আমার চন্দ্রাবতী ১৬+১৭

0
794

#আমার_চন্দ্রাবতী
লেখিকা- সালসাবিল সারা

১৬+১৭)
–“ইয়াদ কি সত্যি আমাকে ভুলে গেলো?”
কল্পনাতীত মনে মুঠোতে নিবদ্ধ মোবাইলে দুআর স্থির দৃষ্টি।কাঙ্খিত মানুষটার ফোনের অপেক্ষা করছিল সে ইয়াদ গ্রাম ত্যাগ করার দিন থেকেই।কিন্তু আফসোস,
কাঙ্খিত সেই মানুষ থেকে ফোন আসেনি একটিবার।সারাটাদিন কলেজ আর ভাইয়ের বিয়ের টুকটাক প্রস্তুতিতে সে ব্যাপারটা ভুলে থাকলেও রাতের বেলায় ইয়াদের স্মৃতি দুআর পিছু ছাড়ে না।লোকটার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দুআ হৃদমাঝার থেকে মুছতে অক্ষম।অথচ মানবটা যখন গ্রামে ছিলো,তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতো, ঘোর দৃষ্টিতে দুআর পানে চেয়ে থাকতো,তখন দুআ লজ্জায় কুঁকড়ে উঠেছিল মাত্রই;কোনো ধরনের কথার উৎপত্তি হতে দিলো না সে।বর্তমানে সেই মানবের একটা ফোনের আশায় দুআ অস্থির।লোকটা গ্রামে অবস্থাকালীন তার কথাবার্তা আর বাচনভঙ্গির সাহায্যে দুআকে অস্থির করে তুলতো,তার অন্তরে অন্য অনুভূতির জানান দিতো।আর এখন সেই একই লোকটাই দুআর মনকে তারই জন্যে ভাবনার জগৎ সৃষ্টি করতে বাধ্য করলো।দুআ চিন্তিত, কিঞ্চিৎ আশাহীন।তার মন এই মুহূর্তে প্রশ্ন করছে দুটো।এক:দুআকে বলা ইয়াদের শেষ কথা কি শুধুই দুআর প্রতি ইয়াদের মোহ ছিলো?দুই:ইয়াদের কি কোনো বিপদ হয়েছে?যার কারণে সে দুআকে ফোন করছে না!

দুআ মত্ত গভীর ভাবনায়।ভেতরকার এক সত্তা বলছে,দুআর প্রতি ইয়াদের ভাবনার বহিঃপ্রকাশ একেবারে পবিত্র। এতে কোনো খাদ নেই।

হৃদয়ে চলাকালীন ঝড়ে দুআ নিজেকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।মস্তিষ্ক থেকে সব ভাবনা দূর করে সে মোবাইল বিছানায় ছুড়লো।ওড়না গলায় উপর সমানভাবে ছড়িয়ে দিয়ে রুম ত্যাগ করলো সে।ইয়াদের ব্যাপারটা আর ভাবতে চাইছে না আপাতত।লোকটাকে আদৌ বিশ্বাস করা ঠিক হবে কিনা,দুআ বুঝতে পারছে না।শহুরে মানুষ,তার উপর বড় মাপের খেলোয়াড়;আর এই মানুষটা নাকি দুআকে ফোন করবে!অসম্ভব।দুআর সব আশা নিরাশায় পরিণত হলো।বুকের মাঝে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করছে সে।লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো,সেই খেলোয়াড়ের ব্যাপারে কিছু ভাববে না।যদিও রামিসাকে জিজ্ঞাসা করলেই তার খবর পাওয়া যেতো,তবে দুআ নিজেকে বেড়াজালে রাখতেই পছন্দ করে। তাই সকল প্রশ্নে মনের মাঝে গুঁজে রেখে সেই প্রশ্নের দহনের উত্তাপ সহ্য করছে মেয়েটা।
বসার ঘরে উপস্থিত সকলে আলোচনায় মগ্ন।দুআর বাবা মাঝের বড় আকারের সোফায় পা তুলে রাজকীয় ভাব নিয়ে বসে আছে।তার মায়ের কোলে বিদ্যমান পানের কৌটা থেকে পান সাজাচ্ছে জেনি।রিজোয়ান এবং তার মা বেশ মনোযোগ দিয়ে ইদ্রিস জমিদারের কথায় মশগুল।দুআ ধীর গতিতে বসলো মায়ের পাশে।কথার আন্দাজে বুঝতে পারলো,আগামীকাল তারা মাইশাদের বাসায় যাবে বিয়ের তারিখ নির্ধারণের জন্যে।প্রধান আলোচনা শেষ হতেই দুআর দিকে দৃষ্টি জ্ঞাপন করলো ইদ্রিস।আলতো হেসে মেয়েকে তিনি বলে উঠলেন,
–“আম্মা,ভাইয়ার বিয়ার খবরে খুশি তো?”
দুআ মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো,
–“জ্বী,আব্বা।আমি কালকেও যাবো সেই বাড়িতে।”
–“আলবৎ যাবি।আমার একমাত্র বোন তুই।”
রিজোয়ান স্ফীত কণ্ঠে বললো।
–“ছোট মালকিনের বিয়াতে এই ঘর আরো বেশি মুখরিত হইবে।তখন আত্মীয় যে বাড়বো!”
জেনির কথায় মুখ কুঁচকে ফেললো ইদ্রিস,
–“আমার মাইয়্যার বিয়া এহন না। ঢের দেরী আছে।আমার মাইয়্যা আগে পইড়বো।”
ইদ্রিসের কথায় সম্মতি জানালো সকলেই।এতে দুআর মনটা স্বস্তিতে ভরে গেলো।এতো ভালো পরিবার কয়জনের ভাগ্যে জুটে!

