#আমার_চন্দ্রাবতী
লেখিকা- সালসাবিল সারা
১৪.
–“আমি শুধু বলেছি,তার ব্যবহারে আমি মুগ্ধ।তার সহজ সরল ব্যক্তিত্ব আমার ভালো লাগে।”
ইয়াদ তার কোমর সমান বারান্দার বাউন্ডারিতে দুইহাত রেখে জবাব দিলো তার বন্ধুগণের অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের।গতকাল ইয়াদ তাদের এই প্রশ্নের উত্তর না দিলে আজ সকালেই তারা পুনরায় ইয়াদের কটেজে এসে তাকে জ্বালাতন শুরু করলো।অগত্য ইয়াদ বাধ্য হয়ে উল্লেখিত জবাব দিলো তার বন্ধুগণদের।তার জবাব শুনে বাকিদের মনে শান্তি মিললো না।তারা ইয়াদ থেকে আরো বেশি কিছু আশা করেছিল যেনো!একে একে নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে সে পুনরায়।কিন্তু ইয়াদ স্তব্ধ।তার দৃষ্টি গগণে।বৃষ্টির তেজ আজ কমার নাম নেই।গতকাল দুআর সাথে কাটানো মুহূর্ত ইয়াদের মনে গভীর দাগের সৃষ্টি করেছে।ইয়াদের এই ক্ষণে এখন শুধু দুআর আগমনের আশায় মত্ত।কিন্তু, তা আজ সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।বৃষ্টির যা তেজ!গতকালের বৃষ্টির চেয়েও আজকের এই বৃষ্টিটা অন্যরকম।তার মাঝে আজ থমকে যাওয়ার কোনো চিহ্ন দেখছে না ইয়াদ।বুক চিড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। আশে পাশের কটেজ জনমানবহীন।দূরে লম্বা উচ্চতার দানব পাহাড় দৃশ্যমান।সেখানে দুই একজন কি যেনো করছে,এতো দূরত্বে সেটা আন্দাজ করা বড় দায়।মনের বর্ষণের কাছে এই তীব্র বর্ষণ ইয়াদের কাছে ফিঁকে লাগছে।মনের বাসনায় দুআর মুখশ্রী স্মরণ করছে সে বারংবার।কাঙ্খিত মানুষটাকে স্বচক্ষে দেখার দহন এতো বেদনাদায়ক কেনো হয়?জানা নেই ইয়াদের।এই মুহূর্তে তার কাছে সবটাই মনে হচ্ছে বিষাদময়।দুআর কল্পনায় মগ্ন ইয়াদের কানে ভেসে এলো ফারসিভের প্রশ্ন,
–“তোর উচিত ছিলো দুআকে সবটা বলে দেওয়া।তুই ওকে ভালোবাসিস,এটা বলতে এতো সংশয়?”
ইয়াদের মেজাজ বিগড়ালো মুহূর্তে।দুআ কেমন ধাঁচের মেয়ে তা যদি তার বন্ধুরা বুঝতে পারতো,তাহলে ইয়াদকে এই প্রশ্ন করার কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবতো না।এক হাত মুঠ করে নিজের চটে যাওয়া মেজাজকে সংযত করার চেষ্টা করলো সে,
–“যেটা বুঝিস না সেটা নিয়ে কথা বলবি না। দুআকে যদি আমি এখনই মনের কথাটা ব্যক্ত করে দিই তাহলে সে নিশ্চিত দ্বিতীয়বার আমার সামনে আসার কথা ভাববে না।মেয়েটা অন্য সাধারণ মেয়ের মতো ইয়াদের জন্যে অপেক্ষা করে নেই।সে নিশ্চয় এমন একজনকে চায়,যে তার সব দুর্বল দিককে আপন করে তাকে চাইবে সারাজীবন!আমি চাই;আমার ব্যবহার,আমার কাজকর্ম,তার প্রতি আমার দুর্বলতা সবটা সে বুঝতে শিখুক ধীরে ধীরে।হুট করে তাকে যদি আমি পেতে চায়,তাহলে হিতের বিপরীত হবে নিশ্চয়।আমি যা ভেবে এগুচ্ছি,সেটা তোদের মস্তিষ্কে ধারণ হবে না।”
