আমার অদিতি পর্ব-০৯ এবং শেষ পর্ব

0
3

#আমার_অদিতি
#পর্ব – ৯ ( অন্তিম পর্ব)
#নয়োনিকা_নিহিরা

অদিতি চোঁখ মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে আহনাফের সামনে। আহনাফ নিজের মুখশ্রীতে ইচ্ছে করেই কৃত্রিম রাগ আর গম্ভিরতা বজায় রেখেছে।

ড্রয়ার থেকে একটি চিরকুট বের করে অদিতির হাতে ধরিয়ে দিয়ে আহনাফ রাগান্বিত স্বরে বললো,” আমার সাথে করা এই ছলনার ব্যাখা দাও।”

অদিতি রিনরিনে আওয়াজে বললো,” আমি এই চিরকুট লিখিনি। এসব কিছু আলভী ভাইয়ার কাজ।”

_” ওই রাস্কেলের নামও মুখে আনবে না। কতবড় বড় সাহস ওই আলভীর বাচ্চার! আমার বউকে আমারই কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে এতদিন। আর তুমিও আলভীর এসব ফালতু কাজে সামিল হয়েছো! তুমি কি জানো আমার এই কয়েকদিন কতো যন্ত্রণা হয়েছিলো? আমি মরে গেলেই ভালো হতো তাইনা?”

অদিতি সাথে সাথেই আহনাফের মুখ চেপে ধরলো। অসহায় কন্ঠে বললো,” এসব কথা বলবেন না প্লিজ। আমার ভীষণ কষ্ট হয়।”

_” তাহলে ভাবো আমার কি অবস্থা হয়েছিল এতদিন। পাগলের মতো তোমাকে খুঁজে বেড়িয়েছি আমি। এতো অভিমান ছিলো তোমার আমার উপর? আমি কি এতটাই খারাপ বউপাখি? তুমি কিভাবে আমাকে ছাড়া এতদিন থাকতে পারলে? আমার কথা একবারের জন্যেও কি মনে পড়েনি তোমার?”

অদিতি চোঁখ টলমল করে আহনাফের দিকে চেয়ে অভিমানী কন্ঠে বললো,” সব দোষ কি শুধু আমার? আপনার কোনো দোষ নেই? আমি চলে না গেলে আপনি কোনোদিন নিজের জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারতেন? আমাকে স্ত্রী হিসেবে স্বীকার করতে পারতেন সবার সামনে?”

_”তোমাকে বললেও তো তুমি বিশ্বাস করবে না, অদিতি।”

আহনাফ বিছানা থেকে নেমে আলমারিতে রাখা অদিতির জন্যে কিনে আনা উপহারগুলো দেখিয়ে বললো,” এইযে দেখো তোমার অভিমান ভাঙ্গানোর জন্য আমি সেইদিন তোমার পছন্দের শাড়ি, লাল রঙের কাচের চুড়ি আর লাল গোলাপ নিয়ে এসেছিলাম। আমি তোমাকে আমার স্ত্রী হিসেবে স্বীকার করে নিতাম অদিতি অনেক আগেই। কিন্তু তুমি কি করলে? আমাকে রেখে চলে গেলে। হৃদয়হীন মানবী কোথাকার!”

_” আমি হৃদয়হীন হলে আপনি কি?”

_” আমি তোমার প্রেমিক পুরুষ।”

আহনাফের কথা শুনে লজ্জায় রক্তিম আভা ফুটে উঠলো অদিতির মুখশ্রীতে। অদিতি আহনাফের সামনে থেকে সরে যেতে নিলে আহনাফ অদিতির হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে।

মোহযুক্ত কন্ঠে অদিতির কানে ফিসফিস করে শুধায়,”কোথায় যাচ্ছো বউপাখি?”

