#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_ঊনত্রিশ
–
–
–
-‘ আমি বলামাত্রই বিয়েতে রাজি হলে কেন? কিসের জন্য রাজি হলেন?’
একথা শুনে রিদওয়ান মৃদু হাসল। সে যেন আগে থেকেই জানত এমন কিছু জিজ্ঞাসা করা হবে। কুহু জবাবের আশায় তাকিয়ে আছে তার মুখ পানে। তারপর কিয়ৎকাল চুপ থেকে রিদওয়ান অকপটে জবাব দিলো,
-‘ধরে নাও, তোমার তৈরি করা ভাবনাটাই সঠিক। ভালোবাসি তোমায়।’
-‘বলতে হবে তাই বললেন বুঝি?’
-‘এমন মনে হলো কেন?’
-‘আপনারা সবাই আমাকে অসুস্থ বানাতে উঠে পড়ে লেগেছেন। মন হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়?
-‘না। স্বাভাবিক নয়।’
-‘তাহলে ভালো না বেসে বিয়ে করলেন কেন? করুণা করতে?’
-‘বলো। তবে লিমিটি রেখে। আমাকে খোঁচা মারতে গিয়ে নিজেকে এত ছোটো করিও না।’
-‘
-‘পৃথিবীতে সবাই যদি ভালোবেসে ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করতে পারত তাহলে এরেঞ্জ ম্যারেজ বলে কোনো শব্দ’ই থাকত না। ধরে নাও, আমরাদের বিয়েটা এরেঞ্জ ম্যারেজ। বিয়ের আগে ভালোবাসি তো কি? বিয়ের পর বাসব। বউটা তো আমারই, তাই না?’
কুহু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর মেঝের দিকে দৃষ্টি ফেলে মলিন কন্ঠে বলল,
-‘ মনে মনে আফসোস হচ্ছে তাই না?’
-‘কার?’
-‘আপনার।’
-‘কেন আফসোস হবে?’
-‘আমাকে বিয়ে করে।’
-‘এখন অবধি হচ্ছে না। তবে তুমি যদি আমার কথা না শোনো তাহলে আফসোস না বরং ভীষণ কষ্ট পাব।’
-‘কি কথা শুনতে হবে? ‘
-‘বিয়ের পর প্রতিটা হাজবেন্ড-ওয়াইফের দায়িত্ব একে অপরের খেয়াল রাখা। ভালো রাখা। ভালোবাসা। কবুল বলার সময়ই আমি ভুলে গেছি, তুমি আমার স্টুডেন্ট ছিলে, বন্ধুর বোন ছিলে, পূর্বের সব সম্পর্ক বাদ। আজ থেকে তোমার একটাই পরিচয় তুমি আমার বউ। বিয়ের করা বউ। আর বউয়ের জন্য যখন যেটা ভালো হবে আমি সেটাই করব৷ শুরুতেই বলেছি,প্রতিটা হাজবেন্ড-ওয়াইফের দায়িত্ব একে অপরের খেয়াল রাখা। ভালো রাখা। ভালোবাসা। সেই যুক্তি থেকে তুমি শুধু রেগুলার মেডিসিন
নিবা। ডেইজি যা বলবে শুনবা। তাহলেই আমি ভালো থাকব। বউ রুপে
তুমিও আমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব পালনে সাকসেস হবা। আর কোন রোগের মেডিসিন খাচ্ছো। কেন খাবা, হ্যান, ত্যান, কোনোকিছুই ভাবতে হবে না তোমার।শুধু মনেপ্রাণে এইটুকু বিশ্বাস রাখবা আমি বেঁচে থাকতে জেনে শুনে কখনো কোনো ক্ষতি হতে দেবো না তোমার, প্রমিস!’
-‘কি রোগ? কেন মেডিসিন খাচ্ছি তাও জানতে চাইব না?’
-‘না, চাইবে না।’
-‘নিষিদ্ধ জিনিস আকৃষ্ট করে বেশি।’
-‘করুক।’
-‘মন মানবে না।’
-‘জানাটা কি খুব দরকার?’
-‘হুম, দরকার।’
-‘তাহলে আজ থেকে জেনে নাও তোমার অসুখের নাম রিদওয়ান রিদ।’
শেষ নিঃশ্বাস চলাকালীন এই অসুখ থেকে তোমার নিস্তার নেই।’
-‘পেতেও চাই না।’
-‘তাহলে কি করতে হবে?’
