আমার অদিতি পর্ব-০৩

0
94

#আমার_অদিতি
#পর্ব – ৩
#নয়োনিকা_নিহিরা

বাড়ি ফিরতেই অদিতিকে লিভিংরুমের ডিভানে বসে এক যুবকের সাথে হাসিমুখে কথা বলতে দেখে থমকে দাঁড়ায় আহনাফ। ধুক ধুক করে ওঠে তার হৃদযন্ত্রখানি। আলভী ডিভানের অন্য সাইডে বসায় আহনাফ তার মুখ দেখতে পায় না। আহনাফ ভেতরটা অস্থিরতায় ছটফট করে ওঠে পরক্ষনেই ডিভানের আরেক পাশেই নিজের মাকে বসে থাকতে দেখে ভেতরে ভেতরে খানিকটা স্বস্তি অনুভব করে সে। আহনাফ সামনে আসতেই তিন জোড়া চোখ তার দিকে নিবন্ধ হয়। আলভীকে দেখার সাথে সাথে আহনাফ সচকিত হয়ে শুধায়,” আলভী তুই? কবে দেশে ফিরলি?”

আলভী আহনাফকে দেখেই খুশিতে করমর্দন করে উচ্ছ্বাসিত গলায় বলে,” আম টোটালি ফাইন ব্রো। এইতো দুদিন হলো দেশে এসেছি ঘুরতে। আর ব্রো ভাবী কিন্তু খুবই সুইট। ইউ আর সো লাকী ব্রো।”

আলভীর কথা শুনে আহনাফ আড়চোখে অদিতির দিকে তাকায়। এতক্ষন ধরে প্রাণবন্ত থাকা অদিতি আহনাফকে দেখেই কেমন যেন উদাসীন হয়ে গেছে। বিষয়টা দৃষ্টি এড়ায়নি আহনাফের। বুকের ভেতরটা হিংসায় কিড়মিড় করতে লাগলো আহনাফের। আহনাফ গভীর দৃষ্টিতে অদিতির দিকে তাকিয়ে আলভীর সামনেই অদিতির বাহু জড়িয়ে ধরে অদিতিকে নিজের সাথে ঘেঁষে দাঁড় করালো। অদিতি কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো আহনাফের দিকে। আজ প্রথম আহনাফ স্পর্শ করলো অদিতিকে।

আহনাফ গা ছাড়া ভাব নিয়ে বললো,” আমি জানি সেটা। তুই কি এখানেই থাকবি নাকি?”

আলভী খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,” থাকার জন্যই তো এসেছি। মামার বাসায় বেড়াতে এসেছি কমপক্ষে এক মাস তো ঘুরবোই।”

আলভীর কথা শুনে হিংসায় অন্তরটা ফোঁসফোঁস করে উঠলো আহনাফের। শয়তানটা নাকি বাসায় থাকবে। বাসায় কি এখন সে একা থাকে? তার স্ত্রী অদিতিও তো থাকে।

আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,” আমার সারাদিন কাজ থাকে অফিসে। তোর সাথে ঘুরাঘুরির সময় নেই আমার।”

_” আরে সমস্যা নেই ব্রো আমি ভাবীর সাথে ঘুরবো। এমনিতেও তোমার সঙ্গে ঘুরাটা বোরিং। সারাক্ষণ গম্ভীর হয়ে মুখটা গোমড়া করে রাখো।”

আলভীর কথা শুনে অদিতির ফিক করে হেসে ওঠে। তবে পরক্ষনেই আহনাফের গম্ভীর মুখখানা দেখে হাসি বন্ধ করে চোঁখ মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়ায়। আহনাফ চোয়াল শক্ত করে অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে আলভীর দিকে চেয়ে আছে।

আলভী শুষ্ক ঢোক গিলে বলে,” কুল ব্রো কুল। আমি তো শুধু মজা করছিলাম।”

