আমায় রেখো প্রিয় প্রহরে পর্ব-৩২+৩৩

0
456

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৩২
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

সকাল সকাল বাড়িতে বাচ্চাদের হৈহৈ রব, চেঁচামেচি, দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি। সুজানা ওদেরকে অনেকবার বারণ করেছে ছোটাছুটি করতে। হোঁচট খেয়ে পড়লে অবস্থা বারোটা বেজে যাবে। তার গায়ে নিজের থ্রিপিছটা। ক্লথ ডায়ার থাকায় সুজানার কাপড় শুকাতে সহজ হয়েছে আনিকার। রান্নাঘরে সালমা বেগম থাকায় সুজানা ভয়ে ওদিকে যায়নি। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই চলে এল ব্রেকফাস্ট সাড়তে। বাড়ির সবাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে এটা খুব ভালো লেগেছে সুজানার। বাচ্চারা তো তারও আগে।
মমতাজ বেগম অজীফা পড়া শেষে এলেন ধীরপায়ে হেঁটে। আজীম সাহেব, আজাদ সাহেব আর আহনাফ টেবিল দখল করে বসলো। সুজানাকে দেখে বলল

ঘুম ভালো হয়েছে তো সুজানা? টিচারকে পেয়ে স্টুডেন্টদের তো খুশির শেষ নেই।

সুজানা অনা আবিদের দিকে আবারও তাকালো। বলল

হ্যা। সকাল সকাল বিছানায় শুরু করে দিয়েছে।

আনিকা এসে টেবিলে পানির জগ রেখে বলল

এর আর নতুন কি? নিজেদের ঘুম ভাঙলে এরা আর কাউকে ঘুমাতে দেবে?

তারমানে সুজানার ঘুমেই ব্যাঘাত ঘটলো।

সুজানা বলল

না এমন কিছু না আঙ্কেল।

আনিকা বলল,

চাচ্চু আর বলো না অভি কাল অর্ধেক রাত সুজানাকে দিয়ে কাজ করিয়েছে। ঘুমালো কখন?

সালমা বেগম টেবিলে নাশতার প্লেট সাজাতে সাজাতে সুজানার দিকে চাইলেন।

আজীম সাহেব বললেন

তাই নাকি? না এটা তো ভারী অন্যায়।

সুজানা বলল

না, তেমন কিছু না।

না, অভি এটা ভালো করেনি মোটেও। অত রাত জাগিয়ে কাজ করতে হবে কেন?

আনিকা বলল

হুম, কাল আমি কোথায় ভেবেছি সুজানার সাথে গল্প করে রাত কাটাবো অভি সব বরবাদ করে দিল। হুহ স্টুডেন্টও পেয়েছে চুপচাপ তাই যেমন ইচ্ছা তেমন করছে।

সুজানা মৃদু হাসলো তবে কিছু বললো না। বৃদ্ধা বললেন

ছোট বৌমা আমার দাদুভাইকে ডাক দাও। আমরা একা একা খাব কেন?

অভিকে ডাকতে হলো না। সে শপিং ব্যাগ হাতে নিজেই হাজির হলো।

মাথায় কাপড় টানা সবুজ রঙা সেলোয়ার-কামিজ পরিহিত মেয়েটাকে পেছন থেকে দেখে চিনতে ভুল হলো না। মেয়েটার সামনে ব্যাগটা রেখে বলল

ওটা নিয়ে যাবেন। এবার কুঁচকে গেলে খবর আছে।

তারপরেই বিপরীতমুখী চেয়ারটা টেনে বসলো। সুজানা চোখ তুলে দেখলো আকাশীরঙা টি শার্টে তাকে আজকে অন্যরকম স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে।

সুজানার চোখাচোখি হওয়ায় ভুরু নাঁচালো অভিক। সুজানা লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিল।

আজীম সাহেব বলে উঠলেন,

তুমি নাকি কাল সারারাত সুজানাকে দিয়ে কাজ করিয়েছ?

অভিক মুখের কাছে পানির গ্লাস থামিয়ে বলল

কি কাজ?

আনিকা বলল

ওই ডিজাইনের কাজগুলো।

এগুলো সুজানার ডিউটি। করতে তো হবেই। তাই নয় কি সুজানা?

