আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব-২৩+২৪

0
5

#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_তেইশ



-‘ভাই মুখে যাইই বলি আমার খুব টেনশন হচ্ছে। ডাক্তার দেখানোর কথা শুনলে কুহু হাঙামা শুরু করবে। আমি বোনকে ভয় পাই না। ভয় পাই ওর জেদকে। ‘
-‘আমিও কোনো দায়িত্ব নিলে সেই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে না সারা অবধি শান্ত থাকতে পারি না। টেনশন করে লাভ নেই। নিজেকে শক্ত কর। কুহুর জন্য যতটুকু করার দরকার। আমরা সবটুকু করব।’
-‘এখন তুইই আমার একমাত্র ভরসা। পাশে থাকিস ভাই।’
-‘ইনশাআল্লাহ!’
এরপর দুই বন্ধু আরো কিছুক্ষণ কথা বলে কল কাটল। রুপক সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে একা একা কত কিছু ভাবল। তারপর মনে মনে ঠিক করল যত কিছুই হয়ে যাক সে আর পিছনে ফিরে তাকাবে না। বোনকে নিয়ে যাবেই সে। প্রয়োজনে নিজে আরো শক্ত হবে। শক্ত হয়ে শক্ত হাতে বোনকে সামাল দেবে। এভাবে আর বসে থাকা যাচ্ছে না। বসে থাকাটাও ঠিক হচ্ছে না। কারণ কুহুর সমস্যাটা দিন দিন জটিল রুপ ধারণ করছে।
বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, সে সারাদিনে কি করে না করে রাতের বেলা মনে করে বলতে পারে না। আত্মীয় কিংবা চেনা মানুষদের চিনতে পারে না। ছোটোবেলার স্মৃতি মনে করতে পারে না। প্রয়োজনীয় জিনিস কোথায় রাখে না রাখে পরক্ষণেই ভুলে যায়। কখনো কখনো এমনও হয় কলেজ থেকে ফেরার পথে বাসার রাস্তা ভুলে যায়। কিছুতেই মনে করতে পারো না তার বাসা কোথায়। কোন পথ দিয়ে এসেছে। তখন তাকে ফোন করে কান্নাকাটি করে। সে গিয়ে বোনকে নিয়ে আসে। এমনিতেই নিকিতাদের
বলা আছে কুহু একা বের হলেই তাকে জানাতে। তারাও তাই করে। ওরা বুঝতেই দেয় না যে ওরা জানে কুহুর সমস্যার কথা। এমন ভাব করে যে তারা কিচ্ছুটিই জানে না। আর কুহুও সুস্থ স্বাভাবিক কেউ। অথচ কুহুর অনুপস্থিতিতে তারা কুহুর বর্তমান অবস্থার কথা ভেবে মন খারাপ করে, কাঁদে। অথচ কুহুর জন্য বাবা মা সহ সবাই অভিনয়ের জাল এমন করে বিছিয়ে রেখেছে যেন সব সত্যি। কুহু যখন যা বলে তারা বিশ্বাসও করে।
আসলে কিন্তু তা নয়। কারণ তারা জানে কুহু ভাবনা জগতের বাসিন্দা।
সে ভাবতে ভালোবাসে। ভাবতে ভাবতেই সত্য মিথ্যা দিয়ে ভাবনার এক
জগৎ তৈরি করে ফেলে। সেসবের প্রভাব বিস্তার করে তার বাস্তব কর্মে।
আর এসব বেশি হয় যখন কুহু কোনো কিছু নিয়ে টেনশন করে। কাঁদে।
