আমায় রেখো প্রিয় প্রহরে পর্ব-৩৪+৩৫

0
459

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৩৪
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

ধীরপায়ে হেঁটে সুজানা অভিকের পিছু পিছু গেল। লোকটা থলে দুটো নিয়ে ওদিকে কোথায় চলে যাচ্ছে। সুজানাকে জ্বালানাের জন্য যেখানে সেখানে হাজির হবে।

সুজানা বেশ কিছুদূর গিয়ে তাকে ডেকে থামাতে চাইলো। কি বলে ডাক দেবে বুঝে পেল না। তাই কিছু ডাকলো না। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল অভিকের কাছে। অভিক ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখে বলল

আপনি মাছ কিনতে পারেন?

পারব না কেন?

ওহ হ্যা আপনি তো সবই পারেন। কি পারেন না সেটা বলেন।

সুজানা কপাল ভাঁজ করে বলল

আমার থলে দিন। ওটা নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?

মাছের বাজারে যাচ্ছি।

কেন?

মাছের বাজারে মানুষ ঘুমাতে যায়?

সুজানার কপালে আরও ভাঁজ পড়লো। থলে কেড়ে নিতে চেয়ে বলল

দেরী হলে আম্মা বকবে। আপনি আপনার বাজার করুন। আমাকে আমার থলে দিন।

অভিক থলেটা বাড়িয়ে দিল। সুজানা থলে নিয়ে উল্টোপথে পা বাড়ালো। অভিক হেসে ডাক দিল। বলল,

থলে বদল হয়ে গিয়েছে সু-জা-না।

সুজানা চট করে ফিরে চাইলো। নিজের হাতের থলেটা দেখে বলল,

আপনি সবসময় এমন করেন কেন?

অভিক হাসলো আবারও। বলল

আপনি আমাকে ফেলে যাচ্ছেন কেন? ওটা তো ভুলই, ওই ভুল করতে গিয়ে থলে বদলের মতো ভুল করে ফেলেছেন।

আমার থলে দিন।

আমার থলে দিলেই দেব।

সুজানা ওর কাছাকাছি গিয়ে থলেটা বাড়িয়ে দিল। বলল

আমার থলে।

অভিক ওর হাত থেকে চট করে থলেটা কেড়ে নিয়ে বলল

সবাই দেখছে। চুপচাপ আমার সাথে চলুন। আপনাকে মাছ কেনা শেখাবো। ফিউচারে কাজে লাগতে পারে।

সুজানা বলে উঠলো

অ্যাহ আমি মাছ কিনতে জানি।

তাই নাকি? তাহলে তো আরও ভালো। আপনি আমাকে শেখাবেন। শিখিয়ে পড়িয়ে নেয়ার দায়িত্ব তো আপনার।

সুজানা বিড়বিড়িয়ে বলল

কচু।

অভিক শুনে বলল

পটিয়ার মেয়েদের এই এক স্বভাব। কথায় কথায় কচু।

সুজানা বলল

থলেটা কি দেবেন?

আপনি কি আমার সাথে যাবেন? আসুন। আর বলব না কিন্তু।

অভিকের পিছু পিছু গেল সুজানা। মাছের বাজার আগের চাইতে খানিকটা হালকা হয়েছে। দুজনেই মাক্স টেনে নামালো নাকে। এত হৈ হৈ আওয়াজে মাথা ধরে যাচ্ছে সুজানার। অভিক ঘাড় ঘুরিয়ে সুজানাকে আরেকবার দেখে নিল। চার পাঁচ দোকান দেখার পর বড় লাল লাল নাইলোটিকা মাছ দেখার পর অভিক বলল

ওগুলো কিনব। আসুন।

সুজানা তার পিছু পিছু গেল। অভিক মাছগুলো নেড়েচেড়ে নিতে গেল। সুজানা বলল

ওগুলো তো মরা মাছ। এত তাজা মাছ থাকতে এগুলো কেন নিচ্ছেন?

মা এসব পছন্দ করে।

তাই বলে মরা মাছ?