-‘ভালো বউ হতে হবে।’
-‘ভালো বউ হতে গেলে কি করতে হবে?’
-‘ভালো রাখতে হবে।’
-‘ভালো রাখতে হলে কি করতে হবে?’
-‘হাজবেন্ডের মনমতো চলতে হবে।’
-‘হাজবেন্ডের মনমতো চলতে গেলে কি করতে হবে?’
-‘মেডিসিন নিতে হবে।’
-‘নিবা?’
-‘নেবো।’
-‘পরে পাল্টি খেলে কি করব?’
-‘ যা শাস্তি দেবেন মাথা পেতে নেবো।’
-‘ওকে।’
রিদওয়ান মুখভর্তি হাসল। এরপর ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে গেল। এসে দেখে কুহু জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি খোলা জানালায়। ওই দূর আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। অপরুপ তার সৌন্দর্য! অপার্থিব
সেই আলোয় রিদওয়ান তাকিয়ে আছে মায়াভরা, স্নিগ্ধধরা একটা পুতুল মুখের মেয়ের দিকে।সে ডাগর ডাগর নেত্রে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ মেয়েটার চোখ দিয়ে একফোঁটা অশ্রুবিন্দু। কুহু নীরবে কাঁদছে। সে এগিয়ে গিয়ে কুহুর পেছনে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর ডাকল,
-‘কু..হু।’
-‘আমার জীবনটা দিন দিন কেমন জানি হয়ে যাচ্ছি। আমি আজকাল বুঝতে পারি, আমি হঠাৎ হঠাৎ অনেককিছু ভুলে যাই। চোখের সামনে সেসব ঘটে কিছুক্ষণ তা মনে থাকে। একটুপরে কি ঘটল তা ভুলে যাই। তখন শতচেষ্টা করেও মনে রাখতে পারি না। ভাবি। প্রচুর ভাবি। ভাবতে ভাবতে আমি ক্লান্ত হয়ে যায় অথচ আমার ভাবনা শেষ হয় না। কি সব হচ্ছে আমার সাথে! কেন হচ্ছে! এখন আমার ভয় হচ্ছে। খুব ভয়। এই বিয়েটা না করাই উচিত ছিল।’
এইটুকু বলতে বলতে কুহুর কান্নার বেগ বাড়ল। ঝরঝর করে তার গাল বেয়ে গড়িয়ে গেল অশ্রুঁফোটা। সে ফুঁপিয়ে উঠল। তার ফুঁপানোর শব্দে
রিদওয়ান তাকে সামনে ঘুরাল। দুহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে কুহুর চোখ মুছে দিলো। ক্ষনিকেই গাল ভিজে একাকার। সে যতবার মুছে ততবারই কহুর অবাধ্য চোখের জল বেহায়ার হয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে। রিদওয়ান আবারও মুছে দিলো। এরপর কুহুর চোখে চোখ জিজ্ঞাসা করল,
-‘কাঁদছো কেন?’
-‘এমনি।’
-‘এমনি কেউ কাঁদে না?’
-‘কাঁদে।’
-‘কে কাঁদে?’
-‘আমি কাঁদি।’
-‘ভালোবাসো আমাকে?’
-‘খু্ব।’
-‘আমি চলে আসাতে কষ্ট পেয়েছিলে?’
-‘পেয়েছিলাম।’
-‘রাগ হয়নি?’
-‘হয়েছে।’
-‘তখন আমাকে কি করছে মন চাচ্ছিল?’
-‘(………)’
-‘বলো?’
-‘(………)’
-‘ চুপ কেন?’