অতিরিক্ত ভাবে। এমনকি চলতিপথে রিলেটিভরা কিছু জিজ্ঞাসা করলে সে পূর্বের কথা স্মরণ করতে পারে না। বুঝতে পারে না মানুষটার অচেনা নাকি চেনা। একেক দিন অচেনা ভেবেই পাশ কাটিয়ে চলে আসে। তখন সেই রিলেটিভ তাকে অহংকারী ভাবে। গালমন্দ করে। কখনো কখনো বাসার এসে অভিযোগ জানিয়ে যায়। তখন সে আর তার বাবা মা চুপ করে শোনে। এছাড়া তো কোনো পথ খোলা নেই। এতসব আগে হতো না কিন্তু আজকাল তার সমস্যাগুলো খুব বেশি নজরে পড়ছে। অবস্থা দেখে ভাবাচ্ছেও। তাছাড়া রিদওয়ানকে নিয়ে যা অভিযোগ করেছে সেটা অন্য কাউকে নিয়েও যদি করে তাতেও অভিযোগ করার সুযোগ নেই। কারণ তার সমস্যা এটাই। তবে এটা কি কেউ বুঝবে? অনেকে তো এই রোগের নাম জানে না। শোনেও নি কখনো। তারা তো আর বুঝবে না এটা রোগ।এমনও রোগ হয়। ঠিক এই ভয়ে সে এতদিন বাসায় কোনো হোম টিউটর রাখতে পারে নি। পড়াশোনায় চাপ দিতে পারে না। বকাবকি করে না। সে
শুধু চুপ করে আছে বোনটার মুখের দিকে তাকিয়ে। তার বোন সুস্থ হলে একদিন পড়াশোনা করবে। বড় হবে। এখন যেভাবে চলছে চলুক। আর
দেশে বাইরে গিয়ে কি হবে, না হবে, সেটা পরে দেখা যাবে। আগে ভেবে
মাথা আওলাতে চাচ্ছে না। আপাতত যাওয়ার কাজ এগিয়ে নিতে হবে।
যত দ্রুত সম্ভব কাজ গুছিয়ে নিতে হবে। সে কালই যাবে ভিসা অফিসে।
আর বসে থাকা যাবে না। বোনকে ভালো করতে হবে। সুস্থ করতে হবে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতেই হবে। আর এটা করাটা এখন তার জীবনের লক্ষ্য।

পরেরদিন খুব সকালে কুহু একা একা ছাদে এসেছে। ছাদের মাঝখানে চুপ করে বসে আছে। কেন এসেছে, কি করতে এসেছে সে জানে না তার ইচ্ছে হয়েছে তাই সে এসেছে। মেয়ের রুমের দরজা খোলা পেয়ে ইসমত আরা মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে এসেছেন। এসে ছাদের গাছগুলোয় পানি দিলেন। তখন পাশের ছাদে একটা ভাবিও এলেন। কুশল বিনিময় করলেন। তারপর ভাবিটা কথায় কথায় বলে বসলেন,
-‘ভাবি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলতাম।’
-‘হ্যাঁ বলুন।’
-‘কুহুর কি জ্বিন ভূত অথবা মানসিক সমস্যা আছে নাকি?’
-‘এ আবার কেমন কথা? আর একথা মনে হলো কেন?’
-‘রাস্তায় দেখা হলে এক কথা বলে। একদিন বলে না। মাঝে মাঝে এমন আচরণ করে যেন চেনেই না।’
-‘ছোটো মানুষ। কখন কোন মুডে থাকে।’
-‘তাও অদ্ভুত আচরণ করে। আচ্ছা ভাবি আপনাদের বাসায় কিছুদিন আগে একটা ছেলে থাকত সম্ভবত রুপকের ফ্রেন্ড। তাকে আর দেখা যায় না কেন? চলে গেছে নাকি?’
-‘হুম। কিছু কাজের জন্য দেশে বাইরে থেকে এসেছিল। কাজ সেরে চলে গেছে আবার।’
-‘ছেলেটা দেখতে শুনতে ভালোই। কুহুর সঙ্গে জোড়া বেঁধে দিতেন। বিয়ে হলে কুহুর এসব ত্যাড়ামি সেরে যেতো।’
-‘আমার মেয়ের কিসে কি হতো সেই চিন্তা নাহয় আমাকেই করতে দিন। আমরা এখনো মারা যাই নি।’
-‘আরে ভাবি রাগ করলেন নাকি? আমি কুহুর ভালোর জন্যই বললাম। রাগ কইরেন না। ওর কথাবার্তা, চালচলন অদ্ভুত লাগে এজন্যই বললাম আর কি। তবে আপনি বললে আমি একটা হেল্প করতে পারি আপনাকে।’
-‘কি হেল্প?’