মাক্স থাকায় সুজানার হাসি দেখা গেল না। তবে চোখদুটো তো হাসলো। অভিক মুখ গোমড়া করলো। সুজানা বলল

আমি কিছু জানিনা। আপনার ইচ্ছে । পাশের রুইমাছগুলো দেখতে পারেন। ওগুলো ঠিক আছে।

দোকানদার বলল

ভাবি ভাইজান ভালা মাছ পছন্দ করছে। এক্কেবারে খাঁটি। লইয়্যা যান। ঠকবেন না।

অভিক নিচু হয়ে পাশের রুইমাছ গুলো দেখতে দেখতে বলল

এখান থেকে দু কেজি দিন। ভালো হলে পরের বার থেকে আপনার কাছ থেকেই মাছ কিনবো। মাছ না চিনলেও খাঁটি মানুষ আমি চিনি।

দোকানদার ফোকলা হেসে দাঁড়িপাল্লা হাতে নিল। বলল

ভাইজান দেখি ভাবির কথার পাত্তা দেয়। আমারও আমার বেডির কথামতো চলতে হয়। নাইলে তো আমার ভাত আমি খাইতে পারুম না।

অভিক হেসে ফেলল।

হোয়াট ইজ বেডি টেডি? ভালোবেসে বেডি ডাকেন নাকি?

সুজানা খলখলিয়ে করে হেসে উঠলো। সাথে অভিকও। দোকানদার তাদের চাইতেও জোরে হেসে উঠলো।

____________________

মাছ কেনা শেষে ওরা দু’জন বেরিয়ে এল। সুজানা বলল

আপনি দু থলেতে মাছ নিয়েছেন কেন? আম্মা সামুদ্রিক মাছ খেতে পছন্দ করে।

দাদু আর জেম্মাও সামুদ্রিক মাছ খায়। কেনা যায়।

আম্মা জানতে চাইবে সবটা।

আমি বলে দেব। আপনার আম্মার সাথে আমর ভাবসাব একটু বেশিই।

সুজানা ভুরু কুঁঞ্চন করে বলল

কিভাবে?

খবরদার! ওখানে পঁচা নাকটা গলাতে যাবেন না। ওটা আমার আর উনার ব্যাপার।

সুজানা মৃদু হাসলো। মাছের দোকান দেখতে দেখতে বলল

ওই-দূরে তাজা লইট্যা মাছ দেখা যাচ্ছে। ওগুলো ভালো হবে।

অভিক সেইদিকে চোখ তাক করে বলল

পটিয়ার মেয়ে শেষমেশ লটিয়া খুঁজে পেল। সাবাশ পটিয়া!

সুজানা নাকফুলিয়ে তাকালো কিন্তু সেসব দেখে কে? সে তো সুজানাকে একটু পঁচাতে পারলেই হলো।

অভিক মাছ কিনে নিয়ে এল। থলের মুখ খুলে সুজানাকে দেখিয়ে বলল,

দু থলেতে দুইকেজি নিয়েছি।

আম্মা ফ্রিজে রেখে খেতে পছন্দ করেনা। আধাকেজি তিনজনের জন্য যথেষ্ট।

না না পটিয়ার মেয়েদের লটিয়া বেশি বেশি করে খেতে হবে।

সুজানা থলে দুটো কেড়ে নিয়ে যেতে যেতে বলল

ধ্যাত।

অভিক ডেকে বলল

সুজানা আপনি যান। আমি এখনি আসছি।

সুজানা ঘাড় ফিরিয়ে বলল

কেন? কোথায় যাচ্ছেন?

মাছওয়ালাকে একটা থ্যাংকস দেয়া হয়নি। উনাকে কি বলব উনার ভাবিজানও উনাকে একটা থ্যাংকস দিয়েছে?

সুজানা আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না। লজ্জা তো দেয় তারউপর ফাইজলামি!

____________

অভিক ফিরে এসে দেখলো সুজানা দু-থলের ভর্তি করে ফেলেছে। মাছের টোকলা গুলো কাঁচা তরকারির উপর রেখে পিছু ফিরতেই অভিককে দেখলো। অভিক বলল

কি হচ্ছে এসব?

কিছু হচ্ছে না।

অভিক থলে দেখে বলল,

শোধ করে দেয়া হচ্ছে?

আপনিও কিছুর শোধ দিয়েছেন?

সেটা কেন হবে? আমি কিনে দিতে পারি না?