-‘কিছু করতে মন চাই নি।’
-‘ওহ। তবে আমি চলে আসার পর কেউ একজন আমাকে ম্যাসেজ করেছিল, ‘এভাবে কথা না বলে চলে গেলেন কেন রিদ ভাইয়া? আমি কিন্তু কষ্ট পাচ্ছি। ফিরে আসুন। আপনি আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছেন। তাই আপনার বুকে মাথা রেখেই কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আমি কাঁদব। আপনি আসুন।’ সেদিনের ইচ্ছেটা আজ পূরণ করতে পারো। আমি এবং আমার বুক দু’টোই সাক্ষরহীনভাবে তোমার নামে লিখে দিলাম।’
কুহু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। এই কাজ আবার কখন করল? সে কি করে, না করে, তার মনেও থাকে না। তবে লজ্জা পেল। লজ্জায় তার
গাল দুটো লাল হয়ে উঠল। ঘড়িতে তখন রাত দুটো। কথা বলতে বলতে এত রাত! রিদওয়ান কুহুকে ইশারায় ঘড়ির দিকে তাকাতে বলেই হেসে ফেলল। তারপর বিছানার ফুল সরিয়ে পাশে জায়গা রেখে শুয়ে পড়ল।
একবার মাথা উঁচিয়ে অসস্ত্বিতে বুদ হওয়া কুহুর দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘চেঞ্জ করবে?’
-‘হুম।’
-‘কেন, শাড়ি পরে ঘুমানোর অভ্যাস নেই?’
-‘না।’
-‘ওই রুম থেকে ড্রেস এনেছো? নাকি এনে দেবো?’
-‘আমি ওই রুমে যাই?’
-‘ চেঞ্জ করতে যেতে চাইলে যাও তবে ঘুমাবে এখানেই।’
-‘আজ.. ম..মানে বলছিলাম যে ..!’
-‘কি?’
-‘আজ মানে বলছিলাম যে..। ‘
-‘আজ মানে বলেছিলে যে’ এর মানে কি বুঝব? তোতলাচ্ছো কেন? যা বলার স্পষ্টভাবে বলো। ওয়েট, ওয়েট, ওই রুমে ঘুমাতে চাও? হবে না।
যেতে দেবো না। বউ ছাড়া অনেকগুলো রাত অতিবাহিত করেছি আর না। দ্রুত চেঞ্জ করে এসো।’
একথা শুনে কুহু এই বেহায়া পুরুষটার দিকে কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পাশে এসে শুয়ে পড়ল।
করবে না চেঞ্জ। ওকে শুয়ে পড়তে দেখে রিদওয়ান মিটিমিটি হাসল। সে বুঝলেও তাকাল না। একটুপরে রিদওয়ান বলল,
-‘ আজকে রাতের আঁধারের সঙ্গে তোমার সব দুঃচিন্তাকে বিসর্জন দাও।
নিজেকে মুক্ত পাখির ন্যায় স্বাধীন করো।ভয়, দুঃচিন্তা এবং অহেতুক সব ভাবনার লাগাম টানো। নতুন এক সকালে নতুনভাবে জীবনের আর্বিভাব ঘটাও। মানুষ পারে না এমন কিছু নেই।’
একথা কথা বলে সে আচমকা হেঁচকা টানে তাকে কাছে টেনে তার বুকে কুহুর মাথা চেপে ধরল। তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘ চিন্তা ভাবনার জন্য আমি আছি। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও।’
নিরাপদ ভরসাস্থল খুঁজে পেয়ে কুহু সত্যি সত্যিই চোখজোড়া বন্ধ করল।
মুখে হাসি ফুটল। এইটুকুই তার চাওয়া। মুখ ফুটে না বলতেই সে পেয়েও গেছে। অবাধ খুশিতে তার চোখের কার্ণিশ বেয়ে অঝরে গড়াতে লাগল নোনাজল। সেই জল গিয়ে টি-শার্ট ভেদ করে স্পর্শ করল রিদওয়ানের প্রশ্বস্ত বুক। তবুও কেউ কথা বলল না। নড়লো না। সরলো না। শুধু কুহু উন্মাদের মতো ব্যাকুল সুরে মনে মনে আওড়াতে লাগল, ‘আমি বাঁচতে চাই! সুস্থ জীবন চাই। আমাকে ভালোবাসুন। আগলে রাখুন। কখনো দূরে সরতে দিয়েন রিদ। কখনো না!’
To be continue………!!
