আমায় রেখো প্রিয় শহরে পর্ব-০৮

0
16

#আমায়_রেখো_প্রিয়_শহরে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#অষ্টম_পর্ব

এক সপ্তাহ পরের ঘটনা,
এই এক সপ্তাহে কারো জীবনেই কোনো পরিবর্তন আসে নি। সব চলছে আগের নিয়মে। রিদওয়ানের প্রথম প্রথম নিজের কাছে কেমন যেন লাগত। অনেক বারই ভেবেছে চলে যাবে। রুপককেও জানিয়েছে, তার জন্য বাসা খুঁজে দিতে। রুপক গুরুত্বই দেয় নি। বরং মাছি তাড়ানোর মতো এড়িয়ে গেছে। ইসমত আরা বেগমকে জানালেও কোনো কথায় শুনেন নি। উল্টে ভুলভাল যুক্তি দেখিয়ে তারই মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। পরে কুহুর বাবা একথা শুনে নিজে বলেছেন সে যেন থাকে। বাসার ছেলে হয়ে যেন থাকে। সে যদি থাকে তারা পরিবারের সবাই খুব খুশি হবে।

একথা শুনে সেও কিছু বলার সাহস পায় নি। পারে নি জোর দেখিয়ে চলে যেতে। ওইদিকে তার প্রিন্সিপাল বাবাও বাসায় উঠার জন্য আকার ইঙ্গিত দিচ্ছে,বোঝাচ্ছে সে যেন বাসায় উঠে। বাবা ছেলে একসঙ্গে থাকবেন। উনিও ছেলেকে কাছে পেতে পান। মরা বাড়িটাতে প্রাণ ফেরাতে চান। পুনরায় সেই সংসার নামক স্বপ্নে জোড়াতালি দিয়ে জীবিত করতে চান।
উনি এখন একা। উনার সঙ্গীর প্রয়োজন। প্রয়োজন দুটো মনের কথা বলা মানুষ। একথা শুনে সে শুধুই হেসেছে। এবং
স্পষ্টভাবে জানিয়েও দিয়েছে, ‘যেখানে আমার মা থাকে না, বোন থাকে না, একদিন নিজেও ঠাঁই পায় নি, আজ সেখানে আমিও থাকব না।’
একথা শুনে বাবা কেবল তাকিয়ে ছিলেন। বাবার তাকানোয় তার বুকটা ক্রমশই ভারি হয়ে আসছিল। নিজেকে সেলফিস মনে হচ্ছিল। কিন্তু তার হাতেও কিছু ছিল না। আজ উনার সঙ্গে তার সম্পর্কের এমন ছাড়া ছাড়া ভাব থাকত না। যদি না তিনি নিজের বাবার মায়ের অন্যায় আবদারকে প্রশ্রয় না দিতেন। বাবা মায়ের কথায় স্ত্রীসহ ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে
দুটোকে নানুর বাসায় রেখে না আসতেন। দীর্ঘদিনছেলেমেয়ে
দুটোকে চোখের দেখা দেখতে যেতেন। কোনো সম্পর্ক এমনি এমনি নষ্ট হয় না। নষ্ট হয় অবহেলায়। অনাদরে। অবিশ্বাসের ছোবল যখন বিশ্বাসকে দংশন করে তখন সম্পর্কে জং ধরে।
মরিচা ধরে বন্ধনে। মায়াতে। আবেগে জর্জরিত মোহতে। সে তবুও উনার সঙ্গে কথা বলে। সন্মান দেখায়। কারণ একটাই উনি তার জন্মদাতা পিতা। উনার রক্ত বইছে তার শরীরে। সে উনার হাতে ধরে হাঁটছে শিখেছে, কথা বলতে শিখেছে, সঙ্গে শিখেছে ‘বাবা’ বলার সুযোগ। তবে আফসোস একটাই তার বাবা তার মিষ্টি মধুর শৈশবকে কেড়ে নিয়েছে। তাদের দুই ভাইবোনকে বাবার আদর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছে।
এগুলো হিসাব কে দেবে?
তাছাড়া সে মায়ের সঙ্গে রাগ করে মূলত দেশে এসেছে। তার ব্যবহারে মা ভীষণ কষ্টও পেয়েছে। কষ্ট পেয়েছে ছোটো বোন রিমিও। সে হঠাৎ করে এসেছে ঠিকই। তবে অকারণে আসে নি। যেই কাজে এসেছে সেই কাজ ফুলফিল না করে ফিরবে না সুইজারল্যান্ড। এটাই তার ওয়াদা।

