আমার চন্দ্রাবতী পর্ব-১২

0
891

#আমার_চন্দ্রাবতী
লেখিকা- সালসাবিল সারা

১২.
–“আম্মি,আমি চিটাগং যাচ্ছি।চার পাঁচদিন পরেই ফিরে আসবো।”
ইয়াদ মাঝারি সাইজের লাগেজে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্যাকিং করার মাঝে তার মাকে বললো।
ডালিয়া নিশ্চুপ দৃষ্টি জ্ঞাপন করলো ছেলের পানে।ভোরের পূর্বে উঠার অভ্যাস আছে ডালিয়ার। উদ্দেশ্য, ছেলে ঘরে আছে নাকি তা পর্যবেক্ষণ করা।সচরাচর ইয়াদ বাড়িতে থাকলে এমনটা করেন উনি।আজও এর ব্যতিক্রম হলো না।তবে ব্যতিক্রম ঘটলো অন্যথায়।অন্যান্য রাতে এই সময় ইয়াদের দরজা বন্ধ থাকে।আর আজ একেবারে সটান করে খোলা।সেই অবস্থা দেখেই ডালিয়া ছেলের রুমে প্রবেশ করলে উল্লেখ্য কথাটা বলে ইয়াদ তার মাকে উদ্দেশ্য করে।ডালিয়া ছেলের পানে এখনো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে।তার ছেলে পূর্বের সেই পার্টির কাপড় পরিবর্তন করেনি।কিন্তু, তার ছেলে তো এমন না!ঘরে এসে সাথে সাথে বাহিরের পোশাক পরিবর্তন করা ইয়াদের বৈশিষ্ট্য।তবে, আজ তার ছেলের এমন অবস্থা কেনো?ডালিয়া চোখের চশমা ঠিক করলো।ছেলের বিছানায় হাত বুলিয়ে এইবার তিনি নিজের মুখ খুললেন,
–“বাসায় কখন এসেছো,আব্বা?”
–“অনেক আগেই।”
ইয়াদ নিজের লাগেজ গোছাতে ব্যস্ত।
–“তাহলে এতক্ষণ বাহিরের কাপড় পরিবর্তন করোনি কেনো?তুমি তো বাহির থেকে এলেই কাপড় পরিবর্তন করে নাও সাথে সাথে।তুমি কি চিন্তিত কিছু নিয়ে?”
ইয়াদ মায়ের প্রশ্ন শুনে থামলো। শার্টের হাতা ফোল্ড করার অভিনয় করে সে তার মাকে মিথ্যা জবাব দিলো,
–“বেরুনোর জন্যে তৈরী হবো একেবারে।সেই হিসেবে চেঞ্জ করিনি।বাদ বাকি আমি কিছু নিয়ে চিন্তিত না।”
ডালিয়া এখনো সন্দেহভাজন দৃষ্টি জ্ঞাপন করছে ইয়াদের প্রতি।ইয়াদ সেদিকে মাথা না ঘামিয়ে নিজের স্যান্ডেল এবং বুটজোড়া লাগেজে রাখার বন্দোবস্ত করছে।এটাই সত্যি ইয়াদ আজ নিজের নিয়মে পরিবর্তন এনেছে, যা তার মায়ের চোখে এড়িয়ে যায়নি।

পার্টি থেকে এসেই ইয়াদ শ’খানেক বার দুআর সেই ভিডিও দেখতে ব্যস্ত ছিলো। দুআকে সরাসরি নিজের দৃষ্টির সামনে দেখাটাই যেনো ইয়াদের মুখ্য উদ্দেশ্য এখন।তাছাড়া,রামিসা এখনো কি কারণে ফোন ধরছে না;এই নিয়েও চিন্তার শেষ নেই।ইয়াদ চেয়েছিলো মাইশাকে ফোন দেওয়ার।তবে,বিবেকে তার বাঁধ সাধলো।অগত্য ফোন দেওয়া থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিলো সে।

