#আমার তুমি
#পর্বঃ৩৫
#তানিশা সুলতানা
তুলতুলদের রুম থেকে বের হলেই পাখির রুমটা সামনে পড়ে। পাখির রুমের পাশে সিঁড়ি।
তুলতুল পাখির রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কুঁচি ঠিক করে। তারপর উঁকি দেয় পাখির রুমে। পাখি ঠিক কি করছে এটা জানার জন্য।
ওমা মহা রানী হাতে ব্যান্ডেজ করছে। একটু খানি কেটে গেছে হাত।
তুলতুলের ফাঁপা মাথায় ধপ করে বাড়ি খায় একটা কথা। এবার পাখি নিশ্চয় সায়ানকে বলবে “বেবি আমার হাত কেটে গেছে এবার খাইয়ে দাও”
চোখ দুটো বড়বড় হয়ে যায় তুলতুলের। এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না।
তুলতুল হুরমুর করে ঢুকে পাখির রুমে। পাখির সামনে থেকে তুলা আর ব্যান্ডেজ নিয়ে নিজের হাত ব্যান্ডেজ করতে থাকে।
পাখি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে।
“কি হলো? তোমার হাত তো ঠিকই আছে?
পাখি কপালে তিনটে ভাজ ফেলে।
” ঠিক ছিলো না এখন ঠিক আছে।
ব্যান্ডেজ করা হাতটাতে চুমু খেয়ে বলে তুলতুল। পাখিও রাগী দৃষ্টিতে তাকায় তুলতুলের দিকে। তুলতুল পাখিকে ভেংচি কেটে বেরিয়ে যায়।
পাখি দাঁত কটমট করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে সাজুগুজু করতে বসে।
এই ফাঁকা তুলতুল খাবার টেবিল সাজাতে থাকে। এই বাড়িটাতে সায়ানের অফিসের যে কয়জন এসেছে তারাই থাকে। পাখির বাবা আর বাকি সবাই আগেই বেরিয়ে গেছে। তারা তো কাজ করতে এসেছে। পাখির আবদারে সায়ানকে যেতে হয় নি। অবশ্য কথাটা তুলতুল বা সায়ান কেউ জানে না। তুহিন শরীর খারাপের বাহানায় যায় নি। পাখির হাতে মোরগ পোলাও খাওয়ার আশায় শরীর খারাপের বাহানা।
তুলতুল কোমরে আঁচল গুঁজে প্লেট ঠিক করছে। গ্লাসে পানি ঢালছে। সায়ান আর তুহিন কথা বলতে বলতে আসছে। তুলতুলের দিকে চোখ পড়তেই থেমে যায় সায়ান। একদম গিন্নি গিন্নি লাগছে তুলতুলকে। কোমরে আঁচল গোঁজা চুলগুলো আধখোপা করা। কিছু চুল গোপা থেকে ছুটে এসে চোখে মুখে আঁচড়ে পড়েছে।
সায়ান অনমনে বুকের বা পাশে হাত দেয়।
“ভাই কি হলো?
তুহিন সায়ানের চোখের সামনে তুরি বাজিয়ে বলে। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সায়ান। দ্রুত চোখ ফেরায় তুলতুলের থেকে।
” সায়ান আমি তোমার জন্য নিজে হাতে রান্না করেছি।
পাখি এক গাল হেসে সায়ানের এক হাত জড়িয়ে বলে।
সায়ান অনিচ্ছা স্বতেও পাখির দিকে তাকিয়ে একটু হাসে।
“খাবে চলো
পাখি সায়ানকে টেনে নিয়ে যায়।
” তুলতুল তুমি বরং আমাকে টেনে নিয়ে যাও। আমি বেচারি অনাথ কেউ ভালোবাসে ডাকে না।
তুহিন কাঁদো কাঁদো ফেস করে অফসোসের সুরে বলে।
সায়ান রাগী দৃষ্টিতে তুলতুলের দিকে তাকায়। তুলতুল সেদিকে পাত্তা না দিয়ে তুহিনের কাছে যায়।
“ভাইয়া আমি তো নেকা ষষ্ঠি না তাই নেকামো করতে পারলাম না। (পাখিকে ভেংচি কেটে বলে তুলতুল)
তুমি এসো ডাইনি থুক্কু পাখি আপু রান্না করেছে। খেয়ে কিন্তু ভুল ধরাতে হবে।
একগাল হেসে বলে তুলতুল৷ তুহিনও হাসে।
সায়ান কাটা চামচ মুঠো করে ধরে আছে। ইচ্ছে করছে তুলতুলের চোখে চামচটা ঢুকিয়ে দিতে।
” তুমি আমাকে ডাইনি কোনো বললা?
পাখি তেরে এসে বলে।
“আমি? তোমাকে? ডাইনি বলেছি?
