আমার নিঠুর মনোহর পর্ব-১১+১২

0
125

#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_এগারো

“খাটে বউ রেখে বেলকনিতে এসে লুকিয়ে প্রাক্তনের সাথে কথা বলতে বলতে আপনার বিবেকে বাঁধা দিলো না, মাস্টার মশাই?”
হুট করে তারিনের কণ্ঠস্বর পেয়ে তামজিদ কেঁপে উঠল। পেছন ঘুরে দেখলো তারিন দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে সে কি অসহায়ত্ব মেয়েটার! তারিনকে এমন ছন্নছাড়া ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তামজিদের বড্ড কষ্ট হলো। বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। তামজিদ কানের থেকে ফোন নামিয়ে শান্ত বাক্যে বলল,
“তারিন, ভুল বুঝো না আমাকে। আ…।”
তারিন হাত উঁচু করে থামিয়ে দিলো তামজিদকে। শক্ত বাক্যে বলে উঠল,
“চুপ করেন। আর আমাকে ভুল বুঝাতে আসবেন না। আমার যা বুঝার আমি বুঝে গেছি।”
তারিন আর কিছু বলতে পারলো না। ওর খারাপ লাগছে। কণ্ঠস্বর রোধ পাচ্ছে। তামজিদ নিচু স্বরে বলল
“তারিন! আমি তোমাকে ভুল বুঝাচ্ছি না বিশ্বাস করো।”
“এতক্ষণ আমাকে যা যা বলেছেন আমি বিশ্বাস করেছিলাম। আপনি আমার সামনে দিশা আপুর সাথে কথা বললেও আমি মেনে নিতাম। আমাকে লুকিয়ে কেন কথা বলতে হবে, মাস্টার মশাই?”
তামজিদের মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে। তারিন যেই শক্ত মনের মেয়ে ওকে এত সহজে বুঝানো যাবেনা। তামজিদ তারিনের হাত ধরার জন্য হাত বাড়াতেই তারিন হাত সরিয়ে নিলো। শক্ত বাক্যে বলল,
“একদম আমাকে ছোঁবেন না। কি ভেবেছেন আমাকে? আমি খুব সরল মেয়ে? একদম না। একদম এসব আবোলতাবোল ভাববেন না। আমি কেমন মেয়ে সেটা বোঝার ক্ষমতা আপনার এখনো হয় নি। কি ভেবেছেন, আপনি বউকে লুকিয়ে প্রাক্তনের সাথে পরকিয়ার সম্পর্কে জড়াবেন আর আমি চুপচাপ সব মেনে নিয়ে চলে যাবো। হাসালেন, মাস্টার মশাই। তারিন নিজের অধিকার এত সহজে ছাড়বে না। আমি এর শেষ অব্দি দেখবো। আমাকে ঠকানোর বিন্দু মাত্র চেষ্টা করলে, তার ফল বড্ড খারাপ হবে, মাস্টার মশাই। আমি আপনাকে ছেড়ে কথা বলবো না। মনে রাখবেন।”
বলেই বিছানার দিকে এগিয়ে আসলো। ব্যাথা পায়ে জোর দিয়ে হেঁটে আসার রক্ত বের হওয়া শুরু হয়েছে। তারিনের অদ্ভুত যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে একাধারে৷ শেষ অব্দি তারিন ঠকে গেলো তাহলে! কী হবে এখন? জীবন এমন নিঠুর খেলায় মেতে উঠলো? নাহ! মানতে পারছে না ও। কিছুতেই না। নিজের স্বামীকে লুকিয়ে অন্য একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখা কোনো স্ত্রীর পক্ষে মানা সম্ভব না। তারিন বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। জ্বরে শরীরে কাঁপুনি হচ্ছে। তারিনের ছোট থেকেই জ্বর আসলে খিঁচুনি উঠে যায়। তারিন মনে মনে এই ভয়টাই পাচ্ছে। যদি এখন তেমন কিছু হয় তাহলে কি হবে? মনে মনে আল্লাহর কাছে সুস্থতা প্রার্থনা করতে লাগলো। পাতলা কম্বলটা গায়ে প্যাঁচিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো জোর করে। চোখ থেকে নিরবে অশ্রুরাশি ঝরঝর করে পড়ছে। তামজিদ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। তারিনের ঠোঁট কেঁপে হালকা শব্দ হচ্ছে। সেই শব্দ তামজিদের কানে পৌঁছালো কোনোরকম। ত’ন্দ্রা কেটে গেলো ওর। হন্তদন্ত হয়ে আসল তারিনের কাছে। তারিনের চোখ বন্ধ, ঠোঁট কাঁপানো দেখে তামজিদ চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করল,
“তারিন, কি হয়েছে? খারাপ লাগছে? শীত করছে? জ্বর এসেছে?”