অদিতি কেঁপে উঠে আমতা আমতা করে বলে,” গেস্ট.. গেস্টরুমে চলে যাচ্ছি।”

আহনাফ অদিতিকে টেনে নিজের বুকের মধ্যে আগলে নেয়। আদুরে গলায় বলে,” কোথাও যেতে দিবোনা আমি আমার অদিতিকে। তুমি আমার রুমে,আমার বিছানায়,আমার বুকে থাকবে বুঝলে।”

অদিতি মুখ ফুলিয়ে বলে,” না থাকবো না। আপনি বকা দেন আমাকে। আপনার কোনো জিনিসপত্রে হাত দিতে নিষেধ করেন। আলমারিতে আমাকে কাপড় রাখতে নিষেধ করেন।”

_” আর কখনো বকা দিবো না আমার বউপাখিকে। আমার সবকিছু তো তোমারই জান। তুমি আমার পুরো আলমারি নিয়ে নাও। এই রুমের প্রতিটি জিনিসপত্রে শুধু তোমার অধিকার। আমার স্ত্রী অদিতির অধিকার।

_” অধিকার দিলেন তাহলে?”

_” অনেক আগেই দিয়েছি। তুমি আসোনি আমার কাছে। রাগ করে দূরে দূরে থেকেছো।”

_” আর আপনার হৃদয়ে? আপনার হৃদয়ে জায়গায় দিতে পেরেছেন আমায়?”

অদিতিকে আরো কাছে টেনে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে আহনাফ আদুরে কন্ঠে বললো,” হৃদয়ে জায়গা না দিতে পারলে তোমার জন্য আমার এই বেহাল দশা হতো না। পাগলের মতো তোমাকে খুঁজে বেড়াতাম না। তুমি কি এখনো বুঝো না অদিতি? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকো।”

অদিতি আহনাফের গালের সাথে গাল মিশিয়ে আহনাফের বুকের সাথে লেপ্টে থাকে। আহনাফ পরম আবেশে চোখ বুজে ফেলে।

_” আমি তোমাকে ভালোবাসি অদিতি, ভীষণ ভালোবাসি বউপাখি আমার।”

অদিতি আহনাফের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ম্লান কন্ঠে বললো,” আমি কিন্তু এখনো আগের মতোই আছি আহনাফ সাহেব। এখনো আমার কমিউনিকেশন স্কিল ভালো হয়নি। কেউ কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে এখনো আমি নার্ভাস হয়ে যাই। সঠিক ভাবে উত্তর দিতে পারিনা। আমার এই আচরণে আপনি কাল আবার বিব্রতবোধ করবেন সবার সামনে। তখন আপনার এই ভালোবাসায় আবার ভাটা পড়ে যাবে।”

আহনাফ অস্থির হয়ে আবার অদিতিকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নেয়। অদিতির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,” না অদিতি! এমনটা আর কোনোদিন আমার মনে হবে না বউপাখি। আমি আছি না আমি সব সামলে নিবো। এখন কারো কথায় আমার কিচ্ছু যায় আসে না অদিতি। আমি তোমাকে গ্রহন করেছি, ভালোবেসেছি এটাই সত্যি। আর কখনো আমি আমার ভালোবাসাকে অবহেলা করবো না।”

অদিতি আগের ঘটনাগুলো মনে করে আহনাফের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কান্নাজড়িত গলায় বলে,” কেউ যদি জানতে চায় আমি আপনার কি হই? তখন কি আবার আমাকে পেয়িংগেস্ট হিসেবে পরিচয় করাবেন?”

আহনাফ অদিতির মুখ তুলে অদিতির দুগালে আলতো করে ছোট ছোট চুমু এঁকে দিয়ে বলে,” বলবো তুমি আমার অদিতি। আমার স্ত্রী। আমার জীবন,আমার ভালোবাসা, আমার সবকিছু। তোমার প্রায়োরিটি সবচেয়ে আগে থাকবে আহনাফ ওয়াহিদের জীবনে। তোমাকে আর কখনো অসম্মানিত হতে দিবো না আমি, কথা দিলাম। এতদিন দায়িত্ববোধের কারণে আমি এই সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলাম। তবে এখন আমি ভালোবেসে তোমার সকল দায়িত্ব নিলাম অদিতি। এই দায়িত্ববোধ এখন আমার বোঝা না আমার শান্তি,আমার স্বস্তি। আমি তোমাকে পড়ালেখা করাবো, প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করবো কিন্তু আমি তোমার হাত ছাড়তে পারবো না অদিতি। আমি আর কখনো তোমার থেকে আলাদা হতে চাইনা। আমি আমার অদিতির সাথে সারাজীবন কাটাতে চাই। আমাকে ক্ষমা করে দাও বউপাখি। আমার সাথে থেকে যাও সারাজীবনের জন্যে প্লিজ।”

