#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_একচল্লিশ
–
–
–
-‘রিদ চুপ কেন? কিছু বলার থাকলে বলো?
নিলুফা ইয়াসমিন উনার পুরো কথা শেষ করতেই আতিকুর রহমান উক্ত কথাটি বললেন রিদওয়ানকে। রিদওয়ান পূর্বের মতোই নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। মূলত মন দিয়েই শুনছিল সবার কথা। কুহু আর রিমি অনুষ্ঠানে কে কি রংয়ের শাড়ি/লেহেঙ্গা পরবে তা নিয়েও একচোট আলোচনা হয়ে গেছে। ঠিক হলো কোন পার্লার থেকে তাদের সাজাতে আসবে। কোন কোম্পানির মেহেদি দিয়ে হাত রাঙাবে। মেয়েলি এসব আলোচনার মধ্য পুরুষরা এতক্ষণ চুপ’ই ছিল। তখন বাবার কথা শুনে রিদওয়ান একবার কুহুর দিকে তাকাল। মেয়েটা খুশিতে গদগদ করছে। চোখে, মুখে, উপচে
পড়ছে অবাধ খুশি। এই মুহূর্তে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে নিজের খুশি
পুরো পৃথিবীকে জানাতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে ধৈই ধৈই করে এক
একচোট নেচে নিতে। কারণ আর পাঁচটা মেয়ের মতো তারও ইচ্ছে ছিল লাল টুকটুকে শাড়ি পরে লাগে রাঙা বউ সাজবে। গা ভর্তি গয়না পরবে।
বউ সেজে শখের পুরুষটাকে বর বেশে দুচোখ ভরে দেখবে। সেই খুশি উদযাপন করতে কখনো হাসবে; কখনো কাঁদবে। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে বউ সাজার সুযোগই দেয় নি। দেখতে পারে নি পাগড়ি পরা বরের বেশে থাকা রিদওয়ানকে কেমন লাগবে দেখতে! খুব সাদামাটাভাবেই তাদের বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়েছিল। শখের পুরুষকে পেলেও বউ সাজতে না পারার আফসোসটা তার রয়ে গেছে। অথচ আজ সেই স্বপ্নটা পূরণ হতে যাচ্ছে।
ওদিকে আতিকুর রহমান উনার জবাবের আশায় ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। তখন কুহু পাশ থেকে তার কোমরে একটা চিমটি কেটে বোঝাল কিছু একটা বলতে। চিমটিটা একটু জোরেই হয়ে গেছে৷ জ্বলে যাচ্ছে ওই জায়গাটা। সবার সামনে রিদওয়ান কুহুর চিমটি নীরবে হজম করে মৃদু হেসে জবাব দিলো,
-আমি কি বলবো? আপনারা বড়রা যেটা ভালো মনে হয় করুন ।’
-‘তা বললে হয় নাকি? তুমি একদিকে বড় ছেলে আবার আরেকদিকে ওই বাড়ির একমাত্র জামাই। অবশ্যই তোমার মতের দাম আছে। কিসে ভালো হবে; মন্দ হবে তা বলবে না তুমি?’
-‘যেখানে দুই পরিবারের মানুষগুলোকে নিয়ে আমার পরিবার। যেখানে খুব ভালো করেই জানি তারা আমার ভালো বৈ মন্দ চাইবে না। সেখানে তাদের সিদ্ধান্ত বেস্ট অপশন হবে। তাই আলাদা করে কিছু বলার কারণ দেখছি না। আমার সিদ্ধান্ত অনেক সময় অনেকের মনমতোও হবে না। যেহেতু আমরা সবাই আলাদা আলাদা মানুষ।’
ছেলের এমন কড়া জবাব শুনে আতিকুল রহমান মুখ ভোঁতা করে বসে রইলেন। ছেলে যে উনার উপর রেগে আছে উনি জানেন। কারণ দুপুরে ছেলের সঙ্গে উনার একচোট ঝগড়াও হয়েছিল। ঝগড়ার কারণ রিমির জন্য উনি রুপকের চেয়েও আরো ভালো পাত্র চাচ্ছিলেন। সময় নিয়ে তা খুঁজতে চাচ্ছিলেন। রুপক যে ভালো নয়, তাও নয়। তবে নিজের মেয়ের জন্য সময় নিয়ে আরো ভালো কাউকে খোঁজা বাবা হিসেবে উনার গুরু দায়িত্ব। কিন্তু রিদওয়ানের কথা রুপক’ই রিমির জন্য বেস্ট কেউ। বন্ধুর সাপোর্ট করাতে উনার খুব রাগ হচ্ছিল। এক সম্পর্কের মধ্যে বারংবার অন্য সম্পূর্কের জোড়াতালি দেওয়াটা উনার পছন্দও হচ্ছিল না। কারণ
এতে সম্পূর্ক নষ্ট হওয়ার চান্স বেড়ে যায়। রুপক বন্ধু ছিল এরপর হলো বউয়ের বড় ভাই; সমন্ধি। বন্ধুকে আগে যেসব কথা শেয়ার করা যেতো
সমন্ধিকে কি সেসব শেয়ার করতে পারবে? পারবে না। বরং একপ্রকার অস্বস্তি কাজ করবে। আবার সমন্ধি যখন বোন জামাই হবে তখন তাদের মধ্যে আরেকধাপ দূরত্ব সৃষ্টি হবে। কিছু বলতে গেলে অথবা করতে গেলে দশবার ভাবতে হবে। মাথাতে রাখতে হবে বাড়ির জামাইকে কোনোভাবে চটানো যাবে না। এতে বোনের সংসারে অশান্তি হবে। কিন্তু এ কথাগুলো উনি ছেলেকে আর বোঝাতে পারলেন না। ছেলে একপ্রকার জেদ করেই এসব আয়োজন করেছে। নিজ উদোগ্যে সবাইকে জানিয়ে রুপক আর রিমির এনগেজমেন্টের ব্যবস্খা করেছে। এমনকি ছেলেটা এমন গোঁয়ার প্রকৃতির যে যাদের এনগেজমেন্ট তাদের কে বাদে সবাইকে জানিয়েছে।
