# আমায়_একটু_ভালবেসো
#জান্নাতুল_ফেরদৌস_কেয়া
(২৪)
পর্ণা রুমে এসে দরজা বন্ধ করলো। খাটের উপর বসে পেটে হাত রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
,আমায় ক্ষমা করিস বাবু। তোর এই কল ঙ্কিনী মা, তোকে নিজ হাতে মে রে ফেলছে। তোকে এই পৃথিবীর আলো দেখাতে অক্ষম সে।তার যে ভিষণ ভ য় হয়,যদি তুই তার মতো হোস! এমন ঘৃনিত জীবন বাস করিস! তাই এমন করছে। জানি কষ্ট হবে, তবুও একটু সহ্য করে নিস।
পর্ণা সিলিং ফ্যানের মাঝে ওরনা দিয়ে দঁড়ির ফাঁ স বানালো।পেটে হাত দিয়ে চেয়ার এনে তার উপর ওঠলো।
প্রচন্ড তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে গেছে আয়ানের।পানি খেতে ওঠে দেখলো,জগে পানি নেই। তাই নিচে নামছে পানি খাওয়ার জন্য।
আয়ানের রুমটা দোতলার একদম শেষ কর্ণারে।তাই আসার সময় সবগুলো রুমই দেখা যায়।আয়ান এলোমেলো পায়ে হাঁটছে। ঘুমের ঘোরে কিছুই মাথায় ঢুকছে না।হঠাৎই কারো কান্না শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ায় আয়ান।ভালো করে লক্ষ্য করেতেই বুঝলো,কান্না টা পর্ণার রুম থেকে আসছে। আয়ান ভাবলো,হয়তো আদনানের সাথে ঝগড়া হয়েছে তাই কাঁদছে। এমনিতেও ওর সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে আয়ানের নেই।ওই মেয়ের যে বদজাত। আর নয়তো কি, কেউ কারো সাথে এমন করো?
আয়ান পা চালিয়ে চলেই যাচ্ছিল।কিন্তু হঠাৎ আবার কি মনে করে যেন পর্ণার রুমে উঁকি দিল।পর্ণার রুমের সামনের জানালাটা খোলা।সেটা দিয়েই আয়ান যা দেখলো,তাতে পায়ের তলে মাটি সরে গেল তার।
পর্ণা নিজের গলায় ওড়না দিয়ে প্যাচ দিয়েছে।পা দিয়ে চেয়ারটা চেষ্টা করছে সরাতে।হঠাৎ শব্দ করে চেয়ারটা নিচে পরলো। আর পর্ণা কাতরাতে লাগলো।চেয়ার পরার শব্দে ধ্যান ভাঙলো আয়ানের।সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। শব্দ শুনে,আয়ান দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলো।
,এই পর্ণা, পর্ণা।কি করছিস তুই?দরজা খোল,দরজা খোল বলছি?
বলেই জোরে, জোরে দরজা ধাক্কা দিয়ে ভাঙ্গার চেষ্টা করছে।
চারিদিক নিঝুম, নিস্তব্ধতায় ছেঁয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতা কে ভেঙে, পুরো বাড়ি জুড়ে ছড়িয়ে পরলো আয়ানের চিৎকার।
বাড়ির প্রায় সকল সদস্যই সজাগ হয়ে গেছে। আয়ান আর ইশান মিলে ধাক্কা দিতেই দরজা ভেঙে গেল।অনল সাহেব জলদি গিয়ে দু-হাতে পর্ণার পা উপরে তুলে নিল।আয়ান খাটের উপর ওঠে রশি কা টার চেষ্টা করছে। প্রায় পয়তাল্লিশ সেকেন্ড পর পর্ণার গলা থেকে রশি সরে যায়।তার চোখগুলো উল্টো ফেলেছে। ইশান দ্রুত তাকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওনা হয়।
আকস্মিক ঘটনায় সকলেই হতবিহ্বল। পর্ণা যে এমন একটা কাজ করবে,তা কেউ ভাবতেই পারেনি।সবার মাথায় হাত!পাপিয়া বেগম ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠলো। মেয়ে টা কেন এমন হয়ে গেলে? বলেই জোরে কেঁদে দিল।
হাসপাতালে এনে পর্ণাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।আয়ান আদনানকে কল করে সবকিছু বলে।ফোন পেয়ে গাড়ি নিয়ে দ্রুত ছুটে আসে আদনান। তার মাথা হ্যাং হয়ে আছে। তবে কি এই জন্যই ফোন দিয়েছিল পর্ণা?