-‘আমার চেনা জানা একটা কবিরাজ আছে আপনি বললে তাকে নিয়ে আসতে পারি। মেয়েকে দেখালেন নাহয়।’
-‘পাগল ছাগল, জ্বি নে ধরা, ভূতে ধরা, যাই ইচ্ছে তাই হোক আমার মেয়েটাকে নিয়ে এতকিছু ভাবার জন্য ধন্যবাদ। নাসত
একথা বলে উনি ছাদ থেকে নেমে এলেন। রোদ চড়ে গেছে দেখে কুহু অনেক আগেই নেমে এসেছে। উনি ডায়নিং টেবিলের চেয়ার বসলেন। তারপর আঁচলে মুখ লুকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। আর কত!

ইন সুইজারল্যান্ড,
দিনটি রবিবার। সময় রাত আটটা। সারাদিনের ব্যস্ততা কাটিয়ে ডিনার
করতে বসেছে রিদওয়ানের পরিবার। সবাইই খাচ্ছে। নিলুফা ইয়াসমিন আতিকুল রহমানের সঙ্গে শপ নিয়ে কথা বলছেন।

আজ রিমির পছন্দের ডিশ রান্না হয়েছে। সেও মজা করে খাচ্ছে। তখন রিদওয়ানও এসে বসল। সামান্য খাবার তুলে নিলো প্লেটে। চামচ দিয়ে খাবার মুখে পুরো কিছু ভাবল। তারপর কেশে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে
ধীরে সুস্থে কুহুর সমস্যর কথা জানাল। জানাল, কুহু আর রুপক এখানে আসবে। থাকবে। চিকিৎসা করাবে। তাদের যেন সমস্যা না হয় সেটাও দেখতে হবে এই বাসার প্রতিটা সদস্যকে। এই নিয়ে যেন কেউ ভুলেও টু শব্দটি না করে৷ কোনো অভিযোগও তার কানে না আসে। তাছাড়া ওরা গেস্ট হিসেবে নয় আসবে এই বাসায় সদস্য হয়ে। তাই তাদেরকে় যেন সেভাবেই ট্রিট করা হয়। আর কুহুর চিকিৎসার কথা যেন আগ বাড়িয়ে তাকে কেউ না বলে। এখানে আসার পর ধীরে সুস্থে নাহয় বোঝানো যাবে। একথা বলে রিদওয়ান রিমিকে বলল,
-‘কুহুর আইডি লিংক তোমার ইনবক্সে পাঠিয়েছি। তোমার দায়িত্ব কুহু আসার আগেই তার সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা সহজ করা। সে যেন তোমার
সঙ্গে কথা বলে, মিশে, এখানে আসার আগ্রহ পায়।’
-‘পারব না।’
-‘কি?’
-‘পারব না এসব করতে৷’
-‘কেন?’
-‘কেন করব? চিনি না, জানি না। আর তুমি তার জন্য এত হাইপার হচ্ছো কেন ভাইয়া? যার বোন সে নাহয় এসব বুঝে নিবে। আর এদেশে থাকার জায়গায় অভাব আছে নাকি? আমাদের বাসায় কেন আসবে? কতদিন থাকবে তারও ঠিক নেই। তোমার বন্ধু বলেই কি আজাইরা প্যারা নিতে হবে আমাদের?’
-‘কলেজ কি শুধু আড্ডা দিতেই যাও নাকি কিছু শিখতে যাও? একজন স্টুডেন্ট হয়ে তোমার বিহেভিয়ার ছোটলোকের মতো হলে কবে? এটা আশা করি নি তোমার থেকে।’
-‘কার না জন্য তুমি আমাকে ছোটলোক বললে?’