–“হঠাৎ চট্টগ্রামে যাচ্ছো?তোমার ফুফুর বাসায়ও কি যাবে?”
–“উম।আমরা যাচ্ছি আসলে রত্নাপুর গ্রামের(কাল্পনিক) পাহাড়ি ঝর্ণা পরিদর্শন করতে।পাহাড় থেকে ফুফুর বাসা নিকটে।তাই সময় পেলে যাবো।”
ইয়াদ লাগেজের চেইন বন্ধ করলো।
–“থাকবে কোথায়?কটেজে নাকি?”
–“অবশ্যই কটেজে থাকবো।এতো চিন্তা করার দরকার কি আম্মি?আমি কি আজ নতুন যাচ্ছি?”
ইয়াদ বিরক্ত হলো যেনো।
–“বৃষ্টির দিনে পাহাড় ভালো ঠেকছে না আমার কাছে।”
–“কিছুই হবে না।বৃষ্টিতে পাহাড় ভ্রমণের অনুভুতি আলাদা।আর সেখানে সব রকমের সুবিধা আছে।”
–“তোমার যেমন ভালো লাগে,আব্বা।কখন বেরুবে?”
–“এক ঘন্টা পর।”
ইয়াদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো তার মাকে।
–“ঘুমিয়ে পড়ো তাহলে।আমি ডেকে দিবো।”
–“তাকে না দেখে শান্তির ঘুম আর আসবে না, আম্মি।”
ইয়াদ অন্যমনস্ক।
–“কি,আব্বা?”
–“কিছু না।ঘুমিয়ে পড়ো,আম্মি।যাওয়ার আগে তোমার সাথে দেখা করে যাবো আমি।”
ইয়াদ তাড়া লাগালো তার মাকে।ডালিয়া ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে নিজের কামরায় ফিরলো।ছেলের ব্যবহার আজ তার কাছে বড্ড অদ্ভুত ঠেকছে।

লাগেজটা ইয়াদ তার আলমিরার সামনে রাখলো।দুআর সাথে কিভাবে,কোথায় দেখা করবে তার মনে এই নিয়ে কঠিন অংকের হিসাব কষছে। সাড়ে ছয়ফুট ফুল মিরোরের সামনে ইয়াদ নিজের অবস্থান ঠিক করলো।নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে সে হাত রাখলো শার্টের বোতামে।কয়েকটা বোতামকে ঘরমুক্ত করে ইন করা অংশটাও উম্মুক্ত করলো সে।অতঃপর শরীরকে শার্ট মুক্ত করে বিছানায় পিঠ দিয়ে নিজেকে শায়িত করলো সে। অক্ষিকোটরে এখনো সেই পবিত্র মানবীর প্রতিচ্ছবি ঘুরঘুর করছে।শিরা উপশিরায় শুধু একটাই আকাঙ্খা বয়ে যাচ্ছে তার।নিজের চন্দ্রাবতীকে দেখার।
পুনরায় ঘড়ির পানে দৃষ্টি মেললো সে।আজ যেনো ঘড়ির সময় ফুরানোর নামই নিচ্ছে না। ইয়াদ ডান হাত ভাঁজ করে নিজের কপালের উপর রাখলো।দৃষ্টি তার ভারী কারুকার্য খচিত সিলিং এ।মিনিট কয়েক নিষ্পলক চেয়ে থেকে ইয়াদ ধুপ করে উঠে পড়লো।মাথায় পানি দিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টায় রইলো সে।এক পর্যায়ে পূর্ব থেকে নির্ধারিত কাপড় পরিধান করা আরম্ভ করলো। মোটা কাপড়ের ফুল হাতা গেঞ্জি আর কালো স্ক্র্যাচড জিন্স পরিধান করে পুনরায় অবস্থান করলো আয়নার সম্মুখে।পাশে থাকা সেল্ফ থেকে লোশন লাগিয়ে,গায়ে পারফিউম মাখলো সে।চুলগুলোকে আজ জেলের আস্তরণ ছাড়া আঁচড়িয়ে নিলো শুধু।জরুরি জিনিসপত্র পকেটে পুরে লাগেজ হাতে বেরিয়ে পড়লো ইয়াদ।পুরো ঘরে শূন্যতা বিরাজমান।মায়ের দরজায় নক করতেই হাতে তসবি সমেত বেরিয়ে এলো ডালিয়া।মাকে বিদায় জানিয়ে ইয়াদ নিজেই গৃহ ত্যাগ করলো।

