#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_চুয়াল্লিশ(অন্তিম পার্ট)
–
–
–
-‘কেন আসি, বলার অপেক্ষা রাখে না নিশ্চয়ই? তবে তুমি মানুষটা খুবই ছোটো। কিন্তু তোমার কথার ধাঁচ আমার হৃদয় এঁফোড়-ওঁফোড় করার জন্য যথেষ্ট।’
একথা বলে রিদওয়ান দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। ইসমত আরা বেগম থাকতে বললে জানাল অন্যদিন এসে থেকে যাবে। খেতে বললেও খেল না। মলিন হেসে জানাল পেট ভরা। তারপর সে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
তবে যেতে যেতে বলে গেল কুহুর দিকে খেয়াল রাখতে। যতই বমি হোক জোর করে কিছু যেন খাইয়ে দেয়। মেয়েটা দূর্বল। এভাবে থাকলে আরো দূর্বল হয়ে যাবে। তখন বাচ্চা ও মা দুজনকে নিয়ে দুঃচিন্তার অন্ত থাকবে না। ইসমত আরা কোনো জবাব দিলেন না শুধু রিদওয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেটা শুকিয়ে গেছে অনেক। খাওয়া-দাওয়াও করে না। ঘুমায়ও না। বাসায়ও ফিরে না। নিলুফা ইয়াসমিনের থেকে সব খবর পান তিনি। ওই দম্পত্তির কথা কি বলবেন? বেয়াদব মেয়েটা বাবা মাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিয়ে গেছে। একবারও ভাবে নি বাবা মায়ের কথা, বড় ভাইয়ের সন্মানের কথা। উনি খেয়ালও করেছেন রিদওয়ান আগের মতো চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে না। লজ্জায় মুখ লুকাতে চায়।
অথচ আগের রিদওয়ান এমন ছিল না। ছিল শিনা উঁচু করে চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস। বোনের কুকর্মে ছেলেটার মাথা হেট হয়ে গেছে।
ছেলেটার মলিন মুখ দেখে মেয়ের উপরে ভীষণ রাগ হলো উনার। ইচ্ছে করল দুটো থাপ্পড় দিতে মেয়েটাকে। কি শুরু করেছে এসব? অতিরিক্তই করছে কুহু। একটা মানুষের ধৈর্য্য বলেও কিছু আছে! এখানে ছেলেটার কি দোষ ? যা করেছে ওর বোন করেছে, সে কিছু করে নি। তবে তাকে কেন এসব সহ্য করতে হচ্ছে? যেখানে বাবা হওয়ার খবর শুনে প্রতিটা ছেলে খুশি হয়। আনন্দে নাচানাচি করে। মিষ্টি বিলায়। মুখে লেপ্টে রাখে খুশির ঝলক। সেখানে রিদওয়ান খুশি হতে পারছে না অখুশিও হচ্ছে না।
সে দুই অনুভূতিতে চাপা পড়ে দোদুল্যমান। এর একমাত্র কারণও কুহু।
কুহুর অসুস্থতা। তবুও মেয়েটা বুঝছে না, বুঝতে চাচ্ছে না। রিমি যেমন জেদ দেখিয়ে আগে/পিছে না ভেবে দেশে ছেড়ে চলে গেল। সে পৃথিবীর যেখানে থাকুক যেমনই থাকুক তাকে একদিন তাকে পস্তাবেই হবে, হবেই হবে। তাকে কেউ মুখ ফুটে অভিশাপ দেয় না। গালমন্দও করে না। তবুও সে কখনো ভালো থাকতে পারবে না। কাউকে কষ্ট দিলে কষ্ট পেতে হয়, শুধু আজ,কালের ব্যবধান। এখন খারাপ সময় যাচ্ছে। সবাই কষ্ট পেয়ে
গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। কিন্তু আজকের দিন অতিবাহিত হবে। সময়ের
পালাক্রমে আগামীকাল উপস্থিত হবে। এভাবে দিন যাবে। মাসও যাবে।
দেখতে দেখতে বছরও পার হবে। রুপকও হয়তো সব ব্যথা ভুলে নতুন করে জীবন সাজাবে। স্বপ্ন দেখবে। মানুষের জীবনে যখন প্রিয় কারো বিয়োগ ঘটে তখন অনেকেই ভাবে ‘তাকে ছাড়া আমি মরেই যাব।’ অথচ কেউ কারো জন্য মরে না। মুখ্য কথা প্রকৃতি শূন্যস্থান পূরণ পছন্দ করে না। সময়ের প্রেক্ষিতে শূন্যস্থানে পূর্ণতা এনে দেয় প্রকৃতি। ক্ষত-বিক্ষত