ইয়াদ থামলো।মনটা তার হালকা লাগছে।সেও চায় দুআকে নিজের মনের কথাটা চিল্লিয়ে প্রকাশ করতে।কিন্তু,সে অপেক্ষা করবে এক সঠিক সময়ের।যে সময় উপযুক্ত হবে তাদের দুই মনের মিলনের জন্যে যুক্তিযুক্ত।
–“বাহ খেলোয়াড়,তুই যে এতো গভীরতায় চলে গিয়েছিস সেটা আমরা কেউই জানতাম না।ভেবেছি,
দুআকে এইবার বিয়ে করেই নিয়ে যাবি তোর সাথে।”
ইয়াসিরের কথায় পেছনে বাঁক ফিরলো ইয়াদ।ভ্রু জোড়া তার কুঞ্চিত।ইয়াসিরের কথাটা তার ঠিক পছন্দ হয়নি।
–“দুআ এখনো ছোট।ওকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করবো কিভাবে?আঠারো হয়েছে তার! ব্যাপারটা আমার অজানা।যতটুক জানি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।আগে আমাদের মনের মিলন হউক, এরপর বিয়ের জন্যে এক দণ্ড দেরী করবো না আমি।”
ইয়াদ জবাব দিলো সোজাসুজি।
–“কিন্তু,দুআ যদি তোকে পছন্দ না করে?”
স্পন্দন খানিকটা চিন্তিত হয়ে প্রশ্নটা করলো।
–“তো?”
ইয়াদের পাল্টা প্রশ্ন।
–“তো কি,ইয়াদ ওকে উঠিয়ে নিয়ে আসবে।”
ফারসিভ হেসে জবাব দিলো।
বিনিময়ে ইয়াদের অধর প্রসারিত হলো নিমিষেই,
–“দুআ শুধু ইয়াদেরই হবে।আমি ছাড়া দুআর কাছে কোনো অপশন নেই।ছোট একটা মেয়েতে আমি মত্ত।এতো সহজে হাল ছাড়ার মানুষ না আমি।দুআ শুধু আমারই হবে।ক্রিকেট যেমন আমার নেশা,তেমন দুআ আমার আসক্তি।ধীরে ধীরে এই আসক্তি সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে আসছে।তাকে আগলে রাখতে যা যা করার দরকার সব করবো।দরকার পড়লে প্রেমিক পুরুষ হবো,আবার দরকার পড়লে হবো সবচেয়ে বড় খলনায়ক।”
ইয়াদের মুখভঙ্গি অন্যরকম ঠেকছে সকলের কাছে।তার বন্ধুরা এটা বুঝতে পারছে,দুআ যদি ইয়াদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাহলে দুআ ইয়াদের সেই রূপ দেখবে যেই রূপ দুআ কখনো সহ্য করতে পারবে না।সেই স্থানে নিরবতা ছেয়ে গেলো।বৃষ্টির তীব্র শব্দ ছাড়া আর কিছুর শব্দ নেই সেখানে।কটেজের বড় চালের জন্যে বৃষ্টির পানি বারান্দা অব্দি পৌঁছাচ্ছে না।বাকি বন্ধুগণ ইয়াদ এবং দুআর ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত।আর ইয়াদ দুআর কল্পনায় মত্ত। ইয়াদের সারা সত্তাকে যেনো কাবু করে নিয়েছে দুআর কল্পনা।ইয়াদের মনের দহন তাকে জানিয়ে দিচ্ছে,দুআর সাথে তার পরবর্তী দেখাটা শীগ্রই করা প্রয়োজন।নাহলে এই মনের দহনের মাত্রা বেড়ে গেলে দুআর প্রতি বড্ড বেশামাল হয়ে পড়বে সে। নীরবতা ভেঙে ইয়াদ সবার উদ্দেশ্যে বললো,
–“এই বৃষ্টিতে ফুফুর বাসায় যাবি?”