তার গন্তব্য এখন ইয়াসিরের বাসা।সেখান থেকেই একজোট হবে সবাই।
সকলে উপস্থিত,অনুপস্থিত শুধু ইয়াসির।এইদিকে তারই ঘরের সামনে এইভাবে অপেক্ষা করা বাকি তিনজনের কাছে বিরক্তির কারণ বলে মনে হচ্ছে।
–“ফোন দে শালাকে।”
ইয়াদের কণ্ঠে বিরক্তি।
–“দিতাছি,কিন্তু ধরে না।”
ফারসিভ মোবাইল ইয়াদের দিকে তাক করলো।
–“ভেতরে চল।”
ইয়াদ ঘাড় কাত করে বললো।
–“মেইন গেইটে তালা মারা ভেতর থেকে।”
স্পন্দন এর ঘুমঘুম কণ্ঠ।
–“অন্য পদ্ধতি তো আছে।যেমনটা আমরা ছোট বেলায় করতাম!”
ইয়াদের মুখে শয়তানী হাসি।
–“দেওয়াল টপকাবি?”
ফারসিভ প্রশ্ন করলো।
–“অবশ্যই।”
ইয়াদ মলিন হেসে গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো।দক্ষ লোকের মতো সে এক লাফেই পৌঁছালো দেওয়ালের অপরপ্রান্তে। হাত বাড়িয়ে সে ফারসিভকে বললো,
–“চলে আয়।”
ইয়াদের সাহায্যে ফারসিভ বাউন্ডারির ভেতরে প্রবেশ করলো।বাহিরের দিকে একটা লাইট জ্বলছে শুধু।পুরাতন আমলের বিল্ডিং হওয়া সত্বেও চারিদিকে একেবারে চকচক করছে পরিচ্ছন্নতায়।ভোরের হালকা আলো,লাইটের স্বচ্ছ রশ্নিতে চারিদিক স্পষ্ট।ইয়াসিরের রুমের জানালায় টোকা দেওয়া শুরু করলো ইয়াদ।জানালার গায়ে ঝনঝন শব্দে তন্দ্রা কেটে গেলো ইয়াসিরের।
–“ঐ কেরে?”
–“তোর বাপ।”
ইয়াদ রেগে জবাব দিলো।
জানালা খুলতেই বিস্ফোরিত হলো ইয়াসিরের অক্ষিজোড়া,
–“আব্বা..আব… ঐ তোরা?ফোন দিলেই তো হতো।বেশি দেরী করে ফেলেছি?”
ফারসিভ ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
–“মোবাইল পেলে ইয়াদ,তোর মোবাইলের অস্তিত্ব থাকবে না আর।শালা,জলদি রেডি হয়ে আয়।”
–“সাইলেন্ট ছিলো মোবাইল।সরি।”
–“তোর শাস্তি,তুই টানা দুই ঘণ্টা ড্রাইভ করবি।”
ইয়াদ বললো।
ইয়াসির কিছু বলার পূর্বে ইয়াদ পুনরায় দেওয়াল টপকে গাড়ির দিকে ধাবিত হলো আর পিছনে ছুটলো ফারসিভ।