আহনাফ গম্ভীর স্বরে বলে,” যা ঘুরাঘুরি করার নিজের বাসায় গিয়ে কর যা।”

আলভী আহনাফের মায়ের দিকে চেয়ে অস্থির কন্ঠে বলে,”মামি দেখেছো আহনাফ ব্রো আমাকে চলে যেতে বলছে। আরে আমার মামার বাড়িতে আমি বেড়াবো না।”

আজমেরী ওয়াহিদ তাল মিলিয়ে বলেন,” ঠিকই তো বলেছে আলভী। ওর মামার বাড়িতে ও যতদিন খুশি থাকবে। ঘুরবে, বেড়াবে তোর সমস্যা কোথায়? সবাইকে নিজের মতো অন্তর্মুখী বানাতে চাস কেনো?”

আলভী আহনাফকে আরো রাগানোর জন্য অদিতির দিকে চেয়ে বলে,” আর বলো না ভাবী তোমার হাজব্যান্ডকে কিচ্ছু বলা যায় না। কিছু বললেই রাগে ছ্যাত করে ওঠে।”

আহনাফ আলভীর দিকে তেড়ে এসে বলে,”খুব মজা নিচ্ছিস না তুই? কতবার বলেছি আমার সাথে অহেতুক মজা করবি না। তোকে এমন জায়গায় ঘুরতে পাঠাবো ঘুরার শখ মিটে যাবে। এক মাস হসপিটাল ট্যুরে পাঠাবো তোকে আমি খুশি।”

_” নো ব্রো! আমি এই বিশেষ ট্যুরে আপাতত যেতে চাচ্ছি না। ভাবী তোমার গোমড়ামুখো জামাইকে সামলাও প্লিজ।”

আজমেরী ওয়াহিদ হেসে বললেন,” এই তোরা দুজন থাম এবার। সেই ছোটবেলার মতো ঝগড়া- মারপিট শুরু করে দিয়েছিস।”

আহনাফ আলভীকে ছেড়ে দিয়ে অদিতির দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে যায় হনহন করে। অদিতিও রাতের খাবার তৈরি করার জন্য রান্নাঘরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরেই আহনাফের মা রান্নাঘরে এসে অদিতিকে রাশভারী কন্ঠে বলেন,”শোনো অদিতি,বাসায় আলভী যতদিন থাকবে ততদিন তোমাকে আহনাফের রুমেই থাকতে হবে। আমি সার্ভেন্টদের বলে তোমার জিনিসপত্র গেস্টরুম থেকে বের করে আহনাফের রুমে শিফ্ট করতে বলেছি। আলভী যেনো তোমাদের মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়ন আঁচ করতে না পারে।”

অদিতি চিন্তিত স্বরে বলে,” কিন্তু মা ওনার রুমে গেলে উনি যদি আবার রাগারাগি করেন?”

_” কেনো রাগারাগি করবে? আহনাফ তো দেখলোই আলভী এসেছে। আর তোমার সাথে রাগারাগি করলে তুমিও রাগারাগি করবে অদিতি। নিজেকে একটু শক্ত করো মা। নিজের অধিকার নিজেকেই বুঝে নিতে হয়।”

আজমেরী ওয়াহিদ অদিতির মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন।
__
সবাই ডিনার শেষ করে যে যার ঘরে চলে যায়। অদিতি কাঁপা কাঁপা পায়ে আহনাফের রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। আহনাফ তো বার বার অদিতিকে মানা করেছে তার রুমের সামনে না আসতে সেখানে অদিতি কেনো গায়ে পড়ে আহনাফের রুমে যাবে? অদিতি অনেকক্ষন ভেবে আহনাফের রুমে না ঢুকে ছাদে চলে যায়।

আহনাফ ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে অদিতির আসার অপেক্ষা করছিলো। আজমেরী ওয়াহিদ আহনাফকে শাসিয়ে বলেছেন অদিতিকে রুমে ঢুকতে দিতে। আহনাফও আজ কোনো দ্বিমত পোষণ করেনি। কেনো করেনি তা সে নিজেও জানে না।

ল্যাপটপ হাতে নিয়ে আড়চোখে দরজার দিকে বার বার তাকাচ্ছে আহনাফ। অদিতি তবুও না আসায় আহনাফ অপেক্ষা করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠে। অস্থির হয়ে রুমের চারপাশে পায়চারি করতে করতে আহনাফ আনমনেই ভাবে,” অদিতি আবার আলভীর সাথে কথা বলছে নাতো?”