সুজানা মাথা নাড়লো।

বাবা বললেন,

একটু ছাড় তো দেয়া যায় অভি।

ইতোমধ্যে অনেক ছাড় দেয়া হয়েছে।

সালমা বেগম ছেলের প্লেটে সকালের নাশতা দিলেন। বললেন

খাওয়ার সময় কোনো কথা চাই না অভি।

হুম।

অনা আবিদ তাদের বাবার পাশের চেয়ারেই দাঁড়ানো। খেতে খেতে আবিদ সুজানাকে বলল

সুজান আছকে আবার ঘুম যাবে?

সুজানা ওর কথা শুনে মিষ্টি হাসলো। অভিক বলল

মোটেও না। সুজানা আর কখনোই এই বাড়িতে আসবেনা বলে প্রতিজ্ঞা করেছে।

সালমা বেগম খেতে গিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালেন। সুজানা সবার কৌতূহলী দৃষ্টি পরখ করতে গিয়ে সালমা বেগমকে দেখে থমকে গেল।

আনিকা হেসে বলল

বললেই হলো নাকি? মামীরা যখন আসবে তখন আমি সুজানাকে টেনে নিয়ে আসব এখানে। নইলে সবাই মিলে আপনাদের বাসায় চলে যাব। আসবেন তো আপনি?

সুজানা মহাবিপাকে পড়ে গেল। চোখতুলে দেখলো অভিক ফারদিন ভুরু কুঁচকে চেয়ে আছে। সুজানা ওই ভাষা বুঝতে সক্ষম হলো। না বলতে বলছে?
কিন্তু পাশের চেয়ারে বসা উনার মা কেমন করে তাকিয়ে আছে সুজানার দিকে। সুজানা শুকনো ঢোক গিললো। মাথা দুলিয়ে বলল

হুমম।

এই তো ভালো মেয়ের মতো কথা। অভি দেখলি সুজানা আবারও আসবে।

আর কারো দিকে চাইলো না সুজানা। ছেলের আগে মায়ের কথাই বেশি শুনতে হবে তাকে। কি ভয়ানক মহিলা!

ভুলক্রমে একবার চোখ তুলেছিল বৈকি! মায়ের চাহনি দেখে সুজানার জান যায় যায় অবস্থা। সে তো সঠিক কথাই বলেছে। তাহলে এমন করে তাকানোর কারণ কি?

খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষ হতেই সুজানা তৈরি হয়ে নিল। ব্যাগপত্র নিয়ে নীচে এসে সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় শেষ করে বেরোতে যাবে তখনি অভিকের ডাক এল। সুজানা অনাকে সাথে নিয়ে পা বাড়ালো অভিকের ঘরের উদ্দেশ্যে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলো

স্যার……কিছু বলবেন?

ভেতর থেকে আওয়াজ এল।

না।

আচ্ছা। আমি আসি তাহলে।

আমি আপনাকে যেতে বলেছি?

না।

তাহলে?

তাহলে কি দাঁড়িয়ে থাকব?

দাঁড়িয়ে থাকতে কখন বলেছি?

তাহলে কি করব?

আমি না বলা অব্ধি কিছু করবেন না।

সুজানা ছোট্ট করে জবাব দিল।

আচ্ছা।

আজব! আপনার জিজ্ঞেস করা দরকার কেন আমি এভাবে অধিকার কাটিয়ে কথা বলছি।

হুম জানি।

ধপ করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল মুখের উপর।

আপনি কচুও জানেন না।

সুজানা ফিক করে হাসলো।

ক্যাম্পাসে যাতে দেখা যায়। আপনার জানার দরকার ফাঁকা ক্লাসরুম দেখতে কস্মিনকালেও কোনো টিচারের ভালো লাগেনা।

সুজানা আবারও হাসলো।

হুম।

কোনো হুম টুম না সুজানা। উফ!

তাহলে কি?

আপনি আর কখনোই এই বাড়িতে আসবেন না।

আচ্ছা।

সত্যি?

তিনটা।

ওকে। গুড গার্ল।

অভিক এবার নিশ্চিন্ত হলো। সুজানার এবাড়িতে শুধু তার জন্য আসা দরকার। অন্য কারো জন্য কভু নয়, কস্মিনকালেও নয়। এত দেখাদেখির অধিকার শুধু সেই রাখে। তার একটা ব্যক্তিগত স্টুডেন্ট কি থাকতে পারেনা? আজব!