মিনিট বিশেক পর ইয়াসির উপস্থিত হলো গাড়ির সম্মুখে।তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠে বিনা বাক্যে সে গাড়ি স্টার্ট দিলো। বাকিরা আগে থেকেই হেলান দেওয়া অবস্থায় ছিলো গাড়িতে।ইয়াদের মুখের উপর ক্যাপ বিদ্যমান।হঠাৎ জোরে ব্রেক কষলে বাকি তিনজন হচকিয়ে উঠে।ইয়াদ মুখ থেকে ক্যাপ সরিয়ে ইয়াসিরকে চিন্তিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
–“কি হলো?”
–“দোস্ত!ভাই!”
–“আগে বল বাপ!চাপ ধরেছে?”
স্পন্দন প্রশ্ন করলো ইয়াসিরকে। ইয়াসির কেবল মাথা নাড়ালো। ইয়াদের ভ্রূকুঞ্চিত মুখমণ্ডল দেখে হালকা ঢেকুর গিলে মিনমিনে স্বরে সে বলে উঠলো,
–“আমার কাপড়ের ব্যাগ আনা হয়নি। আমি গাড়ি ব্যাক করছি।”
ইয়াদ ইয়াসিরের ঘাড় চেপে ধরলো উত্তেজনায়,
–“গাড়ি সোজা যাবে।একদম সোজা। কাপড়ের ব্যাগ আনিসনি কাপড় ছাড়া থাকবি।সমস্যা কি?”
পিছন থেকে স্পন্দন এবং ফারসিভ টোকা দিলো ইয়াসিরের মাথায়,
–“তোরে আমি বাইজ্জাবো অমানুষ।”
স্পন্দন ক্ষেপলো।
–“গাড়ি চালা।”
ইয়াদ নির্দেশ দিলো পুনরায়।ইয়াসির শুকনো মুখে গাড়ি চালু করলো।সবাই ফিরলো পূর্বের অবস্থানে।ইতিমধ্যে পেছনের দুইজন তন্দ্রাচ্ছন্ন।ইয়াদ মুখ থেকে ক্যাপ সরিয়ে ইয়াসিরের পানে দৃষ্টি দিলো।শুকনো মুখে ছেলেটা গাড়ি চালাচ্ছে।
–“আমার কাপড় পড়িস।”
ইয়াদ ধীর কণ্ঠে বললো।
–“তোর কাপড়?সাইজ দেখেছিস ভাই?তুই কতো লম্বা আর আমি!তোর শার্ট দিয়ে আমার প্যান্টের কাজ হয়ে যাবে।তখন আমায় দেখতে ইন্ডিয়ার নায়িকার মতো লাগবে।প্যান্ট নেই,কিন্তু শার্ট দিয়ে দুটোর কাজ সেরে ফেললাম।”
ইয়াসির হাসলো।
পাতলা অধর জোড়া স্ফীত করলো ইয়াদ,
–“মার্কেট আছে সেখানে।কিনে নিস।”
–“মানিব্যাগ আনিনি।”
–“দুআর ব্যাপারটা না হলে না,তোকে আমি এইখানেই লাত্থি মেরে ফেলে দিতাম।”
ইয়াসির আবারও হাসলো ইয়াদের কথায়,
–“তুই আর যায় করিস আমাকে কখনো মারবি না,এটা আমার বিশ্বাস।বাদ বাকি,আমার লাগবে না কাপড়।”
–“কাপড় ছাড়া থাকলে তোকে কেমন লাগবে,ইয়াসির?”
ইয়াদ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।বন্ধুর এমন খোশ মেজাজ দেখে ইয়াসিরের মন প্রশস্ত হলো যেনো।সেও হাসির তালে ইয়াদকে বললো,
–“দুআর দেখা পাওয়ার আশায় এই হাসি,তাই তো?”
ইয়াদ সম্মুখে দৃষ্টি জ্ঞাপন করে মাথা নাড়ালো,
–“হুম।আমার এই দুচোখ শুধু তার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত।”
–“তোরে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে।প্রেমিক পুরুষ আমাদের,জনাব ইয়াদ বিন তেহরান।”
ইয়াসির এর কথায় ইয়াদ সামনের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে পুনরায় মুখের উপর ক্যাপ দিয়ে সিটে শায়িত হলো।