অদিতির চোঁখের কার্নিশ বেয়ে তপ্ত নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। সেই গম্ভীর, রগচটা আহনাফ ওয়াহিদ যে বিয়ের পর থেকে তাকে সহ্যই করতে পারতো না আজ সেই স্বামী নামক রগচটা পুরুষটি তার জন্যে উতলা হয়ে আছে! তাকে হারানোর ভয় করছে! অদিতি তো এতটা ভালোবাসা পাওয়ার আশা করতে পারেনি কখনো।

অদিতি অশ্রুসিক্ত নয়নে আহনাফের বুকে ঝাপটে পড়ে। আহনাফও আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরে তার বউপাখিকে।

_” অনেক হয়েছে আর কান্নাকাটি করতে দেবো না তোমায়? দেখি কান্না বন্ধ করো।”

অদিতির চোঁখের জল মুছে দিয়ে আহনাফ অদিতিকে কোলে নিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তার অদিতির দিকে। আহনাফ আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না নিজেকে, আঁকড়ে ধরলো অদিতির অধরজোঁড়া। তার কোমল স্পর্শে যেন সময় থেমে গেলো, পৃথিবী এক নিমিষে নিঃশব্দ হয়ে গেলো। অদিতির বুকের ভেতর তীব্র এক শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল, যেন হারিয়ে যাওয়া কোনো অনুভূতি চিরকাল পরে ফিরে এসেছে। এক মিষ্টি অস্থিরতা এসে ভর করলো অদিতির হৃদয়জুড়ে।

এতদিন পর মনের মানুষের নৈকট্য পেয়ে দুজনার মাঝেই ঢেউ খেলে যাচ্ছে। এক সুপ্ত অনুভূতির জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে দুজন। এই একান্তে তারা যেনো পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হারিয়ে যাচ্ছিলো একে অপরের মাঝে। কিন্তু তাদের এই সুন্দর মুহূর্ত বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। বাহির থেকে দরজার কড়া নেড়ে ডেকে উঠলেন আজমেরী ওয়াহিদ।

_” অদিতি, তাড়াতাড়ি নিচে এসো। তোমার ভাই এসেছে দেখা করতে।”

আহনাফের তীব্র অনুভূতিতে ভাটা পড়লো। চোঁখ মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো।

_” দিলো আমাদের সুন্দর মুহূর্ত নষ্ট করে! আর আসার সময় পেলো না তোমার ভাই।”

অদিতি তাড়াহুড়া করে আহনাফের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। লজ্জায় গাল দুটো রক্তিম আভা ধারণ করলো। এক প্রকার দৌঁড় দিয়েই অদিতি পালিয়ে গেলো আহনাফের কাছ থেকে।

____

লিভিংরুমে বসে আছে অদিতির বড় ভাই ইমতিয়াজ। অদিতিকে নিয়ে যদিও তার বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা নেই তবুও মায়ের অসুস্থতার কারণে অদিতিকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আসতে হয়েছে তাকে।

অদিতি তার ভাইয়ের সামনে আসতেই ইমতিয়াজ গম্ভীর গলায় বললো,” কোথায় ছিলি এতদিন তুই? তোর জন্যে দুশ্চিন্তায় মা কতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে জানিস?”

অদিতি অবাক নয়নে চেয়ে থাকে তার বড় ভাইয়ের দিকে। একটাবারও তার ভাই জিজ্ঞেস করলো সে কেমন আছে? কেনো চলে গিয়েছে?

ইমতিয়াজ আরো ধমক দিতো অদিতিকে কিন্তু আহনাফ সামনে এসে পড়ায় আর কিছু বলতে পারলো না। আহনাফের দিকে চেয়ে ইমতিয়াজ গম্ভীর গলায় বললো,”অদিতিকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছি আমি কিছুদিনের জন্য। মায়ের শরীর বেশি ভালো না। অদিতিকে দেখতে চাচ্ছেন বারবার।”

এই কথা শুনার সাথে সাথেই মন খারাপ হয়ে গেলো আহনাফের। মাত্রই তো ফিরে পেলো সে তার বউপাখিকে এখন নাকি তার বউপাখি চলে যাবে তার বাবার বাড়িতে। আবার বিরহের অনলে পুড়তে হবে তাকে।