তারিন কোনোরকম জবাব দিলো,
“আমার কিছু হয় নি, মাস্টার মশাই। আপনি যান।”
বলে অন্যপাশে ফিরে গেলো। কিন্তু তামজিদ সে কথা কানে নিলো না। তারিনের কপালে হাত রাখতেই আঁতকে উঠল। জোরে বলে উঠল,
“তোমার শরীর তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।”
তারিন হাতটা সরিয়ে দিলো। বলল,
“ছোঁবেন না আমাকে।”
তামজিদের বেশ কষ্ট হচ্ছে। এই ছোট্ট মেয়েটা আজকের ঘটনাটা মানতে পারেনি। তামজিদ অনুতাপ হচ্ছে। কেনো কথা বলতে গেলো দিশার সাথে? নিজের উপর রাগ হচ্ছে। তামজিদ তো তারিনকে কিছু মিথ্যা বলে নি৷ সত্যিই তামজিদ দিশার সাথে ইচ্ছাকৃত কোনো প্রকার যোগাযোগ রাখে নি। নিজেই সরে আসার চেষ্টা করছে দিশার থেকে। যতই হোক নিজের ভালবাসার মানুষটাকে ভুলতে একটু সময় তো লাগবে। দিশা অনেকক্ষণ যাবৎ তামজিদকে কল দিচ্ছিলো। তাই বাধ্য হয়ে দিশার ফোনটা ধরেছিলো। আর দিশা ফোন দিয়েই তামজিদকে সুই’সাই’ডের ভয় দেখাচ্ছিলো। তাই তামজিদ ঠান্ডায় ওকে বুঝানোর চেষ্টায় ছিলো। তখনি তারিন শুনতে পায়। তামজিদ রাগে, কষ্টে নিজের চুলগুলো দুই হাতে খাবলে ধরলো। সব দিকের যন্ত্রণাটা ও নিতে পাচ্ছে না আর। জীবনটা হঠাৎ করেই কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেলো। সব এলোমেলো হয়ে গেলো। তারিনের মুখের দিকে তাকিয়ে তামজিদের মায়া হচ্ছে অনেক। মেয়েটা বয়সে ছোট কিন্তু বুঝার ক্ষমতা বেশি বলেই মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে। তামজিদ মনে মনে ভাবছে,
“এই ছোট মেয়েটার তো কোনো দোষ নেই৷ তাহলে ও কেন আমার জন্য কষ্ট পাবে?”