-‘বললাম। তো? বড় হোচ্ছো আদব কায়দা শিখো। সব সময় ফাজলামি করা ছ্যাচড়াদের কাজ।’
-‘আমি বেয়াদব। ছ্যাচড়া। ছোটলোক। তাই এসব ভদ্র কাউকে দিয়েই করিয়ে নাও। আমি পারব না তাইই সরি।ঙ্গিবাদ
একথা বলে রিমি উঠে দাঁড়াল। রিদওয়ান শান্ত দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল। বহুদিন পর ভাইয়ের এমন সর্পশীতল দৃষ্টি দেখে রিমি চুপ করে চেয়ারে বসল। তারপর মাথা নত করে রইল। নিজেও বুঝল বেশি বলে ফেলেছে। তখন রিদওয়ান বলল,

-‘অহংকার জিনিসটা নিজের মধ্যে থেকে ঝেড়ে ফেলো। ভাইরা যেমন বোনদের গর্ব। তেমনি বোনরাও ভাইদের গর্ব। এমন কিছু কাজ কোরো না বা বোলো না যেন রুপকের কাছে আমাকে ছোটো হতে হয়। কখনো কেউ বলতে না পারে আমাদের শিক্ষায় ক্রুটি থেকে গেছে।’

একথা বলে রিদওয়ান না খেয়েই উঠে চলে গেল। আতিকুল রহমান এত ডাকলেও শুনল না। বোনের ব্যবহারে পুরোপুরিই হতাশ রিদওয়ান। তার ধারণা ছিল রিমির সাপোর্ট পাবে। আর এতদিন ভেবেছিল রিমি যথেষ্ট উদার মনে। কিন্তু এখন মনে হলো চাকচিক্যময় জীবনে বোনটাকে সে সঠিক শিক্ষায় দিতে পারে নি। তাদের শিক্ষায় ক্রুটি থেকে গেছে। নতুবা তার ব্যবহারে অহংকার প্রকাশ পেতো না। এদিকে এ প্রথমবার ভাইয়ের
বকা খেয়ে রিমি ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল। তার ইচ্ছে ছিল তার আর ম্যাকসানের সম্পর্কের কথা আজকালকের মধ্যে রিদওয়ানকে জানাবে। কিন্তু এ আপদগুলো সব ভেস্তে দিচ্ছে। এরা কবে যাবে তারও ঠিক নেই। তাই ভীষণ বিরক্ত এসে কুহুদের প্রতি। আর তাই বিরক্ত নিয়েই সে মনে মনে বলল,
-যাদের কারণে আমাকে এতগুলো কথা শুনতে হলো। ঠিক আছে, তারা আসুক। তাদের এখানে থাকা যদি হারাম না করেছি তো আমার নামও রিমি না। আর ভাইয়া নিষেধ করল কুহুতে এসব কথা না জানাতে। সে আমার প্ল্যান ভেস্তে দিলো তো এবার আমিই কুহুকে সবার আগে জানাব তার সমস্যার কথা। বলে দেবো তাকে চিকিৎসা করানোর জন্য আনা হচ্ছে।’

To be continue…….!!

#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_চব্বিশ




মানব মন বড়ই অদ্ভুত। অদ্ভুত এর চাওয়া-পাওয়া হিসাব-নিকাশ। কখন কি বলে, কি চায়, মন বুঝি নিজেও জানে না। এর জলজ্যান্ত উদাহরণ রিমি। এর আগেও সে কুহুকে দেখেছে। কথা বলেছে। অথচ তার নিজের স্বার্থে টান লাগাতে আজ সঙ্গে সঙ্গেই বেঁকে বসল। নিজের প্ল্যানের কথা ভেবে এতগুলোর মানুষ চেষ্টা বিফলে দেওয়ার কথা ভাবছিল। তার এই পুতুলের মতো সুন্দর মুখটা দেখে সেদিন কুহু মুগ্ধ হয়েছিল। কত ভালো ভালো কথা বলেছিল। গুনগান গাইছিল। অথচ রিমি নিজস্বার্থের কারণে আজ অকারণে কুহুকে গালমন্দ করল। ভাইয়ের প্রতি রাগ দেখাতে না পেরে কুহুর উপর রাগ জমালো। মনে মনে ক্ষোভ প্রকাশ করল। মেয়ের ছলছল চোখ দেখে আতিকুর রহমান উঠে মেয়ের পাশে বসলেন।মাথায় আলতো করে বুলিয়ে বললেন,
-‘কষ্ট পেও না মা। তোমার ভাইয়া কয়েকদিন ধরে খুব ছুটাছুটি করছে। টেনশনে তার মেজাজ ঠিক নেই।’
-‘কেন ছুটাছুটি করছে? কে করতে বলেছে? বন্ধুর বোনের প্রতি এত দরদ কিসের?’