____________________

ওই বাড়ি থেকে ফিরে সুজানা সরাসরি বটতলা স্টেশনে চলে গেল। বন্ধুদের সাথে শাটলে তার ফের দেখা। সবাই জানতে চাইলো ও-ই দিনের কথা।

স্যার কেন তার কথা জিজ্ঞেস করছিল? এবং স্যারকে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছিল।

সুজানার সেদিকে হুশ নেই। সে তখন জানালার কাছে মাথা এলিয়ে দেখতে লাগলো ঝকঝক করে চলতে থাকা শাটলের দু’পাশের সবুজ ক্ষেত,বনজঙ্গল। হাতের উপর খোলা বইয়ের পাতা হাওয়ায় উল্টে যাচ্ছে একের পর এক। উড়েচুল তখন ছুঁয়ে যাচ্ছে নাকমুখ।

বন্ধুরা ফিসফিস করে বলে উঠলো,

ডাল মে কুচ কালা হ্যা?

সুজানা কপাল ভাঁজ করে তাকালো তাদের দিকে। মেহুল বলল

সেগুন বাগিচা?

সুজানা মৃদু হাসলো। সবাই হৈহল্লায় মেতে উঠলো সাথে সাথে।

সুজানা কপাল চেপে ধরলো। বলল

সেরকম কিছু না।

মেহুল বলল

আমাকে এটলিস্ট শেখাতে এসো না। আমি না চোখ দেখেই বুঝি সব। বুঝেছ জানু?

আচ্ছা? তাহলে সবাই মিলে খুশিতে শাটল থেকে লাফ দে।

সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।

শান্তা গাল টেনে দিয়ে বলল

স্যার থেকে এখন দুলাভাই ডাকব নাকি?

সুজানা বলল

ধুরর কি বলছিস এসব? লোকে শুনলে কি বলবে?

আরেহ পুরো দুনিয়া শুনে যাক ।

সুজানা ওদের থেকে বাঁচতে বইয়ে মুখ গুঁজলো। সে দুই নম্বর প্রশ্নের উত্তরটাও খুঁজে পেয়েছে।

প্রথম প্রশ্নটা ছিল, যা আমার আছে তা আমি শুধু আপনাকেই দিতে পারি। অন্য কাউকে নয়।

দ্বিতীয় প্রশ্ন : আমার একটা লাইব্রেরি চাই।

প্রথম প্রশ্নের উপর মন আর দ্বিতীয়টা বন্ধুত্ব। এবার তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরটা জানার অপেক্ষায়।

সুজানা ভেবে পেল না সে কিভাবে বলবে উত্তরগুলো? সে তো সামনে পড়লেই লজ্জায় মরে।

না, উত্তর জানতে চাইলেই সে বলে দেবে, উত্তর হচ্ছে, কচু কচু।

চলবে…..

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৩৩
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

বটতলী স্টেশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জিরো ক্যাম্পাস যতক্ষণ না শাটল থেমেছে ততক্ষণ বন্ধুরা ইচ্ছেমত এই-সেই বলে মজা করেছে সুজানার সাথে। বদ গুলো এখন না জানি সারা দুনিয়া বলে বেড়ায় সব। কেনোকিছু চাপাচাপির ব্যাপার স্যাপার নেই এদের মধ্যে। ফা*জি*লের দল।

ক্যাম্পাসে পৌঁছার পর তারা সবাই ক্লাসরুমে চলে গেল। খাতায় নাম তোলা দরকার। মোর্শেদ স্যারের ক্লাসের পরপর দুটো ক্লাস শেষ করে তারা তিন বান্ধবী লাইব্রেরীতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে তক্ষুণি সেই কাঙ্ক্ষিত স্যার ক্লাসরুমে প্রবেশ করে বড়ই সরল মুখে তাকালো সবার দিকে। সবার উত্তেজনার শেষ নেই। বিশেষ করে সুজানার বন্ধুদের। ছাত্রছাত্রীরা জানতে চাইলো

স্যার কেমন আছেন?