আমিও তো পারি।

আপনি কামাই করেন না।

সুজানা তাকাতেই অভিক হাসলো।

ওহ সরি আপনিও তো কামাই করেন।

হুম। কম হোক। করি তো। আপনার মাছ কিনে দেয়ার সামর্থ্য থাকলে আমার সবজি কিনে দেয়ার সামর্থ্য আছে।

অভিক মাথা দুলিয়ে বলল

তথাস্তু।

সুজানা হাসলো। অভিক বলল

মাছওয়ালা বলেছে…

সুজানা দ্রুত পা বাড়িয়ে বলল

আমি শুনতে চাই না।

অভিক তার পেছন পেছন পা বাড়িয়ে বলল

না না শুনতে হবে।

না, আমি শুনব না।

না শোনা জরুরি সু–জা–না।

তন্মধ্যে অভিকের ফোন বেজে উঠলো। সে ফোন তুলে বলল

আপনার আম্মা ফোন করেছে।

সুজানা থমকে দাঁড়ালো। অভিক কানে ফোন ধরতেই সাজিয়া বেগম ওপাশ থেকে বললেন

হ্যালো আমি সুজানার আম্মা বলছি।

হ্যা চিনতে পেরেছি। নাম্বার তো সেভ করেই রেখেছি।

আজ তো বাজার। তুমি বাজারে যাওনি? তুমি ষোলশহরে থাকো না?

আমি ষোলশহরেই থাকি। সরিষাবাড়ি সেখানকার রাজধানী।

সুজানা চোখ পাকিয়ে চাইলো। সাজিয়া বেগম ওপাশে হেসে উঠে বললেন

পাজি ছেলে।

অভিক হাসলো।

তুমি কি আজ বাজারে যাওনি বাবা?

অলরেডি।

বলছিলাম যে সুজানাও তো বাজারে গেল। তুমি যদি একটু দেখতে। অন্য দিন ফোন থাকে তাই চিন্তা হয় না। আজ তো ফোনও নিয়ে যায়নি। তারউপর দেরী হচ্ছে।

সুজানা তো আমার পাশেই আছে।

যাহ মজা করে না। টেনশন হচ্ছে তাই তোমাকে ফোন করলাম।

আরেহ মজা করব কেন? সুজানার সাথে কথা বলুন।

সুজানার দিকে ফোন বাড়িয়ে দিতেই সুজানা ফোনটা কানে দিল।

হ্যালো আম্মা আমি পৌঁছে যাব কিছুক্ষণের মধ্যে।

আল্লাহ কি টেনশন হচ্ছিল আমার। তোর বন্ধুটার নাম ও তো জানা হলো না। কি নাম যেন? খুব ভালো ছেলে।

অভিক চট করে ফোন কেড়ে নিল। মিউট করে বলল

একটা নাম বলেন। সত্যিটা বলা যাবে না। কুইক। কি নাম বলব?

সুজানা মজা করে বলল

করিম।

অভিক আনমিউট করে বলল

আমার নাম করিম। করিম বলে ডাকবেন।

বলা শেষে সুজানার দিকে চোখ লাল করে তাকালো। সুজানা খিকখিক হেসে উঠলো।

সাজিয়া বেগম ওপাশ থেকে বললেন

অনেক সুন্দর নাম। করিমুউল্লাহ আমার আব্বার নাম।

সুজানা ফিক করে হেসে বলল

স্যার থেকে ডিরেক্ট নানাজান! বাহ বাহ!

অভিক গালফুলিয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। বলল,

অভিক করিম হলে সুজানা জরিনা।

অতঃপর দুজনেই একসাথে হেসে উঠলো।

______________

বাজার শেষ করে গাড়িতে চলে এল তারা। সুজানাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অভিক বলল

আপনি কিছু খাবেন?

না সোজা বাসায় যাব।

ঠান্ডা?

না। মাছ ধরেছি। হাতে গন্ধ।

ওকে।

অভিক গাড়ি ছেড়ে দিল। পনের মিনিটের পথ ফুরিয়ে গেল এক নিমেষেই। সেই পনের মিনিটে তাদের মধ্যে পনের দু গুনে ত্রিশ মিনিটের গল্প সেড়ে ফেলা হয়েছে। তাদের গল্পগুলোতে ভালোবাসারা থাকে না কভু।
কিন্তু ভালোবাসা মানেই তো কথা বলতে বলতে হেসে উঠা। একে অপরের হাসিমাখা মুখ আড়ালে পরখ করে না দেখার ভান ধরা।

সরিষাবাড়ির সামনেই সুজানা নেমে গেল। থলে নিয়ে দাঁড়িয়ে বলল

আসি। আপনি গাড়িটা ধুঁয়ে নেবেন। মাছের পানি পড়েছে মনে হচ্ছে।

ঠিক আছে। ওহ আরেকটা কথা, মাছওয়ালা কি বলেছে শুনবেন না?