আগামীকাল সেই বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মা, কাকীর সাথে মিলে ডালা সাজিয়ে নিচ্ছে দুআ।রঙিন ফিতা,রঙিন পেপার সবটা দিয়ে সুন্দর করে ডালা সাজিয়ে ফেলছে মেয়েটা।আর অতীব দামী জিনিসপত্র সব সেখানেই সন্তপর্নে রাখছে আহেলী।দুআর কাকী বসে বসে নির্দেশনা দিচ্ছে মাত্রই।
দুআ কাজ করার সময় কামিজের লম্বা হাতাটা তাকে বড্ড জ্বালাতন করছে। অতঃপর নির্দ্বিধায় সে হাতের কাপড় উঠিয়ে কনুই পর্যন্ত তুললো। শুভ্র হাতখানায় ছোপ ছোপ ডোরাকাটা দাগ।দুআ যতটা এইসব দাগকে কলঙ্ক ভাবে,বাস্তবে তা একেবারে অসত্য।দুআর সম্পূর্ণ ধ্যান ডালা সাজানোতে

–“দুআ মালকিন,আপনার হাত খানা কি সুন্দর লাইগতাছে!”
দুআ হাসলো জেনির কথায়।
–“তাই?কই আমি তো সুন্দরের কিছু দেখছি না!”
দুআর ধারে নিজের অবস্থান ঠিক করলো জেনি,
–“আপনি হাত ঢাইকা রাখেন কেন?আমার এই হাত দেহেন আর আপনার হাত দেহেন।আমার হাতে কেমন লোম, গা’র রং পরিষ্কার হইলেও আপনার হাতের পাশে আমার হাতটা কেমন দেহাচ্ছে!আপনি হুদাই গরম আবহাওয়া থাকলেও এইসব পড়েন।”
–“ধুর,কি যে বলো।আমার লম্বা হাতা ভালো লাগে।ধরণীতে কেউ তোমার মতো সহজ সরল ভাবে না।”
দুআর দীর্ঘশ্বাস।
–“আপনি ডাক্তার দেহান না কেন?এতো যদি আপনার আফসোস থাহে?”
–“এই মাইয়্যা,বেশি কথা বলছিস।আমার মেয়েকে আমরা কম ডাক্তার দেখায়নি,বুঝেছিস!এটা যাবে না দুআর শরীর থেকে।”
কাকীর কথায় জেনি চুপ মেরে গেলো।সে তো এমনিতেই ভাবছিলো দুআর কথা।

