#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_তেতত্রিশ
–
–
–
কুহুকে কেবিনে রেখে রিদওয়ান গেছে মিটিংয়ে এটেন্ড করতে। যাওয়ার ঘন্টা খানিক পেরিয়ে গেছে৷ এরমধ্যে একজন এসে অনেক খাবার দিয়ে গেছে। সে এখনো খাবার ছুঁয়েও দেখে নি। রিদওয়ানের ফোন হাতে নিয়ে
গ্যালারির ছবিগুলো দেখছে।তার একেকটা ছবি একেক রকমের সুন্দর। বলা বাহুল্য, চোখ ধাঁধানো সুন্দর। ছবি গুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ তার
ভ্রুঁ কুঁচকে গেল। ছবিগুলো দেখতে দেখতে ভাবতে লাগল, ‘পুরুষ মানুষ এত সুন্দর হবে কেন? কেন সুন্দর হবে তার বাঁকা দাঁতের হাসি?’ সে বেশ মন দিয়েই ছবিগুলোর খুঁত বের করার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। ব্যর্থ হয়ে ফোনের কোথায় কি আছে, কার সঙ্গে কথা বলেছে, কে, কাকে, কি মেসেজ করেছে তাও দেখল। বাদ রইল না মেসেঞ্জার, মেটা, ইন্সট্রাগ্রাম। সবকিছু চেক করে চোখে পড়ার মতো তেমন কিছুই পেল না। যেগুলো পেলো সেসবের আগা মাথা কিছুই বুঝল না। তাই তার আইডি ট্যাগ না করেই মেরিড স্ট্যাটাস দিলো। ঠোঁটে টানল দুষ্টু হাসি। বিবাহিত হয়েও সিঙ্গেল সাজা হচ্ছে? তা তো হতে দেওয়া যাবে না। এরপর সে কেবিনটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, রিদওয়ানের চেয়াল বসে রইল। গা এলিয়ে বসে পুনরায় ছবিগুলো দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেল।অসময়ে ঘুমানোর বান্দা সে না। এটা সকালে খেয়ে আসার ওষুধের প্রভাব।
–
–
–
অ্যাঞ্জেলিনা নামের নামিদামী একটা কফিশপে বসে আছে রিমি। তার ঠিক মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে ম্যাকসন। রিমির তথাকথিত বিদেশী বয়ফেন্ড। তাদের দু’জনের সামনে রয়েছে ক্যাপাচিনো। অথচ কেউ সিপ নেওয়া দূর, ছুঁয়েও দেখে নি। আদৌও কেউ ছোবে নাকি তাতেও সন্দেহ। কারণ তাদের মধ্যে চলছে বাকদন্ড। দু’জনেই যেন তৈরি হয়েই এসেছে, আজকের দ্বন্দে বিজয়ী হওয়ার উদ্দেশ্যে। এসে অবধিই আক্রমণাত্নক কথা বলে যাচ্ছে দু’জন। শান্ত স্বভাবের ম্যাকসনও থামছে না। সে রিমির প্রতিটা কথার পাল্টা যুক্তি দাঁড় করাতে ব্যস্ত। এবং তার কথার ভঙ্গিমায় সুস্পষ্ট অজ্ঞাত কোনো কারণে সে ভীষণ চোটে আছে। এতদিন সে কেন মিট করে নি, ভালোভাবে কথা নি, কেন ইগনোর করেছে, কোন যুক্তিতে ইগনোর করেছে, এমন নানান বাকদ্বন্দের একপর্যায়ে ম্যাকসন হ্যাৎ বলে উঠল,
-‘আই ওয়েন্ট টু হ্যাভ সেক্স উয়িথ ইউ।’
-‘হোয়াট! আর ইউ ক্রেজি? হোয়াট আর ইউ সেয়িং?’
-‘ আ’ম ইয়োর বফ। আই হ্যাভ দ্যা রাইট টু টাচ্ ইউ।’
-‘ (…..)’
-‘ লিমি লুক এট মি এ্যান্ড আনসার মাই কোশ্চেন। ডো’ন্ট ইউ লাভস্ মি?