তারিন বেশ নিস্তেজ হয়ে পড়েছে জ্বরে। চোখ খুলছে না। কোনো শব্দ করছে না। চুপচাপ আছে। তামজিদ তারিনের হাতটা আলতো করে আঁকড়ে ধরল। নিচু স্বরে তারিনের হাত ছুঁয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল,
“দিশা, যা খুশি তা বলুক বা করুক আজকের পর আমি আর ওর ফোন ধরব না৷ ওর সাথে কোনো যোগাযোগ রাখবো না। তোমাকে আর আমার জন্য কষ্ট পেতে হবে না, তারিন।”
তারিনের হাত ধরে জ্বরের মাত্রা অতিরিক্ত বুঝতে পেরে তামজিদ উঠে পড়ল। লাইফ অন করে থার্মোমিটারটা নিয়ে এসে তারিনকে আলতো ডেকে বলল,
“তারিন! তারিন! তারিন মুখটা খুলো, প্লিজ। জ্বরটা মেপে দেখি। তোমার শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। প্লিজ, মুখটা খুলো।”
তারিন শুনলো না। জবাব দিলো না। তারিনের কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে তামজিদের বুকটা ধক করে উঠল। অনেকক্ষণ ধরে ডাকার পরেও তারিনের সাড়া না পাওয়ায় তামজিদ নিশ্চিত হলো যে, তারিন জ্ঞান হারিয়েছে৷ তামজিদ এবার নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না। ভয়ে বুকের মধ্যে হার্ট বিট বেড়ে গেছে। কি করবে উপায়ন্তর না পেয়ে দৌড়ে গেলো ওয়াশরুমে। এক বালতি পানি এনে তারিনকে ঠিক করে শুইয়ে দিলো। তারপর বেশ অনেক সময় ধরে তারিনের মাথায় পানি ঢালতে লাগলো। মুখেও বেশ কয়েকবার পানির ছিটে দিয়েছে৷ কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। রাত তখন ২টার কাছাকাছি। এত রাতে কী করবে কিচ্ছু মাথায় আসছে না। চিন্তায় দম বন্ধ হয়ে আসছে তামজিদের। নিজে নিজেই হাসফাস করতে লাগলো। প্রায় ১৫-২০ মিনিট ধরে তামজিদ তারিনের মাথায় পানি ঢাললো। এখনো তারিনের কোনো হুঁশু নেই। এবার আর তামজিদ নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না। জ্বরটাও কিছুতেই কমছে না। তামজিদ বেশ আতঙ্কিত স্বরে তারিনকে ডাকতে লাগলো,
“তারিন! এই তারিন! চোখ খুলো। প্লিজ, চোখটা খুলো। তারিন!”
নাহ! কোনো সাড়া নেই। তামজিদ তারিনের নাকের কাছে হাত নিয়ে চেক করলো নিঃশ্বাস নিচ্ছে কি না? হ্যাঁ! নিঃশ্বাস পড়ছে। এবার তারিনকে কাঁত করে শুইয়ে দিলো৷ তারপর দৌড়ে গেলো জাহেলার কাছে। গিয়ে জাহেলাকে তারিনের কাছে পাঠালো। চিৎকার চেঁচামেচি করতে না করলো। নিজে গেলো আমজাদ সাহেবদের রুমে। গিয়ে আস্তে করে তাকে জাগালো। যেনো বর্ষা বেগমের ঘুম না ভেঙে যায়। তারপর তাকে রুমের বাইরে এনে তারিনের অবস্থা ব্যাখা করলো। এর মধ্যেই জাহেলা চেঁচিয়ে উঠল। আমজাদ সাহেব আর তামজিদ দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো রুমে। গিয়ে দেখলো তারিনের খিঁচুনি উঠে গেলো। তামজিদ উপায়ন্তর না পেয়ে এবার তারিনকে কোলে তুলে নিলো। আমজাদ সাহেবকে বলল,
“বাবা, অমিত কাকাকে বলো তাড়াতাড়ি গাড়ি বের করতে।”
আমজাদ সেদিকে ছুটলো। তামজিদ তারিনকে নিয়ে গাড়িতে বসালো। সাথে জাহেলাকে নিয়ে, আমজাদ সাহেবকে বাসায় রেখে গেলো। তারিনকে তামজিদ খুব যত্ন করে নিজের বুকে আগলে রেখেছে। বার বার মাথায় হাত বুলিয়ে ভয়ার্ত স্বরে স্বান্তনা দিচ্ছে,
“কিছু হবে না তোমার। তোমার বাবাকে কথা দিয়ে এসেছিলাম তার চাঁদের গায়ে আমি দাগ লাগতে দিবো না। সেই কথার খেলাপ আমি করবো না। কিছুতেই করবো না।”
চিন্তা আর ভয়ে তামজিদের নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। এর মধ্যেই ওর ফোনটা আবার বেজে উঠল। ফোন স্কীনে দিশার নামটা দেখেই রাগে শরীর গিজগিজ করে উঠল। ফোনটা রিসিভ করেই তামজিদ রাগে চিৎকার করে বলতে লাগলো,
“আমাকে কি তুই কোনোদিন শান্তি দিবি না? প্লিজ ভাই, আমাকে একটু শান্তি দে। আমাকে সুস্থ ভাবে বাঁচতে দে। আমি ম’রে যাচ্ছি। মানসিক অশান্তিতে দিন দিন ভেঙে যাচ্ছি। তুই তো আমাকে ভালোবেসে সামান্য সেক্রিফাইস টুকু করতে পারলি না। তাহলে এখন কেন আমাকে ঠিক ভাবে বাঁচতে দিচ্ছিস না? আমার কি করার আছে এখন? অনেক চেষ্টা করেছিলাম ধরে রাখার। পারি নি৷ সেটার কারণ তুই। প্লিজ, আর আমাকে ফোন দিস না। আমার জীবনে আর অশান্তি ডেকে আনিস না। এত অশান্তির সাথে লড়াই করে বাঁচতে পারছি না আমি। আজকে পর আমাকে ফোন দিলে আমার খারাপ রুপটা দেখবি তুই। মনে রাখিস?”

