#আমার_চন্দ্রাবতী
লেখিকা- সালসাবিল সারা
৩২+৩৩)
দুআ হাসপাতালে।মাইশার লেবার পেইনের কারণে কাকীমা এবং রিজোয়ানের সমেত হাসপাতালে এসেছে সে।যদিও দুআর নিজের শরীর ভালো নেই, তাও সে মাইশার এমন দুর্দিনে;নিজের ভালো খারাপ লক্ষ্য না করেই ছুটে এসেছে সকলের সাথে।মাইশা কাদঁছে প্রচুর।দুআর ভেতরকার অস্থিরতা বাড়লো হঠাৎ।দিন কয়েক পূর্ব হতেই তার ভেতরকার এমন অস্থিরতা তাকে গ্রাস করেছে।খানায় অনিয়ম,অতিরিক্ত তন্দ্রাসক্ত,ক্লান্ত শরীর,অসময়ে বমি এইসবের কারণে টলছে তার শরীর।
এই যে আজও,সকালে একটা রুটি কোনমতে তার পেটে পড়েছে আর অল্পটুকু পানি,ব্যস।এখন মেয়েটাকে খিদে জেঁকে ধরেছে।মাথাটাও ভারী।অপারেশন রুমে নেওয়া হয়েছে মাইশাকে।দ্রুত ডেলিভারির কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন তার। দুআর নিকট রিজোয়ান এবং কাকীমা বসে।কপালে জমে থাকা ঘামটুকু বারংবার মুচছে রিজোয়ান।ছেলেটা বড্ড চিন্তিত।
ভাইয়ের এমন মলিন মুখশ্রী দুআর সহ্য হচ্ছে না।ভাইকে
ভরসা দেওয়ার চেষ্টায় মেয়েটা ভাইয়ের হাতে হাত রেখে শুধালো,
–“সব ঠিক হবে ভাইয়া,চিন্তা করো না।”
–“ঠিক হতেই যে হবে,চাঁদ।আল্লাহ্ ভরসা।”
দুআ হাসার চেষ্টা করলো কেবল।অন্যরকম অস্থিরতায় তার তনু বড্ড ক্লান্ত।
ইয়াদের কথাটাও বেশ মনে পড়ছে তার।ছেলেটা দু সপ্তাহ পূর্বে এসেছিলো,আর আসেনি।জিয়ার বিয়ের তোড়জোড় চলছে।শুনলো,ক্রিকেট জগতেরই একজনের সাথে জিয়ার পরিণয়।একমাত্র ছেলে হওয়ার দরুণ,সবটা ইয়াদের সামলাতে হয়।সেদিনও মেয়েটা ছেলেটার বুক ভাসিয়ে বমি করেছিল তবে ডাক্তার দেখায়নি দুআ। ফুড পয়জনিং বলে ব্যাপারটা চেপে গিয়েছিল।তবে এখন সেই বমির পরিমাণ বেড়েছে,সাথে বেড়েছে অস্থিরতা।
দুআর আন্দাজ হয় কিছুর, তবে ভয়ে মুখ ফুটিয়ে বলছে না এক অক্ষর।পরিকল্পনা অনুযায়ী ইয়াদ এবং দুআর রিসেপশনের সময়কাল এখনো কয়েকমাস বাকি।এর পূর্বে দুআর এমন শরীর খারাপ,কে কিভাবে গ্রহণ করবে আয়ত্বে এলো না মেয়েটার।দুশ্চিন্তা হয় তার।দিন রাত,এই ব্যাপারটা নিয়েই মেয়েটা ভেবে যাচ্ছে।অথচ কেউ বুঝতেই পারছে না কিছু।মেয়েটা বুঝতেই দিচ্ছে না।
ইয়াদ রোজ ফোন করে।মেয়েটার চোখের নিচের দাগটাও তার নজর এড়িয়ে যায় না।তবে, পরীক্ষার কারণে পড়ালেখার চাপে এই বিষয়টা তেমন আমলে নেয় না ইয়াদ।পড়ালেখা সকলের জন্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।নির্দিষ্ট সময়ে আজও ইয়াদের ফোন এলো মেয়েটার মুঠোফোনে।চমকিত দুআ মুঠোফোন নিয়ে আড়ালে গেলো।সকলের সামনে লোকটার সহিত কথা বলতে তার বাঁধে।
ফোন রিসিভ হতেই দুআর দুর্বল কণ্ঠস্বর প্রবেশ করলো মানবের কর্ণ গহ্বরে,
–“বলুন।”
–“হুয়াট হ্যাপেন্ড,চন্দ্র?ভয়েস এমন শোনাচ্ছে কেনো?”