#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_ত্রিশ
–
–
–
পরদিন সকালবেলা। তখন সকাল সাড়ে সাতটা। সাড়ে আটটায় ক্লাস।
রিমি কলেজ ড্রেস পরে একেবারে রেডি হয়েই নেমেছে। কলেজ ড্রেসেও তাকে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। একেবারে পরিপাটি লুক!আজও কলেজে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না তার। কিন্তু ম্যাকসন দেখা করার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে। একনাগাড়ে কল/ মেসেজ দিয়ে পাগল করে দিচ্ছে। তার একই কথা দেখা করো, দেখা করো। তাই বাধ্য হয়ে কলেজে যাওয়ার জন্য সে
মনঃস্থির করেছে। পায়ের ব্যথা একটু কমেছে। তবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। সে কাঁধের ব্যাগটা রেখে সোফায় গিয়ে বসল। এইটুকু আসতে গিয়েই হাঁপিয়ে গেছে। সে সোফায় বসেই রান্নাঘরে উঁকি মারল।
আশেপাশে তাকাল। আশেপাশে কেউ নেই আর রান্নাঘরে তার মা মলিন মুখে ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছে। সে মায়ের মুখভঙ্গি দেখে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করল। মায়ের মুখটা রোজকার চেয়ে আজ গুরুগম্ভীর হয়ে আছে।
খুব কেঁদেছে বোধহয়। চোখ মুখ ফুলে আছে। সে যে কিছু বলবে সাহসে কুলাচ্ছে না। যদি ধমকে ওঠে অথবা মারতে আসে, তখন? মায়ের মলিন মুখের কারণ তারও অজানা নয়। তার মা কুহুকে খুব একটা পছন্দ করে না। বিশেষ করে কুহুকে ছেলের বন্ধুর বোন হিসেবে মানলেও, একমাত্র পুত্রবধূ হিসেবে মানতে একেবারেই নারাজ। চরম বিরোধী এই ব্যাপারে।
এমন না উনি ছেলের জন্য মনমতো কাউকে খুঁজে রেখেছিলেন অথবা
অন্য পরিকল্পনা করেছিলেন। তবুও! আসলে ছেলের থেকে আরো বেস্ট কিছু আশা করেছিলেন।কারণ উনি রিদওয়ানকে সেভাবে বড় করেছেন।
সেই অবস্থানে নিয়ে গেছেন। মা হিসেবে যতটুকু করার উনি ঠিক ততটুকু করেছেন। দিনশেষে প্রতিটা মায়ের মতো উনার চাওয়াও ছেলে খুব সুখে থাকুক। ভালো থাকুক। বলা বাহুল্য, কুহুকে উনি রিদওয়ানের যোগ্য মনে
করছেন না। কারণ কুহুর বয়স কম। আবেগী বয়স। তার উপরে অসুস্থ। সব মিলিয়ে ছেলেটা কাকে নিয়ে কত ভালো থাকবেন তা উনার অভিজ্ঞ মস্তিষ্ক বুঝে গেছেন। উনার ছেলেটা কোনদিক থেকে কম? কম তো নয়ই বরং সবদিক থেকেই বেস্ট। মা হয়ে ছেলের থেকে বেস্ট কিছু আশা করা পাপ নয় নিশ্চয়ই! সেসব কথা বিবেচনা করে এই বিয়েতে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। এদিকে ছেলেও প্রচন্ড জেদি। তার কথা, বিয়ে আজ করব আর কুহুকেই করব।’ছেলেকে বোঝানোর পরও এ কথা শুনে উনি আর একটা কথাও বলেন নি। শুধু চুপ করে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করেছিলেন। আর ঘরোয়াভাবে বিয়ের ব্যবস্থা রিদওয়ানই করেছে।
গতদিনের কথা মনে করে রিমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সে ছোটো মানুষ। তাই বড়দের কথার মাঝে কোনো কথা বলে নি শুধু চুপ করে শুনেছে। যে যা করেছে দেখেছে। এছাড়া তার কোনো কাজ নেই। তবে মায়ের মুখ দেখে এখন তার ভীষণ খারাপ লাগছে। কষ্ট হচ্ছে। সে ধীরে ধীরে উঠে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে রান্নাঘরে গিয়ে দরজা মুখো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিশ্চুপ হয়ে দেখল ব্যস্তহাতে কাজ করতে থাকা নিলুফা ইয়াসমিনকে। সে আনমনে সিঁড়ির দিকে একবার তাকিয়ে আমতা আমতা করে ডাকল,
-‘আম্মু!’