কাকীমা কাজে ব্যস্ত হতেই জেনি পুনরায় দুআর কানে ফিসফিস করে বলতে আরম্ভ করলো,
–“মালকিন,আপনি সত্যিই অপরূপা।আপনার এইসব দাগ দেইখাও আমার আপনাকে সবচেয়ে বেশি অপরূপ মনে হইতাছে।আল্লাহ্ যেনো এক শিল্প দিয়া বানাইছে আপনারে।আপনার শুয়ামি বেশ ভাইগ্যবান হইবো।আপনার মতো চন্দ্রাবতীরে যে পাইবো।চাঁদের গায়ে যেমন দাগ,তাও সে সুন্দর।তেমনি আপনিও একই।এক্কেরে চাঁদের লাহান।”
দুআ স্থব্ধ।এক পর্যায়ে হুঁ হুঁ করে হেসে উঠলো সে ।তার রূপের এমন বর্ণনা আজ পর্যন্ত কেউ দেয়নি।দুআ মুখে হাত চাপলো,
–“তুমি ভারী মজার।আমার জীবনে কোনো পুরুষ আসবে না।কারণ কি জানো?এইযে তারা আমার সুন্দর মুখ দেখেই পটে যাবে,কিন্তু গায়ের দাগ দেখে পালাবে।তাই আমার এইসবে কোনো চাহিদা নেই।”
জেনি দুআর ফিসফিস কথায় কানে আঙ্গুল দিয়ে অল্প চুলকিয়ে পুনরায় বলে উঠলো,
–“হায়রে,মালকিন বলে কি?আসল ভালোবাসা আইসবো আপনার জীবনে।এই গরীব মাইয়্যা দোয়া করলো আপনার জন্যে। দেইখবেন,সে আপনাকে খুদ নিজের থাইকাই বেশি ভালোবাসবো। আমীন!”
জেনির হুংকারে তিনজনই তাকালো তার পানে।দুআ হেসে কুটিকুটি আর বাকি দুই মহিলা আচ্ছামত বকছে জেনিকে।জেনির মুখে যেনো আজ খই ফুটেছে।তবে বিধাতা যেনো জেনির এই কথা সাদরে গ্রহণ করে, এমনটাই প্রত্যাশা করলো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রিজোয়ান।বোনের জীবনে যেনো চিরসুখ চারিদিক থেকে মুড়িয়ে আসে,রিজোয়ানের প্রার্থনারত মনের আকুতি।
____________________
ঢাকায় ফিরে ইয়াদ কয়েকদিন ধরেই ইয়াসিরকে সামলিয়েছে।ছেলেটার বাবা মারা যাওয়ার পর একেবারে রূপ বদলিয়ে ফেললো যেনো।খাওয়া নেই, নাওয়া নেই,”বাবা বাবা” বলে অদ্ভুত সব কথাবার্তা বলে।বন্ধুর করুণ দিনে ইয়াদ পারেনি তার সাথ ছাড়তে।বরং বাকি দুই বন্ধুও বেশ খেয়াল রাখার চেষ্টা করছে ছেলেটার।তার বাবা মারা যাওয়ার দিন তিনেক তো ইয়াসিরকে সমলানোটাই যেনো দায় হয়ে যেত তাদের।তবে এখন ছেলেটা নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে অনেকটা।ইয়াসিরের অবস্থার উন্নতি দেখে ইয়াদ এবং বাকি সবাই তার সাথে দেখা করে ইয়াসিরের ঘর ত্যাগ করলো।বাকি দুইজন চলে গেলে ইয়াদ চড়ে বসলো নিজের গাড়িতে।উদ্দেশ্য মিরপুর স্টেডিয়াম।দুইমাস পর থেকে পুনরায় শুরু হবে সিরিজ।ইয়াসিরের সাথে সময় কাটিয়ে তবেই সে মাঠে ফিরে। যতোই যা করুক সে, তার মনের গহীনে দুআর প্রতিচ্ছবি হাতছানি দেয় ক্ষণে ক্ষণে।ইয়াদের মন খারাপ হলো।মেয়েটাকে ফোন দিবে বলে আশা দেখিয়ে আশা ভাঙলো সে। এতোই ব্যস্ত সময় পার করেছে সে এই কয়দিন,দম ফেলার সময়টুকু যেনো তার জন্যে ছিলো নিষিদ্ধ।অথচ সেদিন ফেরার পথে গাড়িতে অবস্থানকালীন মেয়েটার ফোন নাম্বার নিয়েছিল সে রামিসা থেকে।হৃদয়ে চাপা আর্তনাদ অনুভব করলো ইয়াদ।সরাসরি দেখা বা কথা বলা না হলেও,তার চন্দ্রাবতীর ছবি দর্শন করতে ভুলেনি সে কোনোদিন।এই কাজ যেনো ইয়াদের চরম আসক্তিতে রূপান্তরিত হলো।দুআর কথা স্মরণে এলে সবকিছুই তার আবছা মনে হয়।এইযে এখনো,দুআর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার মুঠোফোনের রিং পড়ার শব্দটা তার কর্ণপাত হচ্ছে না।কয়েকবার পুনরায় রিং বাজতেই হুঁশ এলো তার।মায়ের নাম্বার দৃশ্যমান।
–“আম্মি?”
–“জিয়া আমাকে শেষ করে দিলো,আব্বা।”
ডালিয়ার কান্নারত কণ্ঠ।
–“কেনো?কি হয়েছে আবার?”
ইয়াদের কণ্ঠে রাগের তেজ।
–“জামালের সাথে নাকি সে বিয়ে করে ফেলবে।এতদিন জ্বর থাকায় এই পাগলামি কমেছিল তার।এখন আবারও সেই একই কথা।এইসব আর ভালো লাগছে না,রোজ রোজ।”
–“রুমে তালা মারো আপুর। টাইমলি খাবার দিবে শুধু।আপুর মতো দূর্বল মানুষ নিজের ক্ষতি করবে না।এই যা কান্নাকাটি করবে বা খাবার খাবে না এতটুকুই।কিন্তু, রুমের বাহিরে এলে চলে যাওয়ার বিপদ আছে।”
ইয়াদ স্টিয়ারিং ঘুরানো অবস্থায় জবাব দিলো।