অদিতি আহনাফের দিকে এক পলক চেয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেলো ব্যাগপত্র গুছানোর জন্য। আহনাফও অদিতির পিছে পিছে রুমে এসে জড়িয়ে ধরলো অদিতিকে।

_” তুমি কোথাও যাবে না জানপাখি। অনেক অপেক্ষা করার পর তোমাকে কাছে পেয়েছি আমি। তোমাকে ছাড়া এখন আর থাকতে পারবো না আমি।”

অদিতি শান্ত কন্ঠে বললো,” মা তো আমারই দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কয়েকদিনেরই তো ব্যাপার মা সুস্থ হলে আমি আবার আপনার কাছে চলে আসবো।”

_”তাহলে আমিও যাবো তোমার সাথে।”

___

অদিতিকে স্বচক্ষে দেখার সাথে সাথেই কান্না জুড়ে দিলেন অদিতির মা আমিনা বেগম।

_” কোথায় চলে গিয়েছিলি তুই মা। এভাবে কেউ পাগলামি করে? আমরা সবাই তোকে নিয়ে কতটা দুশ্চিন্তায় ছিলাম সেই খেয়াল আছে তোর? তুই যদি আহনাফের সাথে আর থাকতে না চাস থাকতে হবে না তোকে মা। তবুও নিজের কোনো ক্ষতি করিস না।”

আমিনা বেগমের কথা শুনে মাথায় বাজ পড়লো আহনাফের। আহনাফ অস্থির কন্ঠে বললো,” আণ্টি আপনি এসব কি বলছেন? অদিতি আমার সাথেই থাকবে।”

অদিতি মিটিমিটি হাসি দিয়ে আহনাফের দিকে চেয়ে আছে। আহনাফের এরকম অবস্থা দেখে বেশ ভালোই লাগছে তার। এখন বুঝুক কেমন লাগে?

আমিনা বেগম মলিন স্বরে বললেন,” অদিতি মা তুই যেটা চাস সেটাই হবে। আর মনের বিরুদ্ধে তোকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে না।”

আহনাফ হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে আমিনা বেগমের দিকে। মনে মনে বলে,” অদিতির মা দেখছি উঠে পড়ে লেগেছেন আমার অদিতিকে আমার থেকে আলাদা করার জন্য।”

অদিতি দুষ্টু হাসি দিয়ে আহনাফের দিকে চেয়ে থাকে। অদিতির এই হাসি দেখে রাগে গা জ্বলে উঠে আহনাফের। চুপচাপ এক কোণায় দাঁড়িয়ে রাগে কটমট করতে থাকে আহনাফ।

অদিতি শান্ত কন্ঠে বলে,” না মা,আমি ওনার সাথেই থাকতে চাই। আমাদের মধ্যে বিদ্যমান মনোমালিন্য দূর হয়ে গিয়েছে।”

অদিতির কথা শুনার সাথে সাথেই আহনাফের সমস্ত রাগ উধাও হয়ে যায়। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে ওঠে। বিভোর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আহনাফ অদিতির দিকে।

অদিতি তার মায়ের দেখাশুনার জন্য তার কাছেই থেকে যায় কিছুদিনের জন্য। অদিতিদের বাসায় রুমের স্বল্পতার কারণে আহনাফকে বাধ্য হয়ে অদিতিকে একা রেখেই চলে যেতে হয়। মন খারাপ করে বাসায় ফিরে আসে আহনাফ। শূন্যতায় হায়হুতাশ করতে থাকে সে। এরই মধ্যে প্রায় তিন চার বার কল করেছে আহনাফ অদিতিকে।

আহনাফ আনমনেই ভাবতে থাকে,” কিভাবে একটা বছরের বেশি সময় আমি তোমাকে নিজের থেকে আলাদা করে রাখতে পারলাম অদিতি? তুমি আমার বাসায় ছিলে আমার কাছে ছিলে অথচ তোমাকে আপন না করে কিভাবে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলাম? অথচ দেখো এখন আমি নিজেই বিরহের অনলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছি। তোমাকে আপন করে পাবার নেশা শরীরের নিউরনে নিউরনে ছড়িয়ে পড়ছে বউপাখি। তাড়াতাড়ি ফিরে আসো প্লিজ।”
___