টেল মি লিমি।’
-‘ ইয়েস।’
-‘সো হোয়ার ইউ ইয়োর প্রবলেম? লেটস্ গো।’
-‘নো, নেভার। আই ও’ন্ট গো।’
রিমির মুখে না শব্দ শুনে ম্যাকসন দাঁতে দাঁত খিঁচে বসে রইল। এতক্ষণ বোঝানোর পরেও সেই একই কথা। বাঙালি মেয়েরা এত ঘাড়ত্যাড়া হয় আগে জানত না সে। জানলে হয়তো এমন গোঁয়ার মেয়ের সঙ্গে রিলেশন করত না। হাত ধরতে দেবে, কিস করতে দেবে না, ডেটে যাবে না, বারে যাবে না, ড্রিংকস করবে না, সবকিছুতে না, না আর না।এমন করলে কী রিলেশন টিকবে? বফকে যখন সন্তুষ্ট’ই করতে পারে না তখন রিলেশনের কি দরকার? ম্যাকসনকে রাগে দুঃখে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। ভীষণ বিরক্ত লাগছে সামনে বসা রিমির দিকে তাকাতে। তখন রিমি বলল,
-‘ ডু ইউ ওয়েন্ট টু ব্রেকআপ ফর সাম রিজন?’
-‘(..)’
-‘ম্যাক আনসার মাই কোশ্চেন?’
-‘ইয়েস, আই ওয়েন্ট টু ব্রেকআপ। বিকজ ইউ ডো’ন্ট ডির্জাভ টু বি ও লাভার।’
-‘ আই ডো’ন্ট লস মাই ভার্জিনিটি সো আ’ম ডিসকোয়ালিফাইড? হা,হা, হা, ওকে, দ্যাটস্ ইট।’
রিমি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ম্যাকসনের দিকে৷ যেন চোখ দিয়ে ভষ্ম করে দেবে। দেহ কাঁপছে থরথর করে। তাদের রিলেশনের পূর্ব শর্ত’ই ছিল বিয়ের আগে এসব আবদার করা যাবে না। অথচ ম্যাক তা ভুলে গেছে।
সন্দেহের বশে অবিবেচকের মতো কথা বলছে। এমন না ম্যাক জানে না তার কালচার সম্পর্কে। তাছাড়া সেও খুব ভালো করেই জানে রিমি এই আবদারে রাজি হবে না। তারপরেও…। তার এখন ইচ্ছে করছে ম্যাকের মাথাটা ধরে দেওয়ালে ঠুকে দিতে। নয়তো ইট দিয়ে তার সুন্দর মুখখানা থেঁতলে দিতে। যাতে ভুল ভবিষ্যতেও আর কখনো এসব কথা উচ্চারণ না করে। রিমি সত্যি সত্যি ব্রেকআপ করে যখন উঠতে যাবে তখন ম্যাক তার হাত চেপে ধরল। ঠান্ডা মাথায় কথা বলার অনুরোধ করল। রিমি ও বসল। ম্যাক এবার ধীরে সুস্থ বলল, ইন্টিমেন্ট হতে হবে না শুধু তার নুড পিক দিলেই হবে। এবং সেই পিক সে নিজেই তুলবে। এজন্য তাকে এখন ম্যাকসনের ফ্ল্যাটে যেতে হবে। বফ হিসেবে অন্তত তার এইটুকু আবদার পূরণ করুক। রিমি নিশ্চুপ। তার মতে, বফ হলে কী নুড পিক দিতে হবে? নগ্ন দেহের ভাঁজ দেখাতে হবে? এ আবার কেমন ভালোবাসা? নাকি এটা প্রেম? প্রেম আর ভালোবাসা কি এক নয়? তাকে নিশ্চুপ দেখে ম্যাকসন সাহস পেলো সে আরো সুন্দর করে বোঝানোর জন্য জানাল, সে সুন্দরী। তার শারীরিক গঠনও মারাত্মক সুন্দর। সুন্দর কিছু ঢেকে রাখতে নেই।
সবাইকে দেখানোর জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হয়। তাছাড়া বফ হিসেবেও গফের শরীর দেখার অধিকার আছে তার। সে দেখতেই না অনেক কিছু করতেও পারে। এখানে এটা কমন ব্যাপার। এই অবধি ম্যাকসনের কথা শুনেও রিমির টু শব্দ করল নি। নিরাবতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে ম্যাকসন উঠে এসে তার পাশে বসল। একবারে শরীরের সঙ্গে শরীর মিশিয়ে। তার পুরুষালি এক হাত রাখল রিমির ডান উরুর উপর। রিমি হাতটা সরিয়ে
দিতেই ম্যাকসন ফিচেল হেসে ঝরঝরে ইংলিশে ফিসফিস করে বলল,
-‘এই শপের থার্ড ফ্লোরে রুম ভাড়া করা যায়, যাবে?’