বেচারা রিমি আর রুপক আকষ্মিক সারপ্রাইজে শক্ড। ছেলেটা আগেও এমন মর্জি মতো চলতো এখনো তাই। তার যেটা ভালো মনে হবে সেটাই করবে। এদিকে বাবা ছেলের নীরব অভিমান খুব সহজেই ধরে ফেললেন নিলুফা ইয়াসমিন। ইসমত আরা এবং কুহুর বাবাও বুঝলেন কিছু একটা হয়েছে। নয়তো রিদওয়ান তো এভাবে কথা বলার ছেলে না। এইদিকে রুপকে ওমন খুঁতখুঁত করতে লাগল যে তার আর রিমির সম্পর্কের কথা জানার পথে কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি তা নিয়ে। সবাই ভিতর ভিতর উদ্বিগ্ন। আর এই ব্যাপারটা খেয়াল করে নিলুফা ইয়াসমিন ছেলের দিকে ঘুরে বেশ গুছিয়ে বললেন,
-‘আমরা চাচ্ছি রুপক আর রিমির সঙ্গে তোমাদের অনুষ্ঠানটাও সারতে। সুইজারল্যান্ডে থাকাকালীন বিয়ের সময় কুহুর বাবা মা থাকতে পারেন নি। একমাত্র মেয়ের বিয়ে, অথচ বাবা-মা স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে না পারাটা খুবই কষ্টদায়ক। এবার অনুষ্ঠান করলে উনারাও খুব খুশি হবেন।
জামাই হিসেবে তোমার দায়িত্ব উনাদের মন বুঝে চলা, তাই না? আমরা তাহলে দুই কাপলের বিয়ের আয়োজন করি। এতে আনন্দটাও দ্বিগুন হবে।’
মায়ের কথা শুনে রিদওয়ান কোনো জবাব দিলো না। বরং রিমি আর কুহুকে বলল ফ্রেশ হয়ে নিতে৷ অনেক রাত হয়েছে। তারা দু’জনেই বুঝল কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলাপ করবে বড়রা। এসব আলোচনায় তাদের রাখবে না। এমন ইঙ্গিত বুঝে অগত্যা উঠে চলে গেল তারা। ওরা যেতেই এবার রিদওয়ান সরাসরি কথা তুলল,
-‘ আমি আমার দুই পরিবারকেই বলছি কথাগুলো পজেটিভভাবে ভেবে এরপর সিদ্ধান্ত নিবেন আপনারা। কথা হচ্ছে, আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান করতে চাচ্ছেন খুবই ভালো কথা। আল্লাহ দিলে আমাদের দুই পরিবারই যথেষ্ট স্বচ্ছল। দুই বিয়ের অনুষ্ঠান একসাথে করার সামর্থ্যও আমার দুই পরিবারেরই আছে। কিন্তু এসব করার আগে সবাইকে মনে রাখতে হবে কুহুর কথাটা। সে কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ নয়।বলতে বাধ্য হচ্ছি, অনুষ্ঠান করুন, যার যা ইচ্ছে করুন, আমার বাঁধা নেই। কিন্তু কুহু আমার নজরের আড়াল যেন না হয়। এমন সিদ্ধান্তও যেন না নেওয়া হয় বিয়ের অনুষ্ঠানের আগ মুহূর্তে আমরা আলাদা থাকব। দু’জন দুই বাসায় থাকব। এমনকি বিয়ের আগে কথা বলা বা মুখ দেখাদেখিও বারণ। এসবে আমি
পক্ষপাতী নই। তারপরেও যদি নিয়মের দোহায় দিয়ে এসব করতেই হয়, তাহলে আমাদেন ব্যাপারটা স্কিপ করাই ভালো। রুপক আর রিমি বিয়েই জাঁকজমকভাবে সম্পূর্ণ করা হোক। আমাদের বিয়ে যখন হয়েই গেছে অনুষ্ঠান যে করতেই হবে এর কোনো মানে নেই। আমি আমার সিদ্ধান্ত জানালাম, এবার আপনারা যে যেটা ভালো মনে করেন করতে পারেন।
আমার কথাটা দৃষ্টিকটু লাগলেও আমার কিছু করার নেই। এর কারণও কুহু। এই অবধি এসে আমার সমস্ত কষ্টকে তো বৃর্থা হতে দিতে পারি না।
আশা করি সবাই বুঝেছেন আমি আসলে কি বলতে চাচ্ছি।’
রিদওয়ানের কথা শুনে এবার সবার কপালে দুঃচিন্তার ভাঁজ পড়ল।তবে
তার কথাটা যুক্তিযুক্ত। অনুষ্ঠান অনুষ্ঠান করে হেদিয়ে মরলে হবে না। যে বিপদ থেকে মেয়েটা সেরে উঠছে সেদিকেও নজর দিতে হবে। আরেকটা কথা না বললেই না রিদওয়ানের মতো কেউই কুহুর দিকে নজর রাখতে
পারবে না। একে তো বিয়ের বাড়ি। তার উপরে হাজার রকমের ব্যস্ততা।
তাছাড়া রিদওয়ান যে শুধু টাইম টু টাইম কুহুকে মেডিসিনই খাওয়াই তা নয়। কুহুকে নিয়মিত ব্যায়ামও করায়। যে ব্যয়াম ব্রেণ সচল রাখে। তার মুড কিসে ভালো হয় সেদিকে খুব খেয়াল রাখে রিদওয়ান। এমনকি সে কুহুকে একা থাকতেও দেয় না সে। একা থাকলে’ই কুহু ভাবনার জগতে ডুবে যায়। ভুল ভাবনায় নিজেকে বন্দি করে ফেলে। তখন তার পাগলামি বেড়ে যায়। আর রিদওয়ানকে ছাড়া কুহু কারো কথায় শুনবে না। দেখা যাবে অনুষ্ঠানের ঝামেলা দুই চার বেলার মেডিসিনও মিস করবে। যেটা হতে দেওয়া যাবে না, কোনো ভাবেই না। তাহলে এখন উপায়? অনুষ্ঠান করলে সবার কাজের ব্যস্ততা বাড়বে। গেস্ট আসবে। তাদের আপ্যায়ন করতে হবে। কাজের শেষ থাকবে না এরমধ্যে আলাদাভাবে কুহুকে কে সময় দিবে? মনে মনে এমন নানান কথা চিন্তা করল সবাই। কিন্তু কেউই কোনো সমাধান খুঁজে পেলো না। তখন ইসমত আরা বেগম বললেন,
-‘তাহলে রুপকের বিয়েতে কুহু আমার বাসায় যাবে না?ভাইয়ের বিয়েতে বোন উপস্থিত থাকবে না তা কি করে হয়?’
