আমার নিঠুর মনোহর ২ পর্ব-০৫

0
110

#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_পাঁচ

“এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নেওয়ার কি দরকার ছিলো?”
তামজিদের বুকে মাথা রেখে চুপটি করে শুয়ে ছিলো তারিন। হঠাৎ তামজিদ এ কথা বলায় তারিন হকচকিয়ে যায়। তৎক্ষনাৎ সরে আসে তামজিদের থেকে। লাফিয়ে বসে পড়লো। ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠলো,
“আপনি খুশি না?”
তামজিদ হাসলো। আবার তারিনকে হেচকা টানে বুকে নিয়ে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। দুষ্টুমি মাখা কণ্ঠে বললো,
“নাহ একদম খুশি না। কারণ, আমার আদরে সে ভাগ বসাতে চলে আসবে। এইযে বুকে সেই থাকবে। তাহলে আমার বউকে বুকে নিবো কিভাবে?”
তামজিদের এমন কথায় হেসে ফেললো তারিন। তামজিদের বুকে কিল ঘুষি মে’রে বললো,
“আপনি একটা যা তা।”
অতঃপর দুজনেই হেসে দিলো। তামজিদ আরো কয়েকদফা চুমু খেয়ে বলা শুরু করলো,
“প্রথম যখন শুনেছি এই খবরটা, তখন আমার মন চাচ্ছিলো তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিতে৷ কিন্তু, তোমার স্বপ্ন! সেই স্বপ্নের কথা মনে করে ভেঙে গেছিলাম। ভেবেছিলাম, আমার জন্য এসব হলো। আমার জন্য তোমার স্বপ্নটা ভেঙে গেলো। বছর কয়েক নষ্ট হলো। নিজেকে সামলাতে পারিনি তখন। খুব বেশি কষ্ট হচ্ছিলো। বার বার তোমার কথাগুলো মনে হচ্ছিলোম তবে ভেতরে ভেতরে বাবা হওয়ার এক অসীম সুখ অনুভব করছিলাম।”
তারিন মনোযোগ দিয়ে কথা গুলো শুনছিলো। তামজিদ থামতেই তারিন বললো,
“আমার মাস্টার মশাই, আমার কাছে এই মুহূর্তে আপনার থেকে দামী কিছু নেই। কেউ নেই। আপনার চাওয়া পাওয়া, সুখ, দুঃখ সব আমার কাছে অনেক দামী। আর কেউ না জানুক। আমি তো জানি আমার মাস্টার মশাইয়ের বাবা হওয়ার কত শখ।”
তামজিদ হেসে ফেললো। তারিনের ঠোঁট ছোট্ট করে চুমু বসিয়ে দিয়ে বললো,
“এই ছোট্ট মেয়েটার মাথায় এত বুদ্ধি কোথার থেকে আসে? এই মেয়েটার পাকা পাকা কথা শুনেই এই মেয়েটার উপর আমি ভীষণ ভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছি। আমার অতীত থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে ভালোবাসতে শিখেছি। এই মেয়েটা আমার সুখ। এই মেয়েটার জন্যই তো আমি এত বড় একটা সুখের খবর পেয়েছি। আমি বাবা হবো। একটা প্রাণ আসবে। আমার দায়িত্ব বাড়বে৷ কত কাজ বলো তো আমার। এই খুশি আমি উপলব্ধি করতে পারতাম না, যদি তুমি পাকনামি না করতে। এই প্রথম তোমার পাকামোর জন্য তোমাকে একটা বড় করে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে৷ আর ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখতে নেই।”
বলেই তামজিদ তারিনের ঠোঁট জোড়া নিজের করে নিলো।