সকাল নয়টার দিকে জ্ঞান ফিরে পর্ণার। জ্ঞান ফিরার পর যে কথাটি আগে বলে পর্ণা তা হলো,
,আমার বাচ্চা! আমার বাচ্চা কেমন আছে ডাক্তার? ও বেঁচে আছে তো?
পর্ণার চিৎকার শুনে ডাক্তার দৌড়ে আসে। পর্ণার কথা শুনে জিজ্ঞেস করলো,
,আপনি প্রেগন্যাট?
,হ্যা। আমার বাচ্চা?
ডাক্তার বিড়বিড় করে বলল,
,ওহ নো!
পর্ণা উত্তেজিত হয়ে বলল,
,কি হয়েছে ডাক্তার? আমার বাচ্চা টা ঠিক আছে তো?
ডাক্তার কিছু একটা ভেবে বলল,
,দেখুন আমরা শুধু আপনাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছি।তাই বুঝতে পারছি না,আপনার সন্তান এখন কেমন আছ!আমি এখুনি কিছু টেস্ট করিয়ে দেখছি বিষয়টা।
ডাক্তার কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। পর্ণার চিৎকার শুনে সবাই এসে দাঁড়ালো দরজার সামনে। পর্ণার মুখে বাচ্চার কথা শুনে সবাই আরেক দফা চমকালো।
আদনান যখন বুঝতে পারলো বিষয়টা, তখন রে গে গিয়ে দাবানীয় এক চড় বসালো পর্ণার গালে।পর্ণার গাল চেপে ধরে বলল,
,এই কি বললি? কি বললি একটু আগে। আমার সন্তান আসছে পৃথিবীতে। আর তুই কি করলি,তাকে মা রার জন্য ওঠে-পড়ে লাগলি। আরে মায়েরা তার সন্তান কে আগলে রাখে।বিপদ এলে তা নিজে মোকাবেলা করে আর তুই, তোর নিজের স্বার্থের জন্য একটা নিষ্পাপ বাচ্চা কে মে রে ফেলছিস? তাকে দুনিয়ার আলো দেখতে দিলি না।এই তোর সাহস হলো কি করে, আমার সন্তান কে মা রার কথা চিন্তা করা? আজ যদি আমার সন্তানের কিছু হয়।তবে তোকে জানে মে রে ফেলবো আমি।কথাটা মাথায় রাখিস!
আদনান আরো কিছু বলতে, কিন্তু তার আগেই তাকে ধরে বাইরে নিয়ে গেল সবাই। আদনান ফ্লোরে বসে কান্না ভেঙে পড়লো।দু’হাতে মুখ ডেকে ডুকরে কেঁদে ওঠলো। চিৎকার করে বলল,,
,হে আল্লাহ! এ কোন পা পের শাস্তি দিচ্ছো তুমি আমায়?আমাকে দুঃখ দিলে দাও।কিন্তু ঐ নিষ্পাপ শিশুটা কেন এই কষ্ট সহ্য করবে?আল্লাহ তুমি আমার সন্তানের সকল বিপদ এনে আমায় দাও। তবুও তাকে সুস্থ করে দাও!
সবাই আদনানকে সান্ত্বনা দিল। যে কিছু হবে না ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার পর্ণাকে বিভিন্ন ধরনের টেস্ট করাচ্ছে। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর ডাক্তার বাইরে বের হলো।ডাক্তার বের হয়েছে দেখে সবাই এগিয়ে গেল তার দিকে। প্রত্যেকের মুখে একই প্রশ্ন,” ডাক্তার বাচ্চাটার কি অবস্থা?