#চলবে

#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_বারো

“ঘর বউ রেখে প্রাক্তনের সাথে ফোনালাপ করাকে পরকীয়া বলে, জানেন? আমারে কেন ঠকাইতাছেন, মাস্টার মশাই? আমি তো আপনারে বিশ্বাস করে আপনার হাত ধরে এই অচেনা শহরে পা রেখেছিলাম। তাহলে আজ কেন আমাকে এভাবে বিশ্বাস ভাঙার কষ্টে জর্জরিত করলেন?”
তারিন এখন আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ। রাতের আধার কেটে আলো ফুটেছে আকাশে। তামজিদ সারারাত তারিনের পাশে ছিলো। দু-চোখের পাতা এক মিনিটের জন্যও বন্ধ করে নি৷ আজানের পর নামাজ পড়ে এসে তারিনের বেডে মাথা রেখে বসে ছিলো বেশ কিছুক্ষণ। তারপর হয়তো চোখ দুটো লেগে এসেছিলো। তারিন ঘুম থেকে জেগে নড়তেই তামজিদের ঘুম ভেঙে যায়৷ ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করে,
“ঠিক আছো তুমি? কষ্ট হচ্ছে? খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকবো?”
তারিন সেসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রচন্ড অভিমানে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। শক্ত বাক্যে উপরোক্ত প্রশ্নগুলো করে বসল। এই মুহূর্তে এসব প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলো না তামজিদ। অবাক চোখে তারিনের দিকে তাকিয়ে রইল, কিছুক্ষণ । কোনো উত্তর দিলো না। পরক্ষণেই তারিনের কপালে হাত রাখল জ্বর আছে কিনা চেক করার জন্য। তারিন হাতটা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই, তামজিদ শক্ত বাক্যে বলে উঠল,
“একদম হাত সরানোর চেষ্টা করবে না, বলে দিলাম।”
তারিন শান্ত বাক্যে বলল,
“আপনি আমাকে ছোঁবেন না।”
“তোমাকে ছোঁয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আমার আছে।”
“কিসের অধিকার?”
তামজিদের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় প্রশ্ন করল তারিন। তামজিদ অবাক হয়ে উত্তর দিলো,
“কিসের অধিকার মানে? তুমি কি ভুলে গেছো আমি তোমার কে?”
তারিন খানিক হাসলো। সে হাসি নিষ্প্রাণ। চোখ দুটো টলমল করছে। মুখটা এক রাতেই বেশ শুকিয়ে গেছে। বড্ড ভেঙে পড়েছে মেয়েটা। তামজিদের খুব মায়া হচ্ছে। এত শক্তপোক্ত মনের অধিকারী মেয়েটা আজ এভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তারিন তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,
“একদম না। আপনি আমার স্বামী। তাইতো?”
তামজিদ জোর গলায় বলল,
“অবশ্যই।”
“তাহলে বউকে লুকিয়ে প্রাক্তনের সাথে কিসের সম্পর্ক আপনার?”