দূর্বলতায় সময় নিজেই মলম হয়ে শূন্যকে গড়ে তোলে পূর্ণ। আর এটা মনুষ্যের গড়া সাধারণ কোনো বাক্যপাঠ নয়। এটা প্রকৃতির আর্দশবাণী। মহাসত্যের সর্তকবার্তা।
উনি এসব ভেবে রাগে গজগজ করতে করতে মেয়ের রুমে গেলেন। কুহু এখনো সেইভাবে শুয়ে আছে। তাকিয়ে আছে সিলিংয়ের দিকে। চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে অশ্রুধারা। উনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতেও ভুলে গেলেন। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন নিঃশব্দে। তারপর দরজার দাঁড়িয়ে নরম সুরে বললেন,
-‘নিজেও কষ্ট পাচ্ছিস ছেলেটাকে কষ্ট দিচ্ছিস, কেন বল তো?’
-‘এসো আম্মু। আমার কাছে এসে বসো। তোমার সঙ্গে দু’টো কথা বলি। বুকের ভেতরটা কেমন জানি করছে। জানো মা, রিদ কাঁদতে পারে না।
শত কষ্ট পেলেও না। যখন খুব কষ্ট পায় তখন ওর চোখ লাল হয়ে যায়। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। আজ আমি ওকে খুব বাজেভাবে কথা শুনিয়েছি। খুব কষ্ট পেয়েছে আমার কথায়।’
-‘জানিস যখন কষ্ট পাবে তখন বললি কেন?’
-‘না বললে যে বার বার ছুটে আসত।’
-‘সে তোর স্বামী। স্বামী বউয়ের কাছে আসবে না?’
-‘না আসতে হবে না।’
-‘ স্বামীকে অকারণে কষ্ট দিয়ে, কাঁদিয়ে তুই কি ভালো থাকবি,মা? নাকি তোর অনাগত সন্তান ভালো থাকবে?’
-‘থাকার চেষ্টা করতে হবে।’
-‘বউ, বাচ্চা থাকতে একা থাকার চেষ্টা কেন করবে?’
-‘ভাইয়া রাতে রুমে থাকে না, জানো?’
-‘জানি।’
-‘কেন থাকে না, জানো?’
-‘(….)’
-‘কারণ রিমির পছন্দে ভাইয়ার রুমটা ডেকোরেশন করা। চারদিকে রিমি আর রিমি। আমার ভাইয়া যেখানে গুমড়ে মরছে। কষ্ট পাচ্ছে। সেখানে আমি সেই পরিবারের ছেলের সঙ্গে কীভাবে সংসার করি বলো? ভাবো?
ভেবে একটাবার বলো আমায়। আমার সংসার ছেড়ে থাকতে আমার কি কষ্ট হয় না? এত ভালোবাসে যে মানুষটা তাকে ছেড়ে থাকতেও আমার খুব কষ্ট হয়। ভীষণ কষ্ট হয়। আমি কাউকে বলতে পারছি না, বোঝাতে পারছি না। এই বলতে না পারার কারণে ভাইয়ার কষ্টটা আমি উপলব্ধি করতে পারছি, বুঝতে পারছি বুক ঝাঁঝরা হওয়ার যন্ত্রণা। রিদ কি বলে জানো? বলে, কারো কষ্ট উপলব্ধি করতে গেলে তাকেও কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়। সেই ব্যক্তির জায়গায় নিজেকে বসালে তাহলেই কষ্ট উপলব্ধি করা যায়। আমি তাই করেছি। এবং বুঝেছি আমার কষ্ট ভাইয়ার কষ্টের
কাছে কিছুই না। কেন কিছু না বলো তো? বলতে পারবে না, তাই না? আমিই বলছি, কারণ রিদ আমায় ভালোবাসে। খুব বেশিই ভালোবাসে, যখনই আমি ফিরে যাব আমাকে সাদরে গ্রহন করবে। ভুলচুক মাফ করে দেবে। কারণ আমি তাকে যতটা না ভালোবাসি তারচেয়ে শতগুন বেশি সে আমাকে ভালোবাসে। সন্মান করে। আগলে রাখে। বিশ্বাস করে। এবং
আমার সকল চাওয়া পাওয়াকে সর্বদা প্রাধান্য দেয়। কিন্তু আমার ভাইয়া যে বিশ্রীভাবে প্রত্যাখান হয়েছে, মা। ভালোবেসে, ভালোবাসার মানুষটার কাছে প্রত্যাখান হয়েছে। ভাইয়ার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে যখন ভাবি রিদের কাছে প্রত্যাখান হলে আমার কি হতো? কি করে সইতাম আমি?