সুজানা বলল

ইনননা।

সে চলে যেতে উদ্যত হতেই অভিক ডেকে বলল

সু-জা-না।

সুজানা ফিরে তাকালো। অভিক গাড়ির জানালায় হাত ঠেকিয়ে ভাবুক হয়ে বলল

সুজানা আপনার পাঁচ টাকার পাশে আমার পঞ্চাশ টাকার জায়গা হলে বাজারে ক্রেতা ঘাটতি পূরণ হবে। আপনি নাইলেটিকাকে টা টা বলে দিন। লটিয়া মাছ আর রুইমাছ ভালো বন্ধু হতে পারে।

সুজানা হাসলো। আবছা অন্ধকারে মিলিয়ে মিলিয়ে যেতে যেতে উত্তর দিল।

হোক।

_____________________

অভিককে থলেভর্তি বাজার নিয়ে ঘরে ফিরতে দেখে সবাই ছুটে এল। আনিকা বলল

সত্যি সত্যি বাজার এনেছিস? এত কি এনেছিস?

অনেককিছু।

সালমা বেগম খুশি হলেন। শাড়ির আঁচল টেনে ছেলের কপাল মুছে দিয়ে বললেন

ওমা এটুকুত ঘেমে গিয়েছিস অভি। এগুলো তো কোনো কষ্ট না বাবা।

অভিক বলল

কখন বলেছি কষ্ট হয়েছে। গরম পড়ছে। ঘেমে যাব না? কি বলো মা?

সালমা বেগম বাজার থলে নিয়ে যেতে চাইলো। অভিক বাঁধা দিয়ে বলল

অনেক ভার। আমি দিয়ে আসছি।

সালমা বেগম ছেলের পিছু পিছু ছুটলেন। মনে মনে আওড়ালেন

সব বাজার যেন ভালো পড়ে। নাকি থলে ভর্তি পঁচা আলু টমেটো নিয়ে এসেছে কে জানে?

অভিক বড় থালায় সব ঢেলেও দিল। বেসিনে হাত ধুঁতে ধুঁতে বলল

সব ঠিকঠাক?

ওমা কি সুন্দর গুছিয়ে বাজার করেছিস অভি? যাক তোর বাবাকে আজ আর বাজার আনতে হবে না। তুই তো সব ভালো ভালো পারিস।

এসব সুজানাই কিনেছে মা।

সালমা বেগম চমকে গেলেন? হা করে তাকিয়ে বলল

সু–জা–না। ওখানেও সুজানা?

অভিক বাচ্চাদের মতো স্বীকার করলো।

হুমমম। সবখানেই সুজানা।

একটা কথা বলতো ওই মেয়ে তোকে জ্বালাচ্ছে? নাকি তুই ওকে জ্বালাচ্ছিস?

অভিক ভেজা হাত মায়ের গালে লাগিয়ে বলল

সেটা বড় কথা নয়। আজ লটিয়া আর রুই একসাথে খাওয়া হবে। সেটাই বড় কথা।

সে দরজার দিকে পা বাড়াতেই সালমা বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের ভেজা গাল মুছতে মুছতে বললেন

লইট্যা মাছ বলে অভি। কি লটিয়া লটিয়া বলিস?

অভিক হেসে উঠে বলল

লটিয়া পটিয়ার ভাইরাস মা।

চলবে…….

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৩৫
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

ক’দিনের বাজার করে আনলি আজকে?

সুজানা কপালের পাশে চুল গুঁজতে গুঁজতে উত্তর দিল

যতদিন খেতে পারো।

রুইমাছ কত নিল? টাকা আর ফেরত আসেনি?

রুইমাছ তোমার ওই করিম আব্বাজান কিনে দিয়েছে। তুমি নাকি বাপ ডেকেছ তাই। আমি তাই অল্পস্বল্প সবজি কিনে দিয়েছি। কিছু না দিলে কেমন দেখায় না।

হায় হায় কি বলিস! ছেলেটা দিল আর তুই নিয়ে নিলি?

সুজানা হাসলো। বলল

তুমি বাপ ডেকেছ তাই দিয়েছে আমি অতকিছু জানিনা।

আহা ছেলেটা কি কামাই করে? কেন অত টাকা খরচা করলো শুধু শুধু।

মোটা টাকা কামাই করে আম্মা। এক জায়গা না দু তিন জায়গা থেকে।

ধুরর মজা করিস না। পড়ালেখা করছে অত টাকা কোথা থেকে কামাবে?