-‘তাই তো। কুহুকে ছাড়া কিভাবে কি হবে?’
রুপক মাটির দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে। কুহু না থাকলে সে অনুষ্ঠানই করবে না। একটাই বোন তার। রিদওয়ান যত যাই বলুন বোনকে ছাড়া সে অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নিবেই না। প্রয়োজনে সব বাতিল করা হবে। তারাও সাদামাটাভাবে বিয়ে করবে। অনুষ্ঠান না করলে বিয়েই হবে না এমনটাও না। নিজের মনের কথা রুপক সত্যি সত্যি চট করে বলে বসল,
-‘তাহলে অনুষ্ঠানের দরকার নেই। এখনই কাজি ডাক পারিবারিক ভাবে বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে যাই। যেই অনুষ্ঠানে আমার বোন থাকবে না সেই অনুষ্ঠানের মানে হয় না।’
-‘ কিন্তু আমার বোনকে তো আমি এভাবে যেতে দিবো না।’
-‘আমি দিতে পারলে তুই দিতে পারবি না কেন? কুহুও তো আমার এক মাত্র বোন। রিমি তোর কাছে যতটা আদরে কুহুও আমার কাছে ততটাই আদরের। রিমির থেকেও সাদামাটা আয়োজনে কুুহুর তোর হাতে তুলে দিয়েছি আমি। তখন আমার খারাপ লাগে নি? আমি যখন তা পেরেছি তুইও পারবি।’
-‘উল্টো প্যাঁচ মারিস না। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা কর।’
-‘কোনো বুঝাবুঝি হবে না। এখন হয় অনুষ্ঠানে রাজি হবি আর নয়তো কাজি ডেকে ঘরোয়াভাবে আমাদের বিয়েটাও দিবি। যদি একটাতেও রাজি না হোস, তাহলে আমার বোন আমি নিয়ে যাব।’
-‘তোর বোন আমার বউ। আমার বউয়ের ব্যাপারে আমি কোনো ছাড় দেবো না। তাই বলছি, কথা বাড়াস না।’
-‘তোর বউ আমার বোন। আমার বোন আমার বিয়েতে যদি না থাকে তাহলে আমি বিয়ের অনুষ্ঠানই করব না। তাই বলছি, কথা বাড়াস না।’
ওদের দুই বন্ধু এমন মতবিরোধ দেখে বাকিরা বিরক্ত হলেন। বোন, বউ করে এরাই পাগল হয়ে গেছে। অথচ একবারও ভাবছে না তাদের বোন, বউরাই অনুষ্ঠানে জন্য প্রহর গুনতে শুরু করেছে। কে কি করে সাজবে তা নিয়েও আলোচনা হয়ে গেছে। এখন যদি অনুষ্ঠান না হয় তাহলে ওরা দু’জনই কষ্ট পাবে। আতিকুল রহমান ধমকে এবার দু’জনকেই থামালেন।
কিন্তু তারা দু’জনই নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় দেখে কেউ’ই আর কোনো সমাধান পেলেন না। কিছুক্ষণ এভাবে কেটে গেল। একটুপরে রিদওয়ান বলল,
-‘ এক কাজ করা যাক, একটা রিসোর্ট বুক করে ফেলি। সেখানে আমরা সবাই থাকব এবং সেখানেই যাবতীয় অনুষ্ঠানটা সম্পূর্ণ করা যাবে। এতে কারোরই আর এই বাড়ি, ওই বাড়ি যাওয়ার-আসার ঝামেলা থাকবে না। শুধু সময় মতো গেস্টদের লিস্ট দিয়ে দিলেই হবে।’
রিদওয়ানের সিদ্ধান্তটা সবারই পছন্দ হলো। বড়রাও রাজিও হলো এবং দেখে শুনে একটা রিসোর্ট বুক করার দায়িত্ব দেওয়া হলো রিদওয়ানকে।
এরপর আলোচনার সমাপ্তি ঘটিয়ে বড়রা বাসায় দিকে চলে গেল। আজ রুপকরা আজ এখানেই থাকবে। খাওয়া দাওয়ার পর্বও শেষ। তাই বড়রা যার যার বরাদ্দকৃত রুমে শুতে চলে গেলেন। তবে সবাই গেলেও দুই বন্ধু বসে আছে। দু’জনের দৃষ্টি যৌবণবতী চাঁদের দিকে। চাঁদ একটাই, অথচ তাদের ভাবনাও আলাদা। ভাবনার মানুষ আলাদা। রুপক বেশ কিছুক্ষণ নিজের ভাবনায় বুদ থেকে বলল,
-‘ কখনো ভেবেছিলি কুহুকে এতটা ভালোবেসে ফেলবি?’