ডাক্তার চিন্তিত সুরে বলল,
,আপনারা ঠিক সময়, ফাঁ সির রশিটা কে টে ফেলেছেন। তাই বিশেষ কিছু হয়নি।তবে এখনো ক্লিয়ার করে কিছু বলা যাচ্ছে না। আমরা বাচ্চাটার হার্টবিট শুনতে পাচ্ছি। তবে অন্য কোনো ক্ষ তি হয়েছে কিনা তা বলতে পারছি না।যাইহোক এখন থেকে ওনাকে সাবধানে রাখবেন। আর এরকম যাতে দ্বিতীয়বার না ঘটে, সেই দিকে খেয়াল রাখবেন।
সবাই যেন খুশি হতে গিয়ে ও হতে পারলো না।কোথায় যেন একটা সুর কে টে গেছে।
পর্ণাকে তখন বেডে দেয়া হয়েছে। আদনান করিডোরে বসে আছে। পর্ণাকে দেখার তার কোনো ইচ্ছে নেই। দেখলেই হয়তো গ লা টিপে ধরতে ইচ্ছে হবে।
যারা,যারা এসেছিল সবাই চলে গেছে। শুধু পাপিয়া বেগম আর আদনান রয়ে গেছে।
পাপিয়া বেগম ধীর পায়ে কেবিনে প্রবেশ করলো। পর্ণা তখন চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। বাচ্চা টা বেঁচে আছে শুনে, সে শান্ত হয়েছে। পাপিয়া বেগম মেয়ের মাথায় হাত রাখলো। পর্ণার বিদ্যুৎগতিতে চোখ মেললো।মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল,
,পাপিয়া বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,
,কেমন আছো এখন?
,ভালো মা।
,হুম ভালো।তা রাতে ওমন একটা কান্ড কেন ঘটিয়েছো জানতে পারি?
পর্ণার চুপ করে রইলো।তার কি বলার মতো মুখ আছে। পাপিয়া বেগম এবার কিছুটা শক্ত হলো।কন্ঠে কাঠিন্য ভাব এনে বলল,
,কি হলো, কথা বলছো না কেন?জবাব দাও!
পর্ণা মৃদু কেঁপে ওঠলো।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল,
,আমি এসব নিজেকে শা স্তি দেয়ার জন্য করেছি মা!এই অপরাধ বোধ আমাকে কুঁড়ে, কুঁড়ে খাচ্ছিল।তোমরা আমাকে কোনো শাস্তি না দিয়ে আমাকে ছেড়ে দিলে,এটাই আমি মানতে পারছিলাম না।
,তাই এসব করেছো তাই তো? পর্ণা তোর যদি শরীর ভালো না থাকতো।তবে আজকে আমার হাতের একটা চড় তোর গালে পরতো।হ্যা রে,তুই তো তোর মায়ের থেকে ও নিকৃষ্ট। সে তো তোকে দশ মাস দিন গর্ভেধারণ করে তোকে জন্ম দিয়েছে। তারপর নাহয় ফেলে দিয়ে গেছে।ফেলে দিয়ে গেছে তাতে কি? তুই তো একটা জীবন পেয়েছিস, ভালবাসা পেয়েছিস,আপন মানুষ পেয়েছিস।কিন্তু তুই কি করছিলি,তাকে দুনিয়াতে আসার আগেই শেষ করে দিতে চেয়েছিলি। আজকে যদি আয়ান সঠিক সময় তোকে দরজা ভেঙে গিয়ে না বাঁচাতো।তবে এখন কোথায় থাকতি একবার ভাবতে পারছিস? অবশ্য ওসব ভেবে তোর কি লাভ?তুই তো শুধু নিজের কথায় ভাবিস।তোর জন্য অন্যের কোনো ক্ষ তি হলো কিনা,তা ভাবার তোর সময় আছে?
যাইহোক। এতদিন যা কিছু হয়েছিল তারজন্য আমি তোকে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম।কিন্তু আজ তুই যা করলি,তা ক্ষমার অযোগ্য। তাই আজ থেকে আমি ভুলে যাবো,যে পর্ণা নামের আমার কোনো মেয়ে ছিল। আসছি!
চলবে,,,,