–“যাওয়াটা ভালো ঠেকবে না।চারিদিকে কাদা মাটিতে ভরপুর।গাড়ি চলবে নাকি এটাও একটা বিষয়।”
ইয়াসির বেশ চিন্তা করে জবাব দিল।
–“দুআকে দেখা প্রয়োজন আমার।”
ইয়াদের গম্ভীর স্বর।
–“আজকের বৃষ্টি থামবে বলে মনে হচ্ছে না।এক কাজ কর,কোনোভাবে আজ হজম কর দুআকে দেখার তৃষ্ণা।কালকে কোনো এক ঘটা করে দেখা করিস।”
স্পন্দন ভেবে চিন্তে উত্তর দিলো।
ইয়াদ মত্ত হলো ভাবনায়।আসলেই আজ সকাল থেকেই একই গতিতে বর্ষণ হচ্ছে।এখন বেরুনোটা মোটেও সুবিধার হবে না।ইয়াদ মনে মনে একটা ছক আঁকছে,কিভাবে দ্রুত দেখা করা যায় তার চন্দ্রাবতীর সহিত।
হঠাৎই তার মাথায় এলো,কটেজের ছাতার ব্যাপারটা।যদিও সে ভেবেছিল পরবর্তী দুআর দেখা তার ফুফুর বাসায় পাবে।কিন্তু,এখন ছাতার কথাটা তার সম্পূর্ণ পরিকল্পনা বদলে দিলো।দুআর সাথে দেখা করার আশংকা যদি আরো একবার বৃদ্ধি পায়,তাহলে ক্ষতি কি! ইয়াদের অধর জুড়ে মিষ্টি হাসি।হাতে থাকা মোবাইলের দিকে দৃষ্টি দিলো সে।স্ক্রিনের উপর তার নৃত্যমান আঙ্গুল ডায়াল করলো রামিসার নাম্বারে।
“হ্যালো,রামু।”
ইয়াদের এমন বাক্যে বাকি তিন বন্ধু বাধ্য মানবের মতো হাঁটু ভাঁজ করে বসলো ইয়াদের সম্মুখে।তাদের উশখুশ করা অন্তর জানতে চায়,প্রেয়সীর সাথে দেখা করার জন্যে ইয়াদ এইবার কিসের পরিকল্পনা করলো!
_________________
বেলা বারোটা। রামিসা ছাতা সমেত উপস্থিত হলো দুআর বাড়িতে।ইয়াদের পরিকল্পনা অনুযায়ী রামিসা কাজ করছে।যদিও কথা ছিলো ছাতা নিয়ে গতকাল কটেজে যাওয়ার।তবে বৃষ্টির জন্যে সেটা আর সম্ভব হয়নি।গত দুদিন গগণ ভেদ করে সকল বৃষ্টিকণা যেনো ধরণীতে ভিড় করেছিল।অথচ আজ আকাশ একেবারে চকচকে।বর্ষা ঋতুর শেষ বার্তা হিসেবেই যেনো এই দুইদিন এমন মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছিল!
রামিসাকে দেখতে পেয়ে কিয়ৎ চমকালো দুআ।হাতের মাঝারি ব্যাগটা পাশে রেখে রামিসা দুআর পাশে গিয়ে বসলো।
–“তুই এসেছিস!ভালই হলো।একা একা আমার ভালো লাগছিল না।”
দুআ হাসিমুখে বললো।
–“আরে বলিস না।ব্যস্ত ছিলাম বাসার কাজে।বুঝিসই তো আগামী সপ্তাহে তোদের পরিবার যাবে আপু আর রিজোয়ান ভাইয়ার বিয়ের তারিখ ঠিক করতে।এই নিয়ে যতো কাজ বাসায়।তবে আজ আসতে হলো,
একটা দায়িত্ব থেকে মুক্তি হতে।”
–“কিসের দায়িত্ব?”
দুআ প্রশ্ন করলো তাকে।
–“আরে ডাফার,সেদিন যে কটেজের ছাতা নিয়ে ভাব জমিয়ে বৃষ্টির মাঝে ফিরে এসেছি সিএনজি স্টেশন পর্যন্ত,সেই ছাতা কি আর ফেরত দিবো না?এছাড়াও একজনের অবস্থা বেগতিক হচ্ছে অন্য মানবীকে দেখার আশায়।”
রামিসা গালে হাত ঘষলো।তার দৃষ্টি আজ বেশ সন্দেহযুক্ত।দুআ তার সেই দৃষ্টি লক্ষ্য করে রামিসাকে প্রশ্ন করলো,
–“সবটা বুঝলাম।কিন্তু শেষের কথাটা বোধগম্য হলো না।কাহিনী কি?বাই চান্স,ঐখানে কোনো বন্ধু তোকে পছন্দ!”