আহনাফ তাড়াহুড়া করে ছুটলো গেস্টরুমের দিকে। উতলা হয়ে গেস্টরুমের ডোর নক করা শুরু করলো। আলভী ঘুম জড়ানো চোঁখে দরজা খুলে বললো,”কি ব্যাপার ব্রো! বউ রেখে আমার রুমে কি কাজ?”

_”আমার বউ কোথায়?”

_” তোমার বউ কোথায় সেটা আমি কিভাবে জানবো?”

আহনাফ আড়চোখে চারপাশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলে গেলো। এতক্ষনে আলভীর ঘুমের রেশ সম্পূর্ণ কেটে গিয়েছে আলভী ভ্রু কুঁচকে বললো,” আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে ব্রো আবার কোথায় দৌঁড় দিলো? বিয়ে করলে এই এক সমস্যা বউয়ের চিন্তায় পাগল হয়ে যেতে হয় ভাগ্যিস আমি এখনো সিঙ্গেল জীবন পার করছি।”

কথাগুলো বলে আলভী হাই তুলতে তুলতে আবার লাফ বিছানায় শুয়ে পড়ে।

এদিকে সারা বাড়ি অদিতিকে খুঁজে না পেয়ে আহনাফের অস্থিরতা আরো বাড়তে থাকে। কোথায় গেলো মেয়েটা? নিজেদের বাসায় চলে যায়নি তো?

আশেপাশে তাকাতেই আহনাফের হঠাৎ মনে পড়ে ছাদের কথা। ছাদে একবারও চেক করা হয়নি। আহনাফ দৌঁড়ে ছুটে যায় ছাদের দিকে। সিঁড়ি কোটার সামনে অদিতিকে চুপটি করে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে আহনাফ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এতক্ষন ধরে আহনাফের অশান্ত হয়ে ওঠা মন অদিতির নিষ্পাপ মুখশ্রী দেখে শান্ত হলো। আহনাফ সাথে সাথেই বুঝতে পারলো অদিতি তার ভয়ে রুমে আসেনি। আজ প্রথমবার নিজের কঠোরতার উপর প্রচন্ড রাগ অনুভব করলো আহনাফ।

আহনাফ অদিতিকে ডাক দিতে গিয়েও অদিতির ঘুমন্ত মুখখানা দেখে আর ডাকতে পারলো না। নিঃশব্দে অদিতিকে কোলে করে নিজের রুমে নিয়ে এসে পরম যত্নে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। যেই মেয়েটাকে নিজের রুমের তিরসিমানায় প্রবেশ করতে নিষেধ করেছিল আহনাফ আজ সে নিজেই সেই মেয়েটিকে কোলে তুলে নিজের রুমের ভেতরে নিয়ে এলো। এসব চিন্তা মাথায় আসতেই নিজের অজান্তেই হেসে ফেললো আহনাফ। আহনাফ আজ প্রথমবার গভীর দৃষ্টিতে অদিতির মুখশ্রীর দিকে তাকালো। বুকের ভেতরে কিছু একটা অনুভব হলো আজ। তবে সেই অনুভূতির গভীরতা উপলব্ধি করতে পারলো না আহনাফ।