-‘বলো।’
-‘কলেজে যাব। খেতে দাও।’
-‘বসো, দিচ্ছি।
-‘ বলছিলাম যে, ভাইয়া এসে তোমাকে এভাবে দেখলে কষ্ট পাবে। প্লিজ ইজি হও।’
– ‘পাক কষ্ট। আমি পাচ্ছি না?’
-‘ছেলে কষ্ট পেলে তোমার ভালো লাগবে?’
-‘লাগবে। সে যদি ছেলে হয়ে মাকে কষ্ট দিতে পারে আমি কেন মা হয়ে তা পারব না?’
-‘বিয়েটা তো হয়েই গেছে। এখন রাগ অভিমান করে কি হবে বলো?’
-‘আমি কি কিছু বলেছি? বলছি না তো। চুপ করেই তো আছি। সে পাগল ছাগল যাকে ইচ্ছে বিয়ে করুক। আমি বলার কে? আর বললে আমার কথা শুনবে কেন? ছেলে বড় হয়েছে। বুঝতে শিখেছে। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে শিখেছে। আমাকে আর কি দরকার? দরকার যেন না লাগে আর। সে ভালো থাকুক তার মতো করে।’
-‘তাই যদি হয়, তাহলে কাঁদছো কেন? কষ্টই বা পাচ্ছো কেন?’
-‘কে বলল কষ্ট পাচ্ছি? আমি কেন কষ্ট পাব? খাচ্ছি, দাচ্ছি, কাজকর্ম সবই করছি।’
-‘ কুহু কিন্তু এমনিতেই খুব ভালো মেয়ে। তুমি ওর সঙ্গে মিশে দেখো..! ‘”
-‘ভালো। অবশ্যই ভালো। আমি কি খারাপ বলেছি? বলার অধিকার কি আমার আছে?সে খুব ভালো বলেই তো জাতে পাতাল হয়েও তাল ঠিক
রেখেছে। অসুস্থ হয়েও তার তালে ঠিক প্রেম চালিয়ে গেছে। সুযোগ বুঝে এখানে এসে বিয়েটাও সেরে ফেলল। খুব ভালো বলেই তো এসব করতে পেরেছে। খারাপ হলে কি পারত? পারত না তো!’
মায়ের কথা শুনে রিমি ভিতু দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকাল। রিদওয়ানের কানে গেলে সকাল সকাল আবার অশান্তি শুরু হবে। সকাল সকাল এই অশান্তি সবার সারাদিনটাকেই মাটি করে দেবে। তাই সচেতন হয়েই স্বর নিচু করে বলল,
-‘আস্তে কথা বলো আম্মু। রুপক ভাইয়া, রিদ ভাইয়া শুনলে কষ্ট পাবে।’
-‘তো? এখন কি আমাকে তাদের ভয়ে চলতে হবে? আমি তাদের টাকায় খাই নাকি পরি? আমার বাসা এটা। আমি আমার টাকায় চলি। না কারো ধার ধারি আর না কাউকে ভয় পাই। তুইও বেয়াদব। তুইও আজ থেকে আমাকে আম্মু বলে ডাকবি না। আমি কারো আম্মু না।’
-‘যাহ্ বাবা, আমি আবার কি করলাম?’
-‘কি করতে বাদ রেখেছিস, বেইমানের দল?’
-‘ আশ্চর্য তো! আমাকে শুধু শুধু বকছো কেন?’
-‘শুধু শুধু বকছি? এই বেয়াদব তুই কেন রিদওয়ানকে বুঝালি না? কেন বিয়েটা কোনোভাবে আঁটকালি না? ভাইয়ের কাছে ভালো সাজার জন্য?
-‘উফ! আজাইরা বকবক থামাও তো আম্মু। বিরক্ত লাগছে কিন্তু।’
-‘লাগবেই তো। আমার কথা এখন সবার কাছেই বিরক্ত লাগবে। আমি
এখন ফেলনা কি না! যখন নাদান ছিলে তখন আম্মুকে দরকার ছিল। এখন চোখ ফুটে গেছে। রাস্তা চিনে গেছো। এখন আর কি দরকার আম্মুকে।’
-‘তুমি শুধু শুধু ভুল বুঝেছো ভাইয়াকে। তুমি নিজেও জানো যে তোমার ছেলে কেমন। তাছাড়া এসব বলে কি লাভ আছে? বিয়েটা তো গতরাতে
হয়েই গেছে। এখন এসব নিয়ে কিছু বলা বা ভাবা মানেই টাইম ওয়েস্ট।
আর ভাইয়া যদি তার পছন্দসই কাউকে বিয়ে করে ভালো থাকে তাহলে থাকুক। সমস্যা কি?’