ক্লাসরুমের এ-ই কোণা ও’ই কোণা থেকে চোখ বুলানো শেষে উত্তর এল

আজ একটু বেশিই ভালো।

সুজানা খেল শান্তার কনুইয়ের গুঁতো।

বান্ধবী তোমাকে দেখে স্যার আজ একটু বেশিই ভালো। হুম হুম।

সুজানা উফ শব্দ করে বিড়বিড়িয়ে বলল

বেয়া*দব। ওসব কিচ্ছু না।

শান্তা আর মেহুল একসাথে ফিক করে হাসলো।

একজন ছাত্র মাঝ থেকে বলল

স্যার আজকে বেশিই ভালো কেন জানতে চাই।

অভিক টেবিলে হাতের ভর রেখে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে হাসলো।

আমরা পড়াই যাই।

স্যার রোজই তো পড়ি।

ভুরু উঁচিয়ে চাইলো অভিক। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এক হাতের তালুতে অন্য তালু ঘষতে ঘষতে বলল

তাহলে আজকে পানিশ চলুক।

সবাই একে-অপরের দিকে তাকালো । জানতে চাইলো,,,

স্যার কিসের পানিশ?

গতকাল যারা অনুপস্থিত ছিল।

হঠাৎ শান্তা বলে উঠলো।

স্যার স্যার সুজানা কালকে আসেনি।

বলেই নিজেই নিজের জিভে কামড় দিল। অভিক হেসে বলল

হুম, যারা গত ক্লাসে অনুপস্থিত ছিলেন তারা দাঁড়ান।

হুড়হুড় করে অনেকেই দাঁড়িয়ে গেল। অভিক গুনে গুনে দেখলো মোটমাট বিশজনের কাছাকাছি হবে। এত বড় একটা ক্লাসরুমে বিশজনের অনুপস্থিতি বিরাট ব্যাপার নয়।
নিখিল জানতে চাইলো

স্যার কি পানিশ দেবেন?

খুবই সিম্পল। গতকালকে যা পড়িয়েছি তা বলতে না পারলে ক্লাস শেষ হওয়া অব্দি দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

নিখিল ভাব দেখিয়ে বলল

ওহ সেসব আমার কাছে পান্তাভাত।

অভিক আঁড়চোখে দেখলো একজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়া মুখস্ত করার চেষ্টায় আছে পানিশের ভয়ে।
আহা মেয়েটা বুঝবে কখন অভিক ফারদিন তাকে একটা আঁচড়ও লাগাতে পারে না। একটু ভালো করে দেখার সুবিধার্থে দাঁড় করিয়ে রাখা । এর আর কি। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টদের এসব চট করে বুঝে ফেলার কথা।

দুই একজন কেন আসতে পারেনি তার বর্ণনা দিয়ে সহানুভূতি কামনা করে কোনোমতে বসে গেল। বাকিরা পড়া শিখছে।

অভিক এক-এক করে জিজ্ঞেস করে সুজানার পেছনের জনকে বলল

আপনার কি সমস্যা?

মেয়েটা আমতাআমতা করে বলল

স্যার কাল বেড়াতে গিয়েছিলাম বোনের শ্বশুরবাড়ি।

সামনেই পরীক্ষা। ক্লাস মিস দিলে চলবে? বসুন।

মেয়েটা খুশি হয়ে বসে গেল।

আপনার কি সমস্যা?

শান্তা হাতের উপর চিমটি বসাতেই সুজানা শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ালো। আঁজল চোখ তুলে চট করে নামিয়ে বলল

আমি?

হুম।

আমিও বেড়াতে গিয়েছিলাম।

কোথায় বেড়াতে গিয়েছিলেন?

এক হাতে অন্য হাতের আঙুল মোচড়াতে মোচড়াতে সুজানা ছোট্ট করে জবাব দিল

আপনি তো জানেন।

অভিক হেসে উঠে চলে গেল। শান্তা আর মেহুল হেসে উঠে বলল

মে মার গায়া। কিয়া পেয়ার হে ইয়ার!

সুজানা কনুইয়ের গুতো দিয়ে বলল

চুপ থাক বেডি। আমাকে তো বসতে বললো না। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকব নাকি?

দাঁড়িয়ে থাকো। তুমিও দেখো। তোমাকেও দেখুক। ক্ষতি কি?

সুজানা জোরে হাত খামচে দিয়ে বলল,

চুপ চুপ।

অভিক এলইডি স্ক্রীনের পাশে পড়াতে পড়াতে একসময় তাকালো মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকা সুজানার দিকে। বলল,

আপনি বসবেন ?

সুজানা মাথা নাড়লো। অভিকও তার মতো মাথা নাড়লো। যার অর্থ, বসে পড়ুন।

সুজানা বসার পর শান্তা গালে হাত দিয়ে ফিসফিস করে বলল

মাগোমা এসব কি চলতেছে মেহু?