তামজিদ শান্ত হয়ে বসে পড়ল। শান্ত বাক্যে বলল,
“তোমার শরীর অসুস্থ। এসব আলোচনা বাড়ি গয়ে করা যাবে, তারিন।”
তারিন এবার আগের ন্যায় শক্ত বাক্যে বলল,
“যা বলার এক্ষুনি বলবেন আমাকে।”
তামজিদ পুনরায় বলল,
“বুঝার চেষ্টা করো। এসব বলার জায়গা এটা নয়, তারিন।”
তারিন উঠে বসার চেষ্টা করতেই মাথা ঘুরে উঠল। বসতে গিয়েও পারলো না। তামজিদ ধরে ফেলল থাবা দিয়ে। তারিন দুই হাতে ঠেলে তামজিদকে দূরে সরানোর চেষ্টা করল। তামজিদ শক্ত করে তারিনের বাহুদ্বয় ধরে শুইয়ে দিলো। শাসিয়ে উচ্চ বাক্যে বলে উঠল,
“এই মেয়ে, বেশি পাকনামো করতে বারন করেছি না আমি? কথা শুনছো না কেনো? বেশি সাহস বেড়ে গেছে তোমার? তুমি কিন্তু এখনো তামজিদ তাজওয়ার কে চিনো না। আমার ভালো রুপটা দেখেছো। খারাপ রুপটা দেখো নি৷ বাধ্য করো না আমাকে সেই রুপটা দেখাতে।”
তামজিদের এহেন বাক্যে তারিন ঘাবড়ে গেলো। এই প্রথম তামজিদকে এতটা রেগে যেতে দেখলো। তামজিদের চোখ দুটোতে রাগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তারিন মনে মনে ভয় পেলেও প্রকাশ করলো না৷ বলল,
“আমার প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া অব্দি আমি আপনার সাথে বাড়ি ফিরবো না, মাস্টার মশাই।”
তামজিদ দমে গেলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তারিনের দিকে। এই মেয়েটা এমন কেন? এইটুকু বয়সে কোনো মেয়ে এতটা শক্তপোক্ত, সাহসী হতে পারে? বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। কিছুতেই তারিনকে দমিয়ে রাখা যায় না। তামজিদের হাত দুটো আলগা হয়ে আসলো। শান্ত হয়ে বসে রইলো কিছুসময়। তারিনও বেশ শান্ত হয়ে আছে তাকিয়ে আছে তামজিদের দিকে। নিরবতা কা’টিয়ে তামজিদ বলে উঠল,
“ভালোবাসা ফুরিয়ে গেলেও মায়া ফুরিয়ে যায় না, জানো?”
“না৷ আর জানতেও চাইনা।”
তারিন স্পষ্ট জবাব দিলো। তামজিদ বলা শুরু করল,
“আমাকে তুমি ভুল বুঝছো, তারিন। আমি তোমাকে ঠকাচ্ছি না। হ্যাঁ, আমি দিশার সাথে কথা বলছিলাম। কিন্তু সেটা কোনো প্রেমালাপ ছিলো না। দিশা আমাকে সুই’সা’ইডের ভয় দেখাচ্ছিলো। সেটা নিয়েই ওকে বুঝাচ্ছিলাম। কি করবো বলো? ভালোবেসেছিলাম তো। তাহলে এত সহজে ভুলে যাই কি করে? ভালোবাসার মানুষকে কি এত সহজে ভুলে যাওয়া যায়?”
