#আমার_একলা_আকাশ_তোমায়_জুড়ে
#১৩তম_পর্ব
ধীর স্বরে বললো,
“ভালো হয়ে যাও অর্জুনদা”
মুখখানা তুলতেই দেখলো অর্জুন চোখ মেলে তাকিয়েছে। ক্লান্ত চোখে তার প্রতিবিম্ব। অন্না সরতে যেয়েও পারলো না। অর্জুনের উষ্ণ, রুক্ষ হাতটা চলে গেলো অন্নার কোমল গালে। বাহিরে তখন ঝড়ো বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দ কর্ণকুহরে আসছে। অর্জুনের ক্লান্ত ঘোরলাগা চোখ দেখছে অন্নাকে। অন্নার চোখজোড়া অর্জুনে আবদ্ধ। এরপর কি যেনো হলো! অর্জুনদা মাথা খানা সামান্য তুললো। অন্নার বোঝার পূর্বেই তার শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ছুয়ে দিলো অন্নার কোমল ওষ্ঠ। আকস্মিক ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে গেলো অন্না। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো উষ্ণ রক্তের ধারা। রক্তিম হয়ে উঠলো কোমল গালজোড়া। আগুনের তাপে বিগলিত মোমের ন্যায় গলতে লাগলো সে অর্জুনের তপ্ত স্পর্শে। উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের শব্দ চাপা পড়ে যাচ্ছে বাহিরের মেঘগর্জনে। আবেশে চোখ বুজে এসেছে অন্নার। হৃদস্পন্দন বেসামাল হয়ে গিয়েছে। সবকিছু যেনো তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। বিস্ময়, আনন্দ, লজ্জা, বিষাদ সব অনুভূতি গুলো যেনো মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। অন্নার মনে হলো সময়টা যেনো থেমে গেছে। ক্ষণিকের জন্য কিশোরীর হৃদয়ে উথাল-পাতাল ঢেউ উঠেছে। অর্জুন আবার মাথা এলিয়ে দিলো বালিশে। তার দৃষ্টিতে মাদকতা। অন্না চোখ তুলছে না, কিশোরীর সারা শরীরে লজ্জা দেবী ভর করেছে। তখনই ঘোরলাগা কন্ঠ কানে এলো,
“ভালোবাসি”
অন্না চমকে উঠলো, শব্দটি তার কর্ণকুহরে ঝংকার তুলেছে। অর্জুন হাসছে, স্নিগ্ধ, স্বচ্ছ হাসি। অন্নার মনে হলো তার পৃথিবীটা থমকে গিয়েছে। মস্তিষ্কের নিউরণের রেষারেষি বাড়লো। কিংকর্তব্যবিমুঢ় অন্নার অনুভূতির ঢেউ প্রবল হলো। বসে থাকতে পারলো না। তড়িৎ গতিতে অর্জুনের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে। একটি বারও পিছনে ফিরার ইচ্ছে পোষণ করলো না। করলে হয়তো অর্জুনের প্রগাঢ় নয়নের সাক্ষী হতো, যে নয়নে শুধু প্রণয়ের বর্ষণ হচ্ছে।
রুম থেকে বের হতেই কাকলী দেবীর মুখোমুখি হলো অন্না। হঠাৎ তার মুখোমুখি হতেই চমকে উঠলো অন্না। তার বিভ্রান্ত দৃষ্টি এবং রক্তিম মুখখানা দেখে কাকলী দেবী অবাক কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লেন,
“ভয় পেলি নাকি? চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন?”
“ক….কই নাতো! আসলে ক্লান্ত লাগছে”
কোনোমতে উত্তর দিলো অন্না। কাকলী দেবী আবার প্রশ্ন করলেন,
“অর্জুনকে দেখেছিস? কি করছে?”
“অর্জুনদা ঘুমাচ্ছে, আমি আসছি আজ কাকীমা”
বলেই সদরের দিকে ছুট দিলো অন্না। তার হৃদয় কাঁপছে, হাতপা ঠান্ডা হয়ে আসছে। এদিকে পিছু ডাকলেন কাকলী দেবী, বিস্মিত কন্ঠে বললেন,
“আরে নাড়ু খেয়ে যা, ছুটছিস কেনো?”