-‘দরদ না দায়িত্ব। কুহুর জায়গায় একবার নিজেকে দাঁড় করাও। আর রুপকের জায়গায় রিদওয়ানকে দাঁড় করাও। মন দিয়ে তাদের কথাটা ভাবো। তুমি অসুস্থ হলে কি তোমার ভাইয়া বসে থাকত? সর্বোচ্চ চেষ্টা করতো না তোমাকে সুস্থ করার? বোন এত কঠিন রোগে আক্রান্ত হলে কোনো ভাই শান্ত থাকতে পারে? তুমি পড়ে গেলে অথবা কাঁদলে তোমার ভাইয়া কেমন পাগলের মতো করে না? তেমনি রুপক ওকরছে। বোনকে অনেক ডাক্তারও দেখিয়েছে। কিন্তু কাজ হয় নি বিধায় এখানে আসতে চেয়েছে। মা আমার, মাথা ঠান্ডা করো, তাদের কষ্টটা একবার উপলব্ধি করার চেষ্টা করো।’
-‘বুঝলাম কুহু অসুস্থ। জটিল সমস্যা তার। সব ভুলে যায়। কিন্তু বাসায় আনতে হবে কেন? আজাইরা ঝামেলা।’
-‘তোমার ভাইয়া দেশে গিয়ে হোটেলে উঠেছিল। বাইরের খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তখন কুহুর মা’ই জোর করে তাকে বাসায় নিয়ে গেছে। আদর যত্ন করেছে। নিজ হাতে বেঁধে খাইয়েছে। নিজের সন্তানের
মতো ভালোবেসেছে। এসব ভালোবাসার কি টাকা দিয়ে কেনা যায়? না, যায় না। আর বন্ধুর বাসা থেকে হোটেলে কেন উঠবে? রুপক তো রিদকে হোটেলে থাকতে দেয় নি তাহলে রিদওয়ান কেন দিবে?’
-‘তাতো বুঝলাম বাবা। কিন্তু ওদের জন্য আমার একটা প্ল্যান নষ্ট হচ্ছে। তাই তাদের উপরে রাগ হচ্ছে আমার।’
-‘এটা ঠিক না মা। সব সময় নিজের কথা ভাবলে চলে না। মাঝে মাঝে অন্যের কথাও ভাবতে হয়। আমরা যদি সবাই নিজেদের কথায় ভাবি তাহলে পৃথিবী চলবে কিভাবে? তোমার আম্মু যদি এই খাবারগুলো রান্না না করে শুয়ে বসে থাকত। রেস্ট করত। তাহলে আমরা খেতে পারতাম? পারতাম না তো। আমাদের কথা ভেবেই তো সে কষ্ট করে রান্না করেছে। তাই আমরা খেতে পারছি।’
-‘আম্মুর কথা আলাদা।’
-‘হ্যাঁ, আম্মুরা সব সময় বেস্ট। কিন্তু আমরা নিজ নিজ স্থান থেকেও কম না। যেমন মা ভাববে সন্তানদের কথা। ভাই ভাববে বোনের কথা। বন্ধু ভাববে বন্ধুর কথা। এভাবেই তো আমরা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখি তাই না?’
-‘সরি বাবা। আমি আসলে এভাবেই ভাবি নি।’
-‘জানি তো মা। এবার যাও ভাইয়াকে সরি বলে এসো। আর সে যা বলল তাই শোনো।’
-‘এখন গেলে ভাইয়া বকবে আমাকে।’
-‘ভুল করলে বকা শুনতে হয় মা। আমিও অনেক শুনেছি। আর বড় ভাই বোনকে ভালোর জন্য বকে।’
-‘হুম।’
বাবার কথা শুনে রিমি একা একাই ভাবল। তারপর গেল রিদওয়ানের রুমে। রিদওয়ান রুম অন্ধকার করে শুয়ে ছিল। মন টা ভালো নেই তার।
চিন্তায় থাকলে মন টন এমনিতেই ভার হয়ে থাকে৷ তার উপরে অফিসে একটু ঝামেলা হয়েছে। বাসায় রিমির অবাধ্যতা। সব মিলিয়ে মেজাজও চরম বিক্ষিপ্ত। তখন রিমি এসে দরজা নক করে ডাকল। ভাইয়া! ভাইয়া,
করে ডাকল কয়েকবার। রিদওয়ান অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল। দরজা খুলল। তাকে দেখে রিমি মিষ্টি করে হাসল। তার পুতুল মুখ হাসিতে পূর্ণ হয়ে গেল। তারপর মগ এগিয়ে দিয়ে বলল,
-‘নাও। তোমার ফেভারিট কফি।’
-‘লাগবে না।’
-‘নাও। আমি কত কষ্ট করে বানালাম।’
-‘প্রতিটা কাজই কষ্টের। মানুষ সর্বদা নিজের কষ্টকে বড় করে দেখে তাই নিজের কষ্টটাকে কষ্ট বলে মনে হয়। বাকিদের কষ্ট ফেলনা মনে হয় এই যা।’
-‘সরি ভাইয়া।’
-‘সরি কেন? স্বার্থপরতা দেখিয়ে ফেললে তাই? নাকি অন্যকিছুর জন্য?’