–“এই না।এইসব কিছুই না।ইয়াসির ভাইয়াটা এমনি চান্স মারতে চায়।কিন্তু, আমি এতো সহজে হাতে আসার পাত্রী না।এখন চল ভাই,এই ছাতা দিয়ে এসে আমরা আমাদেরকে দায়মুক্ত করি।এই ছাতার আশায় কেউ একজন দুইদিন ঘুমায়নি হয়তো।”
দুআ শব্দ করে হাসলো রামিসার কথায়।মেয়েটা পারেও যেনো সকল কথা বিকৃত করতে!অধরে হাত রেখে হাসি থামালো দুআ,
–“তুই পারিস বটে।মাহি যাবে?”
–“ধুর না।সে নানাবাড়ীতে।বৃষ্টি থামতেই দৌড় দিল সেখানে।আমি জানি আমাকে না জানিয়ে কোথাও যাস না তুই।তাই নির্দ্বিধায় চলে এসেছি তোর কাছে।”
–“আচ্ছা।কাপড় পরিবর্তন করে আসি।”
দুআর কথায় রামিসা সায় দিলো।
তিতলি কটেজের চারদিকে একেবারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।অথচ কাদা মাখা রাস্তা দিয়ে আসতে তাদের সিএনজি কতো হিমশিম খেয়েছে।এইখানে আসার পূর্বে দুআ তার মাকে অনুরোধ করেছে এই ব্যাপারটা যেনো তার বাবা আর রিজোয়ানকে জানানো না হয়।সে তার মাকে ওয়াদা করেছে দ্রুত ফিরে আসবে।
কটেজের সামনে এসে দুইজন থমকে দাঁড়ালো।ইয়াদকে রামিসা ফোন করতে নিলে বাঁধ সাধে দুআ,
–“তুই উনাকে কেনো ফোন করছিস?”
–“আজিব!আমার ভাইয়ার এতো কাছাকাছি এসে,
দেখা না করে ফিরে যায় কিভাবে?”
–“রিসিপশনে চল।এমনিও তোকে উনারা সরাসরি কটেজে যেতে দিবে না।আগে রিসিপশনে যেতে হবে।সেখানে গিয়ে উনাদের গেস্টদের সাথে দেখা করার ব্যাপারটা জানাতে হবে,এরপর উনারা সেই কাঙ্খিত মানুষটাকে ফোন দিয়ে যাচাই করবে।এরপর তুই যেতে পারবি কটেজে।”
রামিসা অবাক,
–“এতো তথ্য তুই জানিস কিভাবে?”
–“রিজোয়ান ভাইয়ার কিছু বন্ধু এসেছিল এইখানে ভ্রমণে।তাদের সাথে দেখা করতে এসেই এইসবের সম্মুখীন হলো ভাই।যার দরুণ সে বাসায় এসে এই কটেজের কীর্তি গেয়েছে।ভাই থেকেই তো জানতে পারলাম ব্যাপারটা।”
দুআর সাবলীল জবাব।
–“যাক,মান সম্মান বেঁচে গেলো।তাও,ভাইকে একটা ফোন লাগায়।”
রামিসা পুনরায় মুঠোফোনের দিকে তাকালো।
ইয়াদের ফোন বাজছে।কিন্ত, শব্দ হচ্ছে না আবার ভাইব্রেটও করছে না।গতরাতে ফোন সাইলেন্ট করে জেনেরাল করতে সে একেবারে ভুলে গিয়েছিল।
দুআ এবং রামিসা রিসেপশনে যেতেই চমকে উঠলো দুআ।রিসেপশনিস্ট লোকটি দুআর পরিচিত।দুআ নির্বিঘ্নে বলে উঠলো,
–“ফারাজ ভাই?”
–“আরে দুআ!”
দুইজনই মলিন হাসলো।ফারাজ তার নানাবাড়ির দিকে আত্মীয়।নানাবাড়ি গেলে ফারাজের সাথে প্রায়শই দেখা হয় তার।কিন্তু দুআ জানতো না ফারাজের কর্মস্থল এইখানে।
–“এখানের ম্যানেজার আপনি!”