অন্না দাঁড়ালো না। এক দৌড়ে নিচে চলে গেলো। অন্নার এমন কার্যে বেশ হতবাক হলেন কাকলী দেবী। আনমনে বিড়বিড় করে বললেন,
“অন্নার কি হলো? অর্জুন কি আবার ওকে বকাঝকা করলো?”
তারপর ছেলের ঘরে উঁকি দিলেন। ক্লান্ত অর্জুন তখন বেঘোরে ঘুম। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কাকলী দেবী।
*****
অন্নার মাথায় চিনচিনে ব্যাথা, সকাল থেকেই শরীরটা ভালো লাগছে না। ম্যাজম্যাজ করে শুধু, সাথে মাথা ব্যাথা তো রয়েছেই। গা টা হালকা গরমও। এর কারণ ও রয়েছে। গত দুরাত ঘুম নামক পদার্থটি তার চোখের ধারে কাছেও আসে নি। চোখের পাতা এক করে মিনিট দুয়েক বাদেই খুলে ফেলতো সে। চেয়ে রইতো সিলিং এর দিকে। আবার মাঝে মাঝে বড় জানালা থেকে গলা গলিয়ে তাকিয়ে রইলো নিগূঢ় রাতের কৃষ্ণ আকাশটির দিকে। সময়টা অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি, শীত আসবে আসবে ভাব। আবহাওয়া শীতল। গত পরশুর বর্ষার পর থেকেই প্রকৃতির ভ্যাপসা গরমটা আর অনুভব হচ্ছে। ফলে অন্নার ঘরের ফ্যান বন্ধ। ফ্যান ছাড়লেই শীত লাগে। ঠান্ডায় কুকড়ে উঠে সে। রুমের দক্ষিণ ওয়ালের চলতে খসে পড়ছে। কাকীমাকে জানানো উচিত। কিন্তু ওমুখো আর হচ্ছে না অন্না। সেদিনের রাতের পর থেকে অর্জুনদার মুখ দেখে না সে। এখনো স্মৃতিগুলো জীবন্ত। দৃশ্যটি চোখে ভাসতেই আপনাআপনি হাত চলে গেলো অধরজোড়ায়। গাল হয়ে উঠলো রক্তিম। অনুভূতিগুলোর টানাপোড়েনে ঝলসে যাচ্ছে কিশোরীর হৃদয়৷ অর্জুনদার সেই কথাগুলো কি কেবল ই ঘোরের উৎপাদন ছিলো নাকি ছিলো তার কঠিন আবরণের ভেতরে লুকায়িত কোমল হৃদয়ের আহ্বান। চিন্তার ঘোরে মাথা ব্যাথা করছে অন্নার। বিরক্তিও লাগছে বটে। এতোকাল শুধু একপাক্ষীক হৃদয়ের সুপ্ত আকাঙ্খাগুলো এখন ডানা ঝাপটাচ্ছে। চাইছে নীলাম্বরে উড়তে মুক্ত বিহঙ্গীর মতো। কিন্তু সেই সাথে সুক্ষ্ণ ভয় কাজ করছে। যদি সবকিছু মিথ্যে হয়। সব ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়! তখন কি করে সামলানে এই হৃদয়কে! অন্না দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের চাপ আর নিতে পারছে না অন্না। ঠিক এমন সময় দরজায় কড়া পড়লো। ভাঙ্গা কন্ঠে অন্না বললো,
“কে?”
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন রীতাদেবী। হিনহিনে স্বরে বললেন,
“কি রে নবাবনন্দিনী! দাদার বউভাত আর বোন লাট হয়ে শুয়ে আছে। দেখায় কেমন? উঠ, পিসিরা, মাসিরা আসছে। একটু যেয়ে দেখ কার কি লাগে। কৃষ্ণাকে একটু সাজিয়েও তো দিতে হবে”
“মা, শরীরটা ভালো নেই”
“কেনো কি হয়েছে?”