-‘না।’
-‘কেন, ডালিং? চল যাই?’
-‘ হাত সরাও। ‘
-‘কেন সরাবো? আমার স্পর্শ ভালো লাগছে না? কার স্পর্শ ভালো লাগে তোমার ভাইয়ার ফ্রেন্ডের স্পর্শ ভালো লাগে, হুম?’
-‘ম্যাক মুখ সামলে কথা বলো। নয়তো এরপর যা হবে মোটেও ভালো হবে না।’
-‘ ভুল তো বলি নি। ওই ব্ল্যাডি বিচ আসার পর থেকে তুমি আমাকে কেন জানি ইগনোর করো।দেখা করতে চাও না। কথা বলতে চাও না।সবসময়
গা ছাড়া ভাব দেখাও। কতদিন ধরে বলছি ডেটে যাওয়ার জন্য। রাজিও হচ্ছো না। এমনকি কিস করতে দাও না। টাচ্ করতে দাও না। ভেবেছো আমি কিছুই বুঝি না?তার টাচ্ পেয়ে এখন আমাকে আর ভালো লাগছে না?’
-‘ তাকে আমি বড় ভাইয়ের মতো সন্মান করি। তাই বলছি, তাকে নিয়ে নোংরা কথা বলবে না।’
-‘জানি তো,দিনে ভাইয়ের মতো সন্মান করো আর রাতে তার সঙ্গে শুয়ে পড়ো, তাই না? আজ আমাকেও সুযোগ দাও আমিও তোমার দেহ- মন স্যাটিসফাইড করব।’
-‘লাস্টবার ওর্য়ানিং দিচ্ছি মুখে লাগাম টানো ম্যাক।’
-‘ কেন হানি? খারাপ কি বলেছি?’
-‘আমার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙো না ম্যাক, প্লিজ।’
-‘কেন? সত্যি কথা গায়ে লাগছে? রাত ভর তার সঙ্গে মজামাস্তি করে পা মচকানোর অজুহাত দেখাও। সব খবর আসে আমার কাছে। আর এসব বলে ছাড় পাবে না আজ। তুমি যদি আমাকে ভালোই বাসো তাহলে থার্ড ফ্লোরে চল। ছুঁতে দাও তোমার এই আবেদনময়ী দেহ। মেনে নাও সর্বাঙ্গে ছুঁয়ে যাওয়া আমার স্পর্শ। ধরে নাও, এটাই হবে তোমার ভালোবাসার পরীক্ষা।’
-‘পরীক্ষা?’
-‘হ্যাঁ পরীক্ষা। ‘
-‘তা কেন দেবো পরীক্ষা?’
-‘ভালোবাসার প্রমাণ দিতে।’
-‘যদি না দেই?’
-‘তাহলে ব্রেকআপ।
-‘ ভার্জিনিটি দিয়ে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে?’
-‘হবে।’
-‘ ওকে তাহলে সেকেন্ড অপশন চুজ করলাম। ব্রেকআপ! তোর নামের ভালোবাসা তুই গুলে খা। দরকার নাই তোর ভালোবাসার। মর তুই। আর কি বললি তুই রুপকের সঙ্গে মাস্তি করি? হ্যাঁ করি, বেশ করি, প্রয়োজনে আরো করব। এবার যা পারিস করে নে।’
একথা বলে রিমি হনহন করে বেরিয়ে গেল। ম্যাকসন এতবার ডাকলেও শুনল না। তবে সে বাসায় যেতে যেতে একটা সিদ্ধান্ত নিলো। সিদ্ধান্তটা জানাতে সে গেল তার মায়ের শপে।
To be continue….!!