সুজানা হেসে ওয়াশরুমে চলে গেল হাত-মুখ ধুঁতে। আম্মার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে দেখা যাবে সত্যিটা সে বলে ফেলছে। সত্যি বলা যাবে না। করিম সাহেব কখন না জানি রেগে বলে বসে জরিনা আপনি মস্তবড় অপরাধ করেছেন সেই সুবাধে সেগুন-বাগিচায় আসুন। সুজানা তো ওখানে ভুলেও কভু যাবে না। একবার গিয়ে যা ধরা খেল।

__________________

ফ্রেশ হয়ে নীচে আসতেই অভিক বাবাকে দেখলো। উনি বাড়িতে প্রবেশ করেই ছেলেকে দেখে বললেন

তুমি তো ফাটিয়ে দিয়েছ অভি। তোমার মা ফোনে ছেলের এমন প্রশংসা করছে আমি না এসে থাকতে পারলাম না।

অভিক হাসলো। টি টেবিলে রাখা জগ গ্লাস হাতে নিয়ে পানি ঢালতে ঢালতে বলল

মায়েদের প্রথম কাজ এটাই।

কিন্তু আমার একটা কনফিউশান মাই সান।

বলে ফেলো।

তুমি আজ হঠাৎ বাজারে কেন গিয়েছ?

ইচ্ছে হলো তাই।

ইচ্ছেটা দারুণ। গুড জব।

থ্যাংকস বাবা।

ছেলের পিঠ চাপড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলেন আজীম সাহেব।

অভিক দাদুর পাশে সোফায় গা এলিয়ে বসলো। উনি নাতিকে দেখে ছেলে বউকে ডাক দিয়ে বললেন

ছোট বৌমা আমার ভাইকে কিছু খেতে দাও। কত কস্ট করে বাজার করে আনলো।

বলেই বৃদ্ধা হাসলেন। অভিকও হাসলো। ভুরু কুঁচকে বৃদ্ধার চুলে বিচরণ করে বলল

সাদা দেখা যাচ্ছে কয়েকটা।

মেহেদী লাগিয়ে নেব ভাই। আজ তো রোজায় ছিলাম। তাই দেয়নি।

গুড।

মর্জিনা চা কপি নিয়ে আসলো। টি টেবিলে রাখতে রাখতে বলল

চায়ের লগে কফি বানানোটা আমার বহুত ঝামেলা লাগে বাবু। বউ কখন আনবা? তোমার বউ আইলে কফি বানোনটা তার উপর চাপায় দিমু।

অভিক কফির মগে হাতে তুলে চুমুক বসিয়ে বলল

কফি তো মা বানিয়েছে।

মর্জিনা চোখ কপালে তুলে চাইলো।

ত-ত-তো কিতা হয়ছে? সব তো আমি যোগাড় কইরা দিছি। শুধু দুধ ঢালি নাড়া ছাড়া কিছু করেনাই আপনার মা।

সালমা বেগম নাশতা নিয়ে হাজির হলেন। বললেন

হ্যা সব কাজ তুমিই করো। আমরা সবাই বসে বসে খাই। মা নাশতা খেতে পারেন । ইফতার তো অল্প খেলেন। অভি খেয়ে নে।

সালমা বেগম চলেই যাচ্ছিলেন। অভিক ডেকে বলল

মা!

সালমা বেগম ফিরে চাইলেন। অভিক মগ দেখিয়ে বলল

লাভ।

বউ আন আগে। তারপর লাভ ডাভ বলিস। এসব বলে আমাকে খুশি করাতে পারবি না অভি।

অভিক হেসে উঠলো। বৃদ্ধা ও যোগ দিলেন। হাসতে হাসতে বললেন

মা ঠিকই বলেছে ভাই। বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে। কবে বিয়ে করবে?

কে জানে?
যখন ছোট ছিলাম তখন মা বলতো অভি পড় পড়। যখন একটু বড় হলাম বাবা বলতো অভি এব্রোড স্টাডি । যখন এব্রোডে গেলাম ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার। আর যখন ক্যারিয়ারের ঝামেলা চুকলো এখন আবার বউ বউ বিয়ে বিয়ে। মনে হচ্ছে অন্যসব ঝামেলা থেকে এটার ঝামেলা বেশি। মানে বিয়ে যাকে করব তাকে তো থাকতে হবে নাকি?