মাঝে কেটে গেছে প্রায় ৫ মাস। তারিন এতমাস একা হাতেই সংসার সামলালেও এখন আর পেরে উঠে না। তানহাও নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে বলে এ বাসায় থাকতে পারেনা। ছুটির দিনগুলিতে এসে থাকে। তামজিদ সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকায় চাইলেও তারিনের সঙ্গ দিতে পারেনা। এত কিছুতে বিন্দু মাত্র আক্ষেপ নেই তারিনের। নিজের মতো করে আস্তেধীরে সবটা মানিয়ে চলে। তামজিদ আক্ষেপ করে মন খারাপ করলে বরং ওকে সুন্দর করে বলে,
“এই সংসার আমার। বাবা আমার। সংসারের দায়িত্ব আমার। তাহলে আমি সামলাবো না তো কে সামলাবে? আপা কয়দিন নিজের সংসার ছেড়ে আমার সংসারে এসে খাটবে? তা ছাড়া এখনো আমার কোনো সমস্যা হয়না। এমন কত মেয়ে আছে যাদের প্রেগ্ন্যাসির পুরোটা সময় সংসার সামলাতে হয়। সব কাজ করতে। তাই বলে কি তারা সুস্থ সন্তান জন্ম দেয়নি? আমি যদি নিজের শরীর বাঁচিয়ে, সন্তানকে সুস্থ রেখে সব সামলাতে পারি এতে আপনার সমস্যা কোথায়? আর দুই একটা মাস যাক। মাকে নিয়ে আসবো। আর তা ছাড়া জাহেলা আপা তো আছেন। আমার সব কাজে সে সাহায্য করে দেয়। আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে বেশিক্ষণ রান্না করতে না পারলে জাহেলা আপা বাকিটা সামলে নেয়। শুনুন, এত কিছুর মধ্যে সবথেকে বড় হলো আল্লাহর উপর ভরসা করা। তিনিই সুস্থতার মালিক। সব কিছু ঠিক থাকবে? আপনি এত চিন্তা করবেন না? বুঝলেন?”
তারিনের এমন কথায় তামজিদ পুনরায় কিছু বলতে পারে না। বরং এক রাশ মুগ্ধতায় ওর হৃদয় ছেয়ে যায়। সারাদিন সময় দিতে না পারলে বিকেলে এসে থাকে তারিনকে আর কিছু করতে না। বরং ও নিজেই করে। যতটুকু সময় পায় পুরোটা সময় তারিনের পেছনে ব্যয় করে। তারিনকে ভালো, হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করে। সব আবদার মেটারনোর চেষ্টা করে। ব্যস! এইটুকুতেই একজন স্ত্রীর সুখ। একজন স্ত্রীর স্বামীর কাছে এর থেকে বেশি কিছু চাওয়ার নেই। তামজিদের আচরণে তারিনের মনে হয় ও পৃথিবীর সবথেকে সুখী ব্যক্তি। যার কোনো দুঃখ নেই। আছে খালি মন ভর্তি সুখ আর সুখ।



