#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_তিন
“কী আশ্চর্য ব্যাপার! হল সুপারের সাথে ধাক্কা খেয়ে তুই তার প্রেমে পড়ে গেলি?”
তারিনের অবাক স্বরে কথা শুনে নিহা লজ্জা পেলো। লজ্জা লজ্জা মুখ নিয়ে হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“শুধু প্রেম না রে, তারু। আমি নেওয়াজের প্রেমে হাবুডুবু খাইতাছি।”
নিহার মুখে হল সুপারের নাম শুনে তারিনের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে তারিন নিহার মুখ চেপে ধরলো। ফিসফিসিয়ে বললো,
“গাঁধা, এটা পরিক্ষার হল। আর আজ শেষ পরিক্ষা। যদি কোনো গন্ডোগোল করেছিস তাহলে তোকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।”
নিহা ভুলেই গিয়েছিলো ও পরিক্ষার হলে আছে। তারিনের কথা শুনে থতমত খেয়ে উঠলো। তারিনের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে মেঁকি হেসে বললো,
“এভাবে হুমকি দেওয়ার কি আছে, গর্দভ। ভয় পাইছি তো।”
তারিন সে কথায় পাত্তা দিলো না। নিজ মনে বলে উঠল,
“আজ আমাদের শেষ পরিক্ষা। কিভাবে যেনো সময় চলে গেলো তাইনা রে, নিহু?”
নিহাও আপন মনে জবাব দিলো,
“হ্যাঁ, একদম। সময় কিভাবে বয়ে যায় কেউ ধরতেই পারেনা। আমি তোরে খুব মিস করুম রে, তারু।”
বলতেই নিহার গলা ধরে আসলো। আজকের পর আর ওদের নিয়মিত দেখা হবে। দুজনের পথ চলা আলাদা হয়ে যাবে। তারিনের সাথে হাসি, আড্ডায় মেতে থাকা কলেজ জীবনের মুহূর্তগুলো নিহার জীবনে সবথেকে সুন্দর মুহূর্ত। নিজের ভেতরের কষ্টগুলো তারিনের সাথে কখনো শেয়ার করা হয়নি। আর হয়তো হবে না। তবে নিহা এভাবেই হাসি খুশি থাকবে। ভেতরের যন্ত্রণা বাইরে প্রকাশ করবে না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিহার চোখে জল জমেছে তা তারিন খেয়াল করতেই নিহাকে জড়িয়ে ধরলো। বলতে লাগলো,
“আমার জীবনে বন্ধুর সংখ্যা নেই বললেই চলে। গ্রামে থাকাকালীন যে কয়টা বান্ধবী ছিলো সময়ের অতলে ওরা হারিয়ে গিয়েছে। এখন দেখলেও কেউ চিনে না। কিন্তু তুই আমার জীবনে আসা প্রথম কেউ যে আমাকে এতটা ভালোবাসা দিয়েছে, আগলে রেখেছে, শাসন করেছে। তোকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না। দেখা না হলে বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যাবে এটা ভাবিস না। আমার হাত থেকে তুই এ জীবনে আর মুক্তি পাবিনা। বুঝলি?”
বলেই নিহাকে ছাড়লো। নিহা মুখে হাসি টেনে বললো,
“হ, আফা বুঝছি। তুই কি ভাবছোস, আমি তোরে এত সহজে ভুইলা যামু? তোরে ছাইড়া দিমু? কাবি নেহি। আরে আমি তো হবু খালামনি হইতাছি। আমার কত দায়িত্ব জানোস না?”
তারিন ঠোঁট টিপে হেসে বললো,
“হ্যাঁ, সেটাই। কত দায়িত্ব বল তো? আমার বাচ্চার প্রস্রাব, পায়খানা__পরিষ্কার করার জন্য হলে তোকে চাই, দোস্ত।”
নিহা কথাটা শুনে সাথে সাথে নাক ছিটকে বলে উঠলো,
“হো, আল্লায় তো আমারে দুনিয়ায় পাডাইছে তোর পোলাপাইনের হাগা মুতা পরিষ্কার করার লাইগ্যা।”
তারিন হাসলো। বললো,
“আমার বাচ্চার খালামনি বলে কথা, এইটুকু দায়িত্ব পালন করতে পারবি না? ছিহ! কেমন খালামনি হইলি তুই?”