কি বলো দাদুভাই? সে নেই?

অভিক ফিসফিস করে বলল

আছে আছে। ঘুমাচ্ছে। জাগিয়ে তুলতে হবে।

সে আর কখন দাদুভাই? কবরে যাওয়ার আগে তার মুখখানা দেখে যেতে চায়।

ভাববার বিষয়। বলছি যে বিয়ের পর আবার কি নিয়ে সবাই ঘ্যানঘ্যানানি শুরু করবে? প্রস্তুত থাকতাম এই আর কি?

বৃদ্ধা হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন

বিয়ের পর সবাই বলবে বাচ্চা নাও বাচ্চা নাও।

ও মাই আল্লাহ! ডেঞ্জারাস ব্যাপার স্যাপার। এটা তো রীতিমতো একটা আতঙ্কের বিষয়। এখন আমাকে ফেস করতে হচ্ছে তখন জরিনাকেও ফেস করতে হবে।

বৃদ্ধা হাসার জন্য কথা বলতে পারলেন না। শাড়ির আঁচলে চোখ চেপে বললেন

জরিনাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না দাদুভাই। আগে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দাও।

আমার সাথেই তো পরিচিত হয়নি।

কি বলো?

হুমম।

যাহ বিশ্বাস হচ্ছে না।

পরিচিত হয়নি ওইভাবে। কারণ সেগুন বাগিচায় আর দেখা হয়নি। অন্যভাবে পরিচিত হওয়ার একটা ব্যাপার স্যাপার তো আছে নাকি।

আচ্ছা! বুঝেছি। তার নামটা যদি একটু বলে দিতে।

জরিনা।

আসল নামটা বলো দাদু ভাই। নাকি আমি বলব?

অভিক মৃদু হাসলো। বৃদ্ধাও হাসলো। বললো, আমি ইন্ডিয়া থেকে আসার প্রথম দিন বুঝেছিলাম আমার ভাই ফেঁসে গিয়েছে।

হাহ এটা মোটেও খুশির খবর নয়। এটা খুব যাতনার বিষয়।

আহারে! আমার তাকে দেখার খুব ইচ্ছে জেগেছে। কোনো কারণ দেখিয়ে নিয়ে আসতে পারো কিনা দেখো তো। এবার নাতবউ হিসেবে একটু মনভরে দেখব। আহ দেখলেই কলিজা জুড়িয়ে যায়।

কার?

আমার। সাথে অন্য কারো কিছু জুড়িয়ে গেলে আমার কি করার?

অভিক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কবে যে একটু বড়সড় হবে সুজানা। ধরে ধরে পড়া শেখাতে ভালো লাগে। প্রেম নয়।

কিছুক্ষণের মধ্যে আজীম সাহেবও যোগ দিলেন সেখানে। বাচ্চারাও চলে এল টিচার চলে যাওয়ায়। অভিকের কোলে গিয়ে উঠলো একজন। অন্যজন অভিকের পিঠের পেছনে। পিঠ কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল

অভি অভি চা খাইচো?

অভিক হেসে টুপটাপ আদর বসিয়ে বলল

ইয়েসসস। আপনাদের চা আসছে।

অনা গলা জড়িয়ে ধরে বলল

অভি অভি সুজান কেক খাবো।

সুজানের পরীক্ষা সামনে। এখন ডিস্টার্ব করা যাবে না।

বৃদ্ধা বললেন

এটা কিসের পরীক্ষা ভাই?

ফাইনাল।

আজীম সাহেব বললেন

ফাইনাল? তারমানে সুজানা ফাইনাল ইয়ারে যাচ্ছে। আশিকের কি ওরজন্য আরও একটা বছর অপেক্ষা করতে হবে?

অভিক নির্মল চোখে তাকালো। বৃদ্ধা হালকা ধমকে
বললেন

বাবা হয়ে মশকরা করছিস ছোট খোকা?

সালমা বেগম এসে সামনে চায়ের ট্রে রাখতেই উনি বেশ গম্ভীরমুখে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিলেন। অভিককে লক্ষ্য করে বললেন,

তোমার উচিত একটা দিনও অপেক্ষা না করা।

সালমা বেগম কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন। আজীম সাহেব বলে উঠলেন

যদি না সুজানার অমত না থাকে।

সালমা বেগম বললেন

অমত? অমত থাকবে কেন? আমার ছেলে কি ফেলনা? সুজানার অত স্পর্ধা হয়নি যে আমার ছেলেকে ফেরাবে।

আস্তে বলো সালমা। বড় আপাদের কানে গেলে কি হবে?