মেহুল হেসে গাইলো,

সখী ভালোবাসা কারে কয়?

সুজানা বলল

তোরা আমার সাথে কথা বলবি না। বেয়া*দ*ব।

________________________

ঘড়ির কাঁটা বেলা আড়াইটাই পৌঁছেছে। সুজানা চুলের তোয়ালে খুলে চুল ঝাড়ার জন্য বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাজিয়া বেগম ভাত বেড়ে টেবিলে এনে মেয়েকে ডাক দিলেন।

কি রে আড়াইটা বেজে গেল। খাবি কখন?

যাচ্ছি আম্মা। তুমি খেয়েছ?

আমি আজ রোজা।

ওহ সরি ভুলে গিয়েছি।

আয় খেয়ে নে।

সুজানা মাথায় কাপড় টেনে খেতে বসলো। বলল

সায়েম খেয়েছে?

হ্যা। তোর ছোট খালাম্মা ওকে পাঠাতে বলেছে।

কেন?

কিছু নাকি পাঠানোর ছিল। তো ও ওদিকে চলে গেলে বাজারটা তো করা হবে না।

অফিস থেকে ফেরার পথে আমি কিনে আনব যা লাগবে।

পারবি বলছিস?

কেন পারব না আম্মা। তোমার ইফতারির জন্য আছে কিছু?

হ্যা ওসব আছে। দুটে কেকের অর্ডার এসেছে ওগুলোর জন্য ডিম লাগতো। বাকিসব আছে।

বাজারের সাথে ওসবও নিয়ে আসব।

আরও একটা কথা বলার ছিল।

সুজানা ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে বলল

কি?

মা ধীরেসুস্থে কথাটা পাড়লেন।

জমিগুলো বেঁচার কথা বলছে। তোর বড়মামা বাইরে কোথাও জমি বেঁচবে না বললো। বললো যে যা টাকা লাগে দেবে কিন্তু জমি বাইরে দেবে না।

সুজানা খাওয়া থামিয়ে দিল। পানি খেয়ে বলল

জমি বেঁচার কথা উঠছে কেন?

তোকে বিয়ে দেয়ার জন্য লাগবে। আমি অত কাঁচাপয়সা কোথায় পাব? আর জমি বেঁচার জন্য কোথায় ঘুরব একলা মেয়ে মানুষ।

তোমার বাপের জমি বেঁচা টাকায় আমি বিয়ে করব না আম্মা।

মা ধমকে বলে উঠলেন।

সুজানা।

সুজানা বলল

পরে সবাই হাঁটতে বসতে আমাকে বলবে যে আমি জমি বেঁচা টাকা দিয়ে জামাই নিয়েছি। আমার মন্দকথা শুনতে মন চায় না আম্মা।

তাই বলে কি বিয়ে করবি না?

আবার এক কথা।

আমি তোর মামাকে বলে দিয়েছি জমির নায্যমূল্য যাতে আমাকে দিয়ে দেয়। আমি ব্যাংকে ফেলে রাখব।

যা ইচ্ছা করো।

মা চিন্তিত বদনে তাকালো।

একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠান করতে গেলেও লাখ টাকা খরচা আছে। অত টাকা আমাকে কে দেবে? আমার টাকা আমাকে নিয়ে বিয়ে নামাতে হবে তারপর দেখা যাবে কে আমাকে উপহারসুত্রে কি দিচ্ছে। এত ভালো একটা পরিবারে বউ হয়ে যাবি ওদের কত বড়বড় আত্মীয় স্বজন আছে জানিস না। বিয়ের দিন ভালো আয়োজন করতে না পারলে আমার নিজের মুখ থাকবে?
এমনিতেই আশেপাশের মানুষ মজা দেখার জন্য বসে আছে। আমার কথার অবাধ্য হোস না সুজানা। আমি তোর মা। আমি তোর চাইতে ভালো বুঝি।

সুজানা চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে গেল নিজের ঘরে। ঘর থেকে বের হলো সাড়ে তিনটের দিকে। তখন মা খেয়াল করো দেখলো মেয়ের চোখমুখ ফোলা। ভাইবোন দুজনেই একসাথে বেরোলো বাড়ি থেকে। একজন খালার বাড়ির উদ্দেশ্য অন্যজন কাজের উদ্দেশ্য। সুজানা যাওয়ার সময় ভুলবশত তার ফোনটা বাড়িতে রেখে গিয়েছে।