“চট্টগ্রামে স্বাগতম” মাইলফলকে স্পষ্ট লিখা বিদ্যমান।গাড়িতে অবস্থানরত তিন যুবক নিজেদের মোবাইলের ম্যাপ দেখতে ব্যস্ত।ইয়াদ বিনা দ্বিধায় গাড়ি হাঁকিয়ে যাচ্ছে।এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে রাখলেও অন্য হাতে মোবাইলে কাউকে ফোন করছে সে বারংবার।
———————–
আকাশটা পরিষ্কার একদম।মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া পরিবেশকে একদম শীতল করে রেখেছে।তিন মানবী এই পরিষ্কার আবহাওয়ায় একে অপরকে আঁকড়ে ধরে তন্দ্রায় বুদ হয়ে রইলো।গতকাল রাত্রি দুআর মায়ের কাছে পুরাতন চিলেকোঠার গল্প শুনতে শুনতেই লাইব্রেরী রুমের বিশাল খাটে ঘুমিয়ে পড়েছিল তারা।এই রুমে জানালার ব্যবস্থা নেই বলে তিন রমণী এখনো দিনের বেলার আভাস পাচ্ছে না।অন্যদিকে মেয়েদের প্রতি আহ্লাদ দেখিয়ে আহেলিও তাদের ডেকে তুলতে বারবার ভাবছে।পুরাতন এই লাইব্রেরি ঘরে নতুন-পুরাতন সকল বই হলেও,এদের বেশভূষা একেবারে নতুন।এই লাইব্রেরী একান্ত দুআ এবং রিজোয়ানের।বলতে গেলে রিজোয়ান একজন বইপোকা।তাই সুন্দর মৌসুমে প্রিয় বইয়ের ভেতরে আরামের সঙ্গ পেতেই লাইব্রেরীর মাঝে খাটের ব্যবস্থা করেছে সে।বর্তমানে সেই খাটে তিন তরুণী ঘুমে মগ্ন।
রামিসার পেটে মোচড় দিয়ে উঠলে তার নিদ্রা কেটে যায়।পরিচিত বাথরুমের খোঁজে সে দুআর রুমের বাথরুমকে নির্বাচন করলো।বাতাসের গতিতে হাঁটছে রামিসা।
গামছায় মুখে মুছতেই তার কানে ভেসে এলো মোবাইলের শব্দ।বালিশের আস্তরণ ভেদ করে সূক্ষ্ম শব্দ ভেসে আসছে রামসার কানে।রামিসা বালিশের স্তূপ সরিয়ে মোবাইল আবিষ্কার করলো।ইয়াদের নাম দৃশ্যমান স্ক্রিনে।রামিসা কল রিসিভ করতেই ইয়াদের চিন্তিত কণ্ঠ শুনতে পেলো সে,
–“রামু, কাল থেকে ফোন ধরছিলি না কেনো?”
–“আমি দুআর বাসায়।ব্যস্ত ছিলাম,তাই ধরতে পারিনি।কোনো দরকার ভাইয়া?”
রামিসার কণ্ঠে অস্থিরতা।
–“কাল কি হয়েছিল?দুআ সেভাবে সবার মাঝে বসে কান্না করছিলো কেনো?দুআ ঠিক আছে?”
রামিসা স্তব্ধ।দুআর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিভাবে জানলো ইয়াদ এটাই তার বোধগম্য হলো না।দুইহাতে মোবাইল চেপে ধরে সে ইয়াদকে প্রশ্ন করলো,
–“কাল কি হয়েছিল?”
–“তুই তো পাঠিয়েছিলি ভিডিও।”
–“না না।সব ঠিক আছে।দুআর কিছু হয়নি।”
রামিসা হেসে মিথ্যাকে ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করলো। সে গতকালের কথা ভাবার চেষ্টা করে বুঝতে পারলো, ইয়াদের জন্য করা ভিডিওটা গতকাল উত্তেজনায় তার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলো ভুলক্রমে।দুআ তাকে ওয়াদা করিয়েছিল এই ব্যাপারটা সবার কাছ থেকে চেপে যেতে।তাই রামিসা আগ বাড়িয়ে আর কিছু বললো না ইয়াদকে।দুআর ওয়াদা ভেঙে সে নিজের নাম মুনাফিকের খাতায় লিখাতে রাজি না।
–“ওহ। ভালো থাকলে ভালোই।তোকে একটা কাজ করতে হবে।”
–“কি কাজ?”
রামিসা মাথায় হাত রাখলো গভীর চিন্তায়।
–“আমি গ্রামে আসছি।তিতলি কটেজে উঠছি। রত্নাপুরে তোদের বাসা থেকে এই জায়গাটা অনেক কাছেই।আশা করছি দুআর দেখা মিলবে সেখানে। ব্যবস্থাটা তুই করবি।”
–“কি?তুমি গ্রামে আসবে আর আমাদের বাড়ি আসবে না?মাথা ঠিক আছে?আমাদের বাড়িতে আসো।”
–“আসবো।সেটা হবে দুআকে দেখার দ্বিতীয় সুযোগ।”
ইয়াদ মলিন কণ্ঠে জবাব দিলো।
–“ওকে।কোনো সমস্যা নেই।তিতলি কটেজের পাশে অবস্থানরত পাহাড় আমাদের প্রিয় জায়গা।তোমার রাস্তা ক্লিয়ার ভাবতে পারো।কিন্তু,তোমাকে আজ একটা কথা বলবো।দুআর ব্যাপারে।কোনো দ্বিধা ছাড়া শুনতে থাকো তুমি।”

–“বলতে থাক।”