আমিনা বেগমের শিয়রের পাশে বসে আছে অদিতি। বারবার আহনাফের চিন্তা মস্তিষ্কে উঁকি দিচ্ছে অদিতির। নিজের গলায় পড়া লকেটটা হাতে নিয়ে দেখতে থাকে অদিতি। বিয়ের পর আহনাফের কাছ থেকে পাওয়া প্রথম উপহার হচ্ছে এই লকেটটি।

অদিতি মিষ্টি হাসি দিয়ে লকেটটির দিকে চেয়ে থাকে। তখন জিদ করে লকেটটি আহনাফের সামনে ধরে না দেখলেও আহনাফ দৃষ্টির আড়াল হলে সারাদিন আহনাফের এনে দেওয়া এই লকেটটি পড়ে ঘুরে বেরিয়েছে অদিতি। আহনাফ অফিস থেকে বাসায় ফিরলে আবার লকেটটি খুলে ড্রয়ারে রেখে দিয়েছে। এভাবে মান অভিমান করতে করতে কত দিন পার হয়ে গেছে দেখতে দেখতে। ভাবতেই কেমন অদ্ভুত লাগে অদিতির।

_____

আহনাফ মন খারাপ করে প্রতিদিন অফিসে যায়। আবার মন খারাপ করে বাসায় ফিরে আসে। অদিতিকে ছাড়া শূন্যতায় খাঁ খাঁ করে হৃদয়। আহনাফ অবাক হয়ে ভাবে যেই অদিতিকে নিয়ে একসময় তার কোনো মাথাব্যথাই ছিলো না আজ সেই অদিতির জন্য অস্থিরতায় তার পুরো দুনিয়া ওলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে!

অদিতির সাথে প্রায় প্রতিদিনই কথা হয় আহনাফের। মাঝে মাঝে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে আহনাফ অদিতির সাথে দেখা করার জন্য। আজ প্রায় এক মাস ধরে অদিতি তার বাবার বাড়িতেই আছে। অদিতির ভাবী জুঁই অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কারণে বাসার প্রায় সব কাজ অদিতিকেই করতে হচ্ছে। আহনাফ অবশ্য অদিতির মায়ের দেখাশুনার জন্য নার্স রাখতে চেয়েছিলো। কিন্তু অদিতি রাজি হয়নি। সে নিজেই তার মায়ের যত্ন করতে পারবে।

অদিতির সেবাযত্নে আমিনা বেগম এখন প্রায় অনেকটাই সুস্থ। আমিনা বেগমের জোরাজুড়িতে অদিতি আজ শশুরবাড়িতে ফিরে যাচ্ছে। অদিতির সাথে আহনাফের আজও ফোনে কথা হয়েছে কিন্তু অদিতি ইচ্ছে করেই তার বাসায় ফিরে আসার কথা বলেনি। আহনাফকে অদিতি আজ সারপ্রাইজ দিবে।
___
আজ প্রায় অনেক রাত করেই বাড়ি ফিরেছে আহনাফ। বাসায় ফিরলেই মনটা অদিতি অদিতি করে। অদিতিকে ছাড়া থাকতে দমবন্ধ হয়ে আসে। তাই মনকে অন্যদিকে বিমুখ করার জন্য অফিসের কাজে যথাসম্ভব নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে আহনাফ। তবুও একটা সুপ্ত অনুভূতির কারণে বুকে চিনচিন করে ব্যথা অনুভূত হয়। বাসায় ফিরলেই অদিতিকে কল করবে সে। সারারাত কথা বলে কাটিয়ে দিবে। এটাই এখন রুটিন হয়েছে আহনাফ আর অদিতির।

আহনাফ বাসায় এসে সরাসরি রুমে চলে যায়।অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে লাইট অন করারও প্রয়োজন বোধ করে না সে। ডিভানে গা এলিয়ে দিয়ে চোঁখ বন্ধ করে বসে পড়ে আহনাফ। তখনি অদিতি এসে লাইট অন করে দেয়। সাথে সাথেই আলোকিত হয়ে ওঠে চারপাশ। আহনাফ সচকিত হয়ে চোঁখ খুলে সামনে তাকায়।