তারিন রান্না বান্না শেষ করে রুমে এসে বিছানায় বসলো। ঘামে সারা শরীর ভিজে আছে। ক্লান্ত লাগছে খুব। মাথা ঘুরছে চরকির মতো। তাই একটা বালিশ নিয়ে খাটের সাথে ঢেলান দিয়ে বসে চোখ বুঝে রইলো। পেট ও আগের থেকে ফুলেছে বেশ। ক্লান্ত হাতটা পেটের উপর রাখতেই শান্তি লাগলো। পেটে হাত বুলাতে বুলাতে নিজে নিজে বলতে লাগলো,
“তুই যে আর কবে আসবি? আমার তো একদম তর সইছে না। আর কত মাস? কতদিন? অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না। তাড়াতাড়ি চলে আয়, মা। তোকে কোলে তুলে আদর করার বড্ড শখ জাগছে। তোর অস্বস্তি না আসলে আমি বুঝতেই পারতাম না, মা হওয়ার আনন্দ কতটা। আমাকে এত আনন্দ দেওয়ার জন্য তোকে তোর মা অনেক ভালোবাসে।”
তারিন নিজে নিজে যখন কথা বলছিলো তখন হঠাৎ ফোন বেজে উঠে। ফোনটা তুলে দেখে তামজিদ ভিডিও কল করেছে। ফোন স্কীনে নিজের প্রিয় ব্যক্তির নাম দেখে মুখে হাসি ফুটলো তারিনের। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তামজিদ শান্ত স্বরে বলল,
“ঠিক আছো, বউ? তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? শরীর ঠিক আছে? ইশ! মুখটা শুকিয়ে গেছে। ক্লান্ত লাগছে তাইনা? আজকে এসেই তোমাকে একবার ডাক্তার দেখিয়ে আনবো। তুমি শুকিয়ে যাচ্ছো দিনদিন।”
তারিন হাসলো। বললো,
“থামুন। একদম চুপ করুন। একসাথে এতগুলো প্রশ্ন করলে আমি কিভাবে উত্তর দিবো? আমি একদম ঠিক আছি, মশাই। আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না। আর কে বললো আমি শুকিয়ে গেছি? দেখুন কি মোটা হয়েছি? ড্রাম হয়ে গেছি একদম। পেট তো বেলুনের মতো করে ফুলছে৷ আর সে বলে শুকিয়ে গেছি। কি কানামার্কা কথা?”
তামজিদ হেসে ফেললো। বললো,
“আমার বাঘিনী।”
পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
“গোসল করতে যাও এখন। তবে সাবধানে। আগে জাহেলা আপা কে ডেকে ওয়াশরুম ভালো করে ধুয়ে দিতে বলো। যেনো সাবান বা পাউডার না থাকে। তারপর ভেতরে ঢুকে আস্তে ধীরে পা ফেলবে। আর ছিটকিনি আটকানো লাগবে না। আপাকে বলবা রুমে থাকতে। বুঝেছো?”
তারিন মুখে মিছিমিছি রাগ ফুটিয়ে কপাল কুঁচকে বললো,
“প্রতিদিন কি এক কথা বলা লাগে? আমি কি ছোট্ট বাচ্চা নাকি?”
“তুমি তো বাচ্চাই।”
“চুপ করুন। দুইদিন পর আমি বাচ্চার মা হয়ে যাবো। আর সে বলে আমি বাচ্চা৷”
“তুমি কিন্তু আগের থেকে বেশি সুন্দর হয়ে যাচ্ছো। ব্যাপার কি? দেখো, এটা কিন্তু একদম ঠিক না। এভাবে সুন্দর হতে থাকলে আমার কি হবে? আমার তো যৌবনের তালা পুরোটাই খুলে যাবে। তারপর সারাদিন কাজকর্ম ফেলে তোমাকে আদর করার জন্য মন চাইবে।”
তারিন হেসে ফেললো। লজ্জাও পেলো। বললো,
“নির্লজ্জের মতো কথাবার্তা বন্ধ করুন। দুইদিন পর বাবা হয়ে যাবেন। তবুও মুখটা সামলাতে পারছেন না।”
তামজিদও হেসে জবাব দিলো,
“তুমি কাছে থাকলে আমি কোনো নিজেকে সামলাতে পারবো না। তোমাকে দেখলেই শুধু আমার চুমু খেতে মন চায়। আমার কি দোষ বলো?”
তারিন রাগ দেখাতে গিয়েও পারলো না। উচ্চস্বরেই হেসে দিলো। তামজিদের সময় শেষ হয়ে যেতেই ফোনটা রেখে দিলো। তামজিদ ফোন রাখতেই তারিন দেখলো নিহা অনেক গুলো কল দিয়েছে। কি হয়েছে সেটা জানার জন্য তারিন নিহাকে কল দিলো। ওপাশ থেকে কল ধরতেই তারিন হাসিখুশি ভাবেই বলে উঠল,
“কিরে, নেওয়াজের ভাইয়ের কোল থেকে বের হয়ে আমাকে মনে পড়লো অবশেষে?”
ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসলো তারিনের কানে। নিহা কান্নারত স্বরে বলে উঠল,
“আমাকে মাফ করে দিস তারু। আমি হয়তো আর বেশিক্ষণ এই পৃথিবীতে নেই। হেরে গেলাম অবশেষে। এডমিশন নামক জীবন যুদ্ধে হেরে গেছি। আর সহ্য করতে পারলাম না। বাবা-মা, ভাই-বোন, পাড়াপ্রতিবেশি, আত্মীয় স্বজন কেউ আর আমাকে বাঁচতে দিলো না। আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে রে, তারু। নিজের সাথে লড়াই করে আর বাঁচতে পারছি না। তোকে অনেক বেশি মিস করবো আমি। একটা আফসোস থেকে যাবে রে, আমি তোর সন্তানকে দেখে যেতে পারলাম না। ওদের আদর করতে পারবো না। নেওয়াজকে বলে দিস, আমাকে মাফ করে দিতে। ওকে একা করে দিতে চাইনি আমি। কিন্ত আর পারছিনা। আমার মা আমাকে আজকেও বলেছে, ‘আমার জন্য নাকি তারা সমাজে মুখ দেখাতে পারছে না। আমাকে জন্ম দেওয়াই নাকি তার ভুল হয়েছে৷ তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারলাম না। তাদের সম্মান নষ্ট হয়েছে আমার জন্য’। তুই বল, তারপর ও কিভাবে বাঁচি? আমার মায়ের জন্ম দেওয়ার ভুল শুধরে দিয়ে গেলাম। ভালো থাকিস। সাবধানে থাকিস, তারু। তোকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি।”

#চলবে