আমার নিঠুর মনোহর ২ পর্ব-০১

0
144

#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_এক

মা হবার সুসংবাদ দিতেই আমার স্বামী আমার গালে সজোরে একটা থা’প্পড় বসিয়ে দিলো। আচ্ছা এটা কি ভাগ্য নাকি নিজের দোষের শাস্তি? তারিন ভেবে পাচ্ছে না। দেয়াল ঘেষে দুই হাটু ভেঙে মেঝেতে বসে আছে তারিন। চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। গালের এক পাশটা লাল হয়ে আছে ইতোমধ্যেই। ঠোঁট দুটো কাঁপছে বেগতিক হারে। শরীরও কাঁপছে খানিকটা। মাথা ঝিম ধরে আছে। শখের সাজটা এখন চোখের পানিতে সারামুখে লেপ্টে একাকার অবস্থা। চোখের পলকে এত এত স্বপ্ন, খুশি সব ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। এইতো মিনিট কয়েক আগের কথা তারিনের মনে কত স্বপ্ন ছিলো৷ কত খুশি ছিলো। আর এখন? সবটা অতীত। সবটা বিষাক্ত। তারিন নিঃশব্দে কাঁদছে। এর মধ্যেই রুমে জাহেলা দৌড়ে আসলো। এসেই সারারুমে তারিনকে দেখতে না পেরে চিৎকার করে বলা শুরু করলো,
“আফামনি, তুমি কই? ভাইজানের চিৎকার শুনলাম, তারপর দেখলাম ভাইজান রাইগা মাইগা কই জানি গেলো গা। তুমি ঠিক আছো নি? তোমারে দেহি রুমে দেহি না? তোমাগো কি হইছে? সব ঠিক আছে নি?”
তারিন শুনলো ঠিকই। কিন্তু উত্তর দিতে পারলো না।এবার শব্দ করে কান্না বেরিয়ে আসলো। তারিনের কান্নার শব্দ কানে আসতেই জাহেলা বেলকনিতে দৌড়ে গিয়ে তারিনকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে আঁতকে উঠলো। জাহেলা জোরে চিৎকার করে আতঙ্কিত গলায় বলল,
“আয় হায়! তোমার এমুন পাগলের মতোন অবস্থা ক্যান, আফামনি? কি হইছে তোমার?”
বলেই তারিনের পাশে বসলো। তারিনের থুতনি ধরে মাথা দাঁড় করিয়ে চোখের পানিগুলো দুই হাতে মুছে দিতে দিতে হতভম্ব হয়ে বলে উঠল,
“কান্দে না, বইন। তোমার কি হইছে কও? ভাইজান, কি রাগ হইছে তোমার লগে? থাক, কাইন্দো না। মাথা গরম কইরা দুই এক কতা কইছে। মাথা ঠান্ডা হইলে সব ঠিক হইয়া যাইবো।”
তারিন এবার জাহেলাকে জড়িয়ে ধরলো। হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো সশব্দে। জাহেলা ঘাবড়ে গেলো। নিস্তব্ধ রইলো, কিছুক্ষণ, সময়, মিনিট। হুঁশ ফিরতেই ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“ও তারু, বইন? তোমার কি হইছে? এমুন করতাছো কেন? তোমার কি শরীলডা খারাপ লাগে? আমারে কও? কি হইছে? ক্যান কান্দো এমনে?”
তারিন কান্নারত স্বরে থেমে থেমে কোনোরকমে বলে উঠল,
“আমি মা হতে যাচ্ছি, আপা।”
জাহেলার কানে বাক্যটা পৌঁছাতেই জাহেলা খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়লো। চোখে, মুখে আনন্দ ঝলমলে হয়ে উঠলো। চিৎকার করে বলে উঠল,
“আল্লাহ গো! কও কি? সত্যি?”
জাহেলার খুশি দেখে তারিনের ভেতরটা এক দফা ভেঙে চুড়ে গেলো। তবুও মুখে প্রকাশ করলো না। কোনোরকমে হাসি টেনে বলল,
“হ্যাঁ, সত্যি।”
জাহেলা তারিনকে সাবধানে উঠে দাঁড় করালো। নিজেও উঠে দাঁড়ালো। খুশিতে দুই হাত পা নাচিয়ে নাচা শুরু করলো। তারিনকে এক দফা জড়িয়ে ধরে বলল,
“খালুজান জানে?”
তারিন দুইদিকে মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ ‘না’। জাহেলা দৌড়ে আগে সেদিকে গেলো। এক্ষুনি সবাইকে খুশির খবরটা দিতে হবে। দৌড়ে যেতে যেতে বলল,
“ভাইজান রে, ফোন দিয়া এক্ষুনি মিষ্টি লইয়ে আইতে কমু।”
তারিন বারণ করতে পারলো না। জাহেলা চলে যেতেই একবার গুমড়ে কেঁদে উঠল। কি বলবে সবাইকে? কি জবাব দিবে? তামজিদের এত এত স্বপ্ন, আশা সব শেষ করে দিয়েছে? তামজিদের সেক্রিফাইস সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে? এত বড় বোকামি কি করে করলো ভাবতে পারছে না। নিজের উপরেই রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। ভেতরটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে অপরাধ বোধে। সব কিছু ঠিক হয়েও কেনো এভাবে এলোমেলো হয়ে গেলো। তাহলে কি নিজের ভুলে নিজের স্বামীকে হারাবে? তামজিদ কি দূরে সরে যাবে? কথাগুলো ভেবেই তারিন আঁতকে উঠলো। পেটের উপর আলতো করে হাত রাখলো। হুট করেই সব খারাপ লাগা কেনো যেনো দূর হয়ে গেলো। মনে প্রশান্তির হাওয়া বইতে লাগলো। যেই বুকে এতক্ষণ ঝড় বইছিলো, সেই বুকেই আনন্দের ঢৈউ বইছে। তারিন এবার আরো ফুঁপিয়ে কান্না করে উঠলো। পেটে হাত বুলিয়ে নিজে নিজেই বলতে লাগলো,
“আমার অংশ। তুই আমার অংশ। আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন। আমাকে ‘মা’ হওয়ার মতো এত আকাশসম সুখ দিয়েছিস। তোর বাবা খুব রাগ করেছিস জানিস? কি করে বুঝাবো বল তো? তোর মা যে খুব অসহায় হয়ে গেছে রে? কি করবো বুঝতে পারছে না? তবে তুই কিন্তু একদম মন খারাপ করবিনা, বুঝলি? তোর মা সব সামলে নিবে। তোকে একদম কষ্ট পেতে দিবেনা। তোর বাবাকেও ম্যানেজ করে নিবে। তুই তো আমার জীবনের সবথেকে বড় স্বপ্ন। তোকে পাওয়ার জন্য আমি সবকিছু সেক্রিফাইস করতে পারবো। সব স্বপ্ন ভেঙে দিতে পারবো রে মা। সব পারবো।”
বলেই পুনরায় ডুকরে কেঁদে উঠলো। নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে অসহায় মা মনে হচ্ছে।