–“হ্যাঁ,গতমাসে জয়েন করেছি।তুমি এইখানে?তোমার তো কটেজের দরকার আছে বলে মনে হয় না।”
–“আরে না।একটা কাজে এসেছি।”
দুআ বললো।
–“আর কাজটা আমি বলছি।ইয়াদ বিন তেহরানকে ফোন দিন।বলুন রামিসা আর দুআ এসেছে।”
রামিসা ভাব দেখালো।
–“কিন্তু, ইয়াদ স্যার মানা করে দিয়েছে শক্ত ভাবে কোনো ফ্যান ফলোয়ার এসে যেনো উনাকে বিরক্ত না করে।”
ফারাজ ইতস্তত।
–“এই যে,আমি আর দুআ উনার ফ্যান ফলোয়ার না।আমার ভাই ইয়াদ।আপনি ফোন দিন।এতো তর্ক করছেন কেনো?”
–“আরে,শান্ত হো রামিসা।ইয়াদ মানা করেছে বিধায় উনি উনার কাজ করছেন।ব্যাপারটা শান্ত হয়ে বলা যায়।”
দুআ মলিন কন্ঠে বললো।
–“দুঃখিত আমি।তোমরা বসো প্লিজ।আমি ফোন দিচ্ছি এখনই।”
ফারাজ টেলিফোন কানে লাগিয়ে নাম্বার চাপলো।
সশব্দে টেলিফোন বাজলে ইয়াদ সজাগ হলো তন্দ্রা থেকে।দৃষ্টি মেলতেই কটেজের ইউনিফর্ম পরিহিত সন্দেহভাজন একজনকে টেবিলের নিচে কিছু লাগানো অবস্থায় দেখতে পেলো সে। অপর ছেলেটা টেলিফোনের এমন শব্দ শুনে চমকে উঠার পূর্বে ইয়াদের দৃষ্টিতে আবদ্ধ হয়ে গেলো।ছেলেটা ভীত।তবে ইয়াদ ক্ষুব্ধ।তার রুমে এই স্টাফ বাজে কিছু করতে এসেছে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবলো না সে।প্রথমেই এক ঝটকায় বিছানা ছেড়ে দ্রুত গতিতে স্টাফের কলার চেপে ধরলো ইয়াদ।স্টাফ যেহুতু ধরা পড়েছে তাই সে পালানোর চেষ্টা করলো না।পালানোর চেষ্টা করলে সেই ফলাফল শূন্যই হতো।ইয়াদের মেজাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে। আশে পাশের সব কিছু ঘোলা তার দৃষ্টিতে। শুধু পরিষ্কার হয়ে আছে স্টাফের দেহের অবয়ব।একটু ঝুঁকে টেবিলের নিচ থেকে হাতড়ে আবিষ্কার করলো একটা ছোট্ট মাইক্রোফোন।এই ডিভাইসের সাহায্যে ইয়াদের যাবতীয় কথা এই মাইক্রোফোনের মালিক শুনতে পাবে নির্দ্বিধায়।শক্তিশালী হাতের থাবায় ছোট মাইক্রোফোন চুরমাচুর হয়ে গেলো।ইয়াদ বিনা প্রশ্নে স্টাফের কলার চেপে রুম থেকে বেরিয়ে এক প্রকার টেনে হিচঁড়ে তাকে নিয়ে যাচ্ছে ম্যানেজারের কক্ষের দিকে তথা রিসিপশনে।স্টাফ হাত জোড় করে অনুনয় করছে,
–“আমি কিছু করিনি স্যার।আমাকে টাকার লোভ দেখিয়ে এই কাজ করানো হয়েছে।”
ইয়াদ নিশ্চুপ।তার কাছে এখন কথা বলা মানে হাতাহাতি করা।সীমাহীন রাগে ইয়াদ ভাবলেশহীন।
–“ফোন তুলছে না। স্যার হয়তো ঘুমে।”
ফারাজ বললো।
–“ওহ।এই ছাতা দিতে এসেছিলাম।সেদিন কটেজে বিদ্যমান উনাদের ছাতা নিয়েই আমাদের বাড়ি ফিরতে হয়েছিল।আসি আমরা তাহলে।”
কথাটা বলে দুআ উঠে পড়লো।রামিসা বসে আছে নিশ্চুপ।ইয়াদ যদি জানে দুআ এসেও তার সাথে দেখা করেনি,তাহলে রামিসাকে ভুল বুঝবে তার ভাই।সে হয়তো ভাববে,তার বোন কোনো কাজের না।রামিসা দ্বিমত জানালো দুআর কথায়,
–“আমার ভাইয়ের সাথে আমি দেখা করেই যাবো।আর ভাই কেনো ফোন ধরছে না,এই নিয়ে আমার চিন্তা হচ্ছে।ইয়াদ ভাইয়ের কোনো বিপদ হয়নি তো আবার!নাহলে এতবার ফোন করেও কেনো তার হাদীস মিলছে না?”