ইয়াদ বিচলিত।
–“আমি হাসপাতালে এসেছি,মাইশা আপু ওটিতে।”
–“মাইশার কথা বুঝলাম,তোমার স্বর এমন কেনো?কি হয়েছে?”
ইয়াদের কণ্ঠে অস্থিরতা।
–“কিছু হয়নি তো।আমি ঠিক..”
খানিক থেমে মেয়েটা পুনরায় বললো,
–“আমি ঠিক আছি।চিন্তা করবেন না।কবে আসবেন?”
–“তোমার কণ্ঠ যথেষ্ট দূর্বল শোনাচ্ছে।কান্নাকাটি করে এমন হাল করোনি তো?”
ছেলেটা আবারও প্রশ্ন করলো।
ইয়াদের বুলির পরপর মেয়েটার মাথায় চক্কর দিলো।খালিপেটে এইখানে ছুটেছিল মেয়েটা।এতো সময় পেটে কিছু না পড়ার দরুণ মেয়েটার অবস্থা পুনরায় সংকীর্ণ হয়।টলতে আরম্ভ করলো সে।ইয়াদ বিনা বিরতিতে প্রেয়সীকে নানান ফয়সালা শোনাচ্ছে।অথচ মেয়েটা তার ঝাপসা দৃষ্টিতে নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত। দূর্বল হাতের বাঁধন হতে নুইয়ে পড়লো মুঠোফোন।পরপর ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো দুআ।বসা অবস্থায় ফ্লোরে পড়াতে তেমন আঘাত পায়নি সে। তবে, তার এমন অবস্থায় আশে পাশের মানুষজন চিল্লাচিল্লি করলে দৌড়ে আসে রিজোয়ান এবং কাকীমা। তাদের মেয়েটা এইখানেই এসেছিল।
দুআকে নিচে শায়িত অবস্থায় দেখে কাকীমা চিৎকার করলো।সেই চিৎকারে ইয়াদের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল ঘামটুকু বহমান।থরথর কাঁপছে অধর যুগল। কি হলো তার প্রেয়সীর?
থেমে থেমে ছেলেটা “দুআ” নাম বলে হাঁক ছাড়ছে। উত্তর আসছে না কোনো।ফোন কে’টে রিজোয়ানকে ফোন লাগানোর উদ্যোগ নেওয়ার পূর্বেই রিজোয়ান দুআর ফোন হতে উত্তর দিলো,
–“ইয়াদ?”
–“ভাইয়া,চন্দ্রের কি হলো?এই মিনিট তিনেক আগেও আমার সাথে কথা বলছিলো।”
ইয়াদ অস্থির।
–“জানিনা ইয়াদ।সেন্সলেস ও।ডক্টর দেখছে।চিন্তা করো না।হয়তো স্ট্রেসের কারণেই এমনটা হয়েছে।”
রিজোয়ান শান্ত ভঙ্গিতে বললো।
–“আমি বিকালের টিকিট কে’টে আসছি।ততক্ষণ একটু দেখে রাখবেন দুআকে।”
ইয়াদ পরপর উঠে দাঁড়ালো।
–“আচ্ছা আসো তুমি।”
রিজোয়ান তার বক্তব্য শেষ করলো।
ইয়াদ মুঠোফোন প্যান্টের পকেটে পুরে দ্রুত বেরুলো কক্ষ হতে।নিচে জিয়ার বাগদানের অনুষ্ঠানের সকল কিছুর ছড়াছড়ি।আত্মীয় স্বজনের অনেকেই এইখানে উপস্থিত।প্রথমত, দাঁড়ানো অবস্থায় সে অনলাইনে টিকিট বুক করলো চট্টগ্রামের যাত্রায়।ইয়াদকে দেখে অনেকে মিটিমিটি হাসছে।ইয়াদ সেথায় নজর দিলো না।অক্ষি গোলক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মা-বোনের সন্ধান পেলো রান্নাঘরে।সেথায় রামিসা এবং তার মায়ের উপস্থিতিও লক্ষণীয়।
–“আম্মি,আমি বিকালে চট্টগ্রাম যাচ্ছি।”
–“রাতে যাওয়ার কথা ছিলো,আব্বা।”
মায়ের কথায় ইয়াদ পুনরায় শুধালো,
–“দুআ অসুস্থ। মাইশাকে নিয়ে সকলে হাসপাতালে ছিলো।তখন সেন্সলেস হয়েছে মেয়েটা।”
–“হায় আল্লাহ্!কি হলো মেয়েটার?মাইশা কেমন আছে?”