-‘ভালোবাসি না আমি কাউকে।’
-‘এজন্যই বুঝি এসব যুক্তি দিয়ে চোখের আড়াল করা থেকে থামালি?’
-‘আপনি তো পন্ডিত সব বুঝে গেছেন?’
-‘বুঝলাম বলেই তো তোর সঙ্গে লেগে কৌশলে বড়দের রাজি করালাম।’
-‘আমি কাউকে ভালোবাসি না। আমি শুধু আমাকে ভালোবাসি।’
-‘ ওহ আচ্ছা আচ্ছা। তুই তোকে ভালোবাসি। তোর সঙ্গে কুহু জড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ তুই কুহুকেই ভালোবাসি। ‘
-‘খুব যুক্তিবিদ হয়ে গেছেন।’
একথা বলে রিদওয়ান হেসে ফেলল। এছাড়া সত্যি সত্যিই বড়রা এমন সিদ্ধান্ত নিতো। বিয়ের পর তারা একরাতও আলাদা থাকে নি। আলাদা থাকার কথা ভাবলেই কেন যেন দমবন্ধ হয়ে আসে। একথা তো বড়দের বলা যায় না যে, ‘বউয়ের বিরহে পাগল হয়ে যাব। প্রেমসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি আমি। কেউ আমার বউকে আলাদা কোরো না। যদি করো তবে বউ তুলে আনতে পিছ পা হবো না আমি। বিয়ে করা বউকে নিয়ে পালাব আমি।’ ভদ্র সভ্য ছেলের মুখে এসব কথা কেউ সহ্য করতে পারবে না তাই একটু কৌশলে খাটালে হতো। এতে অনুষ্ঠানও হবে আবার বউটাও তার চোখের সামনেই থাকবে। রিদওয়ানকে হাসতে দেখে রুপকও হো হো করে হেসে ফেলল। তবে বোন জড়িয়ে আছে দেখে বেখাপ্পা কোনো কথা বলতে পারল না। এদিকে রিদওয়ানও তাই। তবে রিদওয়ান বলল,
-‘আমি কখনোই বলব না আমার বোনকে আমরা যেমন সুখে রেখেছি তুইও রাখিস। আমি বলব, তুই তোর মতো করেই আমার বোনকে দেখে শুনে রাখিস। তার ভুল গুলো শুধরে দিস। বাংলাদেশে জন্ম নিলেও সে বাংলাদেশের কালচার সম্পর্কে অনেককিছু জানে না। মানিয়ে নিবে তবে মানিয়ে নেওয়ার সময়টুকু দিস। পাশে থাকিস। সাপোর্ট দিস। সেও ছোট মানুষ। জেদ বেশি। কখনো যদি ওর সঙ্গে মতের মিল না হয় তাহলে সেই মুহূর্তে জোড়াজুড়ি করিস না। পরে ঠান্ডা মাথায় বুঝাস দেখবি বুঝবে।
বাবাকে খুব কম পেয়েছে তো তার সব আবদারের মানুষটা আমি। দেখ আমার কাছে এসে কেঁদে কেঁদে তোকে চাইল। আর আমিও প্রতিবারের মতো এবারও তার মুখের হাসি ফুটাতে তোর অনুমতি না নিয়ে আজকে এনগেজমেন্ট করিয়ে দিলাম।’
-‘এত বড় বাসাটা ফাঁকা হয়ে যাবে এজন্য কষ্ট পাচ্ছিস? সময় অসময়ে ভাইয়া, ভাইয়া করে কেউ দৌড়ে আসবে না, কারণে অকারণে জ্বালাতন করবে না, কতশত আবদার পূরণের জন্য পাগলামি করবে না, জুতোর ফিতা লুকিয়ে রাখবে না, ওয়ালেট থেকে চকচকে দশ বিশ টাকার নোট
হারিয়ে যাবে না, এজন্যই বুক ভার হয়ে আসছে তাই তো? জানিস আজ সকালে আমি বাসায় পা রাখতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি কুহু দৌড়ে আসবে। টাকা দাও! টাকা দাও! করে পিছু পিছু ঘুরবে। খালি হাতে বাসায় ফিরতে দেখে ভ্রুঁকুটি করে তাকিয়ে থাকবে। বোনগুলো সব এমনই সব। এরা মায়ার জিনিস। মায়া বাড়িয়ে নিজের বাসা শূন্য করে অন্যের বাসা আলোকিত করাই যেন এদের ধর্ম। কষ্ট পাস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
রুপক হাসল। অথচ তার চোখে ছলছল করছে। রিদওয়ান চট করে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরল। তার পক্ষে বসে থাকা সম্ভব নয়। সে আর পিছু ফিরে তাকাল না। নয়তো বেহায়া চোখের পানি তাকে বন্ধুর কাছে ধরা খাইয়ে দেবে।
To be continue…!!