অদিতি যদি একটু স্মার্ট আর সাহসী হতো তাহলে হয়তো এতদিনে অদিতিকে অহনাফ মেনে নিতো। কিন্তু অদিতির মতো ভীতু আর আনস্মার্ট মেয়ে তার টাইপের না।আহনাফ অদিতির ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ নিষ্পলক ভাবে। অদিতিও তো থাকতে চায় না তার সাথে। ব্যস আর কয়েকটা বছরের অপেক্ষা তার পর তো অদিতি চলেই যাবে। ততদিন পর্যন্ত না হয় আহনাফও মেয়েটার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করার চেষ্টা করুক।
আহনাফও অদিতির পাশে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলো।
____

ঘুম ভাঙ্গতেই আহনাফের রুমে নিজেকে আবিষ্কার করলো অদিতি। পাশ ফিরতেই আহনাফকে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন দেখে চমকে উঠলো হলো সে। সেতো ছাদে ঘুমিয়ে ছিলো তার মানে আহনাফ তাকে নিজে কোলে করে রুমে নিয়ে এসেছে! বিস্ময়াভিভূত হলো অদিতি। ধীরে ধীরে আহনাফের আচরণ একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। কিন্তু কেনো? সে চলে যাবে বলে।

এরই মধ্যে আহনাফেরও ঘুম ভেঙ্গে গেল। নিজের পাশে অদিতিকে চুপটি করে ভাবনায় মগ্ন থাকতে দেখে আহনাফ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অদিতির দিকে। অদিতিও তাকালো আহনাফের দিকে। আহনাফের একটা হাত এখনো অদিতির কোমড়ে। আহনাফ যেনো অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে চলে গেল ক্ষণিকের জন্য। একটু একটু করে এগিয়ে গেলো অদিতির দিকে। অদিতির নরম মসৃণ গালে আলতো করে স্পর্শ করলো আহনাফ। তখনি অ্যালার্মের কর্কশ শব্দে স্ব-জ্ঞান ফিরে এলো আহনাফের। আহনাফ সাথে সাথেই বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। এই মুহূর্তে প্রচন্ড বিব্রতবোধ হচ্ছে আহনাফের। আহনাফকে আরেকটু বিব্রত করে অদিতি প্রশ্ন ছুড়ে দিলো আহনাফের পানে।

_” আমাকে কি আপনি রুমে নিয়ে এসেছিলেন?”

আহনাফ সাবলীল ভঙ্গিতে বলল,” হ্যাঁ।”

_” কিন্তু কেনো?”

_” কেনো মানে কি বুঝো না? বাসায় আলভী আছে ওর সামনে আমাদের সম্পর্কের অবনতি দেখিয়ে বেড়াতে চাও। তুমি চিনো না আলভীকে? সাথে সাথেই বাহিরে রটিয়ে ফেলবে সব।”

আহনাফের কথা শুনে অদিতির মনে আবার আঁধার নেমে আসলো। আহনাফ সেই দিকে পাত্তা না দিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেলো। অদিতি আহনাফের যাওয়ার পানে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
_____

আহনাফ অফিসের ফরমাল গেটআপে রেডি হয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে আসতেই আলভীকে অদিতির সাথে হাসি মুখে কথা বলতে দেখলো। বুকের ভেতরটা হিংসায় জ্বলন্ত লাভায় টগবগ করে উঠলো। মেয়েটা তার সামনে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকে অথচ আলভীর সামনে কতোই না হেঁসে হেঁসে কথা বলছে! আহনাফ অদিতির হাত টেনে অদিতিকে নিজের কাছে নিয়ে এসে বললো,”চলো অদিতি। তোমার ক্লাসে যেতে হবে না।”

_”কিন্তু ভাবী তো নাস্তা করে নি। না খেয়েই চলে যাবে নাকি?”

আহনাফ মনে মনে ভরকায়,” আমার বউ খেলো কি খেলো না তাতে তোর কি?”