***

তখন সবে সাতটা বেজেছে। মাগরিবের নামাজ শেষ করে ঢেকে রাখা বাকি ইফতারটুকু খেয়ে অজীফা পড়তে বসেছিলেন সাজিয়া বেগম। মেয়ের ঘরে ফোন বাজার শব্দে তিনি ছুটে গেলেন। হায়হায় মেয়েটা ফোনটা রেখে গিয়েছে আজকে। কে না কে ফোন করলো।

উনি ফোনের উপরে দেখতে পেলেন “A” লেটার দিয়ে সেভ করা। ফোনটা রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে ভরাট পুরুষালী গলা ভেসে এল।

হ্যালো! সুজানা।

না, আমি তো সুজানার মা বলছি।

আসসালামু আলাইকুম। সুজানা কি আজ অফিসে যায়নি?

ওয়ালাইকুমুস সালাম। গিয়েছে কিন্তু ফোনটা বাসায় ফেলে গিয়েছে। তুমি কে বাবা?

আমি?

অভিক নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে চুপ করে থাকলো। কিছুপরেই বলল

অন্য একদিন বলি?

আজ বললে খুব সমস্যা হবে?

না তা হবে না। কিন্তু সুজানা রাগ করতে পারে।

তার রাগের কথা আর বলো না। সে তো আজ রাগ করেই বেরিয়েছে। তোমার সাথেও কি রাগ দেখায় নাকি?

হুমম।

ওহহ। আচ্ছা তুমি ওর বন্ধু বোধহয়। তাই না?

অভিক উত্তর পেয়ে গেল। বলল,

হুমম।

কে? আহির, নিখিল নাকি জায়িন?

আমি সুজানার নতুন বন্ধু।

নতুন?

হুমম।

ওহ। কত বন্ধু হয় স্কুল কলেজে। তোমার মা বাবা ভালো আছে তো?

জ্বি। সবাই ভালো। সুজানার ছুটি মেবি সাড়ে সাতটায় হয়।

হ্যা, সাড়ে সাতটা কিংবা আটটা। আজ ওর ফিরতে দেরী হবে। তবে তোমার কথা আমি বলে দেব ও ফিরলে।

দেরী হবে কেন?

ও বাজারে যাবে তাই দেরী হবে।

আচ্ছা।

হ্যা। তুমি কেন ফোন করেছ বাবা? কোনো জরুরি?

না আমি প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সুজানাকে ফোন করি।

ওমা এ কেমন কথা?

সব কথার যুক্তি থাকা দরকার?

সাজিয়া বেগম হেসে ফেললেন।

দরকার তো।

অভিকও হাসলো। বলল

এনিওয়ে, সুজানা রাগ করেছে কেন আপনার সাথে?

আর বলো না বাবা। মেয়েকে বিয়ের কথা বললেই কেঁদেকেটে রাগটাগ করে একদম ভাসিয়ে দেবে। খুব জ্বালায় আমাকে। তোমার তো বন্ধু একটু বুঝিয়ে বলো। হ্যা?

আচ্ছা। মার দিতে হবে।

সাজিয়া বেগম হেসে ফেললেন। বললেন

হয়ত। আমি তো মারও দিতে পারি না। মার দিলে কলিজায় লাগে। সারাদিন কম খাটাখাটুনি তো করেনা। কি করে মারব? তুমি আর তোমার বাকিবন্ধুরা মিলে একটু বুঝিয়ে বলোতো। বিয়ে মানে বন্দীশালা নাকি? ও মনে করে বিয়ের পর ওকে কেউ জেলে আটকে রাখবে।

হুমম মেয়েটা আপনাকে ভীষণ জ্বালায় বুঝতে পারছি। যাইহোক আপনার সাথে কথা বলে ভীষণ ভালো লেগেছে।

আমারও ভালো লেগেছে ভীষণ। মাঝেমধ্যে ফোন করো। তোমার মাকে সালাম জানিও।

জানাবো। এবং মাঝেমধ্যে না। আপনি চাইলে রোজ করব। আমার কথা বলতে কখনো কষ্ট হয় না।

সাজিয়া বেগম আবারও হেসে ফেললেন। বললেন

দুষ্ট ছেলে।

অভিক ওপাশে হাসলো। ফোন রাখার আগে বলল

সুজানাকে বিয়ের জন্য রাজী করানোর দায়িত্ব আমার। ওসব নিয়ে আপনাকে একটুও ভাবতে হবে না।

অত সোজা নয়। মেয়েটা একদমই আমার কথা শুনতে চায় না।

কারণ সুজানা খুব ভালো।

ভালো ?