-‘তাই বলে ওই পাগল মেয়েটাকে?’
-‘ভুলে যাওয়া আর পাগল কি এক হলো?’
-‘হলো তো। সে তো পাগলই…!’
-‘মা! চুপ করো। দয়া করে আস্তে কথা বলো। ভাইয়া শুনে কষ্ট পাবে।’
-‘শুনুক। আমি কখনো ওই পাগল মেয়েকে মন থেকে মেনে নিবো না। সে যদি আমার পায়ের নিচে লুটিয়ে পড়ে থাকে তাও…।’
নিলুফা ইয়াসমিন উনার পুরো কথাটুকু শেষ করতে পারলেন না। হঠাৎ উনার নজর গেল ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে থাকা রুপকের দিকে। রুপক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নিচু করে থাকায় মুখের ভাবগতি বোঝার
উপায় নেই। পরনে জগিং শুট। হয়তো কেবল জগিং করে ফিরছে। মাকে কথার মাঝখানে থামতে দেখে রিমি উনার দৃষ্টি অনুকরণ করে পেছনে তাকাল। যেটা ভয় পাচ্ছিল তাইই হলো। সে মায়ের দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি ছুঁড়ে মুখে জোরপূর্বক হাসি এঁটে বলল,
-‘ গুড মনিং!’
রিমির কথা শুনে রুপক একবার চোখ তুলে তাকাল। ছলছল চোখ নিয়ে একপলক তাকিয়ে দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।ভেজা স্বর লুকানোর আপ্রাণ
চেষ্টা চালিয়ে ভাঙা ভাঙা স্বরে জবাব দিলো, ‘মম ম ম..নিং।’ ভাঙা ভাঙা ভেজা স্বর আর লাল টকটকে চোখ দেখে রিমি থ। সামনের দাঁড়ানো এই সুদর্শন পুরুষের মনোভাব বুঝতে তার সময় লাগল না। বুঝল এক বোন পাগল ভাই সে। বোনকে নিয়ে কোনো কটু কথা সহ্য করতে পারে না সে।
তার চোখ আর গলার স্বর শুনে তার বুকেও কেন জানি চিনচিনে ব্যথার অনুভব হলো। খারাপ লাগল। ভীষণ কষ্টও লাগল। মনে হলো আজকের পরিস্থিতি উল্টো হলে কেমন হতো?রুপককের জায়গায় রিদওয়ান আর
কুহুর জায়গায় সে থাকলে কি হতো? মুখে ঝরঝর করে অনেক কথায়
বলা সহজ। কিন্তু অপর জনের জায়গায় দাঁড়িয়ে তার কষ্ট অনুভব করা এতটাও সহজ না। যদি তাই হতো তাহলে কুহুর মতো বাসার খুব আদুরে মেয়ে গুলোর জীবনে কষ্ট বলে কিছু থাকত না। এমন হতো, তাদের কষ্ট পাওয়া মাত্রই বাবা -মা কিংবা রুপককে মতো ভাইরা তাদের কষ্ট ছিনিয়ে নিয়ে নিজের কাছে তা রেখে দিতো।আসলেই কি এমন হয়? হয় না। যার
যার কষ্ট তাকেই ভোগ করতে হয়। এত ঝড় ঝাপটার পর গতরাতে তার বোনের বিয়ে হয়েছে। অথচ সকাল হতে না হতেই এসব শুনলে পৃথিবীর কোন ভাইয়া সহ্য করতে পারবে? এড়িয়ে যেতে পারবে?