-‘আমি আসলেই ব্যাপারটা ওভাবে ভাবি নি। ক্ষণিকের জন্য নিজেরটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।’
-‘কেন ভাবলে না? জটিল সমস্যা শুনলে তাও কেন ভাবলে না? আজকে কুহুর জায়গায় তুমি থাকলে রুপকও আমার কথা ভেবে আগে এগিয়ে আসত। তুমি আজ যা ব্যবহার করলে তাতে তুমি নিজেকে না আমাকে ছোটো করলে। অপমান করলে। আমার বোন তো এমন নয়। আমাদের রিমি এত সেলফিস তো ছিল না। কুহুকে তুমি দেখেছো। কথাও বলেছো।
তবুও…! ”
-‘আর এমন হবে না। এক্সটেমলি সরি ভাইয়া। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ।’
-‘মনে থাকে যেন। আর আরেকটা কথা রুপক’রা আসার পর বাসায় যদি
লঙ্কাকান্ডও বেঁধে যায়। যে কোনো কারণে তাদের সঙ্গে তোমার মত না মিলে তবুও তাদের সঙ্গে তুমি মিসবিহেভ করবে না। আই রিপিট, কোনো
পরিস্থিতিতেই মিসবিহেভ করবে না৷ কখনো না। যদি করো তাহলে আমি ভুলে যাব তুমি তোমার বোন। আর যাই হোক, কোনো বেয়াদবকে আমি বোনকে বলে স্বীকারই করব না।’
একখা শুনে রিমির মুখটা ছোটো হয়ে গেল। সে বুঝল তার ভাইয়া হার্ট হয়েছে। হার্ট না হলে রিদওয়ান কখনো তার সঙ্গে কঠিন সুরে কথা বলে না। সে নিজের ভুলটা বুঝে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল। গাল বেয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু ঝরে গেল। তা দেখো রিদওয়ান কফির মগটা নিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল। ডোজ বেশি হয়ে যাচ্ছে ভেবে আড়চোখে বোনকে একবার দেখে বলল,
-‘নিচের ড্রয়ারে চকলেট আছে। নিয়ে যাও।’
-‘নাই। যা ছিল সব শেষ করে দিয়েছি।’
-‘আছে। দেখো।’
একথা শুনে রিমি এগিয়ে ড্রয়ার খুলতেই দেখে ড্রয়ার ভর্তি তার পছন্দের চকলেট। সে একগাল হেসে মুঠো ভরে চকলেট হাতে তুলে নিলো।ছোটো
থেকেই সে দেখে আসছে এই রুমের এই ড্রয়ার সব সময় চকলেটে ভর্তি থাকে। তার ভাইয়া পূর্ণ ড্রয়ার শূন্য হতে দেয় না। জানে বোন পছন্দ করে তাই সেদিকেও নজর থাকে। রিমি চকলেট নিয়ে ভাইয়াকে বলল,
-‘আমি আবারও সরি ভাইয়া। মন থেকে সরি। বুঝতে পারি নি। এভাবেও ভাবি নি। আমি আজই কুহুর সঙ্গে কথা বলব। আর কোনো ভুল হবে না, প্রমিস।’
-‘হুম।’
-‘সাবধানে কথা বোলো কুহুর সঙ্গে। সে অসুস্থ হলেও কিন্তু খুব চালাক। কথা দিয়ে কথা আদায় করে নেয়। রুপক থেকে শুরু করে সবাইকে সে তাপের উপরে রাখে। এমনকি আমি যে কয়েকদিন ওদের বাসায় ছিলাম
আমাকেও নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে।