আহনাফ গম্ভীর স্বরে বলল,” লেট হয়ে যাচ্ছে অদিতির। আর আমার অদিতি নাস্তা করেছে কি করেনি সেটা নিয়ে তোর না ভাবলেও চলবে।”

আহনাফের মুখে “আমার অদিতি” শব্দটি শুনে অদিতি চমকে তাকায় আহনাফের দিকে। তীব্র অধিকারবোধ যেনো ফুটে উঠেছে আহনাফের কথায়। আহনাফ অদিতির হাত ধরে তাকে নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায়।

আহনাফের কান্ড দেখে আলভী পুরোই হতভম্ভ হয়ে যায়। জ্যামে রুটি চিবোতে চিবোতে বলে,”আশ্চর্য!ব্রো এতো জেলাস হচ্ছে কেনো?”

___

আহনাফ রাগের মাথায় জোরে জোরে ড্রাইভ করতে থাকে। অদিতি ভয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,” আসতে ড্রাইভ করুন প্লিজ। আমার ভয় করছে।”

_” কেনো আমার সামনেই তোমার এতো ভয় করে কেনো? ওই আলভীর সাথে তো ঠিকই হেঁসে হেঁসে কথা বলো। খবরদার! আমি অফিসে যাওয়ার পর তুমি ঐ আলভীর সাথে কোনো কথা বলবে না।”

আহনাফ রাগে কটমট করতে করতে একটি রেস্টুরেন্টের সামনে এসে গাড়ি পার্ক করে।

_” এখানে থামালেন কেনো?”

_” নাস্তা করার জন্য।”

_” তাহলে তো আমরা বাসাই নাস্তা করতে পারতাম।”

_”আহা! অদিতি, ফালতু প্রশ্ন করো নাতো।”

অদিতি অবাক নয়নে চেয়ে আহনাফের কাণ্ড কারখানা দেখছে। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে আহনাফ জেলাসিতে এসব কাজ করছে।

অদিতিকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে সরাসরি অফিসে চলে যায় আহনাফ। আজ নাবিলা খুবই সেজেগুজে অফিসে এসেছে আহনাফকে ইমপ্রেস করার জন্য। নাবিলা আহনাফের ক্যাবিনে এসে মিষ্টি স্বরে বলে,” স্যার, আজকে আপনার মিটিং আছে রাত নয়টার দিকে। আমি সমস্ত ফাইল চেক করে আপনার ডেস্কে রেখে দিয়েছি।”

নাবিলার বলা কথাগুলোর দিকে আহনাফের কোনো ধ্যান নেই। আহনাফ তো অদিতিকে নিয়েই চিন্তিত। অদিতির ক্লাস এতক্ষনে শেষ হয়ে গেছে হয়তো। আবার আলভীর সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলবে অদিতি। আহনাফ তো জানে অদিতির কোনো যত্ন সে করে না। অদিতি যদি মোহে পড়ে যায় তাহলে তো সর্বনাশ! না না এ কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। আহনাফ ল্যাপটপে মুখ গুঁজেই গম্ভীর স্বরে বলে,” আজকের মিটিং ক্যানসেল করে দাও। আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।”

_”ঠিকাছে স্যার। কিন্তু…”

আহনাফ নাবিলাকে কথা সর্ম্পূণ করতে না দিয়ে ইশারায় কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে বলে। আহনাফের আচরণ নাবিলার ইগোতে গিয়ে আঘাত করে। নাবিলা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বেরিয়ে যায় আহনাফের কেবিন থেকে।

_”একটু বেশিই দেমাগ আহনাফ স্যারের! এতো সুন্দর করে সেজেগুঁজে আসলাম ফিরেও তাকালেন না। তবে আমিও দেখি কতদিন আমাকে এভাবে ইগনোর করতে পারেন। ওনাকে যদি নিজের পেছনে না ঘুরাতে পারি তাহলে আমার নামও নাবিলা ইয়াসমিন নয়, হুহ্।

নাবিলা যেতেই আহনাফ ফোন বের করেই অদিতিকে ভিডিও কল করে। অদিতি কলেজ থেকে এসে রেস্ট নিয়ে সবে মাত্র পড়তে বসেছিল। হঠাৎ নিজের ফোনে আহনাফের ভিডিও কল দেখে চমকে উঠে অদিতি। আহনাফ তাকে ভিডিও কল দিচ্ছে! অদিতি কল রিসিভ করতেই আহনাফ অস্থির কন্ঠে শুধায়,” কি করছিলে তুমি? আর কোথায় তুমি?”

