আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব-০২

0
19

#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#দ্বিতীয়_পর্ব

সবগুলো ক্লাস করে মন ভার করে সিঁড়ি বেয়ে নামছে কুহু।
কলেজ ছুটি হলো কিছুক্ষণ আগে। হুঁটোপুটি গ্যাং আজকে
মনস্তাপ। কারণ তাদের লিডারের মন খারাপ।নিকিতা, চন্দ্রা,
পিয়াস, মিরাজ সকলে বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। কুহু ওয়াশরুমে যাওয়ার নাম করে সেই যে গেছে ফেরার নামগন্ধ নেই। তারা সেই কখন থেকে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে কুহুর মন ভালো করতে, কিন্তু পারছে না। এদিকে কুহু ভেবে পাচ্ছে না ‘অকৃতজ্ঞ’ দিয়ে কিভাবে প্যারাগ্রাফ লিখবে। বাংলাতে হলে চিন্তা ছিল না। তার আবার বানিয়ে লেখার হাত ভালো। এত বানিয়ে লিখতে পারে যে, লিখতে লিখতে মূল ব্যাখা থেকেই ছিঁটকে যায়। তবুও লেখা শেষ হয় না। কিন্তু এখানে আসল
সমস্যা হচ্ছে ইংলিশ। ভাব দেখাতে কথায় কথায় দু’একটা ইংলিশ শব্দ ব্যবহার করাই যায়। করেও সে। কিন্তু লাইন বাই লাইন ইংলিশে প্যারাগ্রাফ লেখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সম্ভব নয় মানে একেবারেই সম্ভব নয়। যেখানে ইংলিশে বড্ড কাঁচা সেখানে আবার প্যারাগ্রাফ। মোদ্দাকথা অকৃতজ্ঞ নিয়ে কে প্যারাগ্রাফ লিখে ভাই? আজ পর্যন্ত আদৌও কেউ লিখেছে? মনে তো হয় না৷ অথচ তাকে জব্দ করতে ওই ধিড়িঙ্গি ব্যাডা
এই ঝামেল গছিয়ে দিয়েছে। গুগলে সার্চ দিয়ে খুঁজেছে কিন্তু পাচ্ছে না। যেগুলো পেলো সেগুলো কাজেও না। ক্লাস মিস কিংবা কলেজ বাং করা যাবে না আগেই বলে দিয়েছে। মানে সব পথ বন্ধ। দুষ্টুমির ছলে নাহয় একটু আধটু দুষ্টুমি করেছে তাই বলে এমন শাস্তি দিবে? অন্ধ মানুষ যদি বলে তুমি চাঁদ দেখো। সে দেখতে পারবে? উপভোগ করতে পারবে চাঁদের
মোহময় সৌন্দর্য?পারবে না। বরং মন খারাপ করবে। কষ্ট পাবে। তার অবস্থাও এখন সেইম। তার মতো গবেট মার্কা ছাত্রীকে দিয়েছে প্যারাগ্রাফ দিয়েছে তাও আনকমন একটা বিষয়ে। এখন এই বিপদ থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে? বাবাও নেই, ভাইয়া জীবনেও হেল্প করবে না। আম্মুকে বলা মানেই হাজারটা ভাষণ শোনা। সময়টাও বড্ড খারাপ যাচ্ছে তার।
এমন নানান চিন্তা করতে করতে সে ফ্রেন্ডদের কাছে এসে দাঁড়াল। কাঁধের ব্যাগ উল্টো করে বুকে লাগিয়ে রাখা। চোখে মুখে বিষন্নতা। মাথাভর্তি টেনশন। কলেজ প্রায় ফাঁকা। তারা দাঁড়িয়ে আছে কলেজের গেটের বাইরে।তাকে মন মরা দেখে পিয়াস ফিক করে হেসে ফেলল। তার দেখে মিরাজও হাসল। হাসির কারণ কেউই জানে না তবুও সবাই হাসল। হাসল না শুধু কুহু। সে মুখ ভার করে গাড়ি দেখছে। আশেপাশে ফাঁকা রিকশা নেই। রোদ চড়েছে।গরমে দরদর করে ঘামছে শরীর।
তখন পিয়াস একগাল হেসে বলল,
-‘স্যাররা ওইরকম একটু আধটু বকেই। চিল মাম্মা। এক কাজ করি চল, বাজি ধরে ফুচকা খাই। যে হারবে সে বিল দিবে।’
পিয়াসের কথা শুনে চন্দ্রা তার বাহুতে একটা কিল বসিয়ে দিলো। তারপর বিরক্ত মুখে বলল,
-‘তোর আইডিয়া গুলো তোর মতোই ত্যানামার্কা। ক’টা বাজে খেয়াল আছে? এখন বাজি ধরে ফুচকা গিলতে গেলে ফিরবে দেরি হয়ে যাবে। সাড়ে তিনটার দিকে কোচিং আছে ভুলে গেছিস?’
-‘বালামার। কথায় কথায় মারিস ক্যান তুই? এমনিতেই গা গতর ব্যথা। ব্যথায় মরে যাচ্ছি আমি। আর এই মুটকি খালি মারে। দাঁড়াবোই না তোর পাশে।”