–“ঠিক আছে,তাই করছি।”
ডালিয়ার কথায় ইয়াদ ফোন রাখলো।এই জামাল আর জিয়ার কাহিনীর ইতি কবে ঘটবে এই নিয়ে আবারও চিন্তায় মগ্ন হলো সে।তার একটাই আফসোস,তার বোন যার জন্যে এত অতিষ্ট হচ্ছে সে তাকে নাম মাত্রই ভালোবাসে।তবে,নিজের বোনকে এমন কুলাঙ্গার থেকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে ইয়াদ।একদিন ঠিকই সে মুক্তি করবে তার বোনকে এই নরপিশাচের চুঙ্গুল থেকে।
.
ক্লান্ত শরীর,অশান্ত মন।বাহিরের আবহাওয়াটা আজ উথাল পাথাল।সবেমাত্র সে ফিরলো স্টেডিয়াম থেকে।জামালের সাথে বিরাট কান্ড বাঁধলো আজ।তাই অনুশীলনের শেষ পর্যায়ে জামালকে অপমান করে সে রাগের মাথায় বাড়ি ফিরে এলো।আজ যদি জিয়া তার সামনে এসে জামালের জন্যে তাকে কথা শোনায়,তবে ইয়াদ জানেনা কি করবে সে আজ দুইজনকে।কক্ষে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা জারির জন্যেই সে রুম লক করে দিয়েছে।জিয়ার ক্যাঁচাল তার সহ্য হবে না।বেশ সময় নিয়ে গোসল সারলো সে।
ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতেই ঘুমপরী আসর সাজালো তার আঁখি জোড়ায়।এক ঘুমেই ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটার সংখ্যায় স্পর্শ করলো।।
তন্দ্রা ছুটতেই দুআর শূন্যতায় ছেয়ে গেল ইয়াদের অশান্ত মনে।সিদ্ধান্ত নিলো বাহিরে যাবে বন্ধুদের সহিত।ঝটপট তৈরি হলো সে।পড়নে হাফ হাতা শার্ট ঠিক করে মুঠোফোন এবং মানিব্যাগ পকেটে পুরে কামরা ত্যাগ করলো ইয়াদ।বাড়িতে সবাই নিরবতা পালন করছে।মায়ের রুমে উঁকি দিতেই দেখলো ডালিয়া তন্দ্রাচ্ছন্ন।মারিয়া বা জিয়া কারো রুমের দিকে আগালো না ইয়াদ। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছে।সারাদিনের তোড়জোড় বিগড়েছে তার মেজাজ।বাড়ির লম্বা লন পার করতেই পেছন থেকে ডেকে উঠলো সাজ্জাদ,
–“কোথায় যাচ্ছো?”
–“বাহিরে।”
ইয়াদের শান্ত জবাব।
–“ওহ,যাও।তবে যখন তখন গ্রামে দৌড় দিও না। দেশ বিদেশের উচ্চ স্থান থাকতে কিভাবে ইচ্ছে করে তোমার নোংরা গ্রামে যেতে?”
সাজ্জাদের চেহারায় অহংকার স্পষ্ট।
–“শহরে থাকতে থাকতে তোমার নাকে জং ধরেছে বাবা।গ্রামের মাটির সুভাস একবার উপভোগ করতে পারলে আর এই যান্ত্রিক শহরে ফিরতেই তোমার মন চাইবে না।আর বাদ বাকি আমার যা ইচ্ছা আমি তাই করবো,যেখানে ইচ্ছে সেখানেই যাবো।তোমার মতামত আমার জন্যে জরুরি না।”
ইয়াদ গলার সুর চওড়া করলো।
–“তা জানি।ওহ,সায়েদ সাহেবের মেয়ের সাথে একবার সাক্ষাৎ করার সময় বের করবে।বয়স তো কম হচ্ছে না।সংসার জীবন শুরু করো।আমাদের ফ্যামিলির সাথে মেয়েটার স্ট্যাটাস ভালো যাবে।”
–“আমি?আমার পছন্দ আছে।সময় হলে জানাবো।আর এইসব ওভারস্মার্ট,হাই স্ট্যাটাসের মেয়ে আমার পছন্দ না।”
ইয়াদের সরু ভ্রু কুঁচকে এলো।
–“রাবিশ!ডোন্ট সে,তুমি গ্রামের মেয়েকে পছন্দ…”
–“আমার ব্যাপার সেটা।সময় এলে জানাবো।এই ব্যাপারে আমি কারো মতামত নিতে আগ্রহী না।”
ইয়াদ দ্রুত পা ফেললো সম্মুখে।