আসলেই তো!দুআর মাথায় এই ব্যাপারটা আসলেও সে ভাবলো না।সেই লম্বা মানবের ক্ষতি করার জন্যে কেউ কি ওত পেতে আছে?কিন্তু সে কার কিই বা ক্ষতি করেছে।দুআর আঁখিতে ভর করলো ইয়াদের কল্পিত অবয়ব।এই সুদর্শন মানব আজ কোথায়?ঠিক আছে তো সে?
তখনই বেশ তীব্র শব্দে কেউ মুখ থুবড়ে পড়লো মেঝেতে। আতঙ্কে দুআ হাত চেপে ধরলো রামিসার।রিসিপশনের টেবিলে সজোরে ঘুষি দিয়ে ইয়াদ চিল্লিয়ে উঠলো,
–“এই কটেজে গেস্টদের কোনো নিরাপত্তা নেই?টাকা খেয়ে অন্যর কথায় আমার রুমে টেবিলের নিচে মাইক্রোফোন লাগাচ্ছিল এই বাস্টার্ড।এতো ভালো মানের কটেজ হাউজে এইসব চলে তাহলে!আপনাদের কটেজ বন্ধ করার প্রস্তুতি নিন।”
–“স্যার,সরি স্যার।”
ফায়াজ ভীত।মেঝেতে পড়ে থাকা স্টাফ নিজেকে সামলে উঠে হাত জোড় করলো ইয়াদের সম্মুখে,
–“আমি দোষী।আমাকে শাস্তি দিন।জামাল স্যারের নির্দেশে আমি এইকাজ করেছি।আমাকে মাফ করে দিন।”
–“মাইক্রোফোন লাগাতে বলেছে তা করেছেন।যদি খুন করতে বলতো?তাহলে কি তাই করতেন?ওহ মাই গড!এইখানে গেস্ট বিন্দুমাত্র নিরাপদ না।”
ইয়াদের গগণ ছোঁয়া রাগ।তার এই অবস্থা দেখে দুআ বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে ইয়াদের পানে চেয়ে আছে।লোকটার চোখ দুটি ভয়ংকর দেখাচ্ছে।খুব কষ্টে যেনো নিজেকে হাতাহাতি থেকে বিরত রেখেছে লোকটা।
–“না না, স্যার এইসব কিছুই না।আমাকে মাফ করবেন!”
স্টাফের করুণ আবেদন।
–“স্যার সত্যি আমি দুঃখিত।”
ফারাজ বললো।
–“এতোই যখন আপনি দুঃখিত ম্যানেজার,তাহলে এই ছেলেকে বিদায় করুন এক্ষুনি,আমার চোখের সামনে।চাকরিচ্যুত হলে একটা শিক্ষা হবে ছেলেটার।এরপর তার অন্তর কাঁপবে ভবিষ্যতে টাকা খেয়ে অন্যের ক্ষতি করার পূর্বে।”
ইয়াদ রিসিপশনের টেবিলে ঝুঁকে বললো।
স্টাফ ছেলেটা আকুতি করে ইয়াদের হাত ধরতে এলে ইয়াদ হাত সরিয়ে দেয়।কিন্তু দুআ ভাবলো ইয়াদ ছেলেটার গায়ে হাত তুলছে।তাই সে মুখে হাত দিয়ে বলে উঠলো,
–“আল্লাহ্!”