#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_চৌত্রিশ
–
–
–
অফিস থেকে বেরিয়ে দুপুরের লাঞ্চ সেরে রিদওয়ান আর কুহু এসেছে ডেইজির চেম্বারে। ক’জনের পরেই কুহুর নাম ধরে ডাকলে তারা ভেতরে প্রবেশ করল। বসল পাশাপাশি চেয়ারে৷ ডেইজি কুহুর সঙ্গে কথা বলছে।
মূলত ফানি কথা বলে কুহুকে ইজি করার চেষ্টা করছে। তার কথা শুনে কুহুও খিলখিল করে হাসছে। হাসির কারণ ডেইজি রিদওয়ানকে নিয়ে ফান করছে। এত ফানি কথা বলছে যার কারণে কুহু না হেসেও পারছে না৷ তবে রিদওয়ান এখানে নীরব দর্শক। একপর্যায়ে ডেইজি মূল পয়েন্টে এলো। হাসতে হাসতে কথার মাধ্যমেই কুহুর কিছু সমস্যার কথা জেনেও নিলো। আবার ফান করল। আবার হাসল। এরপর আবার কুহুর সমস্যা নিয়ে কথা তুলল। তারপর তার কথাগুলো মন দিয়ে শুনল। কথা বলতে বলতে কথা ভুলে যায় নাকি তাও খেয়াল করল। এবং কথার মাধ্যমেই ডেইজি ধরে নিলো কুহুর আরো কিছু সমস্যা। এভাবে’ই বেশ কিছুক্ষণ সময় গেল। এমন না করলেপেশেন্ট বিরক্ত হয় কথা বলতে চায় না। আর কথা না বললে তার সমস্যাগুলো সহজে ধরা যায় না। তারপর ডেইজি বেশ কিছু মেডিসিন লিখে দিলে এবং তারা বেরিয়ে এলো। ডাক্তারের কাছে এসে আজ কুহুর কান্না পেলো না। মন খারাপ হলো না। কষ্ট হলো না কারণ তার রোগের নাম নাকি রিদওয়ান রিদ। এরপর তারা সেখান থেকে বেরিয়ে মেডিসিন শপে এলো। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মেডিসিন নিয়ে রিদওয়ান গাড়িতে বসেই তাকে দুপুরের মেডিসিন খাইয়ে দিলো। বাসায় ফোন দিয়ে রুপকের খোঁজ নিলো। রুপক খেয়েছে। শুয়ে শুয়ে গেম খেলছে। রিমিও আর তার বাবাও নাকি কিছুক্ষণ আগে ফিরেছে।
এরপর তারা বাবা মেয়ে আবার কোথাও যেন বেরিয়েছে। একথা শুনে রিদওয়ান আর কথা বাড়াল না সাবধানে থাকতে বলে কল কেটে দিলো।
এরপর তারা গেল নীল পানির লেক দেখতে। মাথার উপর ঝকঝকে স্বচ্ছ আকাশের দেখা পেতো। পাহাড়ের গায়ের ঘ্রাণ নিতে। এতদিন পর ঘুরতে পেরে কুহুর ভীষণ ভালো লাগছিল। তার ওষ্ঠে হাসি লেগে আছে। চোখ মুখে ঝরছে অপার খুশি। কিছুক্ষণ ড্রাইভ করে রিদওয়ানরা এলো কাঙ্ক্ষিত সেই স্থানে। গাড়ি থেকে নেমে কুহুর হাত ধরে এগিয়ে গেল নীল পানির লেকের দিকে। নীল পানির লেক দেখে কুহুর মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল। জায়গাটা এত সুন্দর! সৌন্দর্যে ভরপুর। এজন্যই বুঝি এ দেশকে স্বর্গ বলা হয়। সে প্রাণ ভরে শ্বাস নিলো। তারপর বেশ কিছুক্ষণ লেকের পানির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-‘ লেকের পানি নীল হয় কেন?’