তুহিন ভাইয়া তুমি শুনেছো?
তুলতুল অবাক হওয়ার ভান ধরে বলে।
” কই শুনলাম না তো।
তুহিন গালে হাত দিয়ে বলে।
পাখি দাঁত কটমট করতে করতে আবার সায়ানের কাছে যায়। সায়ানকে খাবার বেরে দেয়। তুলতুল সায়ানের পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে। পাখি সবে সেখানে বসার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিলো। আরেক দরফা দাঁত কটমট করে পাখি। তারপর সায়ানের ডান পাশে গিয়ে বসে।
তুহিন ওদের সামনে বসেছে।
সায়ান কোনো দিকে না তাকিয়ে খাচ্ছে। পাখি চামচ দিয়ে খাচ্ছে। তুহিনও খাচ্ছে।
শুধু বসে আছে তুলতুল।
“হাত কেটে গেছে আমার। খাবো কি করে?
তুলতুলের কথা শুনে পাখি বড়বড় চোখ করে তুলতুলের দিকে তাকায়। এই ছিলো তোর পেটে?
সায়ান মিটমিট করে হাসছে। তুলতুলের হাতে যে কিছুই হয় নি এটা জানে ও।
” তোমার হাতে তো কিছুই হয় নি। ইচ্ছে করে ব্যান্ডেজ করেছো।
পাখি কটমট চোখে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে বলে।
“আহহহহ পাখি মেডাম। মানছি আপনি শএু পহ্ম তাই বলে একটা নিরিহ নারীকে মিথ্যেবাদি বলবেন। ইটস নট ফেয়ার।
তুহিন মুখে খাবার পুরে বলে।
” আমারও তো হাত কেটে গেছে। আমি তো চামচ দিয়ে খাচ্ছি। তো ওকেও চামচ দিয়ে খেতে বলো।
“আমি তো গরীব মানুষ। চামচ কাকে বলে চিনিই না। চামচ কি করে ধরতে হয় সেটাও জানি না। তোমার মতো স্মার্ট নই তো।
তাই আমাকে হাত দিয়ে খাইয়ে দিতে হবে।
তুলতুল এক গাল হেসে বলে।
” চিটিং করে তুমি ফাস্ট রাউন্ড জিতে যাবে?
পাখির মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে। কিছু বলতেও পারছে না করতেও পারছে না।
সায়ান এক মনে খাচ্ছে। দিন দুনিয়ার খবর তার কানে ঢুকছে কি না সন্দেহ।
“তুহিন ভাইয়া তুমিই বরং আমাকে খাইয়ে দাও।
হতাশার সুরে বলে তুলতুল। পাখি খুশিতে লাফিয়ে ওঠে।
” হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিই খাইয়ে দাও।
খুশিতে গদগদ হয়ে বলে পাখি।
“আআআমি?
শুকনো ঢোক গিলে বলে তুহিন।
তুলতুল উঠতে যায়। সায়ান তুলতুলের হাত ধরে ফেলে। তুলতুল সায়ানের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে হা করে।
সায়ান তুলতুলের মুখে খাবার পুরে দেয়। পাখি দাঁতে দাঁত চেপে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে আছে। তুলতুল চোখ টিপ দেয় পাখিকে। পাখির রাগ বেরে যায়। আস্ত একটা চিটিং বাজ।
তুলতুল চেয়ার ঘুরিয়ে সায়ানের দিকে মুখ করে কাছাকাছি এসে বসে। সায়ানের দুই পায়ের ওপর নিজের দুই পা রাখে।
সায়ান ভ্রু কুচকে তাকায় তুলতুলের দিকে। তুলতুল ভ্রু নাচিয়ে বলে ” কিহহহ?
সায়ান মুচকি হেসে মাথা নারায়। মানে কিছু না।
সায়ান নিজে খাচ্ছে আর তুলতুলকে খাওয়াচ্ছে। তুলতুল সায়ানের পায়ের আঙুল পা দিয়ে নরা চারা করছে আর খাচ্ছে।
“তুলতুল তুমি এতে অসব্ভ কেনো?