একথা বলে পিয়াম সরে দাঁড়াল। চন্দ্রা খিলখিল করে হেসে আরেক ঘা বসিয়ে দিয়ে পিয়াসের পিঠে। পিয়াস রেগে তার একহাত মুঁচড়ে ধরল। তখন নিকিতা আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠল,
-‘এই তোরা মারামারি বন্ধ কর। রিদওয়ান স্যার আসছে। তোদের মারামারি দেখলে সব ক’টাকেই রাস্তাতে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবে। তখন ইজ্জ্বতের ছিঁটেফোঁটা যা বাকি আছে তাও অবশিষ্ট থাকবে না।’
একথা শুনে সবাইই গেটের দিকে তাকাল। রিদওয়ান ফোনে কথা বলতে বলতে বের হচ্ছে। রাগে গজগজ করছে, কাকে যেন ঝাড়ছে। এই লোকের কাজই বোধহয় ঝাড়াঝাড়ি করা।
কোনোদিন যদি রিদওয়ান স্যারের মায়ের সঙ্গে কুহুর দেখাও হয়। তাহলে সে একটা কথা জানতে চাইবে। জন্মের সময় কী রিদওয়ান স্যারের মুখে মধু দেওয়া হয়েছিল? নাকি মধু আর সরিষার তেল পাশাপাশি থাকায় গুলিয়ে ফেলে মধুর বদলে সরিষার তেল দিয়েছিল। এত ঝাঁঝ কেন উনার? একটুও কি হাসা যায় না? সুন্দর করে কথা বলা যায় না? সবসময় এমন খ্যাচখ্যাচ করে কেন? খ্যাচখ্যাচ করা পুরুষদের বউয়ের সুখ থাকে না। স্বামীর খ্যাচ খ্যাচ শুনতে শুনতে তার জনম যায়।
এই খারুস ব্যাডার বউয়ের কপালেও সুখ নাই সেটা তার ব্যবহারে বোঝা যায়। কুহু রিদওয়ানের দিকে তাকিয়ে এসব কথায় ভাবছিল। তখন রিদওয়ান ঘাড় ঘুরাতেই চোখাচোখি হয়। কুহু অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুত নজর সরিয়ে নেয়। তাদের এই পাঁচজনকে দলবন্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিদওয়ান কল কেটে এগিয়ে আসে। পাঁচ মূর্তির দিকে একনজর তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
-‘কোনো সমস্যা? দলবেঁধে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
মিরাজ জোরপূর্বক হেসে জবাব দেয়,
-‘না মানে স্যার এমনি।’
-‘এমনি? এটা কি এমনি দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা?’
-‘না মানে স্যার, যাচ্ছি স্যার।’
-‘তোমাদের বাসা কি এক জায়গায়?’
-‘না স্যার। কুহুর বাসা অন্যদিকে। ওই রিকশা পাচ্ছে না তাই আমরা দাঁড়িয়ে আছি।’