_” কেনো? আমি তো বাসায়, আপনার রুমে বসে আছি। মাত্র পড়তে বসেছি আমি।”

অদিতির কথা শুনে আহনাফ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে শুধায়,” ওই আলভী কোথায়?”

_” উনি মনে হয় বের হবেন বিকেলে।”

_” তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে চাইলে যাবে না কিন্তু বলে দিলাম। আর ওর সাথে বেশি কথা বলবে না বুঝেছো।”

কথাগুলো বলে আহনাফ অদিতির মুখের উপর ফোন কেটে দেয়। অদিতির এইবার ভীষণ রাগ উঠে আহনাফের উপর। স্ত্রী হিসেবে সম্মান দিবে না আবার ঠিকই স্বামীর অধিকার দেখাতে আসবে। আবার এরকম করলে অদিতি সরাসরি জিজ্ঞেস করবে,” আপনার এতো জ্বলে কেনো? আপনি না আমাকে স্ত্রী হিসেবে পছন্দ করেননা। তাহলে এখন এত অধিকারবোধ দেখাচ্ছেন কেনো?”
___
আহনাফ নিজের কিছু পেন্ডিং কাজ শেষ করে বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। তখনি নাবিলা এসে বলে,” স্যার আমাকে একটু লিফট দিতে পারবেন?”

_” কাউকে লিফট দেওয়ার কাজ আমি করি না।”

নাবিলা নিজের পায়ের দিকে ইশারা করে বলে,” স্যার হিলটা ভেঙ্গে পায়ে মোচড় লেগে গিয়েছে প্লিজ একটু যদি লিফট দিতেন। এই অবস্থায় আমি কিভাবে গাড়ি ঠিক করবো?”

প্রত্যয় সেই সময়ই বাইক নিয়ে বেরিয়ে যেতে নিয়েছিল। প্রত্যয়কে দেখে আহনাফ তাকে ডাক দিয়ে থামিয়ে বলে,”প্রত্যয়, মিস নাবিলাকে ওনার বাসা পর্যন্ত ড্রপ করে দিও, ওনার পায়ে মোচড় লেগেছে হাঁটতে পারবেন না।”

আহনাফ প্রত্যয়কে অর্ডার দিয়ে সাথে সাথেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় অফিস থেকে। নাবিলা রাগে দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রত্যয় হেসে বলে,” বসুন, নাবিলা। একদম দুশ্চিন্তা করবেন না আমি সেফলি আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিবো।”

নাবিলা সৌজন্যতামূলক মেকি হাসি দিয়ে বাধ্য হয়ে বাইকে উঠে বসে। প্রত্যয় নাবিলাকে ভালোমতো বসতে বলে বাইক স্টার্ট করে।

___
আহনাফ ঝড়ের গতিতে ড্রাইভ করে বাসায় ফিরে আসে। বাসায় ফিরতেই আহনাফের চোঁখ জোড়া অদিতিকে খুঁজতে শুরু করে। অদিতিকে রুমের ভেতরে মনোযোগ দিয়ে পড়তে দেখে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠে আহনাফের। মেয়েটা তাহলে তার কথা রেখেছে। আহনাফকে এতো জলদি অফিস থেকে ফিরে আসতে দেখে অদিতি খানিকটা অবাক হয়।

_” আপনি আজ এতো জলদি চলে এসেছেন?”