ভালোই তো। বিয়েতে না বলা মানেই তো ভালো।

আরেহ না বাবা। আমি চাই ও রাজী হোক। ওর একটা সাজানো-গোছানো সংসার হোক। কিন্তু ও বুঝেনা কিছুতেই। তোমরা বন্ধুরা আছ কেন? ও তোমাদের কথা শুনবে। একটু বুঝিয়ে বলো।

ঠিক আছে। বুঝিয়ে বলব।

আচ্ছা। আর বেড়াতে এসো। বাকিরা তো এসেছে তুমি বোধহয় একবারও আসোনি আমাদের এখানে।

হুম হুম অবশ্যই যাব। যেতেই হবে। রাতে আবারও ফোন দেব। ঠিক আছে? এখন রাখি।

আচ্ছা। ভালো থেকো।

ফোন রাখার পরে অভিক ঘড়িতে সময় দেখলো। বাড়ি থেকে বেরুনোর সময় সালমা বেগমের চোখে পড়লো ওকে।

হ্যা রে কোথায় যাচ্ছিস অভি?

বাজারে।

বাজার?

সবাই কেমন বিস্ময় নিয়ে তাকালো। আনিকা বলল,

এ সময় বাজার? তোকে ঠেললেও যাস না। আর আজ?

কাজ আছে তাই যাচ্ছি। তোমাদের কিছু লাগবে? লাগলে বলো। নাহলে যাচ্ছি।

সালমা বেগম বড় থলে নিয়ে আসলেন।

হ্যা লাগবে তো। নে কাঁচা বাজার নিয়ে আসিস কিছু।

অভিক থলেটা নিল না। বলল

ওখানে পাওয়া যায় । কাঁচা বাজার আর মাছ। ঠিক আছে?

সালমা বেগম মাথা নাড়ালেন। অভিক বেরিয়ে গেল। আনজুমা বেগম এসে বললেন

কি রে ছোট? ওকে কেন এসব করতে দিলি?

ওর বাপ জেঠা সারাজীবন বেঁচে থাকবে না বাজার করে করে খাওয়ানোর জন্য। পুরুষমানুষের সব করতে হয়। বাজার করাটাও একটা কাজ। কিছুদিন পরে ওর সংসার হবে। তখন ওকে সব করতে হবে।

আনিকা হেসে বলল

ওকে পঁচা আলু টমেটো সব থলের ভেতর ঢুকিয়ে দেবে দোকানদার।

আজকে ভুল করলে পরেরবার হবে না। আজকে দেখি কেমন বাজার করে আনে।

মমতাজ বেগম বললেন

ছোট বৌমা তুমি বোধহয় ভুলে গিয়েছ আমার দাদুভাই লন্ডনে অনেক বড় শেইপের কাছে রান্না শিখেছে। নিজে নিজে রান্না করে খেয়েছে। তখন ও বাজারও করেছে।

জানি মা। সেই বাজার আর এই বাজার আকাশ পাতাল তফাত। নাতির গান গাওয়া শুরু করলে তো আপনার শেষ হয় না। কই নাতির জন্য একটা ভালো মেয়ে তো যোগাড় করতে পারলেন না আজ অব্দি।

যে সংসার করবে সে নিজেই যোগাড় করে নেবে। আমাদের ওসব নিয়ে না ভাবলেও চলবে।

সে যোগাড় করে নেবে?

নেবে। হয়ত নিচ্ছে। সেটা কিন্তু ওই পঁচা আলু টমেটোর মতো হবে না। সেটা একদম খাঁটি সোনা।

সালমা বেগম চুপ হয়ে গেলেন। আনিকা বলল

দাদু আমাকে বলো প্লিজ। কে সে? তোমরা চেনো? ছোটমা আমরা কিছু জানিনা কেন?