ইয়াদ থমকে গেলো।চিরচেনা স্বরের উপস্থিতি আন্দাজ করে পাশে ফিরতেই দেখলো দুআ রামিসা দাঁড়িয়ে আছে।দুআর চেহারা ভীত,রামিসা চিন্তিত।ইয়াদের মেজাজ যেনো পূর্বের চেয়ে আরো বেশি খারাপ হলো।দুআর সামনে নিজের এই রূপ প্রকাশ করার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি সে। ভ্রু কুঁচকে ইয়াদ রামিসার সামনে এসে দাঁড়ালো,
–“এইখানে কি?আমার কটেজে না গিয়ে এইখানে কি?”
ইয়াদের সজোরে করা প্রশ্নে ভীত দুআর আঁখিতে পানি ছলছল করছে।
–“এইখানের কটেজে কিছু নিয়ম থাকে ভাইয়া।গেস্টদের সাথে সরাসরি দেখা করা যায় না।তাই!”
–“কটেজে চল।”
ইয়াদের দৃষ্টি দুআর পানে।মেয়েটার ভীত আঁখিতে পানির উপস্থিতি টের পেয়ে ইয়াদ আর কথা বাড়ালো না।ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়লো রিসিপশন থেকে।রামিসা দুআর হাত চেপে ইয়াদের পিছু হাঁটছে।
দুআ নিজেকে সামলে রামিসাকে বলে উঠলো,
–“বাসায় ফিরে যায়,চল!আমাদের কাজ শেষ এইখানে।”
–“ইয়াদ ভাই কি বললো শুনতে পাসনি?আমি এখন তার সামনে কিছু বলতে পারবো না।”
–“কিন্তু,আমার উনাকে ভয় করছে।”
ইয়াদের পায়ের গতি থামলো।দুআর ফিসফিস কথাটাও কিভাবে যেনো ইয়াদের কর্ণধারে প্রবেশ করেছে।ইয়াদের থেমে যাওয়া গতি দেখে রামিসা দুআ দুইজনই থামালো নিজেদের গতি।
দুআ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ইয়াদের দিকে তাকালে ইয়াদের থমথমে কণ্ঠের বহিঃপ্রকাশ হলো,
–“আমাকে ভয় লাগছে?কেনো?আমি কি কোনো হিংস্র প্রাণী?”
দুআ কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।এই মানবটাকে দেখে কখনো তার মনে এতো ভয় কাজ করেনি।কিন্তু আজ তার রাগ কিছুতেই যেনো হজম হচ্ছে না দুআর।দুআ এটাও বুঝতে পারছে লোকটার রাগ করাটা স্বাভাবিক।নিজের কটেজে এইভাবে অপর মানুষের আগমন সাথে নজরে রাখা এইসব কিছু কেউই মেনে নিবে না কখনো।দুআর তো এইসবে কোনো অভিযোগ নেই।দুআ শুধু এখন চিন্তিত,ভীত একমাত্র ইয়াদের রাগ দেখে।
–“কিছুই না ভাইয়া।দুআ ভয় পাচ্ছে না।”
–“ওর মুখেই শুনি!তারপর বিশ্বাস করবো।”
দুআর নিচু দৃষ্টি।নিজেকে সামলে সেই লম্বা মানবের দিকে নজর দিলেই দেখলো লোকটার দৃষ্টি ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে।অর্থাৎ মানবতার রাগ কমছে এখন।
–“আসল..আসলে আপনাকে এইভাবে রাগতে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয়েছি।”
দুআ ইতস্তত করে জবাব দিলো।
–“আমার রেগে যাওয়াটা কি স্বাভাবিক না?আমার রুমের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে কেউ চুরি করে আমার রুমে ঢুকে আমার জন্যেই ফাঁদ পাতছিলো আর আমি রেগে যাবো না!”
দুআ উপর নিচ মাথা নাড়ালো। যার অর্থ,হ্যাঁ।
খানিক দূরে ইয়াসিরের এইদিকে আগমন দেখে রামিসা দুআকে রেখে ইয়াসিরের দিকে এগিয়ে গেলো নিভৃতে।কারণ,ইয়াসির এইখানে এলে ইয়াদ পুনরায় সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে নিজের রাগেরই বহিঃপ্রকাশ করবে।যার দরুণ, আগেই সবটা জানিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে রামিসা গেলো ইয়াসিরের পানে।
দুআ রামিসার চলে যাওয়া দেখে ভরকে গেলো খানিকটা।
–“তুমি ঠিক কেনো বলেছো তোমার ভয় লাগছে আমাকে?”