–“মাইশা আপু ওটিতে,মামী।কিন্তু,দুআর কি হলো?”
বড্ড চিন্তিত রামিসা।
–“জানিনা,রামু। আম্মি,তুমি এদিকটা সব সামলিয়ে নাও।আমি কাল ফিরে আসবো দুআর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে।”
ইয়াদ রান্নাঘর হতে বেরুতে নিলে ডালিয়া থামালো তাকে,
–“দরকার নেই।মেয়েটা অসুস্থ কয়েকদিন থেকে আসো।একেবারে অনুষ্ঠানের দিন মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে আসবে।”
–“আচ্ছা।”
ইয়াদ প্রস্থান করলো।রান্নাঘরে উপস্থিত সকলের চেহারা বেজার।মনে মনে একটাই দোয়া করছে,দুই মেয়ে যেনো একেবারে সুস্থ থাকে।
‘
হতবিহ্বল দুআ।আঁখিতে পানি টুইটুম্বর। আহেলী নিষ্পলক মেয়ের পানে চেয়ে।দুআর মা হওয়ার খবর ইতোমধ্যে তিনজন জেনেছে। কাকীমা আহেলীকে দমিয়ে রাখলেন।মেয়ের এমন সুসংবাদ শুনেও জমিদারের কথা ভেবে আহত হচ্ছেন উনি।তার মেয়েটা ছোট, তবে ইয়াদ তো ছোট নয়!তার সকল জিদ মেনে নিলেও, জমিদারের একটা অনুরোধ কি ছেলেটার মেনে নেওয়া খুবই কঠিন ছিল?জমিদার এই ব্যাপারে শুনলে নিশ্চিত তুলকালাম বাঁধিয়ে দিবেন? আহেলী বড্ড চিন্তিত সাথে খুশিও।এহেন সময়ে এই খুশি প্রকাশ করতে পারছে না শুধু।
দুআ মাথা ঝুঁকিয়ে অশ্রু বিসর্জন করছে।মায়ের এমন অভিব্যক্তি দেখে ইয়াদের ব্যাপারে ভাবতেই তার রুহ কাঁপছে।দোষটা তার মা ইয়াদকে দিলেও,সত্যিকারের দোষ তার নিজেরই।জেনে শুনে মেয়েটার খামখেয়ালী পনায় ঔষধে হেলফেলের ফলাফল আজকের এই দিন।মায়ের রাগান্বিত চেহারার পানে আরেক নজর চেয়ে দুআ ক্ষীণ কণ্ঠে আওড়ালো,
–“দোষ আমার আম্মা,উনার না।”
–“চুপ একদম।তোর বাপ শুনলে কষ্ট পাবেন না, বল?”