সালমা বেগম চলে গেলেন মমতাজ বেগমের দিকে একপলক তাকিয়ে। আনিকা জোর করতেই মমতাজ বেগম হেসে বললেন

আমি কিছু বলতে পারব না। দাদুভাই ফিরলে তার কাছ থেকে জেনে নিও নাতবউ।

আনিকা কপালে হাত দিয়ে বলল

ও আল্লাহ! আজকে আসুক। কানটা একদম মলে দেব। আমার কাছ থেকে লুকোনো?

______________________

অফিস থেকে বের হয়ে বাজারে উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে সুজানা। মুখে মাক্স পড়া। ফোন না আনায় আজ বেশ ঝামেলায় পড়ে গিয়েছে। কি মাছ কিনবে কি সবজি কিনবে সে নিজেই জানে না। তবে আন্দাজ করে সে কিনে নিয়ে যাবে। কারণ সে বাজার নিয়ে গেলে মা রান্না বসাবে। আজ মা রোজা রাখায় দিনে রান্না করেনি।

বাজারের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সুজানার মনে হলো সেই দিনের কুকুরটার ছায়া তার পিছু ধরেছে। সড়ক বাতি আলোর হাঁটতে হাঁটতে গায়ে ভয় জমে গিয়েছে। দোয়া-দরূদ পড়ে ছুটতে ছুটতে একসময় মনে হলো ছায়াটা আরও বিশাল । প্রাণপণে কোনোমতে বাজারের কাছাকাছি আসতেই ভয় কেটে গেল। অসংখ্য মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যেতে তার সময় লাগলো না খুব বেশি। বাজারের ভেতর গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সবজির দোকানে গেল। আলু টমেটো দেখে কেনার সময় টমেটো চেক করে বলল

এগুলো দিয়েন না।

এগুলা সকালে আনছি আপা। তরতাজা একদম।

না টমেটোগুলো নরম দেখাচ্ছে। থাকলে ভালো থেকে দিন। নাহলে দিয়েন না।

দোকানদার ভালো থেকে দিল। সুজানা থলেতে ভরে নিয়ে টাকা দেয়ার জন্য ব্যাগে হাত দিতেই পাশ থেকে একজন বলে উঠলো

ম্যাডামকে যেমনটা দিয়েছেন আমাকেও তেমনটা দেবেন।

সুজানা টাকা গুনতে গিয়ে চমকে উঠলো। এত এত মানুষের ভীড়ে ঠিকই চিনতে সক্ষম হলো পরিচিত গলার স্বর । পাশ ফিরতেই মাক্স পরিহিত ছেলেটিকে দেখলো বাজারের থলেতে সবজি নিচ্ছে। সুজানা চোখ বড় বড় করে তাকালো। অভিক থলের মধ্যে চোখ ঢুকিয়ে সবজি গুলো দেখে সুজানার দিকে তাকালো। সেই চিরাচরিত ভুরু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো সুজানাকে।

কি?

সুজানাও জানতে চাইলো।

আপনি এখানে?

কেন আমার এখানে আসা বারণ?

সুজানা মাথা নেড়ে বলল
,
না। কিন্তু…

আপনি রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন?

আপনাকে কে বললো?

আপনার মা।

সুজানা আরও বড় বড় করে চোখ পাকিয়ে চাইলো।

আপনি কি করে জানলেন?

আমি আপনার খোঁজ রাখি।

সুজানা ঘুরে হাঁটা শুরু করলো। বলল

আপনি নিশ্চয়ই ফোন দিয়েছেন।

অভিক তার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে বলল

ফোন দিয়েছি। কথা বলেছি। এন্ড আপনাকে বিয়েতে রাজী করানোর পারমিশন নিয়েছি।

সুজানা চট করে ঘাড় ফিরিয়ে চাইলো।

বিয়ে?

অভিক তার নিজের মাক্স টেনে নামালো। সুজানার মাক্সও। আশেপাশে তাকিয়ে বলল

ইয়েস।

সুজানার মুখ থমথমে হয়ে এল।

অভিক হেসে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল

প্রশ্নের উত্তর দিলে পাত্র চেঞ্জ হতে পারে। আরও একবার না হয় দেখা হোক সেগুনবাগিচায়?

সুজানা নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইলো। অভিক ততক্ষণে তার হাত থেকে বাজারের থলে কেড়ে নিয়ে হাঁটা ধরলো মাছের বাজারের দিকে।
আজ তার খুশির দিন।

চলবে….