এত ভালোবাসার পরেও রিদ আমাকে ফেলে অন্যের কারো কাছে চলে গেলে, আমার কেমন লাগত?এসব ভাবলে আমার মাথা কাজ করে না। আমার বুক ফেটে যায়। কষ্ট হয়। মানতে পারি না আমার ভালোবাসার মানুষের পাশে অন্য কেউ থাকবে। তাকে অন্য কেউ ছুঁবে। মানতে পারি না আমি। ভীষণ কষ্ট হয়। এই কষ্ট বুঝো মা? উপলব্ধি করছো তুমি? ঠিক
বুকের পাঁজর ভাঙলে যেমনটা কষ্ট হয় এই কষ্টটাও ঠিক তেমনই গো মা।
আমার ভাই মোড়ের উপর দিয়ে গেলে মুখ লুকায়। বিয়ের ভাঙার কারণ কেউ জানতে চাইলে মিথ্যা কথা বলতে হয়। সে রাতে রুমে থাকে না। যে ছেলে কখনো সিগারেট খেতো না সে এখন কত প্যাকেট শেষ করে তার ইয়াত্তা নেই। সব কথা আমার কানে আসে, আমি সব শুনি। কষ্ট হয়, খুব কষ্ট। এজন্য আমি রিদের কাছে যেতে পারি নি। সব ভুলে সংসার নতুন করে সাজানোর স্বপ্ন দেখতে পারি না। আমি নিরুপায়। ভাইয়ার মুখটা চোখের সামনে ভাসে। আমি পারি না আম্মু, সহজভাবে নিতে পারি না। আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। এসবের জন্য আমি দায়ী। শুধু আমি। আমার কারণেই ভাইয়া ওখানে গেল আর রিমির সঙ্গে সম্পর্কে জড়াল। না গেলে কি এসব হতো, হতো না? আমি কিভাবে আমার ভাইয়ের মুখে হাসি ফিরিয়ে আনব মা? কিভাবে? শুধু একবার বলে দাও কিভাবে, কিভাবে!’
-‘শান্ত হো মা। এই সময় এত হাইপার হওয়া যাবে না। শান্ত হও, সময় সব ঠিক করে দেবে।’
-‘কিচ্ছু ঠিক হবে না মা। কিচ্ছু না।’
-‘মেয়েটা আমাদের সবার স্বপ্নগুলোকে তছনছ করে স্বার্থপরের মতো চলে গেল। চলে গেল।’
একথা বলে কুহু তার মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদঁতে লাগল। কোলের ভেতর মুখ লুকিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে সে। দরজার পর্দা আড়াল করে দেওয়ালে হেলান দিয়ে রুপকও শুনছে। সেও কাঁদছে
নীরবে। ঝরঝর করে ঝরে যাচ্ছে নোনাজল। সেই জল গড়িয়ে আকাশি
শার্টের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কার জন্য বুকে কষ্ট চেপে এতদিন মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছিল ? কার ভালোর জন্য ভালো থাকার অভিনয় করে গেল? কি আশ্চর্য! কি হতভম্ব ব্যাপার, যার কারণে এসব করল তার কাছেই কি না ধরা খেয়ে বসে আছে। ছোট্ট কুহু! তার বোন। তার কলিজা পাখিটা তার ভেতরে থাকা কষ্টটুকুও দেখে নিয়েছে। পড়ে ফেলেছে! সে তার কষ্ট উপলব্ধি করতে নিজেও জ্বলছে এই জ্বালাতে?