আহেলীর কণ্ঠ তেজী।
–“উনি আমাকে সব ঔষধ বুঝিয়ে খাওয়ান।আমার খামখেয়ালীর কারণে এমনটা হয়েছে।”
আহেলী কটমট করে তাকায়।
–“এই ছোট বউ,তুই এমন করছিস কেনো মেয়েকে?মেয়েটা তো বাচ্চা না।আর না ইয়াদ বাচ্চা! তাদের ব্যাপার তারাই বুঝবে।বাদ বাকি,ইদ্রিস বুঝে নিবে সবটা।তোকে আর নাটক করতে হবে না।”
আহেলী দমলো কাকীর কথায়।
তবে দুআ থেমে নেই।ইয়াদের অভিব্যক্তি সম্পর্কে দুআ স্পষ্ট ধারণা করতে পারছে।লোকটা হয়তো আর কথা বলবে না তার সহিত।
ওড়নার কিনারে চোখ মুছলো মেয়েটা।
ইয়াদের সাথে কথা বলেনি দুআ।মোবাইল সুইচড অফ করেছে সে।ভয়ে তার হাত পা অসাড়।ঘড়ির কাঁ’টায় রাত আটটা।ইয়াদ বিকালে আসবে বলেও এখনো কেনো এলো না এই নিয়েও তার ব্যাপক সংশয়।বাড়ির সকলকে দুআর ব্যাপারে ইয়াদকে কিছু জানাতে নিষেধ করেছে দুআ।অগত্য মেয়েটা নিজেও জানেনা,ইয়াদের খবরাখবর।
আপাতত সে ইয়াদের ভয়ে।মেয়েটা ছেলেটার অভিব্যক্তির ব্যাপারে একেবারে বেখবর।
_____
পানির পিপাসায় কক্ষ হতে বেরুলো দুআ। সিঁড়ির কাছাকাছি যেতেই তার দৃষ্টিতে ইয়াদের অবয়ব ভেসে এলো। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে আহেলীর সমেত কথা বলছে সে।মুখে এখনো মাস্ক লাগানো।দুআ পা ঘুরালো।রুমে গিয়ে থামলো পা জোড়া।শ্বাস প্রশ্বাস বাড়লো তার। পেটে হাতের আস্তরণ স্পর্শ করলে মেয়েটার নেত্রযুগল পুনরায় ভিজে আসে।একটু পরে হয়তো,ইয়াদের কঠিন বাক্যের শি’কার হবে সে?
দরজার নব ঘুরিয়ে ইয়াদ রুমে প্রবেশ করলো।মনটা তার প্রশান্তিতে ভরপুর।আহেলী মাইশার ছেলে সন্তান জন্মদানের কথা বললেও দুআর ব্যাপারটা তার থেকেই জানতে বললো।বিনা বাক্যে ইয়াদ রুমে আসলেও, সফেদ আভায় আলোকিত কক্ষে কাঙ্খিত মানুষটির ছায়া নেই।ইয়াদ ব্যালকনিতে ঢু মারলেও মানবীর দেখা পেলো না।বাথরুমের পানে দৃষ্টি জ্ঞাপন করতেই বুঝলো মেয়েটা সেথায়।ব্যাগ রেখে আরাম কেদারায় বসলো ইয়াদ।
বেশ সময় পার হলে ইয়াদ বাথরুমের সম্মুখে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো,
–“দুআ?”
মেয়েটা নিশ্চুপ। ফোঁপানির শব্দ ইয়াদের কানে স্পষ্ট।বুক ভার হলো ছেলেটার,
–“দরজা খুলো,দুআ।কাদঁছো কেনো?”
নিজেকে ধাতস্থ করার বৃথা চেষ্টা করে মুখে পানি ছিটালো সে।রক্তিম নাক,আঁখি কিছুতেই ঘুচছে না।ইয়াদ বুঝে যাবে সবটা।কিন্তু,কিছু করার নেই।ইয়াদের কণ্ঠ গম্ভীর হচ্ছে সাথে তার দরজা ধাক্কানোর শব্দের বেগ হচ্ছে জোরালো।
দুআ দরজা খুললো ভয়ে।ইয়াদ সন্দেহের দৃষ্টিতে তার পানে চেয়ে। তাওয়াল সমেত মুখের পানি মুছে দিলো তার।মেয়েটার নজর এখনো ঝুঁকে।হাঁটু গেড়ে প্রেয়সীর সম্মুখে বসতেই মেয়েটা কিঞ্চিৎ নড়লো।ইয়াদ দুআর হাতের মুঠোয় নিজের হাত গুঁজলো,
–“এতো কান্নাকাটি কি উপলক্ষে?ডাক্তার কি বলেছে?সিরিয়াস কিছু হলে,বাসার সকলে এমন শান্ত থাকতো না।কি হয়েছে আমার চন্দ্রের?”