অদিতি আহনাফের দিকে মিষ্টি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে। অদিতিকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় আহনাফ। বিভোর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে অদিতির দিকে।

অদিতি আজ খুব সুন্দর করে সেজেছে। আহনাফের এনে দেওয়া লাল রঙের শাড়ি পড়েছে। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে দুহাত ভর্তি কাঁচের লাল চুড়ি পড়েছে। লম্বা রেশমি চুলগুলো খুলে রেখেছে, যা তার কোমল কাঁধে নেমে এসে বাতাসে ভেসে ভেসে অনন্য এক আভা সৃষ্টি করছে। হালকা মেকআপেও অপরুপ সুন্দর লাগছে আজ অদিতিকে।

আহনাফ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অদিতির দিকে। এক ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছে আহনাফ।

_” কি দেখছেন এভাবে?

_” আমার অদিতিকে।”

অদিতি দুষ্টু হাসি দিয়ে এগিয়ে এসে আহনাফের চোঁখের সামনে তুরি বাজাতেই সৎবিৎ ফিরে আহনাফের। আহনাফ অবাক কন্ঠে শুধায়,” এক মিনিট কখন এলে তুমি?”

_” আজই সকালেই এসেছি।”

আহনাফ ডিভান ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে জড়িয়ে ধরে অদিতিকে। কপালে গাঢ় চুমু এঁকে দিয়ে বলে,”আমাকে বলোনি কেনো?”

_” আপনাকে সারপ্রাইজ দিলাম।”

আহনাফ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অদিতিকে।

_” আই মিসড ইউ বউপাখি। তুমি বললে আমি সকালে গিয়েই তোমাকে নিজের সাথে নিয়ে আসতাম। আর তাড়াতাড়ি বাসায়ও ফিরে আসতাম। কেনো করো এরকম আমার সাথে ? আমাকে জ্বালাতে খুব ভালো লাগে তোমার তাইনা?”

অদিতি দুষ্টু হাসি দিয়ে আহনাফের গলা জড়িয়ে ধরে। আহনাফ মিষ্টি হাসি দিয়ে অদিতিকে নিজের কোলে তুলে নেয়। রুমের দিকে তাকাতেই আরেক দফা বিস্মিত হয় আহনাফ। আহনাফের রুমটা আজ খুব সুন্দর করে ফুল আর লাইট দিয়ে ডেকোরেশন করেছে অদিতি।

আহনাফ মৃদু হেসে অদিতির দিকে চেয়ে বলে,” তো সারাদিন এগুলো করেছো তাইনা?”

অদিতি উচ্ছাসিত গলায় বলে,” হ্যাঁ! কেমন লেগেছে আপনার?”

_” খুব খুব খুউউব ভালো! আজ মনে হচ্ছে আমার জীবনে আবার শান্তি ফিরে এসেছে।”

আহনাফ খুশিতে আত্মহারা হয়ে অদিতিকে কোলে নিয়ে ঘুরতে থাকে। অদিতি খিলখিল করে হেসে ওঠে। আহনাফ গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে অদিতির দিকে।

_” আর কখনো হারিয়ে যেও না অদিতি। তোমাকে ছাড়া দমবন্ধ হয়ে আসে। হৃদস্পন্দন থমকে দাঁড়ায়। আমি তোমাকে আর কোনদিন অবহেলা করবো না বউপাখি। ভালোবাসি অদিতি, ভীষণ ভালোবাসি।”

অদিতিও মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,” আমিও ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি আপনাকে।”

আহনাফ গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে অদিতিকে নিজের প্রশস্ত বাহুডোরে আগলে নিলো। আজ আহনাফ আর অদিতি সর্ম্পূণরূপে খুঁজে পেয়েছে একে অপরকে। সকল জড়তা,অস্বস্তি, মান- অভিমান ভুলে গুরুত্ব দিয়েছে নিজেদের হৃদয়ের অনুভূতিকে। সকল মান অভিমান ভুলে আজ এক হয়ে যাবে আহনাফ আর অদিতি। ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে তুলবে এক অপরকে। যেখানে থাকবে না কোনো অপমান বা অবহেলা। এক নতুন জীবনের পথচলা শুরু করবে তারা।

সমাপ্ত।