ইয়াদের অনুমতি পেয়ে রামিসা গড়গড় করে বলতে আরম্ভ করলো,
–“দুআ বাহির থেকে অনেক শুভ্র হলেও কেউ তার ভেতরকার দেহের দাগ সম্পর্কে জানেনা।সবাই তার বাহিরের রূপেই মগ্ন হয়ে যায়।কিন্তু,দুআর ভয় হয় অনেক;তার দেহের ভেতরকার ত্বকের অবস্থা জেনে তার প্রেমে কেউ মশগুল হবে না।এমনটাই ভেবে আসছে সে সর্বক্ষণ।তাই তুমি যদি শুধুই তার বাহিরের মোহে মত্ত থাকো,তবে আমার বান্ধুবিকে কষ্ট দেওয়ার মতো অধিকার আমি দিবো না তোমায়।প্রমিজ করো ভাইয়া,তুমি দুআর সবটা মেনে নিবে!”
ইয়াদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।নিজেকে নিয়ে দুআর এমন মনোভাবনা ইয়াদের মনকে নাড়া দিয়ে উঠলো যেনো।তরুণী মেয়েটা নিজের ত্বক নিয়ে ভালোবাসায় বিশ্বাস হারাতে বসলো।কিন্তু ইয়াদ এই মেয়েকে সারাজীবন নিজের পাশে রেখে তার কথাটা ভুল প্রমাণ করে দিবে।কারণ,ইয়াদের শুধু দুআকে চায়।তার সকল খাদ,ভালো দিক সবটাই আপন করে নিতে প্রস্তুত ইয়াদ। রামিসার কথায় ইয়াদ তাকে জবাব দিলো,
–“তার গায়ের দাগ, ত্বকে সমস্যা সবটাই আমার।আমার শুধু তার উপস্থিতির অনুভবতা চায়।শুভ্র,পবিত্র মুখশ্রীতে আমার অস্তিত্বের জানান দিতে চায়।দুআকে বলে দিস,কেউ একজন তার প্রেমে মত্ত।নিজের চন্দ্রাবতীকে চোখে হারায় সে।”
রামিসার কথার অপেক্ষা করলো না সে,ফোন কেটে দিলো।
অন্যথায় রামিসা অবাক দৃষ্টিতে মোবাইলের স্ক্রিনে চেয়ে রইলো নির্বিঘ্নে।আজ তার কথার প্রমাণ সে হাতেনাতে পেলো।ইয়াদ নিঃসন্দেহে দুআর জন্যে সবচেয়ে উত্তম।

–“রামিসা,তুই কবে উঠেছিস?আমাদের ডাকলি না কেনো?দুপুর একটা বাজে।”
দুআ রুমে এসে তাড়া লাগালো এলোমেলো বিছানা ঠিক করার কাজে।
–“আরে,তুই করছিস কেনো? জেনি করে দিবে।এইদিকে আয় বস।”
দুআর হাত ধরে পাশে থাকা টেবিলে বসলো রামিসা।
–“কাহিনী কি?”
দুআর সন্দেহভাজন দৃষ্টি।
–“কাহিনী হলো,আমি অনেক খুশি আজ।আর সেই খুশিতে আমরা তিতলি কটেজের পাশের পাহাড়ে যাচ্ছি।”
–“সত্যি যাবো!”
দুআ অবেগপ্লুত।
–“আলবৎ যাবো।মাইশা আপুকে বললে সে নাচতে নাচতে যাবে আমাদের সাথে।পরীক্ষা শেষ, তাই বাঁধা দেওয়ার কেউই নেই।”
–“আমিও যাবো,আজব।কই যাবি?”
মাহির বাথরুম থেকে বেরিয়ে প্রশ্ন করলো।
–“পাহাড়ে।”
–“তিতলি কটেজের পাশে?”
–“হ্যাঁ।”
–“আরে বাহ!বৃষ্টিকালে পাহাড়ের দৃশ্যটা দেখা ভাগ্যের ব্যাপার।”
মাহি হাসিমুখে জবাব দিলো দুআর কথায়।
–“আগে মাকে রাজি করিয়ে আসি।”
দুআ কথাটা বলে উঠতে নিলে রামিসা হাত ধরলো তার,
–“আমিও যাবো।চাচীকে রাজি করাতেই হবে আমাদের।”
–“ইন শাহ্ আল্লাহ্!”
দুআ হেসে জবাব দিলো রামিসাকে।