তারিন নিজের অনুভূতি গুলো আর লুকিয়ে রাখতে পারলো না। শান্ত হয়ে উত্তর দেওয়ার মতো ধৈর্য নেই টলমলে চোখে তামজিদের দিকে তাকালো। তামজিদও শান্ত দৃষ্টিতে তারিনের দিকে তাঁকিয়ে আছে। তারিন এবার জোরে চেঁচিয়ে অভিযোগের স্বরে বলে উঠল,
“দেখুন, এসব সস্তার আবেগ অন্য কাউকে দেখাবেন। আমি এখনো এত আবেগ, ভালোবাসা এত প্যাচিয়ে বুঝে উঠতে পারিনি৷ আপনার যদি তার প্রতি এতই ভালোবাসা থেকে থাকে, তাহলে আপনি আমাকে বিয়ে করলেন কেন? যখন আপনার সামনে আপনার ভালোবাসাকে অপমান করছিলাম আমরা সবাই, তখন চুপ করে ছিলেন কেন? কেনো প্রতিবাদ করেন নি? কেনো মেনে নিয়েছিলেন সব? আমাকে কথা দিয়েছিলেন তো আমাকে ঠকাবেন না। তাহলে এখন কেন তার সাথে প্রতি মুহূর্ত যোগাযোগ রাখেন। আমি তো আপনার অতীত, ভালোবাসা সব কিছু মেনে নিয়েছিলাম। তবুও কেনো ঠকাচ্ছেন আমাকে? আমাকে কেনো এত কষ্ট দিচ্ছেন? একবারো কি ভেবেছেন আমার কতটা কষ্ট হতে পারে? আমি মানছি আমার বয়সটা কম। তাই বলে কি আমার কোনো আবেগ, অনুভূতি, কষ্ট নেই? ভালোবাসা কাকে বলে আমি কি সেটাও এখনো বুঝি না? স্বামী মানে কি বুঝি না? বলুন, বুঝিনা? উত্তর দেন, মাস্টার মশাই। এক্ষুনি দিবেন।”
তারিন উচ্চ স্বরে কথা বলায় এখন নিঃশ্বাস টেনে উঠাতে পারছে না। বড় বড় নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল। নিঃশ্বাস নিতে না পেরে ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলো। তামজিদের চোখেও জল জমেছে। নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে অসহায় ব্যক্তি মনে হচ্ছে। কিভাবে বুঝাবে তারিনকে? কোনো শব্দ, ভাষা, বাক্য মাথায় আসছে না। সব কিছু অসহ্য লাগছে। মন, মস্তিষ্কের লড়াইয়ে তামজিদ আজ হেরে যাচ্ছে বারবার। দুজনের মাঝেই নিরবতা। কোনো উত্তর নেই ওর কাছে। এর মাঝেই কেবিনে প্রবেশ করল নার্স। তারিনকে কান্না করতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“এ কি আপনি কাঁদছেন কেনো? এভাবে কান্না করলে আপনার ক্ষতি হবে। টেস্ট রিপোর্টে আপনার শ্বাসকষ্ট ধরা পড়েছে।”
কথাটা শুনে তামজিদ চোখ তুলে তাকাল। চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করল,
“কি বললেন?”
নার্স শান্ত স্বরে বলল,
“জ্বী! এই যে রিপোর্টগুলো দেখুন। আমি আপনাকে ডাকতেই এসেছিলাম। আপনাকে ডাক্তার তার চেম্বারে ডেকেছেন। আসুন।”
তামজিদ রিপোর্ট গুলো নিয়ে এক নজর চোখ বুলিয়ে নিলো। নার্সের হাতে রিপোর্ট গুলো দিয়ে শান্ত বাক্যে বলল,
“আপনি যান। আমি আসছি।”
তারপর তারিনের পাশে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলো। অনুরোধ বাক্যে বলল,
“প্লিজ, কান্না করো না। কান্নাটা থামাও। আমি কথা দিচ্ছি, আজকের পর তোমার চোখের পানি চোখ গড়িয়ে গালে পড়তে দিবো না, ইন শা আল্লাহ। শেষ বারের মতো একবার আমাকে বিশ্বাস করো। যাকে ভালোবেসেছিলাম তাকে ধরে রাখতে পারিনি। এখন যে আছে তাকে হারাতে দিবো না।”
তারিনের মন শান্ত হলো। কিন্তু উপরে প্রকাশ করলো না। তামজিদ চলে গেলো ডাক্তারের কেবিনের উদ্দেশ্য। তামজিদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে তারিন একা একা বলে উঠল,
“আপনাকে আমার কারোর পাশে সহ্য হয় না, মাস্টার মশাই। আমার কষ্ট লাগে৷ কেনো লাগে? আমার তো কষ্ট পাওয়ার কথা না৷ তবুও কেনো কষ্ট লাগে, মাস্টার মশাই?”