বাংলাদেশে আসার পর থেকে তার মা তাকে ফোন করে নি। কথা বলে নি। এখন মা যদি শোনেও সে বাবার সঙ্গে থাকছে তাহলে হয়তো আর কোনোদিন যোগাযোগই করবে না। আর না রিমিকে যোগাযোগ করতে দেবে। তার মা এমনই কঠোর।
বাবাও কম যায় না। আর এই দুই কঠোর ব্যক্তির মাঝখানে পড়েছে তারা দুই ভাইবোন। তারা না পারে বাবাকে ছাড়তে আর না মারে মাকে ছাড়া থাকতে। এভাবেই দীর্ঘ দশটা বছর তারা দেশের বাইরেই কাটিয়েছে। তবে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে
তার প্রায় যোগাযোগ হতো। সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ হতো রুপকের সঙ্গে। রুপক তার জীবনে প্রথম বন্ধু। ভাগ্যে গুনে রুপকের মতো বন্ধু পেয়েছে সে। এজন্য শুকরিয়াও করে।
তার বন্ধু ভাগ্য ভালো, পড়াশোনায় ভালো, কেরিয়ার ভালো,
সবকিছুই ভালো তবে তার আফসোস সে পরিবার পায় নি।
এজন্যই বোধহয় পরিবার জিনিসটাকে তার কাছে বরাবরই সোনার হরিণ মনে হয়। হরিণ সবাই কিনতে পারে না৷ সবার ভাগ্যেরও জোটে না। কারণ এটা কিনতে হয় ভালোবাসার বিনিময়ে। সুখ দিয়ে। বিশ্বাস দিয়ে। কিন্তু বাবা মায়ের মধ্যে কারোই এই এগুলোর একটাও নেই। তাদের আছে মনভর্তি ইগো, আত্মঅহমিকা, ক্রোধ, আর একরাশ অবিশ্বাস। যা সম্পর্ককে ধূলিসাৎ করার জন্য যথেষ্ট। ফলে তাদের সংসার বর্তমানে জলে ভাসা পদ্মের ন্যায় ভেসে যাচ্ছে। ঠাঁই নেই। গতি নেই। নিজের আঁটকে রাখার ইচ্ছে নেই। ইচ্ছে থাকলেও এখন আর জো নেই। আর তাদের এই ভাসা ভাসা খেলাটাই হয়তো এই বছরে ডিভোর্স নামক মুক্তিতে সমাপ্তি টানা হবে।