#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_বিয়াল্লিশ
–
–
–
সময় স্রোতহীন চলমান নদীর মতোই বহমান। তার কাজ নির্দিষ্ট গতি পথ ধরে গুঁটি গুঁটি পায়ে এগিয়ে চলা। এই পথের সঙ্গী কখনো সুখের পরশ কখনো’বা দুঃখের নির্মমতা। সুখ দুঃখের সংমিশ্রণের এই জীবনে আমরা ভাবনা সাজায়। কল্পনা করি৷ স্বপ্ন আঁকি। ইচ্ছে পূরণের চেষ্টা করি। সেই ইচ্ছে কখনো পূরণ হয় তো কখনো অপূর্ণই থেকে যায়। জীবনের ফাঁক ফোঁকরে তা হারিয়ে যায় পরিস্থিতির নিরসনে।
আজ সতেরো তারিখ, সোমবার। দুপুর একটা। রিদওয়ান দাঁড়িয়ে আছে গার্লস স্কুলের সামনে। একটু পরে স্কুল ছুটি দিবে। কলকল করে বেরিয়ে আসবে রুপ ও কথা। জমজ তারা। এসেই শুরু করবে অভিযোগ। কে কাকে মেরেছে, কে কাকে ধাক্কা দিয়েছে, কে পড়া পারে নি, কে বই নিয়ে যায় নি, কে টিফিন খেয়েছে, কে টিফিন অন্যকে দিয়ে দিয়েছে, কে কার ব্যাগ নিচে ফেলে দিয়েছে, আরো নানান অভিযোগ। অভিযোগের শেষ নেই। তাদের কথা বলতে না বলতেই দৌড়ে আসতে দেখা গেল তাদের।
স্কুল ড্রেস পরিহিত মেয়েরা তাকে দেখেই হাত নাড়াল। সে হাত নাড়িয়ে আস্তে ধীরে আসার ইশারা করল। রুপ নাদুস নুদুস, দৌড়াতে পারে না।
খুব বেশি নাদুস নুদুস এমনটাও না চলনসই নাসুদ নুসুদ আর কি। নাদুস নুদুস রুপ দৌড়াতে গেলেই ধুম করে পড়ে যায়, তবে কাঁদে না। সে খুব শক্ত ধাঁচের। গম্ভীর টাইপের। শান্ত স্বভাবের। মোদ্দাকথা পরিবেশ বুঝে চলে। ঠিক যেন রিদওয়ানের কপি। আর কথা দারুণ চটপটে। দুষ্ট। কুহুর কার্বন কপি। দুজনের বয়স ছয় বছর। নামের মতোই দেখতেও ফুটফুটে।
সবার ভীষণ আদরের। বাবাকে দেখে আসতে গিয়ে রুপ কিছুর সঙ্গে পা বেঁধে মুখ থুবকে পড়ে গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গে উঠে নিজের জামা কাপড় ঝাড়লো। এরপর ধীরে ধীরে বাবার কাছে এগিয়ে এলো। কথা ততক্ষণে দৌড়ে গাড়িতে উঠে বসেও পড়েছে। রিদওয়ানের কাছে এসে রুপ মাথা নিচু করে অন্যদিকে মুখ করে তাকিয়ে রইল। বাঁ হাঁটু ছিলে গেছে জ্বলছে খুব। রিদওয়ান মেয়েকে কোলে নিয়ে হাঁটু দেখতে দেখতে আদুরে সুরে
বলল, ‘ব্যথা পেয়েছো মা? বাবা, আদর করে দিচ্ছি সব ঠিক হয়ে যাবে।’
রুপ না বোধক মাথা নাড়াল অর্থাৎ ব্যথা পায় নি সে। রিদওয়ান রুপের গালে আদর এঁকে গাড়িতে বসল। ড্রাইভারকে যেতে বলে রুপের পায়ে এন্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিতে দিতে বলল, যারা সামান্য ব্যথাতে কুঁকড়ে যায় তারা বড় হতে পারে না। বড় হতে গেলে কষ্ট সহ্য করা শিখতে হয়।’
রুপ নিশ্চুপ।বাবার আদুরে স্পর্শে সব ব্যথা চলে গেছে। বাবার কথা শুনে
মায়ের মারের ব্যথাও ফিনিশ হয়ে গেছে। সে হাসল। তবে হাসিটা অস্পষ্ট রয়ে গেল। তার বাবাও এভাবে হাসে। বাবাকে দেখে সেও এভাবে হাসতে চেষ্টা করে। রুপ কোনো কথা বলল না তবে কথা ভ্রুঁ কুঁচকে বলল, ‘ কিন্তু বাবা, যে ব্যথাগুলো সহ্য হয় না সেই ব্যথাগুলোকে কি করা যায় ?’
-‘প্রথম প্রথম সব ব্যথাকেই অসহনীয় মনে হয়। এরপর সময় সব ব্যথাকে সহ্য করা শিখিয়ে দেয়।’
-‘কি খেলে ব্যথা সহ্য করা যায়?’
-‘যে খাবার খেলে শরীর সুস্থ ও সবল থাকে। সুস্থ শরীর সব ব্যথাকে সহ্য করতে শিখিয়ে দেয়।’
-‘আচ্ছা।’
এরপর কিছুক্ষণ নিরাবতা। রুপ চুপ করে বাবার বুকে হেলান দিয়ে বসে আছে। জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখছে। তখন রিদওয়ান দুই মেয়ের দিকে
তাকাল। কথার চোখ দুটো একদম কুহুর মতো। মায়ায় ভরা। যেন কুহুর আরেক কপি। তখন তার ফোন বেজে উঠল রুপক ফোন করেছে। মামা কল করেছে দেখে কথা আগ বাড়িয়ে কলটা রিসিভ করার বায়না ধরল।
এরপর কল রিসিভ করে খলবলিয়ে বলে উঠল,
-‘হ্যালো মামা? আমি কথা বলছি।’
-‘ কেমন আছো মামনী? সব ঠিকঠাক তো? রুপ কোথায়?’