রিমি কি বলবে আর কথা খুঁজে পেল না। রুপকও আর না দাঁড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। চলে যাওয়া না ঠিক, এটাকে বোধহয় বলে পালিয়ে বাঁচা। বোনকে নিয়ে বলা কথাগুলো শুনে সে দমবন্ধ করে দাঁড়িয়ে ছিল। শোনার ইচ্ছে ছিল না তবে কিভাবে যেন নিলুফা ইয়াসমিনের কথাগুলো তার কানে পৌঁছে গেল। খুব ভোরে সে যখন জগিং করতে বের হয়েছিল, মনে হয়েছিল আজকের সকালটা খুব, খুব,সুন্দর। বুকের ভার কমেছিল
তাই বোধহয় সবকিছু সুন্দর লাগছিল। এখানে আসার পর রিদওয়ানই তাকে জগিং করতে যাওয়ার সময় ডেকে নিয়ে যেতো। আজ রিদওয়ান ডাকে নি। ওঠেও নি। সেও আর তাদের ডেকে বিব্রত করে নি। তাই একা বের হয়েছিল। এবং জগিং করতে যাওয়ার সময়’ই কুহুকে মেসেজ করে বলেছিল, তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতে। শাশুড়ীর হাতে হাতে কাজ করতে। মুখে মুখে ডাকতে। কুহু ওঠে নি। হয়তো সজাগ’ই হয় নি।
ছোটো মানুষ সে। সংসারের মারপ্যাঁচ বোঝে না। তার উপরে অসুস্থ’ও।
সে জানে না কি হবে? রিদওয়ান কিভাবে সব সামলাবে? তবে তার মনে হচ্ছে বিয়ে দেওয়া বোধহয় ঠিক হয় নি। রোজকার এসব ঝামেলায় কুহু আরো অসুস্থ না হয়ে যায়। কিছুক্ষণ আগে যে সকালকে তার খুব সুন্দর লাগচ্ছিল, এখন সেই সকালকেই মনে হচ্ছে আজকের সকালের মতো তিক্তপূর্ণ সকাল তার জীবনে আসে নি। রুপক সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে তার চোখ ভিজে গেল। দু’ফোটা পানিও গড়িয়ে গেল গাল বেয়ে। দু’চোখ মুছে সিঁড়ির শেষ ধাপে পা রাখতেই সে আচমকা রিদওয়ানের মুখোমুখি হলো। রিদওয়ান রুপকের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলল না। শুধু এক পলক নিচের দিকে তাকিয়ে সাইডে সরে দাঁড়াল। তা দেখে রুপক মলিন হেসে ফ্রেশ হওয়ার নাম করে চলে গেল।
একটুপরে কুহুও নিচে নামল। খুব সুন্দর একটা থ্রি পরেছে। তার মনটাও আজ খুব ভালো। তবে সকালের ঘটনার জন্য সে একটু বিব্রত, লজ্জিত।
তবে লজ্জিত ভাবটুকু এখনো লেগে আছে তার রক্তিম আদুরে গাল ও চোখের তারায়। সকালে ঘুম ভাঙার পর রিদওয়ানকে পাশে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল। বোঝার চেষ্টা করছিল ভাবনা নাকি সত্যি।
মনে করার চেষ্টা করছিল রিদওয়ান এখানে কেন! তখন চোখ বন্ধ করা অবস্থায় রিদওয়ান বলল,
-‘ওহে সুন্দরী মানবকন্যা, আমি আপনার হতভাগা স্বামী। গত রজনীতে আপনার এবং আমার বিবাহ সম্পূর্ণ হইয়াছে। বৈধ বিবাহের জোরে এই কক্ষে ও একই শয্যয় রাত্রি যাপন করিবার দুঃসাহস দেখিয়াছি। আপনি
দয়া করিয়া উত্তেজিত হইবেন না। মস্তক ঠান্ডা রাখিয়া ভাবিলেই সমাধা পাইয়া যাবেন।’
-‘কি আশ্চর্য! এভাবে কথা বলছেন কেন?’
-‘না বলে উপায় আছে? যেভাবে তাকিয়ে ছিলে মনে হচ্ছিল আমাকে পাশে দেখামাত্র চিৎকার করে আমার মান সন্মান নিলামে তুলে ফেলবে।
তাই আগেই বললাম এটা স্বপ্ন নয় সত্যি!’
-‘ আমার মনে আছে।’
-‘সত্যি মনে আছে?’
-‘আছে।’
-‘কিভাবে? তুমি না বলো তুমি আজকাল কথা ভুলে যাও, তাহলে?