নিহা গাল ফুলিয়ে বলে উঠল,
“সর তো যা।”
বলেই বাইরে হাঁটা শুরু করলো। তারিন নিহার যাওয়ার পানে তাকিয়ে হেসে দিলো। এই মেয়েটাকে যে ও বড্ড মিস করবে। অনেক বেশি। ভেবেই মন খারাপ হয়ে গেলো তারিনের।
–
–
–
পরিক্ষা দিয়ে বাসায় আসার সময় তামজিদ তারিনকে নিয়ে সোজা হসপিটালে যায়৷ সেখানে গিয়ে গাইনি ডাক্তার দেখিয়ে, কিছু টেস্ট করিয়ে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্য রওনা হলো। দুজনেই এসে গাড়িতে বসতেই তারিন বায়না ধরে বলে উঠল,
“ও মাস্টার মশাই, ফুচকা, ঝালমুড়ি, ভেলপুরি খাবো।”
তামজিদ তারিনের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। রাগী স্বরেই বললো,
“থা’প্পড় চিনো?”
“হ চিনি।”
“খাইছো কখনো?”
“হ খাইছি তো, আমার বুইড়া জামাইর হাতে। বেডার হাত বড্ড শক্ত গালডায় দুইদিন ব্যাথা ছিলো।”
তারিনের কথা শুনে তামজিদের মুখটা চুপসে গেলো। মনটা কেমন নিমিশেই খারাপ হয়ে গেলো। রাগের বশে মেয়েটার গায়ে হাত তোলা একদম উচিত হয়নি। তারিনকে থা’প্পড় মে’রে সবথেকে বেশি কষ্ট ও নিজেই পেয়েছে। হঠাৎ রাগটা কন্ট্রোল করতে পারেনি, বলেই হাত উঠে গেছিলো। এখন ভেতরে ভেতরে নিজেই অনুতাপের আগুনে পুড়ছে। তামজিদ অনুতাপের স্বরে বললো,
“আমার ভুল হয়ে গেছে, তারিন। শেষ বারের মতো আমাকে মাফ করে দাও। আর কখনো তোমার গায়ে হাত তোলার মতো অপরাধ করবো না।”
তারিন হাসলো। শান্ত স্বরে বললো,
“যে পুরুষ রাগের সময় নিজের স্ত্রীকে সম্মান করতে পারে সেই প্রকৃত পুরুষ। রাগের সময় মানুষ হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে। তখন কি থেকে কি করে ফেলবে এটা সম্পূর্ণ মস্তিষ্কের উপর নির্ভর করে। আপনি আমাকে থা’প্পড় মে’রে ভুল করেছেন ঠিকই৷ কিন্তু আমার তাতে আপনার উপর একটুও রাগ হয়নি৷ কারণ আমি জানি আপনি নিজের জন্য স্বার্থের জন্য আমার গায়ে হাত তুলেননি। আমার স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ এখন শুরু হতে যাচ্ছে। সেই ধাপে এসে আমি পিছিয়ে যাবো এটা আপনি মানতে পারেননি। তবে নেক্সট টাইম এই ভুল করবেন না। তাহলে কিন্তু ক্ষমা পাবেন না।”
তামজিদ অসহায় চোখে তারিনের দিকে তাকালো। তারিনের দিকে একটু ঝুঁকে হাত রাখলো দুই গালে। অসহায় বাক্যে উচ্চারণ করলো,
“আমার ভুল হলে সংশোধন করে দিও। কিন্তু ছেড়ে যেও না।”
তামজিদের উচ্চারিত বাক্যটা যেনো বুকে বিঁধলো তারিনের। ছেলেটার চোখে কী অসম্ভব মায়া, ভালোবাসা, অসহায়ত্ব! তারিন উত্তর দিতে পারলো না। আলতো করে জড়িয়ে ধরলো তামজিদকে। বুকে মাথা রেখে গম্ভীর স্বরে বললো,
“আমি কিন্তু আপনাকে এখনো মাফ করিনি।”
কথাটা শুনে তামজিদ সরে আসলো। অসহায়ত্বের ছোঁয়া যেনো মুখপানে দ্বিগুণ হয়ে ফুটে উঠলো। বললো,
“সত্যি? মাফ করো নি?”
তারিন গম্ভীর হয়ে দুইদিকে মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ ‘না’। তামজিদের চুপসানো মুখটা এবার আরো চুপসে গেলো। অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলো,
“তুমি যা বলবে, যেভাবে বলবে আমি সেভাবেই ক্ষমা চাইবো। প্লিজ শেষ বারের অন্তত আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর কোনোদিন কা-পুরুষের মতো তোমার গায়ে হাত তুলবো না।”
তামজিদের মুখের প্রতিক্রিয়া দেখে তারিন হেসে দিলো। হেসে বললো,
“মাফ করতে পারি একটা শর্ত!”
“কি শর্ত?”