-‘দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে লেকের পানি নীল দেখায়। অল্প পরিমাণে পাণি বর্ণহীন দেখায়। কিন্তু লাল তরঙ্গদৈর্ঘ্যে আলোর সামান্য শোষণের ফলে জলের একটি অন্তর্নিহিত নীল রঙ রয়েছে। আরপরিষ্কার দিনে জল নীল দেখায় কারণ আকাশের নীলতাকে প্রতিফলিত করে। মেঘলা দিনে, বড় জলাশয়গুলি আবার ধূসর বর্ণের দেখায়।’
-‘জটিল সব ব্যাপার স্যাপার।’
-‘কই, সহজই তো।’
-‘ আচ্ছা এখানে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর বানাতে দেবে না? আমি এখানে থেকে যেতে চাই। যানজটের শহর ভালো লাগে না আর। এখানে বাতাস থেকে শুরু সবকিছু যেন মন ভালো করা মাধ্যম।’
একথা শুনে রিদওয়ান কুহুর মাথার তার কাঁধে টেনে নিলো। হাতের পাঁচ আঙুলের মাঝে গুঁজে দিলো তার আঙুল। কুহু নিশ্চুপ। চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে এই মোহনীয় মুহূর্তটাকে। উপলব্ধি করছে পাশে বসা তার ব্যক্তিগত পুরুষটাকে। তখন রিদওয়ান ডাকল,
-‘কুহু।’
-‘হুম।’
-‘ রুপক দেশে চলে গেল থাকতে পারবে না আমার কাছে? শুধু তুমি আর আমি। আমাদের দু’জনের একটা সংসার হবে। তুমি নিজে সাজাবে তোমার সংসার।’
-‘ না।’
-‘কেন?’
-‘ আমি এর আগে কখনো বাবা মাকে ছাড়া থাকি নি৷ এই প্রথম তাও আবার এতদূরে। এবার ভাইয়াও যদি চলে যায় তাহলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে আমার। ম’রে যাব আমি।’
-‘আমি আছি তো। সব সময় তোমার কাছে থাকব। ভালোবাসব। তবুও থাকবে না? আচ্ছা এটা বলো আমাকে রেখে যেতে তোমার কষ্ট হবে না?
মন কাঁদবে না?’
-‘হুম।’
-‘তাহলে থেকে যাও আমার কাছে বাকিরা দেশে চলে যাক। কিছুদিন পর নাহয় আমরাও যাব।’
-‘সবার সঙ্গে গেলে কি হবে? আপনিও দেশে ফিরে চলুন। ফিরে কলেজে জয়েন্ট করুক। শিক্ষক হিসেবে পারফেক্ট ছিলেন। আপনি আসার পর সবাই আপনাকে খুব মিস করেছে।’
-‘এতকিছু জানি না শুধু জানি আমি ছাড়া তুমি দেশে যাবে না, ব্যস!
-‘গেলে কি হবে?’
-‘ নিঃশ্বাস আঁটকে মা’রা যাব।’
-‘তাহলে আপনিও চলুন।’
-‘হঠাৎ করে যাব বললেই কি যাওয়া যায়? গুছিয়ে নিতেও তো সময়ের প্রয়োজন। তাছাড়া যে প্রজেক্টে কাজ করছি মাঝপথে ছেড়ে দেওয়ারও কোনো ওয়ে নেই।’
-‘এসব গুছিয়ে নিতে কতদিন লাগতে পারে?’
-‘মাস তিনেক তো লাগবেই।’
-‘ আচ্ছা।’
-‘আজ সকালে আম্মুর ব্যবহারে খুব কষ্ট পেয়েছিলে?’