দিনের আলো কাটিয়ে অন্ধকার এসে ভীড় করেছে চারদিকে। তানহাও ইতোমধ্যে এসে পড়েছে খুশির সংবাদ পেয়েই। বাড়ির সবাই মিলে হৈচৈ মেতেছে। এত খুশির মাঝেও তারিনের মনে বিষন্নতায় ঘিরে ধরেছে। বুক ফেটে যাচ্ছে। চোখের অবাধ্য জল বার বার বাঁধ ভেঙে গাল বেয়ে পড়ছে। তারিন সযত্মে, সাবধানে জল মুছে নিয়ে সবার সাথে হাসছে। তামজিদ এখনো বাড়িতে ফিরেনি। ফোন করেছে বেশ অনেক বার কিন্তু ধরেনি। তানহার ফোন অবশ্য একবার ধরে বলেছিলো, ‘ও ব্যস্ত’। তারপর থেকে কোনো পাত্তা নেই। তারিনের ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। আজ বাদে কাল পরিক্ষা। কিন্তু কোনো ভাবেই পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না। কি হবে? কি করে সব ঠিক হবে? এই চিন্তায় চিন্তায় ভেঙে পড়েছে মেয়েটা খুব। সন্ধ্যায় বাড়ির সবাই ড্রয়িং রুমে বসেছে গোল করে। তানহা চা বানাতে রান্নাঘরে গিয়েছে। তারিন মাইশাকে কোলে তুলে আছে। মাইশা তারিনকে কাঁদতে দেখে আধো আধো স্বরে বলে উঠল,
“মামনি, কাঁদছো কেলো তুমি?”
বলেই তারিনের চোখের পানিটুকু মুছিয়ে দিতে দিতে পুনরায় বলল,
“কাঁদে না। জানো, মাম্মা বলেছে তুমি আমাল জন্য একটা পুতুল কিনে আনবে। ভাই পুতুল। আনবে মামনি?”
তারিনের কান্নাগুলো বাঁধ ভেঙে আসলো। মাইশাকে বুকে জড়িয়ে কান্না করে উঠলো। কান্নারত স্বরেই বললো,
“আনবো, মা। তোর জন্য ভাই পুতুলেই কিনে আনবো।”
মাইশা কি বুঝলো কে জানে? খুশিতে হাত তালি দিতে দিতে খিল খিল করে হাসতে লাগলো। আমজাদ সাহেব ও বেশ খুশি। তার ঘরে নতুন মেহমান আসছে বলে কথা। খবরটা পেয়েই মিষ্টি কিনে নিয়ে এসেছে। তানহা চা নিয়ে আসতে আসতে মাইশার উদ্দেশ্য মজার ছলে হেসে বলে উঠলো,
“এই যে, মামনি একটা ভাই পুতুল কিনে আনলে তোমাকে আর আদর করবে না। তখন কি করবে শুনি?”
মাইশা বুঝলো না হয়তো পুরো কথাটার মানে। তবে এইটুকু বুঝলো যে, পুতুল আনলে ওর আদরের ভাগ কমে যাবে। তাই সঙ্গে সঙ্গে তারিনের গলাটা শক্ত করে ধরে ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না করে উঠলো। মাইশাকে এমন করে কাঁদতে দেখে ওরা সবাই হেসে উঠলো। তারিন মাইশাকে শান্ত করার জন্য আদুরে স্বরে বলল,
“কে বলেছে আমার মাকে আমি আদর করবো না? একদম পঁচা কথা বলেছে মাম্মা। মাম্মাকে একদম বকে দিবো। আমি তো আমার মাকে সারাজীবন আদর করবো। আমার মায়ের আদরের ভাগ কেউ পাবেনা কাঁদে না, সোনা।”
সবাই মিলে এভাবেই আড্ডায় মেতে উঠলো কিছুক্ষণ। তারিন নিজেকে শান্ত করে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলো। পরিক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতেই হবে। একদম হার মানলে চলবে না।