তারিন ঠোঁট চেপে হেসে বললো,
“আমাকে ফুচকা,ঝালমুড়ি, ভেলপুরি এনে খাওয়াতে হবে। আর ‘কানে’ ধরে স্যরি বলতে হবে।”
তামজিদ বুঝলো এই মেয়েকে ওর দূর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে। তবুও কিছু বললো না। তারিনকে একটু ভড়কে দেওয়ার জন্য কানে ধরে মিষ্টি করে হেসে বলা শুরু করলো,
“স্যরি, বউ। আমাকে মাফ করে দাও। আর কোনোদিন তোমার গায়ে তুলবো না। মানে মা’রার জন্য হাত তুলবো না। যতবার গায়ে হাত দিবো ততবার আদর করার জন্য দিবো। বুঝলে? তোমার গালে, ঠোঁটে, নাকে, মুখে আর বুকের ওই…।”
তামজিদ সম্পূর্ণ কথাটা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই তারিন তামজিদের মুখ চে’পে ধরলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,
“চুপ। একদম চুপ। আর কিছু না। অনেক হয়েছে। যান এবার গিয়ে খাবার নিয়ে আসুন।”
বলেই হাঁফ ছাড়লো। এই ছেলেটার মুখ এমন বেফাঁস কেন? উফফ! তামজিদ তারিনের মুখ দেখে শব্দ করে হেসে উঠলো। অতঃপর হুট করেই শব্দ করে জোরেশোরে একটা চুমু খেলো তারিনের ঠোঁটদ্বয়ে। তারপর চলে গেলো বাইরে খাবার আনতে৷
–
–
–
বিকেলে তামজিদ আর তারিন ছাঁদের এক কোনে বসে বসে দোলনা খাচ্ছিলো। ওদের সামনেই মাইশা নিজের মতো দৌড়ে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক। তামজিদের কাঁধে মাথা রেখে তারিন নিশ্চুপে চোখ বন্ধ করে সময়টা উপভোগ করছে৷ এর মধ্যেই হঠাৎ “ভাউউউ” বলেই চিৎকারের শব্দ কানে আসতেই তারিন ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। আর মাইশা ভয় পেয়ে কান্না করতে করতে দৌড়ে এসে তামজিদের কোলে লুকালো। তামজিদ মাইশাকে কোলে তুলে নিয়ে পেছন ঘুরে দেখলো তামজিদের ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই একসাথে দাঁত কেলিয়ে আছে। তারিন বুকে থুথু দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বলে উঠলো,
“এক্ষুনি হার্ট অ্যাটাক করিয়ে দিচ্ছিলেন। মাগো!”
তামজিদ মাইশাকে শান্ত করে রাগী স্বরে বলে উঠলো,
“এ জীবনে তোদের একটাও আক্কেল হবে না। আমার বাড়িতে কেনো এসেছিস তোরা? উইদ আউট ইনভাইটেশনে কারোর বাইরে আসতে নেই। জানিস না?”
তামজিদের কথা শেষ হতেই ওরা সবাই দাঁত কেলিয়ে বললো,
“না, জানিনা।”
তারিন এবার হেসে ফেললো। জুঁই আর খুশবা এগিয়ে আসলো তারিনের দিকে। এসেই তারিনকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,
“কংগ্রেস, বোনু। ফাইনালি, আমরা খালামনি হতে যাচ্ছি।”
খুশবা বলল,
“আমার তো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে।”
রিহাব তা শুনে বলে উঠল,
“আরে নাচতে ইচ্ছে হচ্ছে বললে কি হবে? নাচতে হবে তো। মিউজিক, প্লিজ।”
বলতে না বলতেই রাফি, রিহাব, রাহিম, মুজাহিদ, অয়ন মিলে একসাথে বেসুরে গান গাইতে গাইতে নাচা শুরু করলো।
“ঝং পড়া যৌবনে রং লেগেছে কেমনে গো, একটু বলো না?
ফুল গাছে পানি দিলে, ফল তো হইবোই গো, বন্ধু জানো না?
তোমার কুন কুন জায়গায় ব্যাথা গো, বন্ধু বলো না?
ও মামা হমু আমরা গো, মিষ্টি খাওয়াও না।
লা লা লা লা লা লা, মিষ্টি খাওয়াও না৷
ও মামা হমু আমরা গো, ও মামা হমু আমরা গো,
তোমার কেন জ্বলে গো, বন্ধু বলো না।”
তারিন, জুঁই, মাইশা হাসতে হাসতে শেষ। তামজিদ রাগে ফোঁসফোঁস করছে। প্রথম লাইনটা কোন ইঙ্গিতে ছিলো তা বেশ বুঝেছে। তারিন লজ্জা পাচ্ছে ঠিকি কিন্তু ওদের নাচ আর গানের বাহার দেখে না হেসে পারছে না। মাইশাও হাসছে খিলখিল করে। এরা যে আজ তামজিদের গুষ্টি উদ্ধার করবে তা বেশ বুঝতে পারছে তামজিদ। মনে মনে বলছে,
“আল্লাহ, এত গুলা পাগলের মাঝে আমারে কেন ভালো মানুষ বানাইলা?”
#চলবে