আহনাফ হাত ঘড়ি খুলতে খুলতে বলে,” আমার কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গিয়েছিলো তাই।”

অদিতি আর কোনো প্রশ্ন না করে আবার পড়ায় মনোযোগ দেয়। ব্যাপারটা আহনাফের পছন্দ হয়না। ইদানিং তার সামনে আসলেই অদিতি কেমন যেন উদাসীন আচরণ করে। তাকে দেখলেও যথাসম্ভব উপেক্ষা করার চেষ্টা করে অদিতি।

_”আলভী ফিরবে কখন?”

_” আলভী ভাইয়া ওনার বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাবেন বলেছিলেন। আজ বন্ধুর সাথেই আড্ডা দিবেন হয়তো।”

আহনাফ বিড়বিড় করে বলে,” যাক ভালো হয়েছে। না ফিরলেই খুশি হবো।”

_” কিছু বললেন?”

_”না কিছুনা। তুমি পড়ো।”

আহনাফ হাত মুখ ধুয়ে রাতের খাবার খেতে বসে। অদিতি এসে খাবার সার্ভ করে চলে যেতে নিলে আহনাফ অদিতির হাত ধরে আটকিয়ে ফেলে।

_” তুমি খেয়েছো?”

অদিতি চমকায়, আহনাফ আজ প্রথমবার তার খোঁজখবর নিচ্ছে। অদিতি মৃদু স্বরে বলে,” হ্যাঁ, খেয়েছি।”

_” আলভী কি এমন বলে যে তুমি হেঁসে একেবারে কুটি কুটি হয়ে যাও?”

অদিতি ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বলে,” আপনার তাতে কি?”

_” তুমি আমার স্ত্রী।”

_”মানেন আপনি?”

_” না মানার কি আছে? কবুল তো করেছি।”

অদিতি তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,” এইতো আর কয়েকটা বছর সহ্য করুন তারপর আমার বোঝা আপনার ঘাড় থেকে নেমে যাবে।”

অদিতির এই রাশভারী কথাগুলো শুনে আহনাফের বুকের ভেতরটা হাসফাঁস করতে থাকে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে। অদিতির দিকে চেয়ে আহনাফ গম্ভীর স্বরে বলে,”খুব তাড়া তোমার আমার কাছ থেকে আলাদা হওয়ার, তাই না?”

_”হ্যাঁ, খুব তাড়া। আমার কারো বোঝা হয়ে থাকতে ভালো লাগে না।”

অদিতির কথা শুনে আহনাফ থমকে যায়। গলা দিয়ে আর খাবার নামে না। অদিতিকে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারে না আহনাফ। আহনাফ খাবার অর্ধেক খেয়ে উঠে যায়। অদিতিও সাধে না আহনাফকে।

___
প্রায় অনেকক্ষন নিজের রুমে বসে অপেক্ষা করে আহনাফ অদিতির জন্য। কিন্তু অদিতি আসে না। আহনাফ রেগে রুম থেকে বের হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”আজো যদি এই মেয়ে সিঁড়ি কোটায় ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে ওর খবর আছে।”

কিন্তু না অদিতিকে সিঁড়িতে খুঁজে পায় না আহনাফ। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে অদিতিকে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে সোজা গেস্ট রুমের দিকে যেতে দেখে আহনাফ অদিতির পথ আটকিয়ে দাঁড়ায়।

_” গেস্ট রুমে যাচ্ছো কেনো তুমি?”