কি আর হবে?

কি হবে না সেটা বলো।

অভিক উঠে গেল।

বৃদ্ধা বললেন,

দিলি তো ভাইটার মন খারাপ করে।

আজীম সাহেবে ছেলেকে ডেকে বললেন,

অভি মন খারাপ হয়েছে?

অভিক যেতে যেতে মাথা দুলালো এপাশ-ওপাশ।

সালমা বেগম বললেন

অভি দাঁড়া। কথা আছে।

পেছনে ফিরে বললেন

সুজানা যদি “না” বলে ওকে আমি ছাড়ব না কিন্তু।

অভিক ঘরের দরজা বন্ধ করে ল্যাপটপ খুলে বসলো। সালমা বেগম ধুপধাপ দরজা ধাক্কা দিয়ে বলল

অভি অভি দরজা খোল। তুই এরকম করলে আমার ভালো লাগেনা বাবা। অভি?

অভিক সাথে সাথেই দরজা খুললো। বলল,

কাজ আছে মা। নাথিং সিরিয়াস।

তুই তোর বাবার কথায় কষ্ট পেয়েছিস? সত্যিই তো বলেছে কেন তুই সুজানাকে কিছু বলছিস না। আমাদেরও বলতে দিচ্ছিস না।

মা আমার কারো সাথে কম্পিটিশন করতে ভালো লাগে না। তাও নিজের একান্ত ব্যাপার স্যাপার নিয়ে। বিষয়টা এতটাও হালকা না যে যাকে আমি পছন্দ করলাম তার অন্য দিকে ঝোঁক আছে। তার ঝোঁক-রোগ সব আমাকে ঘিরে। আমি এটাই বিশ্বাস করি।

সালমা বেগম হাসলেন ঠোঁট ছড়িয়ে। বললেন,

তাহলে, সুজানার মাকে আমি বলি?

বলা হয়ে যাবে মা।

কবে অভি?

সুজানার পরীক্ষার পর। পরীক্ষাটা শেষ হোক। আমি চাই না সুজানার সবকিছুতে আমার প্রভাব পড়ুক। সবার নিজের একান্ত একটা পৃথিবী থাকা উচিত যেখানে নিজের ইচ্ছের মূল্য আছে। সুজানা এখন পড়াশোনা আর ফ্যামিলি নিয়ে লড়াই করছে। আমার উচিত পেছন থেকে তাকে সাপোর্ট করা। যে হবে সে একযুগ পর হলেও আমার কাছে আসবে। সবশেষে আমি সুজানাকে হ্যাপী দেখতে চাই। দ্যাটস ইট।

তুই আমার সোনা ছেলে। সুজানা নিজেই জানেনা ও কতটা ভাগ্যবতী।

এবার বলো বাপের মতো হয়েছি।

সালমা বেগম লজ্জামুখে হাসলেন। বললেন,

হুহ, একদম বাপের মতো।

আমিও বাবার মতো হতে চাই মা। যাতে সুজানাও একদিন এই হাসিটা হাসতে পারে।

পাঁচ আঙুলের মাথায় চুমু খেয়ে ছেলের মুখে ছুঁয়ে দিয়ে উনি বললেন,

তুই ভালো থাক সোনা। তোর একটা সোনার সংসার হোক।

অভিক হাসলো।

কিছুদিন পূর্বেই যে স্বপ্নটা দেখেছিল অভিক। সেগুন বাগিচার পাশেই লালদিঘিটা। সেই লালদিঘিতে সোনার নৌকা আর রূপোর বৈঠায় করে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে সে আর সুজানা। এটা তো সুজানাকে বলা হয়নি।
সোনার নৌকা আর রূপোর বৈঠা না হোক ছোটখাটো ছইয়ের নৌকো আর সেগুন কাঠের বৈঠা না হয় তাদের প্রিয় প্রহরের স্বাক্ষী হয়ে থাকবে। ক্ষতি কি?

অতঃপর…
সুজানার পরীক্ষা শেষ হতে হতে তিনটা মাস লেগে গেল !!!!

বাকি গল্পটা সেই তিনটা মাস পর।

চলবে………