কান্নার বেগ পুনরায় বাড়ালো মেয়েটা।ইয়াদ বুকে টানলো তার প্রিয়তমাকে।মাথায় এক হাত রেখে অপর হাতে পিঠের উপরিভাগ ধীরে বুলিয়ে দিচ্ছে ইয়াদ।
দুআ আঁকড়ে ধরলো ছেলেটার জ্যাকেট।মাথায় অধর স্পর্শের আভা পেলে মেয়েটা কিঞ্চিৎ শান্ত হলো।
–“এইবার বলো।কি হয়েছে?”
–“বক..বেন।”
–“কেনো বকবো?অসুস্থ বউকে আমি কেনো বকবো?”
ইয়াদ তীব্র হাসলো।
–“সবাই বকেছে।”
ব্যাপারটা এইবার ইয়াদের নিকট ভালো ঠেকলো না।সে বুঝলো না আসল কাহিনী।দুআর চোখের পানি পুছে প্রশ্ন করলো,
–“অসুস্থ মেয়েকে বাসার মানুষ বকেছে?বিশ্বাস হয় না তো।”
–“বকবেন না প্লিজ।”
মেয়েটার করুণ আকুতি।
–“আচ্ছা, বকবো না।বলো।চিন্তা হচ্ছে রে চন্দ্র।”
–“আমি প্রেগন্যান্ট,ইয়াদ।”
কানজোড়া উষ্ণতা লাভ করলো।ইয়াদ থমকে আছে।কথাটা যেনো অবিশ্বাস্য ঠেকছে তার নিকট।চোখের রঙের পরিবর্তন হলো নিমিষেই,
–“কি?”
দুআ ইয়াদ হতে ছিটকে গেলো।বিছানায় জুবুথুবু হয়ে বসলো সে।এইবার শব্দ করে কাঁদছে মেয়েটা।
–“সরি।অনেক বেশি সরি।আমার জন্যেই সবটা হয়েছে।সবাই আমাকে বকেছে।আপনিও বকুন।আমার বাচ্চাটাকে কেউ পছন্দ করছে না।আমার দোষ সব,ওর তো দোষ নেই।আব্বা শুনলে নাকি রাগ করবে।আমি আব্বার মেয়ে,তাই আব্বার চিন্তা হচ্ছে,মায়ের চিন্তা হচ্ছে।আমার পেটে যে আছে,সেও তো আমার।ওর জন্যে কি আমার চিন্তা হচ্ছে না।আমার বাচ্চাটাকে কেউ মা’রতে বলবেন না,প্লিজ।আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে, ইয়াদ।”
ইয়াদের তনু কাঁপছে।মেয়েটা ইয়াদকে এতো নিকৃষ্ট ভাবে!বাচ্চাটা তো তারও,দুআর একা না।মেয়েটা কিভাবে এতো বাজে চিন্তা করলো?অসময়ে এই খবর এলেও,ভ্রূণ হ’ত্যার মতো পাপ ইয়াদ করবে?এতটা গুনাহগার সে?
–“পাগল হলে দুআ?আমাকে নিকৃষ্ট পাপী মনে হয়?নিজ বাচ্চা নিজেই খু’ন করবো?তুমি বাচ্চাটার মা হলে,আমি তার বাবা।ভুলে গেলে সেটা?তোমার বাসায় কি বলেছে?আমার বাচ্চাটাকে মা’রতে বলেছে?”
ইয়াদের কণ্ঠ কাঁপছে রাগের কারণে।
–“নাহ!কেউ বলেনি।যদি বলে?আমি ম’রে যাবো,
ইয়াদ।”
দুআ গায়ের চাদর শক্ত করে ধরলো।
–“নিচে আসো।ফাস্ট।”
–“নাহ।আব্বা আছে।এইসব শুনলে বেশ রাগ করবে।”
দুআ বড্ড ভীত।
–“আমার বউ আমার বাচ্চা।সিদ্ধান্ত সব আমারই হবে।না তোমার না তোমার বাড়ির।কথা কম,নিচে আসো।”
দুআ ইয়াদের জ্যাকেট টেনে ধরলো,
–“বাচ্চাটাকে রাখবেন তো?”