অন্না উত্তর দিলো না। রীতাদেবী তার কপালে হাত ঠেকালেন। তারপর বললেন,
“কামচো’র, উঠ। সব ঠিক আছে”
অন্না বলতে পারলো না সমস্যাটি কোথায়। সে অনিচ্ছা স্বত্তেও উঠে বসলো। ওড়নাটা জড়িয়ে ঘর থেকে বের হলো। বসার ঘরের দিকে যেতেই হাত পা জমে গেলো। জং ধরা হৃদয়টা কাঁপছে, কারণ অর্জুন দেবব্রতের সাথে দাঁড়িয়েছে। দেবব্রত চটে আছে খুব। প্রিয় বন্ধু বিয়েতে অনুপস্থিত ছিলো মানা যায়। অভিমানী স্বরে বললো,
“তুই এসেছিস কেন? আমি কে হই! বিয়েতে আমার বন্ধুই আসে না। এই বন্ধু থেকে কি করবো আমি?”
“ক্ষমা করে দে, জ্বর কাবু করে দিলো রে”
দেবব্রত তার রাগ বজায় রেখেই বললো,
“জ্বর আমার বিয়েতেই বাধলো?”
“বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম যে”
“তা এখন কি হাল?”
“কাশিটা যায় নি, হালকা শ্বাসকষ্ট আছে। তবে এখন জ্বরটা নেই। তাই তো ছুটে এলাম”
“আমার ধন্য করেছো”
“মেয়ে মানুষের মতো রাগ করিস না তো! ভুলে যাস না, বিয়েটার হর্তাকর্তা কিন্তু আমি। তোর বোকা বোনের কৃতিত্ব অনেক বটে কিন্তু আমারও কিছু অবদান আছে”
বলতেই হেসে উঠলো দেবব্রত। অন্না বোকা চাহনীতে দেখছে অর্জুনকে। লোকটা কাবু হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে, বেশ রোগাও লাগছে। এবারের জ্বরে ধকল যে গেছে তা বোঝা যাচ্ছে। এর মাঝে দেব বললো,
“কি রে বুড়ি ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
দেবের কন্ঠে স্বম্বিত ফিরলো অন্নার। অর্জুন ও তাকালো তার দিকে। দুজনের চোখাচোখি হলো। অন্নার বুকের ধুকপুকানি বাড়লো। কেনো যেনো প্রচন্ড অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরলো। দাঁড়াতে পারলো না সে। ছুটে চলে গেলো ভেতরে। তার এমন ছুট দেওয়া অবাক করলো দেবকে। অবাক স্বরে বললো,
“ওর কি হয়েছে?”
অর্জুন তখন তাকিয়ে আছে অন্নার যাবার পানে। বিড়বিড়িয়ে বললো,
“হয়তো কিছু মনে পড়েছে”
কথাটা শুনতে পেলো না দেবব্রত। অর্জুনের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। দুর্বোধ্য সেই হাসি, যার রহস্যভেদ শুধু সেই করতে পারে।
*******
দেবব্রতের বৌভাতের অনুষ্ঠান শুরু হলো সন্ধ্যে বাদে। অর্জুনদের বাগানেই স্টেজ করা হয়েছে। স্টেজের উপর বসে রয়েছে কৃষ্ণা। পরণে হালকা গোলাপী রঙ্গের কাতান শাড়ি। শ্বাশুড়ি মায়ের বিবাহের গহনা তার গায়ে। হাতে শাখা পলা, সিঁথি ভর্তি সিঁদুর। যে দেখছে সেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অবন্তীকা দেবী খুবই আনন্দিত। তার কারণ দুটো, এক ছেলের ঘাড়ের প্রেমের ভু’ত নেমেছে আর দুই মনেএ মতো বউ পেয়েছেন। মেয়েটি এতোটা মিষ্টি যে দেড় দিনেই শ্বাশুড়ি মায়ের মনে জায়গা করে নিয়েছে। এর কৃতিত্ব তিনি অন্নাকেই দেন। ও না বললে সত্যি লটারি মিস হয়ে যেতো।
অন্না বউভাতে লুকিয়ে লুকিয়ে আছে। সে ভুলক্রমেও অর্জুনদার মুখোমুখি হচ্ছে না। ওর সামনে গেলেই তার বুক কাঁপতে থাকে। সে বুঝে গেছে বিশ্রী এক রোগে সে আক্রান্ত। এই রোগের নাম কি দেওয়া যায় সে জানে না। তবে এটুকু জানে এই রোগের কোনো নিরাময় নেই। একটাই প্রতিষেধক রয়েছে সেটা কেবল ই অর্জুনদা। অর্জুনদার শিউলি গাছের পাতাটা টানতে টানতে যখন সে চিন্তায় বিভোর ছিলো তখন ই কারোর কন্ঠ কানে এলো। উঁকি দিয়ে দেখলো, ঝোঁপের পাশে রবিন ভাই এবং তানি আপু দাঁড়িয়ে আছে। তানি আপুর মুখ শক্ত৷ সে তাকিয়ে আছে রবিন ভাই এর দিকে। আর রবিন ভাই ঘাসে পা ঘষছেন। গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো তানি আপু, তারপর বললো,
“কি সিদ্ধান্ত নিলে?”