-‘আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? রুপ পড়ে গেছে। হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছে। বাবা তাকে কোলে নিয়ে বসে আছে।’
-‘ইস! বেশি ব্যথা পেয়েছে?’
-‘হুম। কথা বলবে রুপের সঙ্গে? ‘
-‘দাও।’
-‘মামা?’
-‘বলো মামনী?’
-‘আমি তো কথা শুরুর আগে সালাম দিতে ভুলে গেছি? আম্মু যদি জানে আমি সালাম দিতে ভুলে গেছি তাহলে ভীষণ রাগ করবে। এখন সালাম দেই? এখন সালাম দিলে কি রাগ করবে?’
-‘না মামনী একটুও রাগ করব না।’
-‘আসসালামু ওয়ালাইকুম মামা। ভালো আছো?’
-‘ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ, আমি অনেক ভালো আছি।’
-‘ঠিক আছে। এই নাও রুপের সঙ্গে কথা বলো।’
-‘দাও।’
এরপর কথা রুপের হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিলে রুপ ফোনটা কানে ধরে খুব সুন্দর করে সালাম দিলো। তা দেখে রিদওয়ান মুচকি হাসল। কথার মনে থাকে না সালাম দিতে আর রুপ ধীরে সুস্থে সালাম দিয়ে কথা শুরু
করতে ভুলে না। দু’জন দুই রকমের মেধাবী। রুপক রুপকে বলল,
-‘মামনী খুব ব্যথা পেয়েছো?’
-‘ না, না, একটু। তুমি কবে ফিরবে মামা?’
-‘আজকে রাতেই ফিরব মামনি। কি আনব তোমার জন্য?’
-‘কথার জন্য চকলেট আনলেই হবে।’
-‘আর তোমার জন্য?’
-‘ আমার জন্য কিছু লাগবে না।’
-‘হা, হা, ঠিক আছে তাহলে সাবধানে বাসায় যাও। আমি তাহলে রাখি।’
-‘তুমিও সাবধানে এসো। আল্লাহ হাফেজ।’
-‘আল্লাহ হাফেজ।’
এরপর কল কেটে রুপ ফোন বাবার হাতে দিয়ে দিলো। কথা ড্রাইভারের সঙ্গে গল্প করছে, ক্লাসে কি কি করেছে সেসব গল্প। মেয়েটা এত বকবক করতে পারে। রুপ চুপ করে শুনছে। রিদওয়ান তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে, মস্ত বড় মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে প্রায় সাত বছর আগের দিনটির কথা।
সাত বছর আগের ঘটনা,
সেদিন রাতে তাদের বিয়ের দিনক্ষণ পাকা করে পরেরদিন রুপকরা চলে গিয়েছিল। দিনগুলো ভালো যাচ্ছিল। রিদওয়ান দেশে তার কোম্পানির
আরেকটি ব্রাঞ্চ তেরির কাজ গুছিয়ে নিচ্ছিল। কুহু কলেজ যাওয়া শুরু করল। হুঁটোপুঁটি গ্যাং এর সঙ্গে মজামাস্তিতে তার সময় গুলোও কাটতে লাগল। রেগুলার মেডিসিন নেওয়াতে অবস্থাও ভালোর দিকেই যাচ্ছিল।
সামনে পরীক্ষা। সারাদিন কলেজ, কোচিং আর সন্ধ্যার পর রিদওয়ানের কাছে পড়তে বসত। এসবের মাঝে ঘুরাঘুরির আবদার তো আছেই। রিদ তার আবদারে কখনো নাকচ করতো না। বরং তার সাপোর্ট, পরিবারের সাপোর্টে কঠিন রোগ থেকে মুক্তির পথে এগোচ্ছিল মেয়েটা। তাকে কেউ একা থাকতে দিতো না। একা থাকলে সে কল্পনার জগতে ডুবে যায়, কী
সব ভুলভাল ভাবে, চিন্তা করে। সবকিছু ভালোর সঙ্গে বাড়ছিল তাদের ভালোবাসা। গাঢ় হচ্ছিল দু’জনের পবিত্র বন্ধন। মায়া। এবং আসক্তি’ও।
দিনের বেলা যেমন কাটুক রাতের বেলা কেউ কাউকে ছাড়া থাকত না। কুহুর যেমন রিদওয়ানের বুকে মাথা না রাখলে ঘুমই আসত না তেমনি
কুহুকে বুকে না জড়িয়ে নিলো রিদওয়ানও ঘুমাতে পারত না। সব শূন্য শূন্য লাগত। বুক ফাঁকা হয় দম আঁটকে আসত। সেসময় ভালো রিসোর্ট খুঁজে পাচ্ছিল না। সব বুক। রিসোর্ট বুক করলে একমাস আগে জানাতে হয়। এমতাবস্থায় দুই পরিবার নতুন করে আবার ডেট ঠিক করল। দেড় মাস পর তাদের ডেট ঠিক হলো।বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে একটু একটু করে প্রস্তুত’ও হচ্ছিল দুই পরিবার। তার দায়িত্ব ছিল রিসোর্ট বুক করার। সেও ঢাকার মধ্যে দেখে শুনে ‘রৌদ্দুর’ নামে একটি রিসোর্ট বুক করে ফেলল।
নিজেও বর সাজার জন্য প্রস্তুত হলো। এরইমধ্যেই রুপক আগের জবটা ছেড়ে আরো ভালো একটি কোম্পানিতে অফিসার পদে জয়েন করল।