ছোট্ট কুহুটা এত বড় হয়ে গেছে? এভাবে ভাবতেও শিখে গেছে? আর আফসোস নেই যে, কেউ তাকে বুঝে না। যদিও একথা কখনো বলে না সে। কারণ সে রিদওয়ানকে সব সময় পাশে পায়, সব পরিস্থিতিতে পায়।
রিমি যেদিন চলে গেল রিদওয়ান পরাজিত সৈনিকের মতো তার সামনে
এসে দাঁড়িয়েছিল। কথা বলতে পারছিল না। তার গলা কাঁপছিল। চোখ মুখ অস্বাভাবিক লাগছিল। হঠাৎ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রিদওয়ান হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল। হাত জোড় করতে গেলে রুপক নিজেও তার মতো করে বসে পড়ে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বন্ধুকে। বন্ধুর কষ্ট কমাবে কী সেই রিদওয়ানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। রিদওয়ান কিছু বলতে পারে না শুধু শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে। সে নিজেও জানে না আদৌ কখনো সব ঠিক হবে কি না! ভাঙা সম্পর্কগুলো কখনো জড়া লাগবে কী না।
রিমির হুটহাট করে নেওয়া ভুল সিদ্ধান্ত কতগুলো মানুষের জীবন বদলে দিলো। এজন্য শুধু রিমি দায়ী! রুপক দাঁড়াল না ছুটে রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে ওয়াশরুমে চলে গেল। শাওয়ার অন কাঁদতে লাগল ইচ্ছেমতো।
বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদতেও লজ্জা লাগছিল তার। কেউ দেখে ফেলার মতো বিশ্রীকর লজ্জা। কিছুক্ষণ আগে রিদওয়ান বের হতেই তার সঙ্গে দেখা হয়। টুকটাক কথা হয়। হঠাৎ তার নজর পড়ে রিদওয়ানের হাতের দিকে। রক্ত ঝরছে। হাত ধরতে গেলে রিদওয়ান দুই পিছিয়ে গিয়ে হেসে মাথা নাড়াল। এরপর ‘আসি’ বলে গাড়ি টান দিয়ে চলে যায়। বন্ধু এমন হাসির মানে সে বুঝে। খুব ভালো করে বুঝে।
__
পরেরদিন সকালবেলা,
রুপক তার রুমের ডেকোশন পুনরায় চেঞ্জ করে ফেলল। আসবাবপত্রও চেঞ্জ। একদম নিজের মনের মতো করে সাজাল সবকিছু। রাতে থাকতে শুরু করল রুমে। সব সময় গুনগন করে গান গায়। কথা বলে। নিজেকে হাসে। দুষ্টমি করে অন্যকে হাসায়। টুকটাক রান্না করে। টেষ্ট করার দায়িত্ব দেয় কুহুকে। হুঁটোপুঁটি গ্যাং এর সবাইকে ডেকে বাসাতে আড্ডা জমায়।
পিকনিক করে। এভাবে কিছুদিন চলে। প্রেগনেন্সির সিনট্রম দেখা দিতে শুরু করে কুহুর শরীরে। ধীরে ধীরে পেটও বড় হতে থাকে। স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে। হাঁটা চলা করতে পারে না। খেতে পারে না, রাতে ঘুম হয় না। এমন নানান সমস্যা দেখা দেয়। হঠাৎ একদিন রিদওয়ান তল্পিতল্পা নিয়ে
কুহুদের বাসায় হাজির হয়। কুহুর অমতে থাকতে শুরু করে। কুহু বিরক্ত হয়।কথা বলে না।কখনো কখনো এড়িয়ে চলে। কড়া কথা বলে। এমনকি তার রুমেও রিদওয়ানকে থাকতে দেয় না। অগত্যা রিদওয়ান রুপককে রুপককের রুম থেকে দিয়ে সে রুপকের রুমে থাকতে শুরু করে। আর বেচারা রুপকের ঠাঁই হয় ড্রয়িংরুমে। ভাইয়ের সমস্যা হচ্ছে দেখে কুহু বাধ্য হয়ে রিদওয়ানকে থাকতে দেয়। এভাবে নানান ঘটনার মধ্যে দিয়ে
এতে সবার সঙ্গে সবার সম্পর্কও সহজ হতে শুরু করে। বাসাটারও ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে আসে। খুনশুঁটি ঝগড়া হয়। তবে ক্ষনিকে তা ঠিক হয়ে যায়। মাঝে মাঝে নিলুফা ইয়াসমিন ও আতিকুল রহমানএকগাদা খাবার নিয়ে হাজির হোন। দিনভর চলে আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া।