তারিন নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।



সন্ধ্যার নামার কিছুক্ষণ আগে তারিনকে হসপিটালের থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। তামজিদ তারিনকে খুব যত্ন করে বাসায় নিয়ে এসেছে৷ বর্ষা বেগম দরজা খুলে তারিনের অসুস্থ চেহারাপানে তাকিয়ে জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে। কান্নারত স্বরে বলে উঠলেন,
“তুই হঠাৎ করে এমন অসুস্থ হয়ে গেলি কি করে রে, মা। তোর কষ্ট হচ্ছে আমাকে একবার ডাকতে পারতি না? আমি কি তোর কেউ না? আমাকে কি বলা যেতো না? আজকে সারাদিনেও কেউ আমাকে হসপিটালে যেতে দিলো না। তোকে একটা বার খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো রে, মা।”
তারিনের অসুস্থ মস্তিষ্ক হঠাৎ করেই সুস্থ বোধ করল। শাশুড়ী যখন মায়ের মতো আগলে রাখে তখন শশুড়বাড়ি টাও বাবার বাড়ির মতো আপন মনে হয়। তামজিদ বলল,
“মা, ওকে ভেতরে যেতে দাও। বসাও নিয়ে৷”
তারিন বাধা দিয়ে বলে উঠল,
“আমি একদম ঠিক আছি, মা। একদম ব্যস্ত হবেন না আমাকে নিয়ে।”
নাহ! বর্ষা বেগম সে কথা কর্নপাত করলেন না। তারিনকে আস্তে আস্তে ধরে রুমে নিয়ে আসলো। খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে বললেন,
“এখানে বসে থাকবি চুপচাপ।”
তারিন মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। অর্থাৎ ‘ঠিক আছে’।
কিছুক্ষণ তারিনের পাশে নিজেও বসে ছিলেন। তারপর মাগরিবের আযান দিতেই সে নিজের রুমে চলে গেলেন নামাজের জন্য। তারিন ও আস্তে আস্তে উঠে ওযু করে এসে নামাজ আদায় করে নিলো। নামাজ থেকে উঠে ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখলো তামজিদ হাত ভর্তি ফলমূল, আর শুকনো খাবার নিয়ে ভেতরে ঢুকছে। তারিনকে দেখেই তামজিদ শুকনো হাসি দিয়ে উঠল। তারিন সেদিকে খেয়াল না করে সোজা রুমে এসে পড়ল। তামজিদ অবাক হলো বটে। তবে চমকায়নি। তারিন বিছানায় বসে বসে ফোন ঘাটছে। ঢাকায় আসার পর তামজিদ তারিনকে একটা নতুন ফোন কিনে দিয়েছে। কাল রেজাল্ট দিবে মাথার মধ্যে সে চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে তামজিদ রুমে ঢুকে প্রশ্ন করল,
“ফোন ঘাটছো কেন? রেস্ট নিতে বলেছি না তোমাকে?”
তারিন সে কথায় পাত্তা দিলো না। এতটা মনোযোগ দিয়ে ফোন দেখছে যেনো রুমে ও ব্যতিত আর কেউ নেই। তারিনের থেকে কোনোরকম উত্তর না পেয়ে তামজিদ পুনরায় বলে উঠল,
“ফোন রাখো। আমার তোমার সাথে কথা আছে।”
তারিন এবারো ও কোনো উত্তর দিলো না। আগের ন্যায় ফোন দেখতে ব্যস্ত। তামজিদ এবার চরম অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো তারিনের দিকে। মেয়েটা কি ও’কে ইগ্নোর করছে? পাত্তা দিচ্ছে না? নাকি রাগ করেছে? অভিমান করেছে বোধহয়। তবুও ব্যাপারটা তামজিদের হজম হলো না। আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। তামজিদ ওয়াশরুমে ঢুকতেই তারিনের ঠোঁটদ্বয়ে হাসি ফুটল। দুষ্টু হাসি যাকে বলে। মনে মনে বলল,
“মাস্টার মশাই, আপনাকে অনেক ছাড় দিয়েছি। আর দিতে পারবো না। এবার থেকে দেখবেন তারিন আপনাকে ঠিক কিভাবে বশ করে?”

#চলবে