ইয়াদ এইবার নিজের সুর কিয়ৎ নরম করলো।
–“আম…আমি আপনার রাগ এবং তীব্র স্বর শুনে ভয় পেয়েছি।আর কিছুই না।”
ইয়াদ হেসে ফেললো।আজ তার রাগের পরিমাণ হাজারগুণ হলেও সেটার বহিঃপ্রকাশ করেনি ভালো করে।কারণ এটা পাবলিক প্লেস,যেকোনো ভাবে খবর লিক হলে তার খেলার উপর প্রভাব পড়তো।তাই যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখেছিল ইয়াদ।ইয়াদের বাস্তবিক রাগ দেখলে দুআকে হয়তো আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না।
এইদিকে দুআ এলোমেলো চুলের লম্বা মানবকে দেখছে।রাগী চেহারাটা কোথায় যেনো মিলিয়ে গেলো লোকটার।ঘন চুলে আঙ্গুলের সাহায্যে ব্যাকব্রাশ করে ইয়াদ নির্বিঘ্নে বলে উঠলো,
–“সত্যিকারে আমার রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখলে হয়তো জ্ঞান হারাবে তুমি!তবে ভয় পেও না।আমি তোমার সাথে রাগ দেখাবো না কখনোই।”
দুআ চমকে উঠলেও ইয়াদের হাসির অনুকরণ করে নিজেও হেসে ফেললো।
–“কটেজে আসো।একসাথে নাস্তা করবো।”
–“নাহ।চলে যাবো।”
দুআ ছোট স্বরে বললো।
–“তোমাদের না খেয়ে পাঠিয়ে দিলে আমার আম্মি বকবে। আম্মি কিন্তু আমার খবর রাখে সবসময় আমার বন্ধুদের সাহায্যে।তোমরা এইখানে দেখা করতে এসেছো, এটা জানলে আমার আম্মি অনেক খুশি হবে।”
ইয়াদ হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিলো।
দুআ কটেজের বারান্দায় ইয়াসির এবং রামিসা দুজনকেই দেখতে পাচ্ছে।তাদের দিকে দৃষ্টি জ্ঞাপন করে দুআ ইয়াদের পাশাপাশি হাঁটছে দ্বিধামাখা মনে।এই খেলোয়াড়ের কথাবার্তা, চালচলন,ব্যবহার সবটাই দুআর মনে তার জন্যে ভাবনার সৃষ্টি করে নিভৃতে।দৃষ্টি উপরে তুলে খেলোয়াড়কে দেখার চেষ্টা করলো সে। খরশান চোয়ালটা রোদে বড্ড উজ্জ্বল দেখাচ্ছে মানবটার।সামনে দৃষ্টি দিতে হঠাৎই তার কানে ভেসে এলো ইয়াদের বুলি,
–“ভীত চেহারার চেয়ে হাস্যোজ্বল চেহারা বেশি মানায় তোমাকে।তোমার হাসি নির্দ্বিধায় পবিত্র আর স্নেহময়।”
দুআর মাথা ভনভন করে উঠলো।এই লোকটা দুআর এমন বর্ণনা দিয়ে কি বুঝাতে চায়?দুআ সবসময় ভীতু হয়ে থাকে,এটাই কি বুঝিয়েছে ইয়াদ তাকে!
তবে এইসব ভাবনা বাদ দিয়ে,দুআ নিজেই ভাবতে আরম্ভ করলো,
–“আপনাকেও রাগী চেহারা থেকে হাস্যোজ্বল চেহারায় সবচেয়ে বেশি মানায়।”
কিন্তু, আফসোস ইয়াদের লাহান সরল ভাষায় দুআ মনের কথা মুখে আনতে পারলো না।বরং ইয়াদকে নিয়ে নিজের এমন ভাবনায় নিজেই লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলো।মনে মনে দরুদ পাঠ করা আরম্ভ করলো দুআ।তার মনটা আজকাল অন্যদিকে চলে যাচ্ছে যেনো!
চলবে…..