এভাবে সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টার কাটা পেরিয়ে দিন যায়। দিন পেরিয়ে যায় অনেকগুলো মাস। আর এই পুরো সময়টাতে ছায়ার মতো সঙ্গী হয় রিদওয়ান। ভাইকে স্বাভাবিক হতে দেখে ধীরে ধীরে কুহুও স্বাভাবিক হয়।
মেনে নেয় রিদওয়ানকে। রিদওয়ান নিজেই রুপকের জন্য মেয়ে দেখতে শুরু করে। এরপর এই দুই পরিবারে খুশি বিলাতে আগমন ঘটে রুপ ও কথার। তাদের দুই কন্যা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। কুহু ফিরে যায় তার শশুরবাড়ি। শশুর-শাশুড়ী,স্বামী সন্তানদের নিয়ে সংসারে জোড়াতালি দিয়ে সুখ বিলাতে থাকে। রুপ ও কথা আগমনে দুই পরিবারে মিল হয়। যাওয়া আসাও হয়। সম্পর্কও সহজ হয়। এভাবে কেটে যায় আরো ক’টা বছর।
রুপক আর রিদওয়ান শেয়ারে ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে। শুরুর দিকে সেটা লস প্রজেক্ট হলেও ধীরে ধীরে লাভ্যংশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। দু’জনে
বিভিন্ন জেলায় সেই কোম্পানি ব্রাঞ্চ তৈরি করেছে।হাজার হাজার শ্রমিক
কাজ করে সেসব ব্রাঞ্চে। ছয়মাস আগে জরুরি কাজের তাগিদে রুপক জার্মান গিয়েছিল। জার্মানি এক কোম্পানির সঙ্গে ডিল সাইন করতে সে গিয়েছিল মূলত। থেকেছিল দশ কি পনেরো দিনের মতো। এবং ফেরার সময় সঙ্গে করে আনে রিমিকে। রিমিকে দেখে প্রায় সবার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। পুরনো ঘাঁ শুকিয়ে গেলেও দাগ থেকে যায়। এই ক্ষেতেও
তাই হয়েছে। অতঃপর দুই পরিবরকে জানায় তারা বিয়ে করে ফেলেছে। এই ব্যাপারে কেউ টু শব্দ করে না। সবাই রিমির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সুন্দরভাবে এড়িয়ে যায়। সে কিছু বললে কেউ জবাব দেয় না। একমাত্র রুপক বাদে কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না। রিমি রুপকদের বাসায় থাকে,
এজন্য কুহু ও রিদওয়ান কেউ সেই বাসাতে যায় না। ইসমত আরা মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যান। মাঝে মাঝে রুপ আর কথা দুজন গিয়ে ঘুরে আসে। রুপকের সঙ্গে কুহুও কথা বলে না। কারণ যার কারণে এতগুলো মানুষ কষ্ট পেয়েছে, কেঁদেছে, অথচ সে নিজের ভালো বুঝতে সবাইকে উপেক্ষা করে চলে গিয়েছিল। নিজের বাবা মা, ভাইয়ের সন্মানের কথাও ভাবে নি তার মতো সেলফিসের সঙ্গে কি কথা বলবে? কোন যুক্তিতে বা গদগদ হয়ে সব ভুলে পুনরায় এক হবে?সে পারবে না। তবে এখানে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়, রুপক কেন রিমিকে মেনে নিলো? রিমির কি সত্যি বিয়ে হয়েছিল? এতদিন পর রিমিকে কোথায় পেল? মোদ্দাকথা, এতকিছু পর কোন যুক্তিতে রুপক রিমিকে বিয়ে করল, কেন করল? এই প্রশ্নগুলো প্রথমদিন ইসমত আরা নিজে সরাসরি করেছিল রুপককে। তাও আবার মা হয়ে সবার সামনেই। এই প্রশ্নে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রুপক রিমির চোখে চোখ রেখে বলেছিল,
-‘যাকে ভালোবাসি তার দোষ গুন মিলিয়েই ভালোবেসেছি। তার গুনটা যেমন মনে রেখেছি, দোষটা মাফ করে দিয়েছি। ইচ্ছে ছিল, রিমি বিয়ে করুক। অন্যের বাচ্চা মা হোক। তবে যদি কখনো কোনোদিন সে আমার কাছে আমার হতে, ফিরতে চায় তাহলে আমি তাকে ফিরিয়ে দেবো না।’
-‘সে ডিভোর্সী!’