ইয়াদের কথার ধরন বুঝতে পেরে চক্ষু রঙের পরিবর্তন হলো সাজ্জাদের।


জোরপূর্বক ইয়াসিরকে নিজের সাথে শামিল করলো ইয়াদ।দুজন মিলেই ফারসিভের ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টে উপস্থিত হলো।পূর্ব থেকেই সেখানে উপস্থিত আছে ফারসিভ এবং স্পন্দনের।ইয়াসির চুপচাপ।বাকি সবাই তেমন একটা কথা বলছে না আজ।ইয়াদের মেজাজটাই বিগঁড়ে আছে।জ্বলন্ত সিগারেটের উল্টো পাশটা অধরের ভাঁজে দিলো সে।
সবকিছুর সাথে পাল্লা দিয়ে দুআ মেয়েটার দহন তার মনে ক্ষত সৃষ্টি করছে।অদ্ভুত শিহরণ জাগছে তনুতে।তাকে দেখার উম্মাদনায় অধৈর্য হলো হৃদয়।মুঠোফোন চালু করতেই শত মেসেজের ভিড়ে দৃষ্টি আটকে গেলো রামিসার মেসেজের নোটিফিকেশন দেখে।ইয়াদ এই মুহূর্তে মেসেজ চেক করলো না।সে বুঝতে পারছে ছবিগুলো দুআর।রামিসার কাজই হলো দুআর ছবি পাঠানো। লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে ধাধস্ত করলো সে।
–“ইয়াসির ঠিক আছিস?”
–“হুম আছি।”
কণ্ঠেই তার করুণ ভাব।
–“সবকিছু আমার পানশা লাগছে।”
স্পন্দন বলে উঠলো।
–“আমারও ভাই।অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে কোথায় যেনো,
কিন্তু বুঝতে পারছি না।”
ফারসিভের ফিচেল কণ্ঠ।
–“আমার নিজেরই বিরক্ত লাগছে।তার উপর দুআর জন্যে মনটা অশান্ত।”
ইয়াদের ব্যথিত হৃদয়ের বহিঃপ্রকাশ।
–“বিয়ে করে নে।”
ইয়াসির হেসে বললো।ছেলেটা যেনো এখন একটু স্বাভাবিক হচ্ছে!
–“দুআ ছোট এখনো।”
ইয়াদ বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো।
–“ছোট!এই চোখ ধাঁধানো মেয়েকে তোর ছোট মনে হয়?পাখি উড়াল দেওয়ার আগে ধরে ফেলো মামা।নাহলে বুঝছিস তো!”
–“বিশ্রী কথা।”
স্পন্দনের দিকে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ইয়াদ।
ইয়াসির দুইহাত উঁচু করে বলে উঠলো,
–“দুআ শুধু ইয়াদের পাখি।”
হাসির রোল পড়লো।ইয়াদ নিজেই ঠোঁটজোড়া প্রশস্থ করলো নির্দ্বিধায়।এতদিন পর বন্ধুকে হাসতে দেখে হৃদয়টা জুড়ে গেলো নিমিষেই। সেও সায় দিলো ইয়াসিরের কথায়,
–“ইয়েস।সি ইজ ওনলি মাই বার্ড। মাই লাভ বার্ড।”
ঠোঁট চেপে হাসছে বাকিরা।তাদের এই শক্ত ব্যক্তিক্তের বন্ধুটা পাক্কা প্রেমিক পুরুষে রূপান্তরিত হয়েছে, ছোট্ট একটা মেয়ের কারণে!ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হলেও,
সত্যি।

পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতার রূপে।আড্ডায় মশগুল বন্ধুগণ।আড্ডার মাঝেই ইয়াদ রামিসার মেসেজ খুললো।দুআর সাজসজ্জা আর হাসিতেই ইয়াদের অবস্থা করুণ।হৃদকম্পন সৃষ্টি হলো মুহূর্তেই।অদ্ভুতভাবে আকর্ষিত হচ্ছে সে দুআর এমন মোহে।এক ছবিতে দুআ কানের দুল ঠিক করছে,যার কারণে জামার লম্বা হাতা বেশ উপরে উঠলো।দৃশ্যমান হলো দুআর কব্জি থেকে কুনুইয়ের বাহিরের অংশের ডোরাকাটা হাত।অদ্ভুত লাবণ্যময় হাতখানা।সৃষ্টিকর্তার অপরূপ কারুকার্য যেনো এই মানবীর জন্যে করে রাখা।মেয়েটা গায়ের দাগ নিয়ে দ্বিধা করে,আর এইদিকে তার প্রেমিক পুরুষ সেই দাগেই হলো খু’ন।শরীরের উত্তাপ বাড়লো।মনের অস্থিরতার শব্দ বাহিরেও বুঝি কম্পিত হচ্ছে।প্রেয়সীর সাথে এইক্ষণে কথা বলাটা যেনো বাধ্যতামূলক।সহ্য হচ্ছে না ইয়াদের।মেয়েটার সবকিছু এতো মোহনীয় কেনো?এইযে তার দাগমাখা অদ্ভুত সুন্দর হাত দেখে পুনরায় প্রেমে মত্ত হলো প্রেমিকপুরুষটা।নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না।কনট্যাক্ট লিস্ট থেকে “চন্দ্রাবতীর” নামটা খুঁজে নিলো সে। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে ডায়াল করলো সেই মানবীর নাম্বারে।

মাত্রই তন্দ্রা নেমেছিল দুআর আঁখির শহরে।বালিশের পাশে হাতড়ে মোবাইল উদ্ধার করে কানে চাপলো।ঘুম জড়িত কণ্ঠে,”হ্যালো” বলতেই ইয়াদের স্নায়ু অস্বাভাবিক হলো যেনো।প্রেয়সীর ঘুম জড়ানো কন্ঠে মাদকতা ভরপুর।সোফা ছেড়ে খানিক দূরে কেবিনে বিদ্যমান চেয়ারে নিজের অবস্থার পরিবর্তন করলো ইয়াদ।ফিচেল কণ্ঠে বলে,
–“চন্দ্রাবতী?”
দুআর তন্দ্রা ছুটি নিলো।হচকিয়ে বসলো রমণী।এতদিনের কাঙ্খিত পুরুষ আজ তার কথা রেখেছে, ফোন দিয়েছে।দুআ হচঁকালো,চমকালো।লোকটার কণ্ঠ চিনতে দুআ ভুল করবে না।কখনোই না।কি গম্ভীর সুরেলা সেই কণ্ঠ!

–“জ.. জ্বী?আপনি এতো রাতে ফোন দিয়েছেন!”
দুআর স্বর কম্পায়মান।খেয়াল করলো তার কপাল ভিজে।কিসের এতো কাতরতা এই খেলোয়াড়ের সাথে কথা বলতে!