পাখি বলতে গিয়েও বলে না। এই মেয়ে যে ধানিলংকা দশটা কথা শুনিয়ে দেবে। ঝগড়া করাতে একদম এক্সপার্ট। পাখি আবার ঝগড়া করতে পারে না। ঝগড়া করার সময় মূল টপিক টাই ভুলে যায়।
খাওয়া শেষ হতে না হতেই পাখি বায়না করে ঘুরতে যাবে।
তুলতুল সায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে সায়ান কি বলবে শুনতে।
সায়ান তুলতুলের দিকে তাকায়। মনে মনে খুব ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে করছে। এখানে আসার পর থেকে কোথাও যাওয়া হয় নি।
” ওকে যাবো। দশ মিনিট টাইম দিলাম রেডি হয়ে নাও।
সায়ান হাতের ঘড়ির দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে।
তুলতুল বাঁকা হাসে। মনে মনে এটাই চাই ছিলো যাতে সায়ান রাজি হয়ে যায়।
“আমি কোথাও যাবো না। ঘুরতে বোরিং লাগে আমার।
বলেই তুলতুল সিঁড়ি বেয়ে রুমে চলে যায়।
পাখির খুশি আর দেখে কে? এখন সায়ান আর ও ঘুরতে যাবে।
পাখি খুশিতে লাফাতে লাফাতে রুমে চলে যায়। একদম পারফেক্ট মেকাপ করতে হবে। সব চেয়ে বেশি সুন্দর দেখাতে হবে।
সায়ানও দ্রুত রুমে চলে যায়।
রুমে গিয়ে দেখে তুলতুল কানে হেডফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
সায়ান তুলতুলের পাশে গিয়ে বসে। তুলতুলের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেয়। তুলতুল তবুও তাকায় না।
” কেনো যাবি না?
“ইচ্ছে করছে না।
“শিওর যাবি না?
” নাহহহহ
“ওকে
সায়ান উঠে যায়। লাগেজ থেকে জামাকাপড় বের করতে থাকে। ভ্রু কুচকে ফেলে তুলতুল। ফট করে চোখ খুলে। তুলতুল যাবে না শুনেও সায়ান যাবে?
ভালোবাসলে নিশ্চয় যেতো না।
বুক ভারি হয়ে আসে তুলতুলের।
সায়ান সজোড়ে দরজা গালিয়ে ফেলে ওয়াশরুমের। কেঁপে ওঠে তুলতুল।
চোখ দিয়ে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে তুলতুলের। সাথে সাথে হাতের উল্টো পিঠে মুছে ফেলে।
পাঁচ মিনিট পরে সায়ান বের হয়। এখন তুলতুলের লাগেজ খুলে। সেখানে থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বের করে সায়ানের লাগেজে রাখে।
তারপর লাগেজটা টেনে এই রুমের পেছনের জানালার কাছে যায়। তুলতুল লাফ দিয়ে উঠে বসে। বোঝার চেষ্টা করছে সায়ান কি করতে চলেছে?
সায়ান জানালার কাচ সরায়। তারপর লাগেজটা তুলে ফেলে দেয়।
দুই ঠোঁটের মাঝে কিঞ্চিত ফাঁকা হয়ে যায় তুলতুলের৷ চোখ দুটো বড়বড় করে ফেলে। এটা কি করলো সায়ান?
দুই মিনিট লাগে পুরো বেপারটা বুঝতে। সায়ান তুলতুলের লাগেজ ফেলে দিছে কথাটা মস্তিষ্কে আসতেই তুলতুল রেগে যায়। ধাপধাপ পা ফেলে জানালার কাছে আসে। বাইরে উঁকি দেয়। কোনো একটা নাম না জানা নদী। নদীর পানি হালকা নীল। লাগেজটা ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে।
সায়ানের জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
” আমার লাগেজটা কেনো ফেলে দিলেন?
তুলতুল কোমরে হাত দিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে।
সায়ান নদী থেকে চোখ ফিরিয়ে তুলতুলের দিকে তাকায়। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে সায়ানের। কপালের রগ ফুটে উঠেছে।
ভয় পেয়ে যায় তুলতুল। লোকটা রেগে গেলো কেনো?
সায়ান তুলতুলের শাড়িটা মুঠো করে ধরে এক টান দেয়। কিছুটা দুরে ছিঁটকে পরে তুলতুল। শাড়িটা এখন সায়ানের হাতের মুঠোয়।
এই শাড়িটাও সায়ান ফেলে দেয়।
তুলতুল কেঁদে ফেলে। দুই হাত দিয়ে শরীর ঢাকার চেষ্টা চালায়।
এখন পড়বে কি ও? এমন কেনো করলো লোকটা? এতো খারাপ উনি? আর কখনোই তুলতুল কথা বলবে এই বজ্জাত লোকটার সাথে।
কখনোই না।
“একটা কথা একবার বললে কানে যায় নাহহ তোর? তোকে বলেছিলাম না এই শাড়ি পরে বাইরে যাবি না। তবুও কেনো গেছিলি? এতো সাহস হয় কি করে তোর? আমার কথার অবাধ্য হস।
সায়ান চোয়াল শক্ত করে চিৎকার করে বলে। রাগে পুরো শরীর কাঁপছে। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করা।
” এবার ফেলে দিলাম শাড়ি। এইবার আমিও দেখবো তুই কি করে এই শাড়ি পড়িস?
তুলতুলের দুই বহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলে সায়ান।
তুলতুল ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
চলবে