-‘মা, রিমি বিয়েই করে নি। ম্যাক ওর মগজ ধোলাই করে বুঝিয়েছিল যে, বাঙালি বউদের একঘেয়েমি জীবন। এদের জীবনে হেঁশেল সামলানোই সীমাবদ্ধ। এরা স্বাধীনতা পায় না। এদেরকে কোনো স্বাধীনতা দেওয়া হয় না। শশুর শাশুড়ী, স্বামী, সন্তানে সেবা করে করেই জীবন শেষ। এমনকি কুহুর ব্যাপারে নানান কথা বলে তার ভেতরে জেদের সৃষ্টি করেছ়ে।বোকা মেয়েটা সেসব শুনে জেদের বশে বিয়ে করবে না বলে দেশ ছেড়েছিল।
গিয়ে বুঝে ভুল করেছে সে। বাসায় ফেরারো মুখ নেই। পরে একজনের সাহায্যে ইতালি চলে যায়। সেখানে জব করে। ম্যাক তার পিছু নেওয়াতে চলে যায় জার্মান। সেখানেই তার সঙ্গে আমার দেখা। প্রথমবার আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছিল এবার আর পালানোর সুযোগ দেই নি। এবার জোর বিয়ে করে ধরে এনেছি। তোমরা তো আমাকে ভালোবাসো তাই না? তোমরা চাও আমি ভালো থাকি। তাহলে বলব, তোমরা ওকে মাফ করে দাও। মেনে নাও। তাহলেই আমি ভালো থাকব। আমার সব ভালো থাকাটুকুই ওর মধ্যে সীমাবদ্ধ।’
এভাবে রিমি আবার ফিরে এসেছে। সে রুপকের স্ত্রী হয়ে লোক সমাজে পরিচিত। হঠাৎ ব্রেক কষাতে রিদওয়ানের ভাবনা ছেদ ঘটল। সে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এলো বর্তমানে। কপাল কুঁচকে কিছু বলার আগেই ড্রাইভার
নেমে গেল। রিদওয়ান জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখে কুহু তার স্কুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিসব বলাবলি করছে ড্রাইভারের সঙ্গে। ব্যাপারটা বোঝার জন্য রিদওয়ান বের হতেই কুহু বলল,
-‘এই যে মিস্টার হ্যান্ডসাম আমার সঙ্গে আসুন।’
-‘ এই রোদের মধ্যে স্কুটি নিয়ে বেরিয়েছো কেন তুমি?’
-‘শখে, খুশির ঠেলায়। এবার জলদি আসুন।’
-‘ যেখানে যাওয়ার বিকেলে যাব। এখন রোদের মধ্যে কোথাও যাবে না তুমি। গাড়িতে ওঠো।’
-‘রুপ, কথা, শোনো মামনী তোমরা বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে দাদুমনির কাছে গুড গার্ল হয়ে খেয়ে নিও, কেমন? আমি আর বাবা একটা কাজে যাচ্ছি। কাজ সেরে জলদি জলদি ফিরে আসব।’
-‘ওক্কে মাম্মা।’
তারপর রিদওয়ানের কথা উপেক্ষা করে কুহু ড্রাইভারকে যেতে বলল।
ড্রাইভার বাধ্য হয়ে চলেও গেল। রিদওয়ান প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে তাকিয়ে আছে কুহুর দিকে। তা দেখে কুহু গালভর্তি হাসল। এরপর রিদওয়ানের আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে হেলমেট এগিয়ে দিয়ে পরতে ইশারা করল।
রিদওয়ান বাধ্য হয়ে হেলমেট পরে কুহুর পেছনে বসে পড়ল,
-‘এই রোদের মধ্যে কোথায় যাচ্ছো বলবে তুমি?’
-‘ বাসায়।’
-‘কার বাসায়?’
-‘আপনার শশুরের বাসায়।’
-‘কেন, হঠাৎ ওখানে কেন? এই স্কুটি থামাও। আমি যাব না।’
-‘আপনি যাবেন। আপনার ঘাড়ও যাবে।’
-‘কুহু!’
-‘রিদওয়ান!’
-‘ দিন দিন বড্ড বেয়াদব হচ্ছো তুমি। ভুলে যেও না তুমি দুই কন্যার মা। তোমার দেখাদেখি আমার মেয়েগুলোও এসব শিখবে!’
-‘ শিখুক। দাগ থেকে যদি দারুণ কিছু হয় তবে দাগ..!’
-‘ উফ! ভর দুপুরে ওই বাসায় কেন যাচ্ছো বলবে তুমি?’
-‘ মামা হচ্ছেন। মিষ্টি নিয়ে বোনকে দেখে আসবেন না? আমাদের ছানার আগমনে অর্ধেক অভিমান মুছে গিয়েছিল। এবার এই পুঁচকের আগমনে পরিপূর্ণ অভিমান মুছে ফেলি। অনেক তো হলো, আর কত? যতই রাগ বাগ করি তাদের দুরে সরিয়ে আমরাও কেউ ভালো নেই, তাই না? কষ্ট দিয়ে আমরাই কষ্ট পায়। তাছাড়া রাগ পরের উপরে করা যায় ঘরের মানুষের উপর কতদিন রাগ করে থাকা যায় বলুন? তাছাড়া রিমি আপু কেঁদে কেঁদে অনেকবার মাফ চেয়েছে। আপনিই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
এখন তার এই অবস্থা তার উপরে রাগ করে থাকা উচিত হবে না। এবার রাগ বাগ সব বাদ।’
-‘তুমি মাফ করতে পেরেছো?’
-‘রেগে ছিলাম আমার ভাইয়াকে কষ্ট দিয়েছিল তাই। ফিরে এসে আমার ভাইয়ার হাসি ফিরিয়ে এনেছে দেখে অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি।
এতদিন ভাণ করে ছিলাম। তবে কিছুক্ষণ আগে সুখবরটা শুনে আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। ওরা ভালো থাকুক। আপনিও ওই সব ভুলে যান। এখন গিয়ে বোনের সামনে দাঁড়িয়ে তার খুশিটাকে আরো বাড়িয়ে দিন।’
রিদওয়ান নিশ্চুপ। তার নীরাবতাকে সম্মতির লক্ষণ ধরে কুহু মিটিমিটি হাসল। তাকে হাসতে দেখে রিদওয়ান তার কোমর জড়িয়ে ধরতেই কুহু মুচড়ে উঠে বলল,
-‘আরে কি হচ্ছে, কি!’
-‘ ভালোবাসা হচ্ছে।’
-‘রাস্তার মধ্যে এত ভালোবাসা লাগবে না।’
-‘নির্জন রাস্তা। কেউ দেখবে না তো।’
-‘হাত সরান।’
-‘সরাব না।’
-‘কাতুকুতি লাগছে।’
-‘লাগার জন্যই তো ধরেছি।’
-‘উফ, হাত সরান, নাহলে কিন্তু..! ‘
-‘নাহলে কি?’
-‘প্রথম দেখার মতো ভুল ঠিকানায় নিয়ে চলে যাব।’
একথা শুনে রিদওয়ান হাসল। মনে পড়ে গেল পুরনো কথা। অনেক যুদ্ধ করেই তারা এক হয়েছিল। ভালোবেসেছিল। কুহু এখন সুস্থ। স্বাভাবিক।
দুই পরিবার নিয়ে তারা ভীষণ সুখী। রিদওয়ান হঠাৎ পেছন থেকে শক্ত করে কুহুকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলল,
-‘তাই চলো। তারপর আবার সেখান থেকে’ই পুনরায় আমাদের পথচলা শুরু করব। নতুন ভাবে। নতুন রুপে। নতুন কাহিনির সংযোজনে।’
সমাপ্ত।’