____________________
এইখানে কটেজের সংখ্যা প্রায় পঁচিশ।কটেজে বিদ্যমান বেশিরভাগ মানুষই বিত্তশালী।কারণ,কটেজের খরচ তুলনামূলকভাবে একটু বেশি।তবে,এখন বৃষ্টির সিজন হওয়ায় বেশিরভাগ কটেজ খালি।স্থানীয়দের যাতায়াত এইখানে সর্বদা লক্ষণীয়।পাহাড়ের অবস্থান এবং উচ্চতাই এইখানকার বিশেষ আকর্ষণ।এমন খাড়া উঁচু পাহাড়ে অনেকে নিজের নামের পতাকাও বেঁধে আসে উপস্থিত গাছের সাথে।
মানুষ কম বিধায় ইয়াদ আজ মাস্কের সাহায্য নেয়নি।খোলামেলা চলাফেরা করছে।অবশ্য তাকে দেখে ম্যানেজার থেকে শুরু করে সব কর্মচারী একটু বেশি ভালো যত্ন নিচ্ছে তাদের।ইয়াদ মাথার ক্যাপ উল্টো ঘুরিয়ে রিসেপশনের সোফায় বসে আছে।ইয়াসির এবং স্পন্দন পাশের পর্যটন মার্কেটে গিয়েছে কিয়ৎক্ষণ পূর্বে।হাতের ম্যাগাজিন কিছুক্ষণ উল্টে পাল্টে নিতেই ফারসিভ বলে উঠলো,
–“দুআ কি আসবে?”
–“হুম। রামিসা তো তাই বললো।”
ইয়াদের থমথমে কণ্ঠ।
–“বৃষ্টি আসলে?”
ফারসিভের প্রশ্নে বাঁকা চোখে তাকালো সে,
–“বি পজেটিভ।মেজাজ ভালো করতে সাহায্য করতে না পারলে,অন্তত খারাপ করতে সাহায্য করিস না।”
ইয়াদ সোজা হয়ে বসলো।
–“কি ইয়াদ,কি হয়ে গেলো!”
–“চুপ থাকবি?”
ফারসিভ ইয়াদের চটে যাওয়া দেখে মুখ টিপে হাসলো।আর ইয়াদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো বাহিরে।আজ বৃষ্টি নামলে ফারসিভকে সেই বৃষ্টিতে জুবুথুবু করবে ইয়াদ।

–“ভাইয়া,আমরা বেরিয়ে পড়েছি।আসতে সময় লাগবে পনেরো মিনিট।”
রামিসার মেসেজ দেখে ইয়াদ হুট করে উঠে দাঁড়ালো।আয়নায় নিজেকে আবারও পর্যবেক্ষণ করে সে বেরিয়ে পড়লো রুম থেকে।

–“আরে ভাই,আমাদের জন্যে অপেক্ষা তো কর!কই যাচ্ছিস?”
স্পন্দন প্রশ্ন করলো।
–“পাহাড়ে চল।”
ইয়াদ তীব্র স্বর প্রবেশ করলো সেই তিন তরুণের কর্ণগহ্বরে।

পাহাড়ে অবস্থিত টং এর দোকান থেকে চা অর্ডার করলো ইয়াদ।অপেক্ষা শুধু এখন দুআর আগমনের।এই ঠান্ডা পবনের ছোঁয়াও ইয়াদের তপ্ত শরীরকে শীতল করতে পারছে না।ভেতর থেকে অজানা এক গরম আভা বেরিয়ে আসছে যেনো।এরমধ্যেই তার কানে ভেসে এলো অপেক্ষারত সেই চিরচেনা কণ্ঠ,
–“মাহি আমার হাতটা শক্ত করে ধর!”

–“ইয়াদ রামিসাকে দেখা যাচ্ছে।”
ইয়াদ সম্মুখে ফিরলো ইয়াসিরের বাণীতে।রামিসা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।পাশে থাকা মেয়েটা অর্থাৎ মাহি দুআর হাত চেপে তাকে উপরে উঠতে সাহায্য করছে।উপরে উঠে দুআ বুকে হাত রেখে সস্থির নিঃশ্বাস ফেলার দৃশ্যটা ইয়াদের মনকে শরীরে হিম ধরিয়ে দিলো।সেই শুভ্রতা,পবিত্রতার অধিকারিণী আজ কতটা দিন পর তার সামনে এসেছে! পরনে লম্বা হাতার কামিজটা টেনে দিচ্ছে বারংবার।ইয়াদ আগে তার এমন কাজ না বুঝলেও আজ সেটা বুঝতে তার একটুও কষ্ট হলো না। মাথার কাপড় ঠিক করে মেয়েটা পুনরায় মাইশাকে তুলতে সাহায্যের জন্যে এগিয়ে গেলো।ইয়াদের দৃষ্টি নড়ছে না সামনে উপস্থিত মানবীটার সত্ত্বা থেকে।