বাবার উপর রাগ। মায়ের উপর অভিমান। নিজের ভাগ্যের উপর বড়ই অসন্তুষ্ট রিদওয়ান। এজন্য মেজাজটা সবসময় থাকে খিটমিটে। তবে কুহুদের বাসায় আসার পর থেকে সে
দৈনন্দিন কাজে কিছুটা পরিবর্তনও এনেছে। আনতে বাধ্য হয়েছে। কারণ একা থাকা আর স্বপরিবারে থাকা এক নয়। স্বপরিবারে থাকতে গেলে কিছু নিয়ম মানতে হয়। অন্যের সুবিধা অসুবিধার ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হয়। নিজেকেও নিজ দায়িত্বে কিছু দায়িত্বের বোঝা ঘাড়ে নিতে হয়। তবেই না সে পরিবারের বিশ্বস্ত সদস্যের স্থান পাবে। ভালোবাসা পাবে৷ পাবে শ্রদ্ধা, স্নেহ এবং ভরসা। জগিং করতে করতে এসবই ভাবছিল রিদওয়ান। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। তার টি শার্ট ঘেমে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। রোদ চড়ে গেছে আর দৌড়ানো যাবে না। তাই সে বাসায় পথে পা বাড়াল। বাসায় গিয়ে দেখে ইসমত আরা বেগম ছাড়া কেউ এখনো উঠে নি।
উঠবে আরো পরে। তাছাড়া আজকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ঘড়িতে সকাল সাড়ে আটটা। রিদওয়ানকে বাসায় ঢুকতে দেখে ইসমত আরা বেগম একগাল হাসলেন। মুখভর্তি হাসি নিয়ে বললেন,
-‘আব্বা ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নাও।’
-‘জি আন্টি।’
একথা বলে রিদওয়ানও ভদ্রতাসূচক হেসে ফ্রেশ হতে চলে গেল। তারপর ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে রেডি হয়ে বের হতেই দেখে কুহু ড্রয়িংরুমে বসে আচার খাচ্ছে। খালি পেটে কেউ আচার খায়?এখন যদি কিছু বলা হয় তাহলে হয়তো বলবে,
‘কেউ খায় না বলে কি আমি খেতে পারব না?’সে কেন বলল, কি জন্য একথা বলল এই মেয়েটা তো বুঝবেই না৷ এরচেয়ে একে কিছু না বলায় উত্তম। সে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে ইসমত আরা বেগম রান্নাঘর পরিষ্কার করছে। সে গিয়ে সুন্দরভাবে ডেকে বলল,
-‘ আন্টি আমার আর্জেন্ট বাজারে যাওয়া লাগত। রুপক ঘুমাচ্ছে। বলছিলাম যে, বাজারটা যেন কোনদিকে?’
-‘বাজারে যাবে? একা? দাঁড়াও, কুহুকে সঙ্গে নিয়ে যাও। সে অলিগলি সব চিনে।’
একথা বলে উনি কুহুকে ডেকে যাওয়ার কথা বললেন। কুহু রিদওয়ানকে আপাদমস্তক দেখে নিলো। তারপর আচার মাখা হাতটা ধুয়ে বলল,
-‘পাঁচ মিনিট দাঁড়ান আমি দশ মিনিটে রেডি হয়ে আসছি।’
একথা বলে কুহু রুমে গেল। তারপর পাক্কা আধাঘন্টা পর সে রেডি হয়ে বের হলো। সাজগোছ কিচ্ছু করে নি। সোনালী রঙের একটা থ্রি পিস পরেছে। আর কাঁটা দিয়ে উচুঁ করে চুল বেঁধেছি। এইটুকুতেই তার আধাঘন্টা লেগেছে। রিদওয়ানের রাগ হলেও নিজেকে সামলে নিলো। তারপর ইসমত আরা বেগমকে বলে যখন বের হবে তখন ইসমত আরা কুহুকে বললেন,
-‘ছেলেটাকে সাবধানে নিয়ে যাবি। খবরদার বলছি একদম হাঁটাবি না। আর যদি ভেবেও থাকিস ছেলেটাকে নাস্তানাবুদ করবি। তবে বলে রাখছি আজ তোর পিঠে চ্যালাকাঠ ভাঙব আমি।’
আম্মুর কথা শুনে কুহু করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল। তার মনের কথা তার মা জানল কিভাবে তাই বুঝল না। সে সত্যি সত্যিই ভেবেছিল রিদওয়ানকে হাঁটাবে। হাঁটাতে হাঁটাতে জান ত্যানা ত্যানা করে ফেলবে। তারা বাসা থেকে বেরোতেই খালি রিকশা দেখতে পেল। কুহু ইশারায় রিকশা থামাতে বলে উঠে বসল। রিদওয়ানও বসল। তবে
এমনভাবে সরে বসল যেন কুহুর গায়ের সঙ্গে তার স্পর্শ না লাগে। আড়চোখে ব্যাপারটা খেয়াল করল কুহু। কেন জানি ভালোও লাগল। টং টাং বেল বাজিয়ে রিকশা চলছে গলির মোড়ের রাস্তা ধরে। তখন কুহু বলল,
-‘কোথায় যাচ্ছি জানতে পারি?’
-‘সবজি বাজার করতে। যে বাজারে টাটকা সবজি পাওয়া যাবে সেখানে চলো।’
-‘মানে কি? আপনি এখন বাজার করতে যাচ্ছেন? তাও হিরো সেজে? বাংলাদেশের সবজি বাজার সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে?’
-‘ধারণা নেই বলেই তোমাকে সঙ্গে নিয়েছি। আর হ্যাঁ যারা হিরো তাদের এক্সটা করে হিরো সাজা লাগে না। বরং যারা
অর্কমা, কাজ থাকে না। তারাই সাজগোজের পেছনে সময় ব্যয় করে।’
কুহু মুখ ভেংচাল। রিদওয়ান দেখেও মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। ভাঙাচোরা চিকন রাস্তা। একটা রিকশা গেলে অন্য রিকশাকে সাইড দিতে দাঁড়াতে হয়। এরমধ্যে ফাঁক গলিয়ে সাইকেল ওয়ালা সেই রাস্তায় ঢুকে পড়ে। এরপর শুরু হয়, বাংলা গালাগালি। বাংলাদেশের এই ব্যাপারটা খুবই খারাপ লাগে তার। ঘন্টার ঘন্টা সময় ব্যয় করতে হয় জ্যামে পড়ে।
যুগের পর যুগ এভাবেই চলে আসছে। তবুও এর সমাধান নেই। মনে মনে বিরক্ত হয়ে এসবই ভাবছিল রিদওয়ান। কুহু চুপ করে বসে আছে। মুখ কখন চকলেট পুরেছে কে জানে। চকলেট কটমট করে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। রিদওয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।তাকে তাকাতে দেখে কুহু একটা লাভ ক্যান্ডি
এগিয়ে দিলো। রিদওয়ান নিলো না সে বাচ্চাদের খাবার খায় না। একথা শুনে কুহু বলল,
-‘আসলে মন থেকে দিচ্ছিলামও না। তাকাতে দেখে ভদ্রতা দেখাতে দিচ্ছিলাম। না নিয়ে খুব উপকার করলেন, হে হে। ‘