একথা শুনে রিদওয়ান রাস্তার দিকে তাকাল। রাস্তা ফাঁকা। একটুপরে দূর থেকে একটা রিকশা আসতে দেখা গেল। সে হাতের ইশারায় রিকশা ডেকে কুহুরে যেতে বলল। কুহু বিনা বাক্যে রিকশায় চড়ে বসল। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলা তো দূর দৃষ্টি তুলে তাকালোও না। দেখল না বন্ধুদের করুণ দৃষ্টি। রিকশা চলতে শুরু করল। কুহু যাচ্ছে দেখে বাকিরাও দাঁড়াল না তারাও হাঁটা ধরল। সামনেই মোড়। সেখান থেকে রিকশা নিয়ে নিবে। রিদওয়ানের থেকে বিদায় নিয়ে তারাও সটকে পড়ল। এই লোক বিপদজনক। ইনার পাশে দাঁড়ানো মানে বিপদ।

কুহুর বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসল। আজকে কোচিং আছে তবুও যাবে না। যাবে না কারণ তাকে স্যারের বাঁশটা থুরি পড়াটা রেডি করতে হবে। যেই মেয়ে পরীক্ষার আগের দিন রাতে ভসভস করে ঘুমায়। সেই মেয়েই পড়ার টেনশনে
অস্থির। একদিনেই এত পরিবর্তন। এই পরিবর্তন ঠিক কেন সে তো আর কাউকে বোঝাতে পারছে না। এই পড়াটা রেডি না করলে শাস্তির মাত্রাও যে বাড়বে এটা জানতে অসু্বিধা হচ্ছে না তার। সে খেয়ে আবারও ফোন নিয়ে বসল। গুগল ঘেঁটে দেখল। যত ইংলিশ বই ছিল সব তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাঙ্খিদ প্যারাগ্রাফ খুঁজে পেল না। অবশেষে হাল ছেড়ে সে ঘুমিয়ে গেল। এখন শেষ ভরসা তাই ভাই রুপক। কিন্তু রুপক ফিরবে কখন কে জানে! সে রুপকে একটা মেসেজ লিখল,
‘ভাইয়া, তাড়াতাড়ি ফিরো। তোমাকে জরুরি দরকার।’
রুপকের ফোনে চার্জ নেই। ফোন বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। তাই মেসেজও দেখল না। কুহু ঘুম থেকে উঠল ঠিক মাগরিবের আজানের পর। তাও তার আম্মুর বকা শুনে। বসার ঘরে কারো কথা শোনা যাচ্ছে। রুপক হাসছে। তার হাসির শব্দ ভেসে আসছে। ভাইয়ের কন্ঠ শুনে সে ধড়ফড় করে উঠে বসল। গায়ে কোনোমতে ওড়না জড়িয়ে ড্রয়িংরুমে এলো।
আর এসে দাঁড়াতেই রুপক তাকে দেখে বলল,
-‘ছুটকি এসেছিস? কতবার ডাকলাম তোকে উঠলিই না।
এত ঘুম কাতুরে হলে চলবে? নে মেহমানের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নে, আমার ফ্রেন্ড রিদওয়ান। তোদের কলেজের টিচার।’

রিদওয়ানকে তার বাসার ড্রয়িংরুমে দেখে কুহু জোরপূর্বক হাসল। সালাম দিলো। কত কষ্টে যে সালাম দিলো একমাত্র সেই জানে। তারপর মনে মনে বলল,

-‘বাঁশ আর কোন কোন দিক দিয়ে আসবে? জীবনটা দেখি বাঁশময় হয়ে গেল। এই লোক বাঁশ হয়েই কেন বার বার দেখা দিচ্ছে?’

To be continue………!!