ইয়াদ গাল চেপে ধরলো তীব্র রাগে,
–“আমাকে অমানুষ মনে হয়?এটা আমার বাচ্চা।ভুল হোক আর যায় হোক,আমারই তো।তুমি এতটা বাজে ভাবো আমাকে?”
দুআ অসহায় ভঙ্গিতে তার নিকট চেয়ে রইলো।
লোকটার মুখটা আনন্দিত না,থমথমে।হয়তো দুআর কথায় মনে আঘা’ত পেয়েছে মানুষটা!
–“সরি।আমি অনেক ভয়…”
ইয়াদ শুনলো না দুআর কথা। হাত টেনে তাকে নিয়ে নিচে ছুটছে।
বসার ঘরে সকলে উপস্থিত।ইদ্রিস জমিদার কয়েকবার শুধালো তাকে বসার জন্যে।কিন্তু, ইয়াদ অনড়।বেশ গম্ভীর মুখে সে ইদ্রিস জমিদারের নিকট ব্যক্ত করলো,
–“দুআকে নিয়ে ঢাকায় ফিরতে চাই।আপুর বিয়ের বেশি দেরী নেই।পরশু বাগদান হবে,বৃহস্পতিবার হলুদ,শুক্রবার বিয়ে।দুআ এবং আমার রিসিপশন আমি দ্রুত শেষ করতে চাই।ধরুন,এই মাসের শেষে?”
ইদ্রিস জমিদার চ’টে গেলো যেনো।গমগমে চোখে ইয়াদের দিকে তাকাতেই দুআ ইয়াদের হাত খাম’চে ধরলো।
–“ইয়াদ,মাইয়্যারে বিয়া দিলাম তোমার কথায়।এহন এইসব কি?আমার কথার খেলাফ করা আমার পছন্দ না।”
বাবার কথায় দুআ ফিসফিসিয়ে ইয়াদকে বললো,
–“প্লিজ, চুপ করুন।”
–“দুআ,এখন একা নেই।আপনার মেয়ে যেমন আপনার কাছে দামী,তেমন আমার অনাগত অংশ আমার জন্যে দামী।এইসব নিয়ে আমি খোলামেলা কিছুই বলতে চাই না।সবটা আল্লাহ্ এর নির্ধারিত করা।”
ইয়াদের এমন সুশীল বাক্যে সকলের থমথমে চেহারায় হাস্যোজ্বল ভাব ফুটে উঠলো। ইদ্রিস জমিদার খুশি হলেন ঢের।ইয়াদ সবটা মেনে নিয়েছে এবং ইদ্রিস জমিদারের হাসিমুখ দেখে কাকীমা এবং আহেলীর বুক হতে পাথর সরল যেনো।
–“আলহামদুলিল্লাহ্।দুআর মা,আমারে জানাও নাই কেনো এইডা?জেনি? দারোয়ানরে ক মিষ্টি লইয়া আইতে।”
ইদ্রিস জমিদারের কথায় ছুট লাগালো জেনি।
–“জামাই,বইয়া কথা কও?”
–“নাহ আব্বা।একটু রেস্ট নিব।হঠাৎই ছুটে এসেছি,তাই টায়ার্ড।”
–“খাবার পাঠাচ্ছি রুমে।”
আহেলী কথাটা বলে উঠতে নিলে ইয়াদ হাত দেখিয়ে থামালো,
–“নাহ,একেবারে ঘুমানোর পরিকল্পনা করছি।আজ আর কিছুই খাওয়া যাবে না।”
ইয়াদ বাঁক ফিরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে।
দুআ নির্বাক।
ধীর পায়ে এগোতে নিলে তার মা ফিচেল কণ্ঠে বলে,
–“জামাই রাগ করছে।সব ঠিক করে খাওয়ার টেবিলে নিয়ে আসিস।জেনিকে ডাকতে পাঠাবো।”
–“আচ্ছা।”
দুআ মাথা নাড়িয়ে পায়ের গতি বাড়ালো।
দ্বিতীয় তলার সম্মুখে দাঁড়াতেই পা থমকে গেলো মেয়েটার।ইয়াদ ব্যাগ নিয়ে অন্য রুমে প্রবেশ করছে।ভ্রু কুঁচকে এলো দুআর,
–“এই,কই যাচ্ছেন?”