একথা শুনে রিমি হেসে ফেলল। চোখ মুছল। এতক্ষণ বোনের মুখে হাসি দেখে রিদওয়ানও হাসল। কুহুকে নিয়ে মজার মজার কয়েকটা ঘটনাও বলল। পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হলো। কুহুর কান্ডকৃতীর কথা শুণে রিমির তো হাসি থামে না। রিদওয়ান কুহুর সমস্যার কথা আরো খোলাসা করে বলল। সব শুনে রিমির নিজের কাছে খারাপ লাগা কাজ করল। ছোটো মনে হলো নিজেকে। ছিঃ! রাগের বশে কি করতে যাচ্ছিল সে। না ভুলটা শুধরে নেবে সে। বাবা ঠিকই বলেছে সবসময় নিজের কথা ভাবলে হয় না। মাঝে মাঝে অন্যের কথা ভাবা মনুষ্যত্বের কাজ। রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠায় ঠিক ভুলের ভাবনাটা জ্ঞানশূন্যহীন হয়ে গিয়েছিল। এজন্য বলে রাগ ধ্বংস ডেকে আনে। সম্পর্ক নষ্ট করে। ভাগ্যিস বাবা আর ভাই এত সুন্দর করে বোঝাল। নয়তো তার করা ভুলের কারণে সারাজীবন নিজেকে দোষারোপ করতে হতো। মনে মনে অনুতপ্ত হয়ে রিমির চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে তখনই রিদওয়ান উঠে দাঁড়াল। বোনের মাথা হাত রেখে স্নেহের সুরে বলল,
-‘বোনরা হচ্ছে ভাইয়ের কলিজা। বোনরা ভুল করলে, বকবো, মারব, আবার কাছে টেনে আদর করব। বোনের হাসিতে যেমন ভাইদের পুরো পৃথিবী হাসে। তেমনি বোনের অসুস্থতায় আমাদের পুরো পৃথিবীতে ঘন অন্ধকার নেমে আসে। চারদিকের এত আনন্দ, এত সুখ, তখন ফিঁকে মনে হয়। এখন যদি আমাকে কেউ বলে তুমি তোমার প্রাণ বিসর্জন দাও আমি তোমার বোনের পায়ে কাছে পৃথিবীর সমস্ত সুখ এনে দেবো। আমি রিদওয়ান তাতে কিন্তু পিছ পা হবে। হাসতে হাসতে আমার প্রাণ বির্সজন দেবো।’
-‘ভাই..য়া!’
কান্নাভেজা কন্ঠে ডাকল রিমি। রিদওয়ানের কথা শুনে তার চোখ দিয়ে ঝরতে লাগল অঝর শ্রাবণ। তার ভাই তাকে এতটা ভালোবাসে? এতটা?
সে তো আগে কখনো উপলব্ধি করে নি। উপলব্ধি করার চেষ্টাও করে নি।
সে ভাবতো আর পাঁচটা ভাইদের মতোই তার ভাইও। বিয়ের আগে সব ভাইরা এমনই থাকে। তার ভাইও তাই। বিয়ে করলেই ভাই পর হয়ে যাবে। তখন বোন হবে বোঝা। চোখের বিষ। কিন্তু আজকে ওর ভুল ভাঙল। সে বুঝল, সব ভাইরা এক না। আজকের এই ছোট্ট ঘটনাটা নতুন করে তার চোখ খুলে দিলো। বুঝিয়ে দিলো তার ভাই তাকে ভীষণ ভালোবাসে। সে এবার নিজেও মনে মনে ওয়াদা করল, পৃথিবী উল্টো যাক। পাল্টে যাক। সে কখনো তার ভাইয়ের অবাধ্য হবে না। কষ্ট দেবে না। পরিস্থিতি যতই নির্মম হোক সে ভাইয়ার কথা শিরোধার্য হিসেবে মেনে নেবে। আজকের পর থেকে তাকে ভাই বোনের সম্পর্কটাকে আরো মজবুত করার চেষ্টা করবে।’

ওদিকে,
রুপকের বুদ্ধিটা বেশ কাজে দিয়েছে। আয়নাতে যতবারই কুহু নিজেকে দেখে কাগজটার দিকে তার নজর যায়। ভুলে গেলেও আবার মনে পড়ে। চোখের সামনে থাকা সেই কাগজটা তাকে ভুলতে দেয় নি সুইজারল্যান্ড যাওয়ার কথা। আর যখনই ওর যাওয়ার কথা মনে হয় সে জামা কাপড় গুছাতে থাকে। ভিসাও রেডি। আজকাল রিদওয়ানের বোন রিমির সঙ্গে তার কথা হয়। ফ্রেন্ড হয়ে গেছে তারা। খুব মিশুক রিমি মেয়েটা। কি যে সুন্দর দেখতে। পুতুলের মুখে যখন হেসে কথা বলে মন ভালো হয়ে যায়।
তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। এমন খারুস,রসকষহীন ভাইয়ের এত মিষ্টি একটা বোন হলো কিভাবে তাইই ভেবে পায় না কুহু। মেয়েটা এত সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখায় ভিডিও কলে। সেখানে যাওয়ার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সে তো রুপককে খোঁচাতেই থাকে কখন যাবে, কবে যাবে। ভুলো মনের কুহুকে রিদওয়ান,রুপক,রিমি, এবং তার বাবা-মা ভুলতেই দিলো না সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার কথা। তারা এমন এমন কাজ করলো কুহু ভুলে গেলেও নতুন করে মনে করাতো। সারাদিনে কত কথা যে হয় তার রিমির। সেখানে গেলে কে কি করবে, কোথায় কোথায় যাবে সেসব নিয়েও আলোচনা হয়ে গেছে। মেয়েদের গল্পের শেষ নেই। শখ, আহ্লাদ, ইচ্ছের শেষ নেই। রিমি যত সহজে দূর থেকে কুহুকে ম্যানেজ করছে তা রিদওয়ানের পক্ষেও সম্ভব হতো না। রিদওয়ানের সঙ্গে কথা হলেও পাচঁ কি দশ মিনিট। খুব বেশি হলে পনেরো মিনিট। এর বেশি তারা কেউ কথা এগোতে পারত না। অথচ রিমি আর কুহু সারাদিন যাওয়া নিয়ে বকবক করেই যায়। এভাবে দেখতে দেখতেই তাদের যাওয়ার দিনটা এসে গেল।
তারা হাসি মুখে বাবা মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে পাড়ি জমাল এক অচিন পুরীতে। তার বাবা-মা ছেলে মেয়েকে বিদায় দিয়ে ফাঁকা বাসায় ডুকরে ডুকরে কতক্ষণ কাঁদল। মেয়েটার কারণে কাঁদতেও পারে না। কষ্টগুলো বোঝাতে পারে না। আজ সুযোগ বুঝে উনারা কেঁদে মোনাজাতে দু’হাত তুললো, আল্লাহর কাছে মেয়ের শেফা চাইল। ছেলেটা যেই আশায় এত দূরের পথে গেল তার মনের সব আশা পূরণের জন্য ফরিয়াদ জানাল।
আর তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষার যাত্রা শুরু করল, কবে শুনবে যে মেয়েটার মধ্যে একটু একটু করে ইমপ্রুভ দেখা দিচ্ছে। নিভু নিভু বাতিটা আবারও জ্বলে ওঠার সম্ভবণা দেখা যাচ্ছে।

যথাসময়ে তারা ভাই বোন সুস্থভাবে লুগানো বিমানবন্দরে পৌঁছাল। দীর্ঘ যাত্রা কুহু প্রায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পার করেছে। ঘুমের ঘোরেই কুহু দুই বার
মাকে ডেকেছে। শালিক পাখিদের খেতে দিতে বলেছে৷ বাবাকে কাচ্চির খাওয়ার কথা বলেছে। আর রুপক স্নেহ সহকারে বোনের মাথায় আদুরে ভাবে হাত বুলিয়ে দিয়েছে। কখনো গল্পে মাতিয়ে রেখেছে। কখনো তারা গিয়ে কি করবে, না করবে, এসবও আলোচনা করেছে। মাঝে মাঝে কুহু তার সঙ্গে আনা উপন্যাসের বইটা পড়েছে। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেলে
ঘন্টা খানিক ঘুমিয়ে জেগে ওঠে জিজ্ঞাসা করেছে কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে। রুপক তাকে সেই কাগজ দেখিয়ে মনে করিয়েছি আর মনে মনে আল্লাহকে ডেকেছে যেন কোনো ঝামেলা না হয়। বোনটা যেন কান্নাকাটি না করে। তারা ফ্লাইটে ওঠার পর থেকে প্রায় সবারই চিন্তায় প্রতিটা মুহূর্ত কেটেছে। অস্থির থেকেছে তাদের আপনজনগুলো।

To be continue………!!