-‘না তো। মায়ের বকা খাওয়ার অভ্যাস আছে আমার। মারও খাই। ‘
একথা শুনে রিদওয়ান হাসল। কুহুর হাত ধরে বসে পড়ল নরম ঘাসের উপর। এরপর দু’জনে তাকিয়ে রইল নীল জলের লেকের দিকে। অদূরে থাকা পাহাড়ের দিকে। কথা নেই। শব্দ নেই। শুধু দু’চোখ ভরে দেখতে লাগল সৃষ্টিকর্তার তৈরি সৌন্দর্যকে। এরপর সন্ধ্যায় আগ মুহূর্তেই তারা বাসায় ফিরল। নিলুফা ইয়াসমিন এখনো আসে নি। উনার ফিরতে রাত হবে। তখন রুপক আর রিমি রান্নাঘরে কিছু একটা করছিল। কুহু ফ্রেশ হয়ে এসে তাদের সঙ্গে জয়েন হলো। আজ রুপক রান্না করছে। কি যে রান্না করছে কে জানে। তবে তাদের তিনজনের খিলখিল করা হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে দো’তলাতে বসেও।
রাত তখন সাড়ে ন’টা। রাতের খাবার খেতে বসেছে সবাই। তখনই জানা গেল রিমি তার বাবার সঙ্গে দেশে ফিরবে। টিকিটও কনফার্ম। রিদওয়ান ভ্রুঁ কুঁচকে কিছু বলার আগে নিলুফা ইয়াসমিন বাঁধ সাধলেন। তিনি অন্য কথা তুলে এই প্রসঙ্গের লাগাম টানলেন। কুহু তার ঘুরতে যাওয়ার কথা সবাইকে জানাল। কি কি দেখেছে গড়গড় করে তাও বলল। তার খুশির আভাস মুখখানাতেও যেন সুস্পষ্ট। আগের সেই চঞ্চলতাও চোখে পড়াে মতো। রুপক বোনের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে রিদওয়ানের দিকে তাকাল। এরপর কিছু না বলে খাওয়াতে মন দিলো।পাশাপাশি দু’জনকে বেশ মানিয়েছেও। দেশে থাকতে কুহুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়াটা যেন যুদ্ধের সামিল। আবার ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে মন মরা থাকে। কারো সঙ্গে কথা বলে না। খায় না। মেডিসিন খাওয়ানোর কথা আর কী বলবে। অথচ আজকের দৃশ্যটা যেন অন্যরকম। তার মনটা খুশিতে ভরে গেছে। মন থেকে দোয়া আসছে প্রিয় বন্ধুর প্রতি। সবকিছু ঠিক হওয়ার
আশা দেখছে। আভাসও পাচ্ছে বোনকে সে সঠিক মানুষের হাতেই তুলে দিয়েছে। সারাদিন শুয়ে বসে থেকে বিকেল রিমির সঙ্গে সে হাঁটতে বের হয়েছিল। আশপাশটা ঘুরে ফেরার সময় একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে।
ম্যাকসন নামের একটা ছেলে এসে রিমির হাত ধরে টানতে থাকে। রাগে হিসহিসিয়ে জানায় রিমিকে তার সঙ্গে যেতে। রিমির চেনা ভেবেই রুপক দাঁড়িয়ে দেখছিল। হঠাৎ রিমি ছেলেটার গালে সপাৎ করে চড় বসিয়ে তার বাহু জড়িয়ে ধরে বলে বসল,
-‘এটা আমার উডবি হাজবেন্ড। তাকে আমি ভালোবাসি৷ সামনের মাসে বিয়ে আমাদের। আর কখনো আমার সামনে আসবি না। যদি আসিস তাহলে পুলিশ কল করব।’