“আমার সিদ্ধান্তে কি কিছু যায় আসবে?”
“মানে?”
“মানে তুমি চাইলেও কি তাদের ফেরাতে পারবে? এতো বড় পরিবার, বিশাল তাদের রঙ ঢং”
“ফ্যাক্টর তো তারা নয়। কথা হচ্ছে তুমি কি চাও?”
“আমার চাওয়ায় কি হবে? কথা হচ্ছে তাদের তুমি মানা করতে পারবে না। এখানে আংকেলের ব্যাবসা জড়িত”
“আমি তো এতোকিছু শুনতে চাচ্ছি না। আমি তোমার সিদ্ধান্ত শুনতে চাচ্ছি। আমি বাসায় জানাবো কি না সেটা শুনতে চাচ্ছি”
রবিন ভাই এবার তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তানি আপুর কড়া স্বরের সামনে অসহায় কন্ঠে বললেন,
“তানি আমি এখন চাকরিতে কিছু করে পারি নি, বেতন আমার খুব একটা না। বাসায় বিয়ের কথা বলার মতো অবস্থাটা এখনো হয় নি। আবেগে যাবার মতো ছেলেমানুষ আমি নই। ওদের সামনে আমি কেবল ই একজন মাইনর ক্যারেক্টর। আর সত্যি কথা বলতে তুমি তাদের নিষেধ করতে পারবে না। তুমি ছেলেকে দেখো, এমন ও হতে পারে ছেলেকে তোমার পছন্দ হয় নি।”
এবার কিঞ্চিত কপালে ভাঁজ পড়লো তানির। কন্ঠে দৃঢ়তা নিয়ে বললো,
“এই শোনো, তুমি যদি আমাকে বলো পৃথিবী উল্টে গেলেও আমি তোমাকেই বিয়ে করবো তাহলে বিল গেটস এর ছেলেকেও আমি মানা করে দিবো। কিন্তু তুমি যদি কনফিউজড থাকো তাহলে বলে দাও। আমি রাস্তা মাপি”
তানির অগ্নিবাক্য শুনে হেসে উঠলো রবিন ভাই। এগিয়ে এসে কপালে উষ্ণ ঠোঁট জোড়া ঠেকিয়ে বললো,
“আমি মোটেই কনফিউজড নই। ভালোবেসেছিলাম যখন তখন ও কনফিউজড ছিলাম না। শুধু একটু সময় লাগবে। সব বলবো। একটু সময় দাও। দুনিয়া উল্টালেও আমি তোমাকেই বিয়ে করবো, কথা দিচ্ছি”
“তাহলে সাহস করছো না কেনো?”
“এই যে করলাম”
রবিনের তপ্ত স্পর্শে কেঁপে উঠলো তানি। হৃদয়ে জমা রাগটা একটু হলেও দমলো। এদিকে অন্নার কান রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। সর্বদা মানুষের সুপ্ত মূহুর্তেই কেনো সে সেখানে উপস্থিত থাকে! তবে রবিন ভাই এর সাহসিকতায় সে খুব অনুপ্রাণিত। একটু সাহস কি তার ও করা উচিত। কথাটা ভাবতেই পা বাড়লো সামনের দিকে। এদিকে কলার খোসার ন্যায় শাড়ির তলটা আবারো পায়ের নিচে বাধলো। অমনি হুমড়ি খেয়ে পড়তে গেলো অন্না। কিন্তু এবার আর মাটির সাথে মোলাকাত হলো না। কারণ তার পূর্বেই এক জোড়া হাত তার কোমাড় জড়িয়ে ধরলো। তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
“চোখ জোড়া খুলে আঁচলে বেধে রাখ”………
চলবে