ঘড়ির কাটায় ১১টা বেজে ৫মিনিট। তারিন মন দিয়ে পড়ছে। মাথা থেকে সমস্ত চিন্তা দূর করে দিয়ে পড়ছে। তামজিদ এখনো ফিরেনি। সেই নিয়ে চিন্তা হচ্ছে খানিকটা তবে মনে মনে সাহস সঞ্চয় করছে। তামজিদ আসলে ওকে বুঝাতে হবে। যে করেই হোক এই অভিমানের পাঁচিল ভাঙতে হবে। এর মধ্যেই তামজিদ রুমে ঢুকলো। তারিনকে পড়ার টেবিলে মন দিয়ে পড়তে দেখে কিছুটা অবাক হলো। দুপুরে ওমন কান্ডের পর মেয়েটা এখনো এত শান্ত আছে কি করে? তারিন তামজিদের উপস্থিতি টের পেয়ে উঠে দাঁড়ালো। হাসিমুখেই জিজ্ঞেস করলো,
“খাবার এখানে নিয়ে আসবো?”
তামজিদ থমথমে স্বরে জবাব দিলো,
“খাবো না। খেয়ে এসেছি।”
তারিন আর কিছু বললো না। তামজিদ তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যেতেই তারিন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বিছানা গুছিয়ে দিয়ে এসে আবার পড়ার টেবিলে বসলো। তামজিদ ফ্রেশ হয়ে এসে চুপচাপ সুয়ে পড়লো। কোনোরকম শব্দ করলো না। তামজিদের এমন এড়িয়ে যাওয়া তারিনকে ভেতর থেকে বারবার ভেঙে চূড়ে নিঃশ্ব করে দিচ্ছে। প্রায় ঘন্টা খানেক পড়াশোনা করে তারিন গিয়ে তামজিদের পাশে শুয়ে পড়লো। তামজিদ ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। তারিনের কিছুতেই ঘুম আসছে না। তামজিদের বুকে ঘুমাতে ঘুমাতে অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রায় অনেক ক্ষণ এপাশ ওপাশ করতে করতে মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে ওর। উঠে পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলো। অসহায় চোখে তামজিদের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আলতো হাতে তামজিদের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগলো,
“আমার উপর খুব রাগ করেছেন তাইনা, মাস্টার মশাই? করাটাই স্বাভাবিক। আমি খুব বেশি অন্যায় করে ফেলেছি আপনাকে না জানিয়ে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে। আমাকে ক্ষমা করে দেন না একবার। বাবা হওয়ার সংবাদে যে আপনিও খুশি হয়েছেন সেটা আমি জানি। কিন্তু আমার কথা চিন্তা করে রেগে আছেন। জানি এই রাগটা খনিকের কিন্তু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, মাস্টার মশাই। অনেক কষ্ট হচ্ছে।”
বলেই কেঁদে ফেললো। ঠোঁট চেপে কান্না আটকে পুনরায় বলা শুরু করলো,
“আমার আর আপনার স্বপ্ন আমি বেঁচে থাকলে একদিন ঠিক পূরণ করবো মাস্টার মশাই। আদর্শ ডাক্তার হয়ে আপনার সামনে দাঁড়াবো। সেদিন আপনি নিজেই বলবেন আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো ভুল করিনি। কিছু স্বপ্ন দেরিতে পূরণ হোক ক্ষতি কি? আপনি আমার স্বপ্নের পেছনে ছুটতে গিয়ে ভুলে গেছেন, আল্লাহ সবসময় সবাইকে সব খুশি দেয়না। আমাদের এত বড় একটা খুশি উপহার দিয়েছে। অভিমানের দেয়ালে সে খুশি হারিয়ে ফেলবেন না, মাস্টার মশাই৷ কে বলতে পারে সময় কখন কার থেকে কি কেড়ে নেয়? হয়তো আমি হারিয়ে গিয়ে আপনাকে আকাশসমান খুশি উপহার দিয়ে যাবো।”

#চলবে…….