এরপর আর দাঁড়ায় নি সে। তার হাত ধরে টানতে টানতেই বাসায় ফিরে এসেছে। তবে আসার সময় রিমি জানিয়েছে ম্যাকসনের কথা। বলেছে, সেদিনের ঘটনাও। সরিও বলেছে, এসব বলার জন্য নাহলে ম্যাকসনকে থামানো যেতো না। রুপক ব্যাপারটা সহজভাবে নিয়েছে। এবং রিমিকে বুঝিয়েছে। এরপর রিমির মন ভালো করতে তার হাতের বানানো সেইই স্পেশাল বিরিয়ানি রান্না করেছে। সঙ্গে জালি কাবাব। টেষ্টও অসাধারণ।
গম্ভীর মুখে খেতে থাকা নিলুফা ইয়াসমিনও জানালেন রান্না খুব ভালো হয়েছে। রুপক শুনে খুশি হলো। ভদ্রতা সূচক হাসল। রিদওয়ানের মুখে কথা নেই। সে একমনে খাচ্ছে। সে জানে রুপক রাঁধতে পারে। এর আগে বহুবার খেয়েছে তার হাতের রান্নাবান্না তাই আলাদা করে কিছু বলল না।
এদিকে কুহু, রিমি, আতিকুল রহমান একবার খেয়ে আবারও নিয়েছে।
তাদের মধ্যে বাজি চলছে। যেই হারবে আজ তাকে এঁটো বাসন মাজতে হবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে হেরেছে, আতিকুল রহমান। আর হেরেও খুশি তিনি। হাসছেন প্রাণ খুলে। কিছু হার এনে দেয় অপার খুশি। ফলস্বরূপ তিনি এঁটো বাসন মাজতে লেগেও গেলেন। তবে সাহায্য করল সকলেই।
যেমন, উনি মাজলেন আর কুহু সেসব থালা বাসন ধুলো। রিমি সেগুলো সাজিয়ে রাখল। রিদওয়ান আর রুপক ডায়নিং টেবিল পরিষ্কার করল। ব্যস, হাতে হাতে সব কাজ শেষ। এরপর আরো কিছুক্ষণ চলল গালগল্প, হাসাহাসি। এরপর সবাই যার যার রুমে চলে গেল। তবে এই সময়টুকুতে
নিলুফা ইয়াসমিন শুধুই চুপ করে দেখলেন। উপলব্ধি করলেন ব্যখাহীন কিছু সুখ মুহূর্তের কথা। তবে উনার মুখ দেখে কিছু বোঝা গেল না। তবে উনি মনে খুশি হলেন কারণ এই বাসায় এমন স্নেহমাখা দৃশ্য এ প্রথম কী না তাই!
বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। পুরো বাড়ি এখন নীরাবতায় ছেঁয়ে আছে। রাত এখন প্রায় একটার কাছাকাছি। কুহু বকবক করতে করতে ঘুমে তলিয়ে আছে। রিদওয়ান এতক্ষণ পাশে বসে লেপটপে কাজ করছিল। টানা কয়েক ঘন্টা কাজ করে কোমর, পিঠ, লেগে গেছে। ঘাড়টা ব্যথা করছে।
সে লেপটপে ডেক্সের উপর রেখে জানালা ভালো করে আঁটকে একবার নিচে গেল। নিচে সবকিছু ঠিকঠাক দেখে ফ্রেশ হয়ে শুতে এলো। পাশেই
কোল বালিশ বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে একটা জীবন্ত পুতুল। সে হাত বাড়িয়ে পুতুলটাকে কাছে টেনে নিলো। জাপটে ধরল সন্তপর্ণে।
এরপর আদর এঁকে দিলো পুতুলের কপালে, গালে। একা একা হাসলও।
কেন জানি বউ পুতুলটাকে ঘুমাতে দেখে তার সহ্য হলো না। সে কাতুকুতু দিতেই কুহু নড়েচড়ে আবার ঘুম। অসভ্য রিদওয়ান থামল না বরং স্পর্শ গাঢ় করল। তার অবাধ্য হাতজোড়াও চলতে থাকল কুহুর দেহের ভাঁজে।
এমন স্পর্শে এবার কুহু ঘুমে জড়ানো চোখ মেলতেই কানে কানে বলল,
-‘বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ‘
-‘এটা বলার জন্য আমার ঘুম ভাঙালেন?’