স্যালারিও হাই। সেও রিমিকে ঘরে তোলার জন্য সবদিক থেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল। তার রুম ডেকোরেটও করাল রিমির পছন্দকে প্রাধ্যন্য দিয়েই।
এভাবে দিনগুলো এগোতে এগোতে তাদের গায়ে হলুদের দিনটিও চলে এলো। রিসোর্টেই হবে হলুদের অনুষ্ঠান। দুই কাপলের এক সঙ্গে’ই গায়ে হলুদ। আনন্দ হইহট্টগোলে পরিপূর্ণ চারপাশ। কুহুর ফ্রেন্ডদের কিছু কিছু
কান্ডে হেসে গড়িয়ে পড়ছিল অনেকেই।
রেডি হয়ে পাশাপাশি বসেছে রিদওয়ান আর কুহুর। দারুণ মানিয়েছিল তাদের। রুপক আর রিমির স্টেজ একটু দুরত্বে তবে তাদের মুখোমুখিই।
রুপক সেখানে একা বসে আছে রিমি আসে নি এখনো। তার নাকি শাড়ি খুলে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর রিমি এলো। শুরু হলো অনুষ্ঠান। অনেক রাত অবধি চলল নাচানাচি, গান বাজনা, খাওয়া-দাওয়া। গতরাতে রাত করে সবাই ঘুমিয়েছি তাই সকালে উঠেছেও বেলা করে। রিসোর্টটা খুবই সুন্দর।
কুহু রিদওয়ানকে জোর করে ঘুম থেকে টেনে তুলে পুরো রিসোর্টটা ঘুরে দেখল। সেলফি নিলো। এরপর এলো ব্রেকফাস্ট করতে। দুজন খেলোও একসঙ্গে। বড়রা একসঙ্গে বসে গল্প করছে। সবার মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে রিমি অনুপস্থিত। রিদওয়ান ব্যাপারটা খেয়াল করে নিলুফা ইয়াসমিনকে জিজ্ঞাসা করে জানল, রিমি ঘুমাচ্ছে। তান মাথা ধরেছে ওষুধ খেয়েছে, ডাকতে নিষেধ করেছে৷ আর একটু ঘুমালে সব ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর রুপক বেরিয়ে আসে আর সরাসরি রিদওয়ানকে জিজ্ঞাসা করে,
-‘রিমি কোথায় রিদ?’
-‘ঘুমাচ্ছে।’
-‘তুই সিওর ঘুমাচ্ছে? ‘
রিদওয়ানের এবার ভ্রুঁ কুঁচকে গেল। রুপক তো এই টোনে কথা বলে না।
সে এবার উঠে দাঁড়াল আশেপাশে তাকিয়ে নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করল,
-‘কি হয়েছে?’
-‘ রিমি বাসায় চলে গেছে। সে বিয়ে করবে না। আজ রাতে নাকি দেশে ছেড়ে চলে যাবে।’
-‘হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেন?’
-‘সেটা নাহয় তোর বোনকে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর।’
-‘ এই সিদ্ধান্তের পেছনে তোর কোনো হাত নেই তো? যদি থাকে তাহলে কিন্তু আমি আমার বোনের সাপোর্ট নিবো।’
-‘ আর যদি এখানে আমার কোনো দোষ না থাকে, তবে?
-‘ কাজ করেই নাহয় দেখাই। তুই এখানেই থাক। আত্মীয় স্বজন কিছু না জানে। সবার দিকে খেয়াল রাখিস, আসছি আমি।’
রুপক কোনো জবাব দিলো না। রাগে হাত নিশপিশ করছে। রিমিকে দুই থাপ্পড় দিতে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘এসবে মানে কি? বিয়ে করবে না তো
এত কাহিনি কেন করলে? কেন আগ বাড়িয়ে রিদকে সব বলতে গেলে?
এখন সব ঠিক করে বিয়ে না করার কারণ কি?’ ফোনে বলেছেও। কিন্তু তার একটাই কথা সে বিয়ে করবে না। এমন করার কারণও বলছে না।
রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। পরিবারের কেউ এখনো জানে না কিছু। কিন্তু
তাদের দুই বন্ধুর কথোপকথন শুনে কুহু হতভম্ব। সেও এবার ছুটে চলল
রিদওয়ানের পিছু পিছু কিন্তু রিদওয়ানের গাড়ির নাগাল পেলো না সে।
অগত্য সিএনজি নিয়ে রওনা হলো শশুড় বাড়ির উদ্দেশ্যে। রিদওয়ান বাসায় গিয়ে দেখে রিমি লাগেজ গুছাচ্ছে। পার্সপোর্ট পড়ে আছে বেডের উপর। টিকিটও কনফার্ম। রাত আটটায় ফ্লাইট। এখন বেরিয়ে হোটেলে উঠবে এরপর হোটেল থেকে সরাসরি চলে যাবে সুইজারল্যান্ড। সেখানে স্থায়ী হবে আর কখনো দেশে ফিরবে না। তখন রিমির রুমের দরজা নক করল রিদওয়ান। ভাইয়াকে দেখে শুকনো ঢোক গিলে মাথা কিঞ্চিৎ নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। তখন রিদওয়ান রুমে প্রবেশ করে খুব ঠান্ডা স্বরে বলল,
-‘এখানে কেন তুমি?’