–“ডিস্টার্ব করলাম?”
দুআ ফোন চেপে ধরলো।সে তাকে ডিস্টার্ব করেছে!মোটেও না।অনিচ্ছা সত্বেও এই ফোনের জন্যেই তো দুআ অপেক্ষারত ছিলো।
–“নাহ।”
কণ্ঠে দুআর অস্পষ্টতা।
–“আমি যদি বলি আমি তোমাকে চাই আমার সারাজীবনের জন্যে, তাহলে কি তুমি তা মেনে নিবে?অদ্ভুত এই অনুভুতির নামটা যদি ‘ভালোবাসা’ দিই,তাহলে কি সেই নামটা নিজের সাথে জড়িয়ে নিবে?”
কম্পিত দুআর কম্পন বাড়লো।কিন্তু থামলো না প্রেমিক পুরুষের মাতলামি,
–“আমি তোমাতে হেরে গেলাম দুআ।মাঠে আমার পরাজয় অসম্ভব।কিন্তু,তোমার কাছে হেরেছে ইয়াদ বিন তেহরানের মন।বলতে বাধ্য হচ্ছি,আমি তোমাকে ভালোবাসি।এতটাই ভালোবাসি যে,এই প্রেম নিবেদন অনেক পরে করার কথা হলেও আমি পারলাম না নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে।আমি সারাটা জীবন তোমার সত্তায় হারাতে চাই।”
তনুটা টলমল করছে দুআর।তার কান কি সঠিক শুনছে?নাকি সবটা ভ্রম?জানেনা সে।গলা শুকিয়ে কাঠ।শব্দ বেরুচ্ছে না।সবটা শব্দ গলায় দলা পাকিয়ে অনশন করছে।

–“আপ…আপনি আমার চেহারা দেখে ভালোবাসলেও আমার আসল সমস্যার কথা জান..জানলে হয়তো আপনার…”
দুআ থামলো।আজ তার এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো?প্রেমিক পুরুষটা সত্যিটা জানলে দুআর প্রতি তার প্রেমটা বুঝি হারিয়ে যাবে!

–“চুপ থাকো দুআ।তোমার সবকিছুতেই আমি মত্ত,তোমাতেই আমি মগ্ন।হোক সেটা তোমার রূপ বা তোমার দাগ। আই লাভ ইউ।”
–“আমার উপরের রূপ সুন্দর,কিন্তু!আমার ত্বকে দাগ আছে খেলোয়াড় সাহেব।এতো বড় খেলোয়াড়ের জন্যে আমি অযোগ্য।”
–“ইয়াদের জন্য দুআর চেয়ে ভালো কেউ হয়না।তুমি কি জানো,তোমার দাগ দেখেই আমি নিয়ন্ত্রণহীন হয়েছি?কিসের মাদকতা সেই ডোরাকাটা স্থানে?তোমাকে দেখার তৃষ্ণা আমার সর্বাঙ্গে বয়ে যাচ্ছে।”
ইয়াদের কণ্ঠ তীব্র থেকে তীব্রতর।পাশের বন্ধুরা তার কথা শুনে স্তব্ধ।এই মানব ফোনেই প্রেম নিবেদন করে দিয়েছে।এতটাই মত্ত সে দুআতে?

–“আমার প্রেম নাকচ করার দুঃসাহস তোমার নেই দুআ।তোমাকে আমার চাই আর তুমি আমারই হবে।তুমি এবং তোমার সারা সত্তা শুধুই আমার।ঘুমিয়ে পড়ো।”
ইয়াদ ফোন রাখলো।প্রেম নিবেদনে এতো স্বস্থি সে কখনো অনুভব করেনি।এই শান্তি যেনো তার সারা তনুতে সুখের আবেশ ছড়িয়ে দিল।ধীরে ধীরে ইয়াদের মনে নিশ্চয়তার সম্ভাবনা উঁকি দিলো।এই শক্ত ব্যক্তিক্তের অধরে ফুটে উঠলো প্রশান্তির হাসি।

দুআর আঁখিতে অশ্রুজলের ছড়াছড়ি।এই লম্বা মানুষটার ভালোবাসায় যে ‘কিন্তু’ নামক শব্দটা ছিলো,মনের অজান্তে লোকটা সেই ‘কিন্তু’ শব্দটাকে হাওয়ায় মিলিয়ে দিলো এক নিমিষে।দুআ এইবার নিশ্চিত,লোকটা সত্যি তার জন্যে দিওয়ানা।তবে দুআ বুঝলো না,দুআর ত্বকে বিদ্যমান দাগ সে কিভাবে দেখলো!প্রশ্নের চাপ আর উত্তেজনায় মূর্ছা গেলো প্রেয়সী।এই প্রথম এমন স্বচ্ছ প্রেম নিবেদন পেয়ে সহ্য করতে পারলো না মেয়েটা।

চলবে…..।