-‘না। বাইরে বৃষ্টি, পাশে সুন্দর বউ, রোমান্টিক ওয়েদার, শুধু প্রয়োজন পারমিশনের। প্রথমবার তাই পারমিশন নিচ্ছি সেকেন্ড বার পারমিশনের ধাঁর ধারব না যদিও।’
-‘কিসের পারমিশন? কী বলে না বলে কিছুই বুঝছি না।’
-‘স্পর্শ করার সম্মতির। তবে সময় চাইলে নিতে পারো। সঙ্গে এটাও মনে রেখো আজ অথবা কাল ধরা তোমাকে দিতেই হবে। এখন বলো তুমি কী চাও? আমি তোমার হ্যাঁ/না সব সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেবো।’
-‘ (…)’
-‘তবে কি ধরে নেবো, নীরাবতাকে সম্মতি লক্ষণ।’
একথা শুনে কুহুর গাল দুটো লাল বর্ণ হতে দেখে রিদওয়ান আর কথা বাড়াল না। সে কুহুকে নিয়ে ডুব দিলো ভালোবাসার নামক সুখ রাজ্যে।উপেক্ষার উপস্থিতি যেন না আসে তাই সময় দিয়ে অপেক্ষা করল না।
বৈধ সম্পর্কের জের ধরে সম্পর্কে গভীরতা এনে শুরু করল নতুনভাবে পথচলা। আজকের দিনের শুরুটা মন খারাপ দিয়ে শুরু হলেও শেষ টা স্মরণীয় হয়ে থাকল। কারণ আজকের সারাটাদিনে তার প্রাপ্তির খাতায় অনেককিছু ই যুক্ত হয়েছে। এভাবে হাসি খুশিতেই দুটো দিন কেটে গেল।
রাতের ফ্লাইটে রিমি আর আতিকুল রহমান দেশে ফিরে গেল। এতক্ষণে দেশে পৌঁছে গেছে। পাখির ছানার মতো করে আতিকুল রহমান মেয়েকে বুকে আগলে নিয়ে গেছে। একে একে দেখিয়েছেন পড়ে থাকা উনার এত বড় বাড়িটা। শূন্য সংসার। কোলাহলহীন বাড়ির আশপাশ। এসব দেখে রিমির নিজেরও খুব খারাপ লেগেছিল কিন্তু বাবাকে সে বুঝতে দেয় নি।বলা বাহুল্য কষ্ট বাড়াতে চায় নি। এরপর বাবা সঙ্গেই তার সময় কাটতে লাগল। আতিকুল রহমান কলেজের সময়টুকু বাদে প্রায় সময়ই মেয়েকে সঙ্গে রাখেন।কলেজে নিয়ে যান মাঝে মাঝে। ঘুরে ফিরে দেখায় অনেক কিছু। বাবা মেয়ে ঘুরে, শপিং করে, বাজি ধরে লুডু খেলে, নিজেরা রান্না করে, বাজার করে,হইহই করে ঘুড়ি উড়ায়, বাগানের পরিচর্যা করে,একে অপরকে নিজে হাতে খাইয়েও দেয়। এক কথায় মেয়ের আবদার পূরণ করে। এভাবেই বাবার সঙ্গে রিমির সম্পর্কটা আরো মজবুক হয়। রিমিও বুঝে বাবার আদর কাকে বলে। ওদিকে রিদওয়ান আর কুহুর সম্পর্কটা
দাম্পত্যের স্বাভাবিক পর্যায়ে এসেছে। বেড়েছে একের অন্যের মায়াও।
কুহু এখন লেগে থাকে নিলুফা ইয়াসমিনের সঙ্গে। উনার সঙ্গে শপে যায়। হাতে হাতে সাহায্য করে। দুষ্টুমি করে। বকা খায়। মন খারাপ করে, বাবা মায়ের জন্য চুপিচুপি কাঁদেও। সেটা খেয়াল করেসনিলুফা ইয়াসমিন’ই আবার কাছে ডেকে নেয়। ভালোবাসা অপ্রকাশিত রেখেই স্নেহ দেখায়। আদর করে। শপ থেকে অনেককিছু এনে দেয়। কখনো বা প্রচন্ড রেগে গিয়ে ঝাড়তে শুরুতে করে তিনজনকেই। বাদ যায় না রুপকসহ দেশের মাটিতে থাকা আতিকুর রহমান এবং রিমিও। সবাই উনার বকাগুলোকে হাসিমুখে মেনে নেয়৷ অভিযোগ গুলোও শুনে। বকা শুনতে শুনতে কুহু মাঝে মাঝে হেসে ফেলে। তার হাসি দেখে হাসে রিদওয়ান আর রুপকও। তখন চেঁচামেচির মাত্রা বেড়ে যায় একপর্যায়ে হেসে ফেলে রাগী নিলুফা ইয়াসমিনও। এর মধ্যেই আরেকটা ব্যাপার লক্ষণীয়, সেটা হলো কুহুর পরিবর্তন।
To be continue………!!