_”আলভী ভাইয়া তো নেই তাই আমার জন্যে বরাদ্দকৃত রুমে ফিরে যাচ্ছি।”

_” বেশি বুঝো তুমি? বলেছি না পন্ডিতি করবে না আমার সামনে। যাও রুমে যাও।”

_”এখানে পন্ডিতির কি হলো? আলভী ভাইয়া যাতে আমাদের মধ্যকার তিক্ততা বুঝতে না পারেন সেই জন্যেই তো আমি আপনার রুমে ছিলাম। আজ তো আলভী ভাইয়া নেই তাই নাটক করারও কোনো প্রয়োজনও নেই।”

অদিতির যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে জব্দ হলো আহনাফ। আহনাফের নিরবতা দেখে অদিতি এক পলক আহনাফের দিকে চেয়ে ম্লান হেঁসে চলে গেল। আহনাফও মন খারাপ করে নিজের রুমে ফিরে এলো।

বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষন ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো আহনাফ। কিন্তু দুষ্টু ঘুম এসে ধরা দিলো না। আহনাফের মস্তিষ্কে ক্রমাগত অদিতির বলা কথাগুলো বেজে চলেছে। আহনাফের লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে নিজের মাথা চেপে ধরে বললো,” এমন অস্থির লাগছে কেনো এর আগেও তো অদিতি আমার থেকে আলাদাই থেকেছে কই তখন আমার এতো অস্থির লাগেনি!”

আহনাফের ভাবনাগুলো আরেকটু গভীর হওয়ার আগেই ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। আহনাফের সৎবিৎ ফিরে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই সচকিত হয় আহনাফ। অদিতির মা আমিনা বেগম ফোন করেছেন তাও আবার এতো রাতে। ইলিয়াস আঙ্কেলের আবার কিছু হয়ে গেলো নাতো?

আহনাফ সাথে সাথেই কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে আমিনা বেগম মলিন স্বরে বললেন,” কেমন আছো, আহনাফ বাবা?”

_” আমি তো ঠিক আছি কিন্তু ইলিয়াস আঙ্কেল ঠিক আছেন তো?”

_” হ্যাঁ হ্যাঁ উনি আপাতত ঠিক আছেন। আমি দুঃখিত এতো রাতে ফোন দিয়ে তোমাকে ডিস্টার্ব করার জন্য। আসলে কথাটা আমি সকালেই বলতাম কিন্তু সময় পাইনি। অদিতির বাবাকে নিয়ে হসপিটালে ছিলাম তো সেইজন্য।”

_” ইটস ওকে আণ্টি। আপনি কি অদিতির সাথে কথা বলবেন? দাঁড়ান আমি তাকে ডেকে দিচ্ছি।”

_” না না কথাটা তোমার সাথেই ছিলো আহনাফ বাবা। ইয়ে.. মানে অদিতির আজকে জন্মদিন ছিলো। মেয়েটার আঠারো বছর পূর্ণ হলো আজ। তোমাদের তো কেবল ধর্মমতে কবুল পড়ে বিয়েটা হয়েছে কিন্তু কোনো রেজিস্ট্রি তো হয়নি সেইজন্যই আরকি।”

আহনাফ বিস্মিত হয়ে মনে মনে ভাবলো,” অদিতির জন্মদিন ছিলো আজ কই মেয়েটাতো তাকে কিছুই বললো না।”

আহনাফের নিরবতা দেখে ওপাশ থেকে আমিনা বেগম আবার বলে উঠলেন,” বাবা শুনছো।”

আহনাফ ইতস্ততা বোধ করে বললো,” জ্বী শুনছি, দুশ্চিন্তা করবেন না আণ্টি কবুল যেহেতু করেছি অস্বীকার করবো না। আহনাফ ওয়াহিদ সত্যকে অস্বীকার করার মতো মানুষ নয়। আমি অদিতিকে নিয়ে কাল আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি করে আসবো।”

কথাগুলো একদমে বলে ফোন রেখে দিলো আহনাফ। অদিতির উপর ভীষণ রাগ উঠলো তার। মেয়েটা ইচ্ছে করেই তার জন্মদিনের ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে।

_” খুব বেশি বুঝো তুমি অদিতি। আমার কাছ থেকে আলাদা হতে চাও ঠিকাছে কিন্তু এখন এরকম বাচ্চামী করার কি কোনো মানে হয়? গর্দভ মেয়ে!”

চলবে…