-‘এ এই একটু আ..আগেই এসেছি।’
-‘কেন এসেছো সেটাই তো জিজ্ঞাসা করছি।’
-‘ভাইয়া! আ..মি বিয়েটা করতে পার..ব না।’
-‘কারণ?’
-‘আম আ..মি।’
-‘কারণটা জানতে চাচ্ছি?’
-‘ম্যাক সুইসাইড করেছে। হসপিটালে সে। আমি ফিরে না গেলে আবার সুইসাইড করবে। ওর মা ফোন করেছিল সকালে জানিয়েছে সব। ম্যাক মারা গেলে এর জন্য আমি দায়ী থাকব। কারণ সে আমাকে ভালোবেসে এসব করছে।’
-‘ এখানে রুপকের দোষ’টা কোথায়? তার সন্মান নিলামে তোলার মানে কি? সে কি তোমায় বলেছিল ভালোবাসতে? নাকি থ্রেট দিয়েছিল তাকে বিয়ে করতেই হবে? স্বেচ্ছায় বিয়েটা করার জন্য সবাইকে জানিয়ে এখন পিছুটানে মানে কি? আসলে দোষটা তোমারও না তোমার পরিবারের, তারাই তোমাকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারে নি, তাই না?’
-‘ভাইয়া!’
-‘ চলে যাবে, যাও। বন্ধুটাও আমার, বন্ধুর সন্মান রক্ষা করার দায়িত্বও আমার। প্রয়োজনে আমি নিজ দায়িত্ব আজকের মধ্যে ওর বিয়ে দেবো।
তবে একটা কথা জেনে নাও, আজ যদি তোমার কারণে আমার বন্ধু কষ্ট পায় তাহলে আমি ভুলে যাব আমার বোন ছিল। রুপকের মুখ দেখে যদি কুহুর চোখে পানি আসে, আমি ভুলে যাব আমার বোন ছিল। যদি বাবা মাকে কথা শুনতে হয়ে, আমি ভুলে যাব আমার বোন ছিল। তুমিও ভুলে যেও আজ থেকে তোমার ভাই মৃত। তোমাকে একঘন্টা সময় দিলাম। এখন সিদ্ধান্ত নাও।’
একথা বলে সে পেছনে ঘুরতেই রিমি তাচ্ছিল্যের সুরে এবার বলে উঠল,
-‘বাংলাদেশে এসে তোমার মেন্টালিটিও বাঙালিদের মতোই হয়ে গেছে। তুমিও আজকাল ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে শিখে গেছো। সো কল্ড ভাইদের মতো নিজের মতামত অন্যের ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। যত যায় বলো, আমি যাবোই ভাইয়া।’
-‘আমি কি বলেছিলাম, রুপকের সঙ্গে রিলেশনে জড়াতে? নাকি বলেছি, রুপককে বিয়ে করার জন্য আমার কাছে এসে কান্নাকাটি করতে? শুধু তুমি বলেছিলে বলে আমি বাবার অমতে গিয়ে এনগেজমেন্টের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এখন কোন বিবেকে আমার দোষ দিচ্ছো?’
-‘তখন বিয়ের সিদ্ধান্ত ঠিক মনে হয়েছিল এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছি।’
রাগে গজগজ করে একথা বলতেই কুহু হাততালি দিলো। তালির শব্দে তারা দুই ভাই-বোন ঘুরে তাকাতেই দেখে কুহু দাঁড়িয়ে আছে। সে তালি দিতে দিতেই এগিয়ে এসে দাঁড়াল রিমির মুখোমুখি। তারপর মাত্রারিক্ত শীতল চোখে তাকিয়ে বেশ জেদি সুরে বলল,
-‘আজকের পর থেকে তোমাকে সন্মান করতে পারব কি না জানি না। তবে তোমার কারণে আমার ভাইয়া যদি বিন্দু পরিমানও কষ্ট পায় তবে আমিও তোমার ভাইয়ের সমস্ত সুখ কেড়ে নেবো। যেই সম্পর্কের সূত্র ধরে আমার ভাইয়া তোমাকে ভালোবেসেছিল, আমি সেই সম্পর্ক রাখব না। লাস্টবার বলছি, তুমি বিয়েটা করবে কি না?’
-‘না।’
-‘ঠিক আছে।’
একথা বলে কুহু ঘুরে দাড়াতেই রিদওয়ান তার পথ আগলে দাঁড়াল। তার গাল চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলল,
-‘খবরদার বলছি, ওদের সমস্যার মধ্যে আমাদের সম্পর্কটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার স্পর্ধা দেখাবে না। বিয়ে হবে, রিমির সঙ্গে রুপকেরই বিয়ে হবে।’
-‘না, বিয়ে হবে না। যে আমার ভাইকে নিয়ে খেলার পুতুলের মতো শুধু
খেলেছে। ভালোবাসার অভিনয় করেছে দিনের পর দিন। স্বপ্নভঙ্গ করতে কতশত স্বপ্ন দেখিয়েছে। এমনকি যে আমার ভাইকে সামান্যতরও সন্মান করে না, তার সঙ্গে আমি আমার ভাইয়ের বিয়ে হতে দেবো না।’
-‘তোমার ভাইকে বিয়ে করার জন্য আমিও বসে নেই। সস্তা মেন্টালিটির সস্তা কাউকে তার গলায় ঝুলিয়ে দাও।’
একথা শুনে কুহু রিদওয়ানের হাতটা ঝাটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। রিদওয়ানও বোনের দিকে একপলক তাকিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তার আর কিছু বলার নেই। জোর করে, মেরে ধরে তো কবুল বলাতে পারবে কিন্তু সংসার?
To be continue………!!