–“লম্বা চুলের মেয়েটাই কি দুআ?”
–“হ্যাঁ।”
ফারসিভের প্রশ্নে উত্তর দিলো ইয়াসির।তিনজন যখন ইয়াদের দিকে তাকালো,দেখলো তাদের ক্রিকেটার বন্ধু বিনা পলকে সেই কালো রঙে রাঙানো মানবীকে নিজের অক্ষিকোটরে আবদ্ধ করে নিয়েছে।

–“ক্রিকেটারের উইকেট পড়ে গেলো এইবার সত্যি সত্যি।”
স্পন্দনের কথায় তিনজনের মুখে হাসি ফুটলেও, ক্রিকেটার সাহেব দেরী না করে সামনে অগ্রসর হলো।

–“ইয়াদ ভাইয়া!”
রামিসা,মাইশা দুইজনই চিল্লিয়ে উঠলো।
–“তোরা এইখানে?”
ইয়াদ অবাক হওয়ার অভিনয় করলো বৈকি।

অন্যথায়, সেই লম্বা খেলোয়াড় মানবকে এইখানে দেখে অবাকের সীমানায় পৌঁছালো দুআ।এই মানবের দেখা সে এইখানে পাবে ঘুণাক্ষরেও যেনো আন্দাজ করলো না।করবেই বা কিভাবে?এই মানবের খবরাবর কিভাবে সে পাবে! রামিসা এবং মাইশার সাথে কথা বলছে ইয়াদ ঠিকই,কিন্তু তার দৃষ্টি দুআর প্রতি আবদ্ধ।ব্যাপারটা দুআর অগোচরে হচ্ছে না।তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো,ইয়াদের এই নজর একটুও তাকে অস্বস্থি হতে দিচ্ছে না।বরং অন্যরকম শিহরণ বয়ে যাচ্ছে যেনো তার সত্ত্বায়।মাহি মুখ টিপে হাসি আটকে রইলো ইয়াদের অবস্থা দেখে।আজ সে বুঝলো রামিসার বলা কথা খাপে খাপে সত্যি।
সবাই সবার সাথে পরিচিত হয়ে নিলো।কিন্তু দুআ নিশ্চুপ।বাকি তিন মানব দুআর সাথে কথা বলার তেমন চেষ্টাও করলো না অন্য এক কারণে।যে যার মতোই আলোচনায় ব্যস্ত। গগণটা ধীরে ধীরে কালচে হচ্ছে।বাতাসটাও তীব্রতার জানান দিচ্ছে যেনো।দুআর নিচু দৃষ্টির কারণে ইয়াদের কথা বলা হলো না দুআর সাথে।রামিসা ব্যাপারটা বুঝে অন্যদের সাথে খোশ আলাপ জুড়ে দিল।এই বুঝে ইয়াদ দুআর পেছনে নিজের অবস্থান ঠিক করলো নিভৃতে।খুবই ধীর শব্দে সে দুআকে প্রশ্ন করলো,
–“কি ব্যাপার, এতো চুপচাপ কেনো?তোমাদের এইখানে এলাম আর ‘কেমন আছি’ এটাই জিজ্ঞেস করলে না?”
দুআ যেনো বরফে পরিণত হলো।এই লোককে দেখেই তো দুআর বুকটা শান্ত হচ্ছিল না।এখন পেছনে ফিরে এই লোকের সাথে দৃষ্টি মেলাতে তার নজর অনেক উঁচুতে তুলতে হলো।লোকটার মুখশ্রী আজ কেমন যেনো হাসিমাখা।গভীর এই নেত্রযুগলের মালিক যেনো তার চোখের সাহায্যেই মানুষকে বদ করে নিতে উস্তাদ!
–“আসলে,আসলে…কেমন আছেন?”
ইয়াদ মলিন হাসলো।তার খরশান চোয়ালে যেনো মুহূর্তেই মুগ্ধতার রাজারা তাদের অধিকার ফলাতে প্রস্তুত!
–“তোমার প্রশ্ন শুনে,বর্তমানে বেশ ভালো আছি।”
তখনই বজ্রপাত হলো তীব্রতার সাথে।ইয়াদের মলিন কণ্ঠ আর বজ্রপাতের শব্দে দুআর সারা সত্ত্বা যেনো কেঁপে উঠলো বিনা অনুমতিতে।

আর দুআর সেই কম্পণরত সত্ত্বাই ইয়াদকে পুনরায় তাঁর প্রতি কাবু করার জন্যে যথেষ্ট!

চলবে…..