দুআর কণ্ঠ ইয়াদ শুনেও যেনো শুনলো না।
দুআ ইয়াদের পিছু পিছু ঘুরছে।ছেলেটা জ্যাকেট,
সোয়েটার সবটা খুলে রেখে উদোম শরীরে রুমে বিচরণ করছে লাপাত্তাহীন।গোসল নেওয়ার প্রস্তুতি তার।দুআকে এড়িয়ে চলছে সে আপাতত।
দুআ হাত চেপে ধরলো ইয়াদের,
–“কথা বলছেন না যে?”
–“হু?”
–“কি করেছি?সবটা তো আপনার ইচ্ছেই হচ্ছে।তাও এতো রাগ?”
দুআ ইয়াদের বক্ষদেশ জোর পূর্বক দখল করলো নিজে।
–“সরো।”
–“কেনো?”
দুআ মাথা তুললো।
–“এইসব ফেস বানিয়ে লাভ নেই।যে আমাকে মানুষ মনে করে না,তার জন্যে আমি কিছুই না।”
ইয়াদের কণ্ঠে রাগ স্পষ্ট।
–“বাবুর কথা শুনে একটুও কি খুশি হননি?”
–“উফ আল্লাহ্!এই তোমার মাথায় সোজা কথা ঢুকে না?”
ইয়াদ অবাক হয়ে বললো দুআর কথায়।
–“আপনি আপনার বাচ্চাকে একটুও আদর করলেন না।সব বুঝি আমি।”
দুআ ইয়াদের বক্ষদেশ হতে নিজেকে আলাদা করলো।
অভিমানী চেহারার প্রকোপ দেখিয়ে দুআ চলে যেতে নিলেই ইয়াদ দুআর চুল পেঁচিয়ে ধরলো,
–“শা’স্তি বাকি আছে তোমার।যাচ্ছো কই?”
–“ছাড়ুন।”
ইয়াদ নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো মেয়েটাকে।ভালোবাসাময় স্পর্শে অর্ধাঙ্গিনীর পেটে হাত রাখলো।মেয়েটার ললাটে অধর স্পর্শ করে হাঁটু মুড়ে তার সম্মুখে বসে পড়লো ইয়াদ,
–“বাবা,অপেক্ষায় রইলো চ্যাম্প। ভালোবাসি দুজনকে।অনেক অনেক বেশি।”
ইয়াদের অধর জোড়া সেথায় হামলে পড়লো বেশকিছু সময়ের জন্যে।দুআ ইয়াদের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সযত্নে।লোকটাকে খামোখা ভুল বুঝেছে সে।অথচ লোকটা কতো ব্যাকুল তাদের অনাগত সন্তানকে নিয়ে!তার বাবাকেও রাজি করে নিয়েছে ঢাকায় ফিরবে বলে।
ইয়াদ বাথরুমের দিকে যেতে নিলে দুআ তার সম্মুখে দাঁড়ায়,
–“রুমে আসুন।”
–“আমি রেগে।”
–“উফ,ছাড়ুন এইসব রাগ।আমার মাথা ব্যথা করছে।বাড়তি ঝামেলা করবেন না।”
ইয়াদ সন্তর্পনে চোখ বুলালো দুআর সত্তায়।মেয়েটাকে বড্ড আবেদনময়ী লাগছে।বাচ্চার কথা শোনার পর থেকে মেয়েটাকে আরো বেশি আকর্ষণীয় লাগছে ইয়াদের নিকট। এটা তার মোহঘোর,নাকি বাস্তব? আয়ত্তে এলো না তার।মাথা নিচু করে তার গলায় পরশ দিলো।দুআ হাসলো নির্বিঘ্নে।
–“রুমে যাবো এক শর্তে।”
দুআ ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো,”কি?”
ইয়াদের বাক্য দুআর কানে প্রবেশ করতেই মেয়েটা লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো।অথচ ছেলেটা লজ্জা পেলো না।বরং লজ্জামাখা মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলো
আস্টেপিস্টে,তীব্র আকাঙ্ক্ষায়।
………
তাদের নিকট এখন সবটাই সুন্দর।তবে নিয়তি কি তা চায়?
চলবে…..
কপি করা বারণ।