার এই শান্তির জগতে এক বিন্দু পরিমান অশান্তি যুক্ত হোক। আমরা আমাদের ছোট এই পৃথিবীতে খুব ভালো আছি। এখানে না রায়ানকে প্রয়োজন, না প্রীতমকে। আমাদের শুধু আমাদেরই প্রয়োজন।

(সমাপ্ত)