-‘ওই যে আপনার রুমের বাম দেওয়ালে লেখা রিদওয়ান আর কুহুর বাসরঘর। বিয়ে ছাড়া বাসরঘর কে সাজাবে?’
-‘যাক ঘটে বুদ্ধি আছে তাহলে। এখন ঝটপট ফ্রেশ হয়ে নাও নিচে যাব।’
-‘ হুম।’
-‘আর শোনো, একটুপরে ডেইজি আসবে। যা যা জানতে চাইবে বলবে, ওকে? ভয় নেই আমি ওখানেই থাকব।’
-‘হুম। তবে আপনি কিন্তু বলে দিবেন বেশি মেডিসিন যেন না দেয়।’
-‘ঠিক আছে বলে দেবো। আর কিছু?
-হুম, ‘আর একটা কথা।’
-‘বলো।’
-‘এখানে ট্যাটু করে কোথায়? আমি হাতে ট্যাটু করব।’
-‘ট্যাটু? হঠাৎ ট্যাটু করার ইচ্ছে হলো কেন?’
-‘মন ভোলা মানুষ আমি। যদি বিয়ের কথায় ভুলে যাই? তাই হাতে ট্যাটু করে লিখে রাখব, ‘আমি রিদওয়ানের বিয়ে করা বউ।’
একথা শুনে রিদওয়ান উঠে বসল। কুহুর এলোমেলো চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিলো। তারপর কপালে আলতো করে আদর এঁকে বলল,
-‘ওসবের দরকার নেই। আমি আছি না? তুমি যতবার ভুলে যাবে আমি ধৈর্য্য সহকারে ততবার তোমাকে মনে করিয়ে দেবো। এসব নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। তুমি শুধু আম্মুর কাছে থাকবা। যতক্ষণ না তোমাকে দেখে আম্মু আদর করে বুকে টেনে নেয়, ততক্ষণ তুমি পিছু ছাড়বে না। বকলেও না, মারলেও না, মনে থাকবে?’
-‘ আন্টি আমার উপর রেগে আছে? কিন্তু আমি তো কিছু করি নি।’
-‘তোমার উপর না রে পাগলি আমার উপর রেগে আছে। বিয়ের বন্ধনে যেমন আমি তোমার, আমার রুম তোমার, আমার মা তোমার, এমনকি আমার করা দোষও তোমার। তাই তোমাকে আর আমাকে আম্মুর বকা খেতে হবে কিছুদিন। তারপর দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর শোনো,
প্রতিটা স্বামীদের ভালো ও মন্দ কাজের ফল স্ত্রীদেরও ভোগ করতে হয়। সেই হিসাব অনুযায়ী আমার দোষে তোমাকেও একটু আধটু বকা খেতে হবে। বকা খেয়ে মন খারাপ করা যাবে না কিন্তু। মায়েরা ভালোর জন্যই বকে তাই না?’
-‘হুম।’
-‘আন্টি না। আমার আম্মুকে তুমিও আজ থেকে আম্মু ডাকবে সরাসরি।
যতই বকুক পিছু ছাড়বে না।’
-‘আচ্ছা।’
-‘এই মুহূর্ত থেকে তোমার মিশন শুরু। যদি এই মিশন ঠিকঠাকভাবে শেষ করতে পারো তাহলে তোমার জন্য একটা গিফট আছে।’
-‘কি গিফট শুনি?’
-‘তুমি যা চাইবে তাই।’
-‘ওকে।’
রিদওয়ান বলা কথাগুলো শুনে কুহু মন দিয়ে ভাবল। তারপর দ্রুত উঠে তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হতে চলে গেল। আজকে থেকেই তার মিশন শুরু।
সেও প্রস্তুত। শাশুড়ী মা কতদিন মুখ ফিরিয়ে থাকবে? মার খাবে তবুও পিছু পা হবে না। শাশুড়ির মন জয় করেই ছাড়বে। এসব ভেবে সে খুশি মনে নিচে নামল। কিন্তু… সে হয়তো ভুলে গিয়েছিল পরিস্থিতি সব সময় এক থাকে না। আর পরিস্থিতির কড়াঘাতে সব পরিকল্পনা সফল হয় না।
To be continue………!!