রিদওয়ান জবাব দিলো না৷ তখন ফোনে টোন বেজে উঠল। স্ক্রিণে ভাসা নাম্বার আর সময় দেখে কলটা রিসিভও করল। কল রিসিভ করা মাত্রই ফোনের স্কিণে পুতুলের মতো দেখতে একটা মেয়ের ছবি ভেসে উঠল। তবে তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেয়েটি গড়গড় করে বলল,
-‘আচ্ছা সমস্যা কি তোমার? ফোন করলে ধরো না কেন?
এই ভালোবাসো আমাকে? এটা ভালোবাসার নমুনা? আম্মু ঠিকই বলে তুমি একটা মিথ্যাবাদী। মিথ্যা কথা বলে দেশে গিয়েছ তুমি।’
পাশাপাশি বসে থাকায় কুহু একবার উঁকি মেরে মেয়েটাকে দেখল। সত্যিই মেয়েটা দেখতে একটা পুতুল যেন। গফ টফ হবে বোধহয়। এমন খারুস লোকের এত সুন্দর গফ! বাপ্রে ভালোই পটিয়েছে। কুহু আরো কথা শুনতে কান খাঁড়া করে রাখল। আরো দু’একটা কথা শুনে বুঝল, এদের অভিমানের চ্যাপ্টার চলছে। রিদওয়ানকে কিছু বলার সুযোগ দিচ্ছে না মেয়েটি। নিজেই গালমন্দ করে যাচ্ছে। তা সেটা কুহু খুশিই হলো। মেয়েটাকে বাহবা দিতে ইচ্ছে করল। তখন রিকশার চাকা গর্তে পড়ল, আর রিকশার হুডের সঙ্গে তার মাথাটা বারি খেল। ব্যথা পেয়ে একা একাই মাথা ঠলতে ঠলতে বলে বসল, ‘মা গো, মাথাটা গেল আমার। এই রিকশা মামা দেখে রিকশা চালান। বিয়ে হয় নি এখনো।’
একথা বলা মাত্র মেয়েটা হইহই করে বলল,
-‘তোমার পাশে ওটা কে? তুমি কাকে নিয়ে ঘুরছো? আমরা তোমার টেনশনে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়েছি। আর তুমি কি না তোমার গফকে নিয়ে ঘুরছো?’

মেয়েটাকে এবার রিদওয়ান ধমকে উঠল। হঠাৎ ধমক খেয়ে কিউট মেয়েটি চুপ করে গেল৷ তারপর কুহুর মুখের সামনে ফোনটা ধরে ভালো করে দেখাল। কুহুকে দেখে মেয়েটা কল কেটে দিলো। কল কাটা মাত্রই একটা মেসেজ এলো, ‘ এটা রুপক ভাইয়ার বোন? এর জন্যই দেশে গিয়েছো তুমি? ভাবি কিন্তু মাশাল্লাহ ভাইয়া। পাশাপাশি দারুণ মানিয়েছে৷ ভাবির ঠোঁটের পাশের তিলটা কি রিয়েল? জানাবে কিন্তু। আর হ্যাঁ,
ভাবিকে দেখানোর জন্য এমন নাটকের মানে বুঝল না।’
রিদওয়ান এবার মেসেজ করল,
‘ বুঝতে হবে না। তবে শোন বাবার জন্য বাঁশ রেডি। তুই আবার ওভার একটিং করে সব গড়বড় করে দিস না। সো বি